#ফাগুন_এলো_বুঝি!
(৩৫)
মিশরার অচেতন দেহটা বিছানায় শুয়ে।দুই পাশে বসে দুজন,আশরাফ আর সায়রা।আশরাফ রীতিমতো মেয়ের হাত মুঠোয় নিয়ে বসে আছেন।মুখে হাসির ছিঁটেফোঁটাও নেই কারো।মেয়েটার গায়ে হাত তুলেছেন,এই কারনে আশরাফের মন কষ্টে সংকীর্ণ হয়ে আছে।ওসব কথা শুনে কিছুতেই রাগ সংবরন করতে পারলেন না তখন।মেহবুব, সেলিনা,ধীর সবার নিকট লজ্জ্বায় মরার অবস্থা।মেরে বসলেন ক্ষোভের বশে।কিন্তু যখন থেকে শুনলেন,পূর্নতা ধ্রুবকে ভালোবাসে,তখন থেকেই মিশরার প্রতি রাগটা উবে গেল।পাশাপাশি ধীরের রুপ দেখে, ভেতরটায় খুশি লাগছে এখন
“দুঃখী মেয়েটা অন্তত ঠিক ছেলের হাতে পরেছে।সুখি হবে!কিন্তু মিশরার?ওর কী হবে?
মিশরা যখন অজ্ঞান হয়ে পরল ধ্রুবই কোলে করে রুমে আনল ওকে।একটু পর ডাক্তার রুকমান এলেন,চেক- আপ করলেন।জানালেন মিশরার শরীর খুব দূর্বল।খাওয়া দাওয়া ঠিকঠাক করাতে।চেক-আপ শেষে চলেও গেলেন।জানালেন,রিপোর্ট কাল আসবে।
ঘরের মধ্যে সবাই রয়েছে।প্রত্যেকের মুখ থমথমে,অন্ধকার।পূর্ণতার সবচে বেশি।মনে মনে নিজেকে দ্বায়ী করছে।আজ ওর জন্যেই হাসিখুশি পরিবারে বিষাদের ছায়া নামল।ধীর, ধ্রুবর মধ্যে শত্রুতা তৈরি হলো।সবার চোখে অপরাধি ও।সব দোষ ওর।ভাবতেই পূর্নতার কান্না উগলে এল।ফুঁপিয়ে কেঁদেও ফেলল সে।
পাশে ধ্রুব দাঁড়িয়ে ছিল।উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
“কাঁদছো কেন মায়াপরি?
পূর্নতা সজল চোখে তাকাল ওর দিকে।
‘আমার জন্যেই যত অশান্তি!আমি না থাকলে এসব কিছুই হতোনা।
মেহবুব এগিয়ে এসে পূর্নতার মাথায় হাত রাখলেন।নরম কন্ঠে বললেন,
‘কে বলল? এখানে তোর কোনও দোষ নেই মা।সব দোষ আমাদের।আমরাই ছেলেটাকে মানুষ করতে পারলাম না।
সেলিনার বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বের হল।ধীরের জন্যে দুশ্চিন্তা হচ্ছে।রেগেমেগে কোথায় গেল ছেলেটা?যতই অন্যায় করুক,শত হলেও তার নাড়ি ছেড়া ধন।বুক পুড়বে না?
মিশরার আঙুল নড়ে উঠল।বন্ধ চোখের পাতা কেঁপে উঠতেই আশরাফ সতর্ক চোখ বোলালেন।মিশরা ধীরসুস্থে চোখ মেলে তাকাল।আশরাফের ঠোঁটে তৎক্ষনাৎ দীর্ঘ হাসি ফুঁটল।
‘মিশুর জ্ঞান ফিরেছে।
কথাটা শুনতেই সবাই দ্রুত এগিয়ে এল বিছানার নিকট।সায়রা অস্থির হয়ে বললেন,
” এখন কেমন লাগছে মিশু?শরীর খারাপ করছে নাতো!
