রেইনকোট আরোহী” পর্ব- ১৪ শেষ

0
742

“রেইনকোট আরোহী”
পর্ব- ১৪ শেষ
(নূর নাফিসা)
.
.
“এগুলো কি মোতালেব সাহেব?”
আবরারের জিজ্ঞাসায় মুখটা শুকিয়ে গেছে মোতালেবের। সে তবুও নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো মুহুর্তের মধ্যেই। অতি চাঞ্চল্যকর জবাবে বললো,
“আমাদের কসমেটিকস শো-রুমের কিছু মালামালও রেখেছি এখানে। কমপ্লেক্সের গোডাউনের মেরামত চলছিলো একটু। তাই আরকি এখানে এনে রাখা।”
“ও আচ্ছা। তাহলে তো আপনাদের কসমেটিকস শো-রুমটাতেও পরিদর্শনে যাওয়া প্রয়োজন একদিন।”
আবরার এগিয়ে গিয়ে নিজ হাতেই একটা কার্টুনের গিট খুলে নিলো। মোতালেব হকচকানো গলায় দ্রুত এগিয়ে এসে বললো,
“স্যার, আমি কি বড় ভাইকে কল করবো আপনি নিচে গিয়ে একটু বসুন না। আপনি এসেছেন জেনেই বড় ভাই খুশি হয়ে চলে আসবে।”
“কিন্তু আমি খুশি হতে পারছি না আপনার আচরণে। আপনি একটু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকুন। আপনার বড় ভাইকে আমিই ডেকে নিবো আমার অফিসে। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।”
আবরার কার্টুনের মুখ খুলে ফোম সরিয়ে নিলো। তারপরই দেখা মিললো কিছু দেশি-বিদেশি অ*স্ত্রের! বেশি না, মাত্র দুইটা কার্টুনই খুলেছে এবং দেখতে পেয়েছে কিছু বো*মা ও ব*ন্দুকের সমাহার! সেগুলোতে হাত লাগায়নি আবরার। সে কার্টুনের মুখ বন্ধ করে দিয়ে পেছনে ফিরে বললো,
“আপনাদের কসমেটিকস প্রোডাক্টগুলো তো বেশ উন্নতমানের! এ-ই বুঝি আপনাদের দৈনন্দিন জীবনের উন্নতির প্রধান বাহন?”
কোনো জবাব নেই মোতালেবের জবানে! একদম ভয়ার্ত কাপুরুষ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। বাইরে অপেক্ষাকৃত বাহিনীকে এবার ডাকা হলো ফোনে। সাথের দুজনের মধ্যে একজনকে এখানেই মোতালেবের সাথে দাঁড় করিয়ে রেখে আবরার আরেকজনকে সাথে নিয়ে এবার দ্বিতীয়বারের জন্য আবার গেলো ইলিয়াসের রুমে। চাবি তার হাতেই আছে। তালা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে দেখলো একইভাবে পড়ে ঘুমাচ্ছে ইলিয়াস। পাশের জনকে নির্দেশ দিলো রুম তল্লাসি করার, আর সে এসে দাঁড়ালো বিছানার পাশে। জানালার গ্লাস খুলে দিতে দিতে বললো,
“ইলিয়াস? ইলিয়াস…? ঘুম ভাঙবে না নাকি আজ? শেষ ঘুম কি এখানেই হবে?”
ঘুমঘুম চোখে ভ্রু কুচকে তাকিয়েছে ইলিয়াস। আবরারকে দেখে ঝটপট বসে পড়লো। ওদিকে শব্দ পেয়ে দেখলো তার ড্রয়ার, আলমারি, সব ঘাটাঘাটি চলছে! আবরার বললো,
“ক’টা বাজে এখন?”
ইলিয়াস বোকার মতো তাকিয়ে যেন তার পরিবারের কাউকে খুঁজতে লাগলো! আবরার আবারও বললো,
“সবসময়ই কি রাত জেগে কাজ করো? তোমার মতো স্মার্ট ছেলের অবসরের কাজ দেখে মুগ্ধ হলাম আমি। কিন্তু কাজ তো দিনেও করা যায়। রাতের ঘুম নষ্ট করা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এই বয়সে চেহারাটার কি হাল করেছো! ওসব খাওয়া কি খুব জরুরী? তোমার বাবা এতিমখানায় খিচুড়ি খাওয়ায়, একটু সওয়াব পাওয়ার আশায়। অথচ তুমি খাও হারাম! রাতকে করো দিন আর দিনকে করো রাত!”
