#পুনর্জন্ম?
#পর্ব_০৯
#আফিয়া_আফরিন
মৃন্ময়ীর হাত থেকে ঘড়িটা নিলো শিশির। কিছুক্ষণ পরখ করে বললো, ‘এটা যে তন্ময় ভাইয়ের ঘড়ি সেটা তুমি কিভাবে জানো?’
‘গতকালই তার হাতে আমি এই ঘড়ি দেখছি।’
‘তুমি শিওর?’
‘আরে বাবা হ্যাঁ। ভুল হওয়ার কোন চান্সই নেই।’
শিশির চোখ পাকিয়ে বললো, ‘প্রথমত আমি তোমার বাবা নই। দ্বিতীয়ত তন্ময় ভাইয়া কি এসব খুন করছে?’
‘হতেই পারে। হয়তো আহাদ ভাইকে মা’রার পর ঘড়িটা এখানে পড়ে গেছে তার হাত থেকে।’
‘ব্যাপারটা কি এতটাই সহজ?’
‘তুমি যতটা কঠিন ভাবছো ততটা কঠিন ও না। আমরা কি সরাসরি তন্ময় ভাইকে জিজ্ঞাসা করতে পারি না? পুলিশকে আপাতত কোন প্রমাণ না দিলাম, নিজেরা তো জিজ্ঞেস করতে পারি।’
‘আমরা জিজ্ঞেস করলে যেন সে সত্যি কথাটা বলে দিচ্ছে।’
‘তাতো প্রথমে বলবে না। আমরা বলব যে আমরা প্রমাণ পাইছি। সত্যি স্বীকার না করলে পুলিশকে জানিয়ে দিবো।’
‘এত বুদ্ধি নিয়ে রাতে ঘুমাও কেমনে তুমি? এইভাবে কখনো কাউকে সরাসরি জিজ্ঞাসাবাদ করে? আমরা বরং গোপনে তার গতিবিধির উপর নজর রাখি।’
‘হ্যাঁ, এটা তুমি ঠিক বলেছো।’
.
.
পরপর দুইজন খু’ন হয়েছে। কিন্তু খু’নিকে এখনো ধরা যাচ্ছে না।
আজকে সদর থেকে পুলিশ আসবে। ইন্সপেক্টর অনিন্দিতা রায়। বড় বড় অনেক কেসের সুরাহা তিনি করেছেন।
.
.
বিকেল বেলা বৃষ্টি পড়ছিলো। তন্ময় বাজারের দিকেই আছে। শিশির মৃন্ময়ীকে নিয়ে চললো ঐদিকে।
বাজারের একটু আগেই, দেখতে পেল মোতালেব চাচা কে। বৃষ্টির মধ্যে ছাতা হাতে গোটানো, স্যান্ডেল হাতে।
শিশির এগিয়ে এগিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি ব্যাপার চাচা সাহেব? এমন বৃষ্টির মধ্যে আপনি ছাতা মাথায় না দিয়ে হাতে নিয়ে কেন হাঁটছেন? আর জুতাই বা হাতে কেন?’
‘আরে বাবা বোঝোনা। এত ঝড় তুফানের মধ্যে আমার জুতা স্যান্ডেল ক্ষ’য় হয়ে যাবে। বৃষ্টির পানি পড়তে পড়তে আমার ছাতা নষ্ট হয়ে যাবে। তাইতো সব খুলে হাতে নিয়েছি।’
মৃন্ময়ী কোনমতে হাসি চেপে সামনে আগালো। এই মোতালেব চাচা একদম হাড় কি’পটে।
শিশির ওনার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে চলে এলো।
‘এখানে আমরা আর কি করবো? নতুন পুলিশ অফিসার আসছেন। যা করার তিনিই করবেন। এই বৃষ্টির মধ্যে এসব খোঁজাখুঁজি ভালো লাগতেছে না। তারচেয়ে বাসায় গিয়ে আরামসে ঘুম দেওয়া ভালো।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে চলো।’
মৃন্ময়ীকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে, শিশির ফিরে এলো।
.
.
তাওহিদ একদম নিজের রুম থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। সে ম’রতে চায় না, কিছুতেই ম’রতে চায় না। কিন্তু খু’নির মুখোমুখি হতে চায়। একবার এটা ভাবে তো আরেকবার পিছিয়ে যায়।
শেষমেষ সিদ্ধান্ত নেয়, এভাবে কা’পুরুষের মত লুকিয়ে থাকবে না সে। যা হওয়ার, তা হবেই।
.
