লাবণ্য_আলোয় #পর্ব_২

0
255

#লাবণ্য_আলোয়
#পর্ব_২

বাসায় যখন ফিরলাম, ঘড়িতে তখন রাত পৌনে দশটা। আমি আর লাবণ্য ছাড়াও আমাদের আরও চার বন্ধু এসেছে সাথে। বাড়ির কেউ এখনও কিছু জানে না। মা এসে খুব ভালোভাবে কথা বললেন সবার সাথে। বাইরে থেকে খাবার আনালেন সবার জন্য।
কাচ্চি আর বোরহানি খেয়ে সবাই বিদায় নেওয়ার পর, আমার বুকের ধড়ফড়ানির পাশাপাশি, পা কাঁপাকাঁপিও শুরু হয়ে গেল।
আমার অবস্থা দেখে লাবণ্য আমার হাত চেপে ধরে বলল, “এই তুমি এত কাঁপছ কেন? পড়ে যাবে তো।”
মিনমিনে গলায় বললাম, “সবাই এখনই জেনে যাবে লাবণ্য। তখন কী হবে?”
বলতে না বলতেই মা আর ছোঁয়া এসে ঢুকল লিভিংরুমে। দুজনের হাতে আজকের শপিং ব্যাগগুলো, যেগুলোর ছবি আমি সকালেই পেয়ে গেছি ।
মা বললেন, “শুভ্র দেখ, আজকে কী কেনাকাটা করেছি।”
কথাটা বলেই মা’র চোখ পড়ল লাবণ্যর ওপর। মা খুব বেশি অবাক হয়ে বললেন, “তুমি যাওনি এখনও!”
লাবণ্য উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “না আন্টি।”
মা আমার দিকে কটমট করে তাকাতেই আমি মাথা নীচু করে ফেললাম। আজকে বোধহয় আমি মা’কে একটু বেশিই ভয় পাচ্ছি!
মা বললেন, “এত রাতে তুমি এখানে কী করছ? তুমি একা বাসায় ফিরতে পারবে তো?”
লাবণ্য মা’র কথার উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল। মা বিরক্ত হয়ে বললেন, “তোমার ফ্যমিলি পারমিশন দেয় এত রাত অবধি বাইরে থাকার!”
লাবণ্য বলল, “আন্টি আপনি বসেন। আমি একটু কথা বলব আপনার সাথে।”
মা অবাক হয়ে তাকাল লাবণ্যর দিকে। লাবণ্যের ভীতসন্ত্রস্ত মুখ দেখে মা বললেন, “কী বিষয় বলো তো? তোমাকে এমন নার্ভাস লাগছে কেন, তুমি ঠিক আছ তো?”
“আন্টি প্লিজ আপনি বসেন।”
লাবণ্য’র বলার ভঙ্গিতে এমন কিছু ছিল যে মা আর কোনো কথা না বলে, সোফায় বসলেন ।
মা, সোফা বসে আমাকে বললেন, “এই শুভ্র কী হয়েছে, ঠিক করে বল তো? এই মেয়ে তো আমার টেনশন বাড়িয়ে দিচ্ছে। এই তুমি কী বলবে, জলদি বলো।”
লাবণ্য বলল, “আন্টি আমি জানি আপনি আমাকে পছন্দ করেন না। অবশ্য কেন পছন্দ করেন না, সেটা জানি না।”
মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন, “ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা না বলে, সোজা কথা বলো। অনেক রাত হয়েছে। তোমাকে তো বাসায়ও যেতে হবে।”
লাবণ্য বলল, “জি আন্টি।”
“জি আন্টি” বলার পরও লাবণ্য কিছু বলল না। মা পাক্কা তিন মিনিট সময় দিলেন। এরপর মা লাবণ্যকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলতে শুরু করলেন, “শুভ্র জানিস, আজকে তোর আর ডিম্পলের বিয়ের কেনাকাটা করার জন্য বেরিয়েছিলাম। ও হ্যাঁ শোন, তোকে তো বলা হয়নি, আমি কিন্তু ওদেরকে কথা দিয়েছি, আগামীকাল বিকেলে আমরা ওদের বাসায় আকদের জন্য.…”
মা’কে থামিয়ে দিয়ে লাবণ্য বলল, “ঠিক আছে আন্টি, আমি সোজা কথাই বলছি।”
মা, হাতের প্যাকেটটা কোলের ওপর রেখে বললেন, “বলো কী বলতে চাও।”
লাবণ্য বলল, “আন্টি, আজ দুপুরে আমরা বিয়ে করেছি।”
মা কথাটা বুঝতে না পেরে বললেন, “কারা বিয়ে করেছে, এই আমরা কারা! এই শুভ্র, ও কার কথা বলছে রে?”
লাবণ্য কটমটে চোখে আমার দিকে তাকাতেই, আমি উঠে দাঁড়ালাম ।

