প্রিয়_তুমি,০৮,০৯

0
666

#প্রিয়_তুমি,০৮,০৯
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৮

‘বাহ, খুবই ভালো। তাহলে তো এই ডান্ডার বারি খেয়ে যেতেই হয়৷ নাহয় হাত-পা একটু ভাঙলোই। নো প্রবলেম। প্রেমের স্বাদ বোঝার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই তাইনা? সো এলাকাবাসীদের কী তুমিই ডাকবে? নাকি আমি ডাকবো?’

সেহের অবাক হয়ে যাচ্ছে পূরবের কথাবার্তা শুনে। প্রেমের স্বাদ মানে কী? ও তো কারো সাথে প্রেম করছেনা। আর পূরবের বিহেভিয়ারও ভালো ঠেকছেনা। কেমন যেন অদ্ভুত! ওকে যা কিছুই বলছে তাতে কোনো পাত্তা দিচ্ছেনা। এলাকাবাসী ডাকার কথাটা তো ও এমনিই বলেছিলো, কী ঝামেলায় পড়া গেলো! মানুষজন ওকে এই রাতে এখানে দেখলে খারাপ ভাববে। তাছাড়া পূরবের সাথে আর কোনো কথা বলার ইচ্ছে হচ্ছেনা, তাই সেহের বিরক্ত হয়ে বাসায় ফিরে আসে।

সুমা আর শিলা জানালা দিয়ে ওদেরকে দেখেছে এতোক্ষণ। তাই সেহের বাসায় ফিরলে ওকে ওরা ঝেঁকে ধরে কি বললো, কেন গিয়েছে, ওর সাথে পূরবের কী সম্পর্ক আছে? আরও নানা হ্যানত্যান করে ওকে জ্বালিয়ে মারলো। সেহের কোন কথার উত্তর দেয়ার প্রয়োজনবোধ করলোনা। কারণ ও নিজেই পূরবের ব্যবহার সম্পর্কে অবগত নয়, কেন এরকম করছে সেটা সেহেরের চেয়ে পূরবই ভালো বলতে পারবে। সুমা, শিলা ভীষণ আপসেট হলো।

পূরব কিন্তু সেই রাতে আর বাড়ি যায়নি। সেহের চলে যাওয়ার পরেও সে গাড়িতে বসে ছিলো রাত তিনটে পর্যন্ত। কেন এখানে এসে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকে ও নিজেই বুঝতে পারছেনা, শুধু জানে এখানে এসে সেহেরকে দেখলে ওর খানিকটা ভালো লাগে, অদ্ভুত সুখ অনুভূত হয়। মেয়েটার সম্পর্কে যতোই জানছে ততোই ওকে টানছে। সেহের একটা দারুণ মেয়ে, পূরবের বাবাও বলে। এতেই ও আরও আগ্রহবোধ করছে, কেমন ছেলেমানুষী ব্যাপার! মধ্যরাতে হঠাৎ জিসানের ফোন৷ বোধহয় ঘুমাচ্ছিলো। ওকে ঘুমে রেখেই গত চার-পাঁচদিন ধরে সেহেরের এলাকায় আসে পূরব। ওর বাবা বা জিসান কেউওই সেটা জানেনা। ও ঘুমুঘুমু গলায় বলে উঠে,

‘হ্যালো দোস্ত তুই কোথায়?’

পূরব গম্ভীর গলায় বলল, ‘আছি কোথাও।’

জিসান লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসলো। চোখ থেকে সাথে সাথেই ঘুম পালিয়ে গেলো৷ বলল, ‘মানে কী? তুই বাসায় না?’

পূরবের সহজ সীকারোক্তি, ‘না।’

জিসান অবাক হয়ে বলল, ‘তাহলে কোথায়?’

‘বাইরে ঘুরাঘুরি করছি!’

‘এতো রাতে?’

‘হ্যাঁ।’

‘পাগল হয়ে গেলি নাকি? এতো রাতে কেউ বাইরে ঘুরে?’

‘আমি ঘুরি!’

