আনটোল্ড_ডিজায়ার #পর্ব_২৫_ও_শেষ_পর্ব

0
1402

আনটোল্ড_ডিজায়ার
#পর্ব_২৫_ও_শেষ_পর্ব
লেখক_হাসিবুল_ইসলাম_ফাহাদ

ইলিয়ানাকে কাছ থেকে দেখে যতটুকু ধারণা করেছিলাম তা ভুল নয়৷ মালিহার বাবা একজন সরকারি কর্মচারী হলেও তার রোজগারের বড় একটা অংশ ছিলো ঘুষের টাকা।
মালিহা এ ব্যপারে কিছু জানে কিনা তা আমার জানা নেই। কিন্তু খোঁজ খবর নিয়ে যতটুকু জানলাম,
মালিহার বাবা ওয়াসার চাকুরিজীবী ছিলেন। বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে ইচ্ছে করে পানির সাপ্লাই মাঝেমধ্যেই বন্ধ রাখতেন এবং স্থানীয় ক্ষমতাসীন লোকদের সাথে হাত মিলিয়ে ওই অঞ্চলের সবার কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা ঘুষ তুলতেন।
এভাবেই তিনি অতি অল্প সময়ে গড়ে তুলেছিলেন সম্পদের পাহাড়।
এমন লোকজনদের আসলেই বেঁচে থাকার অধিকার নেই।
সারিকার অগোচরে আমি আবারো ইলিয়ানার সাথে দেখা করি। জিজ্ঞেস করি আমাকে এবং বাবুমিয়াকে কেন খুন করতে চাওয়া হয়েছিলো?
ইলিয়ানা জবাব দেয়,
সম্প্রতি তারা বন্ডেজ ক্লাবে আসা যাওয়া আছে এমন লোকজনদের টার্গেট করছিলো। কারণ এ পুরো ব্যপারটাই ধার্মিক এবং নৈতিক ভাবে অবৈধ। তবে প্রশাসন এখানে নিরব ভূমিকা পালন করা ছাড়া আর তেমন কিছু করতে পারছেনা। ক্ষমতাসীন দলের লোকরাই সবকিছু নিয়ন্ত্রন করে।
বন্ডেজ ক্লাবে যাতায়াত আছে একজনকে ধরতেই কারা কারা এখানে যাতায়াত করে তা এক এক করে বের হয়ে আসে। একসময় আমরা খোঁজ পাই নীড়ার এবং নীড়ার মাধ্যমনেই তোমার কথাও জানতে পারি।
যদিও তোমাকে মেরে ফেলার ইচ্ছে থাকলে বন্দি না করে রেখে সরাসরি ই মেরে ফেলতে পারতাম।
তবুও পালিয়ে এসে অনেক বড় বাঁচা বেঁচে গিয়েছ নইলে তোমাকে প্রাণে না মারলেও বড় কোন ক্ষতি করতাম।
– আর বাবুমিয়া তার কি দোষ?
– বাবুমিয়ার স্ত্রী একজন পুলিশের সাধারণ দারোগা৷ কিন্তু ঘুষের টাকা দিয়ে রাতারাতি আংগুল ফুলিয়ে কলাগাছ বানিয়ে ফেলেছে। এছাড়াও সে বেশ কয়েকটা গুম ঘটনার সাথে জড়িত।দুদকের চোখ ফাঁকি দিতে বেশ কয়েকটা ফার্নিচারের শো রুম দিয়ে রেখেছে৷ যাতে টাকার উৎস দেখতে চাইলে ফার্নিচারের শো রুম গুলো থেকে থেকে সব টাকা ইনকাম হয়েছে এটা বলতে পারে।
– সব বুঝলাম। কিন্তু তোমাদের কার্যক্রম-ই বা কতটুকু সঠিক!
মালিহাকে রেপ করা হয়েছিলো কেনো?
– মালিহাকে রেপ করা হয়েছে!
এটা তো আমি জানিনা। আমি আমার টিমের সদস্যদের অর্ডার দিয়েছিলাম ওদের তিনজনকেই মেরে ফেলতে।
– মালিহাকে যে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে সেখান থেকে এবং মালিহার নিজিস্ব স্টেটমেন্ট থেকে জানা গেছে ওকে আটকে রেখে কয়েকজন মিলে রেপ করেছিলো।
কথাটা শোনা মাত্রই রাগে গজগজ করতে থাকে ইলিয়ানা।
আমার দিকে তাকিয়ে বলে, যদি আমি বেঁচে থাকি, সবার আগে ঐ দুজনকে মেরে ফেলবো৷
আমার পুরো টিমের সাথে বেঈমানী!
– আরো একটা প্রশ্ন আছে, মালিহাকে কেনো খুন করতে চেয়েছিলে! ওর দোষটাই বা কি!
– আমি একটা এথিক্স নিয়ে চলি। সেখানে মালিহার মৃত্যু অপরিহার্য।মালিহা বেঁচে থাকলে ওদের সব সম্পত্তি মালিহার নামেই থাকতো। কিন্তু ওকে মেরে ফেললে ওর বাবা মায়ের সম্পত্তিগুলো বাজেয়াপ্ত করে আমরা গরিবদের দান করতে পারতাম। এছাড়াও মালিহার বাবা মা ছাড়া ওর ত্রিকুলে কেউ নেই৷ কষ্ট করে বেঁচে থাকার চেয়ে ওকে মেরে ফেলাটাই ভালো।
– তুমি কি জানো! তুমি এবং তোমার টিম পুরো সাইকোদের মত একটা কাজ করে চলেছ! নিজেরা যা ভালো বুঝছো তাই করছো!এটা ঠিক তোমাদের জন্য সমাজের কিছু আবর্জনা কমছে। তবে এটা আরো বেশি সত্য তোমরা ভুল কাজ করছো।
পৃথিবীতে অপরাধী, ভালো, খারাপ, গুনী, জ্ঞানী মানুষের সমাহার আছে বলেই পৃথিবী এত সুন্দর। মানুষ একবার ই জন্মগ্রহণ করে। তার বেঁচে থাকার অধিকার কেরে নেয়ার মত কোন রাইটস আমাদের নেই যদি না সে মারাত্মক কোন বড় ধরণের অপরাধ না করে থাকে।
– আমি যতদিন বেঁচে থাকবো , আমার মতই কাজ চালিয়ে যাবো।
– বেশ। তবে এখানে বন্দী হয়ে বেঁচে থাকো। দেখি তুমি কিভাবে তোমার কাজ চালাও।
ইলিয়ানা কিছু না বলে আমার দিকে অগ্নী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
.
