#দিন_বদলের_হাওয়ায়-১৮,১৯ শেষ
#তানজিলা_তিহা (লেখনীতে)
১৮
শাশুড়ির কথা শুনে রুনা আপা হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন শাশুড়ির দিকে। আমিও অবাক। আমি আর রেদোয়ান একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছি অবাক দৃষ্টিতে! তিনি আমার পক্ষে সাফাই গাইছেন কেন?
রুনা আপা আম্মাকে বললেন, তুমি আমাকে এগুলো বলতে পারলে মা?
হ পারলাম। আমি একটুকু কওয়ায় তোর কষ্ট লাগতাছে ওই মাইয়াটারে যে এত্তোগুলা কইলি ওর কেমন লাগতাছে?
রুনা আপা কিছু বলতে পারলেন না। তার চেহারায় এখনো বিস্ময়ের ছাপ। আমার শাশুড়ির এই ব্যবহার হয়তো আশা করেন নি। আমিও অবাক হয়ে আমার শাশুড়িকে দেখছি। শাশুড়ি আবার বললেন, আমার কথায় কষ্ট পাইলে পাইছ কিন্তু এই মাইয়াটার বাপ মায় এনে উপস্থিত তাগো সামনে তুই মাইয়াটারে এতগুলা কথা কেমনে শুনাইলি?
রুনা আপা চুপ থাকলেন। শাশুড়িও নীরব রইলেন কিছুক্ষণ। এরপর বললেন, রেদোয়ান আমগোরে গাড়ি দেইখা দে তো। আমরা যাই গা। আমার সরম লাগতাছে এহন। এই মাইয়া নিয়া আমি এন থেকে যাই গা। নাক কাটা যাইতাছে আমার।
ভীষণ অবাক আমি। রেদোয়ান আম্মাকে বললো, এখন কেন যাবে? এসেছো দুদিন থাকো। তবে ঝগড়াঝাঁটি করো না। আমার বাড়িতে আমার ভাই বোন মা বাবা আসবে থাকবে আমি নিষেধ করি নি। কিন্তু আসার পরে মিথ্যে অভিযোগে কেন ঝগড়া শুরু করবে?
শাশুড়ি কিছু বললেন না। রুনা আপা চুপসে আছেন। আমি শুধু দেখছি তাদের অবস্থা। রেদোয়ান আর কথা বাড়ালো না। সবাই নীরব হয়ে গেলো।
সন্ধ্যা বেলা আমি রান্নার জন্য রান্না ঘরে গেলাম। তরকারি কাটা শেষ করে পিঁয়াজ কাটছিলাম। হঠাৎ আমার শাশুড়ি আমার কাছে গিয়ে বললেন, বউ মা আমারে দাও আমি কাটি। তুমি তরকারি ধুইয়া লও।
আমি ভীষণ অবাক হলাম। বললাম, না থাক আম্মা আমি পারবো। আপনি যেয়ে বিশ্রাম করেন।
সারাদিনই তো বইসা ছিলাম। এখন দাও তো।
না আম্মা আপনি বেড়াতে এসেছেন। আপনার আর কাজ করতে হবে না। আপনি ঘরে গিয়ে বসেন।
আমার শাশুড়ির হাসি মাখা মুখটা মলিন হয়ে গেলো। বললেন, দূরে সরায়া দিতাছো তাই না? জানো ওনে একলা একলা আমার ভাল্লাগে না। তোমগো কথা মনে পড়ে। কাম কাইজ যা আছে একলাই করি। রথে আর কুলায় না।
শাশুড়ির কথায় মায়া হলো। তাকে একবার ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম। আগের মতো তেজ আর শরীর তার নেই। কথাবার্তা অনেকটাই নরম হয়ে এসেছে। শরীরের অবস্থাও আগের মতো নেই। কেমন যেন রোগা রোগা দেখা যাচ্ছে তাকে। আগের মতো কথাবার্তাও বলেন না তিনি। তার পরিবর্তন কেমন যেন লাগছে।
আমার ভাবনার মাঝে শাশুড়ি বললেন, কি হইলো মা?
