#লাবণ্য_আলোয়
#পর্ব_৭ শেষ
বাসায় ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল। রুমে ঢুকে দেখি, লাবণ্য ঘুমাচ্ছে। কথাগুলো কি লাবণ্যকে বলব, বললেও কীভাবে শুরু করব, বুঝতে পারছি না। লাবণ্য’র বাবা যে মানুষটা, উনি কি আসলেই দোষী, ওনার কি ঐ পরিস্থিতি সামাল দেয়ার মতো অবস্থা ছিল অথবা ছিল না? উনি নিজেই তো তখন ছাত্র, দাদীর অন্যায় আচরণের কাছে তাঁর বাবা-মাই যেখানে টিকতে পারেনি, সেখানে আসলে তাঁর কিছু করারও ছিল না। এইসব এলোমেলো ভাবনার মাঝে খেয়াল করিনি কখন লাবণ্য উঠে এসে পাশে বসেছে। আমি ফিরে তাকাতেই, সে একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর।
“আমাকে এখানে একা রেখে কোথায় ছিলে এতক্ষণ? আমি জোর করে তোমার বাসায় চলে এসেছি দেখে কী তুমি আমাকে শাস্তি দিলে?”
“উহ, ব্যথা পাচ্ছি, চুল ছাড়ো।”
“না ছাড়ব না।”
“আমার মা যদি এই অবস্থায় তোমাকে দেখে…”
লাবণ্য আমার চুলের মুঠো আরও শক্ত করে ধরে বলল, “আমি কাউকে ভয় পাই নাকি?”
“চুল ছাড়ো, তারপর বলছি, কেন দেরি হলো।”
লাবণ্য চুল ছেড়ে বলল, “বলো কেন দেরি হলো?”
“ছোটো খালার বাসায় গিয়েছিলাম।”
“আজই তোমার খালার বাসায় যাওয়ার দরকার ছিল!”
“লাবণ্য, তোমাকে এখন কিছু কথা বলব। খুব মন দিয়ে কথাগুলো শোনো।”
“কী হয়েছে শুভ্র? আমার বাবা ঠিক আছে তো?”
“আংকেল ঠিক আছেন। আংকেলের কথা না, আবার আংকেলেরই কথা। তুমি শান্ত হয়ে বসো। আমি সব বলছি।”
লাবণ্য আমার মুখোমুখি বসল। আমি লাবণ্যর হাত দুইটা ধরে, সব কথা লাবণ্যকে বললাম, যা আমি ছোটো খালার কাছ থেকে শুনে এসেছি ।
লাবণ্য বলল, “এটা কীভাবে সম্ভব? তোমাদের কোথাও ভুল হচ্ছে মনে হয়। অন্য কারও কথা বলছ না তো?”
“খালা মিথ্যা বলবে কেন, বলো? কিছু তো একটা ঘটনা আছেই, নাহলে মা তোমার সাথে এমন কেন করবেন? আমার মা কখনও কারও সাথে খারাপ ব্যবহার করে না, লাবণ্য।”
লাবণ্য কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “আমি এখন কী করব, শুভ্র?”
“আমিও বুঝতে পারছি না, আমাদের আসলে কী করা উচিত। বিষয়টা হয়ত তেমন কিছুই না, আবার আমার মার দিকে থেকে যদি চিন্তা করো, এটা হয়তো তাঁর জন্য ভীষণ দুঃখজনক আর অপমানের বিষয়। ঘটনাটা মা এত বছরেও ভুলতে পারেননি।”
লাবণ্য হঠাৎ কেমন চুপ হয়ে গেল। বারবার করে জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে; কিন্তু ও কোনো উত্তর দিলো না।
কিছুক্ষণ পর বলল, “শুভ্র তুমি খেয়ে নিয়ো।”
“দুইজন একসাথেই খাব। আমি চেঞ্জ করে আসছি, তারপর আমরা ডাইনিং এ যাব।”
“আমি খাব না।”
“কেন, খাবে না কেন?”
“খেতে ইচ্ছা করছে না।”
“তুমি না খেলে, আমিও খাব না।”
“তুমি খাবে না কেন? আমি শুয়ে পড়ছি। সকালে উঠতে হবে।”
কথাটা বলে লাবণ্য বিছানায় গিয়ে সত্যি সত্যি শুয়ে পড়ল!