.
.
.
ফারহানের ঘাঁটিতে ঢোকার জন্য মোটামুটি সব বন্দোবস্ত করে ফেলেছে সিদ্দীক।
আমরা আবারও প্রস্তুতি নিলাম ফারহানের তিন তলা প্রাচীর ঘেরা বাড়িটিতে মিশন পরিচালনা করার জন্য। এবার আমাদের সাথে থাকছেন বাবুমিয়াও।
আমি সারিকা এবং বাবুমিয়া প্রয়োজনীয় টুলস নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম।
সারিকা আমাদের নিয়ে গাড়ি চালাতে শুরু করলো।
শহরের শেষ পার্কিং স্পেস এ সারিকার গাড়ি পার্ক করা হলো৷ বাকিটা পথ আমাদের অটো রিকশা নিয়ে যেতে হবে। হুট করে এলাকায় নতুন দামি গাড়ির আগমনি বার্তা ফারহানের কানে গিয়ে পৌঁছালে সেটা ভালো কোন ফলাফল বয়ে আনবে না।
সিদ্দীকের সাথে কথা বলে জানলাম সে বেশ কয়েকবার ই ফারহানের বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করেছে।গ্রামের কয়েকজন স্থানীয় লোক ওর বাড়িতে গরুর দুধ এবং শাকসবজি- মাছ মাংস সাপ্লাইয়ের কাজ করে। এ গ্রামের গোয়ালার সাথে মোটামুটি ভালো সখ্যতা-ই গড়ে উঠেছে সিদ্দীকের।
গোয়ালা দুধ দিতে যখন ফারহানের বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে তখন সিদ্দীক ও কিছু ফ্রেশ শাকসবজি নিয়ে প্রবেশ করে গোয়ালার সাথে।
দরজার ওপাশে দুজন গার্ড সব সময় দাঁড়িয়ে থাকে নিখাঁদ দায়িত্ববোধ নিয়ে।
গ্রামের সবাই বলাবলি করে তাদের কাছে নাকি আগ্নেয়াস্ত্র আছে।গ্রামের সুন্দরী কোনো মেয়েদের খোঁজ পেলেই জোরজবরদস্তির মাধ্যমে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথাও লোকমুখে প্রচলিত।
ফারহান একটা প্রত্যন্ত অঞ্চলে এসে এত শক্ত একটা ঘাঁটি তৈরি করেছে কিভাবে সেটা আমার মাথায় আসেনা। অথচ ও সামান্য কয়েকলাখ টাকার জন্য দিনের পর দিন ক্যান্সারের রোগী সেজে অভিনয় করে গেছে। যাই হোক, এসব প্রশ্নের উত্তর রহস্যের শেষ পর্যন্ত না গেলে পাওয়া যাবেনা৷
প্রতিদিন গোয়ালা বেশ কয়েক কেজী দুধ ঐ বাড়িটায় দিয়ে আসে।
সেদিন ইচ্ছা করেই সিদ্দীকের মাধ্যমে গোয়ালাকে লেট করালাম।
যখন গোয়ালা দুধের কলসি নিয়ে গেটের সামনে গেলো তখন রাত ৮ঃ৩০.
ওকে দেখেই গেট খুলে দিলো ভেতর থেকে একজন। গোয়ালা একা নয়। সাথে আছে গ্রাম্য সাজে সজ্জিত শাড়ি পরিহিত একজন যুবতীও। যুবতীর সাদা চামড়া এবং আকর্ষণীয় চেহারা দেখে গার্ড দুজনের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। কোন প্রকার বাক-বিতন্ডা ছাড়াই গোয়ালা ও মেয়েটি ঢুকে গেলো ভেতরে। আমি সিদ্দীক ও বাবুমিয়া অপেক্ষা করছিলাম বাইরেই। গোয়ালার সাথে রয়েছে ছদ্মবেশী সারিকা। গ্রাম্য ভাঁজে শাড়ী পড়ায় ওকে দেখতে আসলেই খুব আকর্ষণীয় লাগছিলো। সারিকা নিজেকে সেভ রাখতে পারবে কিনা সেটা নিয়ে আমার চিন্তা হচ্ছিলো বেশ৷ তবে ও সফল হলে আজ রাতের মিশনের মাধ্যমে গুড়িয়ে যাবে একটি অবৈধ চক্রের কার্যকলাপ।
নিজের পকেট থেকে রিভালবারটি বের করে বার কয়েক ঘুরিয়ে চেক করে নিলাম। তবে সিদ্দীকের কাছ থেকে যতটুকু শুনেছি তাতে আমার এ ৬ রাউন্ড গুলির রিভালবার কিছুই নয়৷
বেশ কিছুক্ষন পরে খালি কলস নিয়ে বের হয়ে আসে গোয়ালা এবং সাথে সারিকাও। সারিকার মুখের অবস্থা বেশ গম্ভীর ছিলো। জিজ্ঞেস করলাম,
-ভেতরে কি কথা হলো!
– ভেতরে যাওয়ার পর আমাকে জিজ্ঞেস করলো ” তোর বাড়ি কোথায় রে ছুকরি? এখানে কিজন্য এসেছিস!”
-তুমি উত্তরে কি বললে?
– বললাম, বাবু আপনারা তো বড়লোক মানুষ। আনন্দ ফূর্তির দরকার হয়। আমি শহরে মদের বারে কাজ করি।দু’দিনের জন্য ছুটিতে এসেছি এখানে। যদি অরজিনাল মদ-পানি কিছু লাগে আমাকে বলেন।আমি আপনাদের দিতে পারব।গার্ড দুটো আমার কথা শুনে দাঁত বের করে হেসে বললো, তা কবে দিতে পারবি?
