#ছোটগল্প
কূপমণ্ডূক অথবা বিশ্বাসী,অন্তিম পর্ব
আরিফুর রহমান মিনহাজ
সালমানের বন্ধু ছাড়াও তানভীরকে আরো একটি বিশেষ পরিচয়ে পরিচিত করা যায়৷ ঘুরিয়ে-বাঁকিয়ে না বললে, সালমানের বাবার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কাছের বান্ধবীর ছেলে হলো, এই তানভীর। এখন অবশ্য অবিরত যাতায়াতের কারণে তানভীরের মা আর পারভীনের সঙ্গে বেশ দহরমমহরম সম্পর্ক। বছরখানেক হলো তানভীরের বাবার চাকরির বদৌলতে তার পরিবার চট্টগ্রামে বদলি হয়েছে। ঢাকায় তানভীর এসেছে বিশেষ কাজে৷ দিন পনের সে ঢাকাতেই থাকবে। কাজেই,এই বাড়িতেই সে উঠেছে। চাইলেও পনেরো দিনের জন্য অন্য কোথাও উঠতে গেলে এরা তা মানবে কেন? অবশ্য ওই মনোহারিণীকে দেখার পর তানভীরের মনে হচ্ছে, ভালোই হয়েছে। যদিও মেয়েটির রূপ যে একেবারে আহামরি কিছু তা নয়,তবু কেন যেন মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দেবার মতো নয়। কী যেন এক হৃদয়-বিধ্বংসী সারবস্তু আছে তার ওই সারল্যমাখা সুরতে, অভিব্যক্তিহীন চোখের চাউনিতে। এমন এক বস্তু,যেটি তানভীরের মতো সবাক,সপ্রতিভ ছেলের সমস্ত সত্তাকে মায়া-গরলে নিষ্প্রাণ করে দিচ্ছে।
সেদিনের পর অবশ্য তাকে আর একবার মাত্র দেখেছিল তানভীর। তাও আরো দুদিন পর। রাতের খাবার টেবিলে তানভীর এসেছিল সবার শেষে। অবশ্য সে প্রায়ই কাজের সুবাদে বাইরে বাইরে খায়। তাকে দেখেই অস্বস্তি আর ভয়ে গাঁট হয়ে বসে ছিল উমাইরা। উঠি উঠি করে একসময় চেয়ার ছেড়ে সটান দাঁড়িয়ে গেল সে। পারভীন সবার দিকে আড়ে চেয়ে শঙ্কিতভাবে চাপাস্বরে বললেন,
– ও কী হচ্ছে। বসো।
উমাইরা কোনোমতে‘আমার খিদে নেই মা’ বলে সেখান থেকে চলে গেল। সকলেই হতবাক। সালমান ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে উঠল,
– এটা কী হলো!
সালমানের বাবা ছেলের সঙ্গে তাল দিয়ে বিড়বিড় করে বললেন,
– ম্যানারলেস মেয়ে! তোমার মেয়েকে বোলো আমাদের সঙ্গে খাওয়ার দরকার নেই। নিজের ঘরেই যেন খায়।
পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হবার আগেই সামলে নিল তানভীর নিজেই। সে সবাইকে শান্ত করে বলল,
– আরে আঙ্কেল, সিরিয়াস হবার দরকার নেই। আমাকে সে একটু লজ্জাই পায়।
পারভীন সুযোগ পেয়ে বললেন,
– হ্যাঁ,ও একটু বেশি লাজুক।
সালমান বন্ধু আর পারভীনের কথা উড়িয়ে দিয়ে বলল,
– না, লজ্জা থাকা ভালো। কিন্তু, কোন্ লজ্জায় মানুষের অপমান হয় সেটাও তো তার মাথায় থাকা উচিত৷
তানভীর বলল,
– আরে বাদ দে। নে শুরু কর। যা খিদে পেয়েছে।
ব্যাপারটায় তানভীরও যে কম মর্মাহত হয়েছে তা নয়৷ কিন্তু পরবর্তী কয়দিনে উমাইরার যা ইতিবৃত্ত সে শুনল রেজার মুখ থেকে এরপর তার মনে আর কোনো ক্ষোভ অবশিষ্ট রইল না। তার নীতিগত বৈশিষ্ট্যকে সম্মান করে কোনো খেদ সে মনে পুষতে পারল না। বিপরীতে এক সৃষ্টিছাড়া অনুরাগ তাকে তন্ত্রসিদ্ধ সাধুর অব্যর্থ কালোজাদুর মতো আচ্ছন্ন করে ফেলল। যুদ্ধবাজ সম্রাটের সাম্রাজ্য বিস্তারের মতোন আত্মমর্যাদা ও আত্মোন্নতির যে বিস্তার সে ঘটিয়েছিল নিজের মধ্যে তা যেন ক্ষণে ক্ষণে সংকুচিত হয়ে যেতে চাইল৷
একদিন ভোরে তানভীরের ঘুম ভাঙল অস্পষ্ট একটি সুরের সুমধুর দ্যোতনায়। এর আগেও ভোরের দিকে এই সুর শুনে শুনে তার ঘুমটা ভাঙতে ভাঙতে আরো গাঢ় হয়েছিল।কিন্তু গত রাতে একটু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ায় আজ যেন এই সুরের উৎস জানার জন্য চৈতন্যপ্রাপ্ত হলো সে। ঘুম চোখে বিছানা ছেড়ে নামে সে। নিজের রুম থেকে বেরিয়ে সূরের উৎস খুঁজতে বিভ্রান্তভাবে তাকায় ডানে-বাঁয়ে। অবশেষে উৎকর্ণ হয়ে অস্ফুট শব্দোৎসের দিকে এগোয় সে। ভেতরের দিকে একটি কামরার আধো ভেজা দরজার মুখে এসে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ায় সে। মধুর চিকন সুরে দীর্ঘ টানে কোরআন পড়ছে একটি নারীকণ্ঠ। হৃদয় নাড়িয়ে দেওয়া সুরের তালে কণ্ঠের পারদ উঠছে আর নামছে। কে হতে পারে তা অনুমান হতেই তানভীর সচকিত হয়ে আস্তে আস্তে উঁকি দিল। রেজা আর উমাইরা। উমাইরার কণ্ঠ তখন থেমে গেছে। রেজা পড়ছে। ওর মাথায় টুপি। গুনগুন করে আটকে আটকে কোরআন পাঠ করছে সে। একটা জায়গায় বেশি আটকে গেলে উমাইরা মাথা নাড়িয়ে ভুল জায়গাটি সহ আরো কয়েকটি আয়াতটি পাঠ করল। এবার সরাসরি দেখে এবং শুনে তানভীরের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে গেল, শরীরের সমস্ত লোম খাড়া হয়ে গেল। কোনো নারীকণ্ঠের এত সুন্দর, সুরেলা, সুস্পষ্ট তেলওয়াত সে কখনো শুনেনি। কী অপরিসীম দরদ মাখিয়ে উচ্চারণ করে প্রত্যেকটি শব্দ!
