#সন্ধ্যামালতী
#সূচনা_পর্ব
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
‘কিরে সন্ধ্যা ছে’ড়া শাড়ি পড়ে কি সবাইকে তোর শ’রীর দেখাতে এসেছিস?’
কথাটা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই গা ঘিনঘিন করে উঠলো সন্ধ্যার। ছলছল দৃষ্টিতে তাকায় তার সামনে থাকা ষাটোর্ধ লোকটির দিকে। ঘৃণ্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আশে পাশে তাকালো। চোখ গুলো বারংবার ঝাপসা হয়ে আসছে। তবুও স্পষ্ট দেখতে পায় কয়েকজন তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছা হলো তার। ঠিক সে সময়ই দৌড়ে আসলো সন্ধ্যার সই বকুল। একটা চাদর জড়িয়ে দেয় তার শরীরে। ষাটোর্ধ লোকটি কটাক্ষ করে বললেন,
‘সবাই যা দেখার তা তো দেখছেই এখন আর ঢাইকা লাভ কি!’
সন্ধ্যা মাথা নিচু করে নেয়। চোখ থেকে টপটপ করে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে। বকুল কিছু না বলে সন্ধ্যাকে ধরে নিজেদের ছোট ঘরে নিয়ে যায়। কাঠের চৌকাঠ পেরোতেই পেছন থেকে হাসাহাসির শব্দ ভেসে আসে। সন্ধ্যা শব্দ করে কেঁদে দেয়। বকুল নিজের সাথে জড়িয়ে নেয় তাকে। তারপর বলে,
‘তুই ছে’ড়া শাড়ি পইড়া আসছিস কেন?’
সন্ধ্যা হিচকি তুলতে তুলতে বলে, ‘আমি ছেড়া শাড়ি পড়ি নাই। আম্মা আমারে নতুন শাড়ি নিয়া দিছিলো তোর বোনের বিয়ের জন্য। আমি সুন্দর করেই পইড়া আসছি। কিন্তু…
‘কিন্তু কি?’
‘ওই যে ফরিদ কাকা উনি পেছন থেকে আমার শাড়ি টান মারছে আর আমিও এগোতে লাগছি তখন পেট আর পিঠের কাপড় ছি’ড়ে গেছে।’
বলেই হু হু করে কাঁদতে থাকে সন্ধ্যা। বকুলের আর কিছু বুঝতে বাকি নাই। বাহিরে যে লোকটা সন্ধ্যাকে এতো কথা শুনাালো তিনিই ফরিদ কাকা। তিনি এতো জ’ঘন্য কাজটা করে আবার বড় গলায় অপমানও করলেন। রাগে শরীর রি রি করে উঠলো বকুলের। তবুও নিজেকে সামলে সন্ধ্যাকে বললো,
‘চাচি কখন আসবে রে?’
‘আম্মা তো আরো পরে আসবে।’
‘তুই ততক্ষণ আমার সাথে থাক। চাচি আসলে বাড়ি চলে যাইস।’
সন্ধ্যা মাথা নাড়ায়। বকুল সন্ধ্যার পাশে কিছুক্ষণ বসে থেকে বাহিরে একটা মেয়েকে ডেকে তার পাশে বসিয়ে দেয়। একটু পরই ছুটে আসে সন্ধ্যার মা সাহেদা। এসেই মেয়েকে জাপটে ধরে। মাথার ওপর একটা বটগাছ না থাকলে বুঝি এমন করেই শকুনরা দৃষ্টি দেয়। সন্ধ্যা মায়ের বুকে মুখ গুজে দিয়ে ছোট্ট পাখির মতো চুপটি করে থাকে। সাহেদা একটা থ্রি পিস এগিয়ে দেয় মেয়ের দিকে। চোখ তার জলে টুইটুম্বর। মেয়েকে কাপড় পড়তে বলে তিনি বাইরে এসে দাঁড়ায়। চোখের কোণা বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। মেয়েটার দিকে