আমি বলেছি আপনি চাইলে আজ রাতেই দু’বোতল দিয়ে যাবো।ওরা বললো সাথে তুইও থাকিস। টাকা পয়সা কিছু বাড়িয়ে দিবো।
জিজ্ঞেস করলাম,
-ওদের এমন প্রস্তাব শুনে তুমি কিছু বলোনি?
– কি আর বলব! বলেছি টাকাপয়সা কিছু বাড়িয়ে দিলে ভেবে দেখব।
আমি বাবুমিয়া সিদ্দীক এবং সারিকা নিজেদের ভেতর আলোচনা করতে করতে আমাদের নিরাপদ জায়গায় চলে আসলাম।
সারিকা তিন তিনটে স্পাইডার ক্যাম অবমুক্ত করে দিয়ে এসেছে ঐ বাড়ির আঙ্গিনায়৷স্পাইডার ক্যাম হলো মাকড়সার মত দেখতে ইলেকট্রনিক একটি ডিভাইস যার সাথে ক্যামেরা লাগানো থাকে এবং একজন মানুষকে অজ্ঞান করার মত উচ্চ ভোল্টেজ এর ইলেক্ট্রিক শক দিতে সক্ষম।
নিরাপদ অবস্থানে বসে
সারিকা ল্যাপটপের মাধ্যমে ডিভাইসগুলোকে কন্ট্রোল করতে শুরু করে। কোথায় কি রয়েছে তা মনিটরে খুব সুক্ষ্ম ভাবে দেখাচ্ছে। বাড়ির ভেতরের অবস্থা দেখে বেশ অবাক হলাম। বাড়িটি অত্যন্ত উন্নতমানের একটি বাড়ি। অনেক বেশি টাকাপয়সা খরচ না করলে এমন রাজকীয় প্রাসাদের মত বাড়ি বানানো সম্ভব নয়৷ বাড়ির সামনে গার্ড বাদে তেমন কোন লোকজন নেই বা দেখা যাচ্ছেনা। এটা বোঝা যাচ্ছে যে, এখানে বসবাস করে এমন লোক খুব কম।
তবে ভেতরে সুইমিংপুল- লাইটিং সহ উন্নত সব ধরণের প্রযুক্তির ছোঁয়া রয়েছে।
স্পাইডার ক্যামের মাধ্যমে সবকিছু দেখেশুনে নেই আমরা। স্পাইডার ক্যামের শক ওয়েভের মাধ্যমে সামনে থাকা বেশ কিছু লাইভ সিসি ক্যামেরা ডিজেবল করে দেয় সারিকা।
দু’বোতল এবসুলুট ভদকার বোতল একটা নীল কালার এর পলিথিনে ঢুকিয়ে সারিকা এগিয়ে চলে প্রাচীরের গেটের দিকে।
দূর থেকে দেখলাম সারিকা গেটের সামনে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার পর আস্তে আস্তে গেটটি খুলে গেলো। সারিকা ভেতরে ঢোকার পরে আবার আস্তে আস্তেই গেট বন্ধ হলো। আমরা বসে বসে অপেক্ষা করতে থাকলাম, কখন সারিকার সিগন্যাল পাব এবং ভেতরে ঢুকবো।
বেশ অনেকক্ষন কেটে যাওয়ার পর ও সারিকার কাছ থেকে কোন প্রকারের রেসপন্স না পেয়ে আমাদের মাঝে এক ধরণের টেনশন কাজ করা শুরু করে।
নির্ধারিত সময় অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার বেশ কিছুক্ষন পরে আমার কাছে সারিকার নম্বর থেকে একটা ফোনকল আসে, ওপাশ থেকে সারিকার কন্ঠ শুনে অনেকটা নিশ্চিন্ত হই আমি। সারিকা ফিসফিসিয়ে আমাকে বলে গেটের কাছে যেতে। আমি ধীরপায়ে মূল গেটের দিকে এগিয়ে যাই।
স্টিলের গেট টি আগে থেকেই হালকা একটু ফাঁকা হয়ে ছিলো। একজন মানুষ একটু চেষ্টা করলেই এ ফাঁকা জায়গাটুকু দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়তে পারবে ।
আমি সাতপাঁচ না ভেবে গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলাম।
সারিকা একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিলো।
আমি গেট থেকে ভেতরে ঢুকেই সারিকার দিকে এগিয়ে গেলাম। সারিকা আমাকে ছোট্ট একটা কুঠুরিতে নিয়ে গেলো। ওখানে দ্বাররক্ষক দুজন রাতে বিশ্রাম করে। গিয়ে দেখলাম দুজনেই চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। সারিকা আমার দিকে তাকিয়ে বকলো ভদকায় এত পাওয়ারফুল ঘুমের ঔষধ মিশিয়েছি যে ২৪ ঘন্টার আগে ওদের ঘুম আর ভাংবে না।
বাড়িটা ভেতরের দিকে একদম ই সিমসাম। নিরাপত্তার তেমন বালাই নেই। চারদিকটা সুন্দর করে সাজানো এবং নির্জন। আমরা দেয়ালের গা ঘেঁষে পা টিপে টিপে চারদিকটা ঘুরে ফিরে দেখতে শুরু করলাম।এখানেই কোন একটা জায়গায় আটকে রাখা হয়েছে আমার মেয়ে সাফা এবং স্ত্রী সাবিহাকে।
দেয়ালের গা ঘেঁষে সন্তোপর্ণে এগিয়ে চলেছি, হঠাৎ করেই গাড়ির হর্ণ এবং হেডলাইটের আলোয় অন্ধকারের আনাগোনা অনেকটা কমে গেলো। খুব জোড়ে জোড়ে গাড়ির হর্ণ বেজে চলেছে।
দরজা খোলার মত কোন লোক নেই। ওরা গভীর ঘুমে বিভোর।
বেশ কিছুক্ষন হর্ণ বাজার পরে আলিসান তিন তলা বাড়ির পাশে থাকা ছোট্ট একটা বর্গাকার ঘর থেকে ছুটতে ছুটতে বের হয়ে এলো একজন লোক।মোবাইল কানে ধরে প্রাণপণে ছুটে চলে গেলো মূল গেটের দিকে। লাইটের সামান্য আলোতে চিনে ফেললাম, যে লোকটি ছোট ঘর থেকে বের হলো সে আর কেউ নয় ” ফারহান”।
স্টিলের গেটটি টেনে খুলে দিতেই পর পর চারটি সাদা গাড়ি ঢুকে পরে ভেতরে। প্রথম দুই গাড়ি থেকে নামে অত্যাধুনিক অস্ত্র হাতে কিছু মানু্ষ। তিন নম্বর গাড়ি থেকে নামে সাদা শার্ট সাদা প্যান্ট ও সাদা জুতা পরিহিত মধ্যবয়সী একজন মানুষ। মাথার উপরে চুল অনেক কম। দেখে বেশ পরিচিত মনে হলো। পেছনের গাডি থেকে নামলো আরো দুজন অস্ত্রধারী মানুষ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে মাঝের গাড়ি থেকে নামা সাদা পোশাক পরিহিত মানুষটির দেহরক্ষী এরা।
সারিকা দাঁতে দাঁত চিপে সবকিছু দেখছে। একটা মোটা ফল গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আমরা সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছিলাম। ফারহান মাথা নিচু করে গাড়ি নিয়ে আসা সবাইকে অভ্যর্থনা জানাতে ব্যস্ত। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে ফারহানকে কেউ একজন অনেক বকাবকি করছে।
ফারহান মাথা নিচু করে আছে।
সাদা পোশাক পরা লোকটি হেঁটে বাসার ভেতরে ঢুকে গেলেন। সামনে সামনে গেলো তার দেহরক্ষীরা। একেবারে শেষের গাড়ি থেকে যে দুজন বের হয়েছিলো তারা তিন তলা বাসার সদর গেটে অস্ত্র বের করে রোবটের মত পাহারায় দাঁড়িয়ে রইলো।
ফারহান মূল ফটকের স্টিলের দরজাটি আটকে দিতে যাবে এমন সময়ে দরজার ফাঁক গলিয়ে দৌড়ে এলো প্লুটো। সিদ্দীক আর বাবুমিয়াকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম প্লুটোকে পাহারা দেয়ার। ওরা এই একটা কাজ ও ঠিকভাবে করতে পারলোনা। প্লুটো গেটের ভিতরে ঢুকেই সারিকার পারফিউমের ঘ্রাণ অনুকরণ করে আমাদের দিকে ঘেউ ঘেউ করতে করতে ছুটে আসলো। কুকুরটিকে এভাবে ছুটতে দেখে ওর পিছু নিলো ফারহান।দূর থেকে তাকিয়ে রইলো দেহরক্ষী দুজন ও। প্লুটো ঘেউ ঘেউ শব্দ করতে করতে সারিকার কোলে এসে ঝাপিয়ে পড়লো। অযাচিত ভাবেই ফারহান এবং রক্ষী দুজনের কাছে ধরা পরে গেলাম আমরা। আমার কাছে থাকা রিভালবার বের করে গুলি চালালেও তাতে কোনরূপ ফায়দা হবেনা। ঝামেলা করলে এখান থেকে নিজের প্রাণ নিয়ে ফেরা যাবেনা। তাই সারিকাকে ইশারায় চুপ থাকতে বললাম।
_____________________
______________________
আমাদের বন্দী করে নিয়ে আসা হয়েছে বেশ অন্ধকার একটা জায়গায়। এখানে ছোট ছোট জেলখানার মত কামরা আছে। প্রত্যেক কামরাতেই আমাদের মত মানুষজনে ভর্তি। এদের কারো কারো মুখ আমার বেশ পরিচিত৷ অনেকেই বামপন্থী রাজনৈতিক দলের উঠতি নেতা। কেউ সৎ অফিসার আছে গুটিকতক সাংবাদিক এবং মিডিয়া পারসোন। এদের অনেকের নিঁখোজ বিজ্ঞপ্তি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় পড়েছি। আসল কাহিনী তাহলে এটাই যে এদের গুম করে এনে এখানে বন্দি করে রাখা হয়েছে।
তবে এর পেছনে মূল হোতা কে!
সারিকা এবার মুখ খুললো। বললো সাদা পোশাক পরা যে লোকটি নামলো গাড়ি থেকে তাকে ও খুব ভালোভাবেই চেনে। ওর ভাইয়ের সাথেই বেশ কয়েকবার বিভিন্ন প্রোগ্রামে দেখেছে৷ সে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের সনামধন্য একজন মেম্বার অফ পার্লামেন্ট।
মিডিয়ার সামনে একজন সৎ, কর্মঠ মানুষ সেজে ভেজা বেড়াল হয়ে থাকলেও আদতে সে যে কতটা নিচু মন মানসিকতার, সেটা তার এ গোপন বন্দিশালা দেখলেই বোঝা যায়। চালচলন দেখে বুঝতে পারলাম উনি ই এ বাড়ির প্রকৃত মালিক।
ফারহান ওনার বাড়িতে হয়ত কোনআমাদের শেল এর অপজিটেই আছে কাচে ঘেরা একটি কক্ষ, ওটাকে টর্চার সেল হিসেবে ইউজ করা হয়। যখন দরজা খুলে কাউকে অত্যাচার করার জন্য ভেতরে ঢুকানো হয়, তখন দরজার ফাঁকা দিয়ে ইলেক্ট্রিক শক দেয়ার চেয়ার, মোটা লাঠি, শিকল এবং হাতুড়ি সহ নানা ধরণের বিপদজনক হাতিয়ারের দেখা মেলে। এখানে ফারহান ছাড়াও আরো তিনটে লোক বন্দীদের খাদ্য সরবরাহ এবং পাহারার দায়িত্বে আছে।
আমাদের মোবাইল ফোন সহ সবকিছুই কেড়ে নেয়া হয়েছে। ফারহানের হাতে চড় থাপ্পড় ও খেতে হয়েছে বেশ কিছু তবে চড় থাপ্পড়ের চেয়েও বেশি আঘাত দিয়েছে ওর খোঁচা দেয়া কথা গুলো।চরম অপমান ও ন্যাক্কারজনক কথা বলে বেশ কয়েকবার গায়ে হাত দিয়েছে ও। সারিকার বুকের উপর হাত বুলিয়ে মুখের ভাষা দিয়েই যেন ধর্ষণ করে ফেলছিলো ওকে।
তবে ফারহান ও বাকি দুজনের কথাবার্তায় বুঝতে পারছিলাম ওরা এখন চাইলেই ওদের নিজ ইচ্ছে স্বাধীন মত কাজ করতে পারবেনা।বাড়ির মালিক যতক্ষন পর্যন্ত এখানে থাকবেন, ততক্ষন পর্যন্ত আমাদের উপর অত্যাচারের খড়গ হয়ত নেমে আসবেনা। কিন্তু সে চলে যাওয়ার পর ফারহান আমাদের নিয়ে যে কি করবে সেটা ভাবতেও বার বার ভয়ে শিউরে উঠছি।
ফারহান বার বার আমাদের দরজার সামনে এসে আমাদের দিকে তাকিয়ে এমন একটা হাসি দেয়, যার মানে – আরতো মাত্র কিছুক্ষন। তারপর ই খেলা জমবে। রাত আরো বেশি গভীর হয়। ফারহান এবং বাকি ক’জনের আনাগোনা কমে আসে। হয়ত ঘুমাচ্ছে। বাকি বন্দিরাও আস্তে আস্তে ঘুমের কোলে ঢলে পড়েছে। আমার এবং সারিকার চোখে ঘুম নেই। স্বাভাবিকভাবেই এ পরিস্থিতিতে ঘুম আসার কথাও না। কিভাবে এখান থেকে মুক্ত হওয়া যায় সে চিন্তা করছিলাম। মনে হচ্ছিলো এখন কোনভাবে সারিকার ভাইকে এখানের অবস্থান এবং অবস্থা জানাতে হবে। কিন্তু সেটার আর উপায় কোথায়। জামাকাপড় বাদে সবকিছুই নিয়ে গেছে ফারহান নামক শয়তানটা। কিছুক্ষন পরে হয়ত জামাকাপড় ও থাকবেনা আমাদের গায়ে।
নিভু নিভু লাইটের আলোয় জীবনের অন্তিম প্রহরগুলো গুনে যাচ্ছি। হুট করে একটা পরিচিত কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম।
– ভাইয়া
তাকিয়ে দেখলাম আমাদের শেল এর সামনে দাঁড়িয়ে আছে মণিকা। ওকে দেখে ঘৃণায় আমার মুখে থু থু চলে আসলো। সব নাটের মূল তো এই মেয়ে ই।
ওর দিকে একবার তাকিয়ে আমি চোখ সরিয়ে নিলাম।
মণিকা আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো, আমি জানি ভাইয়া তুমি আমার উপরে অনেক ঘৃণা নিয়ে আছো। কিন্তু আমি ফারাহানের ভালোবাসার কাছে অন্ধ হয়ে গেছিলাম। আর অন্ধ হলে মানুষ ভুল করে। সেম ভুল আমিও করেছি। ফারহান আমাকে এখানে নিয়ে এসে ওর বন্ধুদের কাছে আমাকে ভোগ্যপন্য হিসেবে ব্যবহার করেছে। আমি আমার বোন ও তার মেয়ের সাথে যে অন্যায় করেছি তার যোগ্য শাস্তি পেয়েছি। আমার দেহের প্রতিটি কোনায় কোনায় পশুদের নোংরা আচড়। আমি আমার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই ভাইয়া। আমি জানি আপুকে কোথায় আটকে রাখা হয়েছে।
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে মণিকা একটা চাবি বের করে আমাদের আটকে রাখা কামরার দরজার তালা খুলে দিলো। খুলে দিয়ে বললো, তাড়াতাড়ি ভাবিকে নিয়ে এখান থেকে পালিয়ে যাও। ওরা এখন সবাই ঘুমাচ্ছে। কেউ কিছু টের পাবেনা। ধরা পরে গেলে অনেক বড় বিপদ হয়ে যাবে।
সারিকা মণিকাকে হেল্প করার জন্য থ্যাংকস জানালো। আর এটাও জানালো এখানে আমরা পালিয়ে যেতে আসিনি। এসেছি অবৈধদের বিনাশ ঘটাতে।
মণিকার পেছনে পেছনে অনুসরণ করে আমরা দ্রুত হাঁটতে শুরু করি সাবিহাকে আটকে রাখা হয়েছে যেখানে সেখানটার উদ্দেশ্যে। যেতে যেতেই মণিকা বলে এখানে সিক্রেট বন্দিশালা টা বানানো হয়েছে দেশে আলোচনা এবং ক্ষমতায় থাকা মানু্ষদের গুম করে লুকিয়ে রাখতে। ফারহান এখানে দেখাশোনার দায়িত্বে আছে। ও নিজেও সুযোগ বুঝে নিজ স্বার্থে কয়েকজনকে এনে এখানে আটকে রেখেছে। শিশু- কন্যাদের নিয়মিত ধর্ষণ এবং অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে।
এ বাড়ির মালিক মন্ত্রীপরিষদের খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব শ্যামল দাস। সে এখানে মাঝে মাঝে আরাম আয়েশ করার জন্য আসে। এখানের কচিকাচা মেয়েদের নিয়ে রাতে ফূর্তি করে এবং দিন দুই থেকে চলে যায়। এ বাড়িতে সবসময়ের জন্য থাকে ওনার ছোট ভাই সজীব দাস। সেও একই রকম। অঘোষিত জাহান্নামে পরিণত হয়ে আছে টোটাল বাড়িটি।
বুঝলাম ব্যক্তি এবং রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য এমন একটা আস্তানা গড়ে তোলা হয়েছে, যা ঐ বন্ডেজ ক্লাবের চেয়েও ভয়ানক। আমাদের সমাজে অনেকে স্ব-ইচ্ছায় বাজে কাজ করে।তা নিয়েই যত মাতামাতি চলে। অথচ আড়ালে আবডালে লুকায়িত কত মানুষের উপরে জোড় করে অন্যায় চাপিয়ে দিয়ে তাকে মনুষ্য পরিচয় দিনের পর দিন ভুলিয়ে দেয়া হচ্ছে, সেটার খবর কেউ রাখেনা।
হাঁটতে হাঁটতে চলে আসলাম সাবিহাকে যেখানে আটকে রাখা হয়েছে সেখানে৷ সাবিহার গায়ের জামাকাপড়ের অবস্থা অনেক নাজেহাল। বুকের ভেতরে সাফাকে নিয়ে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে আছে। পাশেই পরে আছে স্টিলের থালা- গ্লাস। থালার উপরে রুটির ছেড়া টুকরা।
ওর উপর ফারহানের পশুত্বের আক্রমণ চলেছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে। গাল হাত পা ঘাড়ে আঁচড়, কাটাছেড়ার দাগ।
চুলগুলো ময়লায় সাদা হয়ে আছে। ওকে দেখে বুকের মাঝে এতটা কষ্ট লাগলো! মুখ ফুটে ডাক দিতে পারলাম না।
মণিকা কান্না করতে করতে বললো,
এমন পরিণতি হবে তা আমি কখনোই কল্পনাও করতে পারিনি ভাইয়া।সবকিছু ক্রমশ খারাপ থেকে খারাপের দিকে ধাবিত হয়েছে। হঠাৎ হাত তালির শব্দে আমি সারিকা এবং মণিকা তিনজন ই পেছনে ফিরে তাকালাম। ফারহান দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে৷ ওর সাথে আছে আরো তিনজন লোক । ফারহান আমার দিকে তাকিয়ে বললো, তোর ভাগ্য অনেক ভালো রে শহর। নাকের সামনে খেলা করছিস অথচ তোকে একটা বুলেট খরচ করে হত্যা করতে পারছিনা। বড় বাবু ফায়ারিং এর শব্দ শুনলে আবার জবাবদিহি করতে হবে। এই একটা কারণেই আমি এ জায়গাটা পছন্দ করিনা। আর সেটা হলো, আমি এখানে স্বাধীনতা পাইনা।
এখানে থাকলে আমার টাকাপয়সা, মেয়ে নিয়ে ফূর্তি৷ কোন কিছুর অভাব হয়না। কিন্তু একটাই সমস্যা, চাকরের মত আচরণ সহ্য করতে হয়। আর একারণেই আমি চেয়েছিলাম নিজে সেটেল হতে। নিজের মত লাইফ লিড করার জন্য যখন দু’পয়সা এদিক সেদিক করে ইনকাম করা শুরু করলাম, তখন ই তুই এসে আমার জীবনে বাধা দিলি।
আমার সব প্লান ভেস্তে দিলি। তোকে খুন করে তোর লাশ যদি আমি কুকুরকেও খাওয়াই তাহলেও আমার রাগ কমবেনা বুঝলি!! কথাগুলো বলতে বলতে হাতে একটা মুগুর নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করলো ফারহান। কাঠের মোটা দন্ডের এক মাথায় ধারালো অনেকগুলো লোহার পেরেক মেরে মেরে তৈরি করা হয়েছে যন্ত্রটি।
ফারহান কাছাকাছি এসে আমার বুকের উপরে একটা লাথি মারতেই আমি কয়েক হাত পেছনে সরে গিয়ে ফ্লোরে পরে যাই। দু হাত দিয়ে কাঠের মুগুরটা উঁচু করে আমার দিকে আঘাত হানে ফারহান। মুগুড় এসে আমার নাক-মুখের উপর আঘাত করার আগেই মণিকা সামনে ঝাপিয়ে পরে। ধারালো লোহাগুলো ওর মাথায় গেঁথে যায়। মণিকার মুখের কোনায় অদ্ভুত এক কারণে এক চিলতে হাসি দেখতে পেলাম।পেরেকগুলো মণিকার মাথার এত গভীরে ঢুকে গেছিলো যে ফারহান হাত দিয়ে কয়েকবার হ্যাচকা টান দেয়ার পর ও ওটা সরাতে পারছিলো না। কয়েক সেকেন্ডের জন্য একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম। ঘুরে গিয়ে ফারহানের পাজরের হাড় বরাবর বেশ শক্ত করে একটা লিভার পাঞ্চ দিতেই ফারহান একদিকে বাঁকা হয়ে ব্যাথায় কুঁকিয়ে ওঠে। বাকি তিনজন এতক্ষন তামাশা দেখছিলো। ভেবেছিলো ফারহান আমাদের নিয়ে ইঁদুরের মত খেলবে আর ওরা মজা নিবে। কিন্তু বিষয়টা উলটো হয়ে যাওয়ায় তিনজন ই একসাথে আমাদের দিকে ছুটে আসে। মণিকার মাথার ঘাড়ের উপরে পা দিয়ে চেপে ধরে এক হাতে বেশ জোরে টান মারতেই মাথা থেকে কাঠের মুগুরটি খুকে আসে। পেরেকগুলোর মাথায় মগজের কিছু কিছু অংশ লেগে আছে। আমার মাথায় হঠাৎ করেই আগের মত খুন চেপে বসলো। এদিকে সবার আগে ছুটে আসা লোকটার দু’পায়ের ফাঁকা বরাবর লাথি মেরে কুপোকাত করে ফেলেছে সারিকা। তবে বাকি দুজনের হাত থেকে বাঁচতে পারেনি ও। কোমড় চেপে ধরে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ব্যাথায় কাতরাচ্ছিলো ফারহান।দু হাত দিয়ে কাঠের মুগুড়টা ধরে ছোট বেলায় ব্যাট দিয়ে ৬ মারার মত করে ফারহানের চোয়াল বরাবর গায়ের সব জোড় দিয়ে আঘাত করলাম। এক আঘাতেই ফারহানের গালের মাংস উঠে চোয়ালের হাড় ও দাঁত বের হয়ে আসলো। রক্ত ছিটে আমার জামাকাপড় মাখামাখি হয়ে গেলো। এর পর একই জায়গায় আরো একটি আঘাত। এবারের আঘাতে ফারহানের এক চোয়াল আরেক চোয়াল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঝুলে গেল।বেশ বিকৃত একটা লাশে পরিণত হয়ে গেলো ফারহান। বাকি দুজন ফারহানের এ অবস্থা দেখে সারিকাকে ছুড়ে বেশ অনেক দূরে ফেলে দেয়। ওদের রাখা গোপন জায়গা থেকে একজন একটা শর্ট গান বের করে। অন্যজন বের করে রিভালবার। কাঁপা কাঁপা হাতে আমার দিকে তাক করে রিভালবার থেকে ছোড়া হয় বেশ কয়েকরাউন্ড গুলি।নিজেকে বাচানোর জন্য লাফ দিয়েও কাজ হয়না। বুলেটের ক্ষীপ্রতা আমার থেকেও বেশি। তবে সময়মত লাফ দেয়ায় বুলেট এসে আমার হাঁটুর উপরে আঘাত করে। এর মাঝেই পেছন থেকে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পরে প্রায় শতখানের লোকজন। আসার পথে সব বন্দীদের সেলের তালা খুলে দিয়ে এসেছিলাম আমরা। তখন৷ সবাই ঘুমে বিভোর থাকায় কেউ টের পায়নি। হৈ হট্টগোল শুনে যখন সবার ঘুম ভাংগে তখন তারা নিজেদেরকে মুক্ত হিসেবে আবিষ্কার করে এবং এদিকে চলে আসে।
জম্বি মুভীতে যেমন অনেক জম্বিরা মিলে দু একজন মানু্ষকে টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেলে ঐ লোকদুটো ও তেমনি শ’খানের মানুষের আক্রমণে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। কয়েক মাস বা কয়েক বছরের বন্দি হয়ে থাকা ক্ষোভ রাগ সব ঐ লোকদুটোর উপর দিয়ে চলে যায়।
সাবিহাকে আমি মুক্ত করি। সাবিহা আমাকে দেখে প্রচন্ড ভয় পায়। শুধু আমাকে না। যে কোন পুরুষ মানুষ দেখলেই সাবিহা ভয় পাচ্ছে। ওর উপর অত্যাচারের মাত্রা এতটাই বেশি ছিলো যে সাবিহার মানসিক সমস্যা হয়ে গেছে। সাফাকে এই দুরবস্থার ভেতরে কোলে নিলাম। শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে মেয়েটা। আমার দিকে কেমন ড্যাবড্যাব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দেখে মনে হলো আমি এখন বেহেস্তে আছি এত দারুণ অনুভূতি আর হয়না। বন্দি থেকে মুক্ত হয়ে সবাই স্লোগান দেয়া শুরু করলো। স্লোগানের
চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ শুনে শ্যামল ঘোষের দেহরক্ষীরা মূল ভবন ছেড়ে পাশের বন্দিশালায় ছুটে আসে। এসেই সবাইকে এরকম অবমুক্ত অবস্থায় দেখে নির্বিচারে গুলি চালাতে শুরু করে।
হুড়মুড়িয়ে পরে যায় বেশ কয়েকটি লাশ।সবাই উল্টোদিকে ঘুরে দৌড়ানো শুরু করে, আমার বুকের মাঝে সাফাকে নিয়ে ভীড়ের মাঝে কোনরকম দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছি। সারিকা এবং সাবিহাকে ভীড়ের মাঝে কোথাও দেখতে পেলাম না। ওদিকে ভয়ানক শব্দ তুলে গুলিবর্ষণ হচ্ছে। লাশের পর লাশ পড়ছে। হুট করেই কানে আসলো হ্যালিকাপ্টার এর শব্দ। যারা বন্দিশালার মুখে দাঁড়িয়ে গুলি চালাচ্ছিলো তাদের দেহগুলো নিথর হয়ে একের পর এক লুটিয়ে পরে। সারিকা কোন এক ফাঁকে ওর ভাইকে মোবাইলের মাধ্যমে সবকিছু জানালে দ্রুত সোয়াট বাহিনী পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। বেশ কয়েকটা হ্যালিকাপ্টার চলে আসে খুব দ্রুত। শ্যামল পালের বাসার ছাদের উপরে দঁড়ি বেয়ে নেমে পরে সোয়াট বাহিনী। অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের মুহুর্তেই ক্রসফায়ার করা হয়। শ্যমল দাস সহ ওখনানে থাকা সবাইকে আটক করা হয়।
সাফাকে নিয়ে একটা কোনায় বসে পরি আমি। সাফা দুনিয়ার হিসেব বুঝে না। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ওর মুখে দেখতে পাচ্ছি এক চিলতে হাসি। দৃষ্টি ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে। সামনে শতশত মানুষের পা এদিক সেদিক ছুটোছুটি করছে।
ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখছি সারিকা কান্না করছে। বাবু মিয়া সিদ্দীককেও দেখতে পেলাম। দেখতে পেলাম রক্তাক্ত সাবিহাকে। সাবিহার রক্তাক্ত নিথর দেহ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ও প্রাণহীন। চোখের সামনে ভেসে উঠলো না বুঝে ওর সাথে রাগ করার কথা৷ ওকে অহেতুক ঘৃণা করার কথা। ভালোভাসার মানুষটা চলে গেলো! আফসোস হচ্ছে, কেন পৃথিবীতে থাকা কালীন ওকে আরেকটু বেশি ভালোবাসা দিতে পারলাম না! এ আফসোসের কষ্ট মৃত্যু যন্ত্রনা থেকে বেশি।
কিছু কিছু মেয়েরা মন্দ ভাগ্য নিয়েই জন্মায়। সাবিহাও হয়ত তাদের একজন। সুখ নামক জিনিসটা ও দেখে যেতে পারলো না।
চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেলো।
______________________
প্রচন্ড আলোতে যখন চোখ মেলে তাকালাম তখন সূর্যের জানালার ফাঁকা থেকে এসে আমার চেহারার উপরে পড়েছে। হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ করা। আমার বিছানায় মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছি সারিকা। বিছানার পাশের চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমানো মালিহা। একটা দোলনায় রাখা আছে আমার ছোট্ট মেয়েটি। ওর হাসির কলকলানির শব্দ পুরো রুমটাকে মাতিয়ে রেখেছে।
বেঁচে আছি তাহলে!