“না, আংকেল। তেমন কিছু না। এসব কি বলছেন! ঠিক এখানে আপনি?”
কি রেখে কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না ইলিয়াস। থতমত খেয়ে গেছে সে। আবরার শান্ত গলায় বললো,
“রিলেক্স। এতো মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। ঘুম থেকে উঠেছো তো। মাথা ঠান্ডা করো।”
“আব্বু! আব্বু কোথায়! নিচে আছে বোধহয়। চলুন আমি ডেকে দিচ্ছি।”
“তোমার আব্বু মিলাদে গেছে। নিচে আমিই তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি।”
“কি বলছেন, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”
ভয়ার্ত মুখখানায় জোরপূর্বক হাসি ফোটানোর চেষ্টা করলো ইলিয়াস। মুখেও পাগলের মতো প্রলাপ! ভরকে গেলে যেমনটা হয়! এরইমধ্যে র‍্যাব কর্মী তার খাটের ড্রয়ার থেকে রুমালে প্যাচানো ব*ন্দুক বের করে নিয়ে এলো। শুকনো মুখে ঢোক গেলার চেষ্টা করে ব্যর্থ ইলিয়াস! হাতকড়া পরিয়ে চাচা ভাতিজাকে সাথে নিয়েই নিচে নামলো তারা। ওদিকে সংকেত দিতেই গাড়ি থেকে আরও র‍্যাব হুড়হুড় করে প্রবেশ করেছে বাড়িতে। এদের কারো দেহে রেইনকোট নেই। গোডাউন থেকে কার্টুনগুলো সংগ্রহের সাথে র‍্যাবকর্মী দ্বারা পুরো বাড়ি তল্লাশি চললো এবার। বাড়ির সদস্যগণ থমকে গেছে সব। তাদের চাচা ভাতিজার হাতে হাতকড়া দেখে বাড়িতে কান্নার জোয়ার উঠার উপক্রম! ভাঙা হৃদয়ে কতশত প্রশ্নের উত্তোলন স্বজনদের! কিন্তু কোনো জবাবই পাওয়া যাচ্ছে না! বারবারই কল করা হচ্ছে এডভোকেট আব্দুল মান্নানকে। খবর পৌঁছালে সাথে সাথেই তিনি প্রোগ্রাম থেকে কেটে পড়ার চেষ্টা করে বাড়ি পথে ছুটে এসেছেন। ছুটে এসে র‍্যাবকর্মীদের যাওয়ার পথে কয়েকজনকে গাড়ি নিয়ে রওনা হতে দেখতে পেলেও সেখানে আবরারকে দেখতে পাননি। তল্লাশির নির্দেশ দিয়ে আবরার তাদের দুজনকে গ্রেফতার করে সেই গাড়িতেই বাড়ি ত্যাগ করে এসেছে। বাকিদের জন্য তৎক্ষনাৎ পৌঁছে গেছে আরেক গাড়ি। ছয়জন র‍্যাব বাড়ি তল্লাশি চালিয়ে কার্টুন নিয়ে চলে এসেছে কার্যালয়ে। তাদের কোনোভাবেই দমাতে পারেনি এবং কোনো কথা শোনাতে পারেনি কেউ। পরিবেশ স্তব্ধ হয়ে আছে। আব্দুল মান্নান বাড়ি পৌঁছে আবরারকে সাথে সাথে ফোন দিয়েও পায়নি। এমনকি পরপর র‍্যাব কার্যালয়ে গিয়ে দেখাও করতে পারেনি। জানা গেছে, তিনি আসার একটু আগেই আবরার জরুরি কাজে বেরিয়ে গেছে। তবে আবরারের জরুরি কাজটা ঠিক কি? তেমন কিছুই না। নিজের প্রতি যত্ন নেওয়াটাই যেন আপাতত তার জরুরি কাজ হয়ে উঠেছে। সে বিশ্রাম নিতে বাসভবনে চলে এসেছে। জানেই, বহুদিক থেকে এখন বহু কল আসবে তার ফোনে। কিন্তু কারো ফোনই সে রিসিভ করবে না। অফিসের কেউ ডিস্টার্ব করতেও আসবে না তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে। ফোন বন্ধ না রাখলেও সাইলেন্ট মুডে রেখেছে। নিশ্চিন্তে ফোনটা তুলে রেখেছে ড্রয়ারে। তাকে বাসভবনে এসে ডিসটার্ব করার সাহস ততটাও হবে না কারো।
ফ্রেশ হয়ে এন্ড্রয়েড সেটটা নিয়ে বসলো বারান্দার চেয়ারটায়। মিমির নম্বরে ডায়াল করতেই রিসিভ হলো। যেন ফোন নিয়ে বসেই ছিলো মিমি। আবরার মিমির হাসিমুখটা দেখে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বললো,
“ফোনকলের অপেক্ষায় বসে ছিলে নাকি?”