লাবণ্য’র সাথে প্রথম রাতের অভিজ্ঞতা ভালো ছিল না। বাবার জন্য কান্নাকাটি করে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে, আর আমি সারারাত তাকে আগলে বসেছিলাম। সেদিক দিয়ে আজকের রাতটা অনেক বেশি কাঙ্খিত ছিল আমাদের কাছে। দুজনের, দুজনকে কাছে পাওয়ার আকাঙ্খা, অথচ যে ঘটনাটা আজ আমাদের সামনে এসেছে, তা যেন অদৃশ্য একটা দেয়াল তুলে দিলো আমাদের দুজনের মাঝখানে!
আমি কাপড় পালটে এসে, লাবণ্যর পাশে বসে, ওর পিঠে হাত রেখে কয়েকবার ডাকলাম ওকে। সে যেভাবে শুয়ে ছিল, ঠিক সেভাবেই শুয়ে রইল। লাবণ্য সত্যি ঘুমিয়েছে কি না জানি না, কারণ এভাবে ডাকলে, সত্যিকারের ঘুমন্ত মানুষেরও ঘুম ভেঙে যায়। বুঝলাম, যতই ডাকাডাকি করি না কেন, ও এখন উঠবে না। রুমটা অনেক ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। এসির টেম্পারেচার একটু বাড়িয়ে দিয়ে, আমি খেতে চলে এলাম।
বাবা-মা আর ছোঁয়া খেতে চলে এসেছিল। আমাকে একা দেখে বাবা বললেন, “লাবণ্য কোথায়, ও খাবে না?”
“ওর শরীর ভালো লাগছে না বাবা। ও ঘুমিয়ে গেছে।”
“শরীরের কী হলো আবার? বেশি খারাপ লাগছে নাকি?”
“তেমন কিছু না। একটু মাথাব্যথা করছে।”
“ও আচ্ছা।”
বাবা খাবারে মন দিলেন। মা একটা কথাও বললেন না। খালার বাসায় গিয়ে সব ঘটনা শোনার পর থেকে, মার ওপর জমে থাকা সমস্ত অভিমান শেষ হয়ে গেছে। আমার এখন খুব ইচ্ছা করছে মার পাশে বসে, মাকে একটু জড়িয়ে ধরতে। জড়িয়ে ধরে স্যরি বলতে। কী এক জড়তার কারণে মার পাশে বসতেও পারলাম না, স্যরিও বলা হল না। প্লেটে অল্প খাবার নিয়ে, কোনোমতে খাওয়া শেষ করে রুমে চলে এলাম।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, বলতে পারব না। যখন ঘুম ভাঙল, ঘড়িতে সকাল নয়টা পেরিয়ে গেছে। আমি তো ঘড়িতে এলার্ম দিয়েই শুয়েছিলাম, তাহলে ঘুম ভাঙল না কেন! হঠাৎ লাবণ্যর কথা মনে পড়তেই, পাশ ফিরে তাকালাম। লাবণ্য পাশে নেই। ও গেল কোথায়, আর সেও তো আমাকে ডাকতে পারত! ও বোধহয় রেডি হয়ে ক্লাসের জন্য বেরিয়ে গেছে। মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল ওর ওপর। এত্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন হল কীভাবে ও! মোবাইলটা নিতে গিয়ে দেখি মোবাইলের নীচে ভাঁজ করা একটা কাগজ। কাগজ খুলে দেখি, লাবণ্য’র লেখা। লাবণ্য তো কখনোই আমাকে চিঠি লেখেনি। লেখার প্রয়োজনই হয়নি। সারাক্ষণ ফোনে কথা হচ্ছে, ম্যাসেঞ্জারে লেখা বিনিময়, এরপর আর কাগুজে চিঠি লেখার সময় কোথায়? আজকে তাহলে কী এমন হলো? লেখাটায় চোখ বোলালাম।
