#শ্রাবন_আধারে_তুমি_২,১৫,১৬
#লেখিকা_আফরিন_ইসলাম
#পার্ট_১৫
দুই দিন পার হয়ে গেছে ৷ সময়ের সাথে মানুষের জীবনের পরিবর্তন হবে এটাই স্বাভাবিক ৷ সৃষ্টিকর্তা কখন কাকে কোন অবস্থায় নিক্ষেপ করে তা কেউ বলতে পারে না ৷ প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে ৷ রাস্তায় লোকজন একেবারে নেই ৷ রাই এখন ঐ কফিশপেই কাজ করে ৷ কাস্টমারের কাছ থেকে খাবারের অর্ডার নেওয়াই তার কাজ ৷কফিশপের মালিক রাইকে একটা বাসায় থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে ৷ সেখানে আরো দুইজন মেয়ে থাকে ৷ তাদের সাথেই রুম শেয়ার করে থাকতে হবে ৷দুই দিনে বেশ অনেকটা নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে রাই ৷ বুকের ভেতরটা আজকাল বড্ড শক্ত মনে হয় রাইয়ের কাছে ৷ কামার যেমন লোহাকে আগাত করে শক্ত একটা রূপ দেয় ৷ রাই নিজেও আজকাল তেমন হয়ে গেছে ৷ নিষ্ঠুর দুনিয়ার মানুষ তার নরম হৃদয়টাকে শক্ত করে তুলেছে ৷ কেন যেন আজকাল চাইলেই হাসতে পারে না রাই ৷ হাসিটা যেন হৃদয়ে জমে থাকা কষ্টের নিচে চাপা পরে গেছে ৷ তবে কফিশপের মালিক রাইয়ের ঐ অবস্থা কেন হয়েছিল তা জিজ্ঞাসা করে নি ৷যদিও রাই নিজেও অবাক হয়ে ছিল ৷ রাই বাইরে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখছে ৷ আজকাল এই বৃষ্টি রাইয়ের ভালো লাগে না ৷ অনেক বেশি বিরক্ত লাগে ৷রাই নিজের জামার পকেট থেকে মোবাইল বের করলো ৷ মোবাইলের লক খুলতেই আবরার হাসিমাখা মুখের একটা ছবি ভেসে উঠলো ৷ রাই সেই দিকে তাকিয়ে রইলো পলকহীন ভাবে ৷ছবিটাতে হাত বুলাতে বুলাতে রাই বলল ,
“চাইলেই কি সব ভুলে যাওয়া যায় আবরার ৷ আপনি কত সহজে সব ভুলে গেলেন ৷ কিন্তু আমি আপনাকে ভুলতে পারছি না ৷ এই কয়েক দিনে এক সেকেন্ডের জন্য আপনাকে ভুলতে পারি নি ৷জানেন আবরার আপনার আর আমার সম্পর্কে কোনো দোষ নেই ৷ শুধু মানুষের কালো নজর পড়েছে আমাদের উপর ৷ সবাই বলতো আপনার সাথে নাকি আমাকে মানায় না ৷ আপনার মতো এত সুন্দর মানুষের সাথে আমার নাকি যায় না ৷ আচ্ছা আবরার সবাই কি পারফেক্ট হয় ৷ দুনিয়ার সব কিছু কি পারফেক্ট হয় ৷ আমি তো আজ পর্যন্ত কোনো কিছু পারফেক্ট পাই নি ৷সব জিনিসে খাদ আছে ৷ কিন্তু মানুষ সেই খাদ খোঁজে না ৷ মানুষ সত্য মিথ্যার পার্থক্য করতে জানে না ৷ মানুষ অসহায়ের চোখের ভাষা বোঝে না ৷ মানুষ বুকের ভেতরের ক্ষত দেখে না ৷ সবাই শুধু সাদা কালোর পার্থক্য করতে ব্যস্ত ৷জানেন আবরার জীবনে পারফেক্ট কাউকে খোঁজাও ভুল ৷ আপনাকে ভালোবাসার একটা বিশাল কারন কি জানেন ৷ আপনি আপনার পাশে একদম পারফেক্ট কাউকে চান নি ৷কিন্তু মজার ব্যাপার কি জানেন ? আমি আমার পাশে পারফেক্ট কাউকে চেয়ে ছিলাম ৷ যাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায় ৷ যাকে দেখে ধর্ষক মনে হবে না ৷ যার মধ্যে প্রতারক লুকিয়ে থাকবে না ৷ যার মধ্যে কোনো হিংস্র সত্তা থাকবে না ৷ আমি কুৎসিত হলেও সেই পারফেক্ট মানুষটাকে পেলাম ৷ আবার হারিয়েও ফেললাম ৷ এত সহজে মানুষ কেন হারিয়ে যায় আবরার ৷ আমি যে হারাতে চাই না ৷ আমি শুধু চাইবো আপনি অনেক ভালো থাকুন ৷ আমার মতো কখনো যেন আপনাকে হারাতে না হয় ৷ আমি সেটা সহ্য করতে পারবো না আবরার ৷”
রাই ফোনটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরলো ৷ তারপর তাকিয়ে রইলো অকালে আসা ঝুম বৃষ্টির দিকে ৷ যারা আবরার আর রাইয়ের মিষ্টি প্রনয়ের স্বাক্ষী ৷ যারা তাদের প্রনয় খন্ডনের স্বাক্ষী ৷
অপরদিকে রায়হান একটা ঔষুধের দোকানের সামনে দাড়িয়ে আছে ৷ দোকানে অনেক ভিড় ৷ ভিড় কমে যেতেই রাইয়ের ভাই দোকানে প্রবেশ করে ৷ দোকানের কর্মচারী রায়হানকে বলল,
“আপনার কি লাগবে ?”
