#ফাগুন_এলো_বুঝি!
(২৯)
“কিছু বলবে মম?
সায়রা চোখ তুলে তাকালেন।দরজায় দাঁড়ানো মিশরাকে বললেন,
‘আগে তো ভেতরে আয়।
মিশরা খুব ধীর পায়ে এগিয়ে এল।পুরোটা সময় চেয়ে রইলেন সায়রা।টপ্স,জিন্স পরা মেয়ের গায়ে থ্রি-পিস টা কী দারুন মানিয়েছে!কোনো ভালো কাজ হয়ত করেছিলেন জীবনে,এমন পুতুলের মত একটা মেয়ে পেলেন তাই।কিন্তু মেয়েটার রুপ থাকলেও,বুদ্ধি,বিবেচনা কিচ্ছু নেই।না বোঝে নিজের ভালো,না অন্যের।নিজের হাতে জীবনটা শেষ করে দিল।
সায়রা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
” বোস।
মিশরার ভ্রু কোঁচকানো।চুপচাপ মায়ের পাশে বসল।সায়রা সময় নিয়ে বললেন,
‘কী পেলি এসব করে?
আচমকা প্রশ্নে ভঁড়কাল মিশরা।বুঝতে দেরি হলোনা মা কিসের কথা বলছে!ঢোক গিলে কিছু বলতে ধরল,সায়রা এর আগেই সতর্ক করলেন
“আমার কাছে মিথ্যে বলিস না মিশু।আমি কিন্তু সব জানি।সেদিন স্টোর রুমের বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি।
মিশরা বিহ্বল চেয়ে বলল,
‘ততুমি জানতে?
‘জানতাম।
‘তবে আমার হয়ে কথা বললে কেন?
সায়রা ভনিতা ছাড়াই বললেন,
‘যাতে পূর্নতার সাথে ধীরের বিয়ে আটকে যায়, তাই।
মিশরা অবাক কন্ঠে বলল,
” কেন?এতে তোমার কী লাভ?
“লাভ আমার নয়।লাভ পূর্নতার।
মিশরার ভ্রু কুঞ্চন আরো গাঢ় হলো।কথার আগামাথা খুঁজে না পেয়ে বলল,
” একটু পরিষ্কার করে বললে মম?
সায়রা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললেন,
‘পূর্নতা আর ধ্রুব একে অপরকে ভালোবাসে।
তৎক্ষনাৎ মিশরার গোঁটানো ভ্রু হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।মনে হলো মাথার সঙ্গে পৃথিবীটাও চক্কর দিল।আর্তনাদ করে বলল,
“কী?
সায়রা দরজার দিক চোখ বোলালেন।উঠে গিয়ে খোলা দরজা আটকে দিয়ে জায়গায় এসে বসলেন।মিশরা অধৈর্য হয়ে বলল,
“মম এটা কী করে সম্ভব?তোমার কথাও ভুল হচ্ছে।পূর্নতা ধীর ভাইয়াকে ভালোবাসে।আমি নিজে দেখেছি ও–দে–র সিড়ি__
মিশরা থেমে গেল।মায়ের সামনে বলতে পারলনা পুরোটা।
” ভুল আমার নয়,ভুল হয়েছে তোর।পূর্ণতা ধ্রুবকেই ভালোবাসে।
“তোমাকে বলেছে ও?
” না। সব বলতে হয়না।কিছু কিছু জিনিস মানুষের চোখ দেখেও বোঝা যায়।তুইওতো আমাকে বলিস নি,যে তুই ধীরকে ফাঁসিয়ে বিয়ে করছিস,শুধুমাত্র পুর্নতার থেকে ধীরকে কেড় নিবি বলে।আমিত বুঝে নিলাম তাইনা?
সায়রার তীর্যক বাক্যে মিশরা চোখ নামিয়ে ফেলল।মিনমিন করে বলল,
“আজকাল দেখছি পূর্ণতার হয়ে কথা বলছো।
সায়রা স্পষ্ট বললেন,
‘বলছি।আরো আগে থেকে বলা উচিত ছিল।শুধু ওর হয়ে কথাই বলছিনা,আজকাল ওকে ভালওবাসছি।
মিশরা অবিশ্বাস্য চোখে তাকাল।
‘মম!কী হয়েছে তোমার?আমার সেই আগের মমের সঙ্গে তোমার কোনো মিল পাচ্ছিনা আমি।
‘বলছিস?তাহলে নিশ্চয়ই সফল হচ্ছি,ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টায়।
মিশরা বিরক্তিতে ‘চ’ বর্গীয় শব্দ করে অন্যদিক তাকাল।সায়রা ওর থুতনি ধরে আবার নিজের দিক ঘোরালেন। মিশরার দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো সায়রার ছলছল চোখের ওপর।
‘এই পৃথীবিতে আমি সব থেকে বেশি ভালোবাসি তোকে।আমার যখন নিজেকে নিঃস্ব, তুচ্ছ্ব লাগতো,আমি তোর দিকে তাকাতাম।মনে হতো,আমার কাছে সব আছে।এইতো তুই আছিস।
কোনওদিন তোর গায়ে হাত তুলিনি।একটা ধমক অব্দি দেইনি।বুকের মধ্যে আগলে রেখেছি।যা চেয়েছিস চেষ্টা করেছি দেয়ার।তবুও
পারলে আমায় ক্ষমা করে দিস মিশু।আমি তোর কাছে অপরাধি!
সায়রার চোখ বেয়ে জল গড়াতেই মিশরা ব্যাস্ত হাতে মুছে দিল।
‘মম এসব কী বলছো তুমি?তুমি একা আমাকে ভালোবাসো?আমি বাসিনা?তুমি ছাড়া আমার কে আছে বলো!আর কীসের ক্ষমা,কীসের অপরাধ!কেন এসব হাবিজাবি বলছো?
