ফাগুন_এলো_বুঝি! (০৫)

0
1255

#ফাগুন_এলো_বুঝি!
(০৫)
ধ্রুবর ভ্রুয়ের ভাঁজ উধাও।চেহারা ঝলমল করে উঠল। উত্তেজিত হয়ে বলল,
“মিশু?মানে আমাদের মিশু?
মিশরা হেসে ফেলল ‘ হ্যা। তোমাদের মিশু।
ধ্রুব চোখ কপালে তুলে বলল ‘ও মাই গুডনেস! আমি বিশ্বাস করতে পারছিনা।তুই,তুই এত্ত বড় হয়ে গিয়েছিস?আর তোর সাথে এভাবে দেখা হবে আমিতো ভাবিইনি।
” আমিও ভাবিনি।আর আমি একাই বড় হইনি।এই ক’বছরে তোমারও হিউজ চেঞ্জ এসছে কিন্তু।নাহলে আমারও চিনতে সময় লাগবে কেন?
“কিন্তু তুই কি করে জানলি আমি এখানে? আর এত বছর পর আমাকে দেখে চিনতে পারলিই বা কিভাবে?

” আমিওত এখানেই এডমিশন নিয়েছি এবার।আর আজ ক্লাশে তোমাকে দেখে অনেক পরিচিত মনে হয়েছে।পরে স্যারের মুখে তোমার পুরো নাম শুনে কনফার্ম হয়েছি। আমি কিন্তু ভেবেছিলাম আমার নাম শুনেই তুমি বুঝবে।কিন্তু তোমার কোনও খেয়ালই তখন আমার দিকে ছিলনা।
ধ্রুব মনে মনে বলল
“তখন অন্য কাউকে নিয়ে ভাবনায় ডুবেছিলাম যে!
মুখে বলল,
চল বসি।

ধ্রুব চেয়ার টেনে মিশরাকে বসতে দিল।
নিজে বসতে বসতে বলল,
‘আমি এখনও চিন্তাই করতে পারছিনা যে এত বছর পর তোকে এইভাবে এখানে দেখতে পাবো।
এনি ওয়ে,ফুপি, আংকেল ওনারা কেমন আছেন?
“ভালো আছে।আমিও কিন্তু কল্পনায় ও ভাবিনি এখানে এসে তোমাকে পেয়ে যাবো।মম জানতে পারলে কত খুশি হবে জানো?এত বছর বাদে সবাইকে ফিরে পেয়ে সবাই যে ঠিক কত টা চমকাবে ভাবতে পারছো?

‘আন্দাজ করতে পারছি।মা,বাবা ভীষণ মন খারাপ করতেন ছোট ফুপির জন্যে।আজ সত্যিই পুরোনো খুশি ফিরে পাবেন তারা।

মিশরা হাসলো।
“তুমি কিন্তু বেশ হ্যান্ডসাম হয়েছ।
ধ্রুব ছোট চোখে তাকালো ‘ আগে ছিলাম না?

” তখন ছোট ছিলাম। তাই বুঝিনি..
” ক্লাস তো এখনও শেষ হয়নি।তুই ক্লাসে যাসনি?
“গিয়েছিলাম, হাফ টাইমে বার হয়ে গিয়েছি,তোমাকে ধরবো বলে।
ধ্রুব দুই ভ্রু ওঁচালো,
“প্রথম দিনেই ক্লাস বাং?