মিশু দুপ্রান্তে মাথা নাড়ল।
‘একটু বসব মা।শুয়ে থাকলে মাথা ঘুরছে।
মিশরার স্বর ভাঙা।সায়রা, আশরাফ দুই পাশ থেকে মেয়েকে ধরে উঠে বসতে সাহায্য করলেন।আশরাফ মিশরার পিঠে বালিশ গুঁজে দিলে মিশরা আধশোয়া হল।সেলিনা কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,
‘হ্যা রে মিশু,তুই ঠিকঠাক খাবার খাসনা? রুকমান ভাই কীসব বলে গেলেন।তোর শরীর দূর্বল, আরো কত কি!কেন রে, আমার বাড়িতে খাবার নেই?নাকি তুই খেলে কম পরে যাবে?
মিশরা ক্ষুদ্র হাসল।পরপর লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,
“ধীর ভাইয়া কী ফেরেনি?
অন্ধকারটা যেন দীর্ঘ হল সকলের চেহারায়।একে -অন্যের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল।মেহবুব ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
পূর্নতা আগেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেছিল আলগোছে।ফিরে এল হাতে খাবারের প্লেট আর গ্লাস ভর্তি জল নিয়ে।
উদ্বেগ নিয়ে বলল,
‘সকাল থেকে কিচ্ছু খাওনি মিশু।এই যে খাবার, আর এই রইল পানি।চটপট খেয়ে নাওতো।
পূর্নতা একে একে সব খাটের পাশে রাখা টেবিলটায় রাখল।মিশরা এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে। মেয়েটার মুখ দেখে কে বলবে,সকাল এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল!দুভাইয়ের এক মেয়ে নিয়ে হাঙ্গামা হল।যার উৎস,কারন দুটোই ও।কী করে নিজেকে সামলায় পূর্নতা?এই ক্ষমতাটুকুন কীভাবে রপ্ত করল ও?
মিশরা দম ফেলে বাবার দিক তাকাল।কাতর কন্ঠে বলল,
‘আমার ওপর খুব রেগে আছো, তাইনা বাবা?
আশরাফ মিশরার যে গালে মেরেছিলেন সেখানে ধরে বললেন,
‘ব্যাথা পেয়েছিলি?
মিশরা বাবার হাত ছুঁয়ে বলল,
” একটুওনা।
মিশরার গাল বেয়ে টুপ করে এক ফোঁটা জল গড়ায়।আশরাফ যত্র মেয়ের মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরলেন।আশ্রয়স্থল পেয়ে মিশরা ডুকরে কেঁদে উঠল।পরপর কান্না বদলাল চিৎকারে। হা-হুতাশ করে বলল,
“আমার ভাগ্যটা কেন এমন হলো বাবা?কেন হলো এমন?
পূর্ণতা, সায়রা নিশব্দে কাঁদছেন।সেলিনার চোখেও জল।
পূর্নতাও পেছন থেকে মিশরা সহ বাবাকে জড়িয়ে ধরল।তিনজন সমস্বরে কাঁদল।ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেও রুম ত্যাগ করল।পরপর সেলিনাও বেরিয়ে গেলেন।ওদের চারজন কে আলাদা ছাড়া উচিত।অনেকক্ষন চলল তাদের অশ্রু ঝড়া দৃশ্য।আশরাফ চিকচিকে জল হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুছলেন।পূর্নতা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সায়রা দিক তাকাল।বিনিময় হলো শুদ্ধ হাসি।আশরাফ
স্ফুর্ত হয়ে বললেন,
” পূর্নতা,খাবারের প্লেট টা দাওতো।আমি আজ মিশরাকে খাইয়ে দেই।
পূর্নতা ব্যাস্ত হাতে বাবার হাতে প্লেট তুলে দেয়।আশরাফ পরোটা ছিড়ে মিশরার মুখের সামনে ধরতেই মিশরা বলল,
‘শুধু আমাকে নয়,পূর্নতাকেও খাইয়ে দাও।
প্রত্যেকে অবাক চোখে মিশরার দিক তাকাল।মিশরা জলমাখা চেহারায় ঠোঁট উলটে বলল,
‘এভাবে দেখার কী আছে?আমি কি আগের মত হিংসুটে আছি?
কথাটা শুনে হেসে ফেললেন সবাই।আশরাফ স্বস্তির,শান্তির শ্বাস নিলেন।সায়রা পূর্নতাকে বললেন,
‘বোস পূর্নতা।তোর বাবা খাইয়ে দিক।
পূর্নতা মাথা নাড়ল,
‘আমি বাবার হাতে খাবনা ছোটমা।
আশরাফ ভ্রু কোঁচকালেন।
“কেন মা?
পূর্নতা আঙুল কঁচলে মিনমিন করে বলল,” আমি ছোট মার হাতে খাব।
সায়রার কপাল টানটান হয়ে এল।খুশিতে চোখ ভরে উঠল পুনরায়।
প্রচন্ড আনন্দে বললেন,
‘তাহলে দেরি করছিস কেন?জলদি আয়।
একটাই প্লেট।মাত্র দুটো পরোটা,আর ডিম পোচ।দুটো মানুষের হাত চলছে সেখানে।আশরাফ খাওয়াচ্ছেন মিশরাকে।আর সায়রা পূর্নতাকে।এতদিনে,দেরিতে হলেও সুখ যেন ফিরে এল। আশরাফের বুক প্রশান্তিতে ভরে যাচ্ছে।এরকম একটা মুহুর্ত সেই শুরু থেকেই তো চেয়েছিলেন।অবশেষে পেলেন তাহলে!
কিন্তু খুশিটা বেশিক্ষন স্থায়ী হয়না।খাওয়ার মাঝেই মিশরা মুখ চেপে ধরে ওয়াশরুমে ছুটল।পূর্নতাও সঙ্গে সঙ্গে পা বাড়াল।
গিয়ে দেখল মিশরা মুখ ভরে বমি করছে বেসিনে।পূর্নতা দরজায় দাঁড়িয়েই বাবা-মায়ের দিক চেয়ে বলল,
‘বমি করছে।
আশরাফ চিন্তিত কন্ঠে বললেন,
‘এতক্ষন না খেয়ে ছিল, তাই বোধ হয়।তাছাড়া গরম ও পরেছে খুব।
কিন্তু সায়রার মুখভঙ্গি বদলাল না।তার মস্তকে হানা দিচ্ছে নতুন এক ভাবনা।
____
ঠিক দুটোদিন পর ধীর পা রাখল বাড়িতে।জ্বলজ্বলে চেহারা তার।এই দুদিনে হাজারটা ফোনকল করা হয়েছে এ বাড়ি থেকে।সেলিনা করেছেন,মিশরা করেছে।কিন্তু ধীর প্রত্যেকবার এড়িয়ে গেল।তারপর পূর্নতা ফোন করল।বলল,
“বাড়ি ফিরে এসো ধীর ভাইয়া।তোমার জন্যে ভালো কিছু অপেক্ষা করছে।
ধীর জিগেস করল,
‘তুই কী আমার কথা মেনে নিয়েছিস?
‘বললাম তো,ভালো কিছু অপেক্ষা করছে।চলে এসো তাড়াতাড়ি।
ধীর খুশিমনে ফিরে এল।এই দুদিন রিসোর্টে কাটিয়েছে।ওইজন্যে সেলিনা কোনও আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে ফোন করে ছেলেকে পাননি।
ধীর পুরো বাড়ি খালি পেল প্রথমে।বেনিকে দেখে শুধাল,
‘বাকিরা কোথায়?
‘আপনার ঘরেই আছে।
ধীরের খটকা লাগল একটু।তবে বাঁধভাঙা আনন্দের কাছে পাত্তা পেলনা তা।দ্রুত উঠল সিড়ি বেয়ে।
রুমে ঢুকতেই বাড়ির সবাইকে দেখে খটকাটা তীব্র হলো।মিশরা পা গুছিয়ে বসে বিছানায়।পাশে বসে পূর্নতা।তার অতি সাধের পূর্না!
ধ্রুব দাঁড়িয়ে রুমের এক কোনায়।বড়রা এক এক করে বসে সোফাতে।এতগুলো মানুষ একযোগে তাকালে ধীর একটু গুলিয়ে গেল কেমন।জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাল।সেলিনা ছেলেকে দেখতেই উদগ্রীব হয়ে এগিয়ে এলেন,
‘ধীর,তুই এসছিস বাবা?ফোন ধরছিলিনা কেন?কত চিন্তা করছিলাম জানিস?
ধীর গম্ভীরমুখে জবাব দিল,
‘আমি ঠিক আছি মা।
সায়রা বললেন,
‘বাবা-মায়েরা রাগ করে কত কিছু বলে ধীর।ওসব কী ধরতে আছে? তুই__
” পুরোনো কথা ছাড়ো ফুপি।সেদিনের কোনও কথা নিয়ে আমি আলোচনা করতে আসিনি।পূর্না ফোন করল বলে এলাম।নাহলে এই বাড়িতে আসার কোনও ইচ্ছেই আমার ছিলনা।
বাবার দিক আড়চোখে চেয়ে বলল ধীর।মেহবুব মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে রেখেছেন।বেয়াদব ছেলের দিক তাকাবেন না।ঐদিনের অসভ্যতা এখনও ভোলেননি তিনি।
ধীর পূর্নতার দিক দৃষ্টি দিল,
“তুই তাহলে ধ্রুবকে ডিভোর্স কবে করছিস পূর্না?আমি কী লইয়ারের সঙ্গে কথা বলব?ডিভোর্সের পরপরই কিন্তু আমাদের বিয়ে হবে।
মিশরার বুকটা দুইভাগ হয়ে গেল কষ্টে।শুকনো মুখ শুকিয়ে গেল আরও।
ধ্রুব চেঁতে উঠল।কিছু বলতে নেবে এর আগেই পূর্নতা ধ্রুবকে বলল,
‘আমি বলি?
ধ্রুব থেমে যায়।নাক-মুখ কুঁচকে দাঁড়িয়ে থাকে।পূর্নতা মৃদূ হেসে ধীরকে বলল,
” আমি ধ্রুবকে কখনোই ডিভোর্স করবনা ধীর ভাইয়া।
তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে।
ধীর ভ্রু গোঁটাল,
“মানে? তুইতো আমাকে__
পূর্ণতা কথা কেড়ে নিয়ে বলল,
” আমি তোমাকে বলেছি,তোমার জন্যে ভালো কিছু অপেক্ষা করছে।একবারও বলিনি সেই ভালো কথাটা আমার আর ধ্রুবর তালাক নিয়ে।
ধীর নাক ফুলিয়ে বলল,
‘তুই কি আমার সঙ্গে ফাজলামো করছিস?তোর ফোন পেয়ে আমি এখানে এসছি। আর এখন বলছিস অন্য কথা?
“আমি তো তোমাকে এখনও কিছুই বলিনি ধীর ভাইয়া।কত কিছু শোনার বাকি আছে তোমার।
পূর্নতার কন্ঠ খুব কোমল।
সে বালিশের নিচ থেকে রিপোর্টের খাম বের করে, ধীরের কাছে গেল।ওর সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘খুলে দেখো।
‘কী এটা?
‘তুমি যাওয়ার পর মিশরা অজ্ঞান হয়ে গেছিল।ডাক্তার দেখে গেছেন ওকে।এটা ওর রিপোর্ট।
‘ওর রিপোর্ট আমি দেখে কী করব?গোল্লায় যাক ও।
ধীরের কন্ঠে প্রচন্ড অনিহা।মিশরা কান্না আটকাতে মাথা নামিয়ে ঢোক গিলল।পূর্নতা তখনও শান্ত ভাবে বলল,
“খুলেই দেখোনা।সব প্রশ্নের উত্তর এখানে আছে।
তোমার দেখা সবচেয়ে জরুরি।
পূর্নতার কথার ধরনে ধীরের কৌতুহল হলো।চুপচাপ রিপোর্ট হাতে নিল সে।খাম খোলাই ছিল।ভেতরের কাগজটা বের করে চোখের সামনে মেলে ধরল ধীর।সবার প্রথমে চোখ আটকাল গোটা গোটা অক্ষরে প্রেগন্যান্সি রিপোর্ট লেখাটার দিকে।ধীরের কপালে ভাঁজ পরল।
পরপর খেয়াল পরল,পেশেন্টের জায়গায় মিশরার নাম।রিপোর্ট পজিটিভ।ধীরের মাথায় বিরাট আকাশ আছড়ে পরল যেন।হতবিহ্বল সে।হাত দুটো কেমন থরথর করে কেঁপে উঠল।ঝুপ করে রিপোর্টের কাগজগুলো পরে গেল নিচে।
তড়িৎ গতিতে মিশরার দিক তাকাল।মিশরা কেমন অদ্ভূত চোখে তার দিকেই চেয়ে।ঐ দৃষ্টি আজ বুঝে উঠলনা ধীর।তার মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।উপস্থিত সবাই পর্যবেক্ষন করছে ধীরের অভিব্যক্তি। এবার কী ছেলেটা বদলাবে?
পূর্নতা বলে ওঠে,
” মিশরা মা হচ্ছে ধীর ভাইয়া।তোমার সন্তানের মা।
ধীর কতক্ষন কথাই বলতে পারলনা।যখন ধাতস্থ হলো তখন প্রতিবাদ জানাল,
“এ মিথ্যে।অসম্ভব।এটাও ওর নাটক।ও নিশ্চয়ই আবার নতুন কোনও ফঁন্দি আঁটছে।
মেহবুব বিরক্তিতে দাঁত খিচে ধরলেন।নিজেকে সর্বচ্চ সামলাতে চেষ্টা চালাচ্ছেন।আবার গিয়ে বেয়াদবটাকে চড় না মেরে বসে!
মিশরা কথাটা শুনে চোখ খিচে বুজে ফের খুলল।ধীরের চোখে কতটা নিচু সে!যে মা হওয়া নিয়েও নাটক করবে ভাবছে ধীর!
ধীর আবার বলল,
‘এই মেয়েকে আমি আর বিশ্বাস করিনা।যে নিজের মান সন্মান নিয়ে মিথ্যে বলে সে আর কি কি পারে হু নোস!আর তোমরাও বা কীভাবে মেনে নিলে ওর কথা?
” কেন মানবনা ভাইয়া,এখানে মিথ্যে বলার মত কিছুতো নেই।
“আছে।অবশ্যই আছে। ও যেই দেখেছে আমি তোকে বিয়ে করতে চাইছি ওমনি বাচ্চা হওয়ার বুদ্ধি বার করেছে।এই মেয়ের শিরায় শিরায় শয়তানি!ডাইনি একটা!
আশরাফ গর্জে উঠলেন,
” ধীর!মুখ সামলে কথা বলো।
“স্যরি আঙ্কেল!আপনার মেয়ের জন্যে আমার মুখ থেকে এর বাইরে আর কোনও শব্দই বের হবেনা।আপনার শুনতে ভালো না লাগলে কানে তুলো দিন।
মেহবুব কড়া কন্ঠে সেলিনাকে বললেন,
‘তোমার ছেলেকে সংযত হতে বলো শেলী।কার সঙ্গে কী ব্যবহার করছে ও?
পূর্নতা মোলায়েম কন্ঠে বলল,
‘মিশরা মিথ্যে বলছেনা ভাইয়া।ও সত্যিই অন্তঃসত্তা।তোমাদের ফ্যামিলি ডাক্তার রুকমান নিজে রিপোর্ট পাঠিয়েছেন কাল।
ধীর এবারেও জোর গলায় বলল,
‘তাহলে নিশ্চয়ই ওনাকে টাকা খাইয়েছে মিশরা।
ধ্রুব বিরক্তিতে ‘চ ‘বর্গীয় শব্দ করল।ইচ্ছে করছে এক্ষুনি বেরিয়ে যেতে।ধীরের এই অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি সহ্য হচ্ছেনা তার।কিন্তু বড়রা রয়েছে বলে পারলনা।চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল।
কথা বললেন সায়রা এবার,
‘ধীর!তুই একটু ঠান্ডা মাথায় ভাব বাবা।মিশরা বাচ্চা নিয়ে কেন মিথ্যে বলবে?আর কখনই বা করবে ওসব?ওতো পরশু থেকেই অসুস্থ।তাছাড়া আমার মেয়েটা আগের মত নেই।ও বদলে গিয়েছে।
ধীর হেসে ফেলল।বিদ্রুপের হাসি।ভ্রু নাঁচিয়ে বলল,
‘বদলে গেছে?তাই নাকি!কুকুরের লেজ টানলে সোজা হয় শুনেছ কখনও?
