সন্ধ্যামালতী,০৬,০৭

0
601

#সন্ধ্যামালতী,০৬,০৭
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
০৬

সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে এসেছে। সাহেদা আর সন্ধ্যা এখনো আয়াশদের ওখানেই আছে। বিচার শেষে সবাই একসাথে এখানে এসেছে। সবাই নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে৷ সাহেদা নিরবতা ভেঙে বলে,

‘আমি বাাড়ি যায় গা বাজান। সন্ধ্যা আজকা তোমাগো লগে থাহুক!’

লিজা বলে, ‘আন্টি আপনিও থেকে যান আজ। ফরিদের সাথে আজ যা হয়েছে তাতে সে তো এতো সহজে আপনাদের ছাড়বে না।’

‘আমারে কিছু করতো না। হের তো নজরই মোর মাইয়ার দিকে।’

‘তবুও!’

‘সন্ধ্যার দাদাই বাড়িতে একলা আছে মা। আমি যায়।’

আয়াশ বলে, ‘আন্টি আজকের জন্য থেকে যান। পরিবেশটা একটু শান্ত হোক৷ তাছাড়া ফরিদ এখন জ্বলতে থাকা আগুন। সবকিছু পুড়িয়ে ফেলবে।’

সাহেদা নিজ মনে কিছু ভাবে। তারপর বলে, ‘কয়দিন তোমাগো লগে থাকমু? আইজ না হয় কাইল তো আমাগো বাড়ি যাওনই লাগবো তখন কি করমু? হেরা কি এত্তো সহজে আমাগো ছাইড়া দিবো?’

আয়াশ কাঠকাঠ গলায় বলে, ‘আমার ওপর ভরসা রাখেন। কেউ কিছু করতে পারবে না আপনাদের।’

সন্ধ্যা চোখ তুলে তাকায় আয়াশের দিকে। আয়াশের কথায় আরো একবার যেন সাহস পায়। মানুষটার ব্যাক্তিত্ব ভীষণ প্রখর। এই ব্যাক্তিত্বের ওপর যে কেউ মুগ্ধ হতে বাধ্য। সাহেদা সবাইকে বুঝিয়ে বাড়ি চলে যেতে চায়। আকাশ, তমাল আর সাফি এগিয়ে দিতে যায়। লিজা, জেরিন, আয়াশ আর রানা থেকে যায় সন্ধ্যার সাথে। লিজা বলে,

‘আজ তুমি যা করলে তাতে তো আমার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেছে গো। তোমার সাহসের জন্য তোমাকে অস্কার দেওয়া উচিত।’

রানা বলে, ‘অলরেডি আমি মনে মনে কয়েকবার দিয়েও ফেলছি।’

আয়াশ বিড়বিড় করে বলে, ‘অস্কার তো তোর গার্লফ্রেন্ডের হাতের মোয়া যে কয়েকবার দিয়েও দিবি। ডাফার কোথাকার!’

জেরিন বলে, ‘দোস্ত তখন যে বললি তোর বাবাকে বলবি কেইস লড়তে! তা আঙ্কেল কবে থেকে লইয়ার হলো?’

রানা কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলে, ‘আরে ভাই ওইরকম একটু আকটু চাপা না দিলে এমন অ’জাতের চেয়ারম্যান আর চেয়ায়ম্যানের ভাইরে টাইট দেওয়া যায় না বুঝছোস!’

লিজা হেঁসে উঠে। সন্ধ্যাও মাথা নিচু করে হেঁসে দেয়। আয়াশের দৃষ্টি তখনো সন্ধ্যার দিকে নিবদ্ধ। জেরিন রানার মাথায় গাট্টা মেরে সন্ধ্যাকে বলে,

‘সন্ধ্যা বিয়ে টিয়ের প্ল্যান কি? লাভ নাকি অ্যারেঞ্জ? কাউকে পছন্দ করো নাকি?’

