ফাগুন_এলো_বুঝি! (৩২)

0
921

#ফাগুন_এলো_বুঝি!
(৩২)

বিকেলের দিকে ধীর বাড়ি ফিরছিল।বসুন্ধরা পাড় হওয়ার সময় হঠাৎ ধ্রুবর গাড়ি গেটে দাঁড় করানো দেখে সতর্ক চোখে তাকাল।ড্রাইভারকে বলল,
“গাড়ি থামাও।
গাড়ি থামল।ধীর জানলার কাঁচ নামিয়ে বসে থাকল ভেতরে।ধ্রুব শপিংমলে হঠাৎ? কার জন্যে কেনাকাটা করবে?নিজের, নাকি পূর্নার জন্যে?
কিছুক্ষন পরেই ফেরত এল ধ্রুব।হাতে শপিংব্যাগ।ধীর বাইরে থেকে দেখেই বুঝল ধ্রুব কার জন্যে কী কিনেছে!প্যাকেটের ভেতর নির্ঘাত শাড়ি।ধ্রুব গাড়ি নিয়ে চলে যাওয়ার পর নামল ধীর।মলের ভেতরে ঢুকল।সোজা চলে গেল থার্ড ফ্লোরে।
প্যাকেটের গায়ে লেখা দোকানের নামটা মাথায় আছে।ধীর ঠিক সেই দোকানেই হাজির হলো গিয়ে।শাড়িরই দোকান।এর মানে ধ্রুব পূর্নার জন্যেই শাড়ি কিনেছে।কিন্তু হঠাৎ? আজ ভালোবাসা দিবস বলে?ধীরের কোঁচকানো কপাল টানটান হলো।ঠিক করল সেও পূর্নতাকে শাড়ি দেবে।ধ্রুবর থেকেও কয়েক গুন দামি শাড়ি।
শোরুমের লোকটি যখন শুধালেন,
” কী লাগবে স্যার?
ধীর বলল,
‘সব থেকে বেস্ট এন্ড হাইয়েস্ট প্রাইসের শাড়ি দেখান।
____
বাড়ি ফিরে ধীর শাড়ি আলমারিতে তুলে রাখল।রাতেই পূর্নতাকে দিয়ে দেবে।আগে ধ্রুব ওরটা দিক।তারপর ধীর দেবে।পূর্নতা তখন রিয়্যালাইজ করবে সব দিক থেকে ওর ভালোবাসার যোগ্য কে!
এরপর ঢুকল গোসলে।মিশরা প্রতিদিনকার মত লেবুর শরবত নিয়ে এল ধীরের জন্যে।ধীরকে রুমে পেলনা।বুঝল ওয়াশরুমে তাহলে।মিশরা গ্লাসটা টি-টেবিলের ওপর ঢেকে রেখে ফিরে আসতে ধরবে,খেয়াল পরল আলমারির দিকে।আলমারির এক পাশের কপাট চাপানো,হাল্কা ফাঁকা দেখা যাচ্ছে।লাগানো হয়নি ভালো করে।
“এটা আবার কে খুলল?
মিশরা কাছে গিয়ে আলমারির কপাটটা টেনে খুলল।সঙ্গে সঙ্গে ঝুপ করে শাড়ির প্যাকেটটা ভেতর থেকে পায়ের কাছে এসে পরল।মিশরা কৌতুহলে হাতে তুলল।প্যাকেট নেড়েচেড়ে বুঝল ভেতরে শাড়ি।কৌতুহল আরো দ্বিগুন হলো এতে।দ্রুত হাতে প্যাকেট খুলতেই হা হয়ে গেল।
এত্ত সুন্দর, দামি শাড়ি ধীর ভাইয়া কার জন্যে এনেছে?
পরমুহূর্তে ভাবল
” আর কার জন্য আনবে?নিশ্চয়ই আমার জন্যে এনেছে।আজ ভালোবাসা দিবস না?ভাইয়াও নির্ঘাত আমার মতোই সবটা প্রথম থেকে শুরু করতে চাইছে।