‘গুড মর্নিং শুভ্র। কাল তোমার কথা শোনার পর থেকে খুব অস্থির লাগছে। শুধুমাত্র গায়ের রঙের কারণে একটা মেয়ের বিয়ে ভেঙে যাবে? তাও আবার বিষয়টার সাথে আমার বাবার নাম জড়িত! আমার গায়ের রং নিয়ে কেউ কথা বললে, বাবা খুব রাগ করেন সবসময়। মুখের ওপর বলে দেন, গায়ের রং না, আমার মেয়ের যোগ্যতা নিয়ে কথা বলেন। আমি মাকে ফোন করেছিলাম। মা-ও জানে এই ঘটনাটা। শুধু আমিই কিছু জানি না। এখন নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে। আমার বাবা সেদিন কোনো প্রতিবাদ করতে পারেননি তাঁর দাদীর অন্যায় আচরণের। বাবার প্রতিবাদ করা উচিত ছিল। জানো শুভ্র, আমার মাকে কিন্তু বাবার দাদীই পছন্দ করেছিলেন। আমার মা হচ্ছেন, বাবার দাদীর মামাতো ভাইয়ের নাতনী। আমার এখন মনে হচ্ছে, উনি নিজের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করিয়ে আনবেন বলেই, আমার দাদীর পছন্দ করা মেয়ে, মানে আন্টির সাথে বাবার বিয়েটা ইচ্ছে করে ভেঙে দিয়েছিলেন। আমি আন্টির কাছে ক্ষমা চাইছি, আর বাবা সেদিন চুপ থেকে যে অন্যায় করেছিলেন তার শাস্তি হিসেবে তাঁর মেয়ে, তোমার কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছে। ভালো থেকো শুভ্র।’
চিঠিটা পড়ে অফিস যেতে না পারার রাগ ভুলে গেলাম। লাবণ্য কী লিখেছে এসব! সরিয়ে নিচ্ছে মানে কী! ও কী আমার জীবন থেকে চলে যাওয়ার কথা বলল? আমার মাথা নষ্ট অবস্থা! কী থেকে কী হয়ে যাচ্ছে! কবে কী একটা ঘটনা ঘটেছিল আমাদের মা-বাবার জীবনে, তার জন্য আমরা কেন শাস্তি ভোগ করব? লাবণ্য বললেই হলো, ‘সরিয়ে নিচ্ছি’। ওকে ছাড়া আমি নিজেকে কল্পনাই করতে পারি না। তাড়াতাড়ি মোবাইল নিয়ে লাবণ্যকে ফোন করলাম। কয়েকবার ফোন করার পরও ওকে পেলাম না। লাবণ্য ফোনটা অফ করে রেখেছে। এখন আমি কী করব? ওদের বাসায় যাব? যাওয়াটা ঠিক হবে? লাবণ্য ক্লাসে আছে না বাসায়, এটা না জানা পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছি না। নিলয়ের কথা মনে পড়তেই ওকে ফোন করলাম।
নিলয় বলল, লাবণ্য ভোরবেলায় বাসায় গিয়ে সোজা নিজের রুমে চলে গেছে। কারো সাথে কোনো কথাই বলেনি। এখন ঘুমাচ্ছে। নিলয়কে বললাম, লাবণ্য ঘুম থেকে জেগে, আমাকে যেন অবশ্যই ফোন করে।
বিষয়টা আর চেপে রাখার কোনো মানে হয় না। মার সাথে কথা বলতেই হবে এখন। আমি মার রুমে এসে, সরাসরি মার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মা পেপার পড়ছিলেন। পেপার থেকে মুখ তুলে তাকালেন আমার দিকে, কোনো কথা বললেন না।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “বাবা অফিসে চলে গেছে?”
মা নিরুত্তর।
আমি মার পাশে বসে, পেপারটা সরিয়ে রাখলাম। তারপর মার হাত ধরে বললাম, “মা স্যরি।”
মা তবুও নিরুত্তর। কেমন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। মনে হয় বুঝতে পারছেন না, স্যরির উত্তরে কী বলা উচিত।
আমি বললাম, “আমি খালার কাছ থেকে সবকিছু জেনেছি, মা। তুমি শুরুতেই যদি আমাকে বলতে, তাহলে এতকিছু হত না। আমার একটু অভিমান হয়েছিল তোমার ওপর। এখন বুঝতে পারছি অভিমান করাটা উচিত হয়নি। সব ঘটনার পেছনেই একটা গল্প থাকে। অনেক সময় আমরা গল্পটা না জেনেই নিজের মতো করে সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাই। আমি আবারও স্যরি মা।”
হাতে থাকা লাবণ্যর চিঠিটা এগিয়ে দিয়ে বললাম, “এটা একবার পড়বে মা?”