মেহবুব চটে কিছু বলতে চাইলেন,এর আগেই মিশরা শীতল স্বরে বলল,
” তোমরা একটু বাইরে যাবে? আমার ধীর ভাইয়ার সাথে কথা ছিল।
ধীর সঙ্গে সঙ্গে বলল,
‘আমি তোর কোনও কথা শুনতে চাইনা।
“শুনতে তো তোমাকে হবেই ধীর ভাইয়া।কারন,আমি এখন যা যা বলব সেসব সবার সামনে শুনতে ভালো লাগবেনা তোমার।বিশেষ করে পূর্নতার সামনে তো নয়ই।
একে একে সবাই রুম ত্যাগ করল।ধীরের বিরক্তিতে ভ্রুয়ের মাঝে ফুঁটে আছে গাঢ় ভাঁজ।মিশরা উঠে এসে দরজা লাগাল প্রথমে।এরপর পূর্ন দৃষ্টিতে তাকাল ধীরের দিকে,
” এতক্ষন কী বলছিলে ধীর ভাইয়া, আমি মা হতে পারিনা।আমি মিথ্যে বলছি,এ অসম্ভব!
তা কেন অসম্ভব? তুমি কী আমাকে ছোঁওনি?নাকি ফিল্মের হিরোদের মত আলাদা শুয়েছিলে?বরং প্রত্যেকটা রাত আমার শরীরটাকে আঁচড়ে,কামড়ে শেষ করে দিয়েছ।একটা দিন রেহাই পাইনি আমি।হোক সেসব তোমার রাগ,বা তোমার ক্ষোভ।ছুঁয়েতো ছিলে।
ধীর অন্যদিক চেয়ে কটমট করছে।মিশরা ভেজা গলায় বলল,
‘আমি কিন্তু নিজেও জানতাম না আমার গর্ভে সন্তান এসছে।শরীর খারাপ ছিল,কিন্তু এটা মাথাতেও আসেনি।বাড়ির সবার সাথে জেনেছি।
প্রথমে খুব খুশি হয়েছিলাম জানো।প্রথম বার মা হওয়ার অনুভূতি প্রকাশ করা যায়না।সত্যিই না।
কিন্তু তারপরপরই একটা ভয় আমাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে চেপে ধরল।রীতিমতো চিন্তা হতে লাগল আমার সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে।জন্মের পর কী দেখবে ও?ওর বাবা ওর মাকে ছেড়ে অন্য এক মেয়েকে নিয়ে টানাটানি,মারামারি করছে?তাও তারই ছোট ভাইয়ের সঙ্গে!
ধীর চকিতে তাকাল।মিশরা ফের বলল,
আমার সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েই জানবে,ওর বাবা একটা চরিত্রহীন!
ধীর ধমকে উঠল,
“মিশরা!
” ভুল কী বলেছি আমি?তুমি প্রতিটা রাত সমানে আমাকে ভোগ করেছ,এদিকে পূর্নতাকেও তোমার চাই।তাহলে কী তুমি চরিত্রহীন হলেনা ধীর ভাইয়া?
“চরিত্রহীন” শব্দটা যেন সন্মানে গিয়ে আঘাত করল ধীরের।পুরুষত্বের ভীতটা হাওয়ায় টলে উঠল।
মিশরা ব্যাকুল কন্ঠে বলল,
“সেদিনের করা একটা অন্যায় দিয়ে আর আমাকে পরিমাপ কোরোনা ধীর ভাইয়া।এই আমিটা আর আগের আমি নেই।এই আমি এখন তোমার সাথে সংসার করার স্বপ্ন বুনি,এই আমিটা এখন তোমায় ভালোবাসি।তোমার ভালোবাসা চাই।তোমার বুকে মাথা রেখে প্রত্যেকটা রজনী কাটাতে চাই।তোমার হিংস্র স্পর্শে নয়,হারাতে চাই তোমার মিষ্টি সোহাগে।
আমি তোমার সন্তানের মা হচ্ছি ধীর ভাইয়া।এখনও কী আমায় দূরে সরিয়ে রাখবে?
