“রেইনকোট আরোহী”
পর্ব- ৯,১০
(নূর নাফিসা)
০৯
.
রোহান ঘরে ফিরে বড় গেইটের চাবি নিয়ে আবার বেরিয়ে গেলো গেইট খুলে দিয়ে আসতে। মেয়েকে কোলে নিয়ে আবরার ঘরে প্রবেশ করতেই উপস্থিত প্রায় সকলের মুখেই হাসি ফুটলো। একদম গলা জড়িয়ে বাবার বুকে মিশে আছে মারওয়া। যদিও সবারই অভিমান ছিলো, কিন্তু তাকে দেখে চেহারায় অভিমান খুব একটা বজায় নেই। একমাত্র মিমিটাই হাসলো না! যেন আরও রাগলো তাকে দেখে! তার আসার প্রত্যাশায় মোটেও ছিলো না সে। এমনই একটা ভাব ফুটলো চেহারায়। মনের খবর আর কে জানে? কিন্তু এই চেহারায় ততটা গুরুত্ব দেওয়ার সময় তৎক্ষনাৎ হলো না আবরারের। সামনে শ্বাশুড়ি, শ্যালিকা আছে। তাদের সাক্ষাৎ না করবে আগে! মিমির মামাতো বোনদের দুজন উপস্থিত আছে এখানে। তারাও কুশলাদি বিনিময় করলো। রিমি এখানে উপস্থিত ছিলো না। মায়ের রুমে গোছগাছ করছে। এখানে সবাই আলাপসালাপ করছে বিধায় কুশলাদি বিনিময়ের পর শ্বাশুড়ি, সালমা সুলতানা আবরারকে পাশের রুমে গিয়ে বসতে বললো। এতোটা পথ এসেছে, একটু গিয়ে বসুক। বড় মেয়ের হাবভাব এমনিতেই ভালো লাগছে না তার কাছে। জামাই এসেছে, অথচ কোনো কথা তো বললোই না! বসা থেকেও উঠলো না। এখানেই দেবে বসে আছে মুখটাকে পাঁচ রাঙা বানিয়ে! আবরার মারওয়াকে নিয়ে শ্বাশুড়ির রুমে এসে বসলো। রিমিকে দেখেই জিজ্ঞেস করলো,
“আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছো, রিমি?”
“ভাইয়া! ওয়া আলাইকুমুস সালাম। বাট কেমন আছি, সেটা তো এই শেষ সময়ে জানার দরকার নেই।”
আবরার মৃদু হেসে বললো,
“শুরুতে থাকলে তো শেষের মজা পাওয়া যেতো না। চিন্তা করো না, তোমার শ্বশুর বাড়ি গিয়ে বেড়াবো ইনশাআল্লাহ।”
“হুহ্! কত যে বেড়াবেন, জানা আছে। একবার ফোন করার সময় আপনার হয়নি, আবার আমার শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার কথা!”
“তুমিও তো ফোন করলে না।”
“কেন করবো? আপনি ব্যস্ত মানুষ। ডিস্টার্ব করে লাভ আছে? যখন করার, তখন তো করেছিলামই।”
“রাগ করে আছো ভাইয়ার উপর? সিরিয়াসলি আমি সেদিন রওনা দিয়েছিলাম, এতো ইম্পর্ট্যান্ট কাজ চলে আসবে। ভাবতেও পারিনি।”
“আমি ভেবেছিলাম, আমার বিয়ের সব না হোক অধিকাংশ কার্যক্রম ভাইয়া সম্পাদন করবে। অন্তত ছেলেটা ভাইয়া পছন্দ করে ঠিক করবে। অথচ কাজের ভয়ে সেই ভাইয়া একদম পালিয়েছে! এতোটাই ব্যস্ততায় পড়েছে যে, ছেলে দেখার সময়টুকুও হলো না!”