উত্তেজনায় শাড়িটাকে বুকের সাথে চেপে ধরল মিশরা।সকালের রোদের মত চেহারা চিকচিক করছে আনন্দে।শাড়িটা আবার আগের মত প্যাকেটে ভরে সাথে নিয়ে বেরিয়ে গেল মিশরা।পূর্নতাকে দেখাবে এখন।এত্ত বড় একটা খুশির বিষয় ,ভাগ করবেনা ওর সাথে?
______
ঠিক সন্ধ্যে নাগাদ ধ্রুব বাড়ি ফিরল।ভীষণ ক্লান্ত সে।প্রথম বার এত বড় একটা গুরুদায়িত্ব পালনের সাহস করল।যেচে ব্যাবসার ভার কাঁধে তুলল।পারবেতো সব সামলাতে?সেই সাথে ধীরকে নিয়ে চিন্তাতো আছেই।ধ্রুবর ভয় করে ইদানীং। পূর্নতাকে হারানোর ভয়।এই বুঝি ধীর একটা কান্ড ঘটাল,আর পূর্নতা চলে গেল দূরে।ভাবতেই ধ্রুবর ভয় হয়।আসঙ্কায় মুখ ছোট হয়ে আসে।ধ্রুব রুমে ঢুকে টেবিলের ওপর রাখা শরবত পেল।যখনই বাইরে থেকে আসে এরকমই পায়।কিনে আনা শাড়িটা বিছানায় রাখল সে।কাউচে বসে পুরো গ্লাস ঢকঢক করে ফাকা করল।পূর্ণতা রান্নাঘরে। কাজ না থাকলেও গিয়ে সেলিনার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।ওখান থেকেই সেলিনার রুমে গিয়ে গল্প করে,সাথে যোগ দেয় মিশরাও।
ঠিক দশটা নাগাদ রুমে এল পূর্নতা।ধ্রুব তখন নেই।পূর্ণতা প্রথমে ভাবল সে হয়ত বাথরুমে,পরে দেখল নেই।উঁকি দিল বারান্দায়, সেখানেও নেই।পূর্ণতা ঠোঁট কামড়াল।লোকটা গেল কই?তখন চোখ পড়ল বিছানার ওপর। পূর্ণতা এগিয়ে এল।র‍্যাপিং করা প্যাকেট রাখা।ওপরে সাদা ছোট চিরকুট ভাঁজ করা।পূর্ণতা প্রথমে কাগজের ভাঁজটাই খুলল।ভেতরে গোছানো হাতে লেখা,

“মায়াপরি!আজ আমাদের দুজনের একসাথে পাওয়া প্রথম ভালোবাসা দিবস।আর তাই তোমার স্বামীর তরফ থেকে তোমার জন্যে ক্ষুদ্র একটি উপহার রইল। আমি ছাদে অপেক্ষা করছি।জানি,তুমি আসতে চাইবেনা।কারন,আমি তোমার চোখে এখনও অপরাধী। তবু বলব এসো একবার।অনুরোধ করছি এসো।যদি ভালোবেসে থাকো এক বিন্দু,একটু জলদিই এসো তবে।তোমার জন্যে আজকে অপেক্ষা করা,তোমার উপেক্ষার থেকেও ভয়াবহ।