রায়হান নিজের পকেট থেকে একটা কাগজ বের করলো ৷ তারপর কর্মচারীকে কাগজটা দিয়ে বলল,
“এটা কি আপনাদের দোকানের বিল পেমেন্টের কাগজ ?”
দোকানদার কাগজটা দেখে বলল,
“হ্যা এটা আমাদের দোকানের ৷ আমরা কাস্টমারকে এই কাগজ দেই ৷ যেই কাগজে ঔষুধের নাম ,তারিখ আর টাকার পরিমান লেখা থাকে ৷ ঔষুধের দাম বিষয়ক নানা কারনে কাস্টমারের সাথে ঝামেলা হয় ৷ তাই আমরা এই কাগজ দেই ৷ ”
“আচ্ছা আপনাদের দোকানে তো সিসি ক্যামেরা আছে ৷ কয়েক দিন আগে এই দোকান থেকেই কাগজে লেখা ঔষুধটা একজন নিয়ে ছিল ৷ আপনি যদি কষ্ট করে বলতে কে এই ঔষুধটা নিয়ে ছিল ৷ তাহলে খুব ভালো হয় ৷”
“সরি ভাইয়া ৷ আমরা অচেনা কাউকে সিসি ক্যামেরা ফুটেজ দেখাই না ৷ আপনাকে দেখতে হলে পুলিশের সহায়তা নিতে হবে ৷ আমি কিছু করতে পারবো না ভাইয়া ৷”
রাইয়ের ভাই কর্মচারী ছেলেটাকে আর কিছু বলবে ঠিক তখনই তার ফোন বেজে উঠলো ৷রাইয়ের ভাই বেশ বিরক্ত হলো ৷ফোনটা পকেট থেকে বের করতেই দেখলো তার স্ত্রী কল করেছে ৷ রায়হান নিজেকে স্বাভাবিক করলো ৷ তারপর ফোন রিসিভ করে কিছু বলতে যাবে ৷ এর আগেই ওপাশ থেকে তার স্ত্রী চিৎকার করে বলল ,
“রায়হান তুমি তাড়াতাড়ি বাসায় আসো ৷ আমাদের রাফী আর নেই রায়হান ৷ আমাদের রাফী কথা বলছে না ৷ আমাদের ছেলেটা মনে হয় শেষ হয়ে গেছে রায়হান ৷তুমি তাড়াতাড়ি আসো ৷ আমার কলিজা কথা বলে না ৷ আমার পাপ আমাদের ছেলেটার উপর এসে পড়েছে ৷ ওকে বাচাঁতে হবে রায়হান ৷ রাফীকে ছাড়া আমি বাচঁবো না ৷ যার জন্য এত কিছু করলাম সে যদি না থাকে ৷ তাহলে আমি কি নিয়ে বাচঁবো ৷”
স্ত্রীর কান্নার মধ্য দিয়ে এমন অদ্ভুত কথা শুনে রায়হান ব্যস্ত কন্ঠে বলল ,
“কি হয়েছে আমাদের রাফীর ? বলো আমাকে কি হয়েছে ? আর তুমি কি সব বলছো ?আমি কিছু বুঝতে পারছি না ৷”
ওপাশ থেকে বলল,
“আমি আর মা রান্নাঘরে ছিলাম ৷ রাফী ঘরে খেলা করছিল ৷ আমি কাজ শেষ করে ঘরে আসি ৷ রাফীকে ঘরে না পেয়ে আমি ওকে ডাকতে থাকি ৷ কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আমি ওয়াসরুমে যাই ৷ আর সেখানে গিয়ে দেখি আমাদের রাফী মেঝেতে পরে আছে রক্তাক্ত অবস্থায় ৷ মাথার নিচে রক্তে লাল হয়ে গেছে ৷”
রায়হানের যেন পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছে ৷ আল্লাহ বলে একটা চিৎকার দেয় রায়হান ৷ তারপর দৌড়ে চলে যায় গাড়ীর কাছে ৷
বৃষ্টি থেমেছে কিছুক্ষন আগে ৷ রাই এখন কাস্টমারদের অর্ডার নিচ্ছে ৷দোকানে বেশ কয়েকজন কাস্টমার এসেছে ৷ রাই তাদের অর্ডার নিতে টেবিলের কাছে গেল ৷ সর্বশেষ শেষের টেবিলে গেল অর্ডার নিতে ৷ একজন লোক মাথা নিচু করে বসে আছে ৷ রাই নরম গলায় তাকে বলল,
