ভালবাসার_স্পর্শ পর্বঃ ০৭ লেখকঃ আবির খান

0
646

#ভালবাসার_স্পর্শ
পর্বঃ ০৭
লেখকঃ আবির খান

মায়ার অব্যক্ত অপ্রিয় সত্যগুলো শুনে আমি এখনো স্তব্ধ হয়ে আছি। তবে ও আমার কাছে একটা শেষ আবদার করেছে। আমি চাই ওর আবদারটা পূর্ণতা পাক। তাই নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়ালাম। অনেক কিছু ভাবতে হবে৷ মায়া এই ইট পাথরের শহরটা ঘুরে দেখতে চায়, একটু আনন্দ করতে চায়, জীবনটাকে উপভোগ করতে চায়। আর আমি তার এই প্রতিটি চাওয়া পূরণ করতে চাই। আমি সোজা আমার রুমে এসে ফোনটা খুঁজে বসকে একটা কল দিলাম। কিছুক্ষণ রিং হতেই বস কল ধরে। আমি তাকে সালাম দিয়ে বললাম,

– সরি স্যার এই বন্ধের দিনে আপনাকে কল দিয়ে ডিস্টার্ব করলাম।
– না না সমস্যা নেই আবির। তুমি কি জরুরি কিছু বলবে?
– জি স্যার। আসলে স্যার আমি তো এ পর্যন্ত তেমন কোন ছুটি নেইনি অফিস থেকে। আমাকে কি এক সপ্তাহের জন্য ছুটি দেওয়া যাবে? শুধু এই একটা সপ্তাহ আমাকে ছুটি দিন স্যার। দরকার হলে আমি আর কখনো ছুটি চাইবো না।
– আহহা এভাবে বলছো কেন তুমি! তুমি আমার অফিসের একটা বড়ো সম্পদ। তোমার মেন্টালি ভালো থাকা আমার জন্য অনেক উপকারী। তোমার যে ক’দিন লাগে তুমি ছুটিতে থাকো। কোন সমস্যা নেই।
– সত্যি বলছেন স্যার? (অবাক হয়ে)
– হ্যাঁ।
– অসংখ্য ধন্যবাদ স্যার। আমি এক সপ্তাহই ছুটি নিব। আর বাসায় বসে যতটুকু পারি ততটুকু কাজ করে দিব। কোন কাজ পেইন্ডিং থাকবে না ইনশাআল্লাহ। আমি কথা দিলাম স্যার।
– আচ্ছা আচ্ছা তুমি এত চিন্তা করো না। তুমি রিলেক্সে ছুটি কাটাও। তা আবির তুমি ছুটি কেন নিতে চাচ্ছো সেটাই তো জানা হলো না।
– আসলে স্যার পারসোনাল কিছু কাজ এসে পড়েছে। যেটা না করলেই নয়৷ তাই একটু…
– ওহ! ওকে ওকে। কোন সমস্যা নেই। তুমি ছুটি শেষ করে মাইন্ড ফ্রেশ করে কাজে এসো।
– ধন্যবাদ স্যার৷ ভালো থাকবেন।

এরপর বসকে সালাম দিয়ে ফোন রেখে দিলাম। আসলে বস আমাকে খুব ভালবাসে। বাসবেই বা না কেন, আমার বানানো অনেক সফটওয়্যার, অ্যাপ্লিকেশন থেকে মাসে মাসে অনেক টাকা মুনাফা করে তার কোম্পানি। আর আমাদের বস মনে করেন, তাদের ইম্পোলয়িরা সুস্থ এবং ফ্রেশ মাইন্ডে থাকলে তাদের কাজ থেকে আরও ভালো আউটপুট পাওয়া যাবে। তাই তার কাছে ছুটি চাইতেই তিনি দিয়ে দিয়েছেন৷ আমি চাই এই একটা সপ্তাহ সম্পূর্ণ মায়াকে দিতে৷ তার প্রতিটি ইচ্ছা আমি পূরণ করতে চাই।

দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে আসে। আমি বাইরে গিয়ে কিছু ফাস্টফুড কিনে আনি। এসে দেখি মায়া এখনো বের হয়নি৷ আমি সুন্দর করে খাবারগুলো সাজিয়ে আস্তে আস্তে মায়ার রুমের কাছে গিয়ে দরজায় নক করলাম। দুইবার নক করলাম, কিন্তু কোন সাড়াশব্দ নেই। মনে মনে ভয় পাচ্ছিলাম যে আবার খারাপ কিছু করে বসলো নাকি। তাই মায়া বলে যেই জোরে ডাক দিতে যাবো, তখনই সে বেরিয়ে আসে। বেরিয়েই আমাকে দেখে সে মাথা নিচু করে ফেলে আর বলে,

~ কিছু বলবেন?