যে কত শকুনের দৃষ্টি পড়েছে তা ভাবলেই গা শিউরে উঠে। সাহেদার স্বামী মারা গেছে প্রায় ৩ বছর আগে। শহরে গেছিলো ব্যবসা করতে। ফিরার সময় ট্রাকে চাপা দেয়। সেসময় থেকেই মেয়েকে নিয়ে তার একলা পথ চলা। সন্ধ্যা যখন জন্ম নেয় তখন ছিলো ভর সন্ধ্যা। পুরো বাড়ি সন্ধ্যামালতীর গন্ধে ভরা ছিলো। তাই ফুটফুটে চাঁদের মতো সুন্দর মেয়েটার নামও তারা রেখেছিলো সন্ধ্যামালতী। সন্ধ্যা এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। গ্রামের মেয়েদের সাধারণত এসএসসি পাশের সুযোগও হয় না। কিন্তু সাহেদা নিজের মেয়েকে বিয়ের পিড়িতে বসায়নি। গ্রামের কত লোক খারাপ প্রস্তাব দেয় তবুও মাথা উচিয়ে নিজের সম্মানটুকু ধরে রেখে মেয়েকে নিয়ে বেঁচে আছে। কিন্তু এই শকুনগুলোর চোখ থেকে কি সে আদৌও পারবে মেয়েটাকে বাঁচিয়ে রাখতে? আজ কি কি হয়েছে সবটা শুনেছে সাহেদা। মেয়েকে নিয়ে সে রীতিমতো আতঙ্কে আছে। তার ভাবনার মাঝেই সন্ধ্যা ডাক দেয়। সাহেদা সন্ধ্যাকে নিয়ে বকুলের মায়ের কাছে যায়। বকুলের মা’কে ডেকে বলেন,
‘ভাবি আমি মাইয়া ডা রে নিয়া বাড়ি যায়। আইজ যা হইলো…
বকুলের মা মাথা নিচু করে নেয়। তার বাড়িতে এমন একটা কাজ হবে ভাবতেই পারেননি তিনি। বকুলের মা বললেন, ‘আরেকটু থাইকে যান ভাবি।’
সাহেদা হাঁসার চেষ্টা করে বললেন, ‘না ভাবি। আব্বা ঘরে একা। যায় আমরা।’
সাহেদা আর দাঁড়ালো না। সন্ধ্যাকে নিয়ে হাঁটা দিতে লাগলেই হাজির হয় বকুলের ভাই বাদল। এগিয়ে এসে বলে, ‘কাকি চলেন এগিয়ে দিয়ে আসি।’
সাহেদা আর কথা বাড়ালো না৷ বাদলের সাথেই সন্ধ্যাকে নিয়ে নিজের বাড়ি পর্যন্ত আসে৷ বাড়িতে ঢুকতে নিলে আটকায় বাদল। মাথা নিচু করে বলে, ‘কাকি আজ যা হলো তার জন্য মাফ করবেন। আমরা কেউ ভাবতে পারিনি এমন হবে তাছাড়া আমি সেসময় বাড়িতে ছিলাম না।’
‘তোমাগো তো দোষ নাই বাজান। বাড়ি যাও। দেইখা-শুইনা যাইয়ো।’
বাদল মাথা নাড়িয়ে উল্টো পথে হাঁটা লাগায়। সন্ধ্যা বাড়িতে ঢুকে প্রথমে দাদার ঘরে যায়। তার দাদা তখন শুয়ে পড়েছে খুপড়ি ঘরে। সন্ধ্যা দাদাকে শুয়ে থাকতে দেখে বলে,
‘দাদা তুমি না খেয়ে শুয়ে পড়ছো?’
সাত্তার সাহেব হাসে। নাতনীটা তাকে বড্ড ভালোবাসে। বয়স তার ৭০ এর কোটরে। অতো কথা কি মনে থাকে তার! উঠে বসে পাশ থেকে চশমা হাতরে চোখে পড়ে। গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে বছর চারেকের মতো। তাদের ঘরেও বিদ্যুৎ আছে। বিদ্যুৎ এর আলোতে পুরো ঘর আলোকিত হয় আছে। সন্ধ্যা দাদার পাশে বসে বলে,
‘চলো খেয়ে নিবে।’
‘তোরা না বিয়া খাইতে গেলি! চইলা আইলি কেন বইন?’
