লাবণ্য_আলোয় #পর্ব_৩

0
240

#লাবণ্য_আলোয়
#পর্ব_৩

হাসপাতালের বাইরে তো চলে এলাম; কিন্তু এখন ঠিক বুঝতে পারছি না কোথায় যাওয়া যায়। মাত্রই গতমাসে চাকরিতে ঢুকেছি, এরই মধ্যেই আজ অনুপস্থিত হয়ে গেলাম! একবার যেতে পারলে ভালো হত; কিন্তু এই সময়ে গিয়ে আর কোনো লাভ নাই। বন্ধুবান্ধবদের কাউকেই এই সময় পাওয়া যাবে না। সবাই যার যার মতো ব্যস্ত দিন শুরু করেছে। তাই আর সময় নষ্ট না করে বাসায় যাওয়াই ঠিক করলাম। বাসে উঠে বসার পর বুঝতে পারলাম প্রচন্ড ব্যথায় মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে একেবারে। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বাসায় পৌঁছেই নিজের রুমে ঢুকে ব্যথার ওষুধ খেয়ে একেবারে বিছানায় আশ্রয় নিলাম।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছি বলতে পারব না। ঘুম ভাঙার পর জানালার দিকে তাকিয়ে দেখি, দিনের আলো বিদায় নিচ্ছে। আমার রুমের জানালা দিয়ে এখনও অনেকটুকু আকাশ দেখা যায়। ঢাকার মানুষেরা এখন আর জানালার ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখতে পায় না। ঘুম ভেঙে এই আকাশ দেখাটা আমার খুব ভালো লাগে।
শুয়ে আছি চুপচাপ, আকাশের লাল আভাটুকু মিলিয়ে যাওয়া দেখছি, মনে হলো দরজা ঠেলে কেউ একজন ভেতরে ঢুকল। আমি তেমনই শুয়ে থাকলাম, যে আসে আসুক। গতকালের ঘটনার পর বাড়ির কারো সাথে আমার কথা হয়নি। সকালে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ও দেখেছিলাম মা’র রুমের দরজা বন্ধ। ছোঁয়া তখন বোধহয় ভার্সিটিতে ছিল অথবা ওর রুমে।
পিঠে কেউ হাত রাখতেই ফিরে তাকালাম।
ছোঁয়া বলল, “ভাইয়া কোথায় গিয়েছিলি সকালে? লাবণ্য আপু কোথায়?”
“আছে।”
“কোথায় আছে?”
“সে সব তোদের জানতে হবে না।”
“ভাইয়া, তুই আমার ওপর রাগ করছিস কেন? আমি কী করেছি!”
আমি কোনো কথা বলছি না দেখে ছোঁয়া আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলল, “এই ভাইয়া ওঠ তো, উঠে বস। বাড়ি এসে এমন এক ঘুম দিলি, যে একেবারে সন্ধ্যা নামিয়ে ফেলেছিস!”
উঠে বসলাম বিছানায়। লম্বা ঘুমের কারণে মাথা ব্যথাটা কমে এসেছে।
ছোঁয়া আমার হাত ধরে বলল, “লাবণ্য আপু কোথায়, বল না?”
“লাবণ্য হাসপাতালে।”
“মানে কী! হাসপাতালে কেন?”
যা কিছু ঘটেছে সব বললাম ছোঁয়াকে। সে চুপচাপ সব কথা শুনল।
ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “মা কোথায় রে?”
“রুমে আছে, সামনের ফ্ল্যাটের আন্টি এসেছেন। ওনার সাথে কথা বলছে। মা সারাদিন কারো সাথে কথা বলেনি। মা যে কেন এমন করছে কিছুই বুঝতে পারছি ন। এখন কী হবে রে ভাইয়া?”
“বাবা কিছু বলেছেন?”
“না, বাবা তেমন কিছু বলেনি। বাবা দু’একবার মা’কে বুঝানোর চেষ্টা করেছিল যে বিয়ে যখন হয়েই গেছে তখন এত রাগ করার দরকারটা কী? মা তো বাবাকে কোনো পাত্তাই দিল না। এখন বাদ দে ওসব। যা হবে পরে দেখা যাবে। তুই আগে ওঠ, খেতে চল। আমি সেই কখন থেকে অপেক্ষায় আছি তোর ঘুম ভাঙার। খুব ক্ষিদে পেয়েছে, ওঠ না তাড়াতাড়ি।”
“তুই এখনও না খেয়ে আছিস কেন?”
“দুপুরে সবাই বাসায় থাকলে আমরা কেউ কী একা খাই? আমি বাসায় এসেই দেখলাম তুই আছিস। শিউলিকে জিজ্ঞেস করলাম তুই খেয়ে ঘুমিয়েছিস কি না। আজ কী অফিস মিস দিলি, নাকি ছুটি নিয়েছিস? আচ্ছা পরে বলিস। নে ওঠ, ওঠ তাড়াতাড়ি।”

