“রেইনকোট আরোহী”
পর্ব- ২
(নূর নাফিসা)
.
.
রুমে ফিরে মুখের মাস্ক, চোখের গ্লাস সরিয়ে নিলো আবরার৷ পরপরই দরজা লাগিয়ে খুলে ফেললো রেইনকোটটাও। এখন নিজেকে খুবই হালকা লাগছে। কিন্তু মনটা বিষণ্ণতায় ছেয়ে আছে। তবুও শারীরিক দিক থেকে ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এলো। টেলিফোন লাইনে কল করতেই নিচ তলা থেকে সার্ভিস বয় উঠে এলো। বেল চাপতেই দরজা খুলে দিলো আবরার। তাযিন ছেলেটাকে তার রুম সার্ভিসের যাবতীয় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ছেলেটার আচার ব্যবহার খুবই সন্তুষ্টিজনক। কর্ম দক্ষতাও বেশ। আবরার দরজা খুলতেই সে মুখে এক টুকরো হাসি ফুটিয়ে বললো,
“জ্বি, স্যার?”
“ভালো আছো তুমি?”
“আলহামদুলিল্লাহ, স্যার।”
“আজ কোথায় ছিলে? সকাল দুপুর তুহিন খাবার নিয়ে এলো যে?”
“স্যার, একটু হসপিটাল গিয়েছিলাম।”
“হসপিটাল কেন হঠাৎ?”
“বোনের বেবি হয়েছে, স্যার। দেখতে গিয়েছিলাম একটু।”
“তবে তো খুশির খবর। ভালো আছে তারা?”
“জ্বি, আলহামদুলিল্লাহ।”
“মিষ্টি কোথায় তবে?”
তাযিন মুখের হাসি আরও প্রশস্ত করে বললো,
“মিষ্টি তো আজই কেনা হয়নি, স্যার। নিয়ে আসবো ইনশাআল্লাহ।”
“ওকে। চায়ের ফ্ল্যাক্সটা নিয়ে যাও। চা শেষ হয়ে গেছে। আর আমার রাতের খাবারটা এখনই পাঠিয়ে দিয়ো।”
“ওকে, স্যার।”
তাযিন রুমে এসে ফ্ল্যাক্স নিয়ে বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার সময় নিজ দায়িত্বে দরজা চাপাতেও ভুলে না সে। আবরার এন্ড্রয়েড ফোন হাতে নিয়ে বারান্দায় চলে এলো। গ্লাস খুলে দিয়ে বারান্দায় রাখা ইজি চেয়ারটায় হেলান দিয়ে বসে ফোনের স্ক্রিনে প্রিয়তমার নামটা ফুটিয়ে তুলে তাতে ডায়াল করলো। একবার রিং হয়ে কেটে যেতেই দ্বিতীয়বার ট্রাই করলো। এবার রিসিভও হয়েছে। কিন্তু বরাবরের মতোই তার রাজকন্যার চেহারাটাই ভেসেছে। অবশ্য অপ্রত্যাশিত নয় বিষয়টা। সে কলও করেছে রাজকন্যার জন্যই। প্রিয়তমার মুখটা যে এখানে ভাসবে না, তা বেশ ভালোই জানা ছিলো। রাজকন্যা, সৈয়দ মারওয়া আফরিন বাবাকে দেখে মুহুর্তেই মুখে হাসির রাজ্য ফুটিয়ে তুলে আনন্দে কেঁপে উঠে বললো,
“আব্বু!”
মেয়ের বিশ্বজয়ী আনন্দের হাসি দেখে বরাবরের মতোই নিজের গম্ভীরমুখে কোমল হাসি ফুটিয়ে আবরার সাড়া দিলো,
“এইতো, আব্বু। কেমন আছো তুমি?”
“আলহামদুলিল্লাহ। আমি অনেক ভালো আছি আব্বু। তুমি কেমন আছো?”
“আব্বুও তোমাকে দেখার পর এখন অনেক ভালো আছে আলহামদুলিল্লাহ। কি করছো তুমি?”
“আমি তো টিভি দেখছিলাম মামনির সাথে। আম্মু ডেকে বললো তুমি কল করেছো, এই রুমে বসে যেন কথা বলি।”
“ওহ্। তোমার আম্মু কোথায়?”
“আম্মুও মামনির সাথে বসে টিভি দেখছে। মামনির মাথায় জোর করে করে তেল দিয়ে দিচ্ছে।”
“আর কে কে আছে সেখানে?”
“আর কেউ নেই। আমি, আম্মু আর মামনিই।”
“দাদুনের সাথে কথা হয় তোমার? দাদুনকে কল দাও?”
