শ্যামসুন্দর_স্বপ্ন #পর্ব_৮_ও_৯

0
909

শ্যামসুন্দর_স্বপ্ন
#পর্ব_৮_ও_৯
নুশরাত_জাহান_মিষ্টি
০৮

সকালে দেলোয়ার ফরাজির উঠানে বৈঠক বসেছে। গ্রামের প্রায় লোকই সেখানে উপস্থিত। দেলোয়ার ফরাজি ঠান্ডা মাথায় সবার উদ্দেশ্য বললো,“আমার কোন সিদ্ধান্ত আজ অব্দি কারো জন্য খারাপ হয়নি। আপনারা আমার সকল দিক বিবেচনা করেই যেকোন সিদ্ধান্ত জানাবেন। আমি আসা রাখছি কেউ একপাক্ষিক কোন কথা বলবেন না।”
“তা নাহয় বুঝলাম বড় সাহেব। আমরা আপনার সব সিদ্ধান্ত সবসময় মেনে এসেছি, এতে আমাদের লাভ বটে ক্ষতি হয়নি।”(এক লোক বললো)
পাশ থেকে অন্য একজন বললো,“তাই বলে আপনার সব সিদ্ধান্ত সঠিক বলে যে সব শিক্ষা ঠিক তা কিন্তু নয়। আপনার শিক্ষায় ভুল আছে বলেই আপনাদের সন্তানদের পরিনতি এরকম হচ্ছে। কথায় বলে বাহির ঠিক করার পূর্বে ঘর ঠিক করা উত্তম। আপনি তো ঘর ঠিক করতে ব্যর্থ সেখানে বাহির ঠিক করার আসা রাখা অনুচিত বলে মনে হচ্ছে না।”
“আপনার ছেলে কুকর্ম করতে গিয়ে ধরা পড়েছে, তার কুকর্মের শাস্তি আপনি দিয়েছেন তা ঠিক। তবে বাড়ির ভিতরে আপনি নিজের ছেলের বৌকে নির্যাতন করছেন এটা কোন ধরনের শিক্ষা। আপনি গ্রাম প্রধান হয়ে যদি এমন করেন তবে আমরা কি করবো?”

দেলোয়ার ফরাজি বেশ বিচক্ষন কন্ঠে বললেন,“সবসময় যা দেখা যায় তা সত্যি হয় না। আপনারা কাল যেটা দেখেছেন, সেটা হয়তো সত্যি কিন্তু তার যে মানে বের করেছেন তা সত্যি নয়।”
“তারমানে কালকের ঘটনা আপনি অস্বীকার করছেন?”
“না অস্বীকার করছি না। ঘটনার আসল কারনটা জানাতে চাচ্ছি৷ আপনারা হয়তো আমার কথায় ভরসা পাবেন না তাই আমি আমার বৌমার মুখেই আসল সত্যিটা জানাতে চাই।”

দেলোয়ার ফরাজি সাহেদ ফরাজিকে চোখ দিয়ে ইশারা করলো। সাহেদ ঘরের ভিতর চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর মেহরুন বেগম নুরকে সাথে নিয়ে সভায় এলো।

সুফিয়ানও সভায় উপস্থিত ছিলো। সুফিয়ান তার বন্ধুকে ইশারা করতে তার বন্ধু গ্রামের চারজন লোককে ইশারা করলো। সুফিয়ান তাদের দিকে তাকিয়ে মনেমনে বললো,“আমার সন্দেহ ঠিক হলে এরা সবকিছুতে দ্বিমত পোষন করবেন।”

দেলোয়ার ফরাজি নুরকে ইশারা করলো কালকের ঘটনা স্বীকার করতে। নুর স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,“আসলে কাল শশুড় মশাই হাতটা আমার মাথায় আশীর্বাদসরুপ তুলেছিলেন। কিন্তু আপনারা ভুল ভেবে নিয়েছেন। আমার স্বামী পুনরায় সঠিক পথে ফিরে আসায়। নিজের সব ভুল বুঝতে পেরে আপনারা আগে যেমন তাকে চিনতেন, সেই রুপে ফিরে এসেছেন। যার জন্য শশুড় মশাই আমাকে আশীর্বাদ করছিলেন, যাতে তার সন্তানকে আমি সঠিক পথ দেখাতে পারি।”

গ্রামের সহজ সরল মানুষদের নুরের এলোমেলো কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে হলেও বাধ সাধলো সেই চারজন। তাদের মধ্যে একজন বললো,“ঘর থেকে শিখিয়ে পড়িয়ে আনা মুখস্থ বিদ্যে নয়তো এগুলো?”

“আপনারা ভুল বুঝছেন।”
“আমরা কোন ভুল বুঝছি না। আপনার ঘরে বধু নির্যাতন আজ প্রথম নয়। এর পূর্বেও নির্যাতন হয়েছে।”
সাহেদ ফরাজি রেগেমেগে বলল,“কি সব উল্টোপাল্টা কথা বলছেন? আমাদের ঘরের বধুরা খুব সুখী হয়, কারন তাদের ফরাজি বাড়ি খুব ভালোবাসা দিয়ে আপন করে নেয়।”

“আপন করার নমুনা এটা বুঝি?”
একজন লোক ফোন থেকে একটি ভিডিও চালু করলো। তাতে কালকের রাতে সুমন এবং রাইমার মধ্যে যা হয়েছে তা দেখা গেলো। ফরাজি পরিবার থ মেরে গেলো।
“এটা হচ্ছে আপনাদের বাড়ির আপন করার নমুনা। যেখানে বধুরা স্বামীদের থেকেই সুখ পায় না।”

অন্য একজন বললো,“স্বামীর থেকে এভাবে নির্যাতিত হয়েই বোধহয় আপনার বড় বৌমা বড় ছেলেকে খুন করেছিলো?”
“মেয়েটা বাকহীন ছিলো বলে আপনারা তাকে পাগল বলে চালিয়ে দিয়েছিলেন তাই তো?”

ভিডিওটা দেখার পর পুরো গ্রামবাসী ফরাজি বাড়ির বিপক্ষে চলে গেলো। সবাই দেলোয়ার ফরাজিকে যা নয় তাই বলে অপমান করতে লাগলো। সবশেষে গ্রামের প্রধান থেকে সবাই দেলোয়ার ফরাজিকে বাদ দেওয়ার ঘোষনা দিলো।

দেলোয়ার ফরাজির অপমানে আড়ালে আবডালে কেউ তৃপ্তির হাসি হাসে। তার চোখের কোণে তৃপ্তির অশ্রু ধরা দেয়। সে মনেমনে বলে,“প্রথম পদক্ষেপ পূরণ হলো, এবার জমবে আসল খেলা।”

দেলোয়ার ফরাজি থমথমে মুখে বসার ঘরে বসে আছেন। সামনে সুমন ফরাজি এবং রাইমা দাঁড়ানো। সাহেদ ফরাজি কঠিন গলায় বললো,“তোমাদের ঘরের ভিতরের খবর বাহিরে গেলো কি করে?”

সুমন ফরাজি স্বাভাবিকভাবে বললো,“সব এই বেডির কাজ। আমার তো মনে হয় দুধ কলা দিয়ে আমরা এতদিন কাল সাপ পুষেছি। এর মতিগতি আমার কয়েকদিন ধরে ঠিক লাগছে না। আমি নিশ্চিত এসব এই মেয়েটাই করেছে।”

দেলোয়ার ফরাজি কঠিন চোখে রাইমার দিকে তাকালো। সুফিয়ান সবাইকে শান্ত হতে বলে বললো,“সুমন যেটা করেছে সেটা ঠিক করেনি। যদি কোনকিছু ঘটে থাকে তবে তার দ্বায়ভার সুমনের উপর পড়ে। আর এখন মাথা গরম করে লাভ নেই। তারচেয়ে বরং আমাদের সবার মিলে আসল সত্যিটা বের করা উচিত।”