হাতমুখ ধুয়ে ডাইনিং রুমে এসে বসলাম। এই অবেলায় একদম ভাত খেতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। শুধুমাত্র ছোঁয়া না খেয়ে অপেক্ষা করছে দেখে অল্প খাবার নিলাম। লাবণ্য খেয়েছে কি না, কে জানে। ওর সাথে একবার ফোনে কথা বলে নিলে ভালো হত। খাওয়া শেষ করে আগে লাবণ্যকে ফোন করতে হবে।
আমরা দুজন খাচ্ছি আর কথা বলছি এমন সময় মা’র রুমের দরজাটা খুলল। রোকেয়া আন্টি বেরিয়ে এসে সামনে দাঁড়ালেন। কিছু বলার আগে তিনিই বলে উঠলেন, “কী বাবা, খুব নাকি বড় হয়ে গেছ। নিজের বিয়ে নিজেই করে বসে আছ। ভালো তো, খুব ভালো।”
কথাটা বলেই তিনি আর দাঁড়ালেন না। আন্টি চলে যাওয়ার পর মা তাঁর রুমে চলে গেলেন।
এত্তো রাগ হল মা’র ওপর! নিজে তো কথা বলছেই না, আবার পাড়াপ্রতিবেশির কাছে ঠিকই সব বলে বেড়াচ্ছে! ছোঁয়াকে বললাম, “কী রে আন্টি এভাবে কথা বললেন কেন? মা কী যাকে পাচ্ছে তাঁকেই বলে বেড়াচ্ছে নাকি!”
“আরে না । মা তো কারো সাথে কথাই বলছে না । রোকেয়া আন্টির তো আজকে আমাদের সাথে যাওয়ার কথা ছিল, ডিম্পলদের বাসায়। আকদ্ এ গেলে এখন কত শাহী খাবার খেতে পারতাম অথচ দেখ তুই এমন একটা কান্ড ঘটালি যে ডাল-ভাত খেতে হচ্ছে।”
ছোঁয়ার বলার ভঙ্গিতে দুই ভাইবোন খানিকক্ষণ খুব হাসলাম৷
খাওয়া শেষ করে রুমে এসে লাবণ্যকে ফোন করলাম। “হ্যালো লাবণ্য, আংকেল কেমন আছেন এখন?”
“বাবাকে ডিসচার্জ করে দিয়েছে। কিছুক্ষণ আগে আমরা বাসায় চলে এসেছি।”
“আচ্ছা। তুমি কেমন আছ লাবণ্য?”
“ভালো আছি। শুভ্র তুমি চলে এসো। আমার কিছু ভালো লাগছে না। সবাই যেন কেমন করছে আমার সাথে!”
“কোথায় আসব?”
“কোথায় আবার? আমাদের বাসায়।”
“বাসায় আসব মানে কী! হুট করে বাসায় আসা যায় নাকি?”
“আসলে সমস্যা কোথায়? তুমি বাবাকে দেখতে আসবে না?”
“আমি তো এখনই বের হচ্ছিলাম হাসপাতালে যাব বলে। বাসায় যখন চলে গেছ তখন আর আসব না।”
“কেন আসবে না? বাবা তো তোমাকে কিছু বলেইনি। তাহলে আসবে না কেন?”
“এখন যাওয়াটা কী ঠিক হবে লাবণ্য? তোমাদের বাসা ভরা লোকজন। তারা কী মনে করবেন বলো?”
“কেউ কিছু মনে করবে না। তুমি আসো তো, এখনই আসো।”
“একটু বুঝতে চেষ্টা করো। হুটহাট ডিসিশন নিয়ে একটা কাজ করে ফেলেছি। এখন আর জটিলতা বাড়াতে চাই না। আংকেল তো বলেছেন, তিনি সুস্থ হওয়ার পর সবাই একসাথে বসে কথা বলবেন। একটু ধৈর্য ধরে থাকো। দেখো দুই-চার দিনের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“আমি চলে আসি তাহলে? তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে।”
“হুম, তুমি আসো আর সাতসকালে আবার নিলয়ের ফোন আসুক, তাই না? তুমি বাবা তোমার বাবার আদরের মেয়ে হয়ে থাকো আরও কিছুদিন। আমি রাখছি এখন।”
“শুভ্র শোনো, শোনো শুভ্র….”