রিদ ফিরে এসে ধ্রুব কে খুঁজছে।কপালে গাঢ় ভাঁজ। ।চোখমুখে বিরক্তি স্পষ্ট। নোরার একেকটা প্রশ্নে নাজেহাল অবস্থা হয়েছিল একটু আগে।মেয়েটা ধ্রুবর জন্যে এত্ত পাগল না হয়ে তার জন্যে এর আধ ইঞ্চি পরিমান থাকলেই চলতো।আজ অব্দি চেয়েও একটা গার্লফ্রেন্ড হয়নি।আর ধ্রুব?লাকিলি সব মেয়ের প্রোপোজাল ওই পায়।রিদ বিরক্তির শীষ টানলো।
” ধ্রুব আমাকে কেনো খুঁজেছিলো?
ওকি তবে আমাকে নিয়ে কিছু ভাবছে?
নোরার এই প্রশ্নটা মনে পড়লেই মেজাজ খারাপ হচ্ছে।ভাল্লাগছেনা।ধ্রুবকে মারতে মন চাইছে।শালা তোর এত হ্যান্ডসাম হতে হবে কেন?কেনই বা ভালো গান গাইতে হবে?হোয়াই?
হঠাৎ চোখ পড়লো নোরা এদিকেই আসছে।রিদ চোখ বড় করে দুদিকে মাথা নাড়লো।সে আর ঝামেলা ঝক্কি পোহাতে চায়না।ছুটে পিলারের আঁড়ালে লুকালো গিয়ে।
“ধ্রুব ব্যাটা আমাকে ফাসিয়ে দিয়ে,কোথায় হারিয়ে গেলি?
রিদের অসহায়ত্ব কমলো নোরা ক্যান্টিন ছেড়ে বের হলে।আড়াল ছেড়ে সরে এলো রিদ।চারপাশে ধ্রুবকে খুঁজল।এক কোনার টেবিলে ধ্রুব আর সামনে মেয়ে মানুষ দেখে চোখ মারবেলের মত হয়ে এলো ।চোখ ডলে আবার তাকালো।
“না ঠিকইতো দেখছি।কিন্তু কথা হলো,এ আমি কি দেখছি? ধ্রুব ভাই তোর কি হয়ে গেলো!তুই কিনা কোনও মেয়ের সাথে ক্যানটিনে বসে আছিস?এরম হেসে হেসে গপ্প করছিস?এত ঝটকা হজম করতে পারছিনা আমি।পারছিনা।

মিশরার সাথে ধ্রুবর কথার শেষ নেই।ছোট বেলা থেকে দুজনের দারুন ভাব।ধ্রুব কথার এক ফাঁকে হাত ঘড়ি দেখলো।ভার্সিটি ছুটির সময় হয়েছে।
‘ক্লাশ শেষ হবে।তার মানে পূর্ণতাও বেরিয়ে যাবে।যেতে হবে এক্ষুনি।
মিশরা নিজের মত বকবক করছিল।ধ্রুব ব্যাস্ত কন্ঠে বলে ওঠে
‘মিশু,আমার একটা জরুরি কাজ পরে গেছে রে।আমাকে এখন যেতে হবে।
ধ্রুব উঠে পরলো।
“তুই এক কাজ কর, তোদের বাসার এড্রেস টা আমাকে টেক্সট করে দে।
” আচ্ছা ঠিক আছে, তোমার নম্বর দাও।
__
ধ্রুব আসতে দেরি করেছে।পৌঁছানোর পূর্বেই পূর্নতা রুপকে নিয়ে গেট পেরিয়েছে ভার্সিটির।
ধ্রুব কোথাও পেলোনা।মুখ দিয়ে ‘চ’ বর্গীয় শব্দ করে বলল,
“ধ্যাত অল্পের জন্যে মিস হয়ে গেলো।আবার ২৪ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে ওকে দেখতে।
কানের কাছে রিদ খুকখুক করে কেশে উঠলো।ধ্রুব তাকাতেই বলল,
‘কাউকে খুঁজছো বন্ধু?
ধ্রুব ছোট করে বলল ‘ না।
‘আসলেই না?
‘কাকে খুঁজব আমি?
রিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“কি জানি!আজকাল জনাবের যা মতিগতি দেখছি।
ধ্রুব ভ্রু কোঁচকায়,
‘মানে কী?
‘ক্যানটিনের মেয়েটা কে ছিলো তখন?
রিদ সিরিয়াস হলো।
ধ্রুব মনে করে বলল,
– ও,ওটা? ওটা আমার কাজিন।মানে আমার ছোট ফুপির মেয়ে।এখানেই পড়ে।
রিদ সন্দেহি কন্ঠে বলল,
– তোর কাজিন? কই আগে তো দেখিনি।
“কিভাবে দেখবি?আমি নিজেই তো জানতাম না।তাছাড়া ওদের সাথে আমাদের অনেক বছর যোগাযোগ ছিলোনা।কোনও একটা কারণে ছোট ফুপি বাবার ওপর অভিমান করেন।সেই অভিমানের জের ধরে নিজে থেকেই সব যোগাযোগ বন্ধ করে দেন।তারপর বাবার পায়ের ফ্রাকচারের ট্রিটমেন্ট এর জন্যে রাতারাতি আমাদের বিদেশ যাওয়া হলো।কলেজ ওখানেই।দেশে এসে জানলাম আঙ্কেলদের পৈতৃক বাড়িতে তার ছোট ভাইয়ের পরিবার থাকে।তারা ঢাকায় শিফট করেছেন।নামটা ছোট হলেও শহর তো ছোট নয়।ওনাদের আর খুঁজে পাইনি।আজ হুট করেই দেখা হলো।তবে আমি ওকে চিনতে পারিনি প্রথমে জানিস। কিন্তু ও ঠিকই চিনলো।
রিদ ধ্রুবর থুতনী ধরে বলল,
” তোর এই মাখন মার্কা ফেসটাতো রি-মার্ক-আবল।
যে একবার দেখবে তারই মনে থাকবে।