মুহুর্তেই মন খারাপ হয়ে যায় সন্ধ্যার। এর আগেও ফরিদ কাকা তার সাথে এরকম করার চেষ্টা করেছিলো। স্কুলে যাওয়ার পথে ওড়না টেনে ধরতো একা পেলে। ভয়ে আর একা কখনো স্কুলের দিকে পা বাড়ায়নি সন্ধ্যা। সন্ধ্যার ভাবনার মাঝেই সাহেদা ডাক দেয় দুজনকে। তারপর সবাই মিলে খেয়ে ঘুমাতে যায়। পাশাপাশি অনেকগুলো বাড়ি থাকায় সাহেদার ভয় লাগে না আর। প্রথম প্রথম শ’কুনরা উৎ পেতে থাকতো এখন অবশ্য কেউ থাকে না।
______________
রাত মিলিয়ে ভোর হলো। সকালের স্নিগ্ধ বাতাস গায়ে লাগাতে সন্ধ্যা নামাজ পড়ে ঘর থেকে বের হয়েছে। চারপাশে গোলাপ ফুলের সমাহার। কিছু কিছু ফুলের মিষ্টি গন্ধে ছড়িয়ে আছে চারিপাশ। সাহেদা একবার মেয়ের মতিগতি দেখে উঠোন ঝাড়ু দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। একটু পর পর মেয়ের দিকে তাকাচ্ছেন তিনি। সন্ধ্যা সুযোগ বুঝে বাড়ির বাইরে পা দিতে নিলেই হুংকার ছাড়ে সাহেদা। সন্ধ্যা ভয়ে থতমত খায়। সাহেদা এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
‘এই সক্কাল বেলা বাইরে যাস কেন? খবরদার আর এক পা আগাইলে তোর খবর আছে।’
সাহেদার এগিয়ে আসতে দেড়ি কিন্তু সন্ধ্যার দৌড় দিতে দেড়ি নাই। গ্রামাঞ্চলের মেয়েরা চটপটে হয় বেশি। গ্রামের সকাল ৬ টা মানেই লোকজব নিজেদের কাজে ব্যস্ত। সাহেদা পেছন থেকে বকলেও সন্ধ্যা দৌড়ে চলে আসে। বকুলদের বাড়ির সামনে এসে হাঁক ছাড়ে। বকুল বের হয়ে এসে দেখে সন্ধ্যা দাঁড়িয়ে আছে। কোমড়ে হাত রেখে বলে,
‘এই সক্কাল সক্কাল তুই বাইর হইছিস কেন?’
সন্ধ্যা দু’পা এগিয়ে আসে বকুলের দিকে। ফিসফিস করে বলে, ‘পেছনের বাগানটাই ডাসা ডাসা পেয়ারা হয়েছে। চল না সই।’
বকুল কিছু বলার আগেই পেছন থেকে বাদল বলে, ‘এই সকাল সকাল যদি দেখি দুইটা মিলে চু’রি করতে যাচ্ছিস তাহলে খুব খারাপ হয়ে যাবে।’
সন্ধ্যা ঢোক গিলে। বাদল ভাইকে সে ভীষণ ভয় পায়। যেমন তার রাগ তেমন তার গাল ফুলানো মুখ। দেখলে মনে হয় হাসতে জানে না। হুহ! সন্ধ্যা বকুলের হাত ধরে ছুট লাগালো বাদলকে পাত্তা না দিয়ে। বাদল আহম্মকের মতো সেদিকে তাকিয়ে রয়। এ মেয়ে কি তাকে ভয় পাই না? এ কেমন দস্যি মেয়ে! বকুল আর সন্ধ্যা পেছনের বড় বাগানটাই এসে দাঁড়ায়। বকুল ভয়ে বলে,
‘এইটা কি করলি তুই? বাড়ি গেলে তো ভাই এখন বেদম কে’লানি দেবে। মা’র গুলো তো আর তুই খাবি না।’
সন্ধ্যা মুখ বাকিয়ে বলে, ‘কচু। কিছু করবে না তোর ভাই। শুধু ভয়-ই দেখায়।’
তারপর বকুলকে পাত্তা না দিয়ে গাছ বেয়ে উঠতে থাকে। পেয়ারা হাত পেয়ে বলে, ‘কিরে বকুল আসবি নাকি নিচে ফেলবো?’