আমি আর কোনো কথা শুনলাম না, লাইন কেটে দিলাম। ফোনটা রাখতেই জোরে জোরে কথাবার্তার আওয়াজ শুনতে পেলাম । রুম থেকে বেরিয়ে দেখি, মা’র রুমে মা আর ছোটো খালা কথা বলছেন। যদিও দরজা ভেজানো; কিন্তু দু’জনেই এত জোরে কথা বলছে যে বাইরে থেকে সব স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি।
ছোটো খালা বলল, “আপা তোমার সমস্যাটা কী বলো তো? বিয়ে যখন করেই ফেলেছে তখন তো মেনে নেওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই। তাছাড়া মেয়েটাকে নিয়ে তোমার সমস্যা কোথায়, বুঝলাম না! আমি মেয়েটাকে দেখেছি। এত মায়াবী চেহারা, কথাবার্তায় এত ভদ্র একটা মেয়ে, আর তুমি কি না মেয়েটাকে সহ্যই করতে পারছ না।”
“তোর ছেলের সাথে বিয়ে দে যা। এতই যখন পছন্দ তোর।”
“দিতাম, সুযোগ থাকলে নিশ্চয়ই দিতাম। এখন আর সেই সুযোগ নেই। সম্পর্কটা মেনে নাও আপা। রাগ করে থেকো না আর।”
মা রাগ করে বললেন, “এই অন্য কথা বল তো। ঐ মেয়ের নাম শুনলে আমার মাথা গরম হয়ে ওঠে। আমি কিছুতেই মেনে নেব না এই বিয়ে।”
ছোটো খালা হতাশ গলায় বললেন, “আমার যা বলার ছিল, বললাম। তোমাকে সাবধান করে যাচ্ছি আপা, শেষে আবার ছেলে না হারাও।”
মা বললেন, “তুই কী আমাকে অভিশাপ দিচ্ছিস?”
“অভিশাপ দিচ্ছি না, সাবধান করছি। এত দম্ভ ভালো না আপা।”
আমি কোনো দম্ভ বা অহংকার করছি না। তোদের কাউকে আমি ঠিক বোঝাতে পারছি না আমার সমস্যাটা।”
“না বললে বুঝি কী করে, বলো তো? প্লিজ আপা বলো, তোমার সমস্যাটা কোথায়?”
“আমি বলতে পারছি না। তুই আমাকে জোর করিস না। আমি ওকে সহ্য করতেই পারছি না। তুই অন্য কোনো মেয়ে এনে দে। যে কেউ, যে কোনো মেয়ে। আমার সমস্যা নেই। শুধু এই মেয়ে না। আচ্ছা একটা কথা শোন, কাজরীর সাথে আমার কথা হয়েছে। শুভ্র যদি ঐ মেয়েকে ছেড়ে দেয় তো ডিম্পল ওকে বিয়ে করতে রাজি। তুই একটু বোঝাবি শুভ্রকে?”
এবার ছোটো খালা ধমক দিয়ে উঠল, “আপা! তোমার মাথাটা কী আসলেই গেছে! কী বলছ, বুঝে বলছ তো? ওরা ছোটো মানুষ। না বুঝে হুট করে বিয়েটা করে ফেলেছে, তাই বলে তুমি এমন অদ্ভুত কথা বলতে পারো না আপা।”
“এই তুই যা আমার সামনে থেকে, এখনই যা। তোকে দেখে আমার মাথা ব্যথা আরও বেড়ে যাচ্ছে।”
“নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনছ আপা। করো যা ভালো বোঝো। আমি আর কিছুই বলতে আসব না।”
ছোটো খালা আচমকা মা’র রুম থেকে বেরিয়ে আসায়, আমি আর লুকোনোর মতো সময় পেলাম না। খালার সাথে আমার চোখাচোখি হয়ে গেল।
আমাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খালা বলল, “কী রে কী অবস্থা তোর? লাবণ্য কোথায়?”
“ওদের বাসায়। খালা, মা’কে কী কোনোভাবেই রাজি করানো যায় না? মা এমন করছে কেন বলো তো?”
“তুই সব কথা শুনেছিস?”
“হুম।”
“আমিও কিছুই বুঝতে পারছি না রে। তুই এখন চুপচাপ থাক আর লাবন্যকেও বল ওদের বাড়িতেই থাকতে। আমি দুলাভাইের সাথে কথা বলে দেখি কিছু করা যায় কি না। তোর বাবা কই রে?”
“বাবাকে বারান্দায় দেখেছিলাম। বড় চাচার সাথে কথা বলছে। খালা প্লিজ তুমি বিষয়টা ম্যানেজ করো, প্লিজ খালা।”
“না বলে বিয়ে করার সময় মনে ছিল না?”
“স্যরি খালা।”
“তুই যা তোর কাজ কর, দেখছি আমি।” বলে খালা চলে গেল বারান্দার দিকে।