ধ্রুব হাতটা সরিয়ে দিয়ে মুখ কুঁচকে বলল’ আবার ফালতু কথা!

—-
মম প্লিজ!সেই কবেকার মান -অভিমান বাদ দাওনা ওসব।এতদিন বাদে ধ্রুব ভাইয়াকে দেখলাম,মামা মামুনিকেও দেখতে চাই আমি।তাছাড়া আমি জানি তুমিও চাও।আমার সাথে অন্তত মিথ্যে রাগ দেখিওনা।

সায়রা ভারি নিঃশ্বাস ফেললেন।বাড়িতে এসে থেকে মিশরা সমানে বুঝিয়ে যাচ্ছে ধ্রুবদের সাথে সব ঠিক করার কথা।সায়রা প্রথমে খুশি হলেন ধ্রুবর কথা জেনে।পরে কিছু একটা মনে করে চুপ থাকলেন।এক কথায় বললেন,ওদের সাথে যোগাযোগ রাখার দরকার নেই।মিশরাও হেরে যাওয়ার পাত্রী নয়।সে পণ করেছে মামার সাথে মায়ের ভাব করিয়েই ছাড়বে।

“মিশু! তুই যেটা বুঝিস না সেটা নিয়ে কথা বলিস না।,আমি চাইলেও সব কিছু ভুলতে পারছিনা।তোর মামা পূর্নতার জন্যে আমার গালে চড় মেরেছেন। মেয়েটার জন্য যা নয় তাই বলেছেন।কে ও? আমার সৎ মেয়ে।নিজের ছোট বোনের থেকে ওই মেয়েটা বেশি বড় হল? ভাইয়ার কাছে ন্যায় অন্যায় বেশি দামী হয়ে গিয়েছিলো তখন।আমি চাইলেও সেটা ভুলতে পারছিনা মিশু।