“ছেলে তো দেখেছি ই। আমি পছন্দ করেছি বলেই তো সব ঠিক হলো। মাকে জিজ্ঞেস করো, পছন্দের কথা জানিয়েছি কি না!”
সালমা সুলতানা অভিমানের অবসান ঘটানোর ইঙ্গিত করে রিমিকে বললেন,
“ওসব কথা রাখ তো এবার। আর ঘাটাঘাটি করিস না। যার কাজ, সে-ই বুঝে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। পছন্দ অপছন্দের সব মতামতই দিয়েছে দূরে থেকেও।”
আবরার রিমিকে বললো,
“তোমার পছন্দ হয়েছে কি না, সেটা বলো এবার। সবার মতামত তো কনফার্ম হলোই। এবার ডিরেক্ট শুনি তোমার মুখে।”
রিমি ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে বললো,
“আপনি আবার যান। ডিরেক্ট দেখে আসুন একবার ছেলেকে। তারপর আমার মতামত জানাচ্ছি।”
“যাবো? আচ্ছা, আগামী সন্ধ্যায় গিয়ে নাহয় একেবারে হলুদ সন্ধ্যা উদযাপন করে আসবো।”
“ঠিক আছে। আমি বলে রেখেছি, একজনের দেখা বাকি আছে। আজ সকালেও ফোন দিয়ে বললো, সেই একজন কবে যাবে দেখতে। আর তো মাত্র একদিন বাকি।”
“কথা হয় নিয়মিত?”
“ফোন নম্বর নিয়ে গিয়েছিলো। আজ নিয়ে দুইবার কল করেছে।”
“মা, বাসার আয়োজন তো এমনিতে সব ঠিকঠাকই আছে। তাই না?”
“হ্যাঁ, ঠিক আছে। তুমি হাতমুখ ধোও এবার।”
মারওয়া কোল থেকে নেমে গিয়ে বললো,
“মামা তো আমার জন্য দোপাট্টা এনে দিয়েছে মামনির বিয়েতে পরে বউ সাজার জন্য। তুমি দেখবে, আব্বু? দাঁড়াও, দেখাচ্ছি।”
মারওয়া নিজেই গিয়ে নানুর আলমারি টেনে খুললো দোপাট্টা নেওয়ার জন্য। রিমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
“আল্লাহ! আবার দোপাট্টা! যে আসছে ভাইয়া, তাকেই দেখাচ্ছে আজ সারাদিন ধরে! মামা কি এক এনে দিয়েছে, যা না দেখালেই নয়। এতো পছন্দ করেছে মামার উপহার।”
মারওয়া প্যাকেট নিতে নিতে বললো,
“তোমার এতো হিংসে কেন হয় আমার দোপাট্টার প্রতি? মামা তোমাকেও এমন একটা এনে দেয়নি বলে?”
“ওরে বাবা! আমি আবার কখন হিংসে করলাম! এতো যে দেখাচ্ছো সবাইকে, নতুন দোপাট্টা তো দেখে দেখেই পুরাতন হয়ে যাচ্ছে।”
“হোক। নো প্রব্লেম। আমি নতুন জামার সাথে পরলেই আবার নতুন হয়ে যাবে এটা। জামা তো আর কাউকে দেখাইনি।”
“ওকে, বাবা। আই হ্যাভ নো প্রব্লেম।”
এদিকে একবার ডেকে আসার পরও যখন মেয়ে আসেনি, সালমা সুলতানা এখানে থেকেই আবার গলা ছাড়লেন মিমির জন্য। মারওয়া বাবার কোলে প্যাকেট দিয়ে পাশে বসলো। প্যাকেট খুলে দোপাট্টা বের করে আবরার বললো,
“আরে! খুব সুন্দর তো! আমার আব্বুটাও বউ সাজবে নাকি!”
