ভালবাসার_স্পর্শ পর্বঃ ০৫

0
669

#ভালবাসার_স্পর্শ
পর্বঃ ০৫
লেখকঃ আবির খান

বুঝলাম মায়া আবার বারান্দায় গিয়েছে। আমি খাবার গুলো রেখে আমার রুমে গিয়ে বারান্দায় উঁকি মারতেই পুরো থ। আমি দেখি মায়া তার লম্বা ঘন কালো চুলগুলো পিছন থেকে সামনে এনে রোদে শুকাচ্ছে। মায়ার চুলগুলো যে এত লম্বা তা আমি বুঝতে পারিনি। আমি অপলক দৃষ্টিতে শব্দহীন ভাবে দাঁড়িয়ে শুধু তাকেই দেখছিলাম। সে আনমনে তার চুলগুলো তোয়ালে দিয়ে মুছেই যাচ্ছে। কয়েক মুহূর্ত এভাবেই কেটে গেল। হঠাৎই মায়া চুল মুছতে মুছতে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে আমি দাঁড়িয়ে আছি। ও পুরো হতভম্ব হয়ে যায়। আমিও সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি। কি বলবো এখন ওকে? ও কি না কি ভাবছে মনে মনে কে জানে! মায়া কোন কিছু বলার আগেই আমি ওকে বললাম,

– খাবার এনেছি আপনার জন্য। তাড়াতাড়ি আসুন৷ নাহলে ঠান্ডা হয়ে যাবে।

বলেই রুমের ভিতর চলে আসি। বাইরের জামা পরিবর্তন করার জন্য ওয়াশরুমে গেলাম। বেড়িয়ে এসে সোজা ডাইনিং রুমে এসে খাবার গুলো প্যাকেট থেকে বের করতে থাকি। এরমধ্যে মায়াও গেস্ট রুম থেকে বেরিয়ে আসে। আমি শুধু এক নজর ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। দেখলাম সে নীল কালারের একটা কামিজ পরেছে। এত্তো বেশি সুন্দরী লাগছিল তাকে আমি বলে বুঝাতে পারবো না। কিন্তু একবারের বেশি তাকাতে পারলাম না। কারণ খুবই লজ্জাজনক কাজ করেছি একটু আগে। মায়া এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে লজ্জাসিক্ত কণ্ঠে বলল,

~ আপনি বসুন। মেয়েদের কাজ মেয়েদেরই মানায়৷ আমি বেড়ে দিচ্ছি আপনাকে।
– আরে সমস্যা নেই। আমিও সাহায্য করি।

মায়া আবার সেই ভ্রুকুচকে আমার দিকে রাগী ভাবে তাকায়। আমি ভয়ে চুপচাপ চেয়ারে বসে পড়ি। সে সুন্দর করে খাবার গুলো পরিবেশন করে দেয়৷ আমি তাকে বললাম,

– আপনার জন্য অনেক বড়ো রেস্টুরেন্ট থেকে মজার মজার সব খাবার এনেছি। সবগুলো খাবেন কিন্তু।

মায়া চেয়ারে বসে খাবার গুলো দেখে বলে,

~ এতগুলো খাবার একা কিভাবে খাবো?
– হাহা! একা কই? আমাকে দিয়ে খাবেন না বুঝি?

মায়া লজ্জা পায় আর মুচকি একটা হাসি দিয়ে ফেলে। আমি প্রথম তার মুখে হাসি দেখলাম। বিশ্বাস করুন এই হাসি দিয়ে যেন মুক্তা ঝরছিল মনে হচ্ছে। কি অমায়িক হাসি তার। আহ! মনটাই ভরে গেল। আমি মনের অজান্তেই বলে ফেললাম,

– আপনার মুচকি হাসিটা অসম্ভব সুন্দর। সবসময় হাসিখুশি থাকবেন। দেখবেন সবকিছু ভালো হবে।

মায়া খেতে খেতে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

~ একটা সময় অনেক হাসতাম। কিন্তু এখন হাসিটা বোঝার মতো লাগে। হাসতে খুব কষ্ট হয়।

তার কষ্টমাখা কথা শুনে বুঝলাম,, প্রেমিকের জন্য বোধহয় মনে কষ্ট জমেছে অনেক। তাই তাকে কিছুটা স্বান্তনা দেওয়ার জন্য বললাম,

– আপনি যাকে মনে প্রাণে ভালবাসতেন, সে খুবই হতভাগা। আপনার কোন দোষ নেই। আজকাল কজনই বা এরকম অন্ধ ভাবে কাউকে ভালবাসে বলেন। আপনি বেসেছিলেন তাই ধরাও খেয়েছেন। সত্যি বলতে যারা মন প্রাণ দিয়ে ভালবাসতে জানে তাদের কেউ ভালবাসে না। আপনি পারবেন না জানি, তবে তাও বলছি, তাকে ভুলে যান। মনের মধ্যে কষ্ট পুষে রাখবেন না। নাহলে এই কষ্টগুলো জমে মনটা পাথর হয়ে যাবে৷