“হুম। আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম।”
“মাত্রই কল করার জন্য ফোনটা হাতে নিয়েছিলাম, এমনি তোমার কল এলো।”
“ঠিক সময়ে মনে পড়েছে দুজনের। খুব মিস করা হয় নাকি?”
“হচ্ছে তো।”
“চলে এসো কিছু দিনের জন্য বেড়াতে?”
“উহুম। ইলহামের বউ আসুক বাসায়। তারপর একেবারেই যাবো। এমনিতেই তো কতদিন ছিলাম সংসার ছেড়ে।”
“মারওয়া কোথায়?”
“ওইতো, রাগ করে বসে আছে। গতরাতে কল দাওনি কেন?”
“বিজি ছিলাম। মারওয়া দিয়েছিলো?”
“উহুম, দিতে দেইনি তুমি ব্যস্ত আছো ভেবে। বলেছিলাম, তোমার আব্বু ফ্রি হয়ে কল দিবে। সেই প্রত্যাশায় ফোন হাতে নিয়ে বসেছিলো ঘুমানোর আগ পর্যন্ত। অথচ তোমার ফোন এলো না। তাই রাগ করেছে।”
“ডাকো তাকে।”
“এখানেই। এইতো বিপরীতমুখী হয়ে বসে আছে।”
মিমি ফোনটা তার দিকে ঘোরাতেই আবরার ডাকলো তাকে। দ্বিতীয়বার ডাকার পর এক রাশ অভিমান টেনে মারওয়া বললো,
“তুমি কথা বলবে না আমার সাথে। খুব পঁচা তুমি। আম্মুর সাথে কথা বলার জন্য কল করো। আমাকে একবারও কল করো না।”
“আরে! কে বললো এটা আমার আব্বুকে! আমি তো তোমার সাথে কথা বলার জন্যই কল দিয়েছি।”
“কোথায়? গতকাল তুমি কল দিয়েছো? জানো না, আমি ওয়েট করি সন্ধ্যার পর থেকে!”
“স্যরি, আব্বু। আব্বুর খুব কাজ ছিলো তাই কল করতে পারিনি। কাজ না করলে আবার আমার টিচার আমাকে বকা দিবে না?”
“কেন, তুমি বড়ো হয়েছো না? এখনো তবে কেন তোমার টিচার বকা দিবে তোমাকে?”
“টিচার তো আমার থেকেও বড়ো তাই। এখন বলো, তুমি কি চাও তোমার আব্বুকে বকা দেক কেউ?”
“উহুম, একদম না।”
“এইতো আমার কিউট বাবাটা।”
“তুমি কি করছো আব্বু? সবসময় বারান্দায় বসে কেন কল দাও? ঢাকায় না কতকিছু আছে? চিড়িয়াখানা আছে, শিশুপার্ক আছে। তুমি সেখানে গিয়ে কল দিতে পারো না?”
“চিড়িয়াখানা কেন, বারান্দা তোমার পছন্দ নয়?”
“হ্যাঁ, পছন্দ। কিন্তু চিড়িয়াখানায় গেলে তো আমি একটু হাতিদের দেখতে পারি। সিংহের এতো বড় বড় চুলগুলো দেখতে পারি, বড় মাথাওয়ালা রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে দেখতে পারি!”
“তুমি ঢাকায় এলে, আব্বু তোমাকে সব দেখাবো একদিন।”
“ইশ! ঢাকায় তো কেউই নিয়ে যায় না আমাকে!”