সাফার হাসি শুনে মনে হলো ওর এ হাসিটা ধরে রাখার জন্য হলেও আমার বেঁচে থাকাটা বেশ জরুরী ছিলো।
এরপর, বাঁচিয়ে রাখা এবং বেঁচে থাকার নিয়মে অতিবাহিত হতে থাকে আমার দিনগুলো। অনেক কিছু বদলায়। আমার বাচ্চাটিও ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। সারিকা, মালিহা,বাবুমিয়া যে যার মত গুছিয়ে নেয় নিজেকে। সিদ্দীক আমার সাথেই থাকে।

সারিকার সাথে আলাপ করে আমরা মুক্ত করে দিয়েছিলাম ইলিয়ানাকে। তবে ওকে প্রমিস করিয়ে নিয়েছিলাম আইন নিজের হাতে যেন তুলে না নেয়। সারিকা তার ভাইয়ের সহযোগিতায় যে কোন ধরণের অপরাধের মোকাবেলা করার কথা দেয় ইলিয়ানাকে।তবে শুনেছি ইলিয়ানা এখান থেকে মুক্ত হয়ে আর এদেশেই থাকে নি। চলে গেছে সুদূর আমেরিকায়।
প্রাপ্তি এবং পিটার দুজনকেই জেলে নেয়া হয়েছে।শ্যামল দাস এবং সজীব দাসের রিমান্ডে সন্দেহজনকভাবে মৃত্যু হয়েছে। আমার ধারণা ইচ্ছে করেই ওদেরকে খুন করা হয়েছে, আমাদের প্রতিবেশী একটি দেশের “ব” নামক গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা এ কাজটি করেছে। আর তাদের ইন্ধনেই চলতো গুম শ্যামল পালের গোপন গুম খুন। যাতে গোমর ফাঁস না হয়ে যায় সেজন্যই এ হত্যাকাণ্ড।
তবে সবকিছুর হোতা বন্ডেজ ক্লাবটা রয়ে গেছে এখনো। সারিকার ভাই আদ্যপান্ত জানা সত্ত্বেও ক্লাবটা উচ্ছেদের জন্য কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারেনি। কারণ প্রতিটা মানুষ ই একটা নির্দিষ্ট জায়গায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়, সে যত ক্ষমতাবান ই হোক না কেনো!
বন্ডেজ ক্লাব থেকে যাওয়ায় অবশ্য আমার জন্য সুবিধা হয়েছে বেশ।
রাতের আধার নামা শুরু করলেই কালো একটা জ্যাকেট গায়ে চাপিয়ে নেমে পরি। আমার গন্তব্য হয় বন্ডেজ ক্লাবের ধূমায়িত রঙিন ফ্লোর।
আগের মতই সবকিছু আছে এখানে। সব অপরিবর্তিত, শুধুমাত্র ট্রেইনার পিটারের জায়গায় এসেছে নতুন একজন।
বন্ডেজ ক্লাবে নতুন এসে ট্রেইনার হিসেবে সুনাম কামাতে পারা খুব বড় একটা বিষয়। আর সে বিষয়টিকে সুন্দর ভাবেই আমি হ্যান্ডেল করতে পেরেছি। শহরের উচ্চবিত্ত মেয়েরা এখন বন্ডেজ ফ্যান্টাসি করতে এসে সবার আগে আমাকেই খোঁজে।
এই লাল নীল লাইটের অন্ধকার জগতের দুনিয়ায় আমার প্রবেশের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন।
নীড়াকে মনে আছে আপনাদের! ভুলে যাওয়ার কথা না অবশ্যই!
নীড়া মারা যাওয়ার পরও আমি রাস্তায় একদিন ওকে দেখেছিলাম।
ভেবেছিলাম আমার চোখের ভুল ছিলো। কিন্তু না! পরে খবর নিয়ে জেনেছি মেয়েটি ছিলো নীড়ার জমজ বোন সামিরা। সারিকা এবং
সামিরার সাথে আমার নিয়মিত যোগাযোগ হয়। দুজন ই আমার মেয়ে সাফাকে বেশ পছন্দ করে। বাসায় এসে ওর সাথে সময় কাটায়।
এর ভেতরে আরো একটি জটিল রহস্য ভেদ করতে বুদ্ধিমতী সামিরা আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করে। তবে এ রহস্যটি ভেদ না হওয়াই আমার জন্য হয়ত খুব বেশি ভালো ছিলো।
______________________
রাত প্রায় ১২ টা। বারান্দায় বসে আছে সারিকা। হাতে একটা কফির মগ। প্লুটোকে আজ তার খুব মনে পড়ছে। বেচারাকে যে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে তা আর জানতে পারেনি সারিকা।
মালিহা এখন সারিকার সাথেই থাকে। প্লুটোর জায়গায় মালিহা সারিকার নতুন সঙ্গী।তবুও কোন একটা জায়গা সবসময় অপূর্ণ ই থাকে সারিকার কাছে।
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে যখন সারিকা চিন্তার জগতে ডুবে ছিলো তখন হঠাৎ একটা ফোন কলে চিন্তার জগত থেকে ফিরে আসে সারিকা। ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখতে পায় আননোন একটি নম্বর।
ফোন পিক করে কানের কাছে ধরতেই ওপাশ থেকে বিশ্রী একটা হাসির শব্দ শুনতে পায় সে। সারিকা কিছু বলতে যাবে এমন সময়ে ফোনের ওপাশ থেকে জিজ্ঞেস করা হয়,
“Dear Sarika,
What’s your Untold Desire?
তোমার মনের গোপন ইচ্ছের কথা আমাকে জানাও সারিকা। এটাই হবে তোমার পূরণ হওয়া শেষ ইচ্ছে।”
সারিকা যতটা না ভয় পায় ঠিক ততটাই চমকে ওঠে।
কারণ ফোনের ওপাশ থেকে কথা বলছে শহর আহমেদ। শতভাগ নিশ্চিত সারিকা এটা শহরের ই ভয়েস।
সারিকার বুকের ভেতরে ধুকপুক করতে শুরু করে।
তাহলে কি শহর সবটা জেনে গেলো!
নাকি এটা শুধুই প্রাংক!
চিন্তায় কপালে ভাজ পরে যায় তার।

———— সমাপ্ত ———–

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here