মা বোধহয় এতক্ষণে দুই এ দুই এ চার মেলাতে পারলেন। আমার দিকে এমন ভাবলেশহীনভাবে তাকালেন যে আমি বুঝতেই পারলাম না মা’র মনের ভেতর কী কাজ করছে। কিছুক্ষণের জন্য আমার ভাবনার জগৎ থেমে গেল।
ক্ষানিকটা সময় কেটে যাওয়ার পর, মা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “শুভ্র, তোরা কি বিয়ে করেছিস?”
গলা দিয়ে শব্দ বেরোচ্ছিল না। খুব জোর দিয়ে বললাম, “মা আমরা আজ দুপুরে বিয়ে করেছি।”
নিজের গলার আওয়াজে নিজেই চমকে গেলাম, আর মা থমকে গেলেন আমার কথা শুনে। ভালো-মন্দ কিছু না বলে, মা উঠে নিজের রুমে চলে গেলেন। সজোরে রুমের দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ শুনে শুধু আমাদেরই না, প্রতিবেশীদেরও বোধহয় পিলে চমকে গেল এত রাতে। ছোঁয়াও চলে গেল ওর রুমে, আর শপিং ব্যাগগুলো অলস ভঙ্গিতে ওখানেই পরে রইল। এই প্রথম আমার মনে হলো, আমি একটা ভুল করে ফেলেছি। বাবা-মা’র অমতে এভাবে বিয়ে করা একদম উচিত হয়নি; কিন্তু পরিস্থিতিই এমন ছিল যে আমার অন্য কিছু করারও ছিল না।
মা চলে যাওয়ার দশ মিনিট পর বাবা রুমের দরজা খুলে আমাকে ডাকলেন। আমি লাবণ্যর দিকে তাকাতেই সে বলল, “বসে আছ কেন? আংকেল কী বলছেন, শুনে আসো।”
আমি ডাইনিং টেবিলের সামনে দাঁড়ালাম। বাবা তাঁর রুম থেকে বেরিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন; কিন্তু কোনো কথা বলছেন না। আমার গাল দুটো হঠাৎ শিরশির করে উঠল। মনে হচ্ছে বাবা এখনই আমার মুখে চড় বসিয়ে দেবেন। বাবা তেমন কিছুই করলেন না। শুধু আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, “আমার ছেলে যে এত বড়ো হয়ে গেছে, আমি বুঝতেই পারিনি।”
বাবার বলার ভঙ্গিতে এতটাই হতাশা ঝরে পড়ল যে, আমার নিজেরই এখন দুই গালে চড় মারতে ইচ্ছা করছে। মনে হচ্ছে মাথার চুলগুলো টেনে ছিঁড়ে ফেলি! বাবা’র হাত ধরে বললাম, “ভুল হয়ে গেছে বাবা।”
বাবা, আমার হাতটা ছাড়িয়ে দিয়ে রুমের দিকে চলে গেলেন, আর আমিও ক্লান্ত ভঙ্গিতে লাবণ্যর কাছে ফিরে এলাম।
লাবণ্য জিজ্ঞেস করল, “আংকেল কী বললেন? বকা দিয়েছেন?”
আমি শুধু হাসলাম, ওর কথার উত্তর দিলাম না। লাবণ্য বলল, “আমার জন্য তোমাকে অনেক ঝামেলায় পড়তে হল। স্যরি শুভ্র।”
“স্যরি বলছ কেন? যা কিছু হয়েছে, দু’জনের ইচ্ছাতেই হয়েছে।”
এরপর দুজনের কেউই অনেকক্ষণ কোনো কথা বললাম না। হঠাৎ নাইটগার্ডের বাঁশির আওয়াজ কানে আসলে, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, রাত একটা বাজে। লাবণ্যর দিকে তাকিয়ে দেখলাম বেচারি বসে বসে ঝিমাচ্ছে। ওকে ডেকে বললাম, “এখন কী করব?”
লাবণ্য হাই তুলে বলল, “তোমার রুমে চলো।”
“রুমে যাব?”
“মানে কী! আমরা কী এখানে সারারাত বসে থাকব নাকি? মশার যন্ত্রণায় তো বসাও যাচ্ছে না। তুমি তো সবই আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছ। আন্টিকে তো বলেই দিলাম আসল ঘটনা। এখন রুমে যেতে সমস্যা কোথায়? তোমার রুম কোনটা?”
সাহস করে কথাটা বললাম, “লাবণ্য আমি বলছিলাম কী, আজকে নাহয় তোমাকে তোমাদের বাসায় দিয়ে আসি…”
লাবণ্য সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙ্গে বলল, “তোমার মাথা ঠিক আছে তো? তুমি রুমে না গেলেও সমস্যা নাই। এখানেই বসে থাকো; কিন্তু আমার খুব বেশি টায়ার্ড লাগছে। সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় কেটেছে। আমি এখন ঘুমাব। প্লিজ আমাকে রুমটা দেখিয়ে দাও।”
এরপর আর বলার মতো কোনো কথা থাকে না। বিয়ে যেহেতু করেই ফেলেছি, লাবণ্যকে রুমে নিয়ে যেতে কোনো বাধা নেই। তাছাড়া বাধানিষেধে কোনো কাজ হবে না। যে মেয়ে এমন আচমকা সিদ্ধান্ত নিয়ে বিয়ে করতে পারে, সে অনেক কিছুই করতে পারে। অগত্যা লাবণ্যকে নিয়ে আমার রুমে চলে এলাম ।