“স্যার আপনার অর্ডারটা যদি একটু বলতেন ৷ তাহলে খুব ভালো হতো ৷”
লোকটা রাইয়ের দিকে মাথা তুলে তাকাতেই রাই অবাক হয়ে বলল,
“আপনি এখানে ?”
লোকটা রাইকে দেখে হালকা হেসে বলল,
“আরে আপনি এখানে ৷ সেই দিন রাস্তায় যেই ঝগড়া করলেন বাবাগো ৷ তা আমাকে দেখে এত অবাক হলেন কেন ? আমার এখানে আসতে মানা আছে নাকি ৷”
রাই নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
“আপনার অর্ডারটা বলুন ৷এত বকবক করতে পারবো না ৷ ঝগড়া করার মুড নেই ৷”
লোকটা আস্তে করে বলল,
” আপনি একটা কোল্ড কফি দিন আমাকে ৷ আর কিছু লাগবে না ৷”
রাই অর্ডারটা নিয়ে চলে গেল ৷ লোকটার প্রতি প্রথম দিন থেকেই বিরক্ত রাই ৷কফিশপে ওয়েটারের সংখ্যা কম ৷ তাই রাই নিজেই অচেনা লোকটার জন্য কফি নিয়ে এলো ৷ লোকটা কি যেন ভাবছে ৷ রাইয়ের কেন যেন মনে হলো লোকটা গভীর মনযোগ দিয়ে কিছু চিন্তা করেই যাচ্ছে ৷ কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করছে না ৷ কেমন অন্য মনষ্ক হয়ে বসে আছে ৷ লোকটার মুখের হাসিটাও কেমন যেন লোক দেখানো ৷রাই অচেনা লোকটার কাছে গেল ৷ তারপর কফিটা টেবিলে রেখে দিল ৷ তবুও লোকটার হুশ নেই ৷ একমনে সে ভেবেই যাচ্ছে ৷ রাই টেবিলের উপর আস্তে করে টোকা মেরে বলল ,
“আপনার কফি ৷”
অচেনা লোকটার ধ্যান ভাঙ্গলো রাইয়ের কথায় ৷ রাইয়ের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলল,
“ও আচ্ছা ধন্যবাদ ৷আপনি যে কফি দিয়েছেন খেয়াল করাই হয় নি ৷ ”
রাই মুচকি হেসে চলে গেল ৷লোকটার মুখে পাশে লেগে থাকা হাসিটা কেমন যেন হৃদয়ের স্নিগ্ধ হাসি লাগলো না রাইয়ের কাছে ৷ হাজার কষ্টের মাঝে মানুষ যেভাবে হাসে ৷ ঠিক ঐ রকম মনে হলো ৷
অপর দিকে আবরার আর সাদি বসে আছে ৷ আবরার আজ দুই দিন ভার্সিটিতে ক্লাস নেয় না ৷ সে আর ঐ ভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে থাকবে না ৷সাদি আবরার ঘাড়ে হাত রেখে বলল,
“বন্ধু হুট করে সিদ্ধান্ত নিতে নেই ৷ রাইয়ের সাথে আলাদা করে কথা বল ৷ আংকেল আর আন্টি তোর জন্য মেয়ে দেখা শুরু করেছে ৷ এত দ্রুত কিছু করিস না ৷ আমার মনে হয় আরেকটু সময় নেওয়া দরকার ৷”
আবরার থমথমে গলায় বলল,
“তুই এখনো রাইয়ের হয়ে কথা বলছিস ৷ একের পর এক অন্যায় করেছে সে ৷সবাইকে ঠকিয়ে গেছে ৷ এখন মা বাবা যা করবে আমি তাতেই খুশি ৷সন্তান হিসেবে আর তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেতে চাই না ৷ ”
চলবে
#শ্রাবন_আধারে_তুমি_২
#লেখিকা_আফরিন_ইসলাম
#পার্ট_১৬
মানুষ নাকি পাপ করলে তার শাস্তি দুনিয়াতে কিছুটা হলেও ভোগ করে ৷ তবে মজার ব্যাপার হলো মানুষ তা সহজে বুঝতে পারে না ৷ একটা অন্যায় কাজ খুব সহজে করা যায় ৷ কিন্তু সেই কাজের ভয়াবহ কর্মফল আস্তে আস্তে মানুষ ভোগ করে ৷ যার যন্ত্রনা মানুষ না সহ্য করতে পারে ৷ আর না কাউকে বলতে পারে ৷
