তুমি_সূচনায়,#পর্ব-১০ (রিয়ার বিয়ে)

0
532

#তুমি_সূচনায়,#পর্ব-১০ (রিয়ার বিয়ে)
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা

আজ রিয়ার মেহেন্দির অনুষ্ঠান। ঊর্মি নিবিড়ের দেওয়া জলপাই রঙের লেহেঙ্গাটা পড়েছে। কোমড় সমান চুল গুলো সামনে থেকে বিনুনি করে একপাশে রেখেছে। সাথে হালকা মেক-আপ আর নিবিড়ের কিনে দেওয়া অর্নামেন্টস। ঊর্মি তৈরি হয়েই তার পরিবারের সাথে বেরিয়ে পড়ে রিয়াদের বাড়িতে যাওয়ার উদ্দেশ্য। যেহেতু ওদের বাড়ি একই পাড়াতেই, যাতায়াতে বেশিক্ষণ সময় ব্যয় হয় না।

ঊর্মি আর ওর পরিবার রিয়ার বাড়িতে যাওয়ার পরপরই মেহেন্দির অনুষ্ঠান শুরু হয়। রিয়া বায়না ধরেছে ঊর্মি ওকে মেহেন্দি লাগিয়ে না দিলে সে কিছুতেই মেহেন্দি লাগাবে না। এর আগে যেকোনো অনুষ্ঠানে, ঈদে রিয়া সবসময় ঊর্মির কাছে মেহেন্দি দিতো। ঊর্মি খুব যত্ন সহকারে রিয়ার দু’হাত ভরে মেহেন্দি লাগিয়ে দিয়েছে। নাজিফাকে আর নিজের হাতেও লাগিয়েছে সময়ের ফাঁকে।

মেহেন্দি দিতে দিতে রাত প্রায় এগারোটা বাজতে চললো। ঊর্মির এখন বেশ খিদে পেয়েছে। রিয়ার আশেপাশে তার অনেক গুলো কাজিন বসে ফোটোগ্রাফি করছে। ঊর্মি চুপ করে একটা চেয়ারে বসে মোবাইল দেখছে। ফোনের থেকে মাথা তুলে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে নিবিড় একটা প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

নিবিড় : এগারোটা বাজতে চললো তুমি এখনো না খেয়ে আছো তাড়াতাড়ি খাবারটা খেয়ে নাও।
আমি : আমার যে খিদে পেয়েছিলো আপনি বুঝলেন কিভাবে? (অবাক হয়ে)
নিবিড় : বেশি কথা না বলে খেয়ে নাও

এতোক্ষণ একটানা মেহেন্দি লাগিয়ে ওর হাত এখন ব্যথায় টনটন করছে তবে মুখে কোনো কথাই বলছে না সে।

নিবিড় : হা করো! (ঊর্মির মুখের সামনে খাবার এগিয়ে দিয়ে)
আমি : আচ্ছা এই লোকটা সব কিছু বুঝে যায় কিভাবে?

ঊর্মি কোন কথা না বলে খাবার খেতে শুরু করলো। দূর থেকে মিসেস অন্তরা আর আনিসুল সাহেব আড়ালে চোখের পানি মুছলো।

মিসেস অন্তরা : আমার মেয়েটা নিবিড়ের সাথে ভালোই থাকবে তুমি দেখো!
আনিসুল সাহেব : এবার বিয়ে কথাটা ঊর্মিকে বোঝাতেই হবে।

আজ রিয়া আর সাহিলের গায়ে হলুদ, অনুষ্ঠান দু’জনেরটা একইসঙ্গে। রিয়াকে কাঁচা হলুদ রঙের জামদানী শাড়ি সাথে কাঁচা ফুলের গহনা দিয়ে সাজানো হয়েছে, সাহিলও রিয়ার সাথে ম্যাচিং করে কাঁচা হলুদ রঙের পাঞ্জাবি পড়েছে। ঊর্মি আজ লাল পাড়ের বাসন্তী রঙের শাড়ি পড়েছে সাথে কাঁচা ফুলের হালকা কিছু গহনা। ঊর্মি তৈরি হয়ে রুম থেকে বের হচ্ছিলো সেন্টারে যাওয়ার উদ্দেশ্যে এমন সময় নিবিড় ওর রুমে আসে। হাতে কাগজ মোড়ানো কিছু একটা রয়েছে। ঊর্মিকে বিছানায় বসিয়ে নিবিড় ঊর্মির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে কাগজ মোড়ানো প্যাকেটটা খুললো।

নিবিড় : তোমার পা’টা সামনে রাখো আমি নিজে তোমাকে আলতা পড়িয়ে দেবো। তুমি তো আলতা পড়তে ভালোবাসো।
আমি : আপনি কি করে জানলেন আমি আলতা পড়তে ভালোবাসি?
নিবিড় : তোমার জন্মের পর থেকে আমি তোমাকে চিনি। আমি জানি কখন তোমার কোন জিনিসটা পছন্দ হয়, শুধু একটা বিষয় নিয়ে আমি অবগত ছিলাম না।

খুব যত্ন সহকারে নিবিড় ঊর্মির পায়ে আলতা পড়িয়ে দিলো। নিবিড়ের অনেক দিনের ইচ্ছে ছিলো ঊর্মির আয়ে নিজ হাতে আলতা পড়িয়ে দেবে, এই সুযোগে তার ইচ্ছেটা পূরণ হয়ে যাবে।
রিয়া আর সাহিল আজ খুব খুশি কাল তদের ভালোবাসা পূর্নতা পাবে। ক’জনের আর এমন ভাগ্য হয়? সবাই একে একে হলুদ লাগিয়ে দিচ্ছে সাথে ফোটোগ্রাফি আর ভিডিও করা তো আছেই। রিয়া আর সাহিলকে হলুদ লাগিয়ে চলে আসতে নিবে তখনই ওরা দু’জন মিলে ঊর্মির গালে হলুদ লাগিয়ে দেয়।

আমি : কি করলি এটা তোরা?
রিয়া : আমাদের পরে যাতে তোর সিরিয়াল লাগে তাই তোকেও হলুদ লাগিয়ে দিলাম।
সাহিল : আরে এতো প্যারা নিস না বান্ধুবী।

গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান খুব ভালো ভাবেই কেটে যায়। আজ রিয়া আর সাহিললের বিয়ে, পরিবেশটা অনেকটা জমজমাট আর হৈ-হুল্লোড়ের মধ্যেই রয়েছে। বিয়ের সাজে রিয়ার থেকে কিছুতেই চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। ঊর্মি আজ নিবিড়ের দেওয়া মেরুন রঙের লেহেঙ্গাটা পড়েছে, ঊর্মির সাথে ম্যাচিং করে নিবিড়ও গোল্ডেন সুতোয় বাঁধা মেরুন রঙের পাঞ্জাবি পড়েছে। নিবিড়কে আজ অন্যরকম লাগছে, যে কেউ-ই প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ে যেতে সক্ষম। দেখতে দেখতে বিয়ের সমস্ত কাজ সম্পন্ন হয়েছে এখন বিদায়ের পালা। রিয়া তার বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে হওয়ায়, মেয়েকে স্বামীর বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছে বলে সবারই মন খারাপ, রিয়ার মা তো মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই যাচ্ছে। শুধুমাত্র একজনের মন খারাপ নেই, সেই ব্যক্তিটা স্বয়ং রিয়া নিজেই।

আগে প্রায়শই বলতো ‘আমার বিয়েতে আমি কান্না করবো না, শুধু শুধু কান্না করে এতো সুন্দর সাজ আমি নষ্ট করতে পারবো না’ আজ তা দেখিয়েও দিচ্ছে সে। বিদায়ের সময় রিয়া তার মা’কে শান্তনা দিয়ে বলে গেছে ‘আরে আম্মু চিল, বিয়ে হয়ে গেছে বলে কি এতো কাঁদতে হবে। আমি তো তোমাদের কাছেই থাকবো যখন মন চাইবে চলে আসবে আমার কাছে।

নিবিড় : আর যাই বলো তোমার বান্ধুবী কিন্তু তোমার থেকেও বেশি বুদ্ধিমতী। বিয়ের সাজ নষ্ট হবে বলে কান্নাও করছে না।
আমি : বুদ্ধিমতী না ছাই! ও আগে থেকেই বিয়ে পাগল।
নিবিড় : হাহাহা!

দেখতে দেখতে রিয়া আর সাহিল বিয়ের সকল কাজ খুব ভালো ভাবেই সম্পন্ন হয়েছে।


বেশ কিছুদিন পর……..

দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষে ঊর্মি টেবিলে বসে উপন্যাসের বই পড়ছিলো এমন সময় আনিসুল সাহেব মেয়ের রুমে আসেন। ঊর্মি তার বাবার মুখে পানে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে দেখলো আনিসুল সাহেব কিছু একটা বলার জন্য উশখুশ করছেন। বাবার এমন আচরণ দেখে ঊর্মি জিজ্ঞেস করলো….

আমি : আব্বু তুমি কি কিছু বলবে?
আনিসুল সাহেব : তোমাকে আমার কিছু বলার আছে মামুনি।
আমি : হ্যাঁ বলো!
আনিসুল সাহেব : তোমাদের দুই ভাই-বোনকে আমরা সবকিছুতেই স্বাধীনতা দিয়েছি। আমার সন্তানদের প্রতি আমার বিশ্বাস সর্বদা রয়েছে, আমার সন্তানরা কখনোই ভুল পথে চালিত হয়নি। একটা কথা মনে রাখবে সবসময় “বাবা-মা কখনোই সন্তানের খারাপ চায় না।” আজ আমি তোমার কাছে কিছু চাইবো, তুমি কি তা দেবে মামুনি?
আমি : আমি আমার আব্বু-আম্মুর জন্য সব কিছু করতে পারি। বলো আব্বু তোমার কি চাই?
আনিসুল সাহেব : আমি আর তোমার আম্মু চাইছি নিবিড়ের সাথে তোমার বিয়ে দিতে। নিবিড় যথেষ্ট ভদ্র, সুশীল আর সব দিক থেকে তোমার যোগ্য। তুমি তোমার মতামত দিলে আমরা এগোবো, আশা করি তুমি আমাকে ফিরিয়ে দেবে না মা!
আমি : আব্বু আমার কিছু সময় চাই!
আনিসুল সাহেব : তোমার যত সময় লাগে তুমি নাও মামুনি। আমরা চাই আমাদের মেয়ে সুখে থাকুক।

কথাটা বলেই আনিসুল সাহেব মেয়ের রুম থেকে চলে যান। বাবার চলে যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে কিছু একটা ভাবতে লাগলো ঊর্মি।

আমি : আমি আমার আব্বু আম্মুর সাথে কি খুব বেশি অন্যায় করে ফেলছি? তারা তো আমার ভালোর জন্যই ভাবছে। তানভীরকে ভুলে যেতে হলেও আমাকে আমার জীবনে এক ধাপ এগিয়ে যেতে হবে।

অন্যদিকে………

মিসেস অন্তরা নিজের রুমে বসে রিয়ার সাথে কলে কথা বলছিলেন তখনই আনিসুল সাহেব রুমে আসেন। মিসেস অন্তরা ইশারায় জানতে চায় “ঊর্মিকে বলেছো? কিছু কি বললো সে?” আনিসুল সাহেব স্ত্রীর ইশারা বুঝতে পেরে মাথা ডানে বামে করলেন যার অর্থ “না” এবার মিসেস অন্তরা রিয়াকে বলে…

মিসেস অন্তরা : শোন না রিয়া তুই একটু মেয়েটাকে বুঝিয়ে বল না রে মা!
রিয়া : আন্টি তুমি একদম চিন্তা করো না। আমি ওকে বুঝিয়ে বলবো। বিকেলে ওকে আমাদের ফ্ল্যাটে পাঠিয়ে দিও। বলবে আমি যেতে বলেছি।
মিসেস অন্তরা : হুম! আমি এক্ষুনি গিয়ে বলছি।

কল কেটে দিয়ে মিসেস অন্তরা তড়িঘড়ি করে মেয়ের রুমে গেলেন। গিয়ে দেখে মেয়ে তার গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে রয়েছে। মেয়ের কাঁধে হাত রেখে বললেন….