সবাই সুফিয়ানের কথা সমার্থন করে ঘরে চলে গেলো। রাইমাও যেতে নিচ্ছিলো সুফিয়ান তাকে আটকালো। শান্ত কন্ঠে বললো,“আমার ঘরে এসো, আমার কিছু কথা আছে তোমার সাথে।”

রাইমা চুপচাপ সুফিয়ানের ঘরের দিকে পা বাড়ালো।

নুর সুফিয়ান পাশাপাশি দাঁড়ানো, সামনে রাইমা কালো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। সুফিয়ান স্বাভাবিকভাবেই জিজ্ঞেস করলো,“আমি যখন পড়াশোনার জন্য বাহিরে ছিলাম তখন এখানে কি কি ঘটেছে? ভাবী আপনার কাউকে ভয় পাওয়ার প্রয়োজন নেই। আপনি ভয়হীন বলতে পারেন। আমি শুধু আমার আড়ালে ঘটা গল্পটা জানতে চাই। দয়া করে আজ আমার থেকে কিছু আড়াল করবেন না।”

রাইমা চুপচাপ বসে আছে। তার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না।
_______

সকাল সকাল রাজের ফোনে মেসেজ চলে এলো। তাতে লেখা ছিল,“রাজি আছো?”
রাজ সহজ ভাবে বললো,
“হ্যাঁ। আমাকে কি করতে হবে?”
“ফরাজি গার্মেন্টস নাম শুনেছো?”
“হ্যাঁ।”
“গার্মেন্টস এর মধ্যে দেলোয়ার ফরাজি, সাহেদ ফরাজি, সুমন ফরাজি একসাথে যখন থাকবে।”
রাজ কিছুটা ভয় নিয়ে বললো,“তাদের মারতে হবে?”
“উঁহু। তাদের সাথে একটু খেলতে হবে। মৃত্যুর খেলা। এটা এমন একটা খেলা যেখানে মৃত্যু আসবে মনে হলেও ঠিক আসে না।”
“মানে?”
“সেটা বলে দেওয়া হবে।”
রাজ কিছুটা সাহস নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,“আপনি আমাকে দিয়ে এসব কেন করাতে চান?”
“জীবনের একটা অধ্যায় এরিয়ে না গেলে আজ এই প্রশ্নটা করার প্রয়োজন পড়তো না তোমার। সেদিন যদি এরিয়ে না যেতে, যদি একটু আগ্রহ দেখাতে তবে আজ তুমি নিজেই বুঝতে পারতে তোমার সাথে এসব কেন হচ্ছে।”

রাজ থ মেরে গেলো। জীবনের অধ্যায় সে এরিয়ে গেছে। কই তার তো মনে পড়ছে না? কি এরিয়ে গেছে সে? রাজ বেশ ভাবনায় পড়ে গেলো।
________
রাইমা তখন থেকেই চুপ করে আছে। রাইমাকে চুপ দেখে নুর বললো,“আমি থাকায় সমস্যা হলে চলে যাচ্ছি।”
“না তেমন নয়। তুমি নতুন এসেছো, তোমাদের সম্পর্কের সূচনা হয়েছে তার গভীরতা বাড়ুক তারপর পুরনো গল্প নিয়ে পড়ো। তাছাড়া যা কিছু হচ্ছে তাতে ওসব ঘটনা জড়ানো নয়, তাই পুরনো কথা বাদ দেওয়াই ভালো।”
সুফিয়ান সন্দিহান দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,“ঐ ঘটনা জড়ানো নয় সেটা আপনি জানলেন কিভাবে?”
রাইমা থতমত খেয়ে গেলো। তবুও নিজেকে সামলে নিলো।
“তার তো কোন আপনজন ছিলো না, তাই মনে হচ্ছে এসব তার সাথে জড়ানো নয়।”
সুফিয়ান কিছু বলতে চাইলে রাইমা থামিয়ে দিয়ে বললো,“এরপরো কিছু জানার থাকলে নিজের বাবা-মাকে গিয়ে প্রশ্ন করো।”