রায়হানের ছেলেকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে ৷ মাথার পেছনে আঘাত পেয়েছে ৷ ওয়াসরুমে পা পিছলে পরে এই অবস্থা হয়েছে ৷ ছোট রাফীর শরীর থেকে অনেক রক্ত বের হয়ে গেছে ৷ ডাক্তার রাফীর চিকিৎসা করছে ৷ রাফীর জন্য জরুরী ভিত্তিতে রক্তের ব্যবস্থা করতে বলেছে ডাক্তার ৷কিন্তু রায়হান অনেক খুজেও O নেগেটিভ রক্ত এক ব্যাগের বেশি যোগার করতে পারে নি ৷ সাদিকে খবর দেওয়া হয়েছে রক্তের জন্য ৷ কারন তার রক্ত O নেগেটিভ ৷ কিন্তু রাস্তায় ট্রাফিকের জন্য সে আটকে গেছে ৷রাফীর অবস্থা ভালো না ৷ মাথার পেছনে বেশ গাঢ় আঘাত লেগেছে তার ৷ ছেলের জন্য কাদঁতে কাদঁতে রাইয়ের ভাবি অসুস্থ হয়ে গেছে ৷একমাত্র ছেলের কিছু হলে কিভাবে থাকবে সে ৷
অন্যদিকে রাই কফিশপের টেবিল গুলো পরিষ্কার করছিল ৷ ঠিক তখনই তার ফোন বেজে ওঠে ৷ হঠাৎ ফোন বেজে উঠতেই কেঁপে ওঠে রাই ৷ কারন অনেক দিন তার খোঁজ কেউ নেয় না ৷ রাই টেবিল মোছার কাপড়টা রাখলো ৷ তারপর পকেট থেকে ফোন বের করেই কিছুটা অবাক হলো ৷ ফোনে সাদি ভাই নামটা উঠে আছে ৷ রাই ফোনটা রিসিভ করে বলল,
“সাদি ভাই আসসালামু আলাইকুম ৷ কেমন আছেন আপনি ?”
ওপাশ থেকে সাদি বলল,
“ওয়াআলাইকুম আসসালাম রাই ৷ আমি ভালো আছি ৷তুমি ঠিক আছো তো ৷”
“জ্বি সাদি ভাই ৷ আমি একদম ঠিক আছি ৷ হঠাৎ কল করলেন যে ৷”
“রাই অনেক বড় সমস্যা হয়ে গেছে ৷ রাফী ওয়াসরুমে পা পিছলে পরে গেছে ৷ মাথার পেছনে অনেক আঘাত পেয়েছে ৷ ওকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে ৷ কিন্তু রাফী মনে হয় বাচঁবে না ৷ O নেগেটিভ রক্ত ব্যবস্থা করতে পারে নি তোমার ভাই ৷ আমার রক্ত O নেগেটিভ ৷ আজ দুইদিন আমি রক্ত দিয়েছি ৷ ডাক্তার হয়তো আমার শরীর থেকে রক্ত নেবে না ৷ তার মধ্যে আমি ট্রাফিকে আটকে আছি ৷ কি করবো বুঝতে পারছি না ৷ সময় মতো রক্ত দিতে না পারলে রাফীকে বাচাঁনো যাবে না ৷”
রাইয়ের চোখ ভরে এলো ৷ রাফীকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে নিজের হাতে ৷সারাদিন গলা জরিয়ে থাকতো ছোট ছেলেটা ৷ কত রাত বাচ্চাটাকে বুকে নিয়ে পার করে দিয়েছে রাই ৷বুকের ভেতরটা কেমন খাঁ খাঁ করে উঠলো রাইয়ের ৷ রাই কাঁপা স্বরে বলল,
“আমাকে হাসপাতালের নাম বলুন সাদি ভাই ৷আমার ছোট রাফীর ফুপি এখনো মরে যায় নি ৷ এখনো বেচেঁ আছি আমি ৷ আমি ওকে রক্ত দেব ৷ তাড়াতাড়ি হাসপাতালে ঠিকানা বলুন ৷”
সাদি কৃতজ্ঞতার সুরে বলল,
“আমি জানতাম তুমি কখনো কঠোর হবে না ৷ এই উত্তরটা শুনতে তোমাকে কল করেছি ৷ আমি হাসপাতালে ঠিকানা তোমার ফোনে মেসেজ করে পাঠিয়ে দিয়েছি৷ তুমি তাড়াতাড়ি যাও ৷ ”