বলতে বলতে মাথায় পরিয়ে দিলো আবরার। সালমা সুলতানা জবাব দিলেন,
“হ্যাঁ, রিমির শ্বশুরের সাথে পাঠিয়ে দিবো একদিনেই।”
“ইশ! আব্বু আম্মুকে ছাড়া আমি যাবো না কোথাও। এটা তো মামনির বিয়েতে পরবো। আব্বু, জানো? ছোট মামনিও একেবারে আমরটা টেনে নিয়ে মাথায় দিয়ে বসে থাকে। মামা কতবার বলে, এটা মারওয়ার! এটা মারওয়ার! একদমই শুনেনা! সবাই শুধু আমারটা নিয়ে যেতে চায়।”
“মামনি দুষ্টুমি করে ভয় দেখায় তোমাকে। এটা তো মামনি পরতে পারবে না। এটা ছোটদের।”
এমনি মিমি এসে দাঁড়ালো দরজার পাশে৷ মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,
“ডেকেছো কেন?”
“আবরার এসেছে। কোথায় হাতমুখ ধোয়ার পানি এগিয়ে দিবি, তোয়ালে দিবি। সেখানে বসে আছিস কেন?”
“কাকে কি এগিয়ে দিবো? সে এসেছে কেন এখানে? বলেছি তাকে আসতে?”
“কথা কম বল।”
“কেন বলবো কম? এই দুদিনের জন্য এসে নাটক দেখানোর কি খুব প্রয়োজন ছিলো? তার প্রয়োজন নেই তো এখানে। কে বলেছে তাকে আসতে?”
“আমি বলেছি। কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ যা, তোয়ালে নিয়ে আয়। যা হওয়ার হয়েছে। লোক হাসাহাসি করাস না গলা বাড়িয়ে।”
“নাহ! হয়েছে বলে ছেড়ে দিলে তো চলবে না। লোক হাসানোর কাজ করেছে কেন সে? লোকে আমাদের উপর হেসে যায়, তাতে খুব মজা লাগে তো তার। মাস যাবত এসে বাপের বাড়ি পড়ে আছি, বোনের বিয়ে দিবো সেখানে হাজার বার বলে বলে তাকে একবারের জন্য নিয়ে আসতে পারিনি। এগুলো শোনে না লোকে? দেখে না চোখে? হাসে না আমাদের উপর? এখন কি দেখতে এসেছে সে? তামাশা? লোকে কিভাবে হাসছে, সেই তামাশা দেখতে এসেছে?”
কষ্টে গলা কাঁপতে শুরু করেছে মিমির। সে আবারও বলতে লাগলো,
“এখানে তার কোনোই প্রয়োজন নেই। শুরুতে যে থাকতে পারেনি, শেষেও তার থাকতে হবে না। তার অভাববোধ একদমই হয় না। কাজের মানুষের অভাব হয়নি আমার। সে ছাড়াও এ পর্যন্ত কাজ হয়েছে, বাকিটাও হবে।”
“এই, মেয়ে। কথা কম বলতে বলেছি!”
মায়ের সাথে রিমিও বললো,
“আপু, চুপ থাকো তো। বাদ দাও ওসব।”
“চুপই তো ছিলাম এতোদিন। কথা বাড়ানোর জন্য এসেছেই তো এখান। সবসময় তো চুপ থাকবো না। ভাবেটা কি সে? বাবা নেই বলে খুব অসহায় হয়ে পড়েছি? একদমই না। আল্লাহ সব ব্যবস্থা ঠিক করে দেন৷ সে তার কাজ নিয়ে পড়েছিলো বলে আমাদের কোনো কাজ থামিয়ে রাখেননি আল্লাহ তায়ালা। যথানিয়মে এগিয়েছে। তার হাত না লাগলেও সবটা ভালো হয়েছে৷ সে ব্যতিত আমার সব আছে। এতেই আমি সন্তুষ্ট। তার কোনো প্রয়োজন নেই আমার। খুব গুরুত্ব দেওয়া হয় বলে এমন অবহেলা নাকি? যথেষ্ট হয়েছে। মানুষকে ততটাও গুরুত্ব দেওয়া উচিত নয়, যতটার মর্যাদা দিতে সে জানে না।”
“বাদ দিবি নাকি? বারবার বলছে জরুরি কাজ ছিলো, কানে যাচ্ছে না তোদের? পরের অধীনের কাজ, চাইলেই কি ছুটে আসা যায়?”