আমি লাইটের আলোতে যতটুকু দেখলাম, তাতে বুঝলাম সে অনেক কেঁদেছে এতক্ষণ। আমার ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে উঠে তার এই অবস্থা দেখে। কিন্তু এখন এসবের সময় নেই। আমি মায়াকে অনেক খুশি করতে চাই। তার ইচ্ছাগুলো সব পূরণ করতে চাই৷ আমি খপ করেই তার হাত দুটো ধরলাম। সে বেশ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। মনে হলে একটু ভয়ও পেয়েছে। আমি বেশ কষ্ট করে মুখে হাসি এনে বললাম,

– এভাবে রুমের মধ্যে নিজেকে বন্দী করে রাখলে আপনার আবদারটা কিভাবে পূরণ হবে হ্যাঁ?

মায়া চুপ করে আছে মাথা নিচু করে। আমি তার হাত দুটো ছেড়ে তার গালে হাত দিলাম। সে রীতিমতো কেঁপে উঠে। আমি তাকে অন্যকোনো রিয়েকশন না দিতে দিয়ে তার চোখগুলো একসাথে মুছে দিতে দিতে বললাম,

– এইযে আপনার চোখগুলো যেভাবে মুছে দিচ্ছি, ঠিক তেমনি আপনার সব কষ্টগুলোও মুছে দিব আমি। শুধু আমার উপর একটু বিশ্বাস রাখুন।

আমার কথাগুলো শুনে মায়ার অবাক নয়নগুলো আস্তে আস্তে মলিন হতে থাকে। তার গালগুলো এখনো আমার আয়েত্তে। বেশ নরম তুলার মতো তার গাল গুলো। মেয়েদের গাল যে এত নরম হয় জানা ছিল না। মায়াকে এই নিয়ে তৃতীয় বারের মতো স্পর্শ করছি। প্রথম স্পর্শটা অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল। দ্বিতীয় স্পর্শটা তাকে সামলানোর জন্য ছিল। আর এখনের তৃতীয় স্পর্শটায় আছে তাকে বাঁচতে দেওয়ার বিশ্বাস। আমি মায়ার চোখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। কি সুন্দর একটা নিষ্পাপ মেয়ে। কেউ বাহির থেকে দেখলে কখনোই বুঝবেনা মেয়েটা ভিতর থেকে একদম শেষ। সত্যি বলতে আমিও বুঝিনি। মায়ার যতবার কাছে এসেছিলাম, তখন তাকে অন্য নজরে দেখেছি। সে তখন আমার কাছে অন্যের প্রেমিকা ছিল। কিন্তু আজ এখন মায়া শুধু একটা নিষ্পাপ মেয়ে আমার কাছে। যাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। কাউকে পছন্দ হওয়ার জন্য একযুগ সময়ের প্রয়োজন হয়না, এক মুহূর্তই যথেষ্ট। মায়ার এই করুণ জীবনের গল্প আমার মনে ওর জন্য ভালো লাগা অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। জানিনা কতদিন কতটা প্রহর আমি তাকে আমার কাছে পাবো। কিন্তু সে যতক্ষণ আমার কাছে আছে আমি তাকে আমার মতো করে বাঁচা শিখাবো। আমি জানিনা কেন মায়ার কাছে আসলে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি তার মাঝে। আমার মন চায় সারাটা জীবন আমরা এভাবে একসাথে থাকি। কিন্তু তা কি সম্ভব? জানিনা৷ এখন তা জানতেও চাচ্ছিনা৷ এখন শুধু একটা বিষয়ই জানি, আর তা হলো মায়ার আবদার পূরণ। আমি যখন মায়ার চোখের মাঝে হারিয়ে গিয়েছি তখন সে তা বুঝতে পেরে আমাকে ডাক দেয়।

~ আবির সাহেব…আমাকে কি এভাবেই ধরে রাখবেন?
– এহহহ…ওহহহ না না সরি সরি।

আমি মায়াকে ছেড়ে দিলাম। আর সাথে ভীষণ লজ্জাও পেলাম। মায়া আমার অবস্থা দেখে মুচকি হেসে দিল। আমি তার হাসি দেখে খুশি হলাম। তারপর লজ্জা ভুলে তাকে বললাম,