রাই ওকে বলে ফোন কেটে দিল ৷ তারপর মেসেজ চেক করতে লাগলো ৷ সাদির নাম্বার থেকে আসা ঠিকানা সুন্দর করে পড়ে নিল রাই ৷ তারপর এক দৌড়ে চলে গেল কফিশপের মালিকের কাছে ৷রাইকে দৌড়ে আসতে দেখে মালিক বলল ,
“কি হয়েছে রাই ৷ এভাবে দৌড়ে এসেছো কেন ?”
রাই দুঃখ ভরা কন্ঠে বলল,
“কাকা আমাকে দুইশ টাকা দিবেন ৷ আমার ভাইয়ের ছেলে এক্সিডেন্ট করেছে ৷ সেখানে আমার যেতে হবে ৷ আমার কাছে টাকা নেই ৷ আপনি আমার বেতনের টাকা থেকে দুইশ টাকা দিন ৷ ছেলেটাকে রক্ত দিতে হবে ৷ নইলে বাচঁবে না ৷ আমি রক্ত দিয়েই আবার চলে আসবো ৷ দরকার হলে বাড়তি কাজ করে দেব ৷ কিন্তু আমাকে প্লিজ একটু যেতে দিন ৷”
রাইয়ের এমন আচরনে কফিশপের মালিক অনেক অবাক হলো ৷ কারন সে রাইয়ের কথায় যতটুকু বুঝেছে তার পরিবার তাকে ত্যাগ করেছে ৷ রাইয়ের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই ৷ কিন্তু রাই তাদের কাছে যাওয়ার জন্যই হাত জোর করে কিছু টাকা চাইছে ৷ মালিকের কঠোর হৃদয় কেন যেন মলিন হয়ে যায় রাইয়ের চোখে পানি দেখলে ৷ কেন যেন কিছু বলতে পারে না শক্ত গলায় ৷ মালিক টাকার বান্ডিল থেকে একশ টাকার দুইটা নোট রাইয়ের হাতে দিয়ে বললেন ,
“তাড়াতাড়ি ফিরে এসো ৷ বেশি দেরি করো না ৷ ”
রাইয়ের মুখে কৃতজ্ঞতার হাসি ফুটে উঠলো ৷ সে টাকা নিয়ে একটা দৌড় দিল ৷ কিছু দূর যেয়ে রাই পিছনে ফিরে তাকালো ৷ তারপর মালিকের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনার এই ঋন কখনো ভুলবো না আমি ৷”
তারপর রাই দৌড়ে চলে গেল শপের বাইরে ৷অপর দিকে রাফীর অবস্থা ভালো না ৷ একঘন্টার মধ্যে যেভাবে হোক রক্ত দিতেই হবে ৷ সাদির গাড়ী অনেক বড় ট্রাফিকে আটকে গেছে ৷ চাইলেও সে যেতে পারছে না ৷ অন্যদিকে রাই খুব কষ্টে একটা রিকশায় উঠে পড়লো ৷ কিন্তু কিছুদূর গিয়ে সেটাও থেমে গেল ৷ কারন সামনে বিশাল ট্রাফিক ৷ রাস্তার মোড়ে নাকি বাইক এক্সিডেন্ট হয়েছে ৷ তাই গাড়ী গুলো যেতে পারছে না ৷সেখানে অনেক ঝামেলা হচ্ছে ৷ রাই রিকশা থেকে নেমে গেল ৷ রিকশাওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে রাই রোদের মধ্যে দৌড়াতে লাগলো খুব জোড়ে ৷ রাই ভুলে গেল তার ক্ষত বিক্ষত পায়ের কথা ৷ রাই ভুলে গেল তার ঘা না শুকানো হৃদয়ের কথা ৷ রাই ভুলে গেল প্রিয়জনদের দেওয়া আঘাতের কথা ৷ রাই ছুটে চললো সন্তান তুল্য ছোট বাচ্চাটার জন্য ৷ যার ছোট হৃদয়ে কোনো পাপ নেই ৷ যে জানে না এই সমাজের জটিলতার কথা ৷
রাই দশ মিনিট দৌড়ে ট্রাফিক পার করলো ৷ তারপর আরেকটা রিকশায় উঠে পড়লো ৷ হাসপাতালে পৌছাতে আরো পনেরো মিনিট রাইয়ে লেগে গেল ৷ রাই হাসপাতালে পৌছে সাদির নাম্বারে কল করলো ৷ তারপর সাদির দেওয়া তথ্য মতো রাই তিন তলায় উঠে গেল ৷ রাই একজন নার্সের সহায়তায় তিনশত দুই নাম্বার রুমের কাছে আসতেই থমকে গেল ৷ তার সামনেই দাড়িয়ে আছে অতি পরিচিত মানুষ গুলো ৷ যারা বিনা দোষে তাকে ত্যাগ করেছে ৷ রাইয়ের পরিবারের সবাই অবাক চোখে রাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে ৷ তারা যেন রাইকে আশা করে নি এখানে ৷ রাই দৌড়ে ওর ভাইয়ের কাছে গিয়ে বলল ,
“রাফী নাকি অসুস্থ ৷ ওর নাকি রক্ত লাগবে ৷ আপনি নাকি রক্ত খুজে পান নি ৷ আমি ওকে রক্ত দেব ৷ ডাক্তারকে ডাক দিন দয়া করে ৷ বলুন রক্ত দিতে লোক এসেছে ৷ ”
রাইয়ের কথা শেষ হতেই ওর বাবা বললেন ,
“তোমার রক্ত আমার নাতিকে দেওয়া হবে না ৷ তুমি ফিরে যাও ৷ ”
এই বিপদের সময় এমন অদ্ভুত কথা রাই তার বাবার মুখ থেকে আশা করে নি ৷ রাই পেছনে ঘুড়ে নিজের বাবার দিকে তাকালো ৷রাইয়ের বাবা রাইকে উদ্দেশ্য করে আবার বলল,
“তুমি কোন সাহসে এখানে এসেছো ৷ চলে যাও এখান থেকে ৷ আমাদের নাক ,কান তো কেটে দিয়েছো ৷ এখন কি আরো ক্ষতি করার বাকি আছে ৷ তোমার মুখ আমরা দেখতে চাই না ৷”
নিজের বাবার মুখে এমন কথা শুনে রাই কাঁদলো না ৷ তার চোখের কোনে অশ্রু জমা হলো না ৷ কিন্তু হাতের মুঠ শক্ত হয়ে গেল ৷নিজের বাবার দিকে চোখে চোখ রেখে রাই বলল,
“আমাদের মধ্যে বাবা মেয়ের সম্পর্ক অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে ৷ এখন না আমি আপনার কুলাঙ্গার সন্তান ৷ আর না আপনি আমার মহামান্য জন্মদাতা ৷ আপনি সন্তান হিসেবে অনেক আগেই আমাকে ত্যাগ করেছেন ৷ আর এখানে আমি রাফীর ফুপি হিসেবে নয় ৷ আমি একজন রক্তদাতা হিসেবে এসেছি ৷ তাই আমার সাথে ঠিক করে কথা বলুন ৷ আর একটা কথা ৷ এখানে সাদি ভাই আমাকে রক্ত দেওয়ার জন্য আসতে বলেছে ৷ তাই বারবার নিজের মেয়ে বলে দাবি করবেন না আমাকে ৷ কারন আমি এখন না আপনার মেয়ে ৷ আর না আপনার অপমান বারবার সহ্য করবো আমি ৷ ”
রাই তার ভাই রায়হানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ছেলেকে যদি বাচাঁতে চান ৷ তাহলে ডাক্তারকে আসতে বলুন ৷ নইলে আমি চলে যাচ্ছি ৷এখানে কারো কাছে অপমান হতে আসি নি আমি ৷”
রাইয়ের কথা শেষ হতেই রায়হান বলল,
“আমি ডাক্তারকে ডাকতে যাচ্ছি ৷ একটু অপেক্ষা কর রাই ৷ আমি যাচ্ছি ৷”
রায়হান ডাক্তার ডাকতে ছুটে গেল ৷ কারন বেশি সময় নেই ৷ রক্তের অভাবে নইলে একমাত্র ছেলে মারা যাবে ৷ রায়হান ডাক্তারকে সাথে নিয়ে এলো ৷ ডাক্তার রাইকে দেখে বলল,
“অবশেষে রক্তদাতা পেলাম ৷ আপনি তাড়াতাড়ি চলুন ৷ ছেলেটার অবস্থা ভালো না ৷যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রক্ত দিতে হবে তাকে ৷”
রাই ডাক্তারে পেছনে যেতে লাগলো ৷ডাক্তার রাইকে নিয়ে একটা রুমের ভেতর গেলেন ৷ তারপর একটা বেডে শুতে বললেন ৷ ডাক্তার রাইয়ের রক্তের গ্রুপ চেক করলেন ৷তারপর ডাক্তার রাইয়ের শরীর থেকে রক্ত নিতে লাগলেন ৷ এক ব্যাগ রক্ত নেওয়ার পর ডাক্তার বললেন,
“আপনার শরীরে রক্ত স্বল্পতা আছে ৷ আপনার শরীর থেকে এক ব্যাগের বেশি নেওয়া যাবে না ৷ কিন্তু রোগীর আরো এক ব্যাগ লাগবে ৷”
রাই ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে হতাশ কন্ঠে বলল,
“আমার শরীর থেকেই নিয়ে নিন ৷ আরো এক ব্যাগ রক্ত নিলে আমি মরে যাবো না ৷ আর মরে গেলেও কারো কিছু হবে না ৷ কিন্তু রক্তের অভাবে ঐ বাচ্চা ছেলেটা মারা গেলে ওর মা কষ্ট পাবে ৷তার বুক খালি হবে ৷ আর আমি সেটা চাই না ৷ তবে আমার একটা শর্ত আছে ৷ আমি বাচ্চাটাকে একবার দেখতে চাই ৷”
রাইয়ের কথায় ডাক্তার যেন অবাক হলেন ৷ কারন কোনো রক্তদাতা এভাবে রোগীর কথা চিন্তা করে না ৷ নিজের শরীরের ক্ষতি করে কেউ অতিরিক্ত রক্ত দেয় না ৷ডাক্তার কিছু একটা ভেবে বললেন ,
ঠিক আছে ৷ তবে বাচ্চাটা কষ্ট পাবে এমন কিছু করতে পারবেন না আপনি ৷
রাই মুচকি হেসে জবাব দিল ৷
“ঠিক আছে ৷”
রাইয়ের শরীর থেকে দুই ব্যাগ রক্ত নেয় ডাক্তার ৷তারপর রাইকে বললেন ,
“আপনি কিছুক্ষন আরাম করুন ৷ আমি রক্ত নিয়ে যাচ্ছি ৷ আপনি এখন বেড থেকে উঠবেন না ৷ নার্সকে পাঠিয়ে দিচ্ছি ৷ নার্স আপনাকে বাচ্চাটার কাছে নিয়ে যাবে ৷ এবার আমি আসি ৷”
ডাক্তার মুচকি হেসে চলে গেলেন ৷ ডাক্তার যেতেই রাইয়ের চোখে পানি এলো ৷ একটু আগে কতটা কষ্টে নিজের বাবার সাথে অমন আচরন করেছে তা কেবল রাই জানে ৷বারবার কটু কথা শুনতে শুনতে এখন আর সবার সামনে চোখে পানি আসে না ৷ তবে নিরালায় চোখের কোন টলমল করে অশ্রু দ্বারা ৷পনেরো মিনিট পরে একজন নার্স এসে রাইকে বলল,
“আপনি চাইলে এখন দেখা করতে পারেল রোগীর সাথে ৷”
রাই অতি কষ্টে বেড থেকে উঠে বসলো ৷ উঠে বসতেই রাইয়ের মাথা ঘুড়ে গেল ৷ শরীরের সব শক্তি দিয়ে রাই বিছানার চাদর শক্ত করে ধরলো ৷ মুখ থেকে একটা শব্দ করলো না ৷ তারপর আস্তে আস্তে করে বেড থেকে নিচে নামলো ৷ নার্স রাইকে ধরে বাইরে নিয়ে গেল ৷ বাইরে এসে একটা বারের জন্য তার পরিবারের কারো দিকে তাকালো না রাই ৷ নার্সকে ধরে এগিয়ে গেল ৷নার্স রাইকে আইসিইউ এর ভেতর নিয়ে গেল ৷ রাই আস্তে আস্তে ছোট রাফীর কাছে গেল ৷ রাফীকে দেখেই রাইয়ের বুকটা কেঁপে উঠলো ৷ পুরো মাথা জুড়ে ব্যান্ডেজ ,মুখে অক্সিজেন মাস্ক ,অচেতন অবস্থায় পরে আছে তার আদরের বাবাই ৷ রাই ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“ভালো হয়ে যাও বাবাই ৷তোমাকে এভাবে একদম মানায় না ৷তুমি আবার আগের মতো হয়ে যাও ৷আন্টি তোমাকে রক্ত দিয়েছি ৷ তুমি একদম ঠিক হয়ে যাবে ৷বাইরে তোমার জন্য সবাই কত কষ্ট পাচ্ছে ৷ আর তুমি অসুস্থ হয়ে শুয়ে আছো ৷ আমাদের আর দেখা হোক বা না হোক ৷ তুমি আমাকে অতীতের মতো আবারো আন্টি বলে ডাকো আর নাই ডাকো ৷ তবুও আমি চাই তুমি ভালো থাকো ৷রাইয়ের চোখের কার্নিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পরে ৷রাই ছোট রাফীর কপালে চুমু দেয় ৷ তারপর চোখের পানি মুছে উঠে দাড়ায় ৷ মুখে একটা মিথ্যা কাঠিন্য ভাব তুলে ধরে ৷ বাইরে থাকা মানুষ গুলোর সামনে আর দুর্বল হবে না সে ৷ পেছন ঘুড়ে রাফীকে দেখে রাই ৷ তারপর বাইরে বেড়িয়ে আসে ৷ বাইরে আসতেই রাই আবরারকে দেখতে পায় ৷ একটু দূরেই সাদিকে নিয়ে দাড়িয়ে আছে ৷ রাই নিজের চোখ ফিরিয়ে নেয় ৷ রাই চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় ৷ তখন পেছন থেকে রাইয়ের বাবা বললেন ,
“আপনার টাকা নিয়ে যান ৷ আমার নাতির জন্য রক্ত দিয়েছেন ৷ নিজের প্রাপ্য টাকা নিয়ে যান ৷”
রাইয়ের বাবা একটা দশ হাজার টাকার বান্ডিল রাইয়ের হাতে দেয় ৷ তারপর বলে ,
“আশা করি এতে আপনার রক্তে দাম পূরন হয়ে যাবে ৷ এখন আপনি আসতে পারেন ৷”
নিজের বাবার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ রাই জোড়ে জোড়ে থাকে ৷রাইয়ের এমন হাসিতে সবাই চমকে যায় ৷রাই হাসতে হাসতে একটা চেয়ারে বসে ৷ হঠাৎ করেই রাইয়ের হাসি বন্ধ হয়ে যায় ৷ রাই নিজের বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
আপনাকে দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে ৷ আবার মায়া হচ্ছে খুব ৷ যেই আপনারা একটু আগে রক্তের জন্য পাগল হয়ে গিয়ে ছিলেন ৷ সেই আপনারাই এখন দশ হাজার টাকা দিচ্ছেন আমাকে ৷ তাও আবার উপহাস করে ৷ আবার চলেও যেতে বলছেন ৷একটা মানুষের জীবনের মূল্য দশ হাজার টাকা ৷ হ্যা যেহেতু আমি রক্ত দিয়েছি ৷ তাই খুশি হয়ে আমাকে টাকা দিতেই পারেন ৷ কিন্তু তাই বলে অপমান সহ্য করবো না আমি ৷খুব দেমাগ তাই না ৷ যেই টাকা মানুষের জীবনের মূল্য হয় ৷ সেই টাকা আমার দরকার নেই ৷ আর হ্যা আপনার সন্তানদের শরীরেও তো আপনার রক্ত বইছে ৷ তাহলে তাদের নিজের কাছে রেখেছেন কেন ৷তাদেরকে বলুন আপনার রক্তের দাম ফেরত দিতে ৷
রাই টাকার বান্ডিলটা ডাস্টবিনে ছুড়ে মারে ৷ তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
এরপর আমাকে নিজের সন্তান মনে করে ভুল করবেন না ৷ কারন আপনার মেয়ে মরে গেছে ৷ একবার নয় সে বারবার মরেছে ৷আর এরপর কেউ যদি আমাকে একা ভেবে যা ইচ্ছা বলতে আসেন ৷ তাহলে আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না ৷
চলবে