রুমে ঢুকতে না ঢুকতেই লাবণ্য’র হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিলো। আমি ভীষণ ঘাবড়ে গেলাম। হঠাৎ আবার কী হলো! কী করব, কিছুই বুঝতে পারছি না। জিজ্ঞেস করলাম, “কী হলো, এভাবে কাঁদছ কেন লাবণ্য?”
আমার কথার কোনো উত্তর নেই।
আমি লাবণ্যকে জড়িয়ে ধরে বললাম, “সবই তো তোমার ইচ্ছা মতোই হলো, তাহলে এভাবে কাঁদছ কেন? আমার কোনো ভুল হয়েছে?”
লাবণ্য কিছু বলতে গেল; কিন্তু কান্নার দমকে সে কোনো কথাই বলতে পারল না। আমি লাবণ্যর কান্না থামার অপেক্ষায় বসে রইলাম ওর হাতদুটো ধরে। পাক্কা দশ মিনিট পর কান্না থামলে সে যা বলল, তাতে আমার আক্কেল গুড়ুম! বলে কি না বাবা’র জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে, বাবা’র কাছে যাব। এবার মনে হলো আমি চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করি।
আমি বললাম, “বাবা’র কাছে এখন কী করে যাই, বলো? বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছ, এখন যদি আমাকে নিয়ে গিয়ে হাজির হও, তাহলে অবস্থাটা কী হবে, কল্পনা করেছ?”
“কিচ্ছু হবে না। আমার বাবা অনেক ভালো। তোমাকে অনেক আদর করবে, তোমাকে মেনে নেবে, দেখো।”
আমি বললাম, “কিচ্ছু তো তোমার হবে না সোনা। মেয়ের কান্না দেখে বাবা ঠিকই গলে যাবেন। মাঝখান দিয়ে আমি ফেঁসে যেতে পারি। দেখা যাবে আমাকে ধরতে পুলিশ এসে হাজির হয়ে যাবে।
“আমার বাবা এমন না, কক্ষোণো না।”
“তাহলে পালালে কেন? আমি তো আগেই বলেছিলাম , চলো তোমার বাবা’র কাছে গিয়ে বুঝিয়ে বলি। তখন তো বললে, বাবা মেরেই ফেলবে তোমাকে। তাহলে এখন এত কান্না করছ কেন?”
আমার কথা শেষ হতেই, লাবণ্য আবারও কান্না শুরু করে দিলো। অনেকবার স্যরি বলে এবং কাল সকালেই বাবা’র কাছে নিয়ে যাব বলে প্রমিস করার পর, সে শান্ত হয়ে শুয়ে পড়ল, আর আমি তার মাথার কাছে বসে চুলে বিলি কেটে দিতে লাগলাম। একসময় ঘুমিয়ে পড়ল লাবণ্য; কিন্তু আমার আর ঘুম এল না। জীবনের এতবড়ো একটা সিদ্ধান্ত এভাবে নিলাম, কাজটা কী ঠিক করলাম, এরপর কী হতে পারে, মা’র রাগ কীভাবে ভাঙাবো এইসব ভাবতে ভাবতে ভোর হয়ে এল। সারাদিনের ক্লান্তি, টেনশন, সারারাত জেগে বসে থাকা, এই সবকিছু মিলে ভীষণ ক্লান্তি ভর করল আমার দুচোখে। বসে থাকা অবস্থাতেই লাবণ্য’র বালিশে মাথা রেখে আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম একসময় ।