– অনেক কথা হয়েছে, ওদিকে আপনার জন্য আনা সারপ্রাইজটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। আপনি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আসুন।

মায়া অবাক হয়ে বলে,

~ সারপ্রাইজ! আবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। কি এনেছেন?
– সেটা দেখতে হলে আগে ফ্রেশ হয়ে আসুন।
~ আচ্ছা আচ্ছা আসছি।
– জলদি আসুন। আমি ডাইনিং রুমে অপেক্ষা করছি।
~ ওকে ওকে।

আমি মায়াকে ফ্রেশ হতে পাঠিয়ে দিয়ে ডাইনিং রুমে এসে তার জন্য অপেক্ষা করছি। মায়া পাঁচ মিনিটের মধ্যেই চলে আসে। এসে দেখে পুরো ডাইনিং টেবিল বিভিন্ন ধরনের ফাস্টফুডে ভরা। যেমন, বার্গার, পিজ্জা, পাস্তা, চিকেন ফ্রাই, শিক কাবাব আরও অনেক কিছু। আমি মায়াকে এগুলো সব দেখিয়ে বলি,

– এই হলো আপনার সারপ্রাইজ। কেমন লেগেছে?

মায়া অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। দেখলাম তার চোখগুলো ভিজে আসছে। আমি দ্রুত ওর কাছে গিয়ে বললাম,

– এই এই আবার কাঁদবেন না নাহলে কিন্তু আবার চোখ মুছে দিব৷ কান্নার কি আছে…

মায়া হেসে দেয়। নিজেই চোখ মুছে বলে,

~ এতসব মজার খাবার একসাথে কখনোই দেখিনি। আমার বান্ধবীরা এগুলো খেতো আর আমার কাছে এসে আমাকে বলতো। আমি শুধু হেসে হেসে শুনতাম। কখনো খাইনি এগুলো। আপনি সত্যিই এগুলো আমার জন্য এনেছেন?
– জি। এগুলো সব আপনার। আমি অফিস থেকে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়েছি। এই এক সপ্তাহ আমরা শুধু ঘুরবো আর খাবো। কথা দিলাম আপনাকে।

মায়া অনেক বেশি খুশি হয়। তার খুশি দেখে আমিও একটু স্বস্তি পাই। এরপর আমি মায়াকে বসিয়ে দিয়ে নিজ হাতে তাকে সবগুলো খাবার বেড়ে দিলাম। সে খুব মজা করে খেতে শুরু করে। সত্যিই তাকে দেখে মনে হলো মেয়েটা কখনোই এসব খাবার খায়নি। তাকে একদম বাচ্চা একটা মেয়ের মতো লাগছে। আমি তার সামনে বসে তার খাওয়া দেখছি। সে শুধু মজা করে খেয়েই যাচ্ছে। খেতে খেতে যেই আমার দিকে তার নজর যায় সে মুহূর্তেই লজ্জা পায়। আর খাওয়া থামিয়ে বলে,

~ সরি, আমি একা একাই খেয়ে যাচ্ছি। আপনার কথা ভাবিই নি। আপনি খাবেন না?
– আপনার খাওয়া দেখে মনে যে শান্তি পাচ্ছি তাতে আমার মন আর পেট দুটোই ভরে যাচ্ছে। আপনি আয়েশ করে খান আমি দেখি।
~ আপনিও না। নিন এটা খান।

মায়া আমার দিকে একটা চিকেন ফ্রাই এগিয়ে দিল। আমি না নিলে সে কষ্ট পাবে। তাই আমি নিয়ে তার সাথে খেলাম। মায়াকে এখন অনেক খুশি খুশি লাগছে। তার চেহারায় অন্যরকম একটা উজ্জ্বলতা দেখা যাচ্ছে৷ আমি মনে মনে ঠিক করলাম তার এই উজ্জ্বলতা সে যতদিন আমার কাছে থাকবে আমি ততদিন ধরে রাখবো। মায়া খেতে খেতে বলে,

~ এই খাবার গুলোর নামই শুনে এসেছিলাম এতদিন। কিন্তু কখনো খাওয়া হয়নি। আজ প্রথম খেয়ে বুঝলাম খাবার গুলো কত্তো মজার। আপনি সত্যিই খুব খুব ভালো। আমার পেট একদম ভরে গিয়েছে। আমি টানা তিনদিন না খেয়ে থাকতে পারবো আজ যা খেলাম।

আমি মায়ার কথা শুনে হেসে দিয়ে বললাম,

– হাহা, কি যে বলেন না আপনি। এইটুকু খাবার খেয়ে তিন দিন না খেয়ে থাকবেন! আপনি আসলেই একটা পাগলি।