“কিসের কাজ? কাজ না, কাজ না৷ এসবই অযুহাত। আগে আসেনি? তখন কিভাবে পেরেছে? প্রতি সপ্তাহেই দেখি চলে এসেছে। এখন যে মেয়েটা সারাদিন আব্বু আব্বু বলে চিৎকার করে৷ তা-ও তো মন গলে না তার। মনপ্রাণ এখন অন্যদিকে বসে গেছে। সে নিজের মা বাবাকেই মনে রাখতে পারে না, অন্যরা তো পথের ধুলোই!”
“আহ! কি থেকে কি বানাচ্ছো! কাজের গুরুত্বটাও দেখা প্রয়োজন। রাগারাগি ততটাও ভালো না। সীমিত থাকা ব্যাটার।”
রিমির কথার পরপর একটু থামলো মিমি। তার খুবই রাগ হচ্ছে। রাগে শরীর কাঁপছে। আরও অনেকটা রাগ জমা আছে, হয়তো প্রকাশ করতে পারছে না সবটা। সালমা সুলতানা কণ্ঠ এবার একটু কঠিন করলেন,
“মেয়েকে যে বলছি বারবার, শুনছে না? তাকে কি অপমান করার জন্য ডেকেছি এখানে?”
“নাহ! অপমান কেন করবে? সম্মানিত ব্যক্তির সম্মান পাওয়া প্রয়োজন। সে এসেছে, খুশিতে মাথায় তুলে নাচুক সবাই! আমার মধ্যে এতো খুশি উতলাচ্ছে না।”
ভেজা ও কটমটে চোখে তার দিকে তাকিয়ে হনহনিয়ে চলে গেছে মিমি। সালমা সুলতানা আর তাকে ডাকলেন না। থামালো না কেউই। তার এই মেজাজটা আপাতত আর দেখতে ইচ্ছে করছে না কারো। মায়ের মেজাজ দেখে এদিকে প্যাকেট জড়িয়ে কেমন থমকে বসে আছে মারওয়া। মুখে একদমই আনন্দটা বজায় নেই। যেন ঝড়টা বুঝার চেষ্টা করছে। বাবাকে বকেছে, তার ভীষণ খারাপ লাগছে। আর আবরার? শুরু থেকেই একদম চুপ করে বসেছিলো। সে আগে থেকেই তো আন্দাজ করতে পেরেছে, এমন একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন তাকে হতে হবে। প্রথম দুয়েক লাইন বলার সময় মিমির দিকে তাকালেও তারপর থেকে চিন্তিত দৃষ্টি যে মেঝের দিকে নামিয়েছে, এখনো সেই নামানো অবস্থায়ই আছে। কোনো প্রত্যুত্তর করলো না মিমির রাগ বাড়বে বলে। রাগ কমানোর চেষ্টাও করলো না শ্বাশুড়ি ও শ্যালিকা উপস্থিত আছে বলে। মুখে হাসি কাশি কিছুই নেই। গম্ভীরমুখে বসে থেকে শুনেছে সব কথাই। মিমির রাগের পরিমাণও অনুমান করেছে, কারণ ও কষ্টটাও অনুভব করতে পেরেছে, মিমির অপমানের সামনে শ্বাশুড়ি ও শ্যালিকার সাপোর্টটাও অনুধাবন করতে পেরেছে। সাথে ভাবছেও সামাল কিভাবে দিবে৷ এখন কি করা প্রয়োজন তার। এদিকে বাকিরা ভয় পাচ্ছে, মিমির অপমানে আবার চলে না যায় সে! পাশের রুমেও নিরবতা কাজ করছে।
“রেইনকোট আরোহী”
পর্ব- ১০
(নূর নাফিসা)
.