পূর্ণতা চিঠিটা পড়েই বসে পরল বিছানায়।মুখ চেপে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।এরপর আর না গিয়ে পারবেনা।মনের অবাধ্য হবে এতটা জোর নেই তার।তাড়াহুড়ো করে শাড়িটা পরেই বের হতে নিল পূর্নতা।দরজা অব্দি গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল আবার।ছুটে এসে ড্রেসিং টেবিল থেকে কাজল তুলে চোখে পরল।কপালের মাঝে ছোট্ট কালো টিপ লাগাল।ধ্রুবর দেয়া সেই চুড়িগুলো থেকে কালো দুডজন চুড়ি বের করে হাতে ভরল।সব শেষে আবার ছুটে গেল ছাদের দিকে।ধ্রুবর কাছে।
___
ত্রস্ত হাতে আলমারি হাতাচ্ছে ধীর।রাগে মাথার রগ লাফাচ্ছে।পূর্নতার জন্যে নিয়ে আসা শাড়িটা কোথাও খুঁজে পাচ্ছেনা।স্পষ্ট মনে আছে একদম ওপরের শেল্ফেই রেখেছিল।এইটুকু সময়ের মধ্যে হাওয়া হয়ে গেল কী করে?খুঁজতে খুঁজতে আলমারির সব জামাকাপড় নামিয়ে ফেলল ধীর।একরকম সব ছুড়ে ছুড়ে মেঝেতে ফেলল।তবুও পেলনা।কে নিয়েছে?কার এত সাহস?
ক্রোধে হিঁসহিঁস করতে করতে ধীর বসে পরল সোফায়।দুহাতে মাথা চেপে ধরে হাটুতে ঠেস দিল।ঠিক তখনি সম্মুখে টের পেল কারো উপস্থিতি।কেউ একজন এসে একদম সামনে দাঁড়িয়েছে।ধীর চোখ তুলে তাকাল।মিশরা দাঁড়িয়ে।তালু অব্দি ঘোমটা টানা।সেলিনা যত্ন করে পরিয়ে দিয়েছেন।
মিশরা নিচের দিক চেয়ে,গাল দুটোতে রক্তিম আভা স্পষ্ট। ঠোঁটে গাঢ় মেরুন লিপস্টিক।নাকের ছিদ্রতে সূক্ষ্ণ পাথরের নোসপিন,হাতে স্বর্নের মোটা বালা।ব্যাস!এইটুকু সাজ।একটা সময় ভারি মেক-আপ করা মেয়েটা আজ প্রথম বার স্বামীর জন্যে অল্প সেজেগুজে তৈরি হলো।এতেই যেন হুরের মত লাগছে তাকে।লজ্জায় নুইয়ে আছে মিশরা।ধীর কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে জানেনা,তবে জানে এই মুহুর্তে বুকটা প্রচন্ড কাঁপছে।ঢোল বাজছে ভেতরটায়।অনুভূতিতে আড়ষ্ট তারা।
অথচ মিশরাকে ধীর ভালো করে লক্ষ্য অব্দি করলনা।পড়নের শাড়িটা দেখতেই দাঁড়িয়ে গেল সে।রেগে আগুন হয়ে বলল,
‘কোন সাহসে এই শাড়িতে হাত দিয়েছিস তুই?
মিশরা যত্র অবাক চোখে তাকাল।বুঝতে না পেরে বলল,
‘মানে?
‘বাংলা বুঝিস না?এই শাড়ি পরার স্পর্ধা তোর হলো কী করে?
ধীরের বজ্রকন্ঠে মিশরা কেঁপে উঠল ঈষৎ।
‘এভাবে বলছো কেন?এই শাড়িত আমার জন্যেই এনেছো তুমি।

ধীর দুই ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
‘তোর জন্যে শাড়ি আনব আমি?আমি?
মিশরা ঠোঁট নেড়ে শুধাল,
‘তবে?
‘তবে আর কী?এটা আমি পূর্নতার জন্যে এনেছিলাম।আর তুই নিজে পরে নিলি?দাম জানিস এই শাড়ির?

মিশরা স্তব্ধ,বিস্মিত হয়ে বলল
‘কী!তুমি পূর্ণতার জন্যে শাড়ি এনেছ?
ধীরের অকপট জবাব,
‘হ্যা।এক্ষুনি খোল এটা।যাস্ট নাও।
মিশরা জ্বলে উঠল এবার,বিরোধিতা জানাল,
‘না।খুলবনা।
ধীর চোখ ছোট করল,
‘খুলবিনা মানে?
‘খুলবনা মানে খুলবনা।এই শাড়ি আমার স্বামীর কেনা।এর ওপর শুধু আমার অধিকার।আর কারোর না।

মিশরার আচরন অদ্ভূত ঠেকল ধীরের।মুখ কোঁচকাল সে।
‘তোর কী মাথা খারাপ হয়ে গেছে?তুই কী আসলেই বাংলা বুঝিস না?আমি এটা পূর্নার জন্যে কিনেছি।ভালোবাসা দিবসে ওকে উপহার দেব বলে।আর তুই__
মিশরা চটে গেল,
‘তোমার লজ্জ্বা করছেনা ধীর ভাইয়া?নিজের স্ত্রীর সামনে এসব বলতে মুখে আটকাচ্ছেনা?আমি থাকতে অন্য এক মেয়ের জন্যে তুমি শাড়ি কিনেছ,তাও যে কীনা তোমারই ছোট ভাইয়ের বউ?এতটা অধপতন একটা মানুষের হতে পারে?কী করে এত নীচে নামছো?