অনেকক্ষণ পর উমাইরা হঠাৎ খেয়াল করল দরজার দিকে৷ আলুথালু তানভীরকে দেখেই সশব্দে আঁতকে উঠে সে। তানভীর লজ্জিত হয়ে পুরো দরজাটি খুলে একপা ভেতরে এসে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
– স..স… স্যরি,স্যরি। আসলে আপনার তেলওয়াত শুনে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল…। তাই…
একটু নীরবতা। উমাইরা ঈষৎ পিছনে ঘুরে ওর দিকে না তাকিয়েই একটু কাঠকাঠ গলায় বলল,
– আমারই ভুল। আরেকটু আস্তে পড়া উচিত ছিল। আপনি আসুন এখন৷ ওর কোচিং আছে একটু পর।
এমন কাটখোট্টা সুরের কথার জন্য প্রস্তুত ছিল না তানভীর৷ মুহূর্তের জন্য থতমত খেয়ে রেজার দিকে তাকিয়ে বিব্রত হেসে বেরিয়ে এল সে। বোনকে এই প্রথম কঠিন হতে দেখে রেজা একটু দুঃখিত সুরে বলল,
– এমন করে বললে কেন?
– ওমন করে না বললে যেত? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা ঘুরানোর চেষ্টা করত। আর, পরেছে তো বাচ্চা ছেলের মতো হাফ প্যান্ট।
রেজা দরজার দিকে আড়চোখে একবার চেয়ে বলল,
– তানভীর ভাইয়া মনে হয়,লুকিয়ে লুকিয়ে তোমার তেলওয়াত শুনছিল৷
রেজার ইঙ্গিতটাকে আশকারা না দিয়ে পূর্বপ্রসঙ্গের রেশ ধরে উমাইরা বলল,
– হুম। মেয়েদের কণ্ঠও পর্দার অন্তর্ভুক্ত। তাই কখনো যদি বাইরের পুরুষের সঙ্গে কথা বলতেই হয়, মিষ্টি করে না বলা।
রেজাকে গল্পে পেয়ে বসল। বলল,
– আমাদের ক্লাসের একটা ছেলে রং নাম্বারে ফোন করে একটা দুই বাচ্চার মায়ের কণ্ঠের প্রেমে পড়ে বসে আছে। হাত টাত কেটে অবস্থা খারাপ। মহিলাটিও বদ আছে। তবু বাচ্চার মা সুখের সংসার ছেড়ে ওর কাছে আসবে কেন?
উমাইরা বলল,
– তুমি আবার প্রেমট্রেম করো না যেন। আমি মাকে বলব যে,একুশ হলেই তোমার বিয়ে দিয়ে দেয়।
লজ্জায় রেজার কান লাল হয়ে গেল।
– যাঃ
– হয়েছে৷ নাও, আউজুবিল্লাহ পড়ে আবার শুরু করো। ওই লোকটা শয়তান নিয়ে এসেছে।
৪
দিনে দিনে কিন্তু উমাইরা ভারী বিরক্ত হয়ে পড়ল তানভীরের ওপর। লোকটা একেবারে কোনো কথাবার্তা ছাড়াই বাঁধভাঙা স্রোতস্বিনীর উল্লসিত স্রোতধারার মতো চোখের সামনে এসে পড়ে। উমাইরা কী করবে ভেবে পায় না। কোনো একটা ব্যবস্থা না হওয়া অবধি এই বাড়িই তার জন্য শেষ আশ্রয়স্থল। অথচ এখানেই এমন একটা মানুষ তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ওপর চেপে বসেছে যে কি-না নিশিদিশি নিজের উপস্থিতির কথা জানান দিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। লোকটা যে চরিত্রহীন বা কোনোপ্রকার দুরভিসন্ধি এঁটে তাকে জ্বালাতন করছে তা-ও মনে হয় না। সবকিছুর মধ্যে কেমন যেন একটা মৃদু মিষ্টতা আছে, যেটা উমাইরার সূক্ষ্ম বিবেচনায় ধর্তব্য হলেও চুলপরিমাণ প্রশ্রয় দিতে মন সায় দিচ্ছে না। জীবনের এতটুকু পথ এসে, নিজের আসল সত্তাকে বিকিয়ে দিতে গেলে নিজের কাজেই সে গোটা জীবন অপরাধী হয়ে থাকবে।
তানভীরের সময় ফুরিয়ে এল। ঢাকার জরুরত শেষ করে চট্টগ্রামে নিজের কর্মস্থলে ফিরে গেল সে। যাবার সময় অনেক চেষ্টাচরিত্র করেও যখন উমাইরাকে কাছেপিঠে পাওয়া গেল না তখন ফাঁকতালে একটি চিরকুট লিখে পাঠাল উমাইরার কাছে। চিরকুটে লেখা,