‘বিপদে পড়বি দোস্ত, বাসায় চলে আয়।’

‘কীসের বিপদ?’

‘আরে এতো রাতে রাস্তায় চোর, ডাকাতের অভাব নাই। ওদের খপ্পরে পড়লে বুঝবি কি বিপদ। তোর কি কোনো কাজ আছে বাইরে? না থাকলে চলে আয়।’

‘শিট ম্যান। তোর ঘুমুঘুমু কন্ঠে শুনে মেজাজ খারাপ হচ্ছে। আর এসব চোর-ডাকাতের ভয় আমাকে দেখিয়ে লাভ নেই৷ আমি হচ্ছি রাতের আঁধারে বেড়ে ওঠা মানব।’

জিসান বলল, ‘তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে কোনো অশরীরী আত্মা কথা বলছে দোস্ত। আমিতো পানি খেতে উঠছি রাত দেড়টায়, পাশে তাকিয়ে দেখি তোর বেড খালি, ভাবলাম ওয়াশরুমে গিয়েছিস। এখন আবার ঘুম ভাঙলো দেখি তুই নাই৷ সন্দেহ হওয়ায় উঠে সারাবাড়ি খুঁজলাম। আঙ্কেলের ঘরেও চেক করলাম তুই নাই।’

‘আরে ইয়ার। নো টেনশান, জাস্ট চিল। আমি ঠিক আছি। একটু পরই বাসায় ফিরছি।’

‘গাড়ি নিয়েছিস?’

‘হুঁ!’

জিসান হাফ ছেড়ে বলল, ‘ওকে। তাড়াতাড়ি আয়।’

ফোন কাটার আগে পূরব জিসানকে থামালো। বলল, ‘আচ্ছা তোর কাছে প্রেম মানে কী? এটা মানে তুই কী বুঝিস?’

জিসান হঠাৎ এরকম প্রশ্ন শুনে অবাক। বেশকিছুক্ষণ ভেবে বলল, ‘উমম..প্রেম মানে রাস্তায় দাঁড়িয়ে লুতুপুতু করা।’

পূরব রেগে এক ধমক দিলো। তারপর বলল, ‘ফান করবিনা একদম। তোর এসব ফান মোটেও স্বাস্থ্যকর নয়।’

জিসান হেসে বলল, ‘প্রেম আবার স্বাস্থ্যেকর হয় নাকি? প্রেম মানেই অস্বাস্থ্যকর অনুভূতি… ‘

পূরব নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে বলল, ‘আমি জানতে চাইছি লাভ আই মিন ভালোবাসা কী?’

‘আমি জানিনা রে। কখনো প্রেম, ভালোবাসায় জড়াইনি তো তাই এসব বিষয়ে অভিজ্ঞতা কম। অবশ্য তুই চাইলে আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রেমিক-প্রেমিকাদের ইন্টারভিউ নিবো। জানতে চাইবো প্রেম কী, ভালোবাসা কী!! ওরা ওদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করবে আর আমরা জানতে পারবো ভালোবাসার আসল সংজ্ঞা!’

‘ওফফ জিসান৷ আমি যা বলছি শোন।’

‘যথা আজ্ঞা বাদশাহ!’

‘শোন, একটা অসাধারণ মেয়ে, হুম? যে ছোট থেকেই স্ট্রাগল করে বড় হয়েছে, কারো সাহায্য ছাড়াই নিজের উৎসাহে। মানুষের বিপদেও যে সাহায্য করার চেষ্টা করে অথচ নিজেরই অনেক দুঃখ। তো একটা ছেলে আজকাল ওকে একনজর দেখার জন্য নানা ছেলেমানুষী আচরণ করে, মেয়েটাকে দেখতে, ওর হাঁটাচলা, কথাবার্তা, রাগ সবকিছুই ওর ভালো লাগে। মেয়েটার সামনে ওর বেহায় হতে ইচ্ছে করে, যা কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি তা-ই ওর মনে উঁকি দেয় বারবার। মনে হয় সুখের মতো এক ব্যথা..তাহলে কি বলা যায়, ছেলেটা মেয়েটার প্রেমে পড়েছে? আর তারা দুজন স্রোতের বিপরীতে বয়ে চলা পানির মতোন..’

