#লাবণ্য_আলোয়
#পর্ব_৬
“ছোটন ভাইয়ের আব্বা, আমার আব্বার হাত ধরে জোর করে সোফায় বসিয়ে বললেন, ভাই সাহেব, আমি নিজেও চিন্তা করিনি আমার আম্মা শেষ সময়ে এসে এমন কিছু করবেন। আমি আর ছোটনের মা মিলে আমার আম্মাকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করেছি; কিন্তু কোনো কাজই হচ্ছে না। আমি যে কী বলে আপনার কাছে ক্ষমা চাইব, আমার তো ক্ষমা চাওয়ারও মুখ নাই। শুধু তো আপনাদের না, আমাদেরও কেনাকাটা শেষে বিয়ের আয়োজন শুরু হয়ে গেছে। আম্মা কাল থেকে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে বসে আছেন৷ আমি পড়েছি মহা মুসিবতে। আপনি আমাকে মাফ করেন, ভাই সাহেব।
আব্বা রাগান্বিত হয়ে বললেন, মাফ চাইলেই কী সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়, ভাই? আমার বাড়িভরা লোকজন। সবাই আমার মেয়ের বিয়ে উপলক্ষ্যে এসেছে। এই সময়ে খালাম্মা এমন একটা অন্যায় আবদার করছেন, আর আপনারা সেটা মেনে নিচ্ছেন!
ছোটন ভাইয়ের দাদী পাশের সোফায় বসেছিলেন। আব্বার কথা শুনে বুড়ি একেবারে ফণা তুলে উঠল, বুঝেছিস? বয়স কমসে কম পঁচাত্তর তো হবেই; কিন্তু কী তাঁর তেজ! তুই যদি দেখতিস! বুড়ি হিসহিসিয়ে বলল, আমার ছেলেকে কুমন্ত্রণা দিয়ে কোনো কাজ হবে না। আমার কথার বাইরে আমার ছেলে কোনোদিন এক পা-ও ফেলেনি, ফেলবেও না।
আব্বা দাদীকে পাত্তা না দিয়ে ছোটন ভাইয়ের মা’কে বললেন, কী হলো, আপা? আপনি কিছু বলছেন না যে? আমার সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে, কত ভালো ভালো কথা বলে, আমার মেয়েটাকে আপনার বাড়ির বউ করতে চাইলেন! এখন কিছু বলছেন না কেন? আমার মেয়েটার প্রতি আপনার কি একটুও মায়া হচ্ছে না? আপনার নিজের মেয়ের সাথে এমন কিছু ঘটলে, তখন আপনার কেমন লাগবে, আপা?”
“উনি কিছু বলেননি?”
“ঐ জল্লাদ বুড়ির সামনে কী বলবে বল। খালাম্মা মাথা নীচু করে বসে চোখের পানি মুছছিলেন। সবার কথাবার্তায় বুঝতে পারছিলাম, দাদীকে সবাই খুব ভয় পায় । উনি যে একটা অন্যায় করে যাচ্ছেন, এই কথাটা ওনার মুখের ওপর কেউ বলতে পারছিলেন না!”
“এভাবেই বিয়েটা ভেঙে গেল?”
“আমরা সবাই যখন চুপচাপ বসে আছি, ছোটন ভাইয়ের আম্মা উঠে এসে দাদীর হাত ধরে অনুরোধ করলেন, তিনি যেন এই সময়ে এসে এমন না করেন। এখানে ছেলেমেয়ের জীবনের ব্যাপার জড়িত।
জানিস শুভ্র, আমি আব্বাকে কারো কাছে কোনোদিন অনুনয়-বিনয় বা হাত জোড় করতে দেখিনি। সেদিন যে কী হলো, এতক্ষণ রাগে ফুঁসতে থাকা আব্বা হঠাৎ করেই খুব নমনীয় হয়ে গেলেন। ছোটন ভাইয়ের দাদীর পাশে বসে, ওনার হাত দুটো ধরে বারবার অনুরোধ করলেন, তিনি যেন এই সময়ে এসে এমনটা না করেন। তুই বিশ্বাস করবি না, আমার কী যে খারাপ লাগছিল আব্বাকে এমন হাত জোড় করতে দেখে। আমার খুব ইচ্ছা করছিল, বুড়ির মুখে খামচে ধরতে। আব্বা বারবার অনুরোধ করায় উনি হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ঠিক আছে, তারিখ মতোই বিয়ে হবে ।
সবার যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। ঠিক তখনই তিনি নতুন চাল চাললেন। বললেন, আমি তো তোমার কথা মেনে নিলাম বাবা; কিন্তু তুমি যে আমার নাতির ঘাড়ে কালো মেয়ে চাপিয়ে দিচ্ছ, তার একটা দাম তো দিতে হবে । আব্বা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলেন, মানে কী আপনার কথার?