এরপর শুরু হলো জীবনে নতুন বিড়ম্বনা। লাবণ্যকে ফোন করলেই বলছে, ‘আমাকে নিয়ে যাও, না হয় তুমি চলে আসো।’ এদিকে মা, আমার সাথে একেবারেই কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন। যতবারই কাছে যাচ্ছি, যতবারই বলছি, ‘মা একটু শোনো, মা একবার শুধু তাকাও আমার দিকে।’ কিন্তু মা পাত্তাই দিচ্ছেন না।
এত মানসিক যন্ত্রণার ভার আমি নিতে পারছি না। কী করতে কী হয়ে গেল, ভাল্লাগে না কোনোকিছু। কী সুন্দর কাটছিল জীবন, হঠাৎ সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেল!

অফিসে এসেছি ঠিকই; কিন্তু কাজে মন বসছে না। একটু পর পর লাবণ্য’র ম্যাসেজ। রিপ্লাই দিচ্ছি না দেখে ফোন করছে বারবার। ফোন ধরতেই লাবণ্য’র বাবা কথা বললেন। অফিস শেষে যেন অবশ্যই ওনাদের বাসায় যাই। না করার কোনো সুযোগ দিলেন না আংকেল। কথা শেষ করে ফোন রেখে দিলেন। লাবণ্যকে দেখার জন্য আমার মনটাও খুব অস্থির হয়ে আছে। সন্ধ্যায় ওদের বাসায় যাব বলে মনস্থির করলাম।
সন্ধ্যা সাতটায় পৌছালাম শ্বশুরবাড়ি। “শ্বশুরবাড়ি” কথাটা মনে হতেই কেমন যেন লজ্জার অনুভূতি হচ্ছে। সাথে কী কিছু নেয়া উচিত হবে, খালি হাতে গেলে কেমন দেখায়, এই সব ভাবনাচিন্তার শেষে আমার পছন্দের মিষ্টি-সন্দেশ আর ফুলের একটা তোড়া নিয়ে ঢুকলাম বাড়িতে। বাড়িতে ঢুকে আমি পুরাই তাজ্জব! বাড়ি ভরা মানুষ। সবাই এসেছে নতুন জামাই দেখতে। আমি লজ্জায় কুঁকড়ে গেলাম। লাবণ্যর ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছে এখন। সে আমাকে একবার অন্তত বলতে পারত।
ড্রইংরুমের এক কোনায় চুপ করে বসে আছি। কোত্থেকে বিভিন্ন সাইজের আট-দশজন বালক-বালিকা এসে হাজির হলো। এরা সবাই নাকি আমার শালা-শালী! লাবণ্য’র ওপর এত্তো রাগ হচ্ছে যে কী বলব। একবারও আমাকে একটু ধারণাও দেয়নি যে বাড়িতে এমন হুলস্থুল কান্ড চলছে। আর আমি আসার পর থেকে সে একটিবারের জন্য উঁকিও দিলো না! কিছুক্ষণ পর লাবন্য’র বাবা রুমে এসে বসলেন। বাসার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলেন। বাবা-মা দুজনার ফোন নাম্বার দিলাম ওনাকে। উনি জানালেন রাতে ফ্রি হয়ে কথা বলবেন। পাছে মা ওনাকে উলটোপালটা কথা শোনান, তাই বললাম, “আংকেল আপনি বাবার মেবাইলে ফোন দিয়েন।”
একটু হেসে তিনি বললেন, “আপার রাগ এখনো কমেনি?”
আংকেলের কথায় বুঝলাম, লাবণ্য ওর বাসায় সবকিছু বলে দিয়েছে।
আংকেল বললেন, “আচ্ছা ভাইয়ের সাথেই কথা বলব। আর আমি ভাবছিলাম, সামনাসামনি বসে কথা বললে মান-অভিমান অনেক কমে যাবে। কী বলো শুভ্র?”
“জি আংকেল, আপনি যেটা ঠিক মনে করেন।”
“আচ্ছা ঐসব কথা পরে হবে । লাবণ্য’র মা আমার ওপর রাগ হয়ে আছে, কারণ আমি তোমাকে আটকে রেখেছি অনেকক্ষণ ধরে। তারা কী যেন সব আয়োজন করেছে। যাও তুমি ওদের সাথে ভেতরে যাও।”