কথাগুলো শেষ করে মায়ার দিকে তাকিয়ে দেখি সে কাঁদছে আর আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি তার কান্না দেখে অস্থির হয়ে বললাম,

– আরে আরব কাঁদছেন কেন? কি হয়েছে? আচ্ছা আচ্ছা তাকে ভুলতে হবে না। আপনি প্লিজ কান্না করবেন না। আমি আর কিছু বলব না। সরি…

মায়া চোখ মুছে বলে,

~ আরে শান্ত হন। আপনার কথা শুনে কাঁদছি না। কিছু অব্যক্ত কষ্টের কথা মনে পড়েছে। তাই অজান্তেই কখন যেন চোখগুলো ভিজে গিয়েছে। যাইহোক, আপনি খুব ভালো মানুষ। আর বেশ পঁচাও।

আমি মায়ার লাস্টের কথা শুনে পুরো আশ্চর্য্য! তাকে সাথে সাথেই জিজ্ঞেস করলাম,

– আমি পঁচা! কিন্তু কেন? কি করলাম আবার?
~ আপনি পঁচা নাতো কি? তখন ওভাবে চুপচাপ চোরের মতো আমাকে দেখছিলেন কেন?

আমি মায়ার কথা শুনে লজ্জায় শেষ হয়ে যাচ্ছি। কি বলবো ওকে! তাই মাথা নিচু করে চুপচাপ খেতে থাকি। সে আবার বলে,

~ ভালো হয়ে যান বুঝছেন, নাহলে কিন্তু আপনার খবর আছে। আবার এমন করলে দেইখেন আপনাকে কি করি।
– আচ্ছা হয়েছে সরি। আপনি এত সুন্দর হলে কি করবো আমি! আপনার চুলগুলো এত লম্বা আর ঘন, আমি আগে কখনো সরাসরি এমন দেখিনি। তাই কি যেন….
~ হয়েছে হয়েছে থামুন তো। লজ্জা শরম নেই আপনার দেখছি। উফফ! চুপচাপ খাওয়া শেষ করেন।
– ঠিক আছে।

আমি খেতে খেতে আড়চোখে তাকিয়ে দেখি মায়ার মুখখানায় আবার সেই গোলাপি আভা ধরেছে। মানে সে লজ্জায় একদম নাস্তানাবুদ। এরপর আমাদের খাওয়া দাওয়া শেষ হলে মায়া আবার সব গুছিয়ে ফেলে। মনে মনে ভাবছি, এই মেয়েকে যে বিয়ে করবে তার পুরো রাজ কপাল। আজকাল সাংসারিক মেয়ে পাওয়া আর সোনার হরিণ পাওয়া একই। মনে মনে এসব ভাবতে ভাবতে হলরুমে এসে বসলাম। টিভিটা ছাড়লাম খবর দেখবো বলে। এরমধ্যেই ফোনটা বেজে উঠলো। আর সাথে সাথেই পেলাম ভয়। কারণ মা কল দিয়েছে। আমি মায়ার দিকে তাকাতেই দেখি মায়া আগে থেকেই ঠোঁটের উপর আঙ্গুল দিয়ে ইশারায় চুপ হয়ে আছে বুঝাচ্ছে। আমি হেসেই দিলাম ওর কান্ড দেখে। তারপর গলাটে ঝেড়ে কলটা রিসিভ করলাম।

– হ্যাঁ মা বলো….
~ কিরে এতক্ষণ লাগে কল ধরতে? কইছিলি?
– সরি সরি। (প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলাম)
~ খাওয়া দাওয়া করেছিস বাবা?
– হ্যাঁ মা মাত্রই খেলাম। ওই যে আমাদের এখানে বড়ো রেস্টুরেন্টটা আছে না ওইখান থেকেই খাবার এনেছি।
~ ওহহ! যাক ভালো করেছিস। আমি তো ভেবেছি তুই নিজেই রান্না করবি।
– না আজকে করিনি। তুমি খাওয়া দাওয়া করেছো?
~ হ্যাঁ খেয়েই তোকে কল দিলাম।
– ওহ। তুমি চিন্তা করো না মা। আমি তো আর সেই ছোট না, নিজেকে সামলাতে পারবো।
~ মায়ের মন বুঝবিনা। সন্তান যতই বড়ো হোক না কেন মা বাবার কাছে সে ছোটই থাকে।
– আচ্ছা ঠিক আছে।
~ ঘুমা তাহলে। আজকে তো অনেক সকালে উঠেছিস। আমি রাখছি।
– আচ্ছা। তুমি সাবধানে চলাফেরা কইরো। আর কোন সমস্যা হলে আমাকে জানিও।
~ ঠিক আছে।