মা চিঠিটা হাতে নিয়ে বললেন, “কী এটা?”
“পড়ে দেখো। পড়লেই বুঝতে পারবে।”
মা চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করলেন। পড়া শেষ করে মা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “দীপ্তি সব বলেছে তোকে?”
“জি, মা।”
চিঠিটা আমাকে ফেরত দিয়ে মা বললেন, “টেবিলে নাস্তা রাখা আছে, খেয়ে নে।”
আমি ভেবেছিলাম চিঠি পড়ে মা কিছু একটা বলবেন। ভালো, মন্দ যা-ই হোক না কেন। লাবণ্যকে নিয়ে কী একটা কথাও বলার নেই? লাবণ্য ওপর, মার রাগ কী একটুও কমেনি?
নাস্তা খেতে একদম ইচ্ছে করছে না। খিদেটাই মরে গেছে। মার রুম থেকে বেরিয়ে আমার রুমে চলে এলাম। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে, ছোটো খালাকে ফোন করে সবকিছু জানালাম । খালাকে বললাম, আমি এখন লাবণ্যদের বাসায় যাব। খালা সাথে সাথে আমাকে নিষেধ করে বলল, “তুই এখন গেলে তারাও হয়তো একটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়বে। যেহেতু বিষয়টা এখন সবার সামনে চলে এসেছে, লুকোচুরির তো আর কিছু নেই, আর এটা এমন কোনো ভয়াবহ ঘটনা না, যে সেটা নিয়ে বড়ো একটা ইস্যু তৈরি হবে। একটু অপেক্ষা কর বাবা, সবাইকে একটু সামলে নিতে দে।”
“কিন্তু লাবণ্য যে বলল, ও আর আসবে না। আমি লাবণ্যকে ছাড়া কিছু ভাবতে পারছি না খালা। ও যদি আর না আসে তখন? ও কিন্তু খুব জেদি মেয়ে।”
“লাবণ্য আসবে, লাবণ্য অবুঝ না। আর তোর ভালোবাসায় কোনো জোর নেই? বিশ্বাস নেই লাবণ্যর ওপর? এত অল্পতেই এমন কান্নাকাটি শুরু করেছিস কেন? তুই শুধু অপেক্ষায় থাক, লাবণ্য নিশ্চয়ই আসবে।
ছোটো খালার সাথে কথা বলে মনটা একটু শান্ত হলেও ভেতর ভেতর অস্থিরতা ঠিকই রয়ে গেল। লাবণ্যকে নিয়ে সারাক্ষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছে। সে ফোনটা অফ করেই রেখেছে। নিলয়কে ফোন করে বললাম, একবার লাবণ্যকে ফোন দিতে; কিন্তু লাবণ্য কিছুতেই কথা বলতে রাজি হলো না।
মাঝের তিনটা দিন কীভাবে কেটেছিল জানি না। আমার মনে হচ্ছিল, আমি বোধহয় এবার পাগল হয়ে যাব। লাবণ্য হারিয়ে যাবে আমার জীবন থেকে। ছোটো খালার ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছিল। কেন যে ফোন করতে গেলাম খালাকে? তাঁকে জানালাম দেখেই তো আমার ওবাড়িতে যাওয়াটা আটকে গেল। যা হয় হবে, আমি আজ লাবণ্য’র কাছে যাবই। ডিসিশন নিয়ে যখন বাড়ি থেকে বের হব, তখনই ছোটো খালা হাজির হয়ে বলল, “কী রে কী খবর তোর? কোথায় যাচ্ছিস?”
“বাইরে যাব একটু।”
“কোথায়?”
“কাজ আছে।”
“কাজ থাকলে বাদ দে, এখন কোথাও যাওয়া যাবে না।”
খালার ওপর এমনিতেই মেজাজ খারাপ। একটু রাগ হয়েই বললাম, “আমার এখন যেতেই হবে।”
ছোটো খালা বলল, “লাবণ্য’র বাবা ফোন করেছিল একটু আগে।”
“কখন! বলোনি কেন?”
