#ফাগুন_এলো_বুঝি
(১৮)
পূর্ণতা!বোন আমার।
ডাক শুনে ফিরে তাকাল পূর্ণতা।ভার্সিটি শেষে উঠতে যাচ্ছিল গাড়িতে।এর মধ্যে রিদ এসে ডাকল।পূর্ণতা ওকে দেখে মৃদূ কন্ঠে সালাম দিল।
রিদ সালামের উত্তর দিয়ে বলল,
‘বাসায় যাচ্ছিলে নাকি?
পূর্ণতা মাথা নাড়ল।
‘জ্বি।
‘দু মিনিট কথা বলা যাবে বোনটি!
‘জ্বি বলুন ভাইয়া।
রিদ এগিয়ে গেল একটু।
‘শুনেছি তোমার কোনো ভাই নেই।
‘না।আমি আর মিশরা দুই বোন শুধু।ভাই নেই।
রিদ ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘কে বলল নেই?এইযে আমি।আজ থেকে আমিই তোমার ভাই পূর্ণতা।বোন ডেকেছিতো তোমাকে।
পূর্ণতা শুভ্র হাসল।রিদ বলল,
‘এখানে কোনো ধরনের সমস্যা হলে আমাকে জানাবে।বা ধ্রুবতো আছেই।আমরাই ভার্সিটির রাজা বুঝলে।উই আর সিনিয়র!
পূর্ণতা মনে মনে বলল,
‘আপনার বন্ধুই আসল সমস্যা।যেখানে সেখানে হাবিজাবি বলে।
মুখে বলল ‘ জানাব ভাইয়া।
‘গুড!
রিদ ঠোঁট ভেজাল জ্বিভ দিয়ে।পূর্ণতা বুঝতে পারছেনা রিদের আসল ধান্দাটা কী?হঠাৎ এত আলাপ করতে এলো কেন?
তখনি রিদ জিজ্ঞেস করলো,
‘আচ্ছা তুমি নাঁচ জানো?
পূর্ণতা অনতিবিলম্বে জবাব দেয়,
‘না ভাইয়া।
‘আরে না জানলেও সমস্যা নেই।পানিতে না নামলে কেউ সাতার কাটতে পারে?তেমন তুমিও শিখে যাবে।
পূর্ণতা বলল,
‘ঠিক বুঝলাম না ভাইয়া।
রিদ এতক্ষন পূর্নতাদের গাড়ির সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো ছিল। এবার দাঁড়াল সোজা টানটান হয়ে।মন খারাপ করে বলল,
‘আসলে হয়েছে কী বোন,সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকে আমি ডান্স প্রোগ্রাম এটেন্ড করছি।আমার সব সময় পার্টনার হতো নোরা।কিন্তু ও এবার আমায় ইগনোর করে ধ্রুবকে বেছে নিয়েছে।আর আমাকে করেছে অপমান।ধ্রুবর পেছনে এতকাল ঘুরঘুর করে একটু চান্স পেয়েছে বলে আমাকে ছুড়ে ফেলল?
রিদ বহুচেষ্টা করলো চোখে পানি আনার।কিন্তু এলোইনা।নিজেই বিরক্ত হলো নিজের চোখের প্রতি।পূর্ণতা চিন্তিত কন্ঠে বলল,
‘তাহলে এখন?আপনি পার্টিসিপেট করবেন না?
রিদ দুঃখি দুঃখি মুখ করে তাকাল,
‘করতে তো চাইছি।সাথে চাইছি ওই অহংকারী নোরাকে একটা যোগ্য জবাব দিতে।তুমি কী আমাকে একটু সাহায্য করবে বোন?
পূর্ণতা বুঝলনা।নরম কন্ঠে বলল
‘আমি?বলুন।সাধ্যে থাকলে চেষ্টা করব।
‘আছে, তোমার সাধ্যেই আছে।তুমি চাইলেই পারবে।
‘বলুন ভাইয়া।কী করতে পারি?
‘তুমি আমার ডান্স পার্টনার হও প্লিজ!
পূর্ণতা হতভম্ব হয়ে গেল।এটাত ধারনাতীত ছিল।জোরে মাথা ঝাকিয়ে বলল,
‘অসম্ভব!আমি নাঁচতে পারিনা ভাইয়া।সেই কবে ক্লাশ সিক্সে নেঁচেছি।
‘এখনও পারবে।প্লিজ আপুমনি।আজ এক ভাইয়ের অনুরোধ ফিরিয়ে দিওনা।তোমার নিজের ভাই যদি কিছু চাইতো না বলতে পারতে?পারতেনা।তাহলে আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছো কেন?তুমিতো পাষাণ নও,তাহলে কেন এত নিষ্ঠুর আচরন বোন?কেন এক ভাইয়ের সন্মান রক্ষা করবেনা?ভাইয়ের সন্মান রক্ষার দ্বায় কী বোনেদের নয়?
রিদের সিনেম্যাটিক কথাবার্তার প্রকোপে পূর্ণতা আর কিচ্ছু বলতেই পারলনা।কোমল মেয়েটা আরো কোমল বনে গেল।
রিদ অনুরোধ করল,
‘প্লিজ পূর্ণতা রাজি হয়ে যাও।শুধু কালকের দিন।
পূর্ণতা মেনে নিল
‘ঠিক আছে ভাইয়া।
রিদের কান্না কান্না ভাব উবে গেল তৎক্ষনাৎ। ঠোঁটে ফুটলো বিজয়ের হাসি।উত্তেজিত হয়ে বলল,
‘সত্যি তুমি রাজি?
রিদের হাসি দেখে ভালো লাগল পূর্নতার।নিজেও হেসে বলল
‘জ্বী।তবে কতটা কী করতে পারব জানিনা।কখনও কাপল ডান্স করিনি।
‘আরে কিচ্ছু চিন্তা কোরোনা।আমি আছিনা!তুমি এখন বাড়ি যাও তাহলে।বিকেলের দিকে এসো।রিহার্সাল হবে।আর প্রোগ্রামের দিন আসবে খুব সকালে।বিকেলের দিকে প্রোগ্রামতো!অতক্ষন আমাদের চার মিনিটের পার্ফমেন্সের জন্যে এনাফ।
পূর্ণতা মাথা ঝাঁকাল।পূর্ণতাদের গাড়ি যেতেই ধ্রুব এসে পাশে দাঁড়াল রিদের।
‘কীরে শালা, হলো রাজি?
রিদ চোখ টিপে বলল
‘না হয়ে যাবে কই মামা?যা এক্টিং করেছি।
ধ্রুব ওর কাঁধ চাঁপড়ে তুষ্ট কন্ঠে বলল,
‘এই জন্যেইতো তোকে পাঠালাম।তুই ছাড়া এই কাজ হয় কখনও?
রিদ চোখ সরু করে বলল
‘এত গ্যাস দিয়ে লাভ নাই মামা।কথামতো টাকা দাও।পুরা পাঁচশ টাকা বলেছিলি কিন্তু।
ধ্রুব পকেট থেকে এক হাজার টাকার কচকচে নোট বের করে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘তুই পুরোটা রাখ।যা করেছিস তাতে খুশি হয়ে বখশিশ দিলাম
রিদ টাকায় চুমু খেয়ে বলল,
‘বা! বাহ!ভরদুপুরে বিনা খাটুনিতে এক হাজার টাকা কামাই?এবার বুঝলাম সবাই কেন নায়ক হতে চায়।শোন ভাই, এরপর আবার যদি তোর নায়িকাকে কিছু নিয়ে রাজি করাতে হয় আমাকেই ডাকিস ওকে?
ধ্রুব তাকাল।গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘এবার বিরক্ত হচ্ছি রিদ।যা এখন।
রিদ টাকা পকেটে পুরে বলল,
‘যাচ্ছি। কোনো কৃতজ্ঞতা বোধ নেই।হুহ!
পরশুর ঘটনা মনে করে হেসে উঠল ধ্রুব।রিদকে দিয়ে পূর্ণতাকে দারুন বোঁকা বানিয়েছে।ধ্রুব মিটিমিটি হেসে আঁওড়াল,
“বোঁকা রানী।
হঠাৎ ধপ করে কেউ বসে পরল বিছানায়।পুরো বিছানা দুলে ওঠায় ধ্রুবর ভাবনায় ছেদ ঘটে।মিশরাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“তুই কখন এলি?
মিশরা গোমড়া মুখে জবাব দিল,
‘অনেকক্ষন।
ধ্রুব আধশোয়া থেকে সোজা হলো,
‘কী হয়েছে? মুখের এই অবস্থা কেন?ভাইয়ার কাছে ঝাড়ি টারি খেয়েছিস নাকি?
মিশরা চোখ ছোট করে বলল,
‘কেন?তোমার ভাইয়ের হাতে ঝাড়ি খাওয়া ছাড়া আমার কী আর কাজ নেই?আর ওর সাহস আছে আমাকে বকাঝকা করার?আগে করেছে করেছে,এখন করে দেখুক না।হাঁটে হাঁড়ি ভেঙে দেব।
ধ্রুব বুঝতে না পেরে বলল,
‘হাটে হাড়ি ভাঙবি?হাটে হাড়ি ভাঙার মত কী করেছে ভাইয়া?
‘কী করেছে?ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে।
ধ্রুব আগ্রহী হয়ে এগিয়ে বসল মিশরার দিক,
‘কী করেছে,একটু খোলাসা করে বল।ভাইয়া কী প্রেম করছে?কার সঙ্গে?
‘কার আবার!প__
মিশরা থেমে গেল।একটু চুপ থেকে বলল,
‘তোমার ভাই প্রেম করলে তুমি জানতেনা?তুমি যখন জানোনা,তাহলে আমি জানব কী করে?
ধ্রুব মুখ কোঁচকাল,
‘মানে?এই না বললি__
‘ওসব ছাড়ো ধ্রুব ভাইয়া।আমাকে আগে একটা কথা বলো,তুমি আমার সাথে এটা কী করে করতে পারলে?
‘কী করলাম?
মিশরা বিছানায় বাবু হয়ে বসে বলল,
‘কাল বিকেলের প্রোগ্রামে তুমি পার্টিসিপেট করছো।পূর্ণতাও করছে। তাহলে আমাকে বলোনি কেন তোমরা?
ধ্রুব না জানার ভান করে বলল
‘ তোর বোন ও পার্টিসিপেট করবে নাকি?জানতাম না তো।
‘হ্যা করছে, ধীর ভাইয়াকে বলতে শুনেছি।তোমার বন্ধু রিদ ওর পার্টনার।
‘ও।হতে পারে।আসলে আমি নিজেকে নিয়েই এত ব্যাস্ত,তাই খেয়াল করিনি।
“সে তুমি যাই বলো ভাইয়া।এটা ঠিক হয়নি।আমাকে একবার জানাতে পারতে।
‘জানালে আপনি কি করতেন?
” কেন?আমিও ডান্স করতাম।তোমার পার্টনার হতাম।
ধ্রুব দুইহাত জড়ো করে মাথা ঠেকিয়ে বলল
‘মাফ কর ভাই!তুই যে কী নাঁচ জানিস আমার জানা আছে।আজ অব্দি কোনো দিন স্টেজে পার্ফম করেছিস?
“করিনিতো কী হয়েছে?করতাম।তাই বললে এভাবে বলছো? আর পূর্ণতাও তো নাম দিয়ে এল।ওকী ঘোড়ার ডিম নাঁচবে? সেই ক্লাস সিক্সে হাত পা ছুড়ে নেঁচে প্রাইজ জিতেছিল বলে ভাবছে এসব মডার্ন কাপল ডান্স হবে ওর দ্বারা? দেখবে, স্টেজে এক পাক খেতে গিয়েই হিল ভেঙে মুখ থুবড়ে পরেছে।
ধ্রুব ভীষণ ঠান্ডা চোখে চেয়ে রইল মিশরার দিক। ওরই সামনে বসে ওর মায়াপরির দোষ বলছে মিশরা?কত সাহস মেয়েটার!
তেমন শান্ত কন্ঠেই বলল
” কে কী করবে সেটা তার ব্যাপার। তোর বোনকে তো আর আমি নাম দিতে বলিনি।তুই এখন প্লিজ এখান থেকে যা মিশু। আমার কাল অনেক পার্ফমেন্স আছে।আই হ্যাভ টু প্র্যাকটিস!
মিশরা ভেঙচি কেটে উঠে দাঁড়াল,
” যাচ্ছি।আর আসবনা তোমার রুমে। ডাকলেওনা।
ধ্রুব মাথা নেড়ে হাফ ছাড়ার ভঙিতে বলল,
” বাঁচা যাবে।
___
সকাল সাতটায় পূর্ণতা ভার্সিটিতে হাজির।এই সময়েই তাকে বলা হয়েছে আসতে।আগেরদিন রুপের কান্ড,আর ধ্রুবর জন্মদিন নিয়ে ব্যাস্ততায় রিদ আর তার নাঁচ ততটা তোলা হয়নি।তাই জন্যেই এত সকাল সকাল আসতে হলো।হাতে সময় কম।পূর্ণতা জানত ধ্রুবও পার্টিসিপেট করেছে।কিন্তু এত্ত ভোরবেলা যে ধ্রুবও এখানে থাকবে সেটা বোঝেনি।রিহার্সাল রুমে এসে ধ্রুব কে দেখে খানিক গুঁটিয়ে গেল পূর্ণতা।
মনে পড়ল গতকাল রাতের কথা।আচ্ছা,
ধ্রুবকি জানেন,আমার ওনার বিয়ের কথা চলছে?
ধ্রুব একবার পূর্ণতাকে ঢুকতে দেখেছে।আর তাকায়নি।সে ব্যাস্ত নাঁচ নিয়ে।পূর্ণতার একটু মন খারাপ হলো।সেও ব্যাস্ততা দেখাল রিদের সঙ্গে নাঁচ প্র্যাকটিসে।কিন্তু ধ্রুব তাকাচ্ছেইনা আজ।পূর্ণতা বারবার আড়চোখে দেখছে।এই যে ধ্রুব নোরার কোমড় ধরে নাঁচছে? প্রথমবার কিছু একটা অনুভব করলো পূর্ণতা।হিংসে?হ্যা হিংসেই হচ্ছে।জ্বলছে তার।যাকে বলে জেলাস!ধ্রুব কেন অন্য মেয়ের কোমড় চেপে নাঁঁচবে?কেন?
পরমুহূর্তে খেয়াল হলো রিদ ও তো তার কোমড়ে হাত রেখে নাঁঁচবে। তার বেলা!
তাতে কী?রিদ তো তার ভাই।ধ্রুব তো আর নোরার ভাই নয়।তাইনা?
পূর্ণতার ভাবনার সুতো ছিড়ল রিদের ডাকে,
‘বাম পা এদিক থেকে আসবে পূর্ণতা।এই দ্যাখো এভাবে।
পূর্ণতা মাথা দোলাল ‘ আচ্ছা।
রিদ তুষ্ট কন্ঠে বলল ‘ তুমি কিন্তু বেশ তাড়াতাড়ি ক্যাচ করে নিচ্ছ।
‘পেরেছি তাহলে?
‘ভালোই তো হচ্ছে।আমিতো আরো চিন্তায় ছিলাম তুমি একদিনের রিহার্সালে কতটা শিখতে পারবে!
‘পার্ফমেন্সের সময় অল্প দেখেই পারছি।আর আপনিও অনেক সাপোর্টিভ ভাইয়া।
রিদ হাসল।ধ্রুব কান সজাগ রেখে চেষ্টা করছে ওরা কী বলছে শুনতে।
রিদ বলল,
‘এক ঘন্টা রিহার্সাল করলেই হয়ে যাবে পূর্ণতা।তবে কথা হচ্ছে এখানে যেভাবে পারছো,স্টেজেও পারতে হবে।
পূর্ণতা মিহি কন্ঠে বলল,
‘আমার বেস্টটা দিয়ে চেষ্টা করব।
টানা দেড় ঘন্টা রিহার্সাল শেষে পূর্নতা এবার বাড়ি ফিরবে।ধ্রুব এখন আর রুমে নেই।নোরাকে সাথে নিয়েই পূর্ণতার সামনে থেকে বেরিয়েছে।পূর্ণতার মুখটা তখন দেখার মতন হয়েছিল।
পূর্ণতা কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে রিদকে বলল “তবে এবার আমি আসি ভাইয়া??
” সাবধানে যেও।গাড়ি এনেছো?
“জ্বি।
‘আচ্ছা,একটু তাড়াতাড়ি এসো বোন।আমাদের নাঁচটাই হয়ত স্বাগতম হিসেবে দেয়া হবে।
‘ঠিক আছে।
আসছি।
পূর্ণতা যেতে নিলে রিদ ফের ডেকে উঠল।
‘শোনো।
পূর্ণতা ঘুরে তাকায় ‘ জ্বি?
রিদ একটু এগিয়ে এসে দাঁড়াল।ইতস্তত করে বলল,
‘অরুপস__
থেমে গিয়ে বলল ‘রুপ কি আজ আসছে প্রোগ্রামে।
পূর্ণতা মিটিমিটি হাসল।রিদ লজ্জ্বা পেয়ে ঘাড় চুল্কে বলল,
‘আসলে হয়েছে কী__
‘আমি বুঝতে পেরেছি।সমস্যা নেই।হ্যা ও আসছে।
রিদ শান্তির শ্বাস টেনে বলল,
‘যাক!
” আসছি।
___
এই ধ্রুব সিগারেট খাবে?
ধ্রুব চমকে তাকাল নোরার দিকে।নোরা ভ্রু উঁচাল,
‘কী?খাবে?আনব?
ধ্রুব অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলল,
‘তুমি সিগারেট খাও নোরা?
নোরা চোখ কপালে তুলে বলল,
‘এই না না।আমি খাইনা।তুমি খাবে কীনা তাই জিজ্ঞেস করলাম।
ধ্রুব অন্যদিক তাকাল।কপাল কুঁচকে বলল,
‘আমি সিগারেট খাইনা।আর তুমি এত বছরে আমাকে সিগারেট খেতে দেখেছ কখনও?
‘না। তাতো দেখিনি।
ধ্রুব তাকাল,
‘তাহলে অফার করলে কেন?
নোরা নরম কন্ঠে বলল,
‘না আসলে তুমি আমাকে পার্টনার হিসেবে বেছেছো বলে একটা ট্রিট দিতাম।
ধ্রুব হেসে উঠল।
ঠিক তখনই পূর্ণতা ক্লাশ রুম থেকে বের হয়েছে।নোরার সঙ্গে হাসাহাসি করতে থাকা ধ্রুবকে দেখেই মুখটা শুকিয়ে গেল ওর।এরকমটা হতোনা।নোরা ধ্রুবকে পছন্দ করে,প্রপোজ ও করেছে।রিদ বলেছে তাকে।এসব জেনেও কোন মেয়ের তার হবু বরের পাশে সেই মেয়েকে সহ্য হবে?পূর্ণতা তো আর মহান, উদার, দয়ার সাগর নয়।
কিন্তু এখানে এখন কিছুই করার নেই,মন খারাপ করা ব্যাতীত। পূর্ণতা মাথা নিঁচু করে চুপচাপ হেটে যাচ্ছিল।পূর্ণতাকে দেখতেই ধ্রুব চটপট হাসি থামিয়ে নোরাকে বলল,
‘তাহলে তুমি বাড়ি যাও নোরা।আমি আসছি।
‘সেকি তুমি যে বললে আরো রিহার্সাল ___
নোরার কথা অসম্পূর্ণ থেকে গেল।ধ্রুব কিছু না শুনেই হাটা দিয়েছে।নোরার মুখ কালো হয়ে এল যখন দেখল ধ্রুব আসলে পূর্ণতার কাছে যাচ্ছে।ইদানীং একটু বেশিই এই মেয়ের কাছে ঘিষছে ধ্রুব।কী চলছে ওদের মধ্যে?
পূর্ণতা হাটছে আর বিড়বিড় করে ধ্রুবকে গালি দিচ্ছে।
‘অসভ্য লোক।ক্যাবলাকান্ত কোথাকারে।এমন ভাব করল যেন আমাকে চেনেইনা।জানেইনা আমি কে?অথচ আগে কী জ্বালানোটাই না জ্বালিয়েছে!এখন আর আমাকে ভালো লাগবে কেন?নতুন মেয়ে পেয়েছে না।ডান্স পার্টনার পেয়ে ভাবের সীমা নেই।আমিও দেখব,কতদিন ভাব নিয়ে থাকতে পারেন উনি।আসুক একবার।ধাক্কা মেরে ড্রেনে ফেলে না দিলে আমার নাম পালটে রাখব।
‘কী রাখবে,”মায়াপরি”?
কথাটায় চমকে পাশ ফিরল পূর্ণতা।ধ্রুব তার সঙ্গেই।পূর্ণতা দাঁড়িয়ে গেল। অবাক কন্ঠে বলল
‘আপনি কখন এলেন?আপনি না ওখানে___
ধ্রুব তার কাছে এসে দাঁড়াল,
‘যেখানেই থাকি।দিন শেষে তোমার কাছেতো আসতেই হবে।
পূর্ণতা লজ্জ্বা পেতে পেতেও পেলনা।একটু আগের করা ধ্রুবর কান্ডের কথা মনে পড়েছে।রেগে হাটা ধরল।ধ্রুবর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ।
পূর্ণতা হন হন করে হেটে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলতে ধরল।ওমনি এসে হাত চেপে আটকাল ধ্রুব।পূর্ণতা ভ্রু কোঁচকালো। মেজাজ নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” কি হলো?
ধ্রুব শান্ত,ঠান্ডা।
‘গাড়িতে যেতে হবেনা।
‘তাহলে কী এতটা রাস্তা হেটে যাব?
পূর্ণতার মেজাজ খারাপ বুঝতে পেরে ধ্রুব হাসল।বলল,
‘না।আমার সঙ্গে সঙ্গে যাবে।আমি যেখানে তুমি সেখানে।
পূর্ণতা নাক মুখ কুঁচকে বলল,
‘আপনার সঙ্গে আমি কেন যাব?নোরা আপুকে নিয়ে যান।
ধ্রুব চোখ ছোট করল।
‘এর মধ্যে নোরা এলো কোত্থেকে?
‘যেখান থেকে আসার,সেখান থেকে।
ধ্রুব সন্দেহী কন্ঠে বলল
‘আর ইউ জেলাস মায়াপরি?
পূর্ণতা মুখ ঘুরিয়ে বলল ‘ মোটেইনা।
‘আ’ম শিওর।ইউ আর।
পূর্ণতা চোখা চোখে তাকাল,
‘যদি কখনও দেখেন আমি কোনো ছেলের হাত ধরছি,হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছি সেই ছেলে যে কীনা আমার প্রেমে পাগল।তাহলে আপনার কী অনুভূতি হবে?
তৎক্ষনাৎ ধ্রুবর হাসিটা নিভে গেল।গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘এরকম আমি দুঃস্বপ্নেও দেখতে চাইনা মায়াপরি।তোমার মন-মস্তিষ্কের সর্বত্রজুড়ে ধ্রুব থাকবে।অন্য কারো বিচরন সেখানে নিষেধ!
পূর্ণতা বলতে নিল ‘ তাহ__
ধ্রুব আটকে দিল ‘ এত কথা না বলে এসো।
‘কোথায়?
‘ওয়েট!
ধ্রুব জানলা দিয়ে উঁকি দিয়ে ড্রাইভারকে বলল,
‘চাচা আপনি গাড়ি নিয়ে চলে যান।বাড়িতে এখনই যাবেন না।আমি ফোন করলে তারপর।
লোকটি মাথা ঝাঁকাল।মুখে বলল ‘জ্বি আচ্ছা।
ধ্রুব পকেট থেকে টাকা বের করে ওনাকে দিয়ে বলল,
“এটা দিয়ে চা -নাস্তা সেড়ে নিয়েন।এখন যান।
গাড়ি যেতেই ধ্রুব পূর্ণতার হাত ধরল।আঙুলের ভাঁজে আঙুল ডুবিয়ে আকড়ে নিল।পূর্ণতার শরীর শিরশির করে উঠল।ধ্রুব বলল,
‘এসো।
ধ্রুব তার বাইকের চাবি রিদকে দিয়ে এসেছে।পূর্ণতা ভেবেছিল হয়ত ধ্রুব বাইকে নিতে চাচ্ছে তাকে।কিন্তু গেটের সামনে এসে রিক্সা ডাকল ধ্রুব।পূর্ণতাকে উঠতে বলে নিজেও উঠে বসল পাশে।পূর্ণতার শরীর ঘেঁষে বসেছে ধ্রুব।পূর্ণতার শ্বাস আটকে আসছে।রিক্সা চলছে।চারপাশে মুক্ত বাতাসেও যেন শ্বাস টানতে পারছেনা ধ্রুব এত কাছে বসায়। না বলতেও বুঝে ফেলল ধ্রুব।সরে বসল খানিক।কিন্তু হাত ছাড়লনা।ধরে থাকল সারাপথ।
পূর্ণতা স্বস্তি পেল একটু।ধ্রুব কাছে আসুক চাইলেও যখনি আসে,কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে যায়।কী একটা অবস্থা!পূর্ণতা মনোযোগ ঘোরালো যাত্রাপথের দিকে।খেয়াল করতেই বুঝল একটা ভিন্ন রাস্তায় তারা।
“এটা তো বাসার রাস্তা নয়।
” আমরা বাসায় যাচ্ছি কে বলল?
ধ্রুব নিরুদ্বেগ।পূর্ণতা বিস্মিত হয়ে বলল,
“তাহলে কোথায় যাচ্ছি?
” গেলেই বুঝবে..
পূর্ণতা আর কিছু জিজ্ঞেস করলনা।করে লাভই বা কী?ধ্রুব উত্তর দিচ্ছেনা।
রিক্সা এসে থামলো ধানমণ্ডি লেকের সামনে।পূর্ণতা এই প্রথম এলো এখানে।বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘোরাঘুরি তার লিস্টে নেই।ধ্রুব ভাড়া মিটিয়ে পূর্ণতার হাত আবার খপ করে ধরল।কোনো ভাবেই এটাকে ছাড়বেনা আজ।পূর্ণতা মন দিয়ে জায়গাটা দেখছে।সকালবেলা হওয়াতে মানুষ নেই বললেই চলে।এরকম সময়ে কোন পাগলেই বা ঘুরতে আসবে?
সামনে সবুজ টলটলে জলের মধ্যে গোলাপি রঙের পদ্মফুল দেখে পূর্ণতার মন ভালো হয়ে গেল।কী দারুন জায়গা!এর মধ্যেই ধ্রুব প্রশ্ন ছুড়ল,
“পছন্দ হয়েছে?
“ভীষণ সুন্দর!
“এটা আমার মোস্ট ফেভ্রেট প্লেস গুলোর মধ্যে একটা।তাই তোমাকেও এনেছি।
” আপনার পছন্দতো বেশ ভালো।
ধ্রুব হেসে বলল,
‘তার জ্বলন্ত উদাহরণ তো তুমিই।
পূর্ণতা লজ্জ্বা পেল ‘ আবার শুরু করলেন!
‘চলো বসি।
ইটের বেঞ্চের ওপর বসল ধ্রুব।পাশের ধূল ঝেড়ে পূর্ণতাকে বসাল।এইটুকু যত্নেই পূর্ণতার মন জুড়িয়ে গেল।
” ব্রেকফাস্ট করেছ?
“হু।আপনি?
” আমি এত সকাল সকাল কিছু খেতে পারিনা।আরেকটু সময় যাক তারপর খাব।
ধ্রুব আশপাশ চেয়ে বলল,
‘ এখনও তো তেমন দোকান খোলেনি দেখছি।আমি যে ভাবলাম তোমাকে নিয়ে মাটির ভাড়ে চা খাব।
চারপাশে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে।দু একটা মেঘ ও ডাকছে আকাশে।পূর্ণতা ব্যাস্ত কন্ঠে বলল,
‘চা খেতে হবেনা।চলুন বাড়ি যাই।
বৃষ্টি আসবে।
ধ্রুব ভ্রুক্ষেপহীন ” তো?
পূর্ণতা উদ্বেগ নিয়ে বলল ‘ তো মানে?ভিজে যাবনা!
‘তাতে কী?
‘তাতে কী?বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর হবে।
ধ্রুব পূর্ণতার কানের কাছে মুখ এনে বলল,
‘বৃষ্টি নামলে আমাদের বৃষ্টি বিলাস হবে।
কথা শেষ। আর ওমনি বৃষ্টি নামল।প্রথমে কয়েকফোঁটা পরলেও সেকেন্ডের মধ্যে ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো।ধ্রুবর তাও উদ্বেগ নেই।শুধু ফোন, ওয়ালেট আর হাতঘড়ি খুলে পূর্ণতাকে বলল,
‘ব্যাগে রাখো।পূর্ণতা তাই করল।কিন্তু সে যে ভিজে যাচ্ছে জনাবের খেয়াল আছে?ভিজে চুপচুপে হবে সকাল -সকাল?
হঠাৎই ধ্রুব উঠে দাঁড়াল।পূর্নতা ভাবল এবার বাড়ি ফেরা হবে।সেও দাঁড়াল।কিন্তু ধ্রুব নড়লনা।উলটে পেছন ফিরে দীঘির দিক চেয়ে থাকল।মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে সে।পূর্ণতা ভ্রু কোঁচকালো। লোকটা কী চাইছে?
আচমকা পেছন ফিরেই ধ্রুব কোলে তুলে নিল পূর্ণতাকে।পূর্ণতা ভঁড়কালো খুব।যে ক’জন ছিল এখানে সবাই তাকিয়ে দেখছে তাদের।পূর্ণতা লজ্জ্বায় মিশে গেল।ধ্রুব কোলে তোলায় বৃষ্টির ছিটে সরাসরি চোখেমুখে পরছে।পূর্ণতা নিভু কন্ঠে বলল,
“সবাই দেখছে।নামান প্লিজ!
‘দেখুক।আমি কী ওদের বউ কে কোলে নিয়েছি?আমি নিয়েছি আমার মায়াপরিকে!
ওরাও দেখুক,শিখে রাখুক কীভাবে রোম্যান্স করতে হয়!
পূর্ণতা বিরক্ত হওয়ার ভান করল,
‘আপনার মুখে কী কিছু আটকায়না?
ধ্রুব পূর্ণতা নাকে নাক ঘষে বলল,
‘না।
পূর্ণতার শরীরের সব লোম দাঁড়িয়ে পরল ধ্রুবর এমন কাজে।ছোট্ট শরীরটা ধ্রুবর হাতের মধ্যেই কেঁপে উঠল।ধ্রুব তাকে কোলে নিয়েই সামনে পা বাড়ায়।হাটতে হাটতে বলল,
” জানো মায়াপরী,আজ একটা স্বপ্ন পূরন হলেও আরেকটা অপূর্ণ রয়েছে।
পূর্ণতা শুধাল,
‘কী স্বপ্ন?
“ইচ্ছে ছিলো তুমি শাড়ি পরবে,তারপর তোমাকে কোলে নিয়ে বৃষ্টি বিলাস করবো,,কিন্তু সেটা হলোনা।
ধ্রুবর সহজ স্বীকারোক্তি। পূর্ণতা মুচকি হাসলো।গালের টোল ভেসে উঠল তাতে।ধ্রুব কিছুক্ষন চেয়ে থেকেই টুপ করে চুঁমু বসাল পূর্ণতার কপালে।সম্মোহনী গলায় বলল,
‘ তুমি হাসলে তোমাকে ঠিক উজ্জ্বল মুক্তোর মতো মনে হয় মায়াপরি!
পূর্ণতার হাসি শেষ। কুন্ঠায় চোখ অব্দি মেলাতে পারছেনা সে।ঘন নিঃশ্বাস পরছে তার।কাঁপাকন্ঠে বলল
” অ.. অনে..ক ভিজেছি,,এবার,নামান আমাকে।
পূর্ণতা লজ্জ্বা পেয়েছে বুঝতে পেরে আপত্তি করলনা ধ্রুব।নামিয়ে দিল।
পূর্ণতার পা দুটো মাটি ছুঁতেই হাটা ধরল সে।পা বাড়ানোর আগেই এক হাতে হ্যাচকা টান মেরে কাছে নিয়ে এলো ধ্রুব।পূর্ণতা এসে পরল ওর বুকের ওপর। পূর্ণতাকে ঘুরিয়ে ওর পিঠের সাথে বুক মেশাল ধ্রুব। কাঁধে থুতনী রাখল নিজের।ধ্রুব গোটা পূর্ণতাকে নিমিষেই জড়িয়ে নিল বাহুবন্ধনে।ঠান্ডা শরীরের স্পর্শে পূর্ণতার কাঁপুনি দ্বিগুন বাড়ল।ধ্রুব আবারও ফিসফিসিয়ে বলল..
” এভাবে লজ্জ্বা পেওনা মায়াপরি।তোমার লজ্ব্বায় রাঙা মুখ আমার সংযম ভাঙতে যথেষ্ট।
এত লজ্জ্বা এখন পেলে বিয়ের রাতে কী করবে?তখন তো অনেক বাড়াবাড়ি করব।
পূর্ণতা চোখ খিচে বুজে ফেলল।ইচ্ছে করল সামনের দীঘিটায় ঝাপ দিয়ে ডুবে যেতে।অন্তত তাহলে বেঁচে যেত ধ্রুবর হাত থেকে।বিড়বিড় করে বলল
“লাগামহীন নির্লজ্জ!
চলবে…