কিছু না আম্মা। আপনি ঘরে যান। ওখানে তো সব কিছু আপনার নিজের করেই খেতে হয়। এখন না হয় আমি করি আপনি বিশ্রাম করেন।
আচ্ছা কিছু যেহেতু করতে দিবা না আমি এনেই বইসা থাকি। রুমে ভাল্লাগে না।
শাশুড়ি বসেই রইলেন। আমি আমার কাজেই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। মাঝে মাঝে আমার শাশুড়ি দুই একটা প্রশ্ন করতে থাকলেন। আমিও তার উত্তর দিলাম। এক সময়ে শাশুড়ি ঘরে চলে গেলেন।
রাতে তাদের তিন মা মেয়ে ছেলেকে একসাথে খাবার দিলাম। শাশুড়ি মাকে তাদের সাথে খাওয়ানোর জন্য জোর করেছেন কিন্তু মা রাজি হন নি। আমার শাশুড়ি বেশ তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছেন। রুনা আপা তেমন খাচ্ছেন না। তার চেহারায় রাজ্যের অন্ধকার। রেদোয়ান খাচ্ছে আর তার মায়ের খাওয়া দেখছে। আমার শাশুড়ি সেটা হয়তো খেয়াল করলেন। রেদোয়ানকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তিনি হেসে বললেন, এমনে চাইয়া আছোছ কেন বাবা? অনেক দিন পর এমন স্বাদের খাওন খাইলাম। ওনে নিজে ঠিক মতন রানতে পারি না। শরীরে কি আর আগের মতন জোর আছে? করতে পারলে খাই আর না করতে পারলে খাই না। আজকে অনেক দিন পর মন ভইরা দুইটা খাইতাছি।
শাশুড়ি তাঁর কথা শেষ করলেন। কথা শুনে খুব খারাপ লাগলো। সেখানে একা থাকতে ওনার খুব কষ্ট হয়। ঠিকই তো বুড়ো মানুষ আর কতটুকু করতে পারে? ওনাকে রান্নাবান্না নিয়ে খুব ঝামেলায় পড়তে হয়। রেদোয়ানের চেহারায় মলিনতা খেয়াল করলাম। রেদোয়ান ভাত নড়াচড়া করতে থাকলো। কোন রকমে খাওয়া শেষ করে আস্তে উঠে গেলো সে। আমি সবকিছু পরিষ্কার করে নিলাম। আমি আর মাও খেয়ে নিলাম।
রাতে শোয়া নিয়ে পড়লাম আরেক ঝামেলায়। বাসায় ঘর দুটো। একটায় আমার মা বাবা আছেন। আরেকটায় শাশুড়ি আর ননদকে দিলাম। কিন্তু এখন আমরা কোথায় শোবো? নিচে যে বিছানা করে শোবো তারও কোন উপায় নেই। কোন ঘরে বিছানা করবো? যেখানেই ঘুমাবো সেখানেই লজ্জায় পড়তে হবে। শেষে রেদোয়ানকে শাশুড়ির ঘরে নিচে বিছানা করে দিলাম সে সেখানেই ঘুমালো। আর আমি মায়ের কাছে রাতটা কাটিয়ে দিলাম। মা আর আমি কেউই ভালো করে ঘুমাতে পারলাম না রাতে। দুজনেই বসে রাত কাটালাম। বিভিন্ন কথায় রাত কাটলো মা মেয়ের।
ফজরের সময় উঠে নামাযটা পড়ে নাস্তা তৈরি করে নিলাম। রেদোয়ানকে ডাক দিয়ে উঠালাম। রাতে মা বলেছেন গ্রামে চলে যাবেন। ডাক্তার আবার পনেরো দিন পর দেখা করতে বলেছেন। তখন এসে ডাক্তার দেখাবেন। আমি আর মাকে কিছু বলি নি। কোন মুখে আবার থাকতে বলবো আমি? এখানে থেকে অপমান সহ্য করার থেকে নিজের বাড়ি চলে যাওয়াই তাদের জন্য উত্তম।
আমি রেদোয়ানকে সবটা বললাম। সে নীরবে শুনলো। এরপর আমায় বললো, গতকালের ঘটনার জন্য কি তারা চলে যেতে চাচ্ছে আয়ু? প্লিজ রাগ করো না আমার বোনের হয়ে আমি ক্ষমা চাচ্ছি।
না সে কারণে যেতে চাইছেন না। পনেরো দিন তো অনেক দেরি। বাড়িতে পায়রা একা। তাই মা চলে যেতে যাচ্ছেন।
মিথ্যে বলছো তুমি।
মিথ্যে কেন বলবো আমি রেদোয়ান? একটু পরে তারা বের হবে। তুমি মা বাবাকে একটু গাড়িতে উঠিয়ে দিতে পারবে?