“চলে যাচ্ছি। ভাববেন না মুক্তি পেয়ে গেছেন। আমি জানি আপনি আমার ওপর বিরক্ত। কেন সেটা অজানা নয়। তবে এটাও জানি,শুদ্ধতম কিছুতে আপনার আপত্তি থাকার কথা নয়। পরেরবার মনখুলে কথা বলার পরোয়ানা জারি করে ফিরব। ততদিন অবধি আমার প্রতি ধনাত্মক মনোভাব রাখবেন,এটাই একান্ত কামনা। ”
চিরকুটের মর্মোদ্ধার করা সম্ভব হলে না উমাইরার পক্ষে। অবশ্য এটা নিয়ে ভাববার অবসরই তার মিলল না। কারণ,এখান থেকে তার স্থানান্তরের জন্য একটা দুর্দান্ত সুযোগ মিলেছে। ঢাকার একটি বড় মাদ্রাসার উপশাখা হিসেবে,তাঁদেরই অর্থায়নে মোহাম্মদপুরে একটা মহিলা হিফজখানা প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। সেখানে অভিজ্ঞ মোয়াল্লেম নিয়োগ হচ্ছে। মূলত রেজাই অনলাইনে এমন একটা সংবাদ সরবরাহ করে উমাইরাকে দেখিয়েছিল। ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য পরদিনই রেজাকে নিয়ে সেখানে হাজির হয়েছিল সে। দেখা গেল,বিষয়টা সত্য। তবে মাদ্রাসার কার্যক্রম শুরু হতে এখনো ঢের বাকি৷ প্রাথমিক বিভিন্ন বিষয় সমাধান করার পর ভর্তিপ্রক্রিয়া শুরু হবে৷ একজন মধ্যবয়সী সম্ভ্রান্ত মহিলা উমাইরার একটা ছোটখাটো ইন্টারভিউ নিয়ে নিলেন। অনেকক্ষণ ভেবে,কয়েকজনের সঙ্গে বৈঠক করে অবশেষে সন্তোষজনক বার্তা দিলেন তিনি। বললেন,
– আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব। যেহেতু বেশ ক’জন আবেদন করেছেন তাই আগামী সপ্তাহে একটা চূড়ান্ত ইন্টারভিউ হবে।
যথারীতি পরের সপ্তাহে ইন্টারভিউ হয়ে গেল। এবং এর তিনদিন পর উমাইরাকে ফোন করে জানানো হলো,সে নির্বাচিত হয়েছে হেফজখানার জুনিয়র মোয়াল্লেমা পদে। আপাতত এক মাসব্যাপী বিভিন্ন প্রচার-প্রচারণা, ভর্তি কার্যক্রম চলবে,এরপরের মাসেই পাঠদান শুরু হবে। হেফজখানার নিয়মকানুন আলাদা। সকাল-সন্ধ্যা-ভোর রাত্রে পালা করে পাঠ নিতে হয়। মাদ্রাসার আশেপাশে কোথাও একা বাসা নেয়াটা উচিত হবে না বিধায় মাদ্রাসার নিচতলায় অন্য একজনের সঙ্গে রুম ভাগাভাগি করে থাকবে। সেরকম কথাবার্তা পাকা হয়ে গেল। যাহোক,পুরো বিষয়টা এতদিন রেজা আর উমাইরার মধ্যেই গোপন ছিল। যে-ই চাকরি নিশ্চিত হয়ে গেল, সঙ্গে সঙ্গেই উমাইরা আবেগে আপ্লুত হয়ে মিষ্টি কিনে নিয়ে গেল বাসায়। কিন্তু পারভীন ছাড়া আর কেউ তেমন একটা খুশি হলো বলে মনে হলো না। ঠোঁটের কোণে মাপা হাসি টেনে অভিনন্দন জানিয়েই খালাস।
যদিও বোনকে চলে যেতে হবে বলে রেজার মনে চাপা কষ্ট আছে,তবুও ওর সফলতায় মনটা তার স্বস্তির হওয়ায় ভরে গেল। এতদিন বাবা ভাইয়েরা আড়ালে আবডালে বোনকে নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করত,‘ও করবে চাকরি! ওর মতো মেনিমুখো মেয়েকে কে চাকরি দেবে?’। আজ এসব কথার উচিত জবাব হয়েছে।
সপ্তাহখানেক পরে একদিন শাহনাজ পারভীন মেয়েকে নিভৃতে ডেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলার মতো করে বললেন,
– শুন,তানভীরকে তোমার কেমন লাগে?
উমাইরার বুকের তলটা আপনাআপনি ঝিমঝিমিয়ে উঠল যেন। না,কোনো অনুভূতির হুড়োহুড়ি নয়,বরং কেমন যেন একটা ভয় আর শঙ্কা কাজ করল হঠাৎ। শরমিন্দা স্বরে সে বলল,
– কেমন লাগবে আবার!
পারভীন চাপা হেসে গোপন করে বললেন,
– আমার তো মনে হয়,ও তোকে পছন্দ করে অনেক!