.
ইন্সপেক্টর অনিন্দিতা রায় সন্ধ্যার পরপরই থানায় চলে এলেন। দেরি করলেন না এক মুহূর্তও। নিজের মতো করে ই’নভে’স্টি’গেশ’নে বেরিয়ে পড়লেন।
খোঁজ নিলেন এর আগে দা’গী আ’সামী বা অপ’রাধী কারা ছিল। তাদের সবাইকে থানায় নিয়ে অস্থায়ীভাবে জেলে দিলেন। সন্দেহের তালিকায় যারা যারা পড়ে, তাদেরকেও আইনের আওতায় আনা হলো।
গ্রামের সকল মানুষজনের সাথে কথা বললেন। গ্রামবাসী সকলে তাকে বিচার দিলো। তিনি সবাইকে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘আপনাদের সমস্যা খুব শীঘ্রই দূরীকরণ করা হবে। আপনারা কি কিছু দিন চিন্তামুক্ত থাকতে পারেন। আমরা প্রায় খু’নি কে নাগালে পেয়ে গেছি।’
তারপর তিনি গেলেন চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে দেখা করতে।
চেয়ারম্যান সাহেবকে বললেন, ‘আপনি গ্রামের একজন চেয়ারম্যান। অথচ চেয়ারম্যানের কোন দায়িত্বেই আপনি পালন করছেন না। গ্রামে এত এত মানুষ খু’ন হচ্ছে আপনার কি উচিত ছিল না, আরও আগে পুলিশে ইনফর্ম করা।’
চেয়ারম্যান হেসে বললেন, ‘আমি তো নামে মাত্র চেয়ারম্যান। আর পুলিশে আগেই খবর দেওয়া হয়েছিলো। পুলিশের অফিসাররা যদি কোন দায়িত্ব না পালন করে তাহলে কি তার দায় এসে আমার উপর পড়বে? অফিসার মহিউদ্দিনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো। সে কি করেছে? হাতেগোনা গ্রামের কিছু মানুষজন তাকে ময়ূরীর আত্মহত্যার ব্যাপারে অনেক কথাই বলেছে। তিনি শুধু প্রমাণ প্রমাণ করে জমিদারের ছেলেকে, এড়িয়ে গেছেন। তাওহীদ দিব্যি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।’
‘কি করেছে তাওহীদ?’
‘আপনি দেখি ঘটনা জানেনই না। আগে গ্রামবাসীর কাছ থেকে অতীতের ঘটনাগুলো শুনে আসেন, তারপর আমার সাথে কথা বইলেন।’
‘ময়ূরীদের বাসা কোথায়?’
‘সামনে এগিয়ে যান। লোকজনদেরকে বললেই দেখিয়ে দিবে। আর এখন রাত হয়ে গেছে এখন না গিয়ে কাল সকাল বেলা যান।’
‘আচ্ছা।’
‘আর শোনেন, গ্রামের সব দায়িত্বই জমিদারের হাতে। সাধারণ মানুষের কিছু সমস্যা শুধুমাত্র আমি সমাধান করি। আর বাদবাকি সব কিছু জমিদারের হাতে। এই ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি নানান ধরনের অপরাধ কাজ করেন। দয়া করে সেসবের খোঁজখবর নিবেন এবং তার উপযুক্ত শাস্তি তাকে বুঝিয়ে দিবেন।’
অনিন্দিতা আরো দু’এক কথা বলে সেদিনের মতো বিদায় নিলো।
.
.
.
পরদিন বিকেলবেলা মৃন্ময়ী মাঠে আম গাছের নিচে বসে ছিলো। তন্ময় ঐদিক দিয়ে বাড়ি ফিরছিল। হঠাৎ মৃন্ময়ী কে দেখে থেমে গেল। মৃন্ময়ী ও তন্ময়কে দেখে উঠে দাঁড়ালো। মনে পড়ে গেল, সেদিন আহাদের লা’শের পাশে ঘড়িটার কথা।
এখন একবার তন্ময়কে জিজ্ঞেস করা যায়, যেহেতু আশেপাশে কেউ নাই।
তন্ময়কে প্রথমে জিজ্ঞেস করলো, ‘ভালো আছেন?’
‘হ্যাঁ, তুমি?’
‘জি ভালো।’
‘এই দিকে কি করছিলে?’