সন্ধ্যার মুখটা মলিন হয়ে যায়। মনে পড়ে যায় তার আর বাদলের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। লিজা, জেরিন, আয়াশ আর রানা মনোযোগী শ্রোতার মতো করে সন্ধ্যার উত্তরের অপেক্ষায় আছে। সন্ধ্যা মাাথা নিচু করেই বলে,

‘আমার তো বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে আপু।’

উপস্থিত সবাই অবাক হয়। লিজা, জেরিন আর রানা মুখটা কাঁদো কাঁদো করে এক সাথে বলে উঠে, ‘দিল টুট গায়া বা*ল।’

সন্ধ্যা চমকে তাকায়। আয়াশ একটা কুশন ছুঁড়ে মারে তিনজনের দিকে। বলে, ‘ল্যাঙ্গুয়েজ চেঞ্জ কর।’

লিজা আর জেরিন ভেংচি কাটে। রানা বলে, ‘এটা তুমি কি শুনায়লা? আমার এখন কান্নাা আসতেছে।’

আয়াশ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘বুঝলাম না। তোর কেন কান্না আসতেছে?’

রানা উত্তেজনা বশত বলেই বসে, ‘আরেহ কান্না আসবে না? আমার বেষ্ট ফ্রেন্ডের প্রথম…

এটুকু বলতেই দুপাশ থেকে লিজা আর জেরিন দুজনেই রানার মুখ চেপে ধরে৷ আয়াশ কপালে ভাজ ফেলে তাকিয়ে থাকে ৩ জনের দিকে। সন্ধ্যা এদের কিছু না বুঝে আহম্মকের মতো তাকিয়ে আছে সবার দিকে। আয়াশ সবাইকে ইগনোর করে আস্তে করে বলে,

‘কংগ্রেস সন্ধ্যা। নতুন জীবনের জন্য অনেক শুভ কামনা রইলো।’

সন্ধ্যা আশাহত হলো। আয়াশের থেকে সে এমন কিছু আশা করেনি। আয়াশ রুমে যেতেই টপাটপ কি’ল পড়ে রানার পিঠে। রানা আর্তনাদ করে পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলে,

‘তোরা খাস কি বইন? এতো শক্ত হাত কেমনে হইলো? আহারে আমার মেরুদন্ড টা মনে হয় ভেঙেই গেলো। ইশশ বেচারা আমি।’

লিজা আরো একটা কি’ল বসিয়ে দেয়। বলে, ‘তুই এখন মাঝখান দিয়ে ভাঙিসনি এটা কম কোথায়? তোর তো সাহস কম না তুই এখনই আয়াশের সামনে সব উগলে দিচ্ছিলি!’

‘আরে মা’রিস কেন? আমি কি ইচ্ছে করে কিছু করছি?’

সন্ধ্যা ধীর কন্ঠে বলে, ‘আপু ভাইয়াকে আর মে’রো নাা। বেচারা ব্যাথা পাচ্ছে।’

রানা কাঁদো কাঁদো মুখ করে তাকায় সন্ধ্যার দিকে। জেরিন বলে, ‘তুমি যদি বুঝতে বইন তাইলে এর থেকেও বেশি মাইর দিতা ওরে। বে’দ্দপ পোলা।’

এর মধ্যেই হাজির হয় আকাশ, সাফি আর তমাল। আকাশ এসে ঠা’স করে থা’প্পড় বসিয়ে দেয় রানার গালে। রানা হতভম্বের মতো তাকিয়ে থাকে৷ বলে,

‘আজ কি মাইর দিবস? সবাই আমারে মা’রতাছে কেন?’

আকাশ বলে, ‘তোর ভাগ্য ভালো একটা থা’প্পড় দিছি। তুই এই ভুত পাগলারে কেন পাঠায়ছোস আমাদের সাথে? জানিস কি করছে রাস্তায়?’

রানা মাথা নাড়ায়। লিজা, জেরিন, সন্ধ্যা, রানা সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকায়। সাফি মুখ কাঁচুমাচু করে আছে। আকাশ বলতে শুরু করে, ‘আরেহ ভাই যাওয়ার সময় আন্টি ছিলো কিছু করে নাই ‘ও’। মেয়েদের মতো তমাল আর আমার শার্টের কোণা ধরে হাঁটছে আমরা দুজন কিছু বলি নাই। আসার সময় ২ মিনিট করো হাঁটে আর বলে, ‘দোস্ত সামনে ভুত’। ওর এই ভুতের চক্করে আজকে আমরা একটা মহিলার দৌড়ানি খায়ছি।’

সবাই চুপ করে তাকিয়ে থাকে সাফির দিকে। এরপর হু হা করে হাসতে থাকে। আকাশ আর তমাল বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রানা হাসতে হাসতে সোফা থেকে পড়ে যায় ফ্লোরে। হাসির রেশ দ্বিগুণ হয়ে যায়। রানা ফ্লোরে পড়ে শুয়ে থেকেই হু হা করে হাসতে থাকে। আয়াশ নিজের রুম থেকে বাইরে এসে কঠিন এক ধমক লাগায়। সবাই কয়েক সেকেন্ডের জন্য হাসি থামালেও বেশিক্ষণ টিকতে পারে না। লিজা তো হাসতে হাসতে কান্নায় করে ফেলছে৷ সন্ধ্যাও হাসতেছে। আয়াশ এদের কান্ড দেখে কিছু না বলেই রুমে চলে যায়। এই হাসাহাসি চলে প্রায় আধাঘন্টার মতো। তারপর সবাই খেতে বসে যায়। সবাই মিলে খেয়ে নিজেদের মতো রুমে চলে যায়। সন্ধ্যা শুধু ঘরের বাইরে মেইন দরজার কাছে ব্যালকনিতে গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই পেছনে কারো আসার শব্দ পায়। পেছন ঘুরে দেখে আয়াশ। সন্ধ্যা মুচকি হাসে৷ আয়াশ সন্ধ্যার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বলে,

‘এখানে দাঁড়িয়ে কি করো?’

‘কিছু না। এমনিতেই দাঁড়িয়ে আছি।’

এরপর কিছুক্ষণ নিরবতা। সন্ধ্যা ডাকে, ‘শহুরে ডাক্তার!’

আয়াশ চমকে তাকায়। সন্ধ্যা সামনে তাকিয়েই হেঁসে বলে, ‘,আপনারা কতদিন থাকবেন এখানে?’

‘আর ১০ দিন।’

‘শহরে গেলে কি আমার কথা মনে পড়বে?’

আয়াশ ভীষণ চমকায়। জিজ্ঞেস করে, ‘মানে?’

সন্ধ্যা কি বলে ফেলেছে বুঝতে পারে। চোখের দৃষ্টি এদিক ওদিক করে বলে, ‘না না কিছু না।’

আয়াশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, ‘তোমার বিয়ে কবে?’

‘১০-১২ দিন পরেই।’

‘তুমি আর পড়ালেখা করবে না?’

সন্ধ্যা অদ্ভুত ভাবে হেঁসে বলে, ‘গ্রামের মেয়েদের পড়ালেখা! হয় বুঝি শহুরে ডাক্তার?’

আয়াশ জবাব দেয় না। সন্ধ্যা ফের বলে, ‘আম্মা চায় আমি বিয়েতে হ্যাঁ করে দেয় আমিও হ্যাঁ করে দিয়েছি।’

‘তোমার লাইফ তোমার ডিসিশন। কারো চাপে পড়ে বিয়ে করে নিও না। আর বিয়ে করলেও যার সাথে বিয়ে হবে তাকে বলবে তুমি পড়ালেখা করতে চাও।’

সন্ধ্যা মাথা নাড়ায়। আয়াশ বলে, ‘ঘুমাতে যাও।’

‘হুম।’

মুখে ‘হুম’ বললেও অদ্ভুত ভাবে দুজনের একজনও নিজেদের রুমে গেলো না৷ কিছুক্ষণ সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো। সন্ধ্যা হঠাৎ করেই অদ্ভুত এক প্রশ্ন করে বসে।

‘ভালোবাসা কি শহুরে ডাক্তার?’

আয়াশ আর সন্ধ্যাকে বাহিরে দেখে লিজা, জেরিন, রানা, তমাল, আকাশ, সাফি একজোট হয়েছে। রানা কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলে, ‘দোস্ত সন্ধ্যার নাকি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে! আর আয়াশ এটাতে কি কমেন্ট করলো? ‘কংগ্রেস সন্ধ্যা। নতুন জীবনের জন্য অনেক শুভ কামনা রইলো।’ হোয়াট ইজ দিস ব্রো?’

আকাশ কনফিউজড গলায় বলে, ‘ভাই আয়াশ যদি সন্ধ্যাকে পছন্দই করতো তাহলে রিয়েক্ট কেন করলো না? আমরা ভুল না তো? আদৌও আয়াশ সন্ধ্যাকে পছন্দ করে তো?’

লিজা ঠাস করে একটা কি’ল বসায় আকাশের পিঠে। বলে, ‘তোর অশুভ মুখে অশুভ কথা বলবি না হা’রামি। সন্ধ্যার বিয়ে ঠিক হয়লে ওর বিয়ে আমরা ভাঙমু তাও আয়াশ-সন্ধ্যা রে এক করমুই করমু।’

‘হ তা ঠিক আছে। কিন্তু ওরা গেলো কই?’

সাফি দাঁত বের করে বলে, ‘দুজনে ব্যলকনিতে দাঁড়িয়ে গল্প করছে।’

তমাল বলে, ‘ভুত ছাড়া যে অন্য কিছু দেখছিস এটাই আমাদের জন্য অনেক।’

__________________

সকাল সকাল সাহেদা কাজে চলে আসছে। সন্ধ্যা সকাল থেকেই আড়চোখে আয়াশের দিকে তাকাচ্ছে। রাতে যখন আয়াশকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ভালোবাসা কি?’ তখন কোনো উত্তর দেয়নি আয়াশ। চুপচাপ নিজের রুমে চলে গেছে। সন্ধ্যা ভাবছে আয়াশ কি রাগ করলো? তাই বোকার মতো লিজার কাছে প্রশ্ন করে বসে,

‘আপু ভালোবাসা কি?’

লিজার সাথে জেরিনও ছিলো। দুজনে এমন ভাবে সন্ধ্যার দিকে তাকালো মনে হলো যেন চোখ কোটর ভেদ করে বাহিরে চলে আসছে। থতমত খায় সন্ধ্যা। এরাও কি রাগ করবে নাকি? লিজা অবাক কন্ঠে বলে,

‘ভালোবাসা কি জানো না?’

সন্ধ্যা দুদিকে মাথা নাড়ায়। জেরিন কপাল চাপড়ায় আর বলে, ‘এ তো ভালোবাসা কি তাই জানে না। আর এই দুই নিরামিষ রে আমরা কেমনে এক করবো? আল্লাহ বাঁচাও।’

জেরিন বিড়বিড় করে বলেছে বলে সন্ধ্যার কান অবদি পৌঁছায় না। সন্ধ্যা ফের বলে,

‘রাগ করো না আপু।’

‘আরেহ রাগ করবো কেন? এটা কি রাগের মতো কোনো বিষয়?’

সন্ধ্যা কনফিউজড গলায় বলে, ‘যদি রাগ করার মতো বিষয় না হয় তাহলে শহুরে ডাক্তার কেন রাগ করছে?’

জেরিন আর লিজা আয়াশের কথা শুনেই লাফিয়ে সন্ধ্যার কাছে এসে তাকে চেপে ধরে। বলে, ‘শহুরে ডাক্তার মানে আয়াশ রাগ করছে তোমার ওপর? কি বলছো তুমি?’

সন্ধ্যা সরল মনে বলে, ‘শুধু জিজ্ঞেস করেছিলাম ভালোবাসা কি!’

জেরিন আর লিজা একে অপরের দিকে তাকায়। তারপর হতাশ স্বরে ‘ধ্যাত’ বলেই উঠে পড়ে। সেসময় দৌড়ে আসে বকুল। সরাসরি সন্ধ্যার কাছে এসে বলে, ‘সন্ধ্যা ফরিদ কাকারে কে জানি মে’রে ফেলছে। চল তাড়াতাড়ি। ‘

কথাটা যেন বিস্ফোরণ ঘটালো পুরো রুমে। লিজা দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে বলে, ‘মানে? মে’রে ফেলছে মানে?’

‘জানি না। আমি এখনো দেখি নাই। সকাল সকাল সবার মুখে এসব শুনে দৌড়ে আসলাম। দেড়ি করার সময় নাই। সন্ধ্যা দ্রুত চল।’

বলেই সন্ধ্যার হাত ধরে দৌড় লাগালো। লিজা আর জেরিন বাইরে এসে সবাইকে বলে তারাও পেছন পেছন দৌড় লাাগায়। সাহেদাও আছে সাথে। একটা বিশাল জমিতে সবার ভীড় দেখে সেখানে ছুটে আসে সবাই। ভীড় ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই সবাই ভয় পেয়ে যায়। সামনে পড়ে আছে ফরিদের টুকরো টুকরো ক্ষত বিক্ষত দেহ। সন্ধ্যার চোখের সামনে ভেসে ওঠে ফের এক ক্ষত বিক্ষত লা’শ। লুটিয়ে পড়তে নিলে আয়াশ সন্ধ্যাকে আগলে নেয় নিজের প্রশস্ত বুকে…

চলবে..