আশরাফ তখন ঢাকার বাইরে।ছোট পূর্নতা একবার সিড়ি মুছে ময়লা পানি ফেলতে গিয়েছিল।সেই ফাঁকে দৌড়ে নামছিল মিশরা।পূর্নতা দূর থেকে দেখেই চিৎকার করে মানা করা সত্ত্বেও মিশরা কানে নিলোনা।ঠিক পা পিছলে পরে গেল।ওর কান্নার শব্দে রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন সায়রা।মিশরা কেঁদেকেটে নালিশ জানালো।ইচ্ছে করে পূর্নতা এমন করেছে যাতে মিশরার পা ভাঙে।সায়রা রাগে ফেঁটে পরে পূর্নতার হাত টানতে টানতে নিয়ে গেলেন। রান্নাঘরে রাখা ফুটন্ত তেলের কড়াইয়ে চুবিয়ে দিলেন হাত।পূর্নতা ছিটকে হাত সরাতে গেলেই কড়াই উল্টে পরলো গায়ে।সায়রা ভড়কে হাত ছেড়ে দিলেন।সারা শরীরে গরম তেল পরায় মেঝেতে গলা কাটা মুরগির মত ছটফট শুরু করলো পূর্নতা।তখনি মেহবুব এলেন বাড়িতে।পূর্নতার চিৎকার শুনে ছুটে গেলেন।মেয়েটার অবস্থা দেখে হন্তদন্ত হয়ে ওকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটলেন।সায়রার সাথে কথা বাড়ালেন না একটাও।পূর্নতা সুস্থ হলো বিকেলে।মেহবুব আশরাফ কে জানালেন।তবে সত্যিটা লুকিয়ে।আশরাফ ও ফ্লাইটে ছুটে এলো।মেহবুব পূর্নতাকে আশরাফের কাছে হাসপাতালে রেখে চলে এলেন বাড়িতে।সায়রার হাবভাবেই বুঝলেন ওরই কাজটা।এলোপাথাড়ি কত যে চড় মেরেছেন হিসেব নেই তার।শাসিয়ে ছেন কড়া কন্ঠে।সায়রার রাগ হলো।অন্যের মেয়ের জন্যে তার ভাই তাকে মারলো?আশরাফ এসবের কিছুই জানেনা।পূর্নতা কথা বলার অবস্থায় ছিলনা।সায়রা বলেছে পূর্নতা আর মিশরা খেলছিল, এক সময় রান্নাঘরে চলে আসে, দূর্ঘটনায় তেল গায়ে পরে।আশরাফ বিশ্বাস করলেন।পরবর্তীতে,সায়রা পূর্নতাকে শিখিয়ে দিলো ঢাকায় শিফট করার কথা।সে যেন বাবাকে বলে সে ঢাকা পড়াশোনা করতে চায়।সরল-ভদ্র পূর্নতা তাই করলো।মেয়ে মুখ ফুঁটে সহজে কিছু চায়না।এক কথায় আশরাফ রাজি হলেন।নারায়নগঞ্জ থেকে সবাই শিফট করলেন মূল শহরে।মেহবুব প্রথমে রেগেমেগে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেন।এরপরপরই গাড়ির চাকায় পা পরলো।ফ্রাকচার হলো।পরিবার সহ ছুটলেন বিদেশে।সেলিনা অনেক চেষ্টা করলেন সায়রার সঙ্গে যোগাযোগ করার।হলোনা।বাকি বোনেরা এলেও সায়রা দেখা দেয়নি।আশরাফের নম্বরেও কল ঢুকতোনা।কারন আগেই সায়রা ব্লাকলিস্ট করে রেখেছিল।আর আশরাফ ও ব্যাবসা ট্রান্সফারের ব্যাস্ততায় যোগাযোগ করতে পারতেননা।
মেহবুবের অভিমান পরে গেল এক সময়। শত হলেও ছোট বোনটাকে নিজে পেলেপুষে বড় করেছিলেন।চেয়েও পারলেন না যোগাযোগ করতে।সায়রার ভাবনার সুতোতে টান পরলো মিশরার আওয়াজে।