রেদোয়ান কিছুক্ষণ আমার দিকে নীরব তাকিয়ে থাকলো। এরপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, সিদ্ধান্ত যখন নিয়েই নিয়েছে তখন আর কি বলবো আমি। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
রেদোয়ান চলে গেলো। আমি বাবা মাকে নাস্তা দিলাম। শাশুড়ি ননদ এখনো ঘুম থেকে উঠে নি। মা বাবা নাস্তা শেষে তাদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। রেদোয়ানও চলে গেলো। তাদের গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে রেদোয়ান অফিসে যাবে। তারা বের হওয়ার পর আমি কিছুক্ষণের জন্য শুয়ে পড়লাম।
আটটার দিকে আমার শাশুড়ি আমাকে ডাক দিলেন। আমি ঘুম থেকে উঠলাম। তিনি আমাকে বললেন, বউ মা তোমার আম্মা আব্বা কই? তাদের দেখতাছি না যে।
তারা চলে গেছে আম্মা।
শাশুড়ি বিস্মিত হলেন। বললেন, কি কও? গেছে গা মানে?
তারা তাদের বাড়িতে চলে গেছে। সকালেই বের হলো।
কেন মা? রুনার কথায় কি তারা বেশি কষ্ট পাইছে? রাগ কাইরো না মা। ওরে মাফ কইরা দাও।
না আম্মা। গতকাল বাবাকে ডাক্তার দেখালাম না? ডাক্তার পনেরো দিন পর দেখা করতে বলেছেন। তাই ওনারা চলে গেছেন।
শাশুড়ি কিছুক্ষণ শান্ত থেকে বললেন, রেদোয়ান কই?
ওনাদের গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে অফিসে যাবে বলেছে।
শাশুড়ি কিছু বললেন না। আমি বললাম, আম্মা আপনি মুখ হাত ধুয়ে আসুন। আমি নাস্তা দেই। আপা ঘুম থেকে উঠেছে?
হ উঠছে।
ঠিক আছে। আমি তাহলে নাস্তা দেই।
নাস্তা করে আমার শাশুড়ি আর ননদ বেরিয়ে পড়লেন। তারা রুশা আপার বাড়িতে যাবেন বলেছেন। বিকেলে আসবেন বলেছেন। আমি কথা বাড়াই নি। ওনারা চলে যাওয়ার পর নিজের সব কাজ শেষ করে কিছুক্ষণের জন্য শুয়ে পড়লাম আমি। গতকাল রাতে ভালো ঘুমাতে পারি নি আমি। একটু ঘুমিয়ে নিলাম।
আমার ঘুম ভাঙলো মোবাইলের রিংটোনে। মা ফোন করেছেন। তারা বাড়িতে গিয়ে পৌঁছেছেন। মায়ের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে উঠে গেলাম আমি। গোসল সেরে নামায পড়ে বসলাম।
কিছুক্ষণ পরই দেখলাম আমার ছোট জা এসেছে। ওর সাথে কিছুক্ষণ কথা হলো। ও শাশুড়ির কথা জিজ্ঞেস করলো। রুশা আপার বাড়ি গেছে তা বললাম আমি। ও গল্পটল্প করে বিদায় নিলো।
শাশুড়ি আর ননদ সন্ধ্যা নামার পর বাড়িতে এলেন। শাশুড়ি আসার পর রুশা আপার বাসার গল্প শুরু করলেন। আমি নিরবে শুনছি। মাঝে মাঝে দুই একটা কথার উত্তর করছি। নিশি আর নিহালের দুষ্টুমি নিয়ে অনেক কথা বললেন শাশুড়ি। রুনা আপা চুপ করেই রইলেন। তিনি গোমড়া মুখেই বসে রইলেন। রেদোয়ান আসা পর্যন্ত গল্প করলেন শাশুড়ি। রেদোয়ান আসলো। সবাইকে খাবার দাবার দিলাম। খাওয়ার পর কিছুক্ষণ কথা বলে ঘুমিয়ে পড়লাম।
আমার ননদ আর শাশুড়ি মোট সাত দিন আমাদের বাড়িতে থাকলেন। এর মধ্যে জুলি আমাদের বাড়ি দু বার এসেছে। শান্তিও একবার এসেছিলো। আমার শাশুড়ি বেশ পরিবর্তন হয়েছেন। আগের থেকে অনেক নরম হয়ে গিয়েছেন। আগের তেজী ভাব তার শরীরে নেই। এখন ভালো করেই কথা বলেন আমার সাথে। আজ তারা চলে গিয়েছেন। রেদোয়ান তাদের গাড়িতে উঠিয়ে দিয়েছে বিকেলে।
রেদোয়ান বাসায় আসলো সন্ধ্যায়। আসার পর থেকেই তাকে কেমন মনমরা দেখাচ্ছে। চেহারা ভীষণ মলিন। অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে তাকে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে তোমার? এমন মনমরা হয়ে আছো কেন?