মানে আমার নাতির কোনো সন্মান তুমি দিবা না! তোমার মেয়ের গায়ে হলুদের আগে আমার এখানে টাকা দিয়ে যাবা। কত টাকা দিতে পারবা বলো?
টাকা দেবো মানে! টাকা কেন দেবো? কিসের টাকা?
ছোটন ভাইয়ের আম্মা পাশ থেকে বলে উঠলেন, আম্মা, ওনারা কেন টাকা দেবেন? আমাদের কী টাকার অভাব? এইটা কী বলেন আপনি!
বুড়ি, খালাম্মাকে ধমকে উঠলেন, তুমি একদম কথা বলবা না। সব নষ্টের গোড়া তুমি। কে বলেছিল তোমাকে এত মাতুব্বরি করতে? তুমি ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেতে চাও? এত সাহস তোমার! এরপর তিনি আব্বাকে বললেন, কী বাবা বললা না কত দিতে পারবা? অন্য যে কোনো ফর্সা সুন্দরী মেয়ের সাথে বিয়েতে রাজি হলেই, মেয়ের বাপ টাকার বস্তা রেখে যাবে । আমার নাতি ফ্যালনা নাকি? এত বড় ব্যবসা আমার ছেলের । এত বড় ঘরে এত সহজেই মেয়ে পার করবা?
আব্বা হুংকার দিয়ে উঠলেন, ছেলে নিয়ে ব্যবসা করতে চান? আপনি কী বিয়ে ভাঙবেন, আমিই এমন ছোটোলোকের ঘরে আমার মেয়ে দেবো না । বিয়ে আমিই ভেঙে দিলাম।
দাদী হাত উঁচিয়ে বললেন, কালো মেয়ের বাপের এত উঁচু নাক ভালো না। আমিও দেখব, এই মেয়ে তুমি কী করে পার করো।
আমি আর সহ্য করতে না পেরে বলে ফেলেছিলাম, দাদী আপনিও তো কালো । তাহলে রঙ নিয়ে এত কথা বলছেন কেন? এই কথার সাথে সাথে যেন গরম তেলে পানি পড়ল! দাদী ছোটন ভাইয়ের আম্মাকে বকাঝকা শুরু করলেন, দেখো, দেখো কেমন ছোটোলোকের ঘর থেকে মেয়ে আনতে চেয়েছিলে তুমি । মুরুব্বি মানে না, বেয়াদব কোথাকার। ছোটোটারই এই অবস্থা, বড়োটা না জানি কতবড়ো বেয়াদব হবে!
এই কথার পর আব্বা আর এক মিনিটও দাঁড়াননি । খালু আর আমাকে নিয়ে বের হয়ে এসেছিলেন ঐ বাড়ি থেকে।”
“এতকিছু যে হলো, তখন ছোটন ভাই মানে লাবণ্য’র বাবা কী করছিল?”
“ও তখন বাসায় ছিল না । বন্ধুদের সাথে বাইরে ছিল। বেচারা পরদিন সকালে এসে অনেকক্ষণ বসেছিল বাসায়। আব্বাকে বলেছিল, ঐ বাড়ি ছেড়ে চলে আসবে , আপাকে নিয়ে সোজা ঢাকা চলে যাবে। ছোটন ভাইয়ের কোনো কথাই সেদিন আর আব্বার মন গলাতে পারেনি। ছোটন ভাই সারাদিন বসে থেকে, বিকেল বেলায় ক্লান্ত পায়ে আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। আমার সেদিন ছোটন ভাইয়ের জন্য ভীষণ মন খারাপ হয়েছিল। এতগুলো মানুষ মিলে একটা স্বপ্নের জাল বুনছিলাম, আর ঐ বুড়ি দাদী এসে ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে জালটা কেটে দিলেন! গায়ে হলুদের দিনে আপার বিয়েটা ভেঙে গেল। তুই কল্পনা করতে পারবি না শুভ্র, সেদিন বাড়ির অবস্থা কেমন হয়েছিল । মামা আর খালু মিলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ক্ষমা চেয়ে দাওয়াত বাতিল করেছিলেন। লোক দিয়ে ওবাড়ি থেকে আসা সমস্ত উপঢৌকনগুলো ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হলো। আমরা খুব ভয় পাচ্ছিলাম, আব্বা হয়তো আম্মাকে খুব বকাঝকা করবেন। আপা না আবার কিছু একটা করে বসে; কিন্তু তেমন কোনোকিছু হল না । বাড়ির পরিবেশ অন্য সময়ের তুলনায় আরও বেশি শান্ত হয়ে গেল। বিয়ে বাড়িতে আসা মেহমানরা সবাই ফিরে গেলেন। এই ঘটনার পর আব্বা কেমন যেন বোবার মতো হয়ে গেলেন। কারো সাথে তেমন একটা কথা বলতেন না।”
“তারপর?”