ধীর ক্ষেপে মিশরার গাল চেপে ধরল।মিশরা ব্যাথায় চোখ খিচে বুজে ফেলল।ধীর খিটমিট করে বলল,
‘আমি নিচে নামছি?আর তুই?তুই নামিসনি?নিজের সন্মান নিয়ে।মিথ্যে বলে আমাকে বিয়ে করেছিস।তোর জন্যেই আজ পূর্না আমার ছোট ভাইয়ের বউ।
ধীর গাল ঝাড়া মেরে ছাড়ল।মিশরার সমস্ত দাঁত কপাটি ব্যাথায় টনটন করছে।অথচ দমে গেলনা সে।পালটা বাণ ছুড়ে দিল বাক্যের,
‘আমি না হয় মিথ্যে বলে জোর করে তোমায় বিয়ে করেছিলাম।কিন্তু কাছে তো জোর করে আনিনি।তুমি এসেছ।প্রতিটা রাত স্বামীর অধিকার ফলিয়েছ।আমার মনে ভালোবাসা জন্মিয়ে নিজেই দূরে ঠেলে দিচ্ছ! কেন?

ধীর সচেতন কন্ঠে বলল,
‘কী,কী বললি?ভালোবাসা মানে?
মিশরা সময় নিল,ঢোক গিলল,তাকাল ধীরের তপ্ত দৃষ্টিতে।ভেজা কন্ঠে বলল,
“আমি তোমাকে ভালোবাসি ধীর ভাইয়া!
আমি সারাটাজীবন তোমার সঙ্গে কাটাতে চাই।
তোমাকে পাশে চাই আমার।তোমার হাতে হাত রেখে___
মিশরার কথা সম্পূর্ণ হলোনা,এর আগেই ধীর গা কাপিয়ে হেসে উঠল।যেন মজার কোনও কৌতুক শুনলো মাত্র।মিশরার মুখটা আরও ছোট হয়ে গেল এতে।এতক্ষনের চিকচিকে জল গড়িয়ে গালে পরল।
ধীর হাসতে হাসতে বলল,
‘তুই আমাকে ভালোবাসিস?ও গড!ভালোবাসার কি বুঝিস তুই?
ধীর হাসিই থামাতে পারছেনা।এতটা বিদ্রুপ,তাচ্ছিল্য মিশরার সহ্য হলোনা।নিঃশব্দে কেঁদে ফেলল মেয়েটা।
ধীর বলল,
‘অনেক হাসিয়েছিস।এবার আর কথা না বাড়িয়ে শাড়িটা খোল।
তারপর আবার নিজেই বলল,
না থাক।খুলতে হবেনা।ওটা আমি তোকে দান করে দিলাম।তোর ব্যাবহার করা শাড়ি আমি আমার পূর্নাকে দেবনা।
” আমার পূর্না”শব্দটা শুনেই মিশরা ফুঁসে উঠল,
‘একটু লজ্জ্বা করো ধীর ভাইয়া।পূর্ণতা এখন ধ্রুব ভাইয়ার স্ত্রী।তাকে আমার, আমার করছো তুমি?ছি!আর আমি যদি সে দিন তোমায় বিয়েটা নাও করতাম,তাহলেও পূর্নতা তোমার হতোনা।কারন ও ধ্রুব ভাইয়াকে ভালোবাসে।তোমাকে কোনও দিন মেনেই নিতোনা।
‘নিত।এক না একদিন ঠিক মেনে নিত।আমি আমার ভালোবাসা দিয়ে ধ্রুবকে ঠিক ভুলিয়ে দিতাম।
ধীরের দৃঢ় কন্ঠ।
মিশরা অবাক হলো।পরপর মুখের ওপর বলল,
‘তার মানে তুমি জানতে পূর্নতা ধ্রুব ভাইয়াকে ভালোবাসে?তুমিতো তাহলে আমার থেকেও বড় স্বার্থপর।পূর্ণতা আমার রক্তের কেউ ছিলনা।কিন্তু ধ্রুব ভাইয়াতো তোমার ভাই ,আর পূর্নতা তোমার ভালোবাসার মানুষ। তুমি তাদের ভালো থাকার কথা ভাবলেনা?নিজেরটা ভেবেছ?বাহ,বা বাহ!
ধীর মুখ অন্যদিক ঘুরিয়ে বলল,
‘আমি আমারটা ছাড়া কারোরটা ভাবিনা।দাতা কর্ন নই যে ভালোবাসা দান করে দেব।
মিশরা নিজেকে সামলাল।কেন রেগে যাচ্ছে সে?ধীর পূর্নতাকে ভালোবাসে এসব তো অজানা নয়।মিশরা
কাতর কন্ঠে বলল,’
‘যদি তোমার ভালোবাসায় পূর্ণতা ধ্রুব ভাইয়াকে ভুলে যেতে পারত,তাহলে আমার ভালোবাসায় খামতি কীসের?আমার জন্যে কী পূর্নতাকে ভুলতে পারবেনা তুমি?
সেদিন তুমিইতো বললে ‘চল মিশু সব ভুলে যাই,নতুন করে সংসার করি।কেন বলেছিলে?নাটক ছিল ওসব?

‘হ্যা ছিল।তোকে হামিমুনে যেতে রাজি করানোর জন্যে বলেছিলাম।ধরে রাখার মত কোনও কথা ছিলনা ওটা।
ধীরের নিরুৎসাহিত জবাব।মিশরা বোজা কন্ঠে চেঁচিয়ে বলল,
‘ছিল।আমার কাছে ছিল।তোমার ওই কথাগুলোই আমাকে ভাবতে বাধ্য করেছে।বাধ্য করেছে তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করতে।
ধীর বিরক্ত হয়ে চলে যেতে ধরল,মিশরা দ্রুত গিয়ে পথ আগলে দাঁড়াল ওর।
ধীরের কঠিন চোয়াল,নির্দয় চাউনীতে ভেজা চোখ রেখে আকুতি করল,
‘পূর্নতাকে ভুলে যাও না ধীর ভাইয়া!আমাকে একবার ভালোবেসে দেখো,কোনওদিন কোনও অভিযোগের সুযোগ দেবনা তোমায়।আমার সব খারাপ গুন,যেগুলো তুমি সহ্য করতে পারোনা,তোমার এক কথায় আমি বদলে ফেলব সেসব।
জীবনটা ছেলেখেলা নয় ধীর ভাইয়া।আজ আছি,কাল নাও থাকতে পারি।ছোট্ট জীবনটায় তোমাকে না পাওয়ার আফসোস রেখে আমি মরতেও চাইনা।জীবনে প্রথম কাউকে ভালোবেসেছি।আর তাকে পাবনা?আমাকে একবার ভালোবাসো ধীর ভাইয়া,তোমার জন্যে সব করব আমি।যা বলবে তাই।

ধীরের তিঁতকুটে চেহারা সাথে সাথে পরিবর্তন হলো।চোখ সরু করে বলল,
‘যা বলব, তাই করবি?
মিশরা ঘনঘন মাথা নাড়ল দুবার।
‘করব।
‘বেশ।কাল সকালে বাড়ির সবার সামনে সব সত্যি স্বীকার করবি।সবাইকে বলবি,যে ঐদিন আমার কোনো দোষ ছিলনা,ওসব ছিল তোর নাটক,তোর সাজানো একটা নোংরা প্ল্যান।পারবি?যদি পারিস তবেই তোকে মেনে নেব আমি।
______

ধ্রুব ঝিম ধরে বসে।নিস্তব্ধতায় নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ নিজেই শুনছে।আজকাল কোনও কিছু ভালো ঘটছেনা তার সঙ্গে। যা হচ্ছে সব খারাপ।না,একটা ব্যাপার তো সব কিছুর উর্ধ্বে। এইযে মায়াপরিকে পেল।এই ভালোটুকু নাহলে জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে যেত।যতটুকু শান্তি আছে তাও হারাত।ধ্রুব ফের একবার হাতঘড়ি দেখল।পূর্নতা এখনও আসেনি।হয়ত আসবেনা।ধ্রুবর মন ঝুপ করে খারাপ হলো।যতটা খারাপ হলে ছাদ থেকে লাফিয়ে পরে আহুতি দিতে ইচ্ছে হয়,ঠিক ততটা।দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠতে গেল সে।এর মধ্যেই কানে ভেসে এল নূপুরের রিনঝিন শব্দ।ধ্রুবর ঘুরে দেখার প্রয়োজন পরেনা।সে বুঝে গেল পূর্নতাই এসছে।ঠোঁটে চওড়া হাসি ফুটলো তাৎক্ষণিক।