” মম,মামা তো এরকমই।অন্যায় কখনওই সে বরদাস্ত করতে পারেন না।আর সত্যি বলতে ভুল টা বাবার না তোমারই ছিলো।কারো গায়ে ফুটন্ত তেল ঢেলে দেয়া তো ভালো কাজ ছিলোনা বলো।বাবা সেদিন বোঝেননি কাজটা তোমার।কিন্তু মামা কি অত বোঁকা বলো?সে ঠিক বুঝে ফেললেন।তোমাকে প্রশ্ন করলে তুমিও চটপট মিথ্যে বলতে পারলেনা।ধরা খেলে।তাই জন্যেই না মামা রেগে তোমাকে থাপ্পড় মারলেন।পূর্ণতাকে আমি সহ্য করতে না পারলেও সেদিনের ব্যাপার টা কিন্তু আসলেই ভুল ছিলো মম।ওর সারা গায়ে কেমন ফোস্কা পরে গেছিল।আমার মায়া লেগেছিল ওর জন্যে।
আর মামার তো দয়ার শরীর।একজন ন্যায় বিচারক হিসেবে এরকম করা কোনো দোষের ছিলনা।

সায়রা চুপ করে গেলেন।বড় ভাইয়ের জন্যে মন তারও কাঁদে।কিন্তু, ইগো আর রাগের দরুন পেরে ওঠেনা নত হতে।সায়রা ছোট্ট শ্বাস ফেললেন,
” বেশ!আমি ফোন করছি।
মিশরা উৎফুল্ল হয়ে বলল,
“সত্যি??
ও মম ইউ আর গ্রেট!ইউ আর যাস্ট গ্রেট মম।
মিশরা মাকে জড়িয়ে ধরলো।সায়রা মুচকি হাসলেন।হঠাৎ ডোরবেল বাজলো।

‘ দ্যাখ কে এলো।খুলে দিয়ে আয়।
‘আমি কেন যাব?পূর্নতা আছেনা।
সায়রা সুন্দর করে বললেন ‘ যাও মা।তোমার বাবা হলে খুশি হবে।
মিশরার অভিব্যাক্তি পাল্টালো।ঠোঁট কামড়ে ভেবে, বসা থেকে উঠে গেল দরজা খুলতে।সায়রা সেদিক চেয়ে আরেকবার হাসলেন।মেয়েটা বাবার ভালোবাসার জন্যে কাঙাল থাকে।অথচ তুমি বোঝোনা আশরাফ!

__
মিশরা দরজা খুলল।ওপাশের মানুষ গুলোকে দেখতেই হোচট খেল এক প্রকার।সেকেন্ড খানেক থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে চিৎকার করে বলল ‘ মামা!

মেহবুব হাত পাতলেন।ওমনি মিশরা ঝাপিয়ে পরলো তার বুকের ওপর।মেহবুব মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন
‘কেমন আছিস মা?কত বড় হয়েছিস।
‘ভালো আছি মামা।মম ভালো নেই তোমাদের ছাড়া।
মিশরার চোখে জল চলে ভিড়েছে আনন্দে।