‘হাবিজাবি নয় মা।সঠিক কথা বলছি আমি।আমি তোকে ভালো শিক্ষা দিতে পারিনি।পারিনি মানুষের মত মানুষ করতে।আসলে নিজের সংসারের টানাপোড়েন নিয়েই এত ব্যাস্ত ছিলাম,এত মানসিক চাপে ছিলাম যে তোর দিকে খেয়াল রাখা আমার হয়ে ওঠেনি।যদি তোকে ভালো মানুষ বানাতে পারতাম,আজ হয়ত হিংসার বশবর্তী হয়ে এত বড় একটা ভুল তুই করতে যেতিসনা।
মিশরার মুখে অন্ধকার নেমে এল।
সায়রা বললেন,
‘আশরাফ তার প্রথম স্ত্রীকে খুব ভালোবাসে জানিস।ও সময় চেয়েছিল আমার কাছে।বলেছিল তাহমিনার শোক থেকে বের হতে ওর সময় প্রয়োজন। আমি শুনিনি।তাড়াহুড়ো করেছিলাম।সদ্য সংসার ভাঙা মেয়ে,দ্বিতীয় বিয়ের পরেও যদি স্বামীর ভালোবাসা না পায়,সে জানে তার কেমন লাগে তখন।সেই শোকে পাগল হয়ে গেছিলাম।বাসর রাতে আশরাফের ঘরে না ফেরা মানতে পারিনি।রাগ ঝেড়েছিলাম পূর্ণতার ওপর।তারপর থেকে প্রতিনিয়ত ঝাড়ছি।সেটাই আমার আমার চরম ভুল ছিল।আশরাফ আরো দূরে সরে যাচ্ছিল আমার থেকে।আমি কিন্তু থেমে থাকিনি। সর্বচ্চ চেষ্টা করতাম ওর মন জয় করার।কিন্তু আশরাফের ভালো থাকা ছিল পূর্ণতার মধ্যে।মাস দুয়েক পরপর ফিরে মেয়ের বিষন্ন চেহারা ওকে আরো এলোমেলো করে দিত।কতবার পূর্নতাকে সাথে নিতে চেয়েছে,মেয়েটা গেলনা।আমার অত্যাচার সয়েও পরে থাকল ওই বাড়িতে।আচ্ছা তুইই বল,কম অত্যাচার করেছিলাম ওকে?ঘরের সব কাজ করিয়েছি,মেরেছি,শাসিয়েছি।কত বড় ভুল,কত বড় অন্যায় করেছি!
সায়রা আফসোসে কেঁদে উঠলেন।মিশরা থম ধরে মায়ের দিক চেয়ে রইল।সায়রা ধাতস্ত হয়ে বললেন,
‘অথচ ও কোনও দিন আশরাফের কাছে আমার নামে বিচার দেয়নি।আমার সাথেও কোনও দিন একটা তর্ক করেনি।চোখ তুলে কথা বলেনি।যেই আমি, আমরা,ওর ওপর অবাধে কর্তৃত্ব ফলিয়েছি,ও কিন্তু দিন শেষে সেই আমাদেরই ভালোবাসত।তুই অসুস্থ হলে ও অস্থিরতায় কেমন করতো আমি তা দেখেছি।এখন কেন যেন পুরনো সব কিছু মনে পড়ছে,মাথায় আসছে,আর আমার অনুতাপ বাড়াচ্ছে।সেদিন কেন দেখিনি ওসব?কেন দেখিনি?
(একটু থেমে)
যাকে এত কষ্ট দিলাম,যন্ত্রনা দিলাম,আজ সেই মেয়েটাই আমার হয়ে তার বাবার কাছে অধিকার চাইল।মাথায় হাত রাখিয়ে বাবার থেকে ওয়াদা নিল।কি বলল জানিস?বলল
‘ছোট মাকে এবার তুমি মেনে নাও বাবা।
মিশরা তখনও নিষ্পলক তাকিয়ে।
‘যে মানুষটা কোনও দিন আমার পাশে বসে দুটো কথা বলেনি,সে এখন নিজেই আমাকে ডেকে বলে ‘সায়রা এসো গল্প করি।
সায়রা খুশিতে ডুকরে কাঁদলেন।
“আমি তোকে দোষ দেবনা মিশু।দোষ সব আমার।ছোট থেকে তোকে যা শিখিয়েছি তুই তাই শিখেছিস।তাই আজ মা তোর কাছে একটা অনুরোধ করব।রাখবি?
মিশরার চোখ ও কেমন চিকচিক করছে।কেন করছে নিজেও বুঝলনা।মায়ের কথায় শুধু ঠোঁট নেড়ে বলল,
‘বলো।
সায়রা মেয়ের দুহাত ধরে কাতর কন্ঠে বললেন,
‘বিয়েটা যেভাবেই হোক,যে পরিস্থিতিতে হোক, যে উদ্দশ্যে হোক,বিয়ে বিয়েই।তুই সব ভুলে এই বিয়ে মেনে নে।ধীরকে মেনে নে।
মিশরা যত্র হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
‘এসব কী বলছো মম?
আমিতো ধীর ভাইয়াকে__
‘ভালোবাসিস না তাইতো?
মিশরা ভ্রু কুঁচকে চোখ নামাল।সায়রা বললেন,
‘সেতো আমিও আশরাফ কে ভালোবেসে বিয়ে করিনি।তাই বলে এখন কী ভালোবাসিনা?বাসি।স্বামীরা এরকমই হয় মা।বিয়ে অদ্ভূত এক শব্দ।মেয়েদের জীবন এক মুহুর্তের মধ্যে পালটে দেয়।যে মানুষটাকে তুই সহ্য করতে পারবিনা,ওই একটা বাক্য বাধ্য করবে তোর সেই ঘৃনাকে ভালোবাসায় বদলে দিতে।
স্বামী, কথাটা শুনতে অনেক হাল্কা লাগে।কিন্তু এর পাল্লা অনেক ভারি মিশু।মেয়েদের কাছে পৃথিবীতে সব চেয়ে দামি তার স্বামী।এর মূল্য দুনিয়ার সব টাকাপয়সার কাছেও হার মানবে।
‘কিন্তু মম আমি কী করে__
‘তুই চেষ্টা কর।চেষ্টা করলে মানুষ কী না পারে?
তোদের বিয়ে হয়ে গেছে মিশু।জীবনে বিয়ে বারবার হয়না।হ্যা যদি আমার মত কপালে__
মিশরা আটকে দিয়ে বলল,
‘মম প্লিজ!কেন বারবার পুরোনো কথা বলছো?
‘তাহলে কী করব?বল কী করব?আজ বাদে কাল আমি তোর বাবার সঙ্গে সুইডেন যাচ্ছি।ওখানে গিয়ে ছটফট করব তোর কথা ভেবে?যে আমার মেয়েটা কিরকম আছে?কী করছে?
যদি আয়ার কথা একটু হলেও মাথায় ঢুকত,মেনে নিতিস,অন্তত শান্তি মনে দেশ ছাড়তে পারতাম।কিন্তু তুই?তুইতো নিজের কথা ভাবিস শুধু।মায়ের কথা ভাববি কেন?
“মম!এভাবে কেন বলছো?আমি কী তোমাকে ভালোবাসিনা?