ভেতরে ঢুকে আমি পুরোই চমকে গেলাম! আয়োজন দেখে আমার মনে হলো, আমি সত্যি বিয়ের পর প্রথম শ্বশুরবাড়িতে এসেছি। টেবিল ভরা খাবার, আমার জন্য নতুন কাপড়চোপড়ই শুধু না, সেই কাপড় তখন গায়ে চড়িয়ে তাদের দেখাতে হবে, এই হল লাবণ্য’র বিচ্ছু ভাইবোনদের আবদার।
লাবন্যকে এক কোনায় নিয়ে বললাম, “এইসব জোরাজুরি যদি চলতে থাকে তাহলে আমি এখনই চলে যাব।”
ভয় দেখানোতে কাজ হলো, লাবণ্য কী বলল কে জানে, বিচ্ছুর দল হঠাৎ একদম দমে গেল। শ্বশুরবাড়ির লোকের মধুর অত্যাচারে আমার এই প্রথম মনে হলো, আমি এখন আর আগের শুভ্র নেই। নতুন অনেক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। প্রতিটা মানুষ অনেক আদর নিয়ে কথা বলছেন আমার সাথে। লাবণ্য যে তাদের কত আদরের মেয়ে, লাবণ্য’র বিয়ে নিয়ে তাদের কতো প্ল্যান ছিল, সেইসব বলছে পাশ থেকে কেউ কেউ। এরমধ্যে লাবণ্য’র মা মানে আমার শ্বাশুড়ি আমার কাছে এসে বসলেন। ওনার সাথে আগে আমার দুবার দেখা হয়েছিল, দুবারই শপিংমলে। বুদ্ধিটা লাবণ্য’রই ছিল। লাবন্য ওর বন্ধুর বড়ভাই হিসেবে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। লাবণ্য’র অস্থিরতা ওনার চোখ এড়ায়নি বোধহয়। আমার দিকে কেমন বিরক্তি নিয়ে তাকাচ্ছিলেন বারবার। খুব একটা কথাও বলেননি আমার সাথে। শুধু জিজ্ঞেস করেছিলেন, কী করি। যখন বলেছিলাম যে মাত্র পড়ালেখা শেষ করেছি, চাকরির চেষ্টা করছি তখন মনে হলো আরও বিরক্ত হয়ে গেলেন। পরে লাবণ্য বলেছিল, ওর মা অলরেডি এক ইঞ্জিনিয়ার পাত্রের মা’র সাথে বিয়ের কথাবার্তা অনেকদূর এগিয়েছেন। কথাটা শুনে এমন মেজাজ খারাপ হয়েছিল সেদিন, যে মনে মনে ঠিক করেছিলাম, ওনার মেয়েকে তো বিয়ে করবই, আর বিয়ের পর ওনার সাথে আমি কথাই বলব না। অথচ আজ ওনার ব্যবহারও একদম পালটে গেছে। এমনভাবে কথা বলছেন, মনে হচ্ছে আমি ওনার অনেকদিনের চেনা।
সবার কাছ থেকে বিদায় নেয়ার পর অল্প সময়ের জন্য লাবণ্যকে একা পেলাম ।
জিজ্ঞেস করলাম, “সব এমন পালটে গেল কী করে?”