“সেটা বলার জন্যেই তো আসলাম। তুই আমাকে এত মেজাজ দেখাচ্ছিস কেন? যা যেখানে তোর যাওয়ার, আমি কিচ্ছু বলব না।”
“মনটা ভালো নেই। স্যরি খালা। বলো না, আংকেল কী বলেছেন?”
“ছোটন ভাই অনেক কথা বললেন। আচ্ছা শোন ওরা আসছে সন্ধ্যায়। সামনাসামনি কথা বলে মনের ভেতরে জমে থাকা রাগ, ক্ষোভ সব মিটিয়ে নেয়াই ভালো। তুই কোথাও বেরোস না যেন। আমি তোর মা’র কাছে গেলাম।”
খালা চলে গেলে ভয় আর ভালোলাগার মিশ্র অনুভূতি একসাথে হতে লাগল। কী হবে যখন আমাদের মা-বাবারা মুখোমুখি হবেন? তারা কী নিজেদের অতীত সম্পর্কের কারণে, নতুন সম্পর্কটাকে মেনে নেবেন না? নাকি অতীত ভুলে ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে, নতুন করে শুরু করবেন? বসে বসে ভাবছি ঠিক তখনই মা আমার রুমে এলেন আলমারিতে কিছু একটা খুঁজতে। মার সামনে দাঁড়াতেই মা ফিরে তাকালেন, “কিছু বলবি?”
ভীষণ কান্না পাচ্ছিল আমার। মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, “স্যরি মা । তুমি যা ডিসিশন নেবে আমি সেটাই মেনে নেব।”
“যা আগে শেভ কর। কী জংলির মতো চেহারা বানিয়েছিস। এগুলো আমার একদম ভাল্লাগে না। সন্ধ্যায় বাড়িতে লোকজন আসবে। যা, যেটা বললাম সেটা আগে কর, তারপর বাবা’র সাথে বাইরে যা। খাবার-দাবার আনতে হবে।”
অনেক দিন পর মা আমার সাথে ভালোভাবে কথা বললেন! খুশিতে মাকে জড়িয়ে ধরে, মাথায় চুমু দিয়ে বললাম, “তোমায় অনেক ভালোবাসি, মা।”
সন্ধ্যায় ওবাড়ি থেকে সবাই এল। দুই বাড়ির লোকজন সবাই ড্রইংরুমে বসেছে। শুধু লাবণ্য আসেনি। খুব রাগ হলো ওর ওপর। কেন সে আসলো না? আমি এখানে অস্থিরতায় শেষ হয়ে যাচ্ছি, তা কী সে বুঝতে পারছে না? সে আছে তার রাগে-অভিমান নিয়ে! আজ এখানে যা হয় হোক; কিন্তু এই না আসার কারণে আমি ওর সাথে আর কথাই বলব না।
লাবণ্য’র বাবা প্রথম কথা বললেন, “আজকে যে এখানে এভাবে আসতে হবে, তা আমি কোনোদিনও ভাবিনি। লাবণ্য, দীপ্তিদের সাথে আমার আগে থেকে পরিচয় ছিল। একটা সম্পর্ক হতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত হয়নি। বিষয়টা যেহেতু আমাদের ছেলেমেয়ে সবাই জেনেছে, তাই ওটা নিয়ে নতুন করে আর না-ই বলি। শুধু এটুকু বলি, আমি ভীষণভাবে অনুতপ্ত। আমি ক্ষমা চাই সেই পরিস্থিতির জন্য। আমি আজকে ছোটন হিসেবে এখানে আসিনি। একজন মেয়ের বাবা হিসেবে এসেছি। আমার মেয়েটা আমার সাথে ভীষণ রাগ করে আছে। কথা বলছে না আমার সাথে।”
লাবণ্য’র মা এসে মার হাত ধরে বললেন, “যা হয়েছিল ভুলে যান আপা, মাফ করে দেন। ছেলেমেয়েরা তো কোনো দোষ করেনি। আমার মেয়েটা ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে।”
আমি খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, বাবা খুব সুন্দর করে পরিস্থিতি সামলে নিলেন।
শুধু বললেন, “মানুষের জীবনে ছোটো বড়ো অনেক রকম ঘটনা ঘটে, এমন অনেক পরিস্থিতি আসে, যেগুলোর ওপর আমাদের কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকে না। আমরা সেসব নিয়ে আলোচনা করে নিজেদের মাঝে নতুন করে তিক্ততা না বাড়াই। ধরে নিন, সেটা ছোটো একটা দুর্ঘটনা ছিল। নতুন একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। সেখান থেকেই নাহয় আবার শুরু করি আমরা সবাই।”
আমার কারো কোনো কথাবার্তা আর ভালো লাগছে না। সবাই নিজেদের গল্প নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছে, অথচ এখানে যে আসল মানুষটাই নেই, সেদিকে কারো খেয়াল নেই। আমার উসখুস ভাব দেখে মা কাছে এসে বললেন, “যা লাবণ্যকে নিয়ে আয়।”
“লাবণ্য আসবে না মা। ও খুব জেদি।”
“আসবে না বললেই হলো? চল আমি তোর সাথে যাই।”
“তুমি যাবে!”