.
রিমি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টায় বললো,
“ভাইয়া, উঠুন তো। ফ্রেশ হতে যান। ক্ষেপার ক্ষেপামি এমনিতেই কমে যাবে। মারওয়া, দোপাট্টা রাখো এবার। উর্মি এসে আবার দেখলেই পরতে শুরু করবে নয়তো।”
মারওয়া বিছানা ছেড়ে নেমে চুপচাপ চলে গেলো প্যাকেট রাখতে। সালমা সুলতানাও আবরারকে বললো,
“যাও, বাবা। হাতমুখ ধোও। কিছু মুখে দাও। মুখটা একদম শুকনো লাগছে।”
আবরার উঠে ওয়াশরুমে গেলো। রিমি তোয়ালে এনে দিয়েছে সামনে। তারপর গেলো খাবারের বন্দোবস্ত করতে। উর্মিকে ডেকে বললো মারওয়াকে সাথে নিয়ে বসতে। ওদিকে রোহান ড্রাইভারকে সাথে নিয়ে এসেছে খাওয়ার জন্য। আবরার হাতমুখ ধুয়ে বাইরে এসে মিমিকে দেখতে না পাওয়ায় রিমিকে জিজ্ঞেস করলো,
“তোমার আপু কোথায়?”
“দেখিনি তো। দোতলায় গেছে সম্ভবত। বসুন, ভাইয়া। খাবার দিচ্ছি।”
“পলাশ ভাইকে খেতে দাও। আমি আসছি একটু পরে।”
“আবার কোথায় যাচ্ছেন? আপুর রাগ ভাঙতে দেরি হবে। আগে খেয়ে নিন।”
আবরার মৃদু হেসে সিড়ির দিকে চলে গেলো।
“আসছি।”
রিমি কিচেন থেকে রোহানকে ডাকছে ড্রাইভারকে খাবার নিয়ে দেওয়ার জন্য। তিন বোনের একটাই ভাই। উর্মির বড় এবং রিমির ছোট রোহান। মাস্টার্সে অধ্যয়নরত। রিমিরও সবে মাত্র মাস্টার্স শেষ হলো। তার অবশ্য এক বছর গ্যাপ পড়েছে। অনার্স শেষ করার পর একবার ভেবেছিলো আর পড়বে না। পরের বছর আবার ভর্তি হয়েছে। বছর দুতিন আগে বাবা মারা গেছেন, পরিস্থিতি এবং মনমানসিকতা একদমই ভালো ছিলো না তখন। বর্তমানে রিমি একটা চাকরিও করছে ব্যাংকিং অফিসে। রোহান এখনো সেভাবে জড়িত হয়নি কোনো কাজে৷ পড়াশোনার পাশাপাশি টুকটাক ফ্রিল্যান্সিং কাজ করে। উর্মি কিছু স্টুডেন্ট পড়ায়। মিমিও পড়াতো শ্বশুর বাড়িতে। মায়ের হাতে টুকটাক হাত খরচ দিতো। আবার মা-ও দিতে কম দিচ্ছে না তাদের। জমি ভাড়া দেওয়া আছে, সেখান থেকেও মাসে মাসে আয় হয় কিছু। বাবার পেনশনের টাকাও পাওয়া হচ্ছে। সবমিলে অভাবহীন ভালোই চলে যাচ্ছে তাদের সংসার। হারিয়ে ফেলা মানুষটার অভাবটাই শুধু অনুভব করে তারা। তাছাড়া স্বচ্ছলতার দিক থেকে অপূর্ণ নয় তাদের জীবন।
আবরার দোতলায় যাওয়ার পথে উর্মিকে দেখলো সিড়ি দিয়ে নামছে। জিজ্ঞেস করলো,
“মিমি উপরে?”