“শুধু কি মামাকেই আদর করবি? আমি বুঝি কেউনা? আমি যে কতক্ষন ধরে পাশে দাঁড়িয়ে আছি আমাকে তো কারও চোখেই পড়েনা।
সেলিনার অভিমানি স্বর।মিশরা হেসে চোখ মুছে বলল,
‘তুমিইতো আমাদের সব মামুনি।মমের পরে আমাকে এত আদর কেউ করে?
‘আয় দেখি তাহলে, একটু মামুনির বুকে আয়।
মিশরা সেলিনাকে জড়িয়ে ধরলো।মিশরার চিৎকার শুনে ওপর থেকে নেমে এলেন সায়রা।দরজায় ভাই ভাবিকে দেখে চোখ ফেটে অশ্রু ইতোমধ্যে বেরিয়েছে।পুরোনো অভিমানের জের ধরে ঠাঁয় দাঁড়ানো সায়রাকে মেহবুব ভেজা কন্ঠে বললেন,
“সায়ু!আমাদের বুঝি তোর বাসায় ঢুকতে দিবিনা?বাইরেই দাড় করিয়ে রাখবি?
ভাইয়ের মুখে সেই আদুরে ডাক।শাড়ির আঁচল মুখে চেপে সায়রা হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল।মেহবুব এগিয়ে এসে মাথায় হাত রাখতেই জড়িয়ে ধরলেন সায়রা।মেহবুব ও কাঁদছেন।
”জানিস ধ্রুব যখন আমাদের জানালো যে ও মিশু মাকে দেখেছে আমি আর এক মুহুর্ত ও নষ্ট করিনি।তোর ভাবীকে নিয়ে ছুটে চলে এলাম।জানিস কত চেষ্টা করেছি তোর সাথে যোগাযোগ করতে।,কিভাবে পারলি তুই এতদিন নিজের ভাইয়ের থেকে দূরে থাকতে?
সায়রা কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
– আমার ভুল হয়ে গেছে ভাইজান।আমাকে ক্ষমা করে দাও।
সেলিনা চোখ মুছতে মুছতে বললেন,
“হয়েছে হয়েছে,তোমরা দুজন এখন কান্না থামাওতো।নাহলে আমিও কিন্তু কেঁদে ফেলবো।
বসার ঘরে এত শোরগোল শুনে রুম ছেড়ে বের হলো পূর্ণতা।সেদিনের পর থেকে সায়রা তার সাথে কথা বলেন না।কোনও কাজেও বলেননা।বলবেন কি করতে হয়না এখন।অথচ কিছুদিন আগেও এই বাড়ির বাসন মাজা থেকে শুরু করে ঘরের প্রতিটি কোনা তাকে পরিষ্কার করতে হয়েছে।আশরাফ একদিনের মধ্যে দুজন কাজের লোক নিয়োগ করেছেন।সব কাজ তারাই করে।পূর্ণতা বাইরে থেকে এসেই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরেছিলো।কারো কান্না আর কথা বলার শব্দে তড়িঘড়ি করে নিচে নামল।,আবার কোনও অশান্তি হলো কিনা!ঘর পোঁড়া গরু তো, সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় হয়।