“হ্যাঁ। কল দেয় তো আম্মু। আমি প্রতিদিন কথা বলি। বাবাইয়ের সাথেও বলি। ফুপিমণির সাথেও বলি। শুধু তুমিই প্রতিদিন কথা বলো না।”
“স্যরি, বাবা। আব্বুর কাজ থাকে, তাই প্রতিদিন কল দেওয়া হয় না। দাদুনকে কি বলো, শুনি?”
“নানু বাসায় আসতে বলি। ঠিকমতো ওষুধ খেতে বলি। আমার জন্য কান্না করতে নিষেধ করি। তুমি কল দাও না, সেই বিচারও দিয়ে দেই।”
শেষ কথা বলে খিলখিলিয়ে হাসলো মারওয়া। আবরার একগাল হেসে বললো,
“আম্মু কথা বলে দাদুনের সাথে?”
“হ্যাঁ, খুব গল্প করে।”
“দাদুন বলে না আম্মুকে, দাদুন বাসায় যাওয়ার জন্য?”
“বলে তো।”
“আম্মু কি বলে?”
“যাবে না বলে। আবার দাদু ভাইয়াও তো বলে, আসতে হবে না নাকি! আমাকেও যেতে বলে না। শুধু বলে, ঠিক মতো খাবে, পড়বে, আম্মুর কথা শুনবে। আমি বাবাইয়ের সাথে একটু ঘুরতেও যেতে পারি না তাদের সবার জন্য!”
ছোটখাটো নিশ্বাস ফেললো আবরার। তারপর মেয়েকে জিজ্ঞেস করলো,
“আম্মুর কাছে পড়তে বসো ঠিকমতো?”
“আমি তো মামনির কাছে পড়তে বসি।”
“ওকে, একজনের কাছে পড়লেই হয়। মামনি যেভাবে বলে, সেভাবে পড়ে নিয়ো। ঠিক আছে?”
“ওকে, আব্বু। কিন্তু আমি কবে স্কুলে ভর্তি হবো!”
“আগামী বছর ইনশাআল্লাহ।”
“আগামী বছর কেন আসে না তবে? কবে থেকেই শুনছি শুধু আগামী বছর, আগামী বছর! শুনতে শুনতেই বোরিং হয়ে যাচ্ছি!”
“ওরে, বাবারে! এই বয়সেই বোরিং হলে চলবে নাকি! এইতো, আর কয়েক মাস বাকি। এরপর থেকেই তোমার স্কুল শুরু।”
এমনি ফোনের স্ক্রীনে প্রিয়তমা, আফসানা মিমিকে কিঞ্চিৎ দেখা গেলো। কিছু নিতেই এই রুমে আসা হয়েছে তার। আবরার সাথে সাথেই মেয়েকে বললো,
“তোমার আম্মুর কাছে ফোনটা দাও।”
“দিচ্ছি, ওয়ান মিনিট ওয়েট করো। আম্মু, তোমার সাথে কথা বলতে চায় আব্বু।”
হাতে চিরুনি নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে মিমি জবাব দিয়ে গেলো,
“কথা শেষ করে কল কেটে রাখো।”
আবরারের কান পর্যন্ত এসেছে তার জবাব। মারওয়া বাবাকে প্রত্যুত্তর করলো,
“আম্মু চলে গেলো তো। কথা বলবে না তোমার সাথে।”
“ওকে। নানু, মামা, মামনিরা সবাই ভালো আছে?”
“হ্যাঁ, সবাই ভালো আছে।”
“নানুর কাছে নিয়ে দাও ফোনটা।”
“নানু তো বাসায় নেই। বড় মামনিকে নিয়ে হসপিটাল গেছে।”
“হসপিটাল কেন?”
“মামনির পায়ের ছোট আঙুলে চেয়ার পড়ে গেছে। খুব ব্যাথা পাচ্ছে মামনি। তাই ডাক্তার দেখাতে গেছে। আঙুল ভেঙে গেলো নাকি আবার!”
“ওকে, ডিনার করেছো?”
“না তো। ছোট মামনি আর আমি বারবিকিউতে পেট ভরে ফেলেছি একটু আগে। এখন খাবো না আর।”
“আরেকটু পরে ঘুমানোর আগে আবার খেয়ে নিয়ো কিছু। নয়তো রাতে পেট ব্যাথা করবে।”
“আব্বু, তুমি কবে আসবে?”
“আসবো বাবা।”
“কবে? শুধু আসবো আসবো বলো। একদমই আসো না! ভালো লাগে না!”