পূরব আর কিছু বলতে পারলোনা। তাঁর আগেই জিসান অবাক হয়ে বলল, ‘মাথামুন্ডু বুঝতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। তবুও তোর কথা শুনে যা বুঝলাম ছেলেটা হয়তো মেয়েটার প্রেমে পড়েছে, আরও গভীরভাবে চিন্তা করলে ধর, ছেলেটা মেয়েটার সারাজীবনের সব দুঃখকষ্টকে ভাগ করে নিলে, কষ্টগুলোকে নিবারণ করার সাহস করলে, একে অন্যের পাশে থাকার চিন্তা করলে তবেই বোধহয় ভালোবাসাটা হয়ে যাবে। তাইতো… ‘

পূরব আর কোনো কথা না বলে ফোন রেখে দিলো। তারপর সেহেরের বাসায় কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। কেন যে ছুটে আসে সেটা কিছুটা হলেও পূরব বুঝতে পারছে। ঠোঁটে মুচকি হাসির রেখা। সেহেরের ঘরের বাতি নেভানো, হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। পূরব গাড়ি স্টার্ট করলো। কিন্তু ও কী জানতো ওই অন্ধকার ঘরে জানালার পাশে বসে কেউ ওকে দেখছিলো? নির্ঘুম রাত পার করেছিলো? আর এর সাক্ষী হয়ে রয়েছিলো নিকষ কালো আঁধার ভেদ করে একঝলক আলোয় মেতে ওঠা ওই শুক্লাদ্বাদশীর চাঁদটা!

সেহেরের আজকাল টিউশনের চাপটা বেড়েছে। পাঁচটা টিউশন করে সাথে সাথে সেলাই কাজও শিখেছে। তার উপর পড়াশোনার যথেষ্ট চাপ। সব মিলিয়ে খুব ব্যস্ত দিনকাল যাচ্ছিলো ওর। তবে টাকাপয়সার চিন্তা এখন আর নেই। যাদের কাছ থেকে ধার নিয়েছিলো, সেই টাকাও শোধ করা হয়ে গিয়েছে। এর মধ্যে একদিন রাস্তায় দেখা হয়ে গেলো ওর চাচা বেলায়েত আলীর সাথে। বাজার সেরে ফিরছিলেন তিনি। সেহেরকে দেখে এগিয়ে এলেন। সেহের কোনোরুপ অবান্তর বাক্যলাপ না করে চাচার সাথে যথেষ্ট মার্জিত ব্যবহার করলো। বেলায়েত আলী জিজ্ঞেস করলো, ‘কেমন আছিস?’

‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি কেমন আছেন চাচা? আর চাচীমা? অনু, মিম, ইফতি ভাই ওরা কেমন আছে?’

‘সবাই ভালোই আছে। তোর চাচী তো গত মাসে স্ট্রোক করেছে৷ একপাশ প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছে। পারভীনের অবস্থা খারাপই।’

