আপনিময়য়_বিরহ (১১)

0
453

#আপনিময়য়_বিরহ (১১)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
__________________

রাতের ডিনার সেড়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে শিশির। অফিসের কিছু কাজ বাকি আছে তা কমপ্লিট করবে। এরমধ্যেই রুমে আসে অনিমা। চোখে মুখে মলিনতার ছাপ। চোখের নিচে কালো দাগ স্পষ্ট। অনিমা এসে শিশিরের সামনে দাঁড়ায়। শিশির ল্যাপটপে মুখ গুজেই বলে,

‘কিছু বলবে?’

অনিমা জবাবে চুপ থাকে। শিশির অনেকক্ষণ পরেও উত্তর না পেয়ে মুখ তুলে তাকায়। অনিমার চোখের কোণে জল দেখে কিছুটা চমকায়। বলে, ‘কি হয়ছে? কান্না করতেছো কেন?’

অনিমা কান্না করা অবস্থাতেই হাসে। চোখ মুছে ভীষণ শীতল কন্ঠে বলে, ‘আপনার কাছে কিছু চাইলে দিবেন শিশির ভাই?’

শিশির এবারও খানিকটা চমকায়। মেয়েটা তো এভাবে বলে না। আজ হঠাৎ কি হলো! শিশিরকে কিছু ভাবতে দেখে অনিমা হেঁসে বলে, ‘অন্যায় কিছুই আবদার করবো।’

শিশির কিছুক্ষণ অনিমার দিকে তাকিয়ে নড়েচড়ে বসে। তারপর বলে, ‘কি চাও?’

অনিমা ভীষণ আকুতির স্বরে বলে, ‘আমাকে একটা বার জড়িয়ে ধরবেন শিশির ভাই?’

শিশির অবাকের শেষ পর্যায়ে। এতোগুলো দিন বাদে অনিমা এমন কিছু চাইবে তা সে কল্পনাই করেনি। তাদের বিয়ের ৬ মাস পার হলেও কখনো এক বিছানায় ঘুমায়নি যথেষ্ট দূরত্ব ছিলো দুজনের। সেখানে আজ অনিমার এমন চাওয়া অবশ্যই ভাবনার বিষয়। শিশিরকে অনেকক্ষণ চুপ থাকতে দেখে অনিমা ধরে আসা গলায় বলে, ‘প্লিজ! শুধু একবার।’

শিশির আর কিছু বললো না। এতদিন পর মেয়েটা কিছু চেয়েছে সে না হয় দিক। তাদের মধ্যেও তো পবিত্র সম্পর্ক অথচ কত কত দূরত্ব। শিশির ল্যাপটপ ছেড়ে উঠে আসে। অনিমার কাছাকাছি দাঁড়াতেই অনিমা ছলছল দৃষ্টিতে তাকায়। শিশির নিজেই কাঁপা কাঁপা হাতে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয় অনিমাকে। অনিমা ভীষণ শক্ত করে আঁকড়ে ধরে তাকে। ঠোঁট চেপে কান্না আটকায় তবুও চোখ থেকে পানি পড়ে শিশিরের টি-শার্ট ভাসিয়ে দেয়। শিশির কিছু বলে না। অনিমা নিজেই একসময় ছেড়ে দেয়। তারপর শিশিরের সামনে দাঁড়িয়ে পা উচু করে কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। শিশির কিছু বলতে গিয়েও চুপ থাকে। অনিমা কেমন করে হেঁসে বলে,

‘ধন্যবাদ। এখন আপনি কাজ করুন। আমি আসি!’

বলেই চলে যায়। অনিমার হঠাৎ এহেন আচরণ হজম করতে পারে না শিশির। কি এমন হলো! এতোদিনের সব ঘৃণা উগলে আজ ভালোবাসার ছোঁয়া! কেন? শিশির ভাবতে পারলো না। মাথা চেপে বসে রইলো।

গভীর রাতে ঘুম নেই প্রিয়তা আর তনিমার চোখেও। দুজনেই চুপ করে বসে আছে ব্যালকনিতে। সারাদিন সব কিছু হজম করে থাকলেও এই রাতটা ভীষণ প্যারা দেয়। রাত আসলেই সব স্মৃতি, ক্ষত একসাথে জড়ো হয়। প্রিয়তাকে চুপ করে থাকতে দেখে তনিমা কি মনে করে বলে,

‘একটা গান শোনা তো প্রিয়ু।’

প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে, ‘আমার ঠ্যাকা পড়ছে এতো রাতে তোরে গান শুনাবো!’