“না তো, ভাইয়া। মারওয়া আছে রুমে। আপু বোধহয় ছাদে গেছে।”
“ঠিক আছে।”
আবরার সোজা ছাদেই চলে গেলো। ছাদের দরজা খোলা। শব্দহীন পা রাখতেই দেখলো একা একা দোলনায় বসে আছে মিমি। হাতে মাথার একপাশ ভর করে রেখেছে। আবরার এগিয়ে যেতেই ভাবনা থেকে সরে এসে কটাক্ষ দৃষ্টি জোড়া আবার নিক্ষেপ হয়েছে তার দিকে। এবার চোখাচোখি। মিমির যেন ইচ্ছে করছে চোখ দিয়েই তাকে খু*ন করে ফেলতে। এতোটা রাগ হচ্ছে তার। যদিও সে দোলনার মাঝামাঝি বসেছে, ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিৎ হাসি রেখে তার একপাশেই বসতে গেলো আবরার। মিমি তাকে পুরো দোলনাটাই দিয়ে যেতে উঠে দাঁড়ালো সাথে সাথে। আবরার বাঁধা দিয়ে হাত টেনে আবার বসিয়ে দিলো।
“হাত ছাড়ুন।”
“ছেড়ে দেওয়ার জন্য ধরেছি নাকি?”
“ছাড়ুন বলছি, নাহয় ধাক্কা মেরে ছাদ থেকেই ফেলে দিবো। এতো জ্বালাতন সহ্য করবো না আমি।”
আবরার আরেকটু চেপে আরাম করে বসলো। এবার দুজন সমান সমান দখল নিয়েছে দোলনার। তবে মিমিকে ছাড়েনি। হাত ছেড়ে একহাতে জড়িয়ে নিয়ে বললো,
“স্যরি।”
“কিসের স্যরি? কোনো স্যরি ট্যরি নেই।”
রেগে থাকলেও চলে যাওয়ার জন্য জোরাজুরি করছে না একদম। মুখটা ফিরিয়ে নিয়েছে অন্যদিকে৷ আবরার ধীর নিশ্বাস ফেলে বললো,
“আর হবে না এমন।”
কোনো প্রত্যুত্তর করলো না মিমি। আবরার তাকে নিজের দিকে ফেরাতে বললো,
“ট্রাস্ট মি, ইম্পর্ট্যান্ট না হলে যেতাম না আমি। মা বুঝলো, শ্বাশুড়ি মা বুঝলো, তুমি বউ হয়ে না বুঝলে কিভাবে হবে?”
মিমি তার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো,
“কি বুঝবো আমি? কি বুঝবো আপনার কাছ থেকে? কাজের জন্য যদি পরিবার ভুলে যেতে হয়, তবে প্রয়োজন নেই তো আমার এমন কাজের! চাকরি কি আমি করতে পারি না? করছি না কেন তবে? পরিবারের অযত্ন করে তো আমি চাকরি করতে যাবো না। আমার দ্বারা যদি পরিবারের যত্নই সম্ভব না হয়, তবে কিসের যত্ন নিবো দেশ কিংবা দেশের জনগনের?”
“এখন আমি তোমার মতো চাকরি না করে পরিবারের কেয়ারে নামলে জীবন চলবে?”
“চাকরি করতে তো আপত্তি করছি না আমি। চাকরির জন্য যদি পরিবারের প্রয়োজনে পাশে থাকা না যায়, তবে দরকার নেই আমার এমন চাকরির। আমি তিন বেলার জায়গায় একবেলা খেয়ে বাঁচবো। তাই বলে পরিবার ভুলে যাবো? কিসের কাজ দেখান আপনি? মা অসুস্থ থাকে, আসতে পারেন না৷ বোনের প্রয়োজন থাকে, আসতে পারেন না। শ্বশুর বাড়িতে প্রয়োজন থাকে, আসতে পারেন না। কি এমন চাকরিজীবী হয়ে উঠেছেন আপনি? কোথায়, আগে তো এমন হতো না। তখনও আপনি চাকরিজীবী ছিলেন। এমন তো নয় যে, যখন তখন ছুটি কাটাচ্ছেন। তাই প্রয়োজনেও ছুটি পাচ্ছেন না!”
“কাজ তো সবসময় একরকম থাকে না। বুঝো না কেন।”
“আমার বুঝতে হবে না আর। খুব বুঝা হয়ে গেছে। আর বুঝার প্রয়োজন নেই। আপনাকে ছাড়া সবই হয়েছে, যা বাকি আছে তা-ও হবে।”
“ঠিক তো?”
“কি আবার ঠিক বেঠিক? সব দেখছেন না চোখে?”
“যা দেখার, তা তো দেখছিই। আমার প্রয়োজনটা কি তোমার কাছে সত্যিই ফুরিয়ে গেছে?”
মিমি মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললো,
“যাবে না কেন?”
“আমি এখন চলে গেলে কি তুমি খুশি হবে?”
“আমার খুশিতে কার কি আসে যায়, কেউ তো হবে।”
“কে হবে?”
“আপনি ফিরে যাওয়ার অপেক্ষায় যে বসে আছে।”
সাথে সাথেই পেটের একপাশে হালকা চেপে ধরলো আবরার,
“তোমার বসে থাকার কথা।”
“কোনো কারণই নেই।”
বারবার চোখ মুছে যাচ্ছে মিমি। গলাও শান্ত। এতোক্ষণ কি বলে আর কি করে রাগ ঝাড়বে, তারই যেন কূলকিনারা পাচ্ছিলো না। এখন আর সেই রাগটা বজায় নেই, তবে জমা আছে যত অভিমান। আবরার নিজের সাথে আরও চেপে ধরার চেষ্টা করতে মিমি আবারও তার দিকে ফিরে তাকালো, গলাও একটু উঁচু হলো,
“হচ্ছে কি!”
জবাবে এক গাল হাসলো আবরার। হাতের বাঁধন হালকা করে পায়ে ভর করে দোলনা দোলাতে দোলাতে বললো,
“ক্ষুধা লেগেছে ভীষণ। যোহরের পর যে খেয়েছি, এ পর্যন্ত আর খাওয়া হয়নি।”
“তো যান, শ্বাশুড়ি দাওয়াত করেছে খাবেন গিয়ে। এখানে এসে বসে আছেন কেন?”
“তোমার জন্য।”
“আমি ডাকিনি কাউকে এখানে।”
“এতোটা পথ এসেছি, একটুও মায়া হচ্ছে না আমার জন্য? সত্যিই ক্ষুধা লেগেছে ভীষণ।”
“এতোটা পথ আসবেন, খাবার দিয়ে দিলো না সাথে। নাকি খেতেই দেয় না ঠিকমতো?”
“সমস্যা কি তোমার? এতো অবিশ্বাস কেন? আসিনা বলে এতোই যখন অভিমান, তবে তুমিই চলো কোয়ার্টারে। বলেছিলামই তো। সেটাও তো যাচ্ছো না।”
“আপনার কেউ না থাকতে পারে, আমার তো আপনি ছাড়াও আরও কেউ আছে। সবার দিকেই নজর রাখতে হয় আমার।”
“তবে উল্টাপাল্টা কেন বলছো আবার? বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে না এসব?”
“আমি সবসময়ই বেশি বেশি করি। খুব বেশিই প্রত্যাশা করে ফেলি আপনার কাছে। উল্টাপাল্টাতেও বেশি বেশিই বলি। এখন নতুন তো না!”