সেহের কথাটা শুনে ঝটকা খেলো। ওই শক্ত-সামর্থ্য, রাগী মহিলাটা যার কথায় পুরো পরিবার উঠবস করতো সে আজ শয্যাশায়ী! হায় নিয়তি, সেহেরের সাথে কতোই না দুর্ব্যবহার করেছে, মারধর করে দিনের পর দিন ঘরে না খাইয়ে আটকে রেখেছে। সেই মানুষটার আজ এই অবস্থা! এটা কী সেহেরের সাথে তার করা পাপের ফল? একটা করুণ দীর্ঘশ্বাস বেরুলো সেহেরের বুক থেকে। ও আর কিছু ভাবতে চাচ্ছেনা। পারভীন বেগমকে দেখতে সে চাচার সাথে বাড়ি এলো। পারভীন বেগমকে এক কোণের একটা ঘরে কাঁথামুড়ি দিয়ে শুইয়ে রাখা হয়েছে। ঔষধপত্র টেবিলের উপর রাখা। ঘরটার ভেতর কেমন অসুস্থ ভাব। না চাইতেও সেহের চাচীর সাথে কথা বললো। পারভীন বেগম ওকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো। এই মেয়েটার উপর তিনি কতোই না অত্যাচার করেছেন একসময়। সেই কথা ভেবে সেহেরের হাত জড়িয়ে ধরে মাফ চাইলেন। অনেকক্ষণ কেঁদে কেঁদে নিজের দুঃখের কথা বললেন। নিজের সন্তান-সন্ততি এখন ওনাকে দেখতে পারেনা, উঠতে বসতে কথা শোনায়৷ বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেয়। অথচ তাদের জন্যই সেহেরকে কতো না অত্যাচার করেছেন! সেহের বিকেলের দিকে বাড়ি ফিরে এলো। তারপর শেফার ফোন। ওর সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা বলে ঘুম দিলো। সেই ঘুম ভাঙলো রাত দশটায়৷ এরপর হাত-মুখ ধুয়ে বই নিয়ে বসলো। বারোটার দিকে রান্নাঘরে চা বানাতে গিয়ে রাস্তার দিকে নজর যেতেই দেখলো আজও পূরব সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। এই এতগুলো দিনে একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে এটা৷ পলকহীন চোখে সেহের শুধু চেয়েই রইলো।

সেহের না জানলেও পূরব এতোদিনে পুরোপুরি শিওর হয়ে গিয়েছে যে সেহেরকে ওর চাই-ই চাই। এই কথাটা সে ইরফান আহমেদের সাথেও শেয়ার করেছে। তিনি তো পুত্রের প্রেমে পড়ার বিষয়টা নিয়ে খুবই উৎফুল্লতা প্রকাশ করেছেন। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা! এই অপেক্ষাও খুব মিষ্টি লাগে পূরবের৷ আহা, মেয়েটা যদি জানতে পারে পূরবের ওকে চায়, তাহলে নিশ্চয়ই ওকে কড়া কড়া কথা শুনিয়ে দেবে! ও মনে মনে বলল, এই চোরেরই বউ হতে হবে তোমায় সেহের। তুমি যে জানালা দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে তোমার সেলিব্রিটি চোরকে দেখো সেটা খুব ভালো করেই সে জানে৷ বউ বানাতে শুধু সময়ের দরকার! বুঝলে চোরের বউ?’ হাসলো শুধু পূরব।

চলবে..ইনশাআল্লাহ!

#প্রিয়_তুমি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৯

ব্যবসায়িক কাজের সূত্র ধরে পূরবকে কিছুদিনের জন্য ইন্ডিয়া যেতে হয়েছিলো। সেই দিনগুলোতে সেহেরের উপর সর্বক্ষণ নজর রাখার মতো পূরব যখন আর কাউকেই পাচ্ছিলোনা তখন সেহেরের রুমমেট সুমা আর শিলাকে খুব করে অনুরোধ করলো ওর করা প্রতিটি কাজের খবর টাইম টু টাইম ওকে জানাতে। আর ভার্সিটিতে যা কিছু হবে সেগুলো জানতে জিসানকে দিয়ে শেফাকে রাজি করিয়েছে। শেফা আর রিমি রাজি হতে চাইছিলোনা সেহেরের অগোচরে। কিন্তু পূরবের অনুরোধ ওরা ফেলতে পারলোনা। পূরব শুধুমাত্র তার ধানিলংকাটার নিউজ জানতে চায়। সে কী করছে, কি খাচ্ছে, কোথায় গিয়েছে এভরিথিং! এতোদিনে পূরবের এসব অস্বাভাবিক আচরণ আর সেহেরের প্রতি অতিরিক্ত কেয়ারিং দেখানোর ফলে জিসান, রিমি, শেফা, সুমা, শিলা বুঝেই গিয়েছে সে সেহেরের প্রতি দুর্বল। অবশ্য ওরা মনে মনে খুশিই হলো। সেহের ওর মতোই কাউকে ডিজার্ভ করে। যাইহোক, পূরব ইন্ডিয়া যাওয়ার পরে সবাই ওর কথামতো সেহেরের খোঁজখবর দিতে থাকলো।