‘এমনিতেই হাওয়া খেতে এসেছিলাম।’
‘ওহ আচ্ছা।’
মৃন্ময়ী খু’নের প্রসঙ্গ টা কিভাবে উঠাবে বুঝতে পারছিল না। এভাবে অচেনা মানুষের সাথে কথার পরিপ্রেক্ষিতে অন্য কথা বলাও মুশকিল।
তাই মৃন্ময়ী আর কোনো ভূমিকায় গেল না। সরাসরি জিজ্ঞেস করলো, ‘আচ্ছা খু’ন গুলো কি আপনি করেছেন?’
তন্ময় মনে হয় একটু অবাক হলো। কিন্তু মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো, ‘এরকম মনে হওয়ার কারণ কি?’
‘কারণ তো অবশ্যই আছে। না হয় বলছি কেন?’
‘কী কারণ?’
‘আপনার একটা ঘড়ি। আপনার সেই ঘড়িটা আহাদ ভাইয়ের লা’শের কাছে পেয়েছিলাম। কালো বেল্টের ঘড়ি। ওইটা আপনার হাতেই দেখছিলাম আমি।’
‘বাহ, বেশ ভালো খোঁজ খবর রাখো তো তুমি আমার। সামান্য একটা ঘড়িও খেয়াল করেছো।’
‘ফাইজলামি কথা বাদ দেন। খুনগুলো কি আপনি করেছেন?’
তন্ময় ঠোঁট উল্টিয়ে বললো, ‘কি যে!’
‘কি যে আবার কি কথা? হ্যাঁ বা না কিছু বলুন। কেন এসব খুন করেছেন?’
‘আমি যে খু’ন করেছি সেটা তোমায় বলল? আর যদি খু’ন করেও থাকি, তার কারণ তো কখনোই তোমাকে বলবো না।’
‘তারমানে আপনি এসব করছেন? কেন করছেন?’
‘এত কৈফিয়ত তো আমি তোমাকে দিতে পারবো না।’
আর দাঁড়ালো না তন্ময়। মৃন্ময়ীকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো।
.
.
সেদিনই সন্ধ্যায় মৃন্ময়ী শিশিরকে বলে দিলো, রাতে যেন ওই ভাবে দেখা না করতে আসে। ইদানিং পুলিশের পাহারা বেড়েছে। যদি হঠাৎ তাকে খু’নি ভেবে বসে?
শিশির ও সম্মতি জানালো মৃন্ময়ীর কথায়।
.
.
.
মা’ল বোঝাই করে ট্রাক আসছে শহর থেকে। কিন্তু সে সব গ্রাম পর্যন্ত আসবে না। কেউ দেখলেই স’র্বনাশ। সর্বনাশের থেকেও বেশি কঠিন হলো, মানুষের প্রশ্ন। মানুষ প্রশ্ন করলে তখন কি জবাব দেবে জমিদার সাহেব?
ট্রাকের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের অ’বৈ’ধ অস্ত্র, আরো কি সব যেন আছে।
গ্রামের চৌরাস্তার মাথা পর্যন্ত এসব আসবে। সেখানে একটা পৌড়োবাড়ি আছে, যেই বাড়িটা ভুতুড়ে বাড়ি হিসেবে আখ্যায়িত। ওখানে কোন লোকজনের আনাগোনা নাই, এমনকি কাকপক্ষীরও কোন আনাগোনা নাই। ওই বাড়িতেই এই সমস্ত জিনিস গুলো রাখা হবে।
জমিদার সাহেব এইবার নিজে যান নাই। তাওহীদ এবং তার কয়েকজন কর্মচারীকে পাঠিয়েছেন।
তাওহীদের অনেকক্ষণ আগে থেকেই এই রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। ট্র্যাকটা যখন এসে পৌঁছালো, তখনই সবাই তাড়াতাড়ি করে মালামাল নামিয়ে ঐ বাড়ির মধ্যে নিয়ে গেলো।
শিশির একটা কাজে এসেছিলো এই দিকে। আড়াল থেকে সবটাই দেখছিল সে।
এইটুকু বুঝল যে, জমিদার সাহেবের অনেক বড় অ’বৈ’ধ ব্যব’সা আছে।
সে এগিয়ে গেলো। তাওহীদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তাওহীদ ভয় পেলো। শিশির কি তাহলে সব দেখে ফেলেছে?
তাওহীদ কিছু বলার আগেই, শিশির বললো, ‘পা’পের ধন প্রা’য়শ্চি’ত্তে যায়!’
.
.
.
.
চলবে…..
[ কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ ]