সন্ধ্যামালতী,২০,২১

0
727

#সন্ধ্যামালতী,২০,২১
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
২০

সকালে সন্ধ্যার ঘুম ভাঙে অনেক বেলায়। আকাশ মেঘলা থাকার দরুণ ঠিক কয়টা বাজে তা ঠাহোর করতে পারে না সন্ধ্যা। প্রচন্ড মাথা ব্যাথায় চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। কোনো রকমে উঠে বসে। কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকে। তারপর ধীরে উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়। কাল রাতের কোনো কথায় মনে পড়ছে না। বাড়ি কখন এসেছে! কিভাবে এসেছে কিছুই মনে নেই। সন্ধ্যা আয়নাতে নিজের অবয়ব দেখে খানিকটা অবাকই হয়। সে শাড়ি কখন পাল্টালো! কনফিউজড হয়ে থম মেরে বসে থাকে। মাথাটা এখনো কেমন করছে। কোনোরকম আগে উঠে নিচে হাঁটা লাগায়। আফরা লিভিং রুমে বসে তখন টিভি দেখছে। সন্ধ্যাকে আসতে দেখে মৃদু হাসে। হাসি মুখেই বলে,

‘শুভ সকাল। এতক্ষণে উঠলি! কিচেনে যা। গিয়ে দেখ লেবুর শরবত রাখা আছে ওটা খেয়ে নাস্তা করে নে।’

‘এতো সকালে নাস্তা করবো! তোমার এতো সকালে সব নাস্তা রেডি করা শেষ?’

আফরা অবাক চোখে তাকিয়ে বলে, ‘এতো সকাল কোথায় রে! ১১ টা বাজে। আকাশের অবস্থা আজ খুব একটা ভালো না তাই বলে তুই একদম সকাল ভাবলি!’

সন্ধ্যা আর কিছু বলে না। কিচেনে গিয়ে লেবুর শরবত খেয়ে নাস্তা প্লেটে নিয়ে আফরার কাছে আসে। আফরা হেঁসে দেয়। সন্ধ্যা মুখে কিছু না বলে প্লেট হাতে মাথা নিচু করে বসে। আফরা হাতটা ধুয়ে সন্ধ্যার থেকে প্লেট নিয়ে সন্ধ্যাকে খাইয়ে দিতে শুরু করে। সন্ধ্যা খানিকটা অবাকই হয়। সে মুখে বলেনি খাইয়ে দিতে তাও মানুষটা বুঝলো কিভাবে! আবার বিরক্ত না হয়ে হাসি মুখে খাইয়ে দিচ্ছে। আচ্ছা মানুষ এতো ভালোও হয়? আবেগে চোখ ছলছল করে উঠে। নিজেকে সামলে চুপচাপ খেতে থাকে। একবার আশে পাশে তাকায়। আফরা খাইয়ে দিতে দিতে বলে,

‘আয়াশ নেই। রানাদের বাড়িতে গেছে। বিয়ের কতো কাজ ওখানে জানিসই তো।’

সন্ধ্যা মিইয়ে যায়। খেতে খেতে আমতা আমতা করে বলে, ‘একটা কথা জিজ্ঞেস করবো আন্টি!’

‘হ্যাঁ বল!’

‘আসলে আ-আমার না ক-কাল রাতের কথা কিছু মনে নেই। কিভাবে বাড়ি এসেছি? আমার শাড়ি!’

আফরা মুচকি হাসে। বলে, ‘কাল অনেক রাতে বাড়ি ফিরেছিস দুজন। তুই তো ঘুমে বিভোর ছিলি তাই আয়াশ তোকে কোলে করে রুমে দিয়ে আসছে। আর শাড়ি আমি পাল্টে দিয়েছি। এখন চুপটি করে খেয়ে নে তো। খেয়ে গোসল করে রেডি হয়ে নে। জুম্মার পর আয়াশ তোকে নিয়ে যাবে।’

সন্ধ্যা চমকে উঠে বলে, ‘আজ শুক্রবার!’

‘হ্যাঁ।’

‘হায় আল্লাহ। আমার আজকেই ফজরের নামাযটা কাযা হয়ে গেলো!’

আফরা কিছু না বলে নিঃশব্দে হাসে। সন্ধ্যা পুরোটা খেয়ে নেয়। আফরা প্লেট নিয়ে রান্নাঘরে চলে যায়। সন্ধ্যাও পিছু পিছু যায়। আফরা প্লেট রাখতে রাখতে বলে, ‘কিছু বলবি!’

সন্ধ্যা আমতা আমতা করে বলে, ‘আসলে আন্টি!’

‘কিছু হয়ছে সন্ধ্যা?’

‘বলছিলাম যে বিয়েতে কি যেতেই হবে?’

আফরা হেঁসে সন্ধ্যার চুলে হাত বুলিয়ে বলে, ‘কেন? যাবি না! রানা অনেক রাগ করবে। তাছাড়া আজ আমিও তো যাবো। তুই এখন যা গোসল করে নে। নামায পড়ে রেডি হয়ে নিবি। কেমন!’

সন্ধ্যা মাথা নাড়ায়৷ দুপা এগিয়ে বলে, ‘আচ্ছা আন্টি এ বাড়িতে কি আর কেউ থাকে না?’

আফরা আফসোসের সুরে বলে, ‘নাহ রে৷ আমি, তোর আঙ্কেল আর আয়াশ থাকি। তোর আঙ্কেল একটা কাজে গেছে। দুদিন পরই চলে আসবে।’

সন্ধ্যা হেঁসে সিড়ি দিয়ে উপরে যায়। আয়াশের বাবা কেমন মানুষ কে জানে! তার যদি এ বাড়িতে থাকা নিয়ে কোনো সমস্যা হয়! গভীর চিন্তায় মগ্ন হয় সন্ধ্যা।

জুম্মার নামায শেষে আয়াশের দেখা পায় সন্ধ্যা। আয়াশ নামায শেষ করে বাড়িতে ঢুকে প্রথমেই সন্ধ্যার ঘরে আসে। গায়ে এখনো পাঞ্জাবি জড়ানো। সন্ধ্যা তখন নামায শেষ করে মাত্রই উঠেছে। আয়াশ এসে ব্যস্ত গলায় বলে, ‘তাড়াতাড়ি রেডি হও। রানাদের বাড়িতে যেতে হবে। আর আম্মু যাবে তুমি সব সময় উনার সাথে সাথে থাকবে।’

সন্ধ্যা আচমকা এতো কথা শুনে খানিকটা ভড়কায়। নিজেকে সামলে বলে, ‘একটু দম নিয়ে বলুন।’

আয়াশ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘দম নেওয়ার টাইম নাই। ওদিকে বরপক্ষ চলে আসছে প্রায়। দ্রুত রেডি হও!’

সন্ধ্যার জবাবের অপেক্ষা না করেই পা বাড়ায় দরজার দিকে। দরজা ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েও আবার ফিরে আসে। গম্ভীর স্বরে বলে, ‘কাবাডে বোরকা, হিজাব, নিকাব সহ পিন, সেফটিপিন যা যা লাগে সবই আছে। অবশ্যই ওগুলো পড়বা।’

সন্ধ্যা নিঃশব্দে মাথা নাড়ায়। কাল তো এমন কোনো রুলস ছিলো না আজ হঠাৎ এমন রুলসের কারণ! সন্ধ্যার ছোট মাথায় এই কথাটা ঢোকে না। আপনমনে কাবাড থেকে বোরকা, হিজাব, নিকাব নিয়ে নেয়। হিজাব বাধতে পারে না বলে বোরকা পড়লেও হিজাব হাতে দাঁড়িয়ে থাকে। ঠোঁট উল্টে একবার এপিঠ তো একবার ওপিঠ দেখে। একবার মাথায় দেয় আরেকবার হাতে নেয়। আয়াশের ততক্ষণে রেডি হওয়া শেষ। এসে দেখে সন্ধ্যা হিজাব হাতে দাঁড়িয়ে আছে। পাঞ্জাবির হাতা গুটাতে গুটাতে বলে,

‘হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছো কেন?’

সন্ধ্যা মাথা নিচু করে বলে, ‘এগুলো কখনো পড়িনি।’

আয়াশ ফোস করে নিঃশ্বাস নেয়। তারপর কিছু একটা ভেবে ইউটিউবে হিজাব টিউটরিয়াল সার্চ দিতে দিতে সন্ধ্যার উদ্দেশ্য বলে, ‘দেখে দেখে পারবা?’

সন্ধ্যা মাথা নাড়ায়। আয়াশ ইউটিউবে খুবই সহজ নিকাবসহ হিজাব বাঁধার টিউটরিয়াল বের করে সন্ধ্যাকে ফোন ধরিয়ে দিয়ে নিজে আবার বাহিরে চলে যায়। সন্ধ্যা দেখে দেখে হিজাব আর নিকাব পড়ে নেয়। একটু সমস্যা হলেও পেরেছে। সন্ধ্যা আয়াশের ফোন নিয়ে রুম থেকে বের হয়। আফরার ঘর বন্ধ দেখে সে দ্রুত নিচে নামে। আফরা আর আয়াশ রেডি দাঁড়িয়ে আছে। আফরা সন্ধ্যাকে দেখে অবাক হলেও আয়াশ স্বাভাবিক। আফরা আয়াশের মুখের দিকে তাকিয়ে যা বোঝার তা বুঝে নেয়। গাড়ি করে দ্রুতই এসে পড়ে রানাদের বাড়ি। আয়াশদের ঢুকতে দেখে লিজা আর জেরিন কাচুমাচু মুখ নিয়ে এগিয়ে আসে। আফরা হেঁসে বলে, ‘কি রে তোদের মুখ এমন কেন?’

লিজা বলে, ‘এমনিতেই আন্টি। বেশি লাফাইলে তোমার ছেলে আমাদের পা ভে’ঙে দিবে বলছে।’

আয়াশ পাশ থেকে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে, ‘উল্টা পাল্টা কাজ করলে শুধু পা না তোদের মাথাটাও ভা’ঙবো।’

জেরিন ভেংচি কাটে। বলে, ‘সন্ধ্যা কোথায়? আন্টি ওকে আনোনি!’

সন্ধ্যা কিছু বলতেই যাচ্ছিলো তার আগে আয়াশ বলে, ‘না রে। ওকে আনিনি। তোরা দুরে সর যা!’

লিজা কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলে, ‘তুই আমাদের জন্য বেচারী সন্ধ্যাকে একা একা রেখে আসলি!’

সন্ধ্যা পাশ থেকে বলে, ‘আরেহ না আপু। এই তো আমি।’

লিজা আর জেরিন আশে পাশে তাকায়। দুজনে একসাথে বলে, ‘এটা সন্ধ্যার কন্ঠ না!’

একবার নিজেদের দিকে আরেকবার আয়াশের দিকে তাকায়। সন্ধ্যা এগিয়ে এসে বলে, ‘আরেহ এই তো আমি।’

লিজা আর জেরিন হা করে তাকায়। আয়াশ ওদের পাত্তা না দিয়ে বলে, ‘তোরা ওর থেকে অন্তত ৫ হাত দুরে থাকবি। আর সন্ধ্যা আই ওয়ার্ন ইউ তোমাকে যেন ওদের সাথে না দেখি। সবসময় আম্মুর সাথে থাকবা। আমি গেলাম।’

কথাটুকু শেষ করেই আয়াশ হাঁটা লাগায়। লিজা আর জেরিন আহম্মকের মতো তাকিয়ে থাকে। আফরা শব্দ করে হেঁসে দেয়। তারপর সন্ধ্যার হাত ধরে বলে, ‘আমিও প্রথমে অবাকই হয়েছিলাম আম্মাজানেরা। এবার নিজেদের মুখ বন্ধ করে ওদিকে যাও। সন্ধ্যা আমার সাথে থাকবে।’

‘আন্টি তুমিও! ‘

‘জ্বি আমিও। কারণ আমার ছেলে যদি জানে আমি তার সম্পত্তির দেখভাল না করে তোমাদের সাথে ঘুরতে দিছি নির্ঘাত আমার ক’ল্লা যাবে।’

শব্দ করে হাসে। সন্ধ্যা অবুঝের মতো তাকিয়ে থাকে। লিজা আর জেরিন শোক কাটিয়ে বলে উঠে, ‘আয়াশ তো দিন দিন জোস হয়ে যাচ্ছে ভাই!’

______________
রাতে ভালো লাগছিলো না বলে সন্ধ্যা ছাঁদে এসে দাঁড়ায়। সাফির মতো ভুতের ভয় নেই সন্ধ্যার। রানাদের বাড়ি থেকে এসে সন্ধ্যা সেই যে রুমে ঢুকছে আর বের হয়নি। আয়াশও ঘুমিয়েছে বাড়ি এসে। সন্ধ্যা ছাঁদে এসে চোখ বন্ধ করে বাতাস অনুভব করছিলো। সে সময় পাশ থেকে পুরুষালি কন্ঠ ভেসে আসে,

‘রাতে ছাঁদে আসতে নিষেধ করেছিলাম!’

সন্ধ্যা কেঁপে উঠে। চোখ খুলে গভীর দৃষ্টিতে তাকায় আয়াশের দিকে। আয়াশের দৃষ্টি তার উপরেই নিবদ্ধ। চোখে চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে নেয় সন্ধ্যা। দৃষ্টি এদিক ওদিক করে। আয়াশ সন্ধ্যাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে শান্ত কন্ঠে বলে, ‘তোমাকে একটা প্রশ্ন করি!’

সন্ধ্যা ছোট করে ‘হু’ বলে। আয়াশ পকেটে হাত গুজে রেলিং এ হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। চোখ দুটো তখনো তার সন্ধ্যামালতীর চোখের দিকে। ভীষণ শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি তোমার বাবাকে ঘৃণা করো কেন?’

মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা হলো যেনো সন্ধ্যার। বিস্ময়, নির্বাক দৃষ্টিতে তাকায় আয়াশের দিকে। আয়াশ ভীষণ স্বাভাবিক। সন্ধ্যা অবাক কন্ঠেই জিজ্ঞেস করে, ‘আপনাকে কে বললো!’

আয়াশ নিঃশব্দে হাসে। বলে, ‘তুমিই তো বললে কাল।’

‘আমি! কখন? আমার তো মনে নেই।’

‘মনে থাকবে কিভাবে! ওয়াইন খেয়ে তো পুরাই মা’তাল হয়ে গেছিলা।’

সন্ধ্যা চোখ মুখ কুঁচকে বলে, ‘ওয়াইন কি?’

‘অ্যালকোহল।’

সন্ধ্যা সাথে সাথেই ওয়াক ওয়াক করে। আয়াশ অবাক কন্ঠে বলে, ‘কি হলো সন্ধ্যা? তোমার কি খারাপ লাগছে?’

সন্ধ্যা মুখ বিকৃত করে বলে, ‘ইয়াক ছিঃ! আমি ওইসব খেয়েছি! আল্লাহ।’

আয়াশ শব্দ করে হেঁসে দেয়। বলে, ‘ওগুলো তোমার হজম হয়ে গেছে। এখন ওয়াক ইয়াক ছিঃ করেও বের হবে না। আরো যাও লিজা আর জেরিনের সাথে।’

‘আপুরা আমাকে এসব খাইয়েছিলো!’

আয়াশ কথা ঘুরিয়ে বলে, ‘তুমি কথা ঘুরিয়ো না। আমার প্রশ্নের উত্তর দাও!’

সন্ধ্যা অন্যদিকে তাকিয়ে মলিন গলায় বলে, ‘নেশার ঘোরে কি না কি বলেছি তা ধরে বসে আছেন কেন?’

‘নেশার ঘোরে মানুষ সত্যি কথা বলে। তাই ধরে বসে আছি।’

‘আপনি কখনো চেষ্টা করেছেন শহুরে ডাক্তার?’

আয়াশ ভ্রু কুঁচকায়। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে, ‘বুঝছি। আচ্ছা বাদ দাও। রুমে যাও!’

সন্ধ্যা মাথা নাড়িয়ে একটু এগিয়ে আবার পিছনে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলে, ‘আমি কি আরো কিছু বলেছি শহুরে ডাক্তার?’

সন্ধ্যা মনে মনে আল্লাহ কে ডাকছে। না জানি কিছু বলেছে কি না! আয়াশ সন্ধ্যার চিন্তিত মুখ দেখে হাই তুলে বলে, ‘বলেছো তো অনেক কিছু। পেটের অনেক গোপন কথা উগলে দিয়েছো।’

সন্ধ্যার বুক ধড়াস করে ওঠে। মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে যায়। চোখ পিটপিট করে জড়ানো গলায় বলে, ‘ক-কি বলেছি?’

‘যা বলেছো তা শুনতে হবে না। রুমে যাও!’

সন্ধ্যা কিছু বলতে গিয়েও বলে না। দ্রুত পায়ে ছাঁদ থেকে নেমে যায়। আয়াশ সেদিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অনেক হিসাব কষতে থাকে। সে সময় পেছন থেকে কেউ ডাকে,
‘আয়াশ!’

আয়াশ পেছনে তাকায়। সানজিদাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খানিকটা চমকায়। নিজেকে সামলে বলে, ‘তুমি এতো রাতে!’

সানজিদা মুচকি হেঁসে বলে, ‘কিছু কথা ছিলো তোমার সাথে।’

আয়াশ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘আমার সাথে?’

‘হ্যাঁ।’

‘নিচে চলো!’

‘এখানেই বলি!’

‘আচ্ছা বলো।’

সানজিদা কিছুক্ষণ চুপ থাকে। তারপর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে, ‘আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না। আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি।’

চলবে..

#সন্ধ্যামালতী (২১)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________

সানজিদার কথায় চরম রকমের শকড আয়াশ। অবাকের চরম পর্যায়ে। সে নিজেই চেয়েছিলো সানজিদার সাথে বিয়ের বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে। একজনকে মনে রেখে তো অন্যজনের সাথে সংসার, প্রণয় কিছুই হয় না। কিন্তু সানজিদা নিজেই যে তাকে বিয়ে করতে চাইবে না সে ভাবতেও পারেনি। খুশিতে, উত্তেজনায় সে বলে,

‘কি বললে?’

সানজিদা খানিকটা অবাক চোখে তাকায়। আয়াশের পুরো মুখে খুশির ফোয়ারা বইছে। সানজিদা ফের বলে, ‘আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না। আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি।’

আয়াশ খুঁজে পায় না কি বলবে! এতো সহজে সে সন্ধ্যাকে পেয়ে যাবে? সত্যি নাকি স্বপ্ন! উত্তেজনায় আয়াশ গড়গড় করে বলে, ‘এটা আগে বলো নাই কেন? আগে বললে তো আরো আগেই সব ঠিক হয়ে যেতো।’

সানজিদা মাথা নিচু করে বলে, ‘দেখো আমি জানি তোমার বিয়ে, ভালোবাসা এগুলোতে ইন্টারেস্ট নাই তবুও আম্মুর জন্য আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলে। আমি ভয়ে তোমাকে কিছু বলতে পারিনি। অনেক ন্যাকামো করতাম, গায়ের সাথে ঘেষে থাকতাম যাতে তুমি আমাকে খারাপ ভেবে বিয়েটা ভেঙে দাও কিন্তু ওগুলো তোমার ওপর কোনো ইফেক্টই করতো না। হতাশ হতাম। কিন্তু সন্ধ্যা মেয়েটা আসার পর থেকে তোমার মধ্যে পরিবর্তন পেয়েছি। মামির সাথে কথা বলে সিউর হলাম তুমি আসলেই সন্ধ্যাকে ভালোবাসো৷ তাই আজ সাহস করে বলতে এসেছি।’

আয়াশ সানজিদার কথায় চোখ বন্ধ করে শ্বাস নেয়। খুশিতে তার হাত পা রীতিমতো কাঁপছে। আর কোনো বাঁধা নেই তার আর সন্ধ্যার এক হওয়ায়।

সন্ধ্যা আফরার রুমে এসে চুপ করে বসে আছে। আফরা এটা ওটা বললেও তার উত্তর খুব কম দিচ্ছে। আফরা সন্ধ্যার চুপ থাকাটা পর্যবেক্ষণ করে। বলে, ‘তুই এতো চুপ কেন সন্ধ্যা? কিছু হয়ছে?’

‘কই! না তো। কিছুই হয়নি। একটা কথা জিজ্ঞেস করবো আন্টি?’

‘হ্যাঁ কর।’

সন্ধ্যা দৃষ্টি এদিক ওদিক করে আমতা আমতা করে বলে, ‘ছাঁদে যেতে দেখলাম একটা মেয়েকে। কে উনি?’

আফরা হেঁসে বলে, ‘ওটা আমার ননদের মেয়ে সানজিদা।’

সানজিদা নামটা শুনতেই সামান্য কেঁপে ওঠে সন্ধ্যা। লিজা আর জেরিনের কাছে সে শুনেছিলো আয়াশের ফিয়ন্সের নাম সানজিদা। আফরা হয়তো খেয়াল করলো সন্ধ্যার অস্থিরতা। সে মৃদু হেঁসে সন্ধ্যার গালে হাত রেখে বলে,

‘জানিস সন্ধ্যা আমার ননদ সাথী ছিলো একটা চরম রকমের ভালো মেয়ে। এতো মায়া ছিলো মুখটাই যে ওর মুখের দিকে তাকালেই চোখ জুড়িয়ে যেতো। আয়াশের প্রিয় ছিলো সাথী। আমার ছেলেটা ছোট বেলা থেকেই ভীষণ চাপা স্বভাবের। তবে সে সাথীর সাথে ছিলো খোলা বইয়ের মতো। সাথী অন্ত প্রাণ আয়াশ। সাথীর তখন বয়স কত হবে! এই ধর ২৩ কি ২৪। সানজিদার বাবার সাথে তখন তার প্রণয় হয়। দু পরিবার থেকেই বিয়ের আয়োজন করা হয়৷ বিয়ে হয়। সানজিদা হয় কিন্তু পাল্টে যায় সানজিদার বাবা। পরনারীতে আসক্ত হয়ে সাথীকে মে’রে ফ্যানের সাথে ঝু’লিয়ে দেয়।’

শেষের লাইন বলতে গিয়ে কথা আটকে যায় আফরার গলায়৷ চোখ বেয়ে ঝড়ে অজস্র অশ্রু। সন্ধ্যার চোখও ছলছল করে ওঠে। আফরা কয়েক সেকেন্ড থেমে বলে, ‘সাথীর মৃত্যুর পর আমার ছেলেটা এলোমেলো হয়ে গেলো। প্রাণ প্রিয় ফুফুর এমন ঝুলন্ত লা’শ দেখার পর থেকে একদম চুপ হয়ে যায়। সেদিন থেকে আয়াশের এই ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাস ঠুনকো হয়ে গেছিলো। সানজিদা আমার কাছেই বড় হয়ছে ২ বছর হলো ‘ও’ হোস্টেলে থাকতেছে। আয়াশ সানজিদাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো এই কারণে যাতে সাথীর মতো সানজিদার অবস্থা করুণ না হয়।’

সন্ধ্যা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, ‘ফুফুর স্বামীর শাস্তি হয় নি?’

আফরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, ‘টাকার জোড়ে আইনের বিচার থেকে বেঁচে গেলেও আল্লাহর বিচার থেকে বাচতে পারেনি। বছর খানেক পরই এক্সিডেন্টে প’ঙ্গু হয়ে গেছে। কেউ দেখতেও যায় না। সানজিদা নিজেও কখনো যায়নি।’

সন্ধ্যার শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়। মানুষ গুলো এমন বদলে যায় কেনো? প্রণয়ের বিয়েতেও কেন পর’কিয়ায় লিপ্ত হয়? এ সমাজ এতো নিচে কেন নেমে যায়? কেন মেয়েরা ভালোবেসে বিয়েতেও এতো কষ্টের সম্মুখীন হয়? কোনো প্রশ্নের উত্তর নেই। অথচ প্রশ্নগুলো এ সমাজে ভীষণ রকম সত্যি। ভালোবাসতেও এখন অনেকে ভয় পায়! স্বাভাবিক নয় কি?

সন্ধ্যা আফরার কাছে থেকে উঠে নিজের রুমে যায়। দেয়ালে টাঙানো সাথী আর আয়াশের হাসি মুখের ছবি দেখে সেদিকেই তাকিয়ে থাকে। সত্যিই মানুষটার মুখে কি নিদারুণ মায়া অথচ উনার পরিণতি কতটা ভয়ংকর! ঠিক কতটা সময় সন্ধ্যা সেই ছবিটার দিকে তাকিয়ে ছিলো তার জানা নেই। হঠাৎ করেই মাথায় উদয় হয়, ‘তার পরিণতি কি হবে? সেও কি এই সাথীর মতো কোনো ফ্যানের সাথে ঝু’লে যাবে কখনো?’ পরক্ষণেই নিজেকে শাষায়। আয়াশ তাার সাথে কখনোই এমন করবে না, কিন্তু..তবুও একটা প্রশ্ন রয়ে যায়। আয়াশ কি আদৌও তাকে বিয়ে করবে?

___________
সন্ধ্যার পর আয়াশের দেওয়া শাড়ি পড়ে বসে আছে সন্ধ্যা। সাথে ম্যাচিং গহনা, কানের দুল, চুড়ি, পায়েল সব পড়েছে। আয়াশের কথা অনুযায়ী সে চুল গুলো খোলায় রেখেছে। যদিও গরম তবুও কিছু করার নেই। সকালে সন্ধ্যা সোফায় বসে টিভি দেখছিলো সে সময় আয়াশ একটা প্যাকেট হাতে নিয়ে তার কাছে আসে। বলে, ‘এগুলো পড়ে রেডি হয়ে থাকবা সন্ধ্যার পর। আমি এসে নিয়ে যাবো। আর হ্যাঁ চুল গুলো খোলা রাখবে।’ ব্যাস শেষ! সন্ধ্যাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সে চলে যায়। সন্ধ্যা গাল ফুলায়। একবার ভাবে এসব কিছুই সে পড়বে না আবার ভাবে আয়াশ যদি রেগে যায়! দোমনা করতে করতে শেষমেশ তৈরী হয়ে বসে থাকে। সন্ধ্যার ভাবনার মাঝেই আফরা এসে দরজায় নক করে। সন্ধ্যা দরজা খুলে দিতেই আফরা হা করে তাকায়। অবাক চোখে বলে,

‘মাশাল্লাহ। কি সুন্দর লাগছে রে তোকে! কারো নজর না লাগে।’

সন্ধ্যা লাজুক হাসে। আফরা হেঁসে বলে, ‘জলদি নিচে যা। আয়াশ দাঁড়িয়ে আছে।’

সন্ধ্যা মাথা নাড়ায়। লজ্জায় মিইয়ে যায়। মাথা নিচু করেই একপ্রকার ছুটে রুম থেকে বের হয়। পেছন থেকে আফরা জোড়ে বলে, ‘আস্তে যা পড়ে যাবি তো! আর সাবধানে যাবি সাবধানে ফিরবি।’

সন্ধ্যা হেঁসে পেছনে তাকায়। তারপর ধীরে ধীরে নিচে নামে। আয়াশ তখন গাড়িতে হেলান দিয়ে ফোন টিপছে। সন্ধ্যা দুর থেকে একবার আয়াশের দিকে তাকিয়ে আবার নিজের দিকে তাকায়। দুজনেরই ডার্ক ব্লু কালার শাড়ি আর পাঞ্জাবি। সন্ধ্যার শাড়িতে একদম হালকা কাজ ঠিক তেমনই আয়াশের পাঞ্জাবি তেও হালকা কাজ করা। সন্ধ্যা চাপা হাসে। এগিয়ে যায় আয়াশের কাছে। আয়াশ সন্ধ্যার উপস্থিতি টের পেতেই দরজা খুলে দেয়। কিন্তু সন্ধ্যার দিকে তাকায় না। সন্ধ্যা খানিকটা ভ্রু কুঁচকায়। তারপর নিজেকে সামলে বসে পড়ে৷ আয়াশও ঘুরে এসে বসে। কোনোমতেই সে সন্ধ্যামালতীর দিকে তাকাবে না। এ মেয়ে ভ’য়ংকর! আয়াশ বেচারা না তাকিয়েও থাকতে পারছে না আবার তাকাতেও পারছে না। নিজেকে সামলে কোনো মতে গাড়ি স্টার্ট দেয়। সন্ধ্যা মৃদু কন্ঠে বলে,

‘আমরা কোথায় যাচ্ছি!’

আয়াশ উত্তর দেয় না। সন্ধ্যার রাগ হয়। রাগে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে বসে থাকে। আয়াশ একবার আড়চোখে সেদিকে তাকিয়ে আবার গাড়ি ড্রাইভে মন দেয়। গাড়ি এসে থামে একটা শুনশান রাস্তায়। আশে পাশে কোনো জনমানবের ছায়াও নেই। সন্ধ্যা এমন অন্ধকার, শুনশান জায়গা দেখে ভয় পায়। ঢোক গিলে বলে,

‘এটা কোন জায়গা শহুরে ডাক্তার?’

আয়াশ গম্ভীর স্বরে বলে, ‘নামো। নামলেই বুঝবা এটা কোন জায়গা!’

‘আপনি এমন ফাঁকা জায়গায় আনছেন কেন আমারে? মে’রে টেরে ফেলবেন নাকি?’

আয়াশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় সন্ধ্যার দিকে। সাথে সাথেই তার হার্টবিট বেড়ে যায়। কপালের ভাজের জায়গায় পুরো মুখে ফুটে উঠে মুগ্ধতা। সন্ধ্যার ভীতু চাহনীতে আরো বেশি হৃদয় কাঁপানো সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে। চোখে মুখে এক অন্যরকম স্নিগ্ধতা। আয়াশ বিড়বিড় করে বলে,

‘আসলেই তুমি এক স্নিগ্ধ সন্ধ্যাবেলার সন্ধ্যামালতী। তাকে যে রুপেই দেখি সে রুপেই স্নিগ্ধতায় ঘেরা থাকে মুখ।’

সন্ধ্যার ডাকে হুশ ফিরে আয়াশের। নিজেকে স্বাভাবিক করে দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে যায়। সন্ধ্যাও সাহস করে নেমে যায়। আয়াশ সন্ধ্যার কাছে এসে বলে, ‘চলো!’

সন্ধ্যা কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করে না। জায়গাটা তার ভীষণ ভালো লাগে। চারদিকে নিরবতায় কেমন গায়ে কাটা দেওয়ার মতো অনুভূতি আর পাশে যদি থাকে প্রিয় মানুষ তাহলে তো কোনো কথায় নাই। দুজনেই নিশ্চুপ ভাবে হাঁটতে থাকে। এই নিরবতায় ছেদ পড়ে আয়াশের কথায়।

‘আচ্ছা সন্ধ্যা সৌন্দর্যের সঙ্গা কি তোমার কাছে?’

সন্ধ্যা ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। অন্ধকারে মুখ দেখতে পায় না। অবয়বটাই ভেসে ওঠে শুধু। এটা কেমন প্রশ্ন তা সন্ধ্যার বুঝে আসে না। এই সময় এটা কোনো প্রশ্ন হলো! সন্ধ্যা তবুও নিজেকে সামলে বলে, ‘যার মন সুন্দর সেই প্রকৃত সৌন্দর্যের মালিক।’

আয়াশ নিঃশব্দে হাসে। আলতো হাতে সন্ধ্যার হাত আগলে নেয়। কেঁপে ওঠে সন্ধ্যা। আয়াশ ঠোঁট কামড়ে হাসে। সে হাসি দেখতে পায় না সন্ধ্যা। অন্ধকারেই মিলিয়ে যায়। আয়াশ ফের বলে,

‘যাকে ভালোবাসো তার কোন সৌন্দর্য দেখো?’

চমকে ওঠে সন্ধ্যা। এমন প্রশ্নের জন্য যে সে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না তার কাপুনিতেই টের পায় আয়াশ। সন্ধ্যা বলে, ‘এসব কি প্রশ্ন করতেছেন শহুরে ডাক্তার!’

‘কেন? তোমার অসুবিধা হচ্ছে?’

সন্ধ্যা চুপ করে যায়। কিছুক্ষণ নিরবতায় কাটার পর সন্ধ্যা নিজেই বলে, ‘যাকে ভালোবাসি তাকে ঠিক কি কারণে ভালোবাসি জানি না। তবে নারীদের প্রতি তার সম্মান, তার ব্যাক্তিত্ব হয়তো এসব দেখেই তার প্রতি অনুভূতির সৃষ্টি। আর ভালোবাসার মানুষকে একটু বেশিই সুন্দর লাগে। হোক সে সুন্দর বা অসুন্দর। তার বাহ্যিক সৌন্দর্যও তখন চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। আর মন সুন্দর হলে তো পুরো পৃথিবীটাই হাতের মুঠোয় মনে হয়।’

আয়াশ মুগ্ধ হয়ে শোনে। বলে, ‘যদি কখনো তার সৌন্দর্য, ব্যাক্তিত্ব হারিয়ে যায় তবুও কি তোমার ভালোবাসা অটুট থাকবে! নাকি ফিকে পড়ে যাবে?’

সন্ধ্যা মৃদু হাসে, ‘ভালোবাসা কি কমার বস্তু নাকি? যদি আবেগ হয়ে তাহলে কমে যাবে কিন্তু যদি ভালোবাসা হয় তবে তা সময়ের ব্যবধানে বাড়বে বয় কমবে না। তাছাড়া মানুষের বাহ্যিক সৌন্দর্য, ব্যাক্তিত্ব আজীবন থাকে না। একসময় ঠিকই তা হারিয়ে যায়।’

সন্ধ্যা কথা শেষ করার সাথে সাথেই আয়াশ সন্ধ্যার হাত ছেড়ে দেয়। আয়াশের কোনো সাড়াশব্দও কানে আসে না সন্ধ্যার। ভীত গলায় ডাকতে থাকে , ‘শহুরে ডাক্তার! কোথায় আপনি? আছেন তো আপনি!’

উত্তর আসে না আয়াশের। সন্ধ্যা আয়াশের অবয়বও টের পায় না। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে৷ দুপা এগোয় আর আয়াশকে ডাকতে থাকে। একসময় হুট করেই কেঁদে ওঠে সন্ধ্যা। সাথে সাথেই পুরো জায়গাটা আলোয় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। সন্ধ্যা চমকে তাকায়। ফ্যালফ্যাল করে পুরো ডেকোরেট দেখতে থাকে। সরু রাস্তার দুপাশে সুন্দর করে গেইট সাজানো। পুরোটা লাইটিং করা। দারুণ লাগছে। কিন্তু এতকিছুর মধ্যেও আয়াশের খোঁজ পায় না। আবারও ডাকতে ডাকতে দুপা দুপা করে এগোয়। একটা জায়গায় গিয়ে দেখে সেখানে গোলাপের পাপড়ি দিয়ে লাভ সাজানো। তার ওপর একটা চিরকুট। সন্ধ্যা নিচু হয়ে চিরকুট তোলে। সেখানে লিখা, ‘ ভালোবাসার এক বিশাল রাজ্যে স্বাগতম সন্ধ্যামালতী।’ সন্ধ্যা গোলাপের পাপড়ি ছুয়ে দেয়। তারপর উঠে আবারও এগোয়। একটু দুরে দেখতে পায় অনেকগুলো সন্ধ্যামালতী একসাথে রাখা। সন্ধ্যা সেখানে ছুটে যায়। সন্ধ্যামালতী ছুঁয়ে দেখে। একগাল হেঁসে আরো একটু এগোয়। রাস্তা শেষ করে একটা বিশাল মাঠে পা রাখে সন্ধ্যা। পুরো মাঠটা অন্ধকারে মোড়ানো। সন্ধ্যা কয়েকবার ডাকে আয়াশকে। ডাকতে ডাকতেই এসে পড়ে মাঠের মাঝখানে। পায়ের সাথে কিছু বেঁধে গেলে নিচের দিকে তাকাতেই লাইট অন হয়ে যায়।গোলাপের অনেক গুলো পাপড়ি ওপর থেকে পড়ছে৷ সামনে তাকাতেই আরো একবার হতভম্ব হয় সন্ধ্যা। আয়াশ হাটু মুড়ে বসে সন্ধ্যামালতী ফুল হাতে হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। সন্ধ্যা ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। আয়াশ গলা পরিষ্কার করে বলে,

‘এই যে মিস সন্ধ্যাবেলার সন্ধ্যামালতী আপনি কি আমার মিসেস হবেন? আমার এসব ভালোবাসা, বিয়ে এগুলোতে ছিলো ভীষণ রকম তিক্ত অনুভূতি কিন্তু আপনার সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকে এই তিক্ত অনুভূতি একটা মিষ্টি অনুভূতিতে বদলে গেছে। আপনাকে ছাড়া আমি নিজের অস্তিত্ব টের পায় না৷ কবে এতো মিশে গেলেন আমাতে? আপনার ‘শহুরে ডাক্তার’ ডাকটা আমার হৃদয় কাঁপিয়ে তোলে। আপনি কি কান পেতে শুনবেন সেই কাঁপা কাঁপা শব্দগুলো? আপনি কি আমার হৃদয় দোলানো অনুভূতি প্রখর হওয়ার কারণ হবেন? আমার ভালোবাসায় নিজেকে রাঙাবেন? ভালোবাসবেন আমাকে? বিয়ে করবেন আমাকে?’