ভার্সিটির একটা ছেলের সাথে সেহেরের বন্ধুত্ব হলো। ছেলেটার নাম মাহিম। খুবই ভদ্র এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। সেহেরেকে পড়াশোনায় যথেষ্ট সাহায্য করে, বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। দুজনে মিলে একদিন তো শিশুপার্কে ঘুরেও এসেছে। এই খবর জিসান ফোন করে পূরবকে জানালো। ও রেগে আগুন। তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে কয়েকদিনের মধ্যে দেশে ফিরলো। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা সেহেরের ভার্সিটি রওয়ানা দিলো। এবং সেখানে পৌঁছে দেখলো জিসানের কথাই ঠিক। ছেলেটা সারাক্ষণ ওর সাথে থাকে। ক্লাসে পাশাপাশি বসে, অফ টাইমে মাঠে বসে গল্প করে। গিটার বাজিয়ে গান গায় বন্ধুমহলে। হাবভাবে বোঝাতে চায় সেহেরকে সে পছন্দ করে। সেটা সেহের না বুঝলেও পূরব বুঝতে পারলো। তখনই ওর অস্থিরতা বেড়ে গেলো। মন কু ডাকতে লাগলো, সেহের বুঝি আর তার হলোনা। ভালোবাসার অনুভূতির মতো মারাত্মক অনুভূতি দ্বিতীয়টি নেই। সেহেরের ব্যক্তিত্ববোধে মুগ্ধ পূরব নিজেকে আর আটকাতে পারলোনা যখন দেখলো ওরই সামনে দিয়ে অন্য কোনো লোক সেহেরের সাথে মেলামেশা করছে। ঠিক মেলামেশা নয়, কিন্তু সেহেরের প্রতি খুবই কেয়ার দেখাচ্ছে যা পূরব কোনোভাবেই মানতে পারছেনা। রাগে ওর শরীর ফেটে গেলো৷

কোনোমতে ড্রাইভ করে বাসায় ফিরলো। জিসান আর ইরফান সাহেব ড্রইংরুমে বসে কথা বলছিলেন। ওকে হঠাৎ দেখে দুজনেই অবাক। কাজের লোক আব্দুল মিয়া চা- নিয়ে এলো। পূরব সোজা বাবার কাছে গিয়ে বসলো। ছেলের গম্ভীর চেহারা দেখে ইরফান সাহেব কিছু একটা আন্দাজ করতে পারলেন। হালকা কেশে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আজ ফিরবে জানালে না কেন?’

‘এমনি।’

জিসান জিজ্ঞেস করলো, ‘তুই ফিরবি বললে তো আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিতাম।’

‘ম্যানেজার সাহেব জানতো। ওনি অফিসের গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।’

ইরফান সাহেব গম্ভীরমুখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে? এরকম করছো কেন?’

পূরব বাবার কথায় মুখ তুলে চাইলো। কিছুক্ষণ ইতস্তত করলো। তারপর সরাসরি বলল, ‘আব্বু আমি আজ একটা জরুরি কথা বলতে চাই।’

ইরফান আহমেদে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, ‘কী কথা?’

‘তুমি কিন্তু না করতে পারবেনা।’

‘রিল্যাক্স। তার আগে তুমি মাথা থেকে হ্যাট খুলো। এরকম ইংরেজ সেজে থাকতে কতোক্ষণ ভালোলাগে?’

‘মোটেও ইংরেজ বলবেনা। আমার ভালোলাগে তাই পরি।’

জিসান হেসে বললো, ‘ভাই এতো ডেস্পারেট হয়ে আছিস কেন? বিপি লো করবে তো!’

পূরব ফুঁসে ওঠে বলল, ‘বিপি লো হয়ে মরে যাক।’

‘কী যে বলিস তুই৷ রেগে আছিস বলে যা তা বলবি নাকি? অফ যা!’

ইরফান সাহেব এবার বলে উঠলেন, ‘ওকে ওকে। ফ্রেশ তো হয়ে আসো। তারপর আরাম করে তোমার কথা শুনবো।’

পূরব ছোট্ট করে বলল, ‘ওকে।’

ওদের সাথে কথা বলে ফ্রেশ হওয়ার জন্য পূরব ঘরে চলে এলো। সানগ্লাস, হ্যাট, ওয়ালেট বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে তোয়ালে নিয়ে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকলো৷ শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে ওর উগ্র মস্তিষ্ক তখন ভাবনায় মত্ত! নাহ, সেহেরের সাথে ওই মাহিমের চলাফেরা একদম মানায় না। সেহেরকে শুধু ওর সাথেই মানায়৷ সাধে কি সেহেরের বলা চোর কথাটা মেনে নিয়েছে? ভালোবেসেছে বলেই মেনেছে। তাই বলে ওর সাত খুন মাফ করে দেবে তা কিন্তু নয়৷ পূরব যেমন ভালোবাসতে জানে, তেমনি কীভাবে ভালোবাসাকে আগলে রাখবে তাও ভালোভাবেই জানে। মেয়েটার কতোবড় স্পর্ধা, পূরবকে আজ ভার্সিটিতে দেখেও এমন একটা ভাব করলো যেন সে দেখেইনি। পনেরোদিন ছিলোনা দেশে, তাই বলে এতোটা পরিবর্তন হয়ে যাবে? অন্য লোকের সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা খাবে, আইসক্রিম খেয়ে নাকের পানি মুছবে অন্য লোকের রুমালে? কেন? পূরবের কী রুমাল নেই? দরকার হলে ওর শার্টে মুছুক, ওর হাতে মুছুক, মানা করেছে নাকি ও?? দু-হাত মুষ্টিবদ্ধ করে পূরব দেওয়ালে একটা ঘুসি মারলো। ব্যথায় প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার যোগাড় হলেও মুখ দিয়ে “টু” শব্দটি পর্যন্ত করলোনা।

ওদিকে জিসান আর ইরফান আহমেদ চিন্তিতমুখে বসে আছেন পূরবের কথা শোনার আশায়। কি বলবে ও? আর এতো রেগেই বা আছে কেন? হলোটা কী ওর? দেখাই যাক কি বলতে চায়!

শেফা, রিমি, সেহের আর মাহিম আজ পুরোটা দিন একসাথে কাটিয়েছে। তিনজনের মধ্যে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে। পূরবকে ওরা কেউই দেখতে পায়নি। সারাদিন হৈ-হল্লা করে কাটিয়ে মাহিম বাড়ি ফিরে গেলো। রিমিও চলে গেলো। শেফা অনেক জোর করে সেহেরকে ওদের বাসায় নিয়ে গেল। রাতে ঘুমানোর সময় শেফা জিজ্ঞেস করলো, ‘মাহিম্মা আর রিমির রিলেশনটা মনে হয় হয়েই যাবে, কী বলস?’

সেহের বলল, ‘মনে তো তাই-ই হয়! মাহিমের ভাবসাব ভালো ঠেকছেনা। রিমিকে দেখলেই তার নিঃশ্বাস দ্রুত উঠানামা করে।’

‘এটা আমিও খেয়াল করছি। মাহিমের আম্মা আবার রিমিকে খুবই পছন্দ করে। সেবার আমরা ওর বাসায় গেলাম না? তখন তো ওনি কী আহ্লাদীপনা করলেন।’

সেহের অবাক হয়ে বলল, ‘কবে গেলি? বললি না তো।’

‘আরে সেদিন তুই ভার্সিটি শেষে টিউশনে চলে গেলি আর মাহিম্মা জোর করে আমাদেরকে ওর বাসায় নিয়া গেলো। তোকে বলতে ভুইলা গেছি।’

‘ওহহ। ওদের কথা বাদ দে। ওই জিসান ভাইয়ের সাথে তোর এতো ফুটুরফাটুর কীসের রে? তলে তলে টেম্পু চালাস না তো আবার?’

শেফা থতমত খেয়ে বলল, ‘মানে?’