‘আরে এমন করিস কেন? শোনা না! প্লিজ প্লিজ প্লিজ।’

প্রিয়তা আর কিছু বলে না। গিটার ছাড়াই গান ধরে,

”তুমি আর তো কারো নও, শুধু আমার
যতো দুরে সরে যাও রবে আমার
স্তব্ধ সময়টাকে ধরে রেখে
স্মৃতির পাতায় শুধু তুমি আমার
কেন আজ এতো একা আমি
আলো হয়ে দুরে তুমি
আলো আলো আমি কখনো খুঁজে পাবো না
চাঁদের আলো তুমি কখনো আমার হবে না
আলো আলো আমি কখনো খুঁজে পাবো না
চাঁদের আলো তুমি কখনো আমার হবে না..’

গান শেষ করতেই তনিমা হাত তালি দিয়ে বলে, ‘বাহ বাহ তোর কাউয়ার মতো গলা দিয়ে এতো সুন্দর গান। যাক ভালোই গেয়েছিস যদিও কাউয়ার কা কা মনে হয়ছে তবুও ঠিক আছে।’

কথা বলতে দেড়ি কিন্তু তনিমার পিঠে মাইর পড়তে দেড়ি না। সামনের বিল্ডিং থেকে পুরোটাই প্রিয়ম দেখলো। চোখ বুজে শ্বাস নিয়ে প্রিয়তার দিকে তাকায়। মেয়েটা কে তার লাগবেই। এই টুনটুনি ছাড়া তার বাঁচাটা অসম্ভব প্রায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে পুরো চাঁদ উঠেছে। চোখ বন্ধ করে চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘চাঁদের আলো তুমি কখনো আমার হবে না…’

প্রিয়তা তনিমাকে মাইর দিয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আচ্ছা তনু জীবনকে যদি আরেকটা সুযোগ দেয় তাহলে কি খুব ভুল হবে?’

তনিমা তখন পিঠে হাত বুলাতে ব্যস্ত। প্রিয়তার কথায় হাত থেমে যায়। অবাক চোখে বলে, ‘কি বললি? আবার বল!’

প্রিয়তা রাগী চোখে তাকায় তার দিকে। তনিমা আরো একটু এগিয়ে আসে প্রিয়তার কাছে। তারপর কপালে, গালে হাত দিয়ে বলে, ‘তোর শরীর ঠিক আছে বইন?’

প্রিয়তা রাগী কন্ঠে বলে, ‘তোর সাথে সিরিয়াস কথা বলার থেকে কু’ত্তার সাথে বলা ভালো। সর।’

তনিমা হেঁসে বলে, ‘তোর ভাইও কিন্তু কু’ত্তার চেয়ে কম না। যা ওর কাছে গিয়ে সিরিয়াস কথা বল।’

প্রিয়তা জবাবে কিছু বলে না। চোখ বন্ধ করে থাকে। তনিমা প্রিয়তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘অনেকদিন পর ভালো একটা ডিসিশন নিয়েছিস। তা সুযোগটা কাকে দিচ্ছিস?’

প্রিয়তা সামনের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তোর কি মনে হয়?’

তনিমা কিছুক্ষণ চুপ করে প্রিয়তার চোখের দিকে তাকায়। দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকিয়ে অবাক স্বরে বলে, ‘প্রিয়ম ভাই!’

প্রিয়তা নিঃশব্দে হাসে। তনিমা অবাক হয়েই বলে, ‘তার মানে তুই সব…

‘আমাকে কি তোর গাধা মনে হয়? যেখানে কোনো ছেলে তাকালেও মেয়েরা বুঝতে পারে সে কোন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেখানে আমি এতোকিছুর পরও বুঝবো না? হ্যাঁ প্রথমে ভাবতাম হয়তো আমাকে স্বাভাবিক করার জন্য উনি এতো কেয়ার করেন। এতোকিছু করেন। কিন্তু সেদিন আমার ধারণা প্রথম বদলে গেছে যেদিন শিশির ভাইকে দেখে উনি ভীষণ রেগে গেছিলো। সেদিন থেকে কিছুটা সন্দেহ হলেও পাত্তা দিতাম না৷ কিন্তু আজ ভার্সিটিতে যা যা হলো তারপর আমি ১০০% সিউর আমার প্রতি উনার প্রখর অনুভূতি আছে। তোর কি মনে হয়?’