মায়া হঠাৎ গম্ভীর কণ্ঠে মলিন মুখে আস্তে করে বলে,

~ এটা আমার জন্য কোন ব্যাপারই না। আমি তিনদিন না চার পাঁচ দিনও একটানা না খেয়ে থাকতাম। কেউ এক গ্লাস পানিও সাধে নি আমাকে। সৎ মা আমাকে সবসময় সবার খাওয়া হলে শেষে যা থাকতো তা দিত। যদি কখনো খাবার না থাকতো তাহলে দিতও না। এমন কতরাত গিয়েছে আমি না খেয়ে ক্ষুধার্ত পেটে চোখের জলে বালিশ ভিজিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। বাবা কোনদিন আমাকে জিজ্ঞেসও করেনি আমি খেয়েছি কিনা। কি আশ্চর্য্য তাই না? আসলে আপন মা যে কি জিনিস, সে যখন থাকেনা তখন বুঝা যায়। মা পরিবারের সবাইকে আগলে রাখে। আমার মা আমাকে আগলে রাখতো। ইসস, মা যদি তার সাথে আমাকেও নিয়ে যেত, খুব ভালো হতো তাই না আবির সাহেব?

মায়ার কথা শুনে আমার চোখ ভেঙে কান্না আসছিল। আমি সবকিছু ঝাপসা দেখছিলাম। ছেলে মানুষ, তাই মায়ার সামনে কান্না করা যাবে না। আমি ওকে বললাম, আমি একটু আসছি। বলেই নিজের রুমে চলে আসলাম। কারণ আমি জানি আপন মানুষ হারিয়ে গেলে কতটা কষ্ট ফেইস করতে হয়। আমার বাবা খুব ভালো মানুষ ছিলেন। আমাকে আর মাকে অসম্ভব ভালবাসতেন। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, তাকে ছোটকালেই হারিয়ে ফেলি। তখন বুঝি বাবার ছায়া না থাকলে জীবনটা কতটা কঠিন হয়ে যায়। তাই মায়ার কষ্টগুলো আমি যেন সবচেয়ে বেশি উপলব্ধি করতে পারি। যার জন্য আমি এতটা শক্ত মনের হওয়া স্বত্ত্বেও কান্নাটা চলেই আসে মায়ার কথাগুলো শুনে। আমি বারান্দায় নিরবে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ পিছন থেকে মায়া এসে আমার কাঁধে হাত রাখে আর বলে,

~ আপনি কি কাঁদছেন? প্লিজ কাঁদবেন না আবির সাহেব৷ আমি আপনাকে কষ্ট দিতে চাইনি। প্লিজ..

আমি কোন কিছু না ভেবেই মায়ার দিকে ঘুরে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরি। কারণ তার কণ্ঠ শুনে আমার অতীতের সব কষ্টগুলো আরও বেশি করে মনে পড়ছিল। এদিকে মায়া পাথরের মতো হয়ে আছে। সে হয়তো স্বপ্নেও ভাবেনি আমি এমন কিছু করবো। আমি শক্ত করে তাকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে আছি। মনে হচ্ছিল ঠান্ডা তুলার কোন একটা কিছুকে জড়িয়ে ধরে আছি। আমার উত্তাল মনটা মুহূর্তেই শান্ত হয়ে যায় যখন আমি তাকে জড়িয়ে ধরি। অনেকটা সময় এভাবে কেটে যায়। আমি আস্তে আস্তে মায়াকে ছেড়ে তার সামনে আসি। সে আমার দিকে আর আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি। আকাশে আজ পূর্নিমার সবচেয়ে সুন্দর চাঁদটা উঠেছে। সেই চাঁদের আলো যেন সম্পূর্ণ মায়ার মুখের উপর পড়েছে। সেই আলোতে আমি তার মায়াবী ভীষণ লজ্জামাখা মুখখানা দেখতে পাচ্ছি। আমরা দুজন দুজনের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। আমাদের মাঝে সময় যেন থমকে গিয়েছে। আমি যেন ধীরে ধীরে মায়ার ঘোরে পড়ে যাচ্ছিলাম। চাঁদের আলোতে মায়াকে এত্তো বেশি সুন্দরী লাগছিল আমি বলে বুঝাতে পারবো না। আমি আস্তে আস্তে তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। জানিনা কি হতে যাচ্ছে সামনে। আমি মায়াকে….

চলবে..?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here