“আমি আবার যখন বেশি ছুটি পেয়ে আসবো, তখন তোমাকে নিয়ে আসবো ইনশাআল্লাহ। ওকে?”
“আমি কি ভয় পাবো না তবে? হাতি যদি আমাকে নিয়ে যায় উঠিয়ে!”
“বাবার সাথে গেলে কোনো ভয় থাকবে না তোমার।”
“প্রমিজ তো?”
“হুম, ইনশাআল্লাহ। খুব প্রমিজ।”
“ওকে, তুমি ভালো থেকো সবসময়। নিজের খেয়াল রেখো।”
“ওকে, বাবা।”
স্ত্রী সন্তানের সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে আসরের নামাজ আদায় করে আবরার নিশ্চিন্তে একটা ঘুম দিয়েছিলো। গতরাতে তার ঘুম হয়নি ঠিকঠাক। কাজে মনযোগ বসানোর ক্ষেত্রেও সুস্থতা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই সুস্থতা নিশ্চিত করতে বেশ সচেতন আবরার। হয়তো পরিস্থিতির কারণে সবসময় সম্ভব হয় না। তবে চেষ্টার ত্রুটি থাকে না। ঘুমের কারণে মাগরিবের নামাজটা যথাসময়ে পড়া হলো না। ইশারের পর রাতের খাবার সম্পন্ন করে তারপর গেলো সে কার্য ভবনে। তাকে দেখে মারফত সাহেব সাথে সাথে ছুটে এসেছে তার রুমে।
“আসসালামু আলাইকুম, স্যার।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কি অবস্থা মারফত সাহেব?”
“আর বলবেন না, স্যার। এডভোকেটের জুতোর তলা তো বোধহয় একদিনেই ক্ষয়! কম হলেও দশবার এসেছে আপনার খোঁজ নিতে। আরও কতদিকে গেছে, হিসেব ছাড়া! ডি. ডি. স্যার, পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট পাঠিয়েছেন আপনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। অপেক্ষা করে ফিরে গেছেন তিনি। আগামীকাল আবার আসবেন হয়তো। রাগিব স্যার স্বয়ং দুইবার কল করেছেন আমাকে। আপনাকে নাকি ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। তার কারণ কি? আপনি কখন আসবেন? এলেই যেন ইন্সট্যান্ট যোগাযোগ করতে বলি। সবাই আপনার উপর ক্ষিপ্ত, স্যার। একটা মামলা ঠুকে দিয়ে আপনি কিভাবে উধাও হয়ে যেতে পারেন!”
“ডি. ডি. কেন। যেতে হলে ডি. জি. পর্যন্ত যাক। যেতে থাকুক। এখন যাওয়ারই সময়।”
“ডি. জি! এতোই সোজা নাকি স্যার!”
মৃদু হাসি ফুটলো আবরারের ঠোঁটের কোণে। সে মারফত সাহেবকে বললো,
“আপনাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। নিজেকে দেখেছেন কি একবারও?”
“সে আর দেখার সময় কোথায় স্যার! তবে আপনাকে খুব ফ্রেশ লাগছে, স্যার। কোনো নতুন ইস্যু আছে কি?”
“দুপুরের মামলাটা কি আপনার কাছে নতুন মনে হচ্ছে না?”
“আলবৎ স্যার! আপনি সেদিন দাওয়াতে যাওয়াতেই কেন জানি আমার একটু অন্যরকম লাগছিলো৷”
“সেটা ব্যাপার না। আরও অনেক দাওয়াতে এটেন্ড করবো, আরও অনেক দাওয়াত রিজেক্ট করবো। সবাইকে হয়তো এডভোকেট সাহেবের মতো দৌড়াতে হবে না। আর সম্ভ্রান্ত লোকেদের একটু দৌড়াদৌড়ি না করলে হয় না। অনেক তো হলো, বসে বসে খাওয়া। আর কত? শরীরের ব্যালেন্স ঠিক রাখতে হবে না? এই মামলা ব্যতীত আপনার আর কোনো কাজ না থাকলে, আপনি চাইলে রেস্ট নিতে পারেন। কাজে অসুস্থতার এন্ট্রি হওয়ার আগে সুস্থতার দিকে লক্ষ্য রাখা উচিত। আপনি ফাইলগুলো আমার কাছে পাঠিয়ে দিন। আমি অনেক্ক্ষণ থাকবো এখানে।”
“জ্বি, স্যার। অপারেটিং রুমে কাজ একটু বাকি আছে। শেষ হতেই আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি। রাগিব স্যার ইন্সট্যান্ট যোগাযোগ করতে বলেছিলো স্যার।”
“আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। কে কে আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে আমি দেখেছি। কথা বলে নিবো সবার সাথে। এখানকার কোনো ইনফরমেশন থাকলে সেটা বলতে পারেন।”
“এখানে আর তেমন কি। এডভোকেট সকলের ধারে ধারে ঘুরছে, উনারা জানাচ্ছেন আপনি যেহেতু কাজটা হাতে নিয়েছেন সেহেতু তার দায়ভার আপনার উপর।”
“ওকে।”
আবরার ডি. ডি. কে মেইলে ইনফর্ম করতে লাগলো মামলার ব্যাপারটা। এরই মধ্যে আবার এডভোকেটের আগমন! আবরারের রুমে ছুটে আসতে চেয়েও বাঁধা পেয়ে গেলেন। গার্ড আটকে দিয়েছে তার পথ।
“স্যার জরুরী কাজে ব্যস্ত আছে। আপনি ভেতরে যেতে পারবেন না এখন।”
“আমিও জরুরি কাজেই এসেছি স্যারের কাছে।”
“সেখানে বসে অপেক্ষা করুন৷ সময় হলে ডাকা হবে।”
নিরুপায় এডভোকেট! কোথাও তার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা মানুষকে অপেক্ষা করতে হয়, আবার কোথাও কারো জন্য অপেক্ষা করতে করতে তার এনার্জি ফুরিয়ে যায়। অথচ যেই আতিথেয়তার এক সম্পর্ক বাঁধানোর চেষ্টা করেন তিনি বড় বড় কর্মকর্তাদের সাথে, সেই হিসেবে হয়তো একটু বেশিই সম্মান পাওয়ার প্রত্যাশা করেছিলেন তিনি। যেটা মোটেও পাওয়া হচ্ছে না আবরারের কাছে৷ আতিথেয়তার সেই প্রচেষ্টাটুকু যেন ব্যর্থ ফলাফল প্রকাশ করলো। অথচ তিনি এইটুকু উপলব্ধি আগে করতে পারেননি যে, আইনের কাছে তার অপরাধটুকুও যে কখনো বা কারো কাছে অপরাধ হিসেবেই আখ্যায়িত হবে৷ কোনো বন্ধুত্বের ছোঁয়ায় অপরাধ ঢেকে যাবে না। বরং বাড়াবাড়ি করে ঘাটতে গেলে দুর্গন্ধ ছড়াবে!
আবরার ঠিকই ব্যস্ত ছিলো সময়টাতে। মেইল পাঠানোর পরপর ফোনকলে কথা হলো রাগিব স্যারের সাথেও। তারপর কিঞ্চিৎ সময় দেওয়া হলো এডভোকেটকে। এডভোকেট ভেতরে ভেতরে তার উপর ক্ষিপ্ত থাকলেও উপরে যথেষ্ট শান্ত মনোভাবে কথা জমালেন,
“কি থেকে কি হলো স্যার? কিছুই মাথায় ধরছে না।”
“ঘোলাটে কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি তো হতে দেখিনি এডভোকেট সাহেব। সবটা চোখের সামনে পরিষ্কার।”
“এটা কোনো চক্রান্ত, স্যার। আপনি জানেন আমার সম্পর্কে, সমাজে আমার নামডাক কেমন সেটা আশপাশের সবাই-ই জানে স্যার। আপনারা খুব সুন্দরভাবে এই চক্রান্ত সামনে নিয়ে আসতে পারবেন আমার বিশ্বাস।”
“প্রথমত, আপনাকে আপনার চেয়ে ভালো কেউ চিনে না। আমাকে আমার চেয়ে ভালো কেউ চিনে না। পার্সোনাল ইমেজটা পার্সোনালভাবেই পার্সোনালিটিতে থেকে যায় এডভোকেট সাহেব। বাইরের মানুষ শুধুমাত্র আমাদের ফেসটা চিনে রাখতে পারে। এরচেয়ে বেশি খুব একটা নয়। দ্বিতীয়ত, আপনার বিশ্বাস আমি রাখতে পারবো কি পারবো না। সেটা আমি একদমই জানি না। কিন্তু, আইনের বিশ্বাস আমি পরিপূর্ণভাবে ধরে রাখার চেষ্টা করে যাবো ইনশাআল্লাহ।”
এডভোকেট আব্দুল মান্নান যেন এইটুকুতেই দমে গেলো। ভেতরে কি ওতরাচ্ছে, ভাবার সময় নেই আবরারের। সে কাজের সময় খুব একটা নষ্ট করতে চাইছে না আলোচনায় বসে। তাই বললো,
“আপনি কি প্রয়োজনে এসেছেন, সেটা বলুন। খুব একটা সময় হয়তো আমি আপনাকে দিতে পারছি না কাজের সময়। আপনি কয়েকবার এসেছেন জেনে, আমি কাজে বিরতি নিলাম একটু।”
“স্যার, আমার ছেলে আর ভাই কোথায়?”