– করলই বা! আমার কী তাতে।
পারভীন এবার ফিক করে হেসে দিলেন,
– পাগলী মেয়ে! ও এখান থেকে গিয়ে ওর মা’কে পাগল করে ফেলছে। ওর মা ছবিতে তোমাকে দেখে ভীষণ পছন্দ করেছে। কাল আসবে এখানে,সরাসরি দেখতে। —কী ওমন করে তাকিয়ে কেন? এখন তো আমিই তোর অভিভাবক। আর তাছাড়া তানভীর কি ছেলে খারাপ? সবদিক দিয়ে সরস।
উমাইরার আর কিছু বলার থাকে না। মানুষ হিসেবে তো ছেলেটা খারাপ বলা চলে না।শুধু একটু দুনিয়ামুখী,বেনামাজি তথা ধর্মীয় বিষয়াদি নিয়ে চরমভাবে গাফেল, যেমনটা বর্তমানের সিংহভাগ তরুণ হয়ে থাকে। অন্যদিকে, উমাইরা হাসনাত যেন ঠিক বিপরীত মেরুর একজন। দিনরাত্রি কেবল দুনিয়াবি সুখ-ঐশ্বর্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকা তানভীরকে সে কীভাবে সাদরে নিজের করে নেবে! এইতো দু-তিনদিন আগে একটু অবসরে রেজার ফোনে ফেসবুকিং করতে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়ল তানভীরের একটি পোস্ট। চলমান কোনো বিষয় নিয়ে তার অগ্নিঝরা লেখা সরাসরি উমাইরার আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। লেখাটা আগাগোড়া পড়ে সর্বাঙ্গ জ্বলে গিয়েছিল তার। এরপর নিতান্ত কৌতুহলবশত তানভীরের ফেসবুক প্রোফাইল ঘুরে এসেছিল উমাইরা। ঘুরে ঘুরে এটুকু স্পষ্ট হয়েছিল যে, মানুষটা নিজের চারপাশে সভ্যতা,আধুনিকতা,ও মুক্তচিন্তার নামে নিজের আসল পরিচয়কে ম্লান করে রেখেছে। বন্ধুমহলের বড় একটা অংশ মেয়ে। সেই বন্ধুদের সঙ্গে সে নিয়ম করে আড্ডা দেয়,হেসে গড়াগড়ি খায়,মধ্যে-মধ্যে দেশের আনাচে-কানাচে থাকা দর্শনীয় স্থান ঘুরে আসে। একটা সময় প্রেমিকাও ছিল,এখন নেই। বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। দেখতে দেখতে হাঁপিয়ে উঠেছিল উমাইরা। সবকিছু এখন চোখের সমুখে মূর্তিমান আতঙ্কের মতো ভাসতে লাগল। কিন্তু মাকে বলতে পারল না কিছুই। বললেও বুঝতে পারবে না। সবকিছু তো এদের নাকের ডগাতেই হচ্ছে! বলারই-বা কী বাকি আছে!
পরেরদিন সত্য সত্য তানভীরের মা চলে এলেন উমাইরাকে দেখতে। মহিলাকে ভালোই লাগল তার। বিদুষী,মিষ্টভাষী, এবং প্রচণ্ড আন্তরিক।অল্প সময়ের নিরিখে তাঁকে পর্যালোচনা করে কিছুটা রক্ষণশীল মনোভাবাপন্ন বলে মনে হলো। ছেলের জন্য উমাইরার মতো মাদ্রাসা-পড়ুয়া সাতেপাঁচে না থাকা মেয়েকেই তিনি খুঁজছেন। কিন্তু ছেলেটা বড় হয়েছে শহুরে হাওয়ায়। এমন পর্দানশিন, ঘরঘেঁষা মেয়েদের তার চোখে লাগবে কেন! কিন্তু অবশেষে বাছাধন এমন মেয়ের মায়াতেই আটকে গেছে। আটকাবেই বা না কেন! কী মিষ্টি মিষ্টি মায়াময় চেহারা৷ যেকোনো মা-ই তো এমন মেয়েকে ঘরের বউ বানানোর জন্য উঠেপড়ে লাগবে৷ হলোও তাই৷
৫
একটা জনবিরল ছাদখোলা রেস্টুরেন্টে অনেক্ষণ যাবৎ বসে আছে উমাইরা। আজ দুই পক্ষের সম্মতিতেই তানভীরের সঙ্গে তার আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ হবার কথা। ইসলাম ধর্মে এই সাক্ষাতের সুস্পষ্ট বৈধতা থাকায় উমাইরা নেকাব খুলে বসেছে৷ মনে মনে একটা কথা ভেবে হাসল,আজতক লোকটা তার মুখদর্শন করে বিশেষ সুবিধে করতে পারেনি। যখনই ওর তৃষ্ণার্ত চোখদুটি উমাইরার আশপাশে ঘুরে ফিরত তখনই সে বাইন মাছের মতো পিছলে বেরিয়ে গেছে দৃষ্টিসীমা ছেড়ে। আরো বেশ কিছুক্ষণ পর তানভীর এলো। উমাইরা মনে মনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সালাম দিল। তানভীর অনর্গল বলে যেতে লাগল,কেন তার এতো দেরি হয়েছে। সবশেষে বলল,
– তুমি রাগ করোনি তো?
– না।
– বেশ৷ বলে সটান বসে বড় নিশ্বাস ফেলল সে। পরক্ষণেই ঈষৎ ঝুঁকে বলল,
– বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে তোমাকে৷ সেজেছ নাকি! মনে হচ্ছে ঠোঁটে একটু লিপজেল পড়েছে। তাই তো! সূর্য কোনদিকে উঠল আজ।
উমাইরা এবার একটু রাগান্বিত হলো। সাজগোছ জিনিসটা তার ধাতে নেই। আজকের মতো বিশেষ দিনেও সে সাজেনি,সাজবার মতো কিছুই হয়নি। উমাইরার বিরক্তি বুঝতে পেরে সে আবার বলল,
– আচ্ছা মূল কথায় আসি।
– হু প্লিজ।
– আমি তোমাকে পছন্দ করি,বলতে দ্বিধা নেই,ভালোবেসে ফেলেছি। গত পনেরদিন আমি…। কিন্তু তোমার দিকটা তো এখনো অস্পষ্ট। আন্টি বলছে,বিয়েতে তুমি হাঁ না কিছুই বলছ না। এটা কেমন হলো?