সেহের আড়চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোরা প্রেম করোস তাইনা? কি ভাবছিস আমার চোখকে ফাঁকি দিবি আর আমি কিছু জানতেও পারবোনা?’

শেফা আহত গলায় বলল, ‘মোটেও না।’

‘মিথ্যা বলবি না একদম। তোর মোবাইলে ওনার এতো ম্যাসেজ কেন তাহলে? সেদিন তো দেখলাম বাংলা সিনেমার হিরোদের মতো তোকে “আই লাভ ইউ” ও লিখেছে। তোর আম্মাকে বলতে হবে!’

শেফা ভয় পেয়ে বলল, ‘কী বলবি?’

‘বলবো আন্টি আপনার মেয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। সে সেলিব্রিটি চোরের বন্ধুর সাথে প্রেম করে।’

এই পর্যায়ে এসে শেফাকে স্বীকার করতেই হলো ওর আর জিসানের মধ্যে রিলেশন আছে। খুব বেশিদিনের নয়। জিসানই প্রথম ওকে প্রপোজ করেছে। সেহের হাসতে হাসতে বলল, ‘তুইও প্রেমে পড়লি ভাই, রিমিরও
মনে হচ্ছে বিয়েটা হয়ে যাবে। আফসোস আমি আজীবন সিঙ্গেল থেকে গেলাম। কী দুঃখ, এই দুঃখ আমি কোথায় রাখি! আমাকে কেউ সান্ত্বনা দে!’

শেফা ভাবুক গলায় বলল, ‘মাহিম আমাদের তিনজনের সাথে অনেক ক্লোজ হয়ে গিয়েছে। পরশু জিসান ভাই জিজ্ঞেস করলো ওর সাথে তোর কোনো সম্পর্ক আছে নাকি? আমি মজা করে হ্যাঁ বললাম আর ওনি বিশ্বাস করে নিলো। ওনি তো আর জানেন না মাহিম অলরেডি বুকড! হা হা।’

সেহের শেফার হাসির সাথে তাল মেলালো। হঠাৎ শেফা জিজ্ঞেস করলো, ‘বাই দ্যা ওয়ে, তোর ওই সেলিব্রেটি চোরের খবর কী?’

সেহের ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘কে?’

‘আরে পূরব ভাই! ভুলে গেলি? তোর জানালার বাইরে যিনি দাঁড়ায় থাকতো?’

‘ওহ ওনি? তুই ওনার খোঁজ জানতে চাইছিস হঠাৎ? কেন?’

‘না অনেকদিন যাবৎ দেখা সাক্ষাৎ হয়না তাই বললাম!’

সেহের গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘জানিনা। তিন সপ্তাহ আগে দেখেছিলাম রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। এখন দাঁড়ায় না, হয়তো এখন মতি পাল্টেছে।’

শেফা মনে মনে হাসলো। পূরব যে এতোদিন দেশেই ছিলোনা আর সেহেরের খোঁজ প্রতিনিয়ত নিয়ে যাচ্ছে সেই খবর সেহেরকে জানাতে ইচ্ছে করলোনা। থাকুক না ব্যাপারটা গোপন। সময় হলে পূরবই বলবে। শেফা হালকা কেশে বলে উঠলো, ‘তো তুই যে ওনাকে পছন্দ করিস সেটা বলছিস ওনাকে?’

সেহের হতভম্ব হয়ে বলল, ‘আমি? ওনাকে পছন্দ করি? কবে, কখন এসব বললাম শেফা? এসব ফালতু কথা আমার সামনে একদম বলবিনা৷ যত্তসব…’

‘কেন?’

‘ওনারা কতো বড়লোক। আর আমি? ছিঃ! ওনাদের সাথে আমার তুলনা? কখনোই না। তাছাড়া ওনাকে আমার এমনিতেই অপছন্দ।’

‘এরকম ড্যাশিং একটা ছেলেকে এরকম বলতে পারলি?’

সেহের রেগে বলল, ‘ড্যাশিং হলে কী হবে? স্বভাব একদম ভালোনা…’

চলবে..ইনশাআল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here