মোবাইলটা কতকাল ধরে বাজছিল কে জানে। রাতে ভলিউম কমিয়ে শুয়েছিলাম, তাই এতবার রিং হয়েছে; কিন্তু আমি শুনতেই পাইনি। আমার যখন ঘুম ভাঙল তখন সে শেষবারের মতো ডেকে ডেকে থামল মাত্র । মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি নিলয়ের উনিশটা মিসড কল! নিলয়, লাবণ্যর ছোটো ভাই। ও কেন আমাকে এতবার ফোন করবে! খাটে লাবণ্যকে দেখে আরও চমকে উঠলাম! ও এখানে কী করছে, বুঝলাম না। কিছুই মনে আসছে না। একটু ধাতস্থ হতেই গতকালের ঘটনাগুলো সব ভেসে উঠল চোখের সামনে। তারপরেই মনে পড়ল মিসড কলের কথা। তাড়াতাড়ি লাবণ্যকে ডেকে তুলে বললাম নিলয়ের ফোন করার কথা। নিলয়কে ফোন করেই লাবণ্য চিৎকার দিয়ে উঠল। ওর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে ভয়ে ভয়ে কানে ধরলাম, “হ্যালো নিলয়…”
“ভাইয়া কোথায় ছিলে এতক্ষণ?”
“ঘুমাচ্ছিলাম৷ কী হয়েছে নিলয়? এতবার ফোন করেছ কেন?”
“বাবা হাসপাতালে। আপুকে নিয়ে চলে আসো এক্ষুণি।”
ফোনটা রেখে পাঁচ মিনিটে তৈরি হয়ে লাবণ্যকে নিয়ে রওনা দিলাম হাসপাতালে। আসার সময় বাড়ির কারও সাথেই আমাদের দেখা হল না।
শিউলিকে বললাম, “মা যদি কিছু জিজ্ঞেস করে তাহলে যেন বলে, আমরা হসপিটালে গিয়েছি।”