– আপনাকে আমার কিছু বলার আছে।
তানভীর গুরুত্বসহকারে কপাল কুঁচকে বলল,
– নির্দ্বিধায় বলো।
– আমি অনেক ভেবে দেখেছি৷ আপনি মানুষটা ভালো। কিন্তু,কিন্তু আমার মতাদর্শের সঙ্গে আপনার মতাদর্শে অনেক অমিল আছে৷ আমি আশঙ্কা করছি, ভবিষ্যতে এটা ভালো কিছু বয়ে আনবে না।
– মানে,বুঝিনি তোমার কথা।
– মানে,আপনার লাইফস্টাইল আর আমার লাইফস্টাইল সম্পূর্ণ আলাদা৷ হয় আপনাকে আমার সঙ্গে সমতা রেখে চলতে হবে,নয়তো আমাকে আপনার সঙ্গে। কিন্তু আমার দিকটা পরিষ্কার। আমি সিরাতুল মুস্তাকিমের পথে আছি,আলহামদুলিল্লাহ। এখন আপনি…
– মানে,তুমি আমাকে বলছ৷ আমাকেও তোমার মতো হুজুর হয়ে যেতে হবে!
তানভীরের কণ্ঠের ধারটা দুর্বোধ্য ঠেকল উমাইরার কানে৷ রাগ,ক্ষোভ,অপারগতা কিছুই যেন প্রকাশ পেল না তার কথার ব্যঞ্জনায়। উমাইরা বলল,
– একজন আদর্শ স্ত্রী কখনো চাইবে না তার স্বামী পরনারী নিয়ে ঘুরে বেড়াক,অন্ধকার,উদ্দেশ্যহীন পথে হেঁটে জীবনের শেষ টানুক। এই জীবনের পরে যে স্থায়ী জীবন, সেই জীবনেও সে স্বামীকে চাইবে৷ কিন্তু স্বামী যদি দুনিয়ার লোভ-লালসার ডুবে থাকে…।
– সোজাসাপটা কথা বলবে প্লিজ? তুমি কী চাইছ? বিয়েটা না হোক? আমি কোনদিক দিয়ে তোমার অযোগ্য, বলো?
-বলেছিই তো, আপনার পার্থিব যোগ্যতা আমার কাছে কিছু নয়। শেষ কথা হলো,আপনি নিজেকে পরিবর্তন করে আসুন। দুনিয়ার মোহ ভুলে একটু রবের দিকে ফিরুন। এর যা হয় হবে। আমি অপেক্ষা করতে রাজি আছি। আসি এখন৷ ভালো থাকবেন।
উমাইরা নেকাবে মুখ ঢেকে প্রস্থানোদ্যত হলো। তানভীর ওকে ডাকল পিছন থেকে,
– শুনো,তুমি সত্যিই অপেক্ষা করবে?
উমাইরা উপরে-নিচে মৃদু মাথা ঝাঁকাল।
– তাহলে আমিও পরিবর্তন হয়ে তোমার সামনে হাজির হবো। তখন কোনো অজুহাত দেখাতে পারবে না!
– আমি কথা দিয়ে কথা রাখি।—শয়তানের ফাঁদে পা দেবেন না।
উমাইরা চলে গেল। তানভীর সেখানে অনেকক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইল। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভেবে দেখল,উমাইরা এতক্ষণ যা যা বলেছে সব সত্য। দু’জন দুমেরুর মতাদর্শের মানুষের মিলন এতটা সহজ নয়। জোরপূর্বক মিলিয়েও যদি দেওয়া হয় সেই মিলনে সুখ নেই। একটা সময় শেষে দু’জনের বুকে ঘনীভূত হতে থাকবে একরাশ বিতৃষ্ণা,হতাশা আর সীমাহীন বৈপরীত্য। দিনকয়েকের দর্শনে উদ্ভুত ভালোবাসার বুদবুদ—একসময় হৃদয়ের হাড়িতেই স্তিমিত হয়ে পড়ে থাকবে।
এই সাক্ষাতের দিনদশেক পেরিয়ে গেল। সেদিনের পর থেকে তানভীর বা তার পরিবারের দিক হতে কোনো উচ্চবাচ্য পাওয়া যায়নি। চিন্তিত হয়ে পারভীন অবশেষে তানভীরের মাকে চেপে ধরলেন ঘটনা কি জানার জন্য। তিনি জানালেন,তানভীর নাকি আচমকা মত পাল্টেছে। আপাতত বিয়ে নিয়ে আর আগাবে না। আরো কিছুদিন সময় চায়। পারভীন গন্ধ শুঁকে এসে ধরলেন মেয়েকে। উমাইরা এতদিন সবকিছু গোপন করলেও আজ আর বহাল থাকতে পারল না৷ চাপে পড়ে অগত্যা বলে দিল, সেদিনের আলাপে কী কী কথা হয়েছিল! সমস্ত শুনে শাহনাজ পারভীন তো রেগে একসা হলেনই নিজের সৎপুত্র এবং স্বামীকেও সমস্ত ঘটনা বলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তুললেন। প্রথম দিকটায় এই সম্মন্ধে ওরা নাখোশ থাকলেও পরে তানভীরদের সঙ্গে সম্পর্ক পাকাপোক্ত করতে মোটামুটি সবাই এই বিয়ে নিয়ে আশাবাদী ছিল। কেন তা অজানা ছিল উমাইরার কাছে। আজ বেরিয়ে এল থলের বেড়াল। শুধু আশাবাদীই ছিল না, এই বিয়ে দিয়ে একপ্রকার লেনদেনের দায়মুক্ত হতে চেয়েছিলেন সবাই। তানভীরের বাবার কাছে মহিউদ্দিন সাহেবের আকাশচুম্বী ঋণের বোঝা। বছরের পর বছরে সেইসব ঋণ সুদে-আসলে বাড়তে বাড়তে এমন একটা পরিমাণে এসে দাঁড়িয়েছে যা শোধ করা মহিউদ্দিন সাহেবের পক্ষে অসম্ভব। কাজেই বিয়েটা হতে পারত দায়মুক্তি দারুণ একটি মাধ্যম। অথচ সেটি কিনা ভেস্তে দিল এই মেয়েটি! আপন মা থেকে শুরু করে সৎভাই,সৎবাবার খরশাণ কথার শর উমাইরাকে অনবরত বিদ্ধ করে ক্ষতবিক্ষত করতে লাগল। কিন্তু কোনো কথার প্রতুত্তরে একটি কটুকথা বেরোল না উমাইরার মুখ দিয়ে। আঘাতগুলো নীরবে হজম করে নিজের ঘরে ফিরে গেল সে। কী মর্মন্তুদ কাকতালীয় ব্যাপার! আপন মানুষগুলোই বারবার তাকে পুঁজি করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে চাইছে! স্বার্থসিদ্ধির পর রুদ্ধ হয়ে গেলে পদাঘাতে দূরে ঠেলে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করছে না। নিজের নিয়তির কথা ভেবে একটা বাষ্পীত দীর্ঘশ্বাসের সাথে ফোঁটায় ফোঁটায় তপ্ত অশ্রু বিসর্জন দিল উমাইরা৷ দুই করতলে কপোলের ওপর বৃষ্টিফোঁটার মতো অশ্রুবারি মুছে বিড়বিড় করে সে উচ্চারণ করল,
ফাইন্না মা‘আল ‘উছরি ইউছরা
ইন্না মা‘আল ‘উছরি ইউছরা-।
(কষ্টের সাথেই তো স্বস্তি আছে।
অবশ্যই কষ্টের সাথে স্বস্তি আছে।)
সকালে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ব্যাগে ভরে প্রস্তুত হয়ে নিল উমাইরা। মাদরাসার বড় আপাকে বলে-কয়ে সেখানে থাকার জায়গাটা পাকাপোক্ত করে ফেলেছে সে। মাদরাসার কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় সাময়িক অসুবিধা হবে বটে,নিজেকেই পাক করে খেতে হবে,একলা থাকতে হবে; আরো কত কি! তবুও ভালো।এই বাড়িতে আর একদণ্ডও নয়। সতের বছর পর মা’কে পেয়ে তার আপনই মনে হয়েছিল,অথচ সেই মাও যে মেয়েকে পুঁজি করে স্বার্থোদ্ধত হবে এতটা আশা করেনি সে। হ্যাঁ নাড়িছেঁড়া ধন বলে সূক্ষ্ণ টান হয়তো-বা আছে,কিন্তু সেই টান উমাইরকে ধরে রাখার জন্য কাফি নয়। যে মা উমাইরার কথা না ভেবে, কোনোপ্রকার সমঝোতায় না এসে বাবার সঙ্গে জেদাজেদি করে সংসার ভেঙে তাকে অকূলপাথারে ভাসিয়ে দিয়ে এসেছিল সেই মা থেকে বাড়তি কিছু আশা করাটাই ছিল বোকামি।
ওরা ডাইনিং-এ ব্রেকফাস্ট করছিল। রোজ কেউ না কেউ এসে উমাইরাকে ডাকে,আজ ডাকেনি। গাঁটরি-বোঁচকা নিয়ে উমাইরাকে বেরুতে দেখে সবাই একযোগে সেদিকে তাকাল। ডাইনিংএর অদূরে দাঁড়িয়ে উমাইরা হাসিমুখে বলল,
– মা, আমি যাচ্ছি।
সালমান আর মহিউদ্দিন সাহেব ঠোঁটের কার্নিশে বিরক্তির রেশ জাগিয়ে চোখ ফিরিয়ে খাবারে মনোযোগ দিলেন। রেজা হাঁ করে তাকিয়ে রইল। পারভীন উৎকণ্ঠিতভাবে বললেন,
– মানে? কোথায় যাচ্ছ?