সোফায় বসা সেলিনাকে পূর্নতার চোখে পরলো আগে।দৃষ্টি ওখানেই আটকে গেল তার।বুক ফেঁটে কান্না পেল।ইচ্ছে করলো ছুটে ঝাপিয়ে পরতে ওই কোমল,নরম বুকটায়।পাশে বসে থাকা মিশরা আর সায়রার জন্যে ইচ্ছেটা ওখানেই দাফন করলো পূর্ণতা।কিন্তু কান্না কী থেমেছে?তার চোখ ভিজে অশ্রু গাল অব্দি গড়িয়েছে। সম্পর্কে এরা ছোটমার ভাই -ভাবি।অথচ কোনো দিন তাকে মিশরার থেকে আলাদা করে দেখেনি। আদর করতেন,কোলে নিতেন,খাইয়েও দিতেন।সেও মিশরার দেখাদেখি মামা -মামুনি বলে ডাকতো।এই ডাক,এই আদর পাওয়া নিয়ে মিশরার সাথে কত ঝগড়া হয়েছে,মারামারি হয়েছে ছেলেবেলায় হিসেব নেই।মিশরা খুব রেগে বলতো ‘ তুই আমার মামা -মামুনিকে মামা মামুনি বলে ডাকবিনা।
পূর্নতা ফের ডাকলেই মিশরার গুটিগুটি হাতের নখ বিধে যেত শরীরে।মুখে।
‘পূর্না না?
সেলিনার অনিশ্চিত কন্ঠ।পূর্নতা এতই ডুবে ছিল ভাবনায় চমকে তাকালো সে।সিড়ির গোড়ায় সোজা হয়ে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে সেলিনার কথায় বাকিরাও ঘুরে তাকালো।মিশরা আর সায়রার হাসি নিভে গেল।মেহবুব আপাদমস্তক দেখে চওড়া হেসে বললেন,
‘এটা কী আমাদের পূর্নতা?
ছলছল চোখে তাকালো পূর্ণতা।আবারও সায়রা মিশরার দিক চেয়ে চোখ নামিয়ে ফেলল।তার পা দুটো কোনো ভাবেই এখানে থাকতে চাইছেনা।ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে সেলিনা আর মেহবুবের কাছে।সেলিনা উঠে গেলেন বসা থেকে।
‘কী রে পূর্নতা,মামুনিকে বুঝি চেনা যায়নি?ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কাছে আসবিনা?
সায়রার মোলায়েম কন্ঠ।
পূর্নতা কাউকে তোয়াক্কা করলোনা এই ডাকে।দৌড়ে গিয়েই সেলিনাকে জড়িয়ে ধরলো।নাকে বিঁধলো সেলিনার গা থেকে পাওয়া পুরোনো সেই মিষ্টি মা’ মা’ গন্ধ।এটাত সায়রার থেকে পাওয়ার কথা ছিল তাইনা!
হুহু করে কেঁদে ওঠে পূর্নতা।সেলিনার চোখেও জল।আশরাফ আর সায়রার বিয়েতে প্রথমবার মেয়েটাকে দেখেছিলেন।কি নাদুস- নুদুস পুতুলের মত দেখতে ছিল।সেলিনা এসেই কোলে নিয়ে আদর করলেন।ওইটুকু আদরেই মেয়েটা আর পিছু ছাড়লোনা।সমস্ত বিয়ে বাড়ি আঁচল ধরে থাকলো।খেলোও তার হাতে।এরপর থেকে যত বার তারা ওদের বাড়ি যেতেন,বা পূর্নতা আশরাফ -সায়রার সঙ্গে সেলিনাদের বাড়ি যেত পূর্নতা গিয়েই সেলিনার বুকের মধ্যে ঢুকে থাকত।একদম খরগোশ ছানার মত চুপ করে বসতো।আর বলতো
“,তুমি আমার আরেক মা মামুনি।মা মরা মেয়েটাকে দেখলেই সেলিনার কষ্ট হতো।ওর প্রতি সায়রার দূর্ব্যাবহারে রাগ হতো।নিজের সর্বচ্চ দিয়ে চেষ্টা করতেন মেয়েটাকে যত্ন করার।কতবার বলেছিলেন আমার কাছে এনে রাখি ওকে।মেহবুব তখন জানতেন না সায়রা পূর্নতার সাথে এমন করে। তাই বলতেন
“এনে রাখলে আশরাফ সায়রাকে কী ভাববে? মেয়ের জন্যে যাকে বিয়ে করলো সেই মেয়ে তার কাছে থাকবেনা, এরকমই মনে করবে।কী দরকার ওদের সংসারে অশান্তি করার!আর তারপর যখন জানলেন,তখন তো সম্পর্কটাই থেমে গেল।
সেলিনা পূর্নতার কপালে চুঁমু খেলেন।
পাশ থেকে মেহবুব গাল ফুলিয়ে বললেন ‘ মামুনিই বুঝি সব,আর এই মামা টা বুঝি পর তাইনা রে?
চোখ মুছে হেসে তাকেও জড়িয়ে ধরলো পূর্ণতা।এদের কাছে এলে একটা কথাই মনে হয়,কত ভালো মানুষ!পর জেনেও তাকে মিশরার থেকে কোনও অংশে কম ভালোবাসেনা।