তনিমাও হাসে। সেও তো বুঝে প্রিয়ম ভাই প্রিয়তাকে অনেকটা ভালোবাসে। কিন্তু প্রিয়তা রাগ করবে ভেবে কিছুই বলতো না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, ‘আমি ভাবতাম তুই কিছুই বুঝিস না। এতো কিছু বুঝেও চুপ থাকতি কেন?’

প্রিয়তা মলিন হেঁসে বলে, ‘কিছু কিছু সময় বুঝেও অবুঝ হয়ে থাকতে হয়। যে কারণে শিশির ভাই আমাকে ছেড়েছে ঠিক একই কারণে যদি প্রিয়ম ভাইও আমাকে কখনো ছেড়ে দেয়!’

তনিমা চমকে তাকায়। প্রিয়তার চোখ ততক্ষণে ঝাপসা হয়ে গেছে। অতীত বড্ড পোড়ায়। এই অতীতের জন্য সে কত রাত ঘুমহীন কাটিয়েছে। তনিমা জড়িয়ে ধরে প্রিয়তাকে। বলে,

‘সবাই এক না। তুই নিজেকে একটা বার সুযোগ দিয়ে দেখ। তাছাড়া প্রিয়ম ভাই তোকে ভীষণ ভালোবাসে রে। অতীতটা ভুলে বর্তমান আঁকড়ে ধর। নতুন সূর্যের, নতুন ভোরের অপেক্ষা কর।’

প্রিয়তাও তনিমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। অনেক তো হলো অতীতের মাপকাঠি এবার না হয় বর্তমানটা নিয়ে একটু ভাবা যাক! তাছাড়া অতীতে যে তার প্রিয় বর্তমানে সেই মানুষটাই তার বোনের স্বামী। তাকে নিয়ে অনুভূতি রাখা শুধু ভুল না চরম অন্যায়। ওরা যেভাবেই পবিত্র সম্পর্কে জড়াক! জড়িয়েছে তো। ওরা না হয় ওদের মতো সুখী থাক। আর সে না হয় এবার নতুন কিছুর অপেক্ষা করুক। নতুন দিন, নতুন অনুভূতি আর নতুন সম্পর্কের অপেক্ষায় থাক।

______________

এলার্মের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় শিশিরের। লাফিয়ে উঠে বসে। আজ হঠাৎ এলার্ম কেনো! পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে দেখে অনিমা নেই। উঠে ওয়াশরুমও চেইক করে। অনিমা তো সকালে উঠলেও বের হয় না। তার মা’কে দিয়ে ইচ্ছে করে সব কাজ করায়। শিশির রুমের দরজা খোলা দেখে বাহিরে আসে। কিচেনে এসে দেখে অনিমা নেই। পুরো বাড়ি খুঁজেও সে অনিমার খোঁজ পায় না। চিন্তার রেখা কপালে ফুটিয়ে নিজের মায়ের দিকে এগিয়ে আসে। শিলা বেগম তখন রান্নায় ব্যস্ত। পেছন থেকে শিশিরের গলা পেয়ে তিনি ছেলের দিকে তাকান। ছেলে হঠাৎ কিচেনে কেন? ভাবতে ভাবতেই শিশির জিজ্ঞেস করে,

‘অনিকে দেখেছো?’

শিলা বেগম বিরক্তির ছাপ ফুটিয়ে তোলেন কপালে। বলে, ‘সে মেয়ে এতোদিনে কখনো রান্নাঘরের আশেপাশে এসেছে?’

‘অনিমা পুরো বাড়ির কোথাও নেই।’

কথাটা কানে যেতেই পিলে চমকে উঠে শিলা বেগমের। অবাক চোখে বলে, ‘কোথাও নেই মানে কি? আমি তো সেই কোন সকালে উঠছি ওকে তো কোথাও দেখিনি।’

চিন্তাটা আরো প্রখর হয় শিশিরের। শিলা বেগমকে কিছু না বলে নিজেই রুমের দিকে এগিয়ে যায়। ফোন হাতে নিয়ে কল দেয় অনিমার মায়ের কাছে। সেখানেও যায়নি শুনে আরো বেশি চিন্তায় পড়ে যায়। মেয়েটা গেলো কই! এদিক ওদিক পায়চারি করতেই নজর যায় টেবিলে চাপা দেওয়া একটা কাগজের ওপর। সন্দেহবশত এগিয়ে যায় সেদিকে। কাগজটা হাতে নিতেই থমকে যায়। অনিমার হাতের লিখা চিনতে বেগ পেতে হয়নি। ছোট ছোট অক্ষরে লিখা,

‘শিশির ভাই..