– মাদ্রাসায়। ওখানেই থাকব।
পারভীন আথালিপাথালি করে উঠে দাঁড়িয়ে মেয়ের কাছে এসে বললেন,
– মা আমার। রাগ করে চলে যাচ্ছিস! এতবছর পর তোকে পেয়ে…
কেন জানি মা’কে আঘাত দিতে ইচ্ছে হলো না উমাইরার। অনেক কষ্ট করে মিথ্যাটা বলে ফেলল সে,
– না রাগ করব কেন? মাদরাসা থেকে ফোন করেছে। নতুন চাকরি তো,কীভাবে পড়াতে হবে সেটা নিয়ে কয়েকদিন একটু ট্রেনিং হবে।
– ওহ,আচ্ছা আয়। কিছু খেয়ে তারপর যা।
– না,আমার সময় কম। বলে সালমান আর মহিউদ্দিন সাহেবের উদ্দেশ্যে বলল,
– এতদিন আমাকে এখানে জায়গা দিয়েছেন,এরজন্য আমি কৃতজ্ঞ। রেজা—যাই হ্যাঁ? তোমার কোরআন পড়া শুদ্ধ হয়েছে মোটামুটি। প্রেকটিস কোরো,নয়তো আবার ভুলে যাবে।
এতটুকু বলে মা’কে আলতো করে জড়িয়ে ধরে আর কোনো বাতচিত না করে প্রস্থান করল উমাইরা।
মাসখানেক বাদে হেফজখানার পাঠদান শুরু হলো পুরোদস্তুর। নানারকম সুযোগসুবিধা ও সর্বাধিক নিরাপত্তা থাকায় প্রাথমিক পর্যায়েই একশ জন ছাত্রী ভর্তি হয়েছে। এখন উমাইরার দিনমান কাটে এদের পেছনে পরিশ্রম করে। পাঠদান ছাড়াও হরহামেশা এদের সঙ্গ দিয়ে নিজের বেদনার্ত অতীতকে ভুলে যেতে চেষ্টা করা সে। চেষ্টা বিফলে যায় না। যতক্ষণ এই পবিত্র বাচ্চাগুলোর সান্নিধ্যে সে থাকে,পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখী ও ভাগ্যবান মানুষ মনে হয় নিজেকে। কোনো দুঃখ,হতাশা পুরনো বিশ্বাসঘাতকতার মরমি চিহ্ন তা মনকে রেখাপাত করতে পারে না। এমনভাবেই যাচ্ছিল দিন। হঠাৎ একদিন ওর গৎবাঁধা জীবন-তরীর পালে একটু বৈরি হাওয়া লাগল। কুরিয়ার সার্ভিস থেকে ওর ঠিকানায় একটা ডকুমেন্টস এলো৷ সময় করে সেটি নিয়ে এসে খুলে দেখল একটি চিঠি। তানভীরের চিঠি। তাড়াতাড়ি পড়া শুরু করল উমাইরা।
‘উমাইরা,ভালো আছো অবশ্যই। ভালো না থাকার কারণ নেই। শুনতে খারাপ লাগলেও সত্যি যে,দুনিয়াতে একা মানুষগুলোই দিনশেষে ভালো থাকে। ওদের থাকে না কোনো পিছুটান, কোনো বিশ্বাসঘাতকতার আশঙ্কা। আরো অনেকভাবে ব্যাখ্যা করা যায় এই কথাটিকে। কিন্তু তুমি বিরক্ত হবে বলে আর কথা বাড়ালাম না। গত দেড়মাস যাবৎ আমি কেবল ভেবে যাচ্ছি, তোমার শর্তে আমি কেন রাজি হলাম? যে শর্ত পুরন করার সাধ্য আমার নেই! বিশ্বাস করো আর না-ই করো,এতটা আবেগি আমি কখনোই ছিলাম না। কিন্তু তোমাতে আমি এতটাই মজে গিয়েছিলাম যে,আমি আমার নিজেকে হারাতে বসেছিলাম। দিন গেছে। আমার আকাশের বুক থেকে তোমার মোহের কুহেলিকাও দ্রুত কেটে গেছে। রয়ে গেছে শুধু ভক্তি,ভালোবাসা আর বুকজুড়ে কেমন একধরণের চিনচিনে ব্যথা। কিন্তু আমি অনুধাবন করতে পারছি,এই ভালোবাসার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। আমি লাইফটাকে তোমার মতো করে দেখি না,দেখতে পারছি না,কখনো পারবও না। আমি ধর্মের জিঞ্জিরে আবদ্ধ হতে চাই না,আমি মুক্তবিহঙ্গের মতো আকাশময় উড়ে বেড়াতে চাই। যাদেরকে তুমি ‘পরনারী’ বলেছ ওরা আমার দশ বছরের পুরনো বন্ধু। আমার সুখে-দুঃখে ওরা আমার পাশে ছায়ার মতো ছিল। তোমার ধর্মীয় দৃষ্টিকোণকে আমি শ্রদ্ধা করি অবশ্যই,কিন্তু—আমার পক্ষে সম্ভব নয় তোমার মনের মতো হয়ে তোমাকে গ্রহণ করে নিজের পৌরুষকে অপমান করা। এই আত্মম্ভরি আমাকে ক্ষমা না করলেও চলবে। আমার জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। তুমি নিজের জীবনটা নিজের মতো করে সাজাও।
পুনশ্চঃ তুমি হয়তোবা জানো আমার একটা পুরনো রিলেশন ছিল। আমাদের মধ্যে আবার সমঝোতা হয়েছে। ও নিজেই ফিরে এসেছে। আমরা বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের জন্য দোয়া রেখো।
ইতি,
পাপিষ্ঠ, নরাধম
তানভীর আজাদ।
চিঠিটা আগাগোড়া দু’বার পড়ে মিনিটকয়েক অনুভূতিহীনভাবে ঠোঁট কামড়ে বসে রইল উমাইরা। এরপর ধীরে ধীরে দুমড়েমুচড়ে সেটি কাগজ-ফেলা ঝুড়িতে ফেলে দিয়ে হেসে উঠল আপনমনে।
.
.
.
.