“হ্যাঁ যাব। আমিও তো একই অপরাধের অপরাধী। মেয়েটা তো কোনো দোষ করেনি; কিন্তু প্রতিবার আমি ওর সাথে খারাপ আচরণ করেছি। কখনও ভালোভাবে কথা বলিনি ওর সাথে।”
“সবাই কী ভাববে, আমরা যদি ওনাদের এভাবে বসিয়ে রেখে চলে যাই?”
“সবাই জানলে তো! কেউ বুঝার আগেই ফিরে আসব। তুই মমিনকে গাড়ি বের করতে বল। আমি দীপ্তিকে বলে আসছি।”
“মা লাবণ্য কিন্তু ফর্সা না। ওর রঙটা কিন্তু আলো ছড়ায় না। পরে আবার কিছু বলো না যেন।”
“আমি এতবার খারাপ ব্যবহার করেছি অথচ মেয়েটা কখনও প্রতিবাদ করেনি, মুখের ওপর দু’টো কথা শুনিয়ে দেয়নি আমাকে। আর কিছু আমার চাওয়ার নেই, অন্য আলো আমি চাই না। ঐ লাবণ্য আলোয় আমাদের ঘর ভরে উঠবে, আমি ঠিক জানি।”
ছোটো খালাকে ম্যানেজ করতে বলে, মাকে নিয়ে সোজা চলে এলাম লাবণ্যদের বাসায়। লাবণ্যই দরজা খুলল আর দরজা খুলে আমাদের দুইজনকে দেখে বোকার মতো তাকিয়ে রইল! মা ভেতরে ঢুকে, লাবণ্যকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “এই মেয়ে, সবাই গেল, তুমি যাওনি কেন?”
লাবণ্য বলল, “আমি আপনাকে বিরক্ত করতে চাইনি, আন্টি।”
মা বললেন, “দরজায় তালা দিয়ে শিগগির চলো আমাদের সাথে। বাসায় কাউকে না বলেই চলে এসেছি, আমার লাবণ্যকে নিতে।”
এমন পরিস্থিতির জন্য লাবণ্য প্রস্তুত ছিল না। আমিও কী জানতাম, হঠাৎ করেই এমন কিছু হয়ে যাবে!
লাবণ্য বলল, “আন্টি আপনার রাগ কমেছে?”
মা বললেন, “আমি কারও ওপর রাগ করে নেই। চলো, তাড়াতাড়ি চলো।”
“আমি ড্রেসটা চেঞ্জ করে আসছি।”
মা ওর হাত ধরে বললেন, “কিচ্ছু করতে হবে না। এই ড্রেসে তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে। চলো।”
মা, লাবণ্যর হাত ধরে সামনে এগিয়ে গিয়ে, পিছে ফিরে বললেন, “তুই আবার দাঁড়িয়ে আছিস কেন? জলদি চল।”
“চলো মা।”
মা আর লাবণ্যর পিছে আমিও এগিয়ে চললাম। আজ সকালেও কী আমি জানতাম, আজকের রাতটা আমার জীবনে এতটা আলোকিত হয়ে উঠবে? জীবন কখনও হয়তো আমাদের বঞ্চিত করে; কিন্তু যখন দেয়, উজাড় করে দেয়।
সমাপ্ত
#ফারজানাইসলাম