“এরপর শুরু হলো নতুন অত্যাচার। আশেপাশে রটে গেল, মেয়ের চরিত্র খারাপ ছিল তাই ছেলের বাড়ি থেকে বিয়ে ভেঙে দিয়েছে। ওদিক থেকেই কেউ কাজটা করেছিল। আমরা বাইরে বের হলেই মানুষজন জানতে চায় আসল ঘটনা কী ? আমাদের সমাজে যে কোনো একটা ঘটনা ঘটলেই, সেটা যেমনই ঘটনা হোক না কেন, আমরা নির্দ্বিধায় বলে দিই, ‘মেয়েটার দোষ ছিল , মেয়েটারই চরিত্র খারাপ, নইলে বিয়ে ভাঙবে কেন?’ আমাদের মুখে আটকায় না কথাগুলো, বলার সময় এতটুকু বুক কাঁপে না । অথচ দেখ এখানে তোর মা’র কোনো দোষই ছিল না। ছোটন ভাই এরপরেও আপার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল। প্রায় দিনই ফোন করত । আপা কখনও ফোন ধরত না। কলেজে যাওয়া-আসার পথেও ছোটন ভাই আপার সাথে কথা বলার সুযোগ পেত না, কারণ আব্বা প্রতিদিন আপাকে আনা-নেওয়া করতেন। ছোটন ভাই ফোন করে আমাকে বারবার বলত, একবার শুধু লাবণ্যকে দাও, শুধু একবার। আমি তো ছোটো মানুষ, আমি কী করতে পারি বল? তখন তো মাথায় অত বুদ্ধিও ছিল না।
একদিন আব্বা জানতে পারলেন ছোটন ভাইয়ের ফোন করার বিষয়টা। আব্বা পরদিন দুপুরে আমাদের সবাইকে ডেকে বললেন, সবাই যার যার জিনিসপত্র গোছগাছ শুরু করো । আমরা সামনে সপ্তাহে বাড়ি চলে যাব । এরচেয়ে দেরি করে গেলে, নতুন ক্লাসে ভর্তির ঝামেলা হয়ে যাবে । এর এক সপ্তাহ পরেই আমরা বাড়ি চলে এলাম। চলে আসার আগে কারও কাছেই আমাদের ঠিকানা দিইনি। আর তোর মা, আমাদের এক চাচার বাসায় থেকে বোর্ড পরীক্ষা দিয়েছিল।”
“বাবার সাথে মা’র বিয়ে হল কবে? বাবা জানেন সব ঘটনা?”
“হুম জানে। তোর বাবা সব ঘটনা জেনেই বিয়েতে রাজি হয়েছিল। তোর বাবার সাথে আপার বিয়ে হলো এই ঘটনার চারমাস পর। দুলাভাই হলো বড়ো মামার বন্ধুর ভাইয়ের ছেলে। ওনাদের বাড়ি থেকেই প্রস্তাবটা এসেছিল। আব্বা হ্যাঁ, না কিছুই বলেননি। শুধু একদিন তোর বাবার সাথে কথা বলেছিলেন, তারপর মামাকে বললেন, ছেলে তো ভালোই মনে হচ্ছে। ভালো বর, ভালো ঘরের নমুনা তো তোমরা দেখলেই। তোমরা সবাই মিলে যা ভালো মনে করো, সেটাই হোক, বাকিটা আল্লাহ্ ভরসা।
তবে আপাকে নিয়ে সবাই খুব চিন্তায় ছিল । ও তো সত্যিই ছোটন ভাইকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। তবে আপা কিন্তু খুব স্বাভাবিকভাবে সবকিছু মেনে নিল। একটা কথাও বলেনি, একটাও প্রশ্ন করেনি। ছোটন ভাইয়ের ওপর তীব্র রাগ আর ঘৃণাই বোধহয় ওকে এতটা শক্ত করে তুলেছিল।”
ছোটো খালার কথাগুলো শুনে আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছিল। ইশ, কতটা অপমানিত হতে হয়েছে আমার নানা-নানীকে, কতটা কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে মা’কে! খালাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আমি এখন কী করব খালা?”
খালা বলল, “অপেক্ষা কর শুভ্র। আমাদের হাতে সবসময় সব সমস্যার সমাধান থাকে না রে। সময় আসলেই বুঝা যাবে, কোথাকার জল কোথায় গড়ায়। সেই পর্যন্ত অপেক্ষা ছাড়া উপায় নেই।”
“আমরা তো সবকিছু জেনে গেছি; কিন্তু লাবণ্য বা আংকেল তো এখনও কিছুই জানে না। ওরা জানার পর কী হবে?”
“আজ হোক বা কাল, ওরা তো জানবেই। তাই তো বললাম, চুপচাপ অপেক্ষা কর। আমাদের হাতে এখন আর কিছু নেই।“
চলবে
#ফারজানাইসলাম