পরিশিষ্ট
পাঁচ বছর পরের কথা। ঈদুল আযহার ছুটিতে শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছিল উমাইরা। সঙ্গে আছেন স্বামী ডা. মাজহাুরুল ইসলাম এবং তাদের তিন বছরের কন্যাশিশু উরাইফা। উমাইরা আর কন্যাকে বাসে নির্দিষ্ট আসনে বসিয়ে দিয়ে মাজহারুল গিয়েছেন কিছু শুকনো খাবার নিয়ে আসতে। দুরন্ত কন্যাকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে উমাইরা উন্মনা হয়ে ফিরে গেল চারবছর আগে। ততদিনে সে হেফজখানায় নিজের অবস্থানটা দারুণভাবে পাকাপোক্ত করে নিয়েছিল। মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতার স্ত্রী ছিলেন হেফজখানার সার্বিক তত্ত্বাবধানে। উমাইরার পরিশ্রমি মনোভাব এবং আত্মনিবেদিত কর্মযজ্ঞের কারণে তিনি বেজায় পছন্দ করতেন তাকে। ধীরে ধীরে তিনি নিজের স্নেহডোরে বেঁধে নিলেন উমাইরাকে। একটা সময় গিয়ে মনের আকাঙ্ক্ষিত অভিলাষ প্রকাশ করলেন৷ নিজের ভাইয়ের জীবনসঙ্গিনী হিসেবে তিনি উমাইরাকে চান। তাঁর ভাই ডাক্তার হলেও পরিবারের ঐতিহ্য ধরে রেখে পুনরায় আলেম হবার জন্য পড়াশোনা শুরু করেছেন। এরপরের ঘটনা বলাবাহুল্য। মাজহারুল যেমন উমাইরাকে পছন্দ করেছে তেমনি উমাইরাও মানুষটার আকাশচুম্বী ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে বিয়েতে সম্মতি দিয়ে দিয়েছিল।
অনেকক্ষণ পর ফিরলেন তিনি। উমাইরা বলল,
– ওমা এতক্ষণ লাগল! আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম! গাড়ি তো ছেড়েই দিয়েছিল প্রায়। কোথায় গিয়েছিলেন?
মাজহারুল আরাম করে বসে বলল,
– কই আর যাব। এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা। হঠাৎ বলল,আমাকে নাকি চেনে! আমি বাবা নগন্য মানুষ। ডাক্তারি করে খাই। আমাকে চেনার কী আছে!
– পরে?
– পরে আর কী৷ আমি জিজ্ঞেস করলাম,কীভাবে চেনেন? পরে তোমার কথা বলল,তার সঙ্গে তোমার বিয়ের কথা ছিল। যার কথা তুমি বিয়ের আগেই আমাকে জানিয়েছিলে,তানভীর না কী যেন নাম!।
উমাইরার দম বন্ধ হয়ে যেতে চাইল উত্তেজনায়। এই লোকটা তার জান্নাতের টুকরোর মতো নির্মল-স্বচ্ছ সংসারে আবার কোনো ঝামেলা পাকাল না তো! সোৎসুক দৃষ্টিতি তাকিয়ে রইল সে। মাজহারুল বলতে যেতে লাগলেন,
‘যাইহোক,সৌজন্যতা দেখিয়ে আমিও হালহকিকত জিজ্ঞেস করলাম। সেও হড়হড় করে আমাকে সব বলে দিল। যে প্রেমিকাকে বিয়ে করেছিল তার সঙ্গে নাকি ডিভোর্স হয়ে গেছে এক বছরের মাথায়। এরপর আর বিয়েসাদী করেনি৷
উমাইরা গম্ভীর হয়ে বলল,
– হুমম।
– কিন্তু ভালো খবর হচ্ছে যে,সে এখন পুরো চেঞ্জ হয়ে গেছে। পুরোদস্তুর মাওলানা সাব। কথায় কথায় আল্লাহর নাম নেয়৷ আমাকে বলল,সেও আমার মতো আবার দ্বীনি লাইনে পড়াশোনা করতে চায়। কীভাবে শুরু করা উচিত। আমি বলে দিয়েছি,যেকোনো সময় আমি তাকে হেল্প করতে প্রস্তুত।
উমাইরা যারপরনাই অবাক হয়ে বলল,
– কীভাবে হলো এত পরিবর্তন?
– সেটাও বলেছে। ডিভোর্সের পর মদটদ নিয়ে পড়ে থাকতো। নিজের জীবন নিয়ে বিতৃষ্ণা জেগে গিয়েছিল। সেই সময় এক মুরব্বি তার পেছনে নিয়মিত দাওয়াত দিয়ে মেহনত করেছে। একসময় সে গলে গেছে। সত্যের কাছে মাথা নত করেছে। একবার এক হুজুরের মুখে একটা কথা শুনেছিলাম,
“দিল যদি না ভাঙ্গে তবে ইবাদতের স্বাদ কিভাবে ঢুকবে?” ওর বেলায়ও তাই ঘটেছে।
অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না। কিছু একটা সমস্যার কারণে বাস ছাড়তে দেরি হচ্ছে,হট্টগোল হচ্ছে ড্রাইভারে আর প্যাসেঞ্জারে। উমাইরা বিরক্ত হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টিপাত করতেই দেখল, দূরের ভিড় হতে একজোড়া চোখ তার দিকে শান্তভাবে তাকিয়ে আছে। ঠিক তাকিয়ে নেই—যেন হঠাৎ করে দেখতে পেয়ে থমকে গেছে। চোখাচোখি হতেই বিব্রত হয়ে অপরাধমাখা দৃষ্টি নামিয়ে লোকটা নিমিষেই হারিয়ে গেল স্টেশনে লোকারণ্যে। উমাইরা ধীরে ধীরে স্বামীর হাতটা নিজের হাতে পুরে নিয়ে কম্পিত গলায় বলল,
– আপনার মনে কি কোনো সন্দেহ আছে?
মাজহারুল মুচকি হেসে বললেন,
– একফোঁটাও না৷
– আমাকে বিশ্বাস করেন?
– সেকথা আমার চাইতে তুমিই ভালো জানো।
বাস চলতে শুরু করল ইট-পাথরের যান্ত্রিক শহরের তাবত মলিনতাকে পেছনে ফেলে চিরহরিৎ গাঁয়ের গন্তব্যে। যে গাঁয়ে স্বপ্নের মতো সুন্দর একটি পরিবার তাদের পথ চেয়ে বসে আছে। একটু আগের ছোট্ট অথচ প্রভাবান্বিত ঘটনাটি বেমালুম ভুলে গিয়ে ওরা দুজন সদ্য বুলি-ফোঁটা কন্যাকে নিয়ে আহ্লাদীপনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
(সমাপ্ত)
Darun