মিশরা বিরক্তির শ্বাস ফেলল।এইসব তার চোখে শুধুই মেলোড্রামা।অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে ছিল।আর পারছেনা। মিশরা উঠে যেতে নিলে সায়রা হাত চেপে ধরলেন।ইশারা করলেন চুপ করে বসে থাকতে।অগত্যা মিশরা বসে রইলো।কিন্তু কটমট করে পূর্নতার দিক চেয়ে থাকলো।এই মেয়েটা তার প্রত্যেকটা আদরের জায়গায় ভাগ বসায়।বাবা থেকে শুরু করে মামা- মামুনি অব্ধি।
“ভাবী!ধ্রুব-ধীর ওরা আসেনি?
সেলিনা মন খারাপ করে বললেন,
‘ধীরের কথা আর বোলোনা।ক্রিকেট খেলে তো।সারাক্ষন খেলা নিয়ে পরে থাকে।আজ এই ম্যাচ তো কাল সেই ম্যাচ।ও অবশ্য জানেনা আমরা এখানে এসেছি।জানলে আসতোনা মানে !তবে ধ্রুব আসছিলোই।মাঝ রাস্তায় ওর এক বন্ধুর এক্সিডেন্ট এর খবর পেয়ে সেখানে গিয়েছে।হসপিটাল থেকে সোজা এখানে আসবে বলেছে।
মামা,মামুনিকে চিনলেও ধ্রুব কে পূর্ণতা তেমন চেনেনা।তবে শুনেছে তার নাম। ছোটবেলায় যতবারই মামা মামুনি তাদের আগের বাড়িতে আসতেন,ধ্রুবকে আসতে দেখেনি।এমনকি যত বারই পূর্ণতা তাদের বাসায় গিয়েছে,ধ্রুব কে রুম ছেড়ে বের হতে দেখেনি।শুনেছিল ভীষণ পড়াকু ছেলে।সারাক্ষন নাকি পড়ে।দেখেছিলও কয়েকবার।ধ্রুব ক্লাশ নাইনে পড়তো তখন।মাথায় সজারুর মত চুল, চোখে চশমা শুধু এটুকুই মনে পড়ছে।একবার পূর্নতা ধীরের রুম থেকে বল নিয়ে খেলছিল।বল টা ছুড়ে মারতেই ঢুকে যায় ধ্রুব’র ঘরে।সোজা গিয়ে লাগে টেবিলে সাজানো যূগল মাটির পুতুলের একটাতে।মেয়ে পুতুল টা বল লেগে মেঝেতে পরে ভেঙে যায়।পূর্নতার বয়স নয়।বলের পিছু নিয়ে দেখল ধ্রুবর হাতে সেটা।গিয়ে নম্র কন্ঠে বলল’ আমার বল দিন। ধ্রুব তাকালো। রেগে এমন এক ধমক দিলো,ভয়ে ছুটে পালালো পূর্নতা।তারপর থেকে আর সে ধ্রুব’র ধারে কাছেও ঘেঁষেনি।ধ্রুব’র নাম শুনলেও ভয় লাগে।মনে মনে ঘোষণা করেছে ধ্রুব বদমেজাজি।অথচ সে আদৌ জানেনা বদমেজাজি ছেলেটা ভার্সিটিতে এখন কুলেস্ট,চকলেট বয়ের খেতাব জিতেছে।তবে আর একটা মানুষ আছে যাকে পূর্নতা খুব ভালো করে চেনে।আর ভালোওবাসে।সেটা হলো ধীর।যে ছোট্ট থেকে তার আশপাশে থাকতো।
কিন্তু ইদানিং তো দেখছি ধ্রুব নামটাই তার আশেপাশে ঘুরছে।মামুনির ছেলের নামও ধ্রুব,আবার তাদের ভার্সিটির মোষ্ট টেলেন্ডেড, ক্রাশ বয় ও কিনা ধ্রুব?কি অদ্ভুত! এতো দেখছি ধ্রুবের ছড়াছড়ি…
পূর্ণতার ধ্যান ভাঙলো কারো কলিং বেল বাজানোর শব্দে।মিশরা লাফিয়ে বলল
‘ মনে হয় ধ্রুব ভাইয়া এসছে।এই পূর্নতা যা দরজা খুলে দে…
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here