‘বাসিস?তাহলে আমার কথা শুনছিসনা কেন?একটা সংসারের মূল্য তুই জানিস?ধীর পুরুষ মানুষ। পূর্নতাকে ভালোবাসে ঠিকই,কিন্তু যখন চোখের সামনে ধ্রুবর সঙ্গে ওর সুখের সংসার দেখবে ওর মানসিকতা ঠিক পালটে যাবে।তার ওপর তুই যদি ওকে একটু ভালোবাসিস,সময় দিস,ভালো করে কথা বলিস,তবে ওর মন তোর দিকে ফিরতে বাধ্য হবে।
ধীর খারাপ ছেলে নয়।একটু রাগি।কিন্তু ওর মন ভালো।ছোট থেকে দেখছি ওকে।দরকার হলে আমি ওকেও বোঝাব।কিন্তু তার আগে তোকে বুঝতে হবে।জীবনটা ছেলেখেলা নয় মিশরা।তোকে ভাবতে হবে,নিজের সংসার টাকে বুক দিয়ে আগলে রাখতে হবে।মাথায় রাখিস!
মিসরা কিছু বলতে ধরল।এর আগেই দরজায় টোকা পরার শব্দ পেয়ে ,দুজন এক যোগে তাকাল।সায়রা চোখ মুছলেন ত্রস্ত হাতে। মিশরা উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখল আশরাফের চকচকে চেহারা।যেটা আরো গাঢ় হলো মিশরাকে দেখে।
‘মিশু মা,তুমি এখানে!
মিশরা কি বলবে বুঝে পেলনা।আশরাফ ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,
‘আমি তোমার রুমে গিয়ে খুঁজে এসেছিলাম।
মিশরা মায়ের দিক একবার দেখে শুধাল,
‘ককেন?
আশরাফ সায়রাকে বললেন
” বুঝলে সায়রা,সকালে নিউজফিড স্ক্রল করছিলাম,হঠাৎ একটা ড্রেস পরল চোখে।কী যে ভাল্লাগলো!কাউকে না বলেই মিশু আর পূর্নতার জন্যে অর্ডার করে দিয়েছি আমি।
সায়রা হেসে বললেন
“খুব ভালো করেছ।
এরপর মিশরার দিক তাকালেন।মিশরা মুখে হাসি ফুঁটিয়ে বলল,
“দেখি বাবা,কেমন?
“হ্যা দাঁড়াও দেখাচ্ছি।
আশরাফ ফোনে স্ক্রিনশট তোলা ছবিটা মিশরার সামনে ধরলেন।মিশরা কাঁপা হাতে ফোন ধরল।চোখ কেমন জ্বলছে।ঝাপ্সা নজরে জামার কিছুই বুঝলোনা।শুধু বুঝল ভেতরটা ছেঁয়ে যাচ্ছে ভাললাগায়।
” পছন্দ হয়েছে?
মিশরা টইটম্বুর চোখ তুলে বাবার দিক চেয়ে বলল,
“খুব সুন্দর!
আসরাফ অবাক কন্ঠে বললেন
” একি! কাঁদছো কেন?
মিশরার ঠোঁট ভেঙে এলো কান্নায়।একরকম ঝাপিয়ে পরল আশরাফের বুকের ওপর।আশরাফ চমকালেন।মিশরা হুহু করে কেঁদে ফেলল।আশরাফ উদ্বিগ্ন হয়ে পরলেন।সায়রা ভেজা চোখ হাত দিয়ে মুছছেন।আশরাফ মিশুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন
“কি হয়েছে মামুনি? কেউ কিছু বলেছে তোমায়?
মিশরা সরে এল।বাবার দিক সেকেন্ড খানিক চেয়ে থেকে দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।পুরো ব্যাপারটা মাথার ওপর দিয়ে গেল আশরাফের।চিন্তিত কন্ঠে সায়রাকে শুধালেন
” কি হয়েছে ওর? বঁকেছ তুমি?
সায়রা মেয়ের যাওয়ার দিক চেয়েইই জবাব দিলেন
‘ হয়ত আমার মত চৈতন্য ফিরছে!
_____
মায়ের কথা সারারাত ভেবেছে মিশরা।ধীর রাতে ঘরে আসেনি।কোথায় ঘুমিয়েছে কে জানে!খুব সকালে যখন দরজা ধাক্কালো,মিশরার ঘুম ছুটে যায়।এলোমেলো হেঁটে গিয়ে দরজা খুলতেই ধীর ঢুকল রুমে।গা থেকে বের হলো সিগারেটের কঁড়া গন্ধ।খালি পেট গুলিয়ে এল মিশরার।ধীরের অস্বাভাবিক চেহারা দেখে কিছু বললনা এ নিয়ে।ধীর যখন কাঁধে তোয়ালে ঝুলিয়ে বাথরুমে ঢুকবে সেই মুহুর্তে ছোট করে জানাল,
‘আমি হানিমুনে যাব।
ধীরের কদম থেমে গেল।ঘুরে তাকাল।নিশ্চিত হতে জিগেস করল,
“কী?
মিশরা ফের একই কথা বলল,
‘আমি হানিমুনে যাব।
ধীরের রুক্ষ ভাবমূর্তি তৎক্ষনাৎ পালটে গেল।মিশরা আলমারির খুলতে খুলতে বলল,
‘আমি আমার জামাকাপড় গোছাচ্ছি,তুমি এসে তোমারটা গুছিও।
মিশরা হাতে কাপড় নিয়ে ফিরতেই হুট করে ধীর জড়িয়ে ধরল ওকে।চমকে গেল মিশরা।ধীর খুশিতে হাঁসফাঁস করে বলল,
‘থ্যাংক ইউ সো মাচ মিশু।তুই জানিস ও না আমি ঠিক কতটা খুশি হয়েছি।
ধীর সরে এসে বলল,
‘আমি শাওয়ার নিয়ে আসছি।দাঁড়া।
ধীর যেমন হাওয়ার বেগে এসে জাপটে ধরল,তেমনভাবেই ঢুকে গেল ওয়াশরুমে।এদিকে মিশরা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল।গতকাল রাতেও ধীরের গভীর স্পর্শে কিচ্ছু হলোনা যেখানে,সেখানে আজ মিশরা টের পেল শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা কিছু বেয়ে চলছে এখন!
___
ধ্রুব আজকাল ভীষণ জ্বালায়।পূর্ণতার শত খেইখেই,রাগ দেখানো কিচ্ছুতে কাজ হয়না।কথায় কথায় এসে জড়িয়ে ধরে।পূর্ণতা রেগেমেগে কত কিছু শোনায়,তাও লাভ হয়না।রাতে পূর্নতা শোয় কাউচে,সকালে খুঁজে পায় বিছানায়।পাশে ধ্রুব তো থাকেই,আবার আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়েও থাকে।এইতো আজ সকালেও একই দৃশ্য। পূর্নতা খুব কষ্ট করে ধ্রুবকে ঠেলেঠুলে নিজের থেকে সরাল।বুকের ওপর আঁচলের খবর ও নেই।আর এখানেই কীনা ঘুমিয়েছিল ধ্রুব?ভাবতেই লজ্জ্বায় পূর্ণতার অবস্থা রফাদফা।কোনও রকম আলগোছে উঠে গেল পূর্নতা।ঘর ছেড়ে বের হতেই মুখোমুখি হলো মিশরার।মিশরা ওরদিকেই আসছে।পূর্ণতা দাঁড়িয়ে গেল ওকে দেখে।মিশরা ঠিক সামনে এসে বলল
‘বিয়ের সময় তোকে এ বাড়ি থেকে অনেক গুলো শাড়ি দেয়া হয়েছেনা?
পূর্ণতা মাথা দোলাল।
‘হ্যা।
‘ওখান থেকে আমাকে ক’টা দে তো।
পূর্ণতা কপাল কোঁচকাল।
‘তুমি শাড়ি দিয়ে কী করবে?
‘ফ্যানের সঙ্গে বেধে ঝুলে পরব।ইডিয়ট! শাড়ি দিয়ে মানুষ কী করে?পরব।
পূর্ণতা দুই ভ্রু কপালে ঠেকিয়ে বলল,
‘তুমি,তুমি শাড়ি পরবে মিশু?
স্যরি মিশরা!
মিশরা কন্ঠ ভারি করে বলল,
‘হ্যা, তো হয়েছে কী?আমার কী শাড়ি পরা নিষেধ নাকি?তুই পরলে আমি পরতে পারিনা?আমিওতো এই বাড়ির বউ।
ধীর হাতঘড়ির বেল্ট বাধতে বাধতে বের হচ্ছিল।মিশরার শেষ কথাটা শুনতেই দাঁড়িয়ে গেল সেখানে।পূর্ণতা বলল,
‘না সে ঠিক আছে।আসলে তুমিতো কখনও শাড়ি পরোনা।তাই বললাম।
এরপরই দেখা গেল পূর্নতার শুভ্র হাসি।গালের একপাশে ভেসে উঠল টোল।যা দেখতেই ধীর বুক জুড়িয়ে গেল।
পূর্নতা হৈহৈ করে বলল,
‘খুব ভালো হয়েছে।এবার থেকে আমরা দুবোন একসাথে শাড়ি পরব।তোমার ক’টা শাড়ি লাগবে, এসো আমি দিচ্ছি।
পূর্নতা মিশরার হাত ধরে ঘরে নিয়ে চলল।ধীরের ভেতরের কষ্টটা ছলাৎ করে লাফিয়ে উঠল আবার।জাগিয়ে দিল পুরোনো ঘা।মনে করিয়ে দিল ‘ পূর্নাকে তুই পেলিনা ধীর!
ধীর যত্র হুশে ফিরল।
‘পূর্না আমারই হবে।বাই হুক অর বাই কুক।
মিশরার আগমনে ধ্রুবর ঘুম আর টিকলনা।পূর্ণতা চেষ্টা করল খুব কম শব্দ করতে,যাতে ধ্রুবর ঘুম না ভাঙে।কিন্তু হয়নি,অল্প আওয়াজেই জেগে গেল ধ্রুব।চুপচাপ উঠে ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে চলল।
পূর্ণতা বিছানা ঝেড়ে,গুছিয়ে সব শাড়ি আলমারি থেকে বের করে বিছানায় মেলল।মিশরা সবটা মন দিয়ে দেখল।সেতো ঘুম থেকে ওঠার পর কোনও দিন বালিশটাও গোছায়নি।এইতো আজকেও এল অগোছালো ফেলে।
পূর্ণতা বলল,
‘কোনটা কোনটা নেবে?
মিশরা এগিয়ে এসে বিছানা ঘেঁষে দাঁড়াল।কতক্ষন শাড়ির দিক চেয়ে থেকে পূর্নতাকে বলল,
‘তুই বেছে দে।সব গুলোই সুন্দর!
‘তাহলে সব নিয়ে নাও?
‘সব নিয়ে কী করব?আর আমি নিলে তুই কী পরবি?
‘আমার তো লাগছেনা এখন।লাগলে ও না হয় আমাকে কিনে দেবে।
মিশরা ভ্রু কোঁচকালো,
‘এই ‘ও’ টা কে?
পূর্ণতা নিচু আওয়াজে বলল,
‘ধ্রুব ভাইয়া।
মিশরার ভ্রু শিথিল হল।ধ্রুবর নাম বলতে গিয়ে পূর্নতার গালের আভা আজ চোখে পরল তার।বুঝে নিল, সায়রাই সঠিক তবে।পূর্নতা তাহলে ধ্রুবকেই ভালোবাসে।এই জন্যেই বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় পূর্নতার মধ্যে কোনও শোক ছিলনা।উলটে এতদিনের পূর্নতার নিস্তব্ধতার কারন ছিল এই বিয়েটা।সে তবে ভুল করে হলেও পূর্নতাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।হেরে যাওয়া নিয়ে এই প্রথম মিশরার কেন যেন আক্ষেপ হলোনা। বরং মনে প্রশ্ন জাগল,
‘আমি কি অজান্তেই একটা ভালো কাজ করলাম?
‘কী হলো?
মিশরা নড়ে উঠল,
‘হু?না কিছুনা।আমার এত গুলো শাড়ির দরকার নেই।আমি বরং পাঁচ-ছয়টা নেই।আগে দেখি ক্যারি করতে পারি কীনা!
‘ঠিক আছে।
পূর্ণতা ছয়টা শাড়ি বেছে বেছে মিশরার হাতে দিল।মিশরারও পছন্দ হয়েছে।শাড়ি হাতে বের হওয়ার সময় আবার ঘুরে তাকাল সে।পূর্নতা মেলে রাখা শাড়ি ভাঁজ করছিল তখন।মিশরা ডাকল,
‘পূর্নতা শোন!
পূর্ণতা তাকাল,
‘হ্যা?
মিশরা সময় নিয়ে বলল,
‘তুই আমাকে মিশু ডাকিস।আমার সমস্যা নেই।
বলে দিয়ে বেরয়ে গেল মিশরা।পূর্ণতা হা করে চেয়ে থাকল সেদিকে।
চমকে উঠল হঠাৎ পিঠে শীতল কিছুর স্পর্শে।সাথে দুটো ঠান্ডা হাত পেঁচিয়ে ধরেছে তাকে।পূর্নতার বুঝতে বাকি নেই এটা কে!ধ্রুব তার ভেজা গাল পূর্নতার গালে ঘষে দিতেই পূর্নতা মুচড়ে উঠল।ধ্রুব থেমে থাকলনা।সে শব্দ করে চুঁমু খেল সেখানে।পূর্নতা হা করল কঠিন কিছু শোনাতে এর আগেই ধ্রুব ছেড়ে দিয়ে হেলেদুলে হেঁটে গেল বারান্দায়।পূর্ণতা খিটমিট করে চেয়ে থেকে বলল,
‘অসভ্য!
________
এয়ারপোর্টের বাইরে দাঁড়িয়ে গাড়ির জন্যে অপেক্ষা করছে দু জোড়া কপোত-কপোতি।
গন্তব্য কক্সবাজারের “হোটেল দ্যা কক্স টুডে।
কিছুক্ষনের মধ্যেই তাদের রিজার্ভ গাড়ি এসে পৌঁছাল।মিশরা লং জার্নিতে অভ্যস্ত কম।একটুতেই নেতিয়ে গিয়েছে।গাড়ির মধ্যে গাদাগাদি করে বসবে না বলে আগেভাগে উঠে বসল সামনের সিটে।ড্রাইভারের পাশে।এরপর উঠল পূর্নতা।জানলা ঘেঁষে বসেছে সে।ধীর পূর্ণতার পাশে বসার জন্যে উঠতে নেবে এর আগেই উঠে গেল ধ্রুব।ধীর চড়া মেজাজ নিয়ে ধ্রুবর পাশে বসল।শব্দ করে লাগাল গাড়ির দরজা।সেকেন্ডের কম সময়ে শা করে ছুটে চলল গাড়ি।
সব সময়ের মত ধ্রুব পূর্ণতার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বসেছে।পূর্ণতা প্রথমে মোচড়ামুচড়ি করলেও
পরে নিজেই চুপ করে থাকল।একটা কথাতো সত্যি,ধ্রুব কাছে আসলে তার ভালো লাগে,ভালো লাগে ধ্রুবর প্রত্যেকটা স্পর্শকে।কিন্তু স্বায় দিতে পারেনা। অতীতের অভিমানের উঁচু পাহাড় ঠেলে সরিয়ে নেয় তাকে।মনে করিয়ে দেয়
‘এই লোকটা তোর হাত ছেড়ে দিয়েছিল।
পূর্ণতা গাড়ির সিটে মাথাটা এলিয়ে দিতেই ধ্রুব প্রশ্ন ছুড়ল,
” তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে মায়াপরী?
পূর্ণতা ছোট করে বলল,
‘হু।
‘মাথাব্যাথা করছে??
‘খুব।
ধীর নড়েচড়ে উঠল এবার।ধ্রুব কিছু বলবে এর আগেই সে ব্যাস্ত হয়ে বলল,
“মাথাব্যাথা করছে পূর্ণা?দাঁড়া আমার কাছে মলম আছে।
পিঠব্যাগ থেকে মলম বের করে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে দিলো ধীর।বলল,
” ধর লাগিয়ে নে।কমে যাবে।
পূর্ণতা হাত বাড়াল।এর আগেই ধ্রুব নিয়ে নিল ওর হাত থেকে।ধীরের মেজাজ আবার বিগড়াল।পরমুহূর্তে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে ধ্রুবকে আস্তে করে বলল,
“প্রতিযোগিতা পরে করিস।ওর মাথা ব্যাথা করছে শুনিস নি?এই তো জোর গলায় বলিস তোদের এতো শত ভালোবাসা!তুইতো খেয়াল-ই রাখতে পারছিস না। আবার বউ বউ করছিস?
ধীরের ফিসফিসানি মিশরা, পূর্নতা কেউই শোনেনি।মিশরার কানে হেডফোন গোঁজা।কিন্তু পূর্নতা আগ্রহভরে দুজনের দিক চেয়ে রইল।কী বলছে এরা?
ধীরের কথার জবাব দিলনা ধ্রুব।এমন ভাব করল সে কিছু শোনেইনি।চুপচাপ আঙুলের ডগায় মলম নিয়ে পূর্ণতার কপাল ম্যাসাজ করতে শুরু করল।ধীরের মুখটা ছোট হয়ে গেল এতে।পূর্ণতাকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকতে দেখে ধ্রুব বলল,
‘কী দেখছো?চোখ বন্ধ করো।ভালো লাগবে তাহলে।
কথামত পূর্নতা তাই করল।ধ্রুব এক হাতে পূর্নতার মাথাটা সিট থেকে নিয়ে আনল নিজের কাঁধের ওপর। পূর্ণতা কিচ্ছু বললনা এবার।আবেশে ঘুম চলে আসছে তার।ধ্রুব পূর্ণতার কপাল ম্যাসাজ করতে করতে ধীরের দিক তাকাল।ধীর দাঁত পিষে তাদের দিকেই তাকিয়ে।ধ্রুব বাঁকা হেসে ধীরের মতই ফিসফিস করে বলল,
“বউয়ের খেয়াল রাখতে স্বামীর থেকে ভালো কে পারে,তাইনা ভাইয়া?
______
হোটেলের দুটো রুম বুকড করাছিল।বন্দবস্ত সব আশরাফ করে রেখেছিলেন।চারজনের নতুন কোনও অসুবিধেই হয়নি।পাশাপাশি রুম পরেছে ওদের।জার্নিতে প্রত্যেকেই ক্লান্ত।পূর্নতা এসেই বিছানার ওপর চিৎপটাং হয়ে পরল।দূরের জার্নি তাদের দুইবোনেরই প্রথম বার।পূর্নতার মাথায় এখন একটুও ব্যাথা নেই।ধ্রুব অনেকক্ষন ধরে টিপেছে।পূর্নতা চোখ বুজে মুচকি হাসল।ধ্রুবর এইটুকু যত্নই তার কাছে অনেক।বিড়বিড় করে বলল,
‘আর যাই হোক,ম্যাসাজ করতে খুব ভালো পারে।
ঠিক তখনি কেউ বলে ওঠে,
” আমি কিন্তু আরও অনেক কিছু পারি,করে দেখাবো?
পূর্ণতা যত্র চোখ মেলল।ধ্রুব কে নিজের ওপর দেখে হকচকাল।
‘আপনি?
‘কাপল রুম।আমিতো থাকবই।তুমি কী একা থাকতে চাইছিলে মায়াপরি?
ধ্রুব মিটিমিটি হাসল।পূর্ণতা চট করে ধ্রুবকে ঠেলে উঠে পরল।ধ্রুবর পিঠ ঠেকল বিছানায়।
পূর্ণতা বিরক্তির ভান করে বলল,
‘নির্লজ্জ্ব লোক একটা।কথায় কথায় গা ঘেঁষে!
ভেঙচি কেটে পূর্ণতা ফ্রেশ হওয়ার জন্যে জামাকাপড় সমেত ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াল।বাথটাবের ট্যাপ অন করে তোয়ালে,শাড়ি,ব্লাউজ হ্যান্ডেলে ঝোলাল।যখনই দরজা লাগাতে যাবে ওমনি আচমকা ধ্রুব ঢুকে ছিটকিনি লাগিয়ে দিল দরজার।
পূর্ণতা ভঁড়কে গেল প্রথমে। ধাতস্থ হতেই মনে হলো সেই একই দৃশ্য দেখল আজ।ভার্সিটির সেই পহেলা ফাল্গুন উৎসবে?ঠিক এরকইতো করেছিল ধ্রুব।তারপর___
পূর্ণতার গাল গরম হয়ে উঠল ভাবতেই।পরমুহূর্তে অভিমান হানা দিল।চটে গেল সাথে সাথে,
‘আপনি কেন ঢুকেছেন?
‘আমরা আজ এক সাথে শাওয়ার নেবো মায়াপরি!
ধ্রুবর নিষ্পাপ জবাব।
পূর্ণতার চোখ বেরিয়ে এল।প্রতিবাদ জানিয়ে বলল,
‘কক্ষনও না।আমি এক্ষুনি বের হয়ে যাচ্ছি।
পূর্ণতা ছিটকিনিতে হাত দিতে গেলেই ধরে ফেলল ধ্রুব।হ্যাচকা টানে নিজের কাছে নিয়ে আসতে গেল।জোরেশোরে টান বসানোয় পূর্নতা আছড়ে পরল বুকের ওপর।হঠাৎ ঘটনায় ধ্রুব ভারসাম্য রাখতে পারলনা।একেবারে ধপাস করে পূর্নতাকে সমেত চিৎ হয়ে পরল বাথটাবের মধ্যে।ঝপাৎ করে শব্দ হল।বাথট্যাবের পানি সব উথলে উঠল,ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল।দুটোতেই ভিজে জুবুথুবু হলো মুহুর্তে।অথচ ধ্রুব হেসে উঠল শব্দ করে।
“দেখলে, ওপর ওয়ালাও চাইছিলেন আমরা একসঙ্গে শাওয়ার নেই।
পূর্ণতা চোখ ছোট করে বলল,
‘আপনাকে বলেছিল?
“বলেনি। তবে ইঙ্গিত দিয়েছে।দেখলে না কেমন দুজন একসাথে ভিজে গেলাম!
পূর্ণতা মেকি রাগ দেখিয়ে বলল,
‘অজুহাত দিতে হবেনা।এসব যে আপনার শয়তানি আমি খুব ভালো করে বুঝেছি।
“তুমিতো পৃথিবীর সব বোঝো।শুধু আমাকে বাদ দিয়ে।
পূর্ণতার অভিব্যক্তি সঙ্গে সঙ্গে সিরিয়াস হয়ে গেল,
“যখন চেয়েছিলাম তখনই পারিনি,তাই এখন আর চাইনা।
পূর্ণতা উঠে পরল ধ্রুবর বুকের ওপর থেকে।ধ্রুবর হাসিটা উধাও।সেও উঠে দাঁড়াল।
” কেনো বারবার পেছনের কথা তুলছো মায়াপরী?সব কিছু ভুলে যাওনা।আমরা আবার__
পূর্ণতা কথা মাঝপথেই কেঁড়ে বলল,
“ভুলে যাওয়া কতোটা সহজ আপনার কাছে তাইনা।কিন্তু আমি তো পারছিনা।ওই পনেরো টা দিন একটাবারের জন্যেও শান্তি পাইনি আমি।একটা রাত ও চোখের জল না ঝরিয়ে ঘুমোতে পারিনি।
প্রত্যেকটা মুহুর্তে মনে হয়েছে, এই বুঝি আপনি এলেন।আমার হাত আকড়ে বললেন,যা বলেছেন সব মিথ্যে।যা করেছেন সব নাটক।আপনি আমায় চান,আমায় ভালোবাসেন।মনে হয়েছে এই বুঝি আপনি এসে বিয়ে টা ভেঙে দেবেন। আমাকে নিজের বউ করে নিয়ে যাবেন।হয়নি।আমার সব জল্পনা- কল্পনা কে মিথ্যে করে দিয়ে আপনি তো এলেনইনা, সাথে ভেঙে গুড়িয়ে দিলেন আমার বিশ্বাস,আমার হৃদয়, আমার ভরসাকে।
পূর্ণতা কেঁদে ফেলল।ধ্রুব এগোতে ধরলে হাত উঁচু করে বলল,
‘কাছে আসবেন না।
ধ্রুব থেমে যায়।বুক পুড়ছে তার।অনুতাপে,আফসোসে।পূর্ণতা ভেজা গলায় বলল,
“সেদিন যদি মিশু আর ধীর ভাইয়ার কারনে বিয়েটা না ভাঙতো আজ তো আমি ধীর ভাইয়ার বউ হয়েই থাকতাম তাইনা!তখন এতো ভালোবাসা কোথায় রাখতেন আপনি?? এতোদিনে হয়তো মন থেকে না হোক শরীর দিয়ে ধীর ভাইয়ার কাছাকাছি__
পুরোটা বলার আগেই পূর্ণতার ঠোটে আঙুল চেপে ধরলো ধ্রুব।পূর্নতার জলমাখা চোখ দুটিতে চোখ রেখে নিরেট কন্ঠে বলল,
” আমি যাই করে থাকি,আমার ভাগ্যে তুমি আর তোমার ভাগ্যে আমিই ছিলাম।আর তাই আজ আমরা কাছাকাছি।সৃষ্টি কর্তা চাইলে সারাটাজীবন এভাবে কাছাকাছিই থাকবো।
বুঝলে?
ধ্রুব ফের পূর্নতার নাকে নাক ঘষে দিল।ভেজা শরীরে কাপুনি না উঠলেও,ধ্রুবর এইটুকু ছোঁয়ায় কেঁপে উঠল পূর্নতা।কিন্তু হার সে মানলোনা।ধ্রুবর যুক্তি মেনেও নিলনা।ওভাবেই ওয়াশরুমে ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
_____
এদিকে আসা থেকে রুমের মধ্যে থম মেরে বসে রয়েছে ধীর।রাগে ফুসছে সে।যে ভাইকে এতটা স্নেহ,আদর,আর ভালবাসতো সেই ভাই আজ ক্রমাগত পাঙ্গা নিয়ে চলছে তার সঙ্গে।এককথায় প্রতিযোগিতায় নামছে।মিশরা আসার পরপরই গোসল করেছে।চুল মুছতে মুছতে বের হলো সে।বিছানায় বসে থাকা ধীরের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
‘আমার হয়ে গেছে।তুমি গেলে যাও।
ধীর উত্তর দিলোনা।মিশরা আবার ডাকল,
‘ধীর ভাইয়া?শুনলে কী বললাম?
ধীর না তাকিয়ে জবাব দিল,
‘কী?
‘ফ্রেশ হবেনা?
‘হু
” তো যাচ্ছোনা কেনো?
ধীর বিরক্ত হয়ে বলল,
“তোর কোনও কাজ থাকলে কর,আমাকে বিরক্ত করিস না তো।
মিশরা ধীরের পাশে বসল।
“অন্যের বউয়ের দিক নজর দিলে অবস্থা তো এমনই হবে।
মিশরার বাঁকা কথায় ধীর তাকাল এবার।
‘কী বলতে চাই__
ধীরের কথা থেমে গেল। মিশরার দিক পূর্ন দৃষ্টি পরতেই চোখ দুটো আটকে যায়।
সদ্য গোসল করেছে।চুল থেকে এখনও টুপটুপ করে পানি পরছে ফোঁটা ফোঁটা।সাথে পরেছে শাড়ি।
এই প্রথম মিশরাকে শাড়ি পরা দেখল ধীর।হঠাৎ কেন যেন মনে হলো মিশরা মারাত্মক সুন্দরী!ধীর সম্মোহনের মত চেয়ে বলল,
‘এতোটা স্নিগ্ধ লাগছে কেন?
ধীরের মুখের সামনে হাত নাড়লো মিশরা,
‘কী হলো?এই?
ধীরের সম্বিৎ ফিরলনা।ঠোঁট নেড়ে বলল
‘হু?
‘এভাবে কী দেখছো?
‘তোকে।
মিশরা বুঝলনা,
‘কী?
ধীর মুগ্ধ হয়ে আওড়াল,
‘তুই খুব সুন্দর!
শব্দ করে হেসে উঠল মিশরা।উঠে চলে যেতে নিতেই হাত ধরে ফেলল ধীর।
মিশরা ঘুরে তাকাল।
‘কী হয়েছে?
ধীর তখনও চেয়ে।নিষ্পলক।মিশরা সন্দিহান কন্ঠে বলল,
“কি চাইছো বলোতো তুমি?
” তোকে!
কথাটা বলেই টান মেরে মিশরাকে বিছানায় ফেলে দিলো ধীর।মিশরা বিস্ময়ে কথা বলতে ভুলে গেল।ঠোঁটের ওপর ধীরের উষ্ণ স্পর্শে সম্বিৎ ফিরল তার।কিন্তু ততক্ষনে বেশ দেরি।চেয়েও ধীরকে সরাতে পারলনা।অথবা,সরাতে চাইলনা।
সেও গা ভাসাল ভিন্ন স্রোতে।মেনে নিল ‘ যা হচ্ছে হোক!’
ধ্রুবর ওপর রাগ করে পূর্ণতা গোসলই করেনি।ভিজে গিয়েছিল বলে রুমে এসে অন্য একটা শাড়ি পরেছে।ধ্রুবকে তখন আটকে রেখেছিল ওয়াশরুমের মধ্যে।যাতে চেঞ্জ করার সময় কিছুতেই বের হতে না পারে ও।শাড়ি পরা শেষ করে তারপর গিয়ে দরজা খুলল।ধ্রুব গোসল করে একদম তৈরি।কোমড়ে তোয়ালে পেঁচিয়েছে সে।সারা গায়ে আর কিচ্ছু নেই।পূর্নতা দেখতেই ঘুরে গেল।ভাণ করল কিছুই দেখেনি।আস্তে আস্তে চুলে তোয়ালে প্যাচাচ্ছে সে।ধ্রুব কাছে এসে পূর্নতার গায়ের ওপর থেকে লাগেজ নিল।পূর্ণতা নড়েচড়ে ওঠার আগেই সরে গেল আবার।পরপর শার্ট-প্যান্ট বের করে আবার পূর্ণতার গায়ের ওপর থেকেই লাগেজ রাখল।পূর্ণতা এবার ঘুরে তাকাল,
‘কী হচ্ছেটা কী?
ধ্রুব উত্তর না দিয়ে চুপচাপ আবার ঢুকে গেল বাথরুমে।পূর্ণতা কপাল কোঁচকাল। ধ্রুব কী রাগ করল?করলে করুক! আমার কী হুহ!
পরমুহূর্তে আবার বাথরুমের দিক তাকাল পূর্নতা।ঠোঁট উলটে ভাবল ‘ বোধ হয় রেগে গেছেন।আমি কী তখন একটু বেশিই বলে ফেললাম?স্যরি বলব?
পূর্ণতা কোনও সিদ্ধান্তই নিতে পারলনা।একটু আগের প্যাচানো তোয়ালে খুলে ফেলল আবার।চুল ঝাড়তে ঝাড়তে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।কাঁধের এক পাশে সব চুল এনে আবার ছুড়ে মারল পিঠের ওপর।
পরনে তার লাল টুকটুকে জামদানী শাড়ি।পূর্ণতা যতবার হাত নাড়াচ্ছে রেশমী চুড়ি গুলোও শব্দ করে দুলে দুলে উঠছে।ধ্রুবরই দেয়া এসব।ঠিক তখনি ভেসে এল একটি কন্ঠস্বর,
“”””” রুপ তেরা মাস্তানা,,
পেয়ার মেরা দিওয়ানা,,,
ভুল কোয়ি হামসে না হো যায়ে এএএএএ”””””
পূর্ণতা বিদ্যুৎ বেগে ঘাড় কাত করে তাকাল।ধ্রুব দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে।ঠোঁটে দীর্ঘ হাসিটা পূর্নতাকে বুঝিয়ে দিল ‘ধ্রুব রেগে নেই।গানের লাইন শুনে পূর্ণতা ভ্রু কুঁচকে বলল,
” আপনার মাথায় কি সব সময় এসবই ঘোরে?
ধ্রুব এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
“সেতো ঘুরবেই।বউ কে কিভাবে ভালোবাসতে হয় সেটাই তো ভাববো তাইনা?এতো সাধের বউ আমার!
পূর্ণতা বিরক্ত হওয়ার ভাণ করল,
“সব সময় ফাজলামো।একটু সিরিয়াস কবে হবেন?
ধ্রুব এসে একদম কাছে দাঁড়াল পূর্নতার।কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,
” যেদিন বাবা হব।
পূর্ণতা বিস্ময়ে টেনে বলল,
‘কী?
‘জ্বী।
‘ছি!
_____
বিকেলের দিকে ওরা বেরিয়ে পরল সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে।মিশরার মুখে আজ হাসি লেপ্টেই আছে।সেও শাড়ি পরেছে।পরিয়ে দিয়েছে পূর্নতা।দুজনেই দ্বিগুন উৎসাহী সেন্টমার্টিনে ঘোরার জন্যে।
১৭ বর্গকিলোমিটারের একটি ক্ষুদ্র দ্বীপ এটা।
চারদিক ঘিরে শুধু নীল রঙের জল।পূর্নতা মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকল।
মাথার ওপর সাড়ি বদ্ধ ভাবে লাগানো লম্বা নারকেল গাছের পাতা। সাথে সমুদ্রের নীল জলরাশির এমন অপার সৌন্দর্য,সব মিলিয়ে চোখ ধাধিয়ে যাত।দূর হতে ধেয়ে আসছে শীতল বাতাস।উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে পূর্ণতার লম্বা খোলা চুল।কিছুক্ষন পরেই ধ্রুব হাতে একটা ডাব নিয়ে হাজির হলো।।মুঁদে থাকা পূর্ণতার কানের পাশে মুখ নামিয়ে বলল,
“”””” আকাশের নীল আর সমুদ্রের নীল,যেখানে মিলেমিশে একাকার,,
সেখানেই ভালোবাসা মেতে আছে তোমার আমার।
হঠাৎ আওয়াজে পূর্ণতা চমকেছিল।ধ্রুবর দিকে আড়চোখে চেয়ে বলল,
” আবার শুরু করলেন?
ধ্রুব অসহায় মুখ করে বলল।
‘কী করব বলো?তোমাকে দেখলে প্রেম প্রেম ভাব আপনাআপনি উথলে আসে আমার।আচ্ছা বাদ দাও,
এখন এটা নাও তো,সেন্টমার্টিন এসে ডাব খাওয়ার মজাই আলাদা।
পূর্নতা চোখ সরু করে বলল
” আপনি কি করে জানলেন?আগেও এসেছিলেন?
ধ্রুব কাঁধ উচু করে বলল,
‘অফকোর্স!অনেকবার।
‘ নোরাকে নিয়ে তাইনা?
ধ্রুব উদ্বেগ নিয়ে বলল
‘এই না।নো ওয়ে।কি যা তা বলছো!মেয়ে নিয়ে আসবো আমি?আমরা তো ট্যুরে এসছিলাম। তাও বছর খানেক আগে।
“মেয়ে নিয়ে আসবেন মানে? আমি কি ছেলে?
ধ্রুব ঠোঁট কামড়ে হাসল,
” তুমি ছেলেও নও,,মেয়েও নও,তুমি আমার বউ।আমার মায়াপরী।একজন সুন্দরী রমনী!
ধ্রুব ক্রমশ ঝুঁকে যেতেই পূর্ণতা মাথাটাকে পিছিয়ে নিয়ে বলল,
‘বুঝেছি,বুঝেছি।আর বলতে হবেনা।
ধ্রুব সোজা হলো।ডাব এগিয়ে দিয়ে বলল,
“নাও।
পূর্ণতা সেদিক চেয়ে আবার ধ্রুবর দিক ফিরল,
“দুটো স্ট্র কেন?
” একটা দিয়ে তুমি খাবে অন্যটা দিয়ে আমি।
পূর্ণতা মুখ ঘুরিয়ে বলল ‘ আমি এভাবে খাবনা।
ধ্রুব মন খারাপ করল।হাতের ডাবের দিক চেয়ে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল।ডাব ফেলে দিতে ধরতেই পূর্ণতা ধরে ফেলল।একটা স্ট্র নিয়ে মুখে পুড়লো তারপর। তাৎক্ষণিক ধ্রুবর অন্ধকার মুখ চকচক করে উঠল।হেসে বাকি স্ট্র -টা নিজেও নিয়ে নিল মুখে।
রেগে গাছের গায়ে ঘুষি বসাল ধীর।রাগ কমাতে এটাই করছে ইদানীং।তবু যদি একটু কমত।চোয়াল মটমট করছে দূরে ধ্রুব- পূর্নতার রোমাঞ্চকর দৃশ্য দেখে।ঠিক তখনি মিশরা পাশে এসে দাঁড়াল।ধীরের বাহু জড়িয়ে বলল,
“ধীর ভাইয়া চলো না সমুদ্রের কাছে যাই।পানিতে পা ডোবাবো আমি।
ধীর থেমে থেমে বলল,
” তুই যা। আমার ইচ্ছে করছে না।
” ইচ্ছে করছে না বললে হবেনা,যেতে হবে,চলো চলো…
মিশরা জোরাজুরি করতেই ধীর চেচিয়ে উঠল,
” বললাম না যাবোনা?
মিশরা বুঝতে না পেরে বলল,
‘চেঁচাচ্ছো কেন?
“তুই -ই বা এতো ঘেষছিস কেন আমার কাছে? দূরে থাকবি।
মিশরা চটে বলল,
” আমি ঘেষেছি,নাকি তুমি?? যখন ইচ্ছে হবে বিছানায় নেবে আবার যখন ইচ্ছে হবে ধমকে- ধামকে দূরে পাঠাবে!
রাগ টা আরও চড়ে বসলো ধীরের।শক্ত হাতে গাল চেপে ধরল মিশরার।ব্যাথায় নুইয়ে গেল মিশরা।ধীর কিড়মিড় করে বলল
” যা ইচ্ছে তাই করবো আমি।তোর অন্যায়ের শাস্তি এখনো পূর্ণ হয়নি।
ধীর হাত সরাতেই মিশরা গাল আগলে ধরল নিজের।ব্যাথায় অবশ হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। ধীর তপ্ত চোখ নিক্ষেপ করে গটগট করে চলে গেল।সেদিক চেয়ে চোখ ভিজে উঠল মিশরার।তাকাল দূরে দাঁড়ানো ধ্রুব পূর্নতার দিকে।আওড়াল,
‘আমার কপালে বোধহয় ভালোবাসা কোনদিন জুটবেনা!
চলবে