‘আজ আর গাছে উঠবো না। তুই নিচে ফেল।’
সন্ধ্যা পেয়ারা খেতে খেতে ধপ করে নিচে ফেললো। যেখানে ফেলেছে সেখান থেকেই কেউ অস্ফুটস্বরে আর্তনাদ করে উঠে। ভয়ে বকুল আর সন্ধ্যা দুজনেই লাফিয়ে উঠে। বকুল নিচ থেকে বলে,
‘সন্ধ্যা তুই তো আজ শেষ।’
বলেই লুকিয়ে পড়ে। সন্ধ্যা ‘আল্লাহ আল্লাহ’ করতে করতে নিচে তাকায়। নিচে একটা ছেলে টি-শার্ট, টাউজার পড়ে কানে হেডফোন লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখতে মাশাল্লাহ যথেষ্ট সুন্দর। সন্ধ্যা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয় তার দিকে। নিচ থেকে অজ্ঞাত ছেলেটি রাম ধমক দেয়। ধমকের দরুণ সন্ধ্যাা ভয়ে নিচে পড়ে যেতে নিলে নিজেকে সামলে নেয়। ছেলেটি বলে,
‘এই মেয়ে নিচে নামো।’
সন্ধ্যা নিচে না নেমে ওপর থেকেই বলে, ‘আ-আমি কেন নিচে নামবো?’
‘কেন নামবে মানে! তুমি একটা আস্ত পেয়ারা আমার মাথায় ফেলেছো তাই তোমার মাথাতেও আমি এই পেয়ারাটা ফেলতে চাই। নিচে নামো!’
সন্ধ্যা ভয়ে ভয়ে নেমে আসে। ছেলেটা তাকে সত্যি মারবে নাকি! ছেলেটা সন্ধ্যার পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে। সুতির গোল ডিজাইনের জামা পড়া, ওড়না কোমড়ে পেঁচানো, চুলগুলো দুইটা বেনী করে দুই পাশে ঝুলিয়ে রাখা। পিচ্চি একটা মেয়ে! ছেলেটা ভ্রু কুঁচকে বলে,
‘আমার মাথায় পেয়ারা ফেললে কেন?’
সন্ধ্যা সন্ধ্যা ভয়ে ভয়ে বলে, ‘আমি আপনার মাথায় ফেলেনি। আমি নিচে ফেলেছি সইয়ের জন্য। ভুল করে আপনি চলে আসছেন!’
‘তোমার সই? সে কোথায়?’
সন্ধ্যা গড়গড় করে বলে, ‘শাঁকচু’ন্নি টা বিপদে ফেলে পালায়ছে।’
‘তোমার সইয়ের নাম ধরে ডাকো।’
সন্ধ্যা কথা না বাড়িয়ে বকুলের নাম ধরে ডাকতে থাকে। বকুল শুকনো ঢোক গিলে বেড়িয়ে আসে। ছেলেটা বলে, ‘এটা কি তোমাদের গাছ?’
সন্ধ্যা দাঁত বের করে হেঁসে একবার মাথা দুদিকে নাড়ায় আবার উপর নীচে নাড়ায়। যা বোঝার তা বোঝা হয়ে গেছে ছেলেটির। বলে, ‘বুঝছি। অন্যের গাছ থেকে চু’রি করো কেন?’
সন্ধ্যা জবাব না দিয়ে বলে, ‘আপনি কি গ্রামে নতুন?’
‘তোমাকে যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দাও। পড়াশোনা করো না?’
সন্ধ্যা মাাথা নাড়ায়। ছেলেটা ফের জিজ্ঞেস করে, ‘কোন ক্লাস?’
‘এসএসসি দিয়েছি এবার।’
ছেলেটা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। সন্ধ্যা নিজেই জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি কি গ্রামে নতুন?’
‘হ্যাঁ। তেমাদের গ্রামে ক্যাম্পিংয়ের জন্য এসেছি।’
‘ক্যাাম্পিং?’
‘হুম। আমরা ফিউচার ডক্টর তো তাই আগে থেকে ট্রেনিং নিচ্ছি।’
সন্ধ্যা লাফিয়ে উঠে বলে, ‘তার মানে শহুরে ডাক্তার আপনি?’
ছেলেটা দুকদম পিছিয়ে এসে কপালে ভাজ ফেলে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, ‘বাড়ি যাও। আর যেনো চু’রি করতে না দেখি!’
সন্ধ্যা বকুলের হাত ধরে দুপা বাড়াতেই ছেলেটা ডাকে। বলে, ‘তোমার নাম কি?’
সন্ধ্যা খিলখিলিয়ে হেঁসে ওঠে। বকুলের হাত ধরে ছুটতে ছুটতে জোড়ে চিল্লিয়ে বলে,
‘আমি এক স্নিগ্ধ সন্ধ্যাবেলার সন্ধ্যামালতী……
চলবে….