আমি আজও আপনাকে ‘শিশির ভাই’ বলেই সম্বোধন করলাম। আপনার আর আমার সম্পর্ক স্বামী স্ত্রীর হলেও কখনোই আমরা স্বামী স্ত্রীর মতো থাকিনি৷ সব সময় একটা দূরত্ব ছিলো। আজ সব দূরত্ব খুইয়ে আপনাকে আর আপনার পরিবারকে মুক্তি দিয়ে আমি চলে যাচ্ছি। আপনাকে ভালোবাসতাম ঠিকই তবে আপনাকে পাওয়ার লোভ আমার ছিলো না। যখন বিয়ের জন্য আপনি এতোকিছু করলেন তখন হঠাৎ করেই স্বার্থপর হয়ে উঠলাম। ভুলে গেলাম ছোট বোনের কথা। যাকে এতো ভালোবেসেছি তার ভালোবাসায় আমি কেড়ে নিলাম। তার ছোট মনটা ভেঙে গুড়িয়ে দিলাম। তার আকাশ সমান ভালোবাসা, স্বপ্ন সবটা শেষ করে দিলাম। এটা ভাবলেও আমার কি যে যন্ত্রণা হয় বলে বোঝানো যাবে না। হ্যাঁ আমি দোষী আর আমি নিজের কাজে ভীষণ লজ্জিত, অনুতপ্ত। তাই নিজের শাস্তিটা নিজেই নিলাম। চাইলেই আপনার সাথে সংসার করতে পারতাম কিন্তু তাতে যে.. যাক ছাড়েন সেসব। ভালো থাকবেন সব সময়। প্রিয়তার মতোই আপনিও আমার আপনিময় বিরহ। আমি আমার বিরহ নিয়েই সুখী হবো।

অনিমা…’

শিশির স্তব্ধ। অনিমা সত্যিই তাকে ছেড়ে চলে গেছে? মেয়েটা তাকে অনেকটাই ভালোবেসেছে কিন্তু বরাবর সে তাকে অবহেলা করে গেছে। সম্পর্কের মর্যাদা তো রাখেনি। তাহলে অনিমা তার কাছে, তার সাথে থাকবে কেনো? শিশির চিঠিটা হাতেই এগিয়ে যায় রান্নাঘরের দিকে। ততক্ষণে শিলা বেগম চেচামেচি শুরু করেছে। চেঁচাচ্ছে আর বলছে,

‘এই মেয়েকে বউ করে নিয়ে আসাই জীবনের চরম ভুল। ভেবেছিলাম শান্তশিষ্ট লক্ষী একটা মেয়ে। লক্ষীর ‘ল’ টাও নেই। এর থেকে ঢের গুণ ভালো ছিলো প্রিয়তা। ওকে বউ করে আনলেও শান্তি পেতাম।’

শিশির মায়ের কথা শুনে তাচ্ছিল্যের সুরে হাসে। পেছন থেকে বলে, ‘প্রিয়তা তোমার চক্ষুবিষ ছিলো তাই ওকে তাড়িয়েছো আর এখন অনিমা তোমার চক্ষুবিষ। চিন্তা করো না! তোমার আর তাড়াতে হবে না। ‘ও’ একাই চলে গেছে।’

জীবন কত বৈচিত্রময়। একজন নতুন ভোরের অপেক্ষা করলো নতুন ভাবে সব শুরু করবে বলে আরেকজন নতুন ভোরের অপেক্ষা করলো সব ছেড়ে যাবে বলে। জীবন তো এমনই। কেউ নতুন ভাবে সব শুরু করে, ভালোবাসা খুঁজে নেয় আর কেউ সব ছেড়ে চলে যায়। ভালোবাসার মানুষকে ছেড়ে যায়। কেউ পরিস্থিতির জন্য তো কেউ ইচ্ছে করে….

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here