যে মানুষটা তোমাকে নয়,অন্য কাউকে ভালোবাসে তাকে জোর করে কেড়ে আনার থেকে,যে মানুষটা তোমায় নিয়ে বাঁচতে চায় তাকে আকড়ে ধরা কী অনেক সহজ নয়?আমিতো চাইছি তোমাকে নিয়ে থাকতে,তোমার সঙ্গে বাঁচতে।এরপরেও আমায় ফিরিয়ে দেবে?
ধীরের শক্ত চোখমুখ শিথিল হল।গভীর দৃষ্টি বোলাল মিশরার ক্রন্দিত চেহারায়।কিছু একটা ভাবল।তারপর ঘুরে গিয়ে দরজার ছিটকিনি টেনে নামাল।মিশরা হতাশ হলো।এত করে বোঝানোর পরেও ধীর বুঝলনা তাকে!
তখনি হাতে ধীরের স্পর্শ পেল।ধীর হাত ধরেছে তার।সে ছোঁয়া না কোমল,না শক্ত।ধীর তাকেও সাথে করে নিয়ে চলল।মিশরার মনে তখন প্রশ্ন,অনেক অনেক প্রশ্ন।ধীর সোজা সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল।প্রত্যেকে বসেছিলেন চিন্তিত ভঙিতে।ওদের দুজনকে দেখেই তৎপর উঠে দাঁড়ালেন।কী সংবাদ দেবে ধীর?
ধীর থামল।সাথে মিশরাও থেমে যায়।ধীর একদম মেহবুবের দিক চেয়ে বলল,
‘আমার এক বন্ধু গাইনোকোলজিস্ট।কাল মিশরাকে নিয়ে আমি ওর কাছে যাব।তারপর আবার চেক- আপ হবে ওর।
সেলিনা শুধালেন,
“কেন?
ধীর ভনিতা ছাড়াই জবাব দেয়,
‘আমি যাচাই করতে চাই,ওই রিপোর্ট সত্যি না মিথ্যে।কারন রিপোর্ট তো আমাদের ফ্যামিলি ডক্টর দিয়েছেন তাইনা!এমনও হতে পারে,তোমরা সবাই এর সাথে জড়িত।তোমরাই ওনাকে বলে মিথ্যে রিপোর্ট বানিয়েছ।
সকলে স্তব্ধ,বিস্মিত।মেহবুব রাগে ফুঁসে উঠলেন,
‘এখন কী প্রমানের ঝুড়ি খুলে বসতে হবে? নিজের বাবা মাকেও সন্দেহ করছো তুমি?
ধীর সোজাসাপটা বলল,
” করছি।সন্দেহ এমন একটা জিনিস,যার তালিকা যত বাড়ে তত ভালো।
তুই তৈরি থাকবি মিশরা।কালই আমি ওর হাসপাতালে নিয়ে যাব তোকে।
মিশরার ভাঙা হৃদয় আর নতুন করে কী ভাঙবে?অতি কষ্টে হাসি পেল তার।বিশ্বাস হারাতে হারাতে এতটা হারাল,যে “রাখালের বাঘ আসার” মতন কপাল হলো আজ।
ছোট করে বলল ‘ তাই হবে।
ধীর প্রত্যেকের দিক চোখ বুলিয়ে হুশিয়ারি দিল,
‘আর হ্যা,একটা কথা সবাইকে বলছি,এই রিপোর্টের সঙ্গে যদি কালকের রিপোর্ট না মেলে তবে আমার থেকে খারাপ কেউ হবেনা।
ধীর ঘরের দিক যেতে পা বাড়াল।পেছন থেকে তখন পূর্নতা বলল
‘আর যদি মিলে যায়?কী করবে,সেটাও বলে যাও ধীর ভাইয়া!
ধীর ঘুরে তাকাল।
চলবে,