মা কল রেখে দেয়। আমি যেন হাপ ছেড়ে বাঁচলাম। ফোন পাশে রাখতেই মায়া এখনো সেই ঠোঁটের উপর আঙ্গুল রেখেই আমার সামনে এসে বসলো। আমি হাসতে হাসতে তাকে বলি,

– এখন কথা বলতে পারেন সমস্যা নেই। হাহা।

মায়াও মুচকি হেসে আঙ্গুল সরালো। আর বলল,

~ আমি ঠিক করেছি, আপনার কল আসলেই আমি চুপ করে থাকবো এভাবে। নাহলে সকালে মতো আবার রাগ দেখাবেন আপনি। সাথে একগাদা লজ্জাও দিবেন।
– আহহা আপনি এখনো মাইন্ড করে আছে। সরি সকালের জন্য।
~ আচ্ছা ঠিক আছে।
– আপনি টিভি দেখবেন? তাহলে দেখতে পারুন। আমি ঘুমাবো, মা ঘুমাতে বলেছে আমকে।
~ বাহ! আপনি তো একদম আপনার মায়ের বাধ্য ছেলে।
– হুম বলতে পারেন। কারণ এই দুনিয়াতে মা ছাড়া যে আপন আর কেউ নেই আমার। তাই মাকে অনেক বেশি ভালবাসি৷ জানেন, বাবা যখন মারা যায় মা অনেক কষ্ট করে আমাকে বড়ো করে। আমি নিজের চোখ দিয়ে মাকে কষ্ট করতে দেখেছি। সে অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করিয়ে আমাকে আজ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার বানিয়েছেন। আমি মাসে এখন লাখ লাখ টাকা ইনকাম করি। আমার মা আজ আরামে আছে। বাবা-মার কষ্ট যদি সন্তানরা না বুঝতে পারে তাহলে কোন দিন সেই সন্তান তাদের মর্ম বুঝবে না। বাবা-মায়ের মতো আপন আর কেউ নেই পৃথিবীতে। আমার মা আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। কিন্তু আমি কোন ভাবেই রাজি হইনি। তাই সে এক প্রকার রাগ করেই গ্রামে ঘুরতে গিয়েছে। কেন বিয়ে করতে চাইনা জানেন?
~ কেন?
– আমি অনেক দেখেছি অনেক। আজকালকার শিক্ষিত মেয়েরা বিয়ে করে শ্বশুর বাড়ি এসে সবার আগে ছেলে আর মায়ের মধ্যে দন্দ লাগায়। তারপর ছেলেকে ম্যানুপ্লেট করে মা বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে বাধ্য করে। আমি এটা কখনো হতে দিব না৷ আমার কোন মেয়েকেই বিশ্বাস হয়না৷ তারা কিভাবে এমনটা করতে পারে! তাদেরও তো বাবা-মা আছে তাইনা। তাদের বাবা-মাদেরও যদি এমন অবস্থা হয় তখন কেমন হবে?
~ সত্যি আপনার মতো সন্তান পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। একটা কথা ঠিকই বলেছেন, বাবা-মা সবচেয়ে বেশি আপন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আপন হলো মা। আপনি খুবই ভাগ্যবান আপনার আপন মা আছে। যে আপনাকে অনেক ভালবাসে।

আমি অবাক হয়ে বললাম,

– কেন আপনার নেই?
~ না না আছে তো। তবে আপনা না, সৎ মা। হাহা।

মায়া অদ্ভুত একটা হাসি দিল। আমি ওর হাসি আর কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লাম। সৎ মা! মানে কি! আমি নড়েচড়ে বসে মায়াকে আবার জিজ্ঞেস করলাম,

– আমি ঠিক বুঝলাম না কিছুই। আমাকে একটু খুলে বলবেন আপনার সম্পর্কে?

মায়া আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে মাথা নিচু করে বলে,

~ আপনাকে এখন কিছু কথা বলবো। তবে আপনি আমাকে প্রমিজ করুন যে আমাকে খারাপ ভাববেন না কিংবা বের করে দিবেন না।
– প্রমিজ প্রমিজ। আপনি শুধু বলুন। আমি সব শুনতে চাই। প্লিজ বলুন।

দেখলাম মায়ার চোখজোড়া অশ্রুতে ভরে এসেছে। সে একবার মুছে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলতে শুরু করলো…

চলবে…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here