হাসপাতালে পৌঁছে রুমে মাত্র ঢুকেছি, দেখি শ্বশুর আব্বা বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় আছেন। পাকানো গোঁফের সাথে রাশভারী চেহারাটা দেখে, আমার বুকটা হিম হয়ে গেল। আশেপাশের সবাই আমার দিকে এমন করে তাকাচ্ছে যেন আমিই সব নষ্টের গোড়া। লাবণ্য ছুটে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে আবারও কান্না শুরু করে দিল। আংকেল শুরুতে মুখটা গম্ভীর করে রাখলেও, কিছুক্ষণ পর তিনিও কান্না শুরু করে দিলেন। মেয়ে যতো কাঁদে, বাবা তত কাঁদে। লোকজনের কথাবার্তায় বুঝলাম, মেয়ের এভাবে বাড়ি ছেড়ে চলে আসাটা তিনি একদম মানতে পারেননি। আদরের একমাত্র মেয়ের দেয়া আঘাত সইতে পারেননি আংকেল। আংকেল ডায়াবেটিস রুগী, সময়মতো ইনসুলিন নেওয়া হয়নি আর খাবার খাননি বলে ডায়াবেটিস কমে গিয়েছিল মারাত্মক রকমের। তার ওপর বুকে তীব্র ব্যাথা। সবকিছু মিলে অবস্থা বেশ খারাপ হওয়ায়, ভোরবেলায় ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

আমি দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে আছি। ভেতরে ঢুকতে সাহস হচ্ছে না। রুমে উপস্থিত থাকা আত্মীয়স্বজনেরা নিজেদের মধ্যে নীচু স্বরে কথা বলছেন আর একটু পর পর আমার দিকে তাকাচ্ছেন। মনে হচ্ছে আমি যেন মস্ত বড়ো কোনো ক্রিমিনাল। আমার মনে হলো, এখান থেকে এখন চলে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পেছনে ঘুরতেই, কে যেন খপ করে হাতটা চেপে ধরে বলল, “বাবা এই যে আপুর হাসব্যান্ড, শুভ্র ভাইয়া।”
তাকিয়ে দেখি, শালা মশাই। মনটা চাচ্ছিল কানটা ধরে… থাক মনের চাওয়া মনেই থাক। আমি নিজেই এখন আছি দৌড়ের ওপর। অন্যকে মারামারির মতো শক্তি অবশিষ্ট নেই।
নিলয় আমাকে টানতে টানতে আংকেলের সামনে নিয়ে গেল। কী বলব বুঝতে পারছি না। সালাম দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। কঠিন ধমক খাওয়ার অপেক্ষা করছি; কিন্তু তিনি কোনোরকম বকাঝকা না করে, ইশারায় আমাকে তাঁর পাশে বসতে বললেন। আমি তাঁর মাথার কাছে রাখা টুলে বসে, মাথা নীচু করে আছি। কী বলে যে অপমান করবেন আল্লাহ্ জানেন! আমার সাথে অন্য সবাইও অপেক্ষায় আছে কী হয় দেখার জন্য।
অবশেষে তিনি বললেন, “মা-বাবা’রা তোমাদের অনেক স্বপ্ন নিয়ে বড় করেন। এখন তো দিন অনেক পাল্টে গেছে। ছেলেমেয়েরা নিজেরাই জীবনসঙ্গী পছন্দ করে। বাবা-মায়েরা এখন আর অমত করেন না সব যদি মোটামুটি ঠিক থাকে।”
আংকেল লাবণ্যর হাত ধরে বললেন, “তুমি একবার অন্তত আমাকে জানাতে পারতে।”
লাবণ্য কিছু না বলে চোখের পানি মুছল।
আংকেল আমাকে বললেন, “আমি আমার মেয়েকে কতটা ভালোবাসি, এটা ঠিক বলে বোঝাতে পারব না। কাল অনেক রাত হয়ে যাওয়ার পরও যখন লাবণ্য ফিরছিল না, তখন নিলয় আমাকে কথাটা জানালো। আমার মনে হয়েছিল, আমি বোধহয় তখনই মারা যাব। আঁধার দেখছিলাম চারদিকে। মেয়ের বিয়ে নিয়ে কত কল্পনা করছিল ওর মা। কয়দিন ধরেই মেয়ের বিয়ের কথা হচ্ছিল বাসায়। কিন্তু আমি তো ভাবতেই পারি না লাবণ্য ছাড়া আমার বাড়িটা। তাই ওর মা বিয়ের কথা বললেই রাগ হয়ে যেতাম। আমার মেয়েটা আমার পুরো বাড়িটা আলো করে রাখে। সেই আলো যদি হঠাৎ নিভে যায়, কেমন যে লাগে, তুমি বুঝবে না। বুঝবে ঠিকই যেদিন তোমার ঘরের আলো এমন নিভে যাবে।”