#সন্ধ্যামালতী (০৭)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
__________________

সন্ধ্যাকে সাথে সাথে হসপিটালে আনায় সেন্স ফিরতে বেশি টাইম লাগেনি৷ দুপুরের দিকে হসপিটাল থেকে বাড়ি নিয়ে আসে সন্ধ্যাকে। পুরো এলাকা ফরিদের মৃত্যুতে আতঙ্কিত হয়ে আছে৷ সেদিনের সেই মেয়ের মৃত্যু আর আজ ফরিদের! কিন্তু এদের মা’রার কারণ কি? এরপর আবার কে হবে পরের শিকার! এসব নিয়ে সবাই খুবই চিন্তিত। সন্ধ্যাকে নিজেদের বাড়ি এনে গোসল করিয়ে দেয় সাহেদা। আয়াশরা সবাই বড় ঘরের ভেতর বসে আছে। সন্ধ্যাকে গোসল করিয়ে এনে বসায়। আয়াশ গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

‘তুমি বার বার সেন্সলেস হও কিভাবে?’

সন্ধ্যা আয়াশের দিকে তাকায়। কিন্তু উত্তর দেয় না। লিজা বলে, ‘এখন এসব বাদ দে আয়াশ। সন্ধ্যা তুমি রেস্ট নাও। আমরা যায়।’

সন্ধ্যা মাথা নাড়ায়। আয়াশরা সবাই চলে যায়। সাহেদা খাবার নিয়ে এসে সন্ধ্যাকে খাইয়ে দেয়। সন্ধ্যা চুপচাপ খেয়ে নেয়। সাহেদা এঁটো প্লেট নিয়ে ঘর থেকে বের হতে নিলে সন্ধ্যা পিছু ডাকে। সাহেদা ফিরে তাকাতেই সন্ধ্যা বলে,

‘সেদিন বাবার সাথে কি হয়ছিলো আম্মা?’

সাহেদা চমকায়। মেয়ের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে দ্রুত বের হয় ঘর থেকে। সন্ধ্যা জানতো তার মা উত্তর দিবে না তাই কোনো রকম কথা না বাড়িয়ে নিজের মতো বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। ফরিদ কাকাকে কে মা’রলো? কার সাথে তার এতো শত্রুতা?

রাস্তায় বের হয়ে আয়াশরা সবাই চুপচাপ হাঁটতে থাকে। সবার মাথাাতেই এক প্রশ্ন! সন্ধ্যা যেদিন ফরিদকে সবার সামনে জু’তা দিয়ে মা’রলো সেদিনই কেনো ফরিদের মৃত্যু হলো? ফরিদ যে বেঁচে থাকলে সন্ধ্যার ক্ষতি করতো তা সবারই জানা কিন্তু তার আগেই ফরিদকে কে মা’রলো? লিজা নিরবতা ভেঙে বলে,

‘এটা গ্রাম না রে৷ রহস্যের বস্তা।’

রানা সায় দিয়ে বলে, ‘এখানে কিছু তো আছে। আয়াশ তোর মনে আছে সন্ধ্যার বাবার মৃত্যুর কথা? আমি শুনেছি সন্ধ্যার বাবা এক্সিডেন্টে মা’রা গেছিলো কিন্তু তারও এরকম কয়েক টুকরা পাওয়া গেছিলো।’

আয়াশ রানার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। আকাশ বলে, ‘দোস্ত আমি খবর নিয়েছি এর আগে এই এলাকায় এই ধরনের মা’র্ডার ৩ টা হয়ছে। আর ৩ জন-ই ছিলো এমন লোফার ক্যারেক্টারের।’

আয়াশ গম্ভীর কন্ঠে শুধায়, ‘কে কে সেই ৩ জন?’

‘এলাকার এক্স মেম্বার, মেম্বারের ছেলে আর চেয়ারম্যানের ছেলে।’

তমাল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘বলিস কি? ফিরোজের ছেলেও খু’ন হয়ছে? কিন্তু কেন?’

‘এরা সবাই মেয়েদের সাথে অ’সভ্যতা করতো। মেম্বার আর চেয়ারম্যানের ছেলে মিলে ২ টা মেয়েকে রেপও করছে কিন্তু কোনে প্রকার বিচার হয়নি, পুলিশ কেসও হয়নি৷ মেয়েগুলো লজ্জায় সুইসাইড করার দুইদিন পরই ওই জা’নো’য়া’র গুলোরও খু’ন হয়।’

আয়াশ অদ্ভুত রকম এক হাসি দিয়ে বলে, ‘আর যে মেয়েগুলো ভিক্টিম ছিলো তাদের সাথে অদ্ভুত ভাবে সন্ধ্যার আত্মীয়তা আছে।’

উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে তাকায়। আয়াশ বাঁকা হেঁসে বলে, ‘একটা মেয়ে যার নাম সোনিয়া সে ছিলো সন্ধ্যার বান্ধবী আর অন্য মেয়ে যার নাম নয়না সে ছিলো সন্ধ্যার প্রাণপ্রিয় ফুফাতো বোন।’

সবাই বুঝে যায় আয়াশ কি বলতে চাচ্ছে। রানা বলে, ‘তুই এতো কিছু কিভাবে জানলি? আর তাছাড়া সন্ধ্যা অনেক ছোট। ‘ও’ এতো মারপ্যাচ বোঝে না।’

‘প্রথমত তোরা হয়তো ভুলে গেছিস আমরা কারা আর কেনো এখানে এসেছি! আর দ্বিতীয়ত সময় আসলে নিজেই বের হয়ে আসবে কে কি করেছে! বাই দ্যা ওয়ে আজকেও পেশেন্ট দেখতে হবে। দ্রুত চল।’

লিজা হাঁটতে হাঁটতে বলে, ‘দোস্ত আমার মনে হয় আমাদের চলে যাওয়া উচিত গ্রাম ছেড়ে।’

সবাই তাকায় লিজার দিকে। লিজা ফের বলে, ‘দেখ যারা খু’ন হয়েছে আমি মনে করি তারা একটাও মানুষের মধ্যে পড়ে না। আর আমরা কোনো অ’মানুষের খু’নীদের শাস্তি দিতে চাই না।’

রানা বলে, ‘তুই ঠিক। তবুও এদের কেনো মা’রা হলো! এগুলো তো জানা দরকার।’

আয়াশ বলে, ‘মানলাম যারা মা’রা গেছে তারা মানুষের মধ্যে পড়ে না কিন্তু ২ দিন আগে যে মেয়েটা মা’রা গেছে তাকে কেন মা’রা হলো? সেদিন সাহেদা আন্টি ১ ঘন্টা ২৫ মিনিট কোথায় ছিলো? এগুলো তো জানা দরকার। আর আমার সন্দেহ যদি ভুল না হয় তাহলে সন্ধ্যার বাবার মা’রা যাওয়াটাও কোনো এক্সিডেন্ট না ওটাও কোনো না কোনো ভাবে খু’ন।’

আকাশ কিছুক্ষণ ভেবে বলে, ‘যে মেয়েটা মা’রা গেছে তার বিষয়ে আগে খোঁজ নিতে হবে৷ আর এখন সবাই চুপ। রাস্তায় এগুলো নিয়ে কোনোরকম ডিসকাশন না।’

কেউ আর কোনো কথা বললো না। সবার মাথায় ঘুরছে একটাই কথা! এতো সৌন্দর্যের, নিষ্পাপ মুখের মেয়ে কি আদৌও কোনো খু’ন করতে পারে?

_______________
টুকরো টুকরো লা’শের খুব কাছে বসে আছে সন্ধ্যা। পাথরের মতো তাকিয়ে আছে রক্ত মাখা মুখের দিকে৷ কয়েকটা টুকরো পড়ে আছে বলে ভয়ে কেউ কাছে আসছে না৷ পাশেই সন্ধ্যার মা বিলাপ করে কাঁদছে। সন্ধ্যা একবার সেদিকে তাকিয়ে আবার সামনে তাকায়। হঠাৎ করেই চিৎকার করে কান্না করে ওঠে।

‘সন্ধ্যা কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে? চোখ খোল।’

সন্ধ্যা ধীরে ধীরে চোখ খুলে৷ নিজেকে বিছানায় দেখে খানিকটা চমকায়। মস্তিষ্ক সজাগ হতেই সে বুঝতে পারে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলো। সামনে বাদলকে বসে থাকতে দেখে চোখ মুছে নেয়। নিজের কাপড় ঠিক করে বসে। বাদল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই সন্ধ্যা নরম গলায় বলে,

‘খারাপ স্বপ্ন দেখেছি বাদল ভাই।’

বাদল আর কিছু বলে না। কাল সে শহরে গেছিলো বলে কিছুই জানে না। আজ এসে সব শুনতেই ছুটে এসেছে সন্ধ্যার কাছে। সন্ধ্যা বাহিরে তাকিয়ে দেখে বিকেলের রোদ কমে গেছে। তার মানে সে অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছে। বাদল নিরবতা ভেঙে বলে,

‘ফরিদ কাকার বিষয়ে কিছু জানিস? আর তাছাড়া তুই নাকি কাল বিচার সভায়…

সন্ধ্যা মাথা নাড়ায়। তারপর আস্তে করে বলে, ‘এসব ছাড়েন। আপনি কাল শহরে গেছিলেন?’

বাদল হেঁসে মাথা নাড়ায়। সন্ধ্যা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। বলে, ‘হাসলেন কেন?’

‘এমনিতেই। অনেকক্ষণ এসেছি। এবার আমি বাড়ি যায়। আর চাঁচি রান্না করতে গেছে৷ তুই উঠলে তোকে বলতে বলছিলো৷ আর তোর ইচ্ছে হলে ওখান থেকে ঘুরে আয়। কিছুদিন এখন এলাকা শান্ত থাকবে।’

সন্ধ্যা মাথা নাড়ায়। বাদল চলে যেতেই সেও ঘর থেকে বের হয়। কলপাড়ে গিয়ে নিজের চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে ঘরের দরজা লাগিয়ে নিজেও বের হয়। ধীরে ধীরে হেঁটে আসে আয়াশরা যেখানে থাকে সেখানে। মায়ের সাথে দেখা করে পুকুর ঘাটে আসে। পুকুর ঘাটে আয়াশরা বসে ছিলো। লিজা সন্ধ্যাকে দেখে এগিয়ে আসে। বলে,

‘এখন কেমন আছো সন্ধ্যা?’

সন্ধ্যা মাথা নাড়িয়ে গলার স্বর ধীর করে বলে, ‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আপু। আজ তোমরা রোগী দেখতেছো না?’

‘দেখছি তো। যে কয়েকটা পেশেন্ট তাতে বেশিক্ষণ লাগে না। আর তাছাড়া অনেক কয়দিন থাকবো বলে সবাই আস্তে ধীরে আসতেছে। শেষের ৩ দিন দেখিয়ো কেমন ভীড় হয়!’

সন্ধ্যা মাথা নাড়ায়। লিজা সন্ধ্যার হাত ধরে আস্তে করে বলে, ‘তোমাকে একটা প্রশ্ন করলে উত্তর দিবা?’

‘হুম বলো।’

সন্ধ্যা জানে লিজা কি প্রশ্ন করবে তবুও চুপ করে সায় দেয়। লিজা আমতা আমতা করে বলে, ‘তুমি বার বার সেন্সলেস হও কেমনে?’

সন্ধ্যা হেঁসে বলে, ‘আসলে আমার বাবার মৃত্যুর পর থেকে যখনই তার রক্তাক্ত মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে তখনই আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।’

লিজা কিছু বলতে যাবে তার আগেই জেরিন ডাকে। বলে, ‘দুজনে একা একা কি ফিসফিস করতেছো? এদিকে আসো।’

সন্ধ্যা আর লিজা এগিয়ে আসে। সাফি বলে, ‘আমার কি মনে হয় জানো সন্ধ্যা! তোমা…

আর কিছু বলার আগেই রানা সাফির মাথায় গাট্টা মেরে বলে, ‘তোর কি মনে হয় ‘ও’ কেমনে জানবে? ব’ল’দ!’

সাফি দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘পুরো কথা না শুনে লাফাস কেন শালা?’

তমাল বলে, ‘ওকে কুল কুল। সাফি বল কি বলতে চাচ্ছিলি!’