“খুব শীঘ্রই আসবো ইনশাআল্লাহ। ওকে, রাখি এখন। মামনির কাছে যাও তুমি।”
“ওকে।”
ওদিকে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ভেতরে আসার অনুমতি চাইছে তাযিন। আবরার কল কাটতে কাটতে উঠে রুমে এলো এবং অনুমতি দিলো ভেতরে আসার। ওয়ালেট থেকে দুই হাজার টাকা নিয়ে এগিয়ে এলো তাযিনের কাছে। তাযিন চায়ের ফ্ল্যাক্স ও খাবারের ট্রে ঠিকমতো রেখে জিজ্ঞেস করলো,
“স্যার, আরও কিছু লাগবে?”
“না। এটা রাখো।”
“এটা কেন, স্যার!”
“রাখো। আমি তো নিজে যেতে পারছি না শপিংয়ে। তোমাদের নতুন অতিথির জন্য কিছু কিনে নিয়ো।”
“থ্যাংক ইউ, স্যার।”
তাযিন খুশি হয়েছে ভীষণ। আবরার মৃদু হেসে তার আনন্দের শামিল হলো। তাযিন চলে গেলে দরজা লাগিয়ে খেতে বসলো। তার ক্ষুধা লেগেছে খুব। আজ রুটিনমাফিক খাওয়াদাওয়া হয়নি তার। সকালের নাস্তা সকালে এলেও সেটা খেয়েছে বেলা বারোটায়। একটু বেশিই ঘুমিয়েছিলো আজ। আর নাস্তা দেরি করে খাওয়ার কারণে দুপুরেরটা ফিরিয়ে দিয়েছে। এখন ক্ষুধা নিয়ে বসে রাতের খাবার শেষ করে নিচ্ছে। আজকাল কাজের ফাঁকে মনটা বেশ ভার হয়ে থাকে। তার পেশা জুড়েই তো বহমান ঝামেলার উপর ঝামেলা। তারউপর পরিবারেও এক মহা ঝামেলার সৃষ্টি হয়ে গেছে তার জন্যই! বউ চলে গেছে বাবার বাড়ি। তার সংসার করবে না প্রিয়তমা আফসানা মিমি। অবশ্য দোষ এখানে সম্পূর্ণ তারই! আজ প্রায় তিন মাস যাবত বাড়ি যাবে যাবে করেও যাওয়া হচ্ছে না। বোনের শ্বশুরবাড়ি থেকে দাওয়াত এলো, তাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হলো। অথচ সে উপস্থিত হতে পারলো না। রাগ করলো বোন এবং বাবামা! বউও শাসন করতে কম করেনি। এরপর বড় শ্যালিকাকে দেখতে এলো পাত্রপক্ষ। কাজের চাপে যেতে পারেনি, সেটা মিমিসহ সবাই-ই স্বাভাবিকভাবে নিয়েছে। তার কাজের চেয়ে সেটা খুব একটা জরুরি বোধ হয়নি। তবে থাকলে ভালো হতো। সে যাক! তাতে কারোই কোনো মাথাব্যথা হলো না। কিন্তু যখন পাত্রপক্ষ পছন্দ করে গেলো, তখন পাত্র ও পাত্রের বাড়িঘর দেখতে যাওয়ার জন্য খুব চাপ পড়লো। সেদিন শ্বশুর বাড়ি থেকে কম হলেও একশো বার কল করা হয়েছে ফোনে। যাওয়ার ইচ্ছেও ছিলো, কিন্তু সকালেই মিটিংয়ের বার্তা চলে এলো! বড় অফিসারের কাছে ডাকা হয়েছে তাকে। আইন মন্ত্রণালয়ে যেতে হয়েছে। ব্যাস তো! সেখানেও তার অনুপস্থিতি! তবুও শ্বাশুড়ির কাছে ক্ষমা চেয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেছে। পাত্রের ছবি সে ফোনে দেখে নিয়েছে। পছন্দ হয়েছে, সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার মতামতও দিয়ে দিয়েছে। বড় মেয়ের জামাই সে। তার মতামত ছাড়া তো আর কাজ এগিয়ে নিবে না। যদিও মিমি রেগে ছিলো তখন থেকেই। এরপর সেদিন এনগেজমেন্ট এর তারিখ পড়লো। তারিখও তাকেই নির্ধারণ করতে দেওয়া হলো। কারণ তার সময় হয়ে উঠে না। তাকে ছাড়া কার্যক্রমও সম্পাদন করতে চায় না। তাই সে যেদিন বলবে, সেদিনই তারা কার্য সম্পাদন করবে। এবার তো প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হলো, তারিখও নিজেই নির্ধারণ করলো। রেডি হয়ে গেলোও। অথচ কি হলো!
(কি হলো??)