“মা খুব ভয় পেয়েছিল বাবাকে নিয়ে। বাবার মনটা যেন ভালো থাকে তাই মা নিজ থেকেই এই আয়োজন করেছে। আমাদের কাউকে কিছু জানায়নি আগে থেকে। সব তো ঘরের মানুষ। চাচা-মামা-খালারা ফোন পেয়েই চলে এসেছে।”
“আমি খুব ভয় পাচ্ছিলাম এখানে আসার আগ পর্যন্ত। বুঝতে পারছিলাম না আসব কী আসব না। ভয় হচ্ছিল, আংকেল যদি অপমান করেন? ব্যাপারটা যে তোমার বাসায় এত সহজে মেনে নেবে, আমি বুঝতেই পারিনি।”
“আমিও বুঝিনি। বাবা’র এমন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যাওয়াটাই বিষয়টাকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। তোমার বাসার কথা বলো শুভ্র। আন্টি কী এখনও আমার ওপর রাগ করে আছেন? আমাকে নিয়ে চলো প্লিজ। দুজন মিলে আন্টির হাত ধরে বসে থাকব, তিনি যতক্ষণ পর্যন্ত মাফ না করেন।”
“আরেকটু সময় দাও লাবণ্য। এখন তুমি গেলে মা যদি আরও খারাপ ব্যবহার করেন, তখন আমারও ভীষণ খারাপ লাগবে। আংকেল তো ফোন নাম্বার নিয়েছেন। সবকিছু আরেকটু সহজ হোক তারপর যেয়ো।”
“তাহলে তুমি থাকো, যাবে না তুমি।” কথাটা বলেই লাবণ্য আমাকে জড়িয়ে ধরল।
খুব লোভ হচ্ছিল লাবণ্য’র কাছে থাকার; কিন্তু মা’র চেহারাটা মনে পড়তেই ইচ্ছেটাকে বিদায় দিলাম। লাবণ্যকে বুঝিয়ে বলে ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসলাম। ওকে ছেড়ে আসার সময় কেন যেন খুব বেশি কষ্ট হচ্ছিল। এর আগেও তো কতোবার বিদায় নিয়েছি অথচ তখন তো এমন লাগত না! কেমন যেন একটা একটা অধিকার জন্মেছে এর মধ্যেই। মনে হচ্ছে এই মানুষটা আমার, একান্তই আমার। বুকের ভেতর উথাল-পাথাল ভালোবাসার ঢেউ, ছেড়ে চলে যাওয়ার এই যে তীব্র কষ্ট, এই অনুভূতিগুলো আমার তো আগে কখনও হয়নি।

“বিয়ে” নামের সম্পর্কটা কী তাহলে এতটাই শক্তিশালী, ঐ কাগজটার কী এতটাই জোর যে মনের ভেতরের ভাবনাগুলোকে নতুন করে ভাবতে শেখায়? কী জানি, আমার তো তাই মনে হচ্ছে।

চলবে

#ফারজানাইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here