“যেখানে তাদের যাওয়ার কথা, সেখানে চলে গেছে অলরেডি।”
“স্যার, তারা জানতোই না কিছু। কোনোভাবে…”
“আপনি জানতেন তবে?”
কথার মাঝখানে বাঁধা পেয়ে গেলেন আব্দুল মান্নান। তিনি ধীর গলায় সেই একই কথা আবার বললেন,
“মানুষের উন্নতি তো লোকের চোখে সয় না। আমাদের কসমেটিকস প্রোডাক্ট নিয়ে নিশ্চয়ই কেউ দুর্নীতি করেছে। কেউ আমাদের ফাঁসিয়ে দেওয়ার জন্য এমনটা করেছে। আইনের প্রতি আমার খুব বিশ্বাস। আমাদের নিশ্চয়তা দিতে আপনারা পারবেন স্যার। আমি আমার ছেলে আর ভাইকে সাথে নিয়ে যেতে চাই স্যার।”
“নিশ্চয়ই। সেজন্য আপনাকে আমি কোর্টে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।”
“স্যার, ঝামেলায় জড়াতে চাইনা। আমার ছেলেটা মাত্র পড়াশোনা শেষ করতে যাচ্ছে, ভাইটাকেও তো দেখেছেন। বয়স কম, ব্যবসাবাণিজ্য বুঝে উঠতে শিখেছে।”
“জ্বি, দেখেছি। শুরুতেই শিক্ষাটা একটু পাকাপোক্ত হওয়া দরকার ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য।”
“স্যার, ওভাবে বলবেন না। চক্রান্ত সম্পর্কে আপনাদের ধারণা তো…”
“আমি কোনোভাবেই এখন আর বলতে চাইছি না, এডভোকেট সাহেব। আপনি কোর্টে আসবেন। ইনশাআল্লাহ, দ্বিতীয় বার কোর্টে দেখা হবে আপনার সাথে। সারাদিন হয়তো অনেক পরিশ্রম করেছেন। বাসায় গিয়ে রেস্ট নিতে পারেন।”
সুন্দর বিদায়বার্তা দিয়ে দিলো আবরার! পরবর্তী সময় ব্যস্ততার খাতায় লিপিবদ্ধ করতে মামলাজনিত ফাইলগুলোও এসে গেছে। ক্লান্ত, হৃদয়ভাঙা এডভোকেট সাহেব ব্যর্থতা নিয়ে ফিরে গেলেন। এরপর বারকয়েক এধার ওধার ঘুরেও আর কোনো কাজ হয়নি। এডভোকেটের প্রথম ছোটাছুটিতে আবরারকে কর্মকর্তারা খুঁজলেও মামলাজনিত তথ্যের সত্যতা ও যৌক্তিকতা আবরারের কাছ থেকে জেনে উপর থেকে তার উপরও আর কোনো চাপ সৃষ্টি হয়নি। পরিকল্পিত এ কার্যে আবরার সফলতা অর্জন করে। আদালতের বিচারকার্যে ইলিয়াস ও আব্দুল মোতালেবের দণ্ডরায় হয়। কোথায় সম্মান, কোথায় আইন আর কোথায় আতিথেয়তা রয়? আতিথেয়তায় আইন কব্জা হয় না, কখনো কখনো তা-ও যে প্রমাণিত হয়।

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here