সুফিয়ান চুপ করে গেলো। রাইমা হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলো।
নুর সুফিয়ানকে প্রশ্ন করলো,“আপনি আপনার বড় ভাই, তার স্ত্রীর কথা জানেন না?”
“আমার বড় ভাইয়া যখন বিবাহ করে তখন আমি পড়ালেখার জন্য হোস্টেলে ছিলাম। বাবা-মা কেন জানি না আমাকে বিয়ের খবর জানায়নি। যখন বাড়িতে আসলাম তখন জানতে পারলাম ভাইয়া বিয়ে করেছিলো। ভাবী পাগল ছিলো তা তারা বুঝতে পারিনি। ভাবী নিজের হাতে ভাইয়াকে মেরে ফেলেছিলো। তারপর তারা তাকে মানসিক হাসপাতালে পাঠায়।”
“মানসিক হাসপাতাল?”
“হ্যাঁ। সাহেরা মানসিক হাসপাতাল। আমি একবার দেখা করতে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু….।”
“কিন্তু?”
“তার আগে জানা গেলো ভাবী পালিয়ে গেছে। হাসপাতাল থেকে খোঁজ নেওয়া হয়েছিলো কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি।”

নুর বেশ ভাবনায় পড়ে গেলো। সুফিয়ান যে ভাবনায় নেই তা নয়। সেও ভাবনায় আছে। আজ সভায় যখন তার ভাবীকে বাকহীন বলা হয়েছিলো তখন থেকে একটা প্রশ্ন সুফিয়ানের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তাকে মেসেজ পাঠানো মানুষটি কোনক্রমে তার ভাবী নয়তো।

সুফিয়ান বিরবির করে বললো,“একবার সাহেরা মানসিক হাসপাতালে যাওয়া উচিত্র।”
বিরবির করে বললেও নুর শুনতে পেলো। নুর বললো,“তার পূর্বে আপনাদের বাড়িতে তার সাথে কি হয়েছিলো সেটা জানা জরুরি।”

সুফিয়ান ঘুরে নুরের দিকে তাকালো। শান্তকন্ঠে বললো,“চলো দু’জন স্বাভাবিকভাবে সংসার করি। একসাথে মিলে সমস্যার সমাধান করি।”
“সমস্যার সমাধান করাই যায় কিন্তু সংসার…”
“সেটা করা যায় না?”
“জোর করে জোড়া সংসার আদো হয় কখনো স্বাভাবিক। সেখানে কি ভালোবাসার জন্ম হয়?”

“চাইলে হয়। মানুষ মানিয়ে নেওয়া শব্দটায় বেশি বিশ্বাসী। মানিয়ে নেওয়া, মেনে নেওয়ার মধ্যেই ধীরে ধীরে ভালোবাসার জন্ম হয়। আমরা চাইলে আমাদের মধ্যে ভালোবাসার জন্মানো সম্ভব।”
“ভালোবাসাটা না জন্মানোই ভালো। ভালোবাসা সে তো বড় বেদনার ডাক।”

নুর একমনে কথাটি বললো। সুফিয়ান জবাবে বললো,“বেদনার অশ্রুতে পদ্ম ফুল ফোটে কবিরা বলে।”
“কোন কবি এমন উদ্ভট কথা বলছে?”
“অবশ্যই আমি।”
বাক্যটি বলে সুফিয়ান হেসে দিলো। নুরও হাসলো।

#পর্ব_৯

সুফিয়ান এবং নুর সাহেরা মানসিক হাসপাতালে দাঁড়িয়ে আছে। মেহরুন বেগমকে জোর করার পরও সুফিয়ান কোন উত্তর পায়নি। রাইমার মতো সেও চুপ ছিলো। তাই সুফিয়ান সিদ্ধান্ত নিয়েছে সাহেরা মানসিক হাসপাতালে গিয়ে খোঁজ করবে। তারা এখন একজন সেবিকার সাথে কথা বলছে।
“আপনারা যার কথা বলছেন সে তো এখান থেকে অনেক আগেই পালিয়ে গেছেন৷ আপনাদের তো জানানো হয়েছিলো।”

“হ্যাঁ আমি জানি। তাও আমি একটু তার সম্পর্কে জানতে চাই। মানে আমি আসলে এটা…. ”
সুফিয়ান বাক্যটি সমাপ্ত করার পূর্বে নুর বললো,“আসলেই সে মানসিক ভারসাম্যহীন রোগী ছিলেন?”
“দেখুন তার সমস্ত ফাইল আমি চেক করেছি, তাতে স্পষ্ট যে আপনি পাগল ছিলেন।”

সুফিয়ান কি বলবে ভেবে পায় না। নুর স্বাভাবিকভাবে বললো,“তাকে যে রুমে রাখা হতো আমরা কি সেটা দেখতে পারি?”
“হ্যাঁ দেখতে পারি। রুমটা ফাঁকা আছে।”
“তাহলে একটু দেখান।”
সেবিকা সম্মতি জানিয়ে ওদের নিয়ে গেলো। কানাঘুষার এক ফাঁকে সুফিয়ান জানতে পারলো হাসপাতালে কর্মরত তিনজন খুন হয়েছে। কথাটি শুনে বেশ অবাক হলো সুফিয়ান। তার মন বলছে হয়তো সব ঘটনা তার ভাবীকে ঘিরেই।

সুফিয়ান এবং নুর ঘরটিতে প্রবেশ করে থমকে গেলো। দেয়ালের চারপাশে অনেককিছু লেখা। কিন্তু সবগুলোই আবছা হয়তো মুছে ফেলা হয়েছে। শুধু একটি বাক্য রয়ে গেছে দেয়ালে স্পষ্টভাবে,“চোখের জলে শ্যামসুন্দর স্বপ্ন হাসে।”

বেশ কিছুক্ষন বাক্যটি দেখলো তারা। তারপর ঘরটি ভালোভাবে খুঁজতে শুরু করলো। আশেপাশে তেমন কিছু পেলো না। হঠাৎ নুর সুফিয়ানকে হাত দিয়ে ইশারা করে সামনে দেখালো৷ সুফিয়ান নুরের ইশারা অনুযায়ী তাকালো। খাটের এক কোনায় একটা দিনপঞ্জি (ডায়েরি) পড়ে আছে। সুফিয়ান দিনপঞ্জিটি হাতে তুলে নিলো। প্রথম পাতা খুলতেই দেখলো লেখা রয়েছে,“আমার অন্ধকার জীবন।”

নুর দিনপঞ্জির দিকে তাকিয়ে বললো,“এটা এতদিন এখানে ছিলো। কেউ কোনভাবে দেখেনি কেন? দেখে থাকলেও এটা নেয়নি কেন?”
সুফিয়ান নুরের দিকে তাকিয়ে একটা রহস্যময় হাসি দিলো। নুর সুফিয়ানের হাসির অর্থ বুঝলো না। সুফিয়ান হাসিমুখে মনেমনে বললো,“আমি জানি। খুব শীর্ঘ্রই তুমিও জানবে। কলঙ্কের দাগ লাগিয়ে সে পার পাবে না।”
সুফিয়ান ভেবে নিলো তার সব প্রশ্নের উত্তর হয়তো সে পেতে যাচ্ছে। সেবিকাকে ধন্যবাদ জানিয়ে তারা দু’জন চলে এলো। চলে আসার পূর্বে খুন হওয়া তিনজনের পরিচয় জেনে নিলো সুফিয়ান। রফিক, সালেহা, কামাল।

নুর এবং সুফিয়ান গ্রামের পথে এসে হেঁটে বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নিলো। সিদ্ধান্তটা অবশ্য সুফিয়ানের। কেন জানি না তার হেঁটে বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে হলো।

দু’জন পাশাপাশি হেঁটে বাসায় আসছিলো। দু’জনার মনেই ভালো লাগা কাজ করছিলো। কিন্তু দু’জনার কেউ প্রকাশ করতে ইচ্ছুক নয়।

হঠাৎ নুরের অবাধ্য মন বলতে চাইলো,“সময়টা থমকে যাক।”

সুফিয়ান বলে উঠলো,“কিছু বললে?”
নুর থতমত খেয়ে বললো,“না তো।”
“মনে হলো যেন কিছু বললে।”
“মনে হওয়া সবসময় ঠিক হয় না।”
“তবুও সবাই বলে,
মনের আয়না হলো চোখ কেননা চোখ কখনো মিথ্যা বলে না। তোমার চোখ দেখে মনে হচ্ছে তুমি সত্যি কিছু বলেছো।”

“তাই। আমার চোখ আর কি কি বলছে?”
সুফিয়ান দাঁড়িয়ে গেলো। নুরের চোখে চোখ রাখলো। নুরও থমকে দাঁড়ালো। সুফিয়ান বললো,“চোখজোড়া ক্ষমা চাচ্ছে আমাকে কলঙ্কিত করার জন্য।”
“তা আপনি কি ক্ষমা করতে পেরেছেন?”

“একসাথে থাকতে হলে আজ নয়তো কাল ক্ষমা নিশ্চয় করা হবে। কিন্তু…”

নুর শান্তকন্ঠে বললো,“আপনার কলঙ্ক ঘুচবে কিনা তাই নিয়ে ভাবছেন?”
“মনে হয় না এ কলঙ্ক ঘুচবে।”

নুর হঠাৎ সুফিয়ানের হাতে হাত রাখলো। সুফিয়ান চমকে নুরের হাতজোড়া দেখলো যা তার হাতকে স্পর্শ করেছে। নুর পূর্ণ বিশ্বাসের সাথে বললো,“একদিন আপনার কলঙ্ক আমি দূর করে দিবো।”
“কিভাবে? এসব যে করেছে তাকে যদি খুঁজে না পাই?”
“তাহলে আমার বাবাকে বলে সব সবার কাছে স্বীকার করে নিবো।”

“লোকজন তো তখন তোমাদের কথা শোনাবে।”
নুর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,“জীবন এমন একটা ক্ষেত্র, যে ক্ষেত্রে প্রতিটা পদক্ষেপে হাজারটা কথার তীর আছে। আপনি যেমনই হন না কেন? ভালো কিংবা খারাপ। জীবনে আপনাকে কথা শুনতেই হবে। হোক সে তিরস্কার কিংবা উপহাসের বাণী।”

একটু থেমে নুর পুনরায় বললো,“যেখানে ভুল না করে কথা শোনা লাগে, সেখানে ভুল করে কথা শোনাটা বেমানান নয়। কথা না শোনাটা বেমানান হতো।”

সুফিয়ান মুচকি হেসে বললো,“হয়তো তোমার কথাগুলো সত্য তবে জীবন সবসময় যে উপহাসের বানী শুনে কাটায় তেমন কিন্তু নয়। এজন্যই হয়তো বড় বড় ব্যক্তিবর্গদের বানী, জীবনে সাফল্যের এমন একটা স্থান অর্জন করো যেখানে তোমাকে তিরস্কার করার জন্য কোন ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না।”

“তাই বলে কি উপহাস বন্ধ হয়? আড়ালে কিন্তু পরনিন্দা, পরচর্চা চলেই।”
“আড়ালে তো হাজার কিছু হয় সবগুলো নিয়ে ভাবলে কি চলে সখী।”

নুর থেমে গেলো। সুফিয়ানও চুপ হয়ে গেলো।


দেলোয়ার ফরাজি, সাহেদ ফরাজি, সুমন ফরাজি গাড়ি দূর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। কিছুক্ষন পূর্বে মরতে মরতে বেঁচে গেছেন তারা। কিছুটা সুস্থবোধ করতে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলেন, তাদের হাসপাতাল কে নিয়ে এলো। তখন ডাক্তার রাজকে দেখিয়ে দিলো। দেলোয়ার ফরাজি রাজের উদ্দেশ্যে বললো,“মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম আজ। তুমি আমাদের আজ অনেক বড় উপকার করলে।”
“এটা আমার দায়িত্ব আংকেল।”
“তা নাম কি বাবা তোমার?”
“রাজ চৌধুরী।”
এরপর টুকটাক পরিচয় হলো রাজের সাথে। বাড়িতে এখনো কেউ জানে না।

অন্যদিকে বাথরুমে পড়ে গিয়ে রোকসানা বেগমের অবস্থা খারাপ। মোটামুটি ফরাজি বাড়ির সবাই বুঝতে পারছে তাদের উদ্দেশ্য করে কেউ জগন্য খেলায় মেতে উঠেছে। রোকসানা বেগমের রাইমার উপর যথেষ্ট সন্দেহ হচ্ছে। সন্দেহ হওয়ার অবশ্য কারন আছে। বাড়ির যেকোন দূর্ঘটনা ঘটার পূর্বে সেখানে রাইমাকেই দেখা যায়। এটা নিছকই কাকতালীয় নাকি পূর্ব পরিকল্পিত তা বুঝতে পারছে না তিনি।

দেলোয়ার ফরাজি রাজকে বিদায় দিয়ে বাসা ফিরে এলো। রাজ সাথে সাথে আগন্তুকের ফোন নাম্বারে মেসেজ দিলো,“আপনার কথামতো কাজ হয়েছে। এবার আমার প্রিয়কে ছেড়ে দিন।”

রিপ্লাই আসলো, “প্রিয়কে এত ভালোবাসেন?”
“আমি আমার ভালোবাসার ব্যাখা দিতে রাজি নই। আমার প্রিয়কে ছেড়ে দিন।”
“যদি না ছাড়ি?”
“মেরে ফেলবো আপনাকে, আমার প্রিয়র সাথে কিছু হলে খুব খারাপ হয়ে যাবে।”
“এত উত্তেজিত হয়ে লাভ নেই, আমার সম্পর্কে খোঁজ নিতে তো বন্ধুদের কাজে লাগালে, কোন লাভ হলো কি?”

রাজ মেসেজটি দেখে চমকে গেল। লোকটি তার সম্পর্ক সবকিছু জানে কিন্তু কিভাবে?

রাজ কিছুটা ভিতু কন্ঠে লিখলো,“আমি কি কোন অপরাধ করেছি? আপনি আমাকে এভাবে ভুল কাজ করাতে বাধ্য কেন করছেন?”
“বললাম না জীবনের একটা অধ্যায় তুমি এরিয়ে গিয়েছিলে।”
“কোনটা?”
“তুমি বরং ততক্ষন ভাবো, আমি বরং তোমার পরবর্তী কাজ সম্পর্কে ভেবে নেই।”

রাজ তারপর যত মেসেজ দিলো কোন উত্তর এলো না। রাজ হতাশ হয়ে বাসায় ফিরলো। মাথায় কোন কাজ করছে না। বাসায় ফিরে হঠাৎ চোখ গেলো বিছানার পাশে তার এবং শ্যামলের তোলা ছবিটির দিকে। আপনমনে ছবিটি হাতে তুলে নিলো সে। পরক্ষনেই চমকে উঠলো।
________
“আমার অন্ধকার জীবন”
সুফিয়ান এবং নুর দিনপঞ্জিটি খুলে পড়া শুরু করলো। প্রথম পাতার লেখাটায় নুর দু’বার হাত ভুলালো। তারপর দু’জনে পড়ার জন্য দ্বিতীয় পৃষ্ঠা উল্টালো,

*
আমি নীলাশা। বাবা-মায়ের ভালোবাসার দ্বিতীয় সন্তান। আসা নামক কোন শব্দ আমার জীবনে পূরণ হয়নি। তাই হয়তো বাবা মা নাম রেখেছে নীলাশা। আমার আরো একটি নাম আছে। সেটা হলো পরী। আমার বোন আমাকে ভালোবেসে ডাকতো। নামগুলো খুব সুন্দর তাই না? হ্যাঁ জানি খুব সুন্দর। নামের মতো আমিও সুন্দর এরকমটাই ভাবছো তো তুমি। আরে হ্যাঁ আমি তোমাকেই বলছি, যে আমার জীবনী পড়ছো৷