আস্তেধীরে ফিরে চাইল সে।পূর্নতা ছাদে এসে অবাক চোখে চারিপাশ দেখছে।ছাদের একটা কর্নার পুরোটা দখল করে সাজিয়েছে ধ্রুব।লাল, সাদা বেলুন পরে আছে সিমেন্টের মেঝেতে।দেয়াল জুড়ে লাইটিং করেছে।জ্বলছে,নিভছে সেসব।ঠিক মাঝখানটায় রাখা একটা গোল টেবিল,দুপাশে দুটো চেয়ার।টেবিলের ওপর রাখা চকলেট কেক ।কিছু একটা লেখা তার ওপর।পূর্ণতা দূর থেকে এর বেশি বুঝে উঠলনা।সে বিস্ময় নিয়ে সব দেখল।এরপর তাকাল ধ্রুবর দিকে।ধ্রুব নিষ্পলক তার দিকেই চেয়ে।বিভোর দৃষ্টি। পূর্নতার পা থেকে মাথা অব্দি দেখে দেখে ধ্রুব মন্থর পায়ে এগোল।পূর্নতা ধ্রুবর বশীভূত চাউনি দেখলেই গুলিয়ে ফেলে নিজেকে।ধ্রুব ঠিক সামনে এসে হাত বাড়াল।নিরবে হাত চাইল পূর্নতার।পূর্নতা হাতের দিক,ধ্রুবর দিক একবার একবার দেখে ভাবল,হাত রাখবে কী?এর মধ্যেই ধ্রুব বলল,
‘প্লিজ!
ধ্রুবর কন্ঠে অনুরোধ। পূর্নতার কাঁপা হাত ধ্রুবর হাতে রাখতেই ধ্রুব আকড়ে ধরে।
‘এসো।
কদম মিলিয়ে দুজন হেটে টেবিলের কাছে এল।ধ্রুব পাতলা ছুড়িটা পূর্নতার দিক এগিয়ে দিল।
কেকের ওপর ”Happy valentine’s day লেখা।
পূর্ণতা চুপচাপ কেক কাটল।ধ্রুব এক টুকরো তুলে পূর্নতাকে খাইয়ে দিল।আশপাশ ইশারা করে বলল,
‘পছন্দ হয়েছে?
‘কখন করলেন এসব?
ধ্রুব ভিন্ন প্রসঙ্গ তুলল,
‘আমায় খাইয়ে দেবেনা?
পূর্ণতা চোখ নামিয়ে কেক তুলতে যেতেই ধ্রুব হাত ধরে বাঁধা দিল।
‘থাক!ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করার প্রয়জন নেই।
পূর্ণতা শুধাল,
‘এসব করে কী লাভ?যেখানে ভালোবাসার ঠিক নেই,সেখানে ভালোবাসা দিবস!
‘কে বলেছে ভালোবাসা নেই।তুমি আমি দুজনেই জানি,আমাদের মধ্যে ভালোবাসা আছে,এবং কতটা প্রবলভাবে আছে।তুমি আমায় ভালোবাসো আর,
আমি তোমাকে ভালোবাসি মায়াপরি!এটাই সবকিছু।
পূর্ণতা ছলছল চোখে তাকাল।
‘আবার একটা মিথ্যে?ঘরকূনো অযোগ্য মেয়েটাকে কেন ভালোবাসবেন?বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছেন বলে?সারাজীবন তার ঘানি টানতে হবে বলে?আমিতো বলেছিলাম, আপনি চাইলে নোরা___
ধ্রুব যত্র পূর্নতার ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরল,
‘শশশ!আজ কোনও ভুল বোঝাবুঝি নয়।কোনও বাড়তি কথা নয়।অনেক হয়েছে,জীবনের অনেক গুলোদিন আমরা নষ্ট করেছি।আর নয়।আজ তোমাকে আমার সব কথা শুনতে হবে।প্লিজ মায়াপরি!প্লিজ!

