আপনিময়_বিরহ (১৩)

0
456

#আপনিময়_বিরহ (১৩)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী

সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে। কেটে গেছে বেশ কয়েকদিন। প্রিয়তা আর প্রিয়মের কেয়ারগুলোকে অন্য ভাবে নেয়না। তবে আগের মতোই সিমির এতো কেয়ার প্রিয়মের ওপর তা সহ্য করতে পারে না। সমানেই নবীন বরণ উৎসব। প্রিয়ম, উদয় ভীষণ ব্যস্ত। ভার্সিটির সিনিয়র হওয়ার সুবাদে সব কাজ তাদের ওপর। তনিমা ইচ্ছে করে নোমানের সাথে হেঁসে হেঁসে কথা বলে। উদয় দেখে আর রাগী চোখে তাকায়। তা অবশ্য পাত্তা দেয় না তনিমা। সাইমা যতটা সাদাফের কাছে নিজেকে প্রকাশ করতে চায় সাদাফ ততটাই ইগনোর করে তাকে। ক্লাসে বসে আনমনে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে ছিলো প্রিয়তা। বাহিরে সব কাজ নিয়ে ছোটাছুটি করছে। প্রিয়মকেও দেখতে পাচ্ছে। হঠাৎ করেই সবাই একদিকে ছুটে যাচ্ছে। হুট করে সবাই একদিকে দৌড়াচ্ছে দেখে প্রিয়তার খানিকটা সন্দেহ হয়। নিজের জায়গা থেকে উঠতে যাবে তখনই তনিমা ছুটে আসে। ব্যস্ত কন্ঠে বলে,

‘প্রিয়ম ভাইয়ের সাথে কারা যেনো ঝামেলা শুরু করেছে। দ্রুত চল।’

প্রিয়তা কয়েক মিনিটের জন্য থমকায়। এই ছেলে আবার কার সাথে ঝামেলা শুরু করলো! প্রিয়তা আর তনিমা দ্রুত ছুট লাগায় ক্যাম্পাসের দিকে। এসে দেখে অনেক ভীড় জমে গেছে কিন্তু কেউ এগোচ্ছে না। প্রিয়তা আর তনিমা কোনো রকমে ঠেলে ঠুলে ভেতরে ঢোকে। অবস্থা বেগতিক দেখে বার বার প্রিয়মকে ডাকতে থাকে৷ এদিকে প্রিয়ম আর ৩ টা ছেলের মধ্যে মারাত্মক রক্তারক্তি হয়ে গেছে। সেই মুহুর্তেই ছুটে আসলেন ভিসি। ভিসিকে দেখেই ঝামেলা থেমে যায়। প্রিয়মের মাথার এক কোণা বেয়ে টপটপ করে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। ভিসি এই অবস্থা দেখে রেগে জিজ্ঞেস করলেন,

‘এটা কি তোমাদের গুন্ডামি করার জায়গা? এটা কলেজ ক্যাম্পাস ভুলে যাও নাকি তোমরা। অনেক হয়েছে তোমাদের গুন্ডামি এবার নিজেদের গার্ডিয়ানকে ভার্সিটিতে আসতে বলো। আর প্রিয়ম তোমাকে তো আমি ভদ্র ছেলে বলে জানতাম তুমি এটা কি করলে?’

প্রিয়ম উত্তর দিলো না৷ ছেলেগুলোকে সে যথেষ্ট মে’রেছে তবুও তার মন ভরেনি। পারলে জানে মে’রে ফেলতো। একবার ঘাড় বাকিয়ে ছেলেগুলোকে আরেকবার প্রিয়তার দিকে তাকালো। প্রিয়তার কাতর মুখ দেখেই হঠাৎ তার সব রাগ উধাও হয়ে গেলো। প্রিয়তার কাতর মুখ দেখে তার কষ্ট হওয়ার কথাা হলেও শান্তি অনুভব করলো। আস্তে আস্তে জায়গা ফাঁকা হতে শুরু করলো। প্রিয়তা একপ্রকার লাফিয়ে আসে প্রিয়মের কাছে। অস্থির গলায় বলে,

‘কত কত রক্ত বের হচ্ছে! কি দরকার ছিলো আপনার ঝামেলা করার? তাড়াতাড়ি এদিকে আসুন।’

প্রিয়মকে কিছু বলতে না দিয়েই প্রিয়তা প্রথমে ওড়নার এক সাইড দিয়ে ফেটে যাওয়া জায়গাটা চেপে ধরে। তারপর টেনে নিয়ে যায় ভার্সিটির সাথে থাকা ফার্মেসিতে। প্রিয়ম পুরোটা সময় নিশ্চুপ হয়ে শুধু প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে ছিলো। ব্যান্ডেজ করা শেষে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

‘কি সমস্যাা আপনার? ঝামেলা করতে গেছেন কেন?’

‘তোর জন্য।’

প্রিয়তা ভ্যাবাচ্যাকা খায়। তার জন্য মানে! প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাতেই প্রিয়ম হালকা হেঁসে বলে, ‘কিছু না। কিন্তু তুই এতো উতলা হচ্ছিস কেন?’

প্রিয়তা উত্তর না দিয়ে বলে, ‘আজ আর ভার্সিটি থাকতে হবে না। বাড়ি চলুন।’

‘কাজগুলো কি তুই করবি?’

‘কাজ করার জন্য অনেক মানুষ আছে। বাই দ্যা ওয়ে আমার ভাইটা কই? এতোকিছু হয়ে গেলো আর ওর পাত্তা নাই।’

‘ও’ একটু বাহিরে গেছে।’

প্রিয়তা আর কিছু বলে নাা। প্রিয়মের হাত ধরে টেনে নিয়ে আসে গেইট পর্যন্ত। তারপর কল দেয় তনিমাকে। তনিমা রিসিভ করেই গড়গড় করে বলে, ‘কই গেলি তোরা? তোদের খুঁজে আমি হয়রান! প্রিয়ম ভাই ঠিক আছে তো?’

‘তোর আর খুঁজে লাভ নাই বইন। তুই উদয় ভাইয়ের সাথে চলে আসিস। আমি আর প্রিয়ম ভাই বাড়ি যাচ্ছি।’

তনিমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই খট করে কল কেটে দেয়। তারপর প্রিয়মকে নিয়ে একটা রিক্সা নেয়। প্রিয়ম ভ্রু কুঁচকে তাকায় প্রিয়তার দিকে। বলে, ‘গাড়ি থাকতে রিক্সা কেন?’

‘শখ হয়ছে তাই। চুপ করে বসে থাকেন। একে তো মাথা ফাটাইয়া দুনিয়া উদ্ধার করতেছে আবার বেশি কথা!’

‘তুই কি আমারে ধমকাচ্ছিস?’

‘ না ধমকাবো কেন? আপনারে তো আমি…

আর কিছু না বলে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকে। প্রিয়ম নিঃশব্দে হাসে। ভালোবাসা তো কেবল শুরু!

এদিকে তনিমা বেচারি আছে বিপদে। উদয় তার ওপর রেগে থাকে বলে বরাবরই সে উদয়ের থেকে দুরে দুরে থাকে। এমনকি বাড়িতেও প্রিয়তা নয়তো তাঁরা বেগমের পিছু পিছু ঘুরে যাতে করে উদয় কিছু বলতে না পারে। কিন্তু এখন? সেই জমের হাতে একা পড়লো! হায় আল্লাহ! আজ তো তার কপালে শনি, রবি, সোম সব আছে। বসে বসে আল্লাহর নাম নিচ্ছে আর নখ কামড়াচ্ছে। সাইমা অনেকক্ষণ এসব পর্যবেক্ষণ করে বললো,

‘একা একা কি বিড়বিড় করতেছিস ভুতের মতো?’

তনিমা একবার তাকায় সাইমার দিকে। তারপর আবার নখ কামড়াতে থাকে। সাইমাও নিজের মতো বসে গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে থাকে। তনিমা ভ্রু কুঁচকে তাকায় সাইমার দিকে। বলে, ‘তুই কি দেখিস?’

‘তোর নখ কামড়ানো।’

‘ধুর সর।’

‘কি হয়ছে বলবি তুই?’

‘বইন পড়ছি আজকা জমের হাতে। আজ আমার ইন্না লিল্লাহ নিশ্চিত।’

‘ক্লিয়ার কইরা ক।’

‘আরে ওই যে উদয় উগান্ডা উনি আমাকে কাঁচা চিবা’ইয়া খা’বে আজ। বইনরে বাঁচা আমারে।’

বলতে বলতেই উদয় হাজির। এসে সরাসরি তনিমার সামনের বেঞ্চে ওর দিকে হয়ে বসে। তনিমা ফাঁকা ঢোক গিলে। সাইমা ঠোঁট চেপে হেঁসে বলে, ‘আপনারা কথা বলেন। আমি আসতেছি।’

বলেই দৌড়। তনিমা মনে মনে সাইমার চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করলো। তারপর দাঁত কেলিয়ে উদয়ের দিকে তাকাতেই উদয় দিলো এক ঝাড়ি। ভয়ে লাফায় উঠে তনিমা। কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলে,

‘ধমকাচ্ছো কেন ভাইয়া? আমার ভয় লাগে তো।’

‘তোর ভয়ের খেতায় আগুন। আজ তোর সব সাহস আমি বের করে ছাড়বো।’

বলেই হাত ধরে টানতে টানতে গাড়ির দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। তনিমা সমানে বলে যাচ্ছে, ‘ছেড়ে দাও ভাইয়া। আর জীবনে তোমাার কথার অবাধ্য হবো না।’

কে শোনে কার কথা? ধপাস করে গাড়িতে ফেলে উল্টো ঘুরে এসে বসে পড়ে ড্রাইভিং সিটে। তনিমা ভয়ে চুপ হয়ে যায়। মনে মনে আল্লাহর নাম তো সে কখন থেকেই নিচ্ছে। উদয় সোজা গাড়ি চালিয়ে একটা শুনশান লেকের পাশে চলে আসে। অনেক দুরে দুরে এক দুইটাা মানুষ দেখা যাচ্ছে। তনিমা ভয়ে ভয়ে বলে,

‘এমন শুনশান জায়গায় আনছো কেন? মে’রে টেরে ফেলবা নাকি!’

উদয় রাগী চোখে তাকায় তার দিকে। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে সামান্য ঝুকে আসে তনিমার দিকে। বলে, ‘নোমানের সাথে কি তোর? এতো কিসের হাসাহাসি তোদের? তুই কোন সাহসে ওর সাথে কথা বলিস?’

তনিমা ভয় পেলেও সাহস করে বলে, ‘তুমিও তো রিনি আপুর সাথে কথা বলো ইনফ্যাক্ট দুজনে রিলেশনশিপেও আছো এতে আ-আমি কি কিছু বলি? না তো। তাহলে তুমি কোন অ-অধিকারে আমার ব্যাপারে নাক গলাও!’

উদয় কটমট করে বলে, ‘অধিকার তাই না! অধিকার!’

বলেই হুট করেই করে বসে এক অনাকাঙ্ক্ষিত কাজ। তনিমা শকড, ফ্রিজড। উদয় রাগ সব ঠোঁটের ওপর ঝাড়ে। কয়েক সেকেন্ড পর ছেড়ে দিয়ে একদম কাছে এগিয়ে আসে। একজন আরেকজনের নিঃশ্বাসের শব্দটাও শুনতে পায়। তনিমা তখনো শকড। এতো দ্রুত সব হয়ে গেছে যে সবটাই তার মাথার উপর দিয়ে গেছে। উদয় ফিসফিস করে বলে,

‘তোর ওপর সবরকম অধিকার শুধু আর শুধু আমার। তুই পুরোটাই আমার।’

তনিমা কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলে। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয় উদয়ের দিকে। উদয় মুচকি হেঁসে দূরত্ব মিটিয়ে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয় তনিমাকে। তারপর বলে, ‘রিনি আমার জাস্ট ফ্রেন্ড রে বোকা মেয়ে। সেদিন তোর ওপর আমার ভীষণ রাগ, অভিমান ছিলো তাই রাগের মাথায় ওকে গার্লফ্রেন্ড বলেছিলাাম। তুই তো চাইলেই নিজের অধিকার খাটাইতে পারতি! কেউ না তোর জিনিসের দিকে নজর দিলে তুই তার ১২ টা বাজাস তাহলে তোর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটার দিকে নজর দেওয়ার পরও চুপ করে ছিলি কেন? নাকি আমাকে ভালোবাসিস না?’

উত্তরে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তনিমা৷ চোখ থেকে টুপ করে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে। তার বিরহ কাটার পালা। সে এখন ভালোবাসার সুখটা অনুভব করবে। উদয় প্রশান্তির হাসি হেঁসে তনিমার কপালে নিজের ওষ্ঠ ছোঁয়ায়।

রাতের বেলায় গা কাপিয়ে জ্বর আসে প্রিয়মের। জ্বরে বিছানা থেকে উঠতে অবদি পারছে না। ভুলভাল বকে যাচ্ছে। তাহেরা বেগম টেনশনে পাগল হওয়ার জোগাড়। একবার এদিকে দৌড়াচ্ছে তো একবার ওদিকে। মাথায় ব্যান্ডেজের কারণে জলপট্টিও দিতে পারছে না। কোনো রকমে হালকা করে কাপড় ভিজিয়ে মুছিয়ে দিচ্ছে। প্রিয়ম একটু ঘুমোতেই তিনি ছুট লাগালেন বোনের কাছে। বাড়ি পাশাপাশি হওয়ায় সময় লাগে না। তাহেরা বেগম যাওয়ার পর পরই পিটপিট করে তাকায় প্রিয়ম। আস্তে করে উঠে ঢুলতে ঢুলতে ব্যালকনির দিকে যায়। ব্যালকনিতে গিয়ে দেখে প্রিয়তা নেই। মুহুর্তেই বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে দেয় সে। ওখানেই হাত পা ছড়িয়ে বসে পড়ে। তাহেরা বেগম তাঁরা বেগম আর প্রিয়তাকে সাথে নিয়ে এসে দেখে প্রিয়ম রুমে নেই। ব্যালকনিতে চেইক করতে গিয়ে দেখে ওখানে বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে। প্রিয়তা এই দুশ্চিন্তার সময়ও নিঃশব্দে হেঁসে দেয়। লোকটা মাঝে মাঝে বাচ্চাদের মতো করে। সবাই মিলে প্রিয়মকে ধরে রুমে আনে। প্রিয়ম খেয়াল করেনি প্রিয়তাকে। নিজের মায়ের কোলে মুখ গুজে দিয়ে বলে,

‘আম্মুউউউ আমি ওর কাছে যাবো। দেখো না ‘ও’ নাই। আসতেছে না। পঁচা মেয়ে।’

প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। এতো বড় ছেলে এমন বাচ্চাদের মতো করে কথা বলতেছে! আর কাকে পঁচা বলতেছে! তাহেরা বেগম ছেলেকে শান্ত করতে বলে, ‘আছে বাবা। চলে আসবে। চিন্তা করো না।’

প্রিয়তা জিজ্ঞেস করে, ‘খাালামনি উনি এমন বাচ্চাদের মতো করে কথা বলতেছে কেন?’

তাহেরা বেগম মুচকি হেঁসে বলে, ‘আমার ছেলেটার জ্বর হলে ‘ও’ এমন বাচ্চা হয়ে যায়। কি বলে না বলে নিজেই জানে না।’

প্রিয়তাা হাসে। তাহেরা বেগম আর তাঁরা বেগম অনেকক্ষণ প্রিয়মের কাছে থেকে তারপর প্রিয়তাকে কিছুক্ষণ থাকতে বলে একটু বাইরে যায়। প্রিয়তা আস্তে করে প্রিয়মের পাশে বসে। তারপর ধীরে ধীরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলে খপ করে হাত ধরে ফেলে প্রিয়ম। প্রিয়তা চমকে উঠে। প্রিয়ম হাত আঁকড়ে ধরে মুখের দিকে তাকায়। মিষ্টি করে হেঁসে মাথাটা চট করে প্রিয়তার কোলের ওপর দেয়। মুখ গুজে দেয় পেটের কাছে। সব কিছু এতো দ্রুত হয়ে গেছে যে প্রিয়তা শকড। কি করবে বুঝতে পারে না। প্রিয়ম শক্ত করে ধরে আছে। ছাড়াতেও পারছে না। প্রিয়ম ফিসফিস করে বলে,

‘এত্তোগুলা ভালোবাসি প্রিয়। তুই শুধু আমার টুনটুনি আর কারোর না। একদম না।’

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here