আবরার হৃদয়ে কোমলতা এনে কানের নিচে আলতো ছুঁয়ে দিয়ে ফিসফিস করলো,
“আমার কাছে প্রতি মুহুর্তেই তুমি নতুন।”
মিমির অভিমানটা যেন এবার নিঃশেষের চূড়ান্ত পর্যায়ে এলো, তাই কান্নাটা একটু বেড়ে গেলো,
“আমি তো ছোটখাটো প্রয়োজন গুলোতে ইচ্ছে করেই আপনাকে ডাকি না। যেগুলো আপনাকে ছাড়া চলবে, জানাইনা পর্যন্ত। টেনশন নিবেন বলে। আর আপনি কি করেন? এভাবেই মানুষের মনে আঘাত দিয়ে যাবেন প্রতিনিয়ত। আর খুব ভালো ভালো সম্মান অর্জন করবেন চারপাশ থেকে। মানুষকে উপলব্ধি করতে শেখাবেন, কাউকে বেশি গুরুত্ব দিতে নেই।”
“স্যরি। বিয়েটা বোধহয় চাকরিতে জয়েন করার আগে করা উচিত ছিলো। তখন অন্তত বুঝা হতো, কোন চাকরিটা আমার জন্য উপযুক্ত। কোন চাকরি করলে পরিবারের মন রক্ষা করা সম্ভব হবে।”
আর কিছুই বললো না মিমি। নিজেকে শান্ত করতে দৃষ্টি নামিয়ে চুপ করে রইলো। ফাঁকে ফাঁকে চোখও মুছে নিয়েছে। আবরার দোলনায় দুলতে দুলতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। ধীর নিশ্বাস ফেলে মিমি উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“নিচে চলো।”
আবরার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সাথে উঠে দাঁড়ালো। সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললো,
“শপিং করা সব শেষ?”
“না, বসে থাকবে উনার জন্য!”
“আমার জন্য কি কিনেছো?”
“মাথা কিনেছি আমার। ঢাকা থেকে এসেছে, কিছু কিনে নিয়ে আসা গেলো না! এখন এসে জিজ্ঞেস করে কি কিনেছি!”
“আচ্ছা, থাক। লাগবে না কিছু। এমনি এমনি বললাম। বাসায় আছে না, তাতেই হবে।”
“আমি নিয়ে আসিনি কিছুই।”
“কাল মা আসবে না? বলে দিয়ো নিয়ে আসার জন্য।”
দোতলায় এসে রোহানের রুমে চলে যাচ্ছে আবরার। এখানে মারওয়া আছে, উর্মি আছে, রোহানও আছে। মেয়েটার সাথে ঠিকমতো আলাপসালাপ হয়নি তার। বাবাকে বলার জন্য মেয়ের কত কথা জমা! মিমি সিড়িতে নামতে নামতে তাকে পেছনে উপলব্ধি করতে না পেরে পিছু ফিরে দেখলো সে রুমে যাচ্ছে। তাই থেমে গিয়ে বললো,
“আবার কোথায় যায়! ক্ষুধা না লেগেছে!”
“আসছি, যাও তুমি।”
“আমি বসে থাকবো না কিন্তু সেখানে।”
“আসছি তো। যাও, রেডি করো খাবার।”
রোহান ও উর্মির সাথে টুকটাক কথা বলে মারওয়াকে সাথে নিয়েই নিচে নামলো। খাওয়াদাওয়া হলো, সকলের একসাথে বসে গল্প করা হলো। মিমির রাগ অভিমান বজায় নেই, তবে কিছুক্ষণ আগে সেটা থাকার কারণে মুখটা কিছুটা গম্ভীর হয়ে আছে। রাতে ঘুমাতে গিয়েও কি আদুরে গল্পে কেটেছে বাবা-মেয়ের দীর্ঘসময়। পাশে থেকে থেকে মিমি নিরব শ্রোতা। একদমই দমানোর চেষ্টা করেনি তাদের। বরং খুবই ভালো লাগছিলো তার। প্রায়ই খুব মিস করা হয় এই সময়গুলোকে।