তুমি না খুব বোকা। নাম দেখে একজনকে সুন্দর ভেবে নিলে। আসলে ভুলটা তোমার নয় ভুলটা আমাদের সবার। সবাই ভাবে সুন্দর রুপ যার আছে সুন্দর নাম পাওয়ার যোগ্যতা সে রাখে। আমার মতো কালো মানুষদের নাম সুন্দর হওয়া বড্ড বেমানান।

আমি মূলত তোমাকে আমার জীবনী শোনাবো না। আমি তোমাদের আমার স্বপ্ন পূরণের একটা গল্প শোনাবো। আচ্ছা তুমি জানো আমার স্বপ্নের নাম কি? উঁহু জানো না। তবে শোন,
মানুষ ভাবে স্বপ্ন দু’ধরনের একটা রঙীন অন্যটা বেরঙীন। রঙ আর বেরঙের মাঝে কোন স্বপ্ন থাকতে পারে তা বোধহয় তোমরা জানো না। কিন্তু আমি জানি রঙ বেরঙের মাঝে একটা স্বপ্ন থাকে।

রঙীন স্বপ্ন যেগুলোকে আমরা সাদা নাম দিতে পারি। যে স্বপ্ন সত্যি হয় সেটাই তো রঙীন, যার রং সাদা। সাদা গায়ের গরন তোমার তাই তো তোমার স্বপ্ন সত্যি হয়। কালো গায়ের গরন যার তার স্বপ্ন সত্যি হয় না তাই তো সেগুলো বেরঙীন। তবে আমি আমার স্বপ্নগুলো কালো বা সাদায় রাখতে চাইনি। আমি তো সাদা নই, তাই আমার স্বপ্ন সত্যি হবে না। কিন্তু তবুও মন বলে স্বপ্নগুলো যদি সত্যি হয়। তাই তো আমি আমার স্বপ্নের নাম দিয়েছি #শ্যামসুন্দর_স্বপ্ন। সাদা আর কালোর মধ্যবতী শ্যাম। যাকে সবাই শ্যামসুন্দর বলে। তাই আমার স্বপ্নগুলো শ্যামসুন্দর। কালো এবং সাদার মাঝে শ্যামসুন্দর স্বপ্ন যদি সত্যি হয় কখনো।
সেই আসায় নাম দিয়েছি #শ্যামসুন্দর_স্বপ্ন। যা রঙ বেরঙের মাঝে পড়ে। পূরণ হতেও পারে নাও হতে পারে। তবুও কিছুটা আসা তো রয়ে যায়।

তোমরা হয়তো ভাবছো আমি তোমাদের লিখে এসব কেন বলছি? মুখে তো বলতে পারি। উঁহু পারি না। কেননা আমি বাকহীন।

শহরের বড় এক ব্যবসায়ী পরিবারে দ্বিতীয় সন্তান হিসাবে আমার জন্ম। আমি দেখতে কালো সেটা নিয়ে আমার বাবা-মার সমস্যা নাহলেও, যখন দেখলো বয়সের সাথে সাথে আমার মুখ দিয়ে শব্দটা একদমি বের হয়না। অর্থাৎ আমি বাকহীন তখন অন্যনা বাবা, মার মতো আমার বাবা, মাও চিন্তিত ছিলো। একটু না অনেকটা চিন্তিত। বেশি টাকা খরচ করে শিক্ষাটা আমার অর্জন হলেও কন্ঠে শব্দটা অর্জন করতে পারি না।

যে আমার এই দিনপঞ্জিটি পড়ছো তাকে আমি আমার একের পর এক স্বপ্ন দেখার গল্পটা জানাতে চাই। আগ্রহ এবং ধৈর্য থাকলে আমার স্বপ্নগুলো মন দিয়ে শোনো।

“এ যে আমার হাজার বাসনায় গড়া #শ্যামসুন্দর_স্বপ্ন। মনোযোগ না দিলে কষ্ট পাবো খুব। মনে রেখো তোমার মনোযোগ আমার একটি স্বপ্ন।”

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here