সন্ধ্যা উত্তেজনায়, আনন্দে কেঁদে ফেলে। দু হাতে মুখ চেপে শব্দ করে কেঁদে মাথা নাড়ায়। আয়াশ চোখ দিয়ে ইশারা করে ফুল গুলো নিতে। সন্ধ্যা ফুল গুলো নিতেই হাত টেনে ধরে আয়াশ। পকেট থেকে একটা রিং বের করে বলে, ‘উইল ইউ ম্যারি মি সন্ধ্যামালতী?’

সন্ধ্যা হুট করেই হাটু মুড়িয়ে বসে আয়াশকে জড়িয়ে ধরে। কাঁদতে থাকে হিচকি তুলে। আয়াশ বোঝে এ অশ্রুর কারণ তাই তো বাঁধা দেয় না। প্রশান্তি নিয়ে হেঁসে আঁকড়ে ধরে তার সন্ধ্যামালতীকে৷ অনেকটা সময় কাটে এভাবেই।

‘আর কতক্ষণ তোরা জড়ায় ধরে থাকবি? এবার তো ছাড়। আর সন্ধ্যারে রিং পড়া।’

কথাগুলো কানে আসতেই ঝটকা মেরে সরে যায় আয়াশ সন্ধ্যা। আয়াশ হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকায় তার বন্ধুমহলের দিকে। আয়াশকে তাকাতে দেখে রানা, আকাশ, তমাল, লিজা, জেরিন, সাফি সবাই দাঁত কেলিয়ে হাসে। ওদিকে সন্ধ্যার তো লজ্জায় মরি মরি অবস্থা। গাল দুটো রক্তিম আভা ধারণ করেছে। আয়াশ অবাক কন্ঠে বলে,

‘তোরা! এখানে!’

রানা দাঁত কেলিয়ে বলে, ‘আয়াশ সন্ধ্যা যেখানে রানাবাহিনীরাও সেখানে।’

সবাই হৈ হৈ করে ওঠে। আয়াশ কান চেপে ধরে বলে, ‘থাম সবগুলা। তোরা আমারে শান্তি দিবি না তাই না! কাবাব মে হাড্ডি হওয়ার জন্য সব জায়গায় চইলা আসবি?’

লিজা ভেংচি কেটে বলে, ‘বন্ধুরা থাকেই শান্তি কেড়ে নিয়ে অশান্তির মুখ দেখানোর জন্য। বাই দ্যা ওয়ে কাবাবে হাড্ডি না থাকলে কি জমে বল!’

‘জ্বি জমে। কারণ মানুষ হাড্ডি ফেলেই দেয়।’

সবাই হতাশ দৃষ্টিতে তাকায়। আকাশ বলে, ‘তুই তো আর আমাদের ফেলতে পারবি না। এবার কথা কম কইয়া সন্ধ্যারে রিং পড়া।’

সবাই গোল হয়ে দাঁড়ায়। লিজা সন্ধ্যাকে আয়াশের সামনাসামনি করে দাঁড় করায়। সন্ধ্যা তখনো লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে। জেরিন হাসতে হাসতে বলে, ‘দোস্ত এ তো লজ্জাবতী লাজুকলতা। সন্ধ্যা তোমার নাম সন্ধ্যামালতী না হয়ে লাজুকলতা হলে ভালো হতো।’

সবাই হেঁসে ওঠে। আয়াশ সন্ধ্যাকে রিং পড়ায়। রানা বায়না ধরে বলে, ‘এখন আমাগো ট্রিট দে।’

আয়াশ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘তোদের কেন ট্রিট দিবো?’

‘ওমা! তোদের দুইটারে মিলানোর পরিকল্পনা তো প্রথমে আমরাই করছি নাকি! আমাদের বুদ্ধির জন্যই তো আজ এতো কিছু।’

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় আয়াশ। বাকি সবাই দাঁত কেলায়। আকাশ বলে, ‘দোস্ত বিয়ে করবি কবে?’

‘এই মাসেই।’

তমাল গালে হাত দিয়ে অবাক হওয়ার মতো চোখ বড় বড় করে বলে, ‘ওহ রে বাবা এতো তাড়াতাড়ি!’

আয়াশ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ এতো তাড়াতাড়িই করবো। সন্ধ্যাকে দিয়ে বিশ্বাস নাই দেখা গেলো কোথা থেকে কে এসে ওকে নিয়ে হাওয়া হয়ে যাবে তখন আমার দেবদাস হতে হবে। সো নো রিস্ক!’

সবাই মুখ টিপে হাসে। জেরিন আর লিজা পাশ থেকে সন্ধ্যাকে পচাচ্ছে। আয়াশ সন্ধ্যার হাত টেনে নিজের কাছে এনে বলে, ‘তোরা এবার যা।’

আকাশ ভেংচি কেটে বলে, ‘ছেলের তর সয় না!’

‘হ্যাঁ জানোসই তো। এবার ভাগ হা’রা’মিরা।’

লিজা আর জেরিন দুইপাশ থেকে সন্ধ্যাকে টেনে নিজদের কাছে এনে বলে, ‘এখন কোনো টাইম স্পেন্ড হচ্ছে না। যা হওয়ার তা বিয়ের পর হবে।’

আয়াশ হতাশ দৃষ্টিতে তাকায়। তারপর সন্ধ্যাকে বলে, ‘কাল আমরা গ্রামে যাবো।’

সন্ধ্যা অবাক চোখে তাকিয়ে বলে, ‘কেনো?’

আয়াশ বাঁকা হেঁসে বলে, ‘তোমার কাগজপত্র আনবো আর গ্রামের রহস্য সমাধান করে আসবো!’

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here