পূর্ণতা সিক্ত চোখে চেয়ে।ধ্রুবর দৃষ্টি ব্যাকুল।পূর্ণতার ও ইচ্ছে করল ধ্রুবর কথা শুনতে।মুখে না বললেও নিরবে সম্মতি জানাল সে।ধ্রুব স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল।আজ সব কথা উগড়ে দেবে।সব।সব।
পূর্নতাকে চেয়ারে বসিয়ে ওর সামনে হাটুগেড়ে বসল ধ্রুব।পূর্নতার তুলতুলে হাতদূটো মুঠোয় নিয়ে বলল,

‘ছোট্ট বেলা থেকে আমি ভীষণ পড়াকু,দিনরাত এক করে পড়া-ই ছিল আমার অভ্যেস।বই ছিল ধ্যান-জ্ঞান।আস্তেধীরে বড় হলাম।স্বভাবে পরিবর্তন এলো।ঘরের মধ্যে আটকে না থেকে বাইরে লাফানো শিখলাম।তৈরি হলো অন্য ধ্রুব।ভাইয়া ছাড়া প্রথম দিকে আমার কোনও বন্ধুই ছিলনা।ক্লাশের কারোর সঙ্গে মিশতামনা।যখন চেঞ্জ হতে শুরু করি,রিদ,সুমন,সাকিবদের মত অনেককে পেলাম।কিন্তু একটা জিনিস আমার কখনও হয়ে ওঠেনি।সেটা হলো,কোনও মেয়ের প্রতি আকর্ষণ, বা কোনও প্রেম!এ নিয়ে ওরা ভীষণ ক্ষ্যাপাতো আমায়।মেয়েরা যেচে প্রেমের প্রস্তাব দিলেও আমি ধ্রুব, মুখের ওপর না করে দিয়েছি।ভেবেই রেখেছিলাম,একেবারে বিয়ে করব।সব ভালোবাসা বউকে দেব।
অথচ সেই আমি প্রথমবার তোমাকে দেখে পিছলে পরলাম।রীতিমতো ঝাপ দিলাম প্রেমের সমুদ্রে।লাভ এ্যাট ফার্স্ট সাইট!
তোমার সুন্দর চোখের ভীত চাউনি,তোমার হাসার সময় ভেসে ওঠা টোল,কপালের অবাধ্য চুলের ঝাপ্টা সব কেমন এলোমেলো করে দিল আমাকে।প্রথম দিকে বুঝিনি,কিন্তু টের পেয়েছিলাম,আমার তোমাকে দেখতে ভালো লাগে।তোমার দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে।কেন,আমি নিজেও জানিনা।পরপর আবিষ্কার করলাম আমি হাবুডুবু খাচ্ছি সেই প্রেমের সমুদ্রে।স্রোত আমায় ভাসিয়ে নিচ্ছে।আমিও হার মানি।সত্যি বলতে চেষ্টাই করিনি কূল খোঁজার।পুরোপুরি ডুবে গেলাম আমার মায়াপরিতে!
ধ্রুব থামল।পূর্ণতা বিহ্বল চেয়ে।ধ্রুব বলল,
‘কোনও দিন ভাবিনি তুমি মিশরার বোন হবে।যেদিন তোমাকে আমাদের বাড়িতে দেখলাম,খুশির মাত্রাটা ব্যাখা করলেও কম হবে।তোমাকে দেখলেই কেমন বেহায়া হয়ে যেতাম।নিজের ওপর নিয়ন্ত্রনই থাকতোনা।কত জ্বালিয়েছি তোমাকে।রাতে ছাদে আনা,ব্ল্যাকমেইল করে তোমার স্পর্শ নেয়া____
সৌভাগ্যক্রমে তুমিও আমাকে ভালোবাসলে।তোমার চাউনি,আমাকে দেখলে তোমার লালচে গাল,তোমার লাজুক হাসি সব আমাকে বুঝিয়ে দিত তুমিও আমাকে চাও।সব কিছু ভালোই চলছি।দিন দিন তোমার প্রতি ভালোবাসাটা আমার তীব্র হচ্ছিল।পহেলা ফাল্গুনে বলতেই যাচ্ছিলাম মনের কথা,তোমার বাবা এসে পরায় হয়ে ওঠেনি।হয়ত সৃষ্টিকর্তা চাননি।
তখনও বুঝিনি,ওইদিনই আমাদের জীবনে দূর্ভোগ নামবে।সেইরাতের বেলাই জানলাম,ভাইয়া তোমাকে ভালোবাসে।ছোট বেলা থেকে ভালোবাসে।যখন আমি তোমাকে ভালো করে চিনতাম ও না।ভাইয়ার গোটা ডায়েরি আমি পড়েছি।তোমায় নিয়ে ওর লেখা প্রতিটি অনুভূতির লাইন আমার বুকটা দ্বিখন্ড করে দিচ্ছিল।অপরাধবোধ আমাকে খোঁচাচ্ছিল।কানের পাশে কে যেন বলছিল,
‘শেষমেষ ভাইয়ের ভালোবাসার দিকে হাত বাড়ালি ধ্রুব?আমার বিবেক আমায় নিয়ে উপহাস করছিল।
আমি আঁতকে উঠি।ভাবলাম,ভাইয়া তোমাকে এতবছর ধরে ভালোবাসে যেখানে সেখানে আমার এই কদিনের ভালোবাসা তুচ্ছ্ব গন্য হবে।ওই তোমাকে ডিজার্ভ করে।তুমি সুখি হলে ওর সাথেই হবে।প্রথমে কষ্ট পাবে কিন্তু পরে ঠিক ভুল যাবে আমায়।তাই তোমাকে ফেরাতে ওসব বাজে কথা বলেছি, নোরার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার নাটক করেছি।যাতে আমার ওপরে তোমার ঘৃনা আরো গাঢ় হয়
আমাকে ভুলে তুমি ভাইয়াকে ভালোবাস।ওকে বিয়ে করো।
আমি তোমাদের সুখ দেখতেই চেয়েছিলাম মায়াপরি!ভেবেছিলাম___