মিসেস অন্তরা : রিয়া আর সাহিল তোকে ওদের ফ্ল্যাটে যেতে বলেছে।
আমি : কেনো?
মিসেস : আমি কি জানি!
আমি : আচ্ছা যাচ্ছি।

কিছুক্ষণ পরেই ফ্রেশ হয়ে চলে যায় রিয়ার সাথে দেখা করার জন্য। কলিং বেল চাপতেই সাথে সাথেই রিয়া গেইট খুলে দেয় যেনো ওর জন্যই অপেক্ষা করছিলো। ঊর্মিকে রুমে নিয়ে গিয়ে বসালো, সাহিল বাসায় নেই একটা পার্ট টাইম জব করছে। রিয়া চটপট দু’জনের জন্য দু’মগ কফি আর নুডলস রান্না করে নিয়ে আসে। কিছুক্ষণ ভালো মন্দ কথা বলার পর রিয়া ঊর্মিকে বলে….

রিয়া : আন্টি বললো আঙ্কেল নাকি তোর সাথে নিবিড় ভাইয়া বিয়ে ঠিক করতে চায়? তোর কি মতামত?
আমি : আমি কি করবো সেটা নিয়ে কনফিউশানে আছি।
রিয়া : একবার মনের কথা শুনে কষ্ট পেয়েছিস এখন না-হয় আঙ্কেল আন্টির কথা শোন। নিবিড় ভাইয়া যথেষ্ট ভদ্র আর কেয়ারিং একটা ছেলে, দেখবি তোকে অনেক সুখে রাখবে। একদিন তুই নিজে থেকে বলবি আঙ্কেল আন্টি ঠিক কাজই করেছেন।
আমি : কিন্তু আমি এখন বিয়ে করতে চাই না!
রিয়া : অন্তত আঙ্কেল আন্টির কথা ভেবে রাজি হয়ে যা।

ঊর্মি চুপ করে রিয়ার কথা গুলো শুনছে আর একটু একটু করে কফির মগে চুমুক দিচ্ছে।

রিয়া : চুপ করে থাকাটাই কি তোর সম্মতির লক্ষণ হিসেবে ধরে নেব?
আমি : হুম!

ঊর্মির হ্যাঁ সূচক মতামত পেয়ে খুশিতে রিয়া ঊর্মিকে জড়িয়ে ধরে। এমন সময় কেউ কলিং বেল চাপে, রিয়া ঊর্মিকে বসিয়ে গেইট খুলতে চলে যায়। সাহিল দেখা মাত্রই রিয়া আনন্দের সাথে ঊর্মির মত দেওয়ার কথাটা বলে দেয়। এই সুযোগে রিয়া মিসেস অন্তরার কাছেও খবর পৌঁছে দিয়েছে। মেয়ের হ্যাঁ সূচক উত্তর শুনে মিসেস অন্তরা আনন্দে দিশেহারা অবস্থা।

এতোক্ষণ রিয়ার চিল্লাপাল্লা ঊর্মি রুম থেকে ঠিকই শুনতে পেরেছে। কিছুক্ষণ পর সাহিল আর রিয়া দু’জনেই রুমে চলে আসে। সাহিল ঊর্মিকে উদ্দেশ্য করে বলে…

সাহিল : সখি আমার বিয়েতে শেষমেশ রাজি হলো। আহ কত দিন বিয়ে খাই না।
আমি : শুরু হয়েছে নাটক। যেমন বউ তার তেমনই জামাই।

চলবে?….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here