খুব মন খারাপ হলো ওনার কথাগুলো শুনে, আর কী আশ্চর্য, আমার কেমন যেন কান্না পাচ্ছে এখন! আমি মনে হয় ওনার কষ্টটা অনুভব করতে পারছিলাম কিছুটা।
শুধু বললাম, “স্যরি আংকেল, ভুল হয়ে গেছে।”
আংকেল বললেন, “কিছু কিছু ভুল থাকে যেগুলো স্যরি বললেই মিটে যায় না, বাবা।”
কী বলব, বুঝতে না পেরে বোকার মতো হেসে বললাম, “জি আংকেল, বুঝতে পারছি।”
“যাই হোক কাজটা যখন করেই ফেলেছ, এখন তো আর কিছু করার নেই। ঠিক আছে, আমি বাসায় ফিরে যাই, তারপর দুই পরিবার মিলে কথাবার্তা বলে ঠিক করব, কীভাবে কী করা যায়।”
আমি ওনার হাত ধরে আবারও স্যরি বললাম। এবার আংকেল আর কোনো কথা বললেন না, চোখ বন্ধ করে ফেললেন। আমার মনে হলো ওখান থেকে চলে আসাটাই এখন উত্তম। অফিসে একবার যেতেই হবে, এই দোহাই দিয়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। লাবণ্যকে বললাম, “তুমি থাকো, আমি রাতে আসব।”
বাবাকে পেয়ে লাবণ্যর কান্নাকাটি বন্ধ হয়েছে। এতক্ষণে তার মনটা বেশ ফুরফুরে হয়েছে, চেহারা দেখে সেটাই মনে হচ্ছে। নানা রকম দুশ্চিন্তা এবং মন খারাপের মাঝেও লাবণ্যর হাসিমুখ দেখে ভালো লাগল।

হসপিটাল থেকে বেরিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। মিশ্র একটা অনুভূতি কাজ করছে মনে। আমাদের বিষয়টা যে আংকেল এত সহজভাবে মেনে নেবেন, এতটা আমি আশাই করিনি। তবে আমার মা যে শেষ পর্যন্ত কী করবেন, আমি কিছুই অনুমান করতে পারছি না। মা’কে নিয়েই এখন যত ভয়। থাক এখন আর টেনশন করতে ইচ্ছা করছে না। যা হবে, সেটা ভবিষ্যতের জন্য তোলা থাকুক। লাবণ্যকে ছেড়ে যেতে মনটা কেমন যেন করছে! একদিনের ব্যবধানে এই সম্পর্কটা এভাবে পালটে গেল, এই পালটে যাওয়া সম্পর্কটা কেমন একটা অধিকার তৈরি করে দিয়েছে। সত্যি ভীষণ ফাঁকা লাগছে চারপাশটা। মনে হচ্ছে, আমার কী যেন রয়ে গেল পেছনে। অদ্ভুত এক পিছুটান নিয়ে অফিসের পথে রওনা দিলাম আমি।

চলবে

#ফারজানাইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here