‘ভেবেছিলেন আপনার ভাই তার ভালোবাসা ফিরে পাক।আপনিও কষ্টটুকু সয়ে নেবেন।তাহলে আমার কথা কখন ভাবলেন?আমার ভালোবাসা বিলিয়ে দেয়ার অধিকার আমিতো আপনাকে দেইনি ধ্রুব!
ধ্রুবর কথা থেমে গেল পূর্নতার শক্ত কন্ঠে।
বলতে নিল,
‘মায়াপরি আমি ভুল__
‘ভুলতো আপনি করেইছেন।আসলে আপনি একটা স্বার্থপর মানুষ। নাহলে কী করে পারলেন এমন করতে?আমার কথা আপনার মনে পড়েনি?একবারও না?
পূর্ণতা উঠে দাঁড়াল। ধ্রুব দাঁড়াতেই
পূনরা উত্তেজিত হয়ে কলার চেপে ধরল ওর।
কেঁদে ফেলল সাথে।
‘আপনি কী ভেবেছেন?আমার ভালোবাসা এতই সস্তা ছিল,যে বিয়ের পর আপনাকে মন থেকে মুছে ধীর ভাইয়াকে ভালোবাসতাম?হ্যা, মেনে নিতাম ওনাকে।সংসার করতাম। কিন্তু সেটা একটা কলের পুতুল হয়ে।মন থেকে নয়।আমার মনে ভালবাসা জুগিয়েছেন আপনি। সেই আপনাকে আমি কী করে ভুলতে পারতাম?তাহলে আমাকে নিয়ে কেন এরকম ভেবেছেন?কেন ছোট করলেন আমার অনুভূতিদের?কোথায় পেলেন এত সাহস, বলুন!
ধ্রুব হাঁসফাঁস করে জড়িয়ে ধরল পূর্নতাকে।
‘আমার ভুল হয়ে গেছে।আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি মায়াপরি!আমার অন্যায়ের শাস্তি তুমি যা খুশি দাও আমি মাথা পেতে নেব।কিন্তু এভাবে দূরে সরে থেকোনা।সহ্য হয়না আমার।বুকটা পুড়ে যায়।
পূর্ণতাও পালটা জড়িয়ে ধরল ধ্রুবকে।পিঠের দিকের শার্ট দুহাতে খামচে ধরে জোরে কেঁদে উঠল।ধ্রুবও কাঁদছে।শব্দ নেই। পূর্নতার অশ্রুতে ভিজে যাচ্ছে ধ্রুবর বুকটা।সেই সাথে মুছে যাচ্ছে দুজনের এতদিনের মান-অভিমান,আর দুরুত্বের ঝাপ্সা রাস্তা।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here