‘আরেহ আমার মনে হয় সন্ধ্যাদের এই গ্রামে ভুত আছে নয়তো ২ দিনে ২ মানুষ খু’ন! আল্লাহ।’

আকাশ, তমাল, রানা এক সাথে বলে উঠে, ‘ভুত কি বাচ্চে তোরে আজ পানিতে চুবামু।’

সাফি ভয়ে দৌড় দিয়ে সন্ধ্যার পেছনে লুকায়। সন্ধ্যা হালকা হেঁসে বলে, ‘ শুধু ভুত না ভাইয়া এটা হলো মানুষ ভুত। শুধু ভুত হলে একেবারে ঘাড় মটকে খেয়ে ফেলতো কিন্তু এখানে তো কে’টে পিস পিস করে রাখছে।’

গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায় লিজার। সন্ধ্যা আর কিছু না বলে চলে যায়। লিজা এগিয়ে আসে আয়াশের কাছে। বলে, ‘আমার কিন্তু মনে হয় না সন্ধ্যা কোনো ধরনের খু’ন করতে পারে!’

রানা সায় দিয়ে বলে, ‘এতো ভালো, সাদাসিধা, ভীতু একটা মেয়ে খু’ন করতে পারে না দোস্ত।’

আয়াশ বিরক্তির দৃষ্টি নিয়ে তাকায় সবার দিকে। বলে, ‘বুঝলাম না তোরা কি আগে থেকেই গাধা নাকি সন্ধ্যাকে দেখে গাধা হয়ে গেছিস!’

‘মানে কি?’

‘মানে কিছু না। আজকের মধ্যে খোঁজ লাগা যে মেয়েটা দুইদিন আগে খু’ন হয়েছে তার সাথে সন্ধ্যা, সোনিয়া, নয়না বা সাহেদা আন্টির কোনো সম্পর্ক আছে কি না!’

জেরিন বলে, ‘তুই বার বার সন্ধ্যাকে কেন এসবে টানছিস? কাল যখন ফরিদ সাহেব মা’রা গেছে তখন কিন্তু সন্ধ্যা আমাদের সাথে ঘুমিয়ে ছিলো৷ আর যেদিন ওই মেয়েটা,মা’রা যায় সেদিনও সন্ধ্যা হসপিটালে ছিলো।’

আয়াশ কপালে কয়েকটা ভাজ ফেলে। বলে, ‘তোদের মনে হয় সন্ধ্যার মতো পিচ্চি একটা মেয়ে একা ফরিদকে মে’রে কে’টে রেখে দিতে পারবে!’

তমাল বলে, ‘তার মানে তুই বলতে চাচ্ছিস যে সন্ধ্যার সাথে অন্য কেউ আছে এগুলোতে!’

‘এক্সাক্টলি!’

রানা বলে, ‘ভাই তুই সন্ধ্যাকে ভালোবাসিস না?’

আয়াশ অবাক হয়ে বলে, ‘হোয়াট! সন্ধ্যার সাথে আমার পরিচয় আজ মাত্র ৩ দিন এর মধ্যে ওরে ভালোবাসবো মানে কি? আর তাছাড়া তোদের মাথার কি তার ছিড়ে গেছে? ভুলে গেছিস আমার ফিয়ন্সে আছে।’

আকাশ ভেংচি কেটে বলে, ‘তোর ওই মাতাল ফিয়ন্সে! সর তো শা’লা।’

বলেই আকাশ উঠে যায়। সাথে সবাই যায়। আয়াশ পেছন থেকে আহম্মকের মতো তাকিয়ে বলে, ‘হোয়াট দ্যা ফাজ ইয়ার?’

সন্ধ্যা পেড়িয়ে কেবলই অন্ধকার নেমে এসেছে তখনই ছুটে আসে আকাশ, তমাল আর রানা। আয়াশ, লিজা, জেরিন আর সাফি মাথা তুলে তাকায় তাদের দিকে৷ রানা ভাঙা ভাঙা ভাবে বলে,

‘দোস্ত সন্ধ্যার সাথে ওই খু’ন হওয়া মেয়েটার সম্পর্ক আছে৷ সোনিয়া, নয়না, সন্ধ্যা আর ওই মেয়ে মানে মুন্নি এরা সবাই একটা ফ্রেন্ড সার্কেল।’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here