রেদোয়ান হকচকিয়ে গেলো। ভাবনার দুনিয়া থেকে বের হলো। কিছুক্ষণ নিশ্চুপই থাকলো সে। আমার কথার কোন উত্তর দিলো না। কিছুক্ষণ গম্ভীরভাবে বসে থাকার পর সে বললো, আয়ু মাকে আমাদের সাথে রাখলে কি তোমার কোন আপত্তি আছে? যত অন্যায়ই করুক সে তো আমার মা। দেখেছো আমার মায়ের কি অবস্থা হয়েছে ওখানে থেকে? আমার মায়ের এই অবস্থা আমার অন্তরকে ক্ষ-ত-বি-ক্ষ-ত করে দিচ্ছে। আমার মাকে তোমার সাথে রাখবে আয়ু?
চলবে………
#দিন_বদলের_হাওয়ায় [অন্তিম পর্ব]
#তানজিলা_তিহা (লেখনীতে)
সকল সন্তানই তার মা বাবাকে ভালোবাসে। তাদের মা বাবা ভালো থাকুক, তাদের সাথে থাকুক এটা সবাই ই চায়। রেদোয়ানও তাই চাচ্ছে। সে যদি নিজের মাকে নিজের সাথে রাখতে চায় তবে আমি বাঁধা দিবো কেন?
আমি শান্ত ভাবেই তাকে বললাম, আমার সমস্যা হবে কেন? তোমার মাকে তুমি অবশ্যই সাথে রাখবে।
রেদোয়ান কিছুক্ষণ নীরব রইলো। এরপর বললো, আচ্ছা মাকে আনলে তো আমাদের বাসা চেঞ্জ করতে হবে।
আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেন? আমাদের তো দুটো ঘরই আছে।
কিন্তু সামনের ঘরে মা থাকবে কি করে?বাহির থেকে আসবো যাবো মা ঘরে শুয়ে বসে থাকবে। সমস্যা হবে মায়ের।
তাহলে ভিতরের ঘরে তাকে থাকতে দেই।
তখন তো আমাদের সামনের ঘরে থাকতে হবে। এটাও তো হয় না।
তবে তুমি যা ভালো মনে করো তাই করো।
হুম। এ মাসটা দেখি সামনের মাসে বাসা চেঞ্জ করে মাকে নিয়ে আসবো।
আমি আর কোন কথা বললাম না। রেদোয়ানও কথা বললো না আর।
এর মাঝেই সময় পেড়িয়ে যেতে লাগলো। কেটে গেলো কয়েকদিন। আমাদের বর্তমান বাসাটা না করে দেওয়া হয়েছে। নতুন বাসা দেখাও হয়ে গেছে। রেদোয়ানই দেখেছে। আমাকেও দেখিয়েছে। বাসাটা মোটামুটি ভালোই। দুটো বেড রুম, একটা ড্রইং, একটা ওয়াশরুম আর রান্নাঘর। নতুন বাসায় এডভান্স দেওয়াও হয়ে গেছে। সামনের মাসেই সেখানে উঠবো। এ কথা কেমন করে যেন বাতাসের বেগে সবার কাছে ছড়িয়ে পড়েছে। জুলি আর শান্তি কয়েকবারই আমাদের বাসায় এসে গেছে। ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে তারাও আমাদের সাথে একসাথে থাকতে চাচ্ছে। কিন্তু আমি কখনো এসব কথা তুলতে দেই নি। ইনিয়ে বিনিয়ে জুলি অনেক বার এ কথা বলার চেষ্টা করেছে। আমি কথা ঘুরিয়ে তাকে কিছু বলতে দেই নি। এতে সে বেশ বিরক্ত হতো কিন্তু বুঝেও না বোঝার ভান ধরে থাকতাম। আজ বিকেলেও শান্তি এসে গেছে বাসায়। এসব বিষয়ে কথা তুলতে চেয়েছিলো। কিন্তু পাশের ঘরের ছেলেটা দৌড়ে আমার ঘরে চলে আসায় কথাটা চাপা পড়ে গিয়েছিল। ওকে নিয়েই বিভিন্ন কথা বললাম শান্তির সাথে।
আমার শাশুড়িও ইদানিং মহাখুশি। তিনি আবার শহরে চলে আসবেন। আগের মতো চলাফেরা করতে পারবেন। এতে খুশি হওয়ারই কথা। রোজ একবার করে আমাকে ফোন করেন তিনি। রোজ ফোন করে ভালো মন্দ খোঁজ খবর নিচ্ছেন। বেশ ভালো লাগে ব্যাপারটা। তিনি বদলে গেছেন এতে খুব খুশি হয়েছি আমি।
সময় কেটে যায় দ্রুত গতিতে। আজ আমরা আমাদের নতুন বাসায় উঠেছি। আগামীকাল রেদোয়ান গিয়ে আমার শাশুড়িকে নিয়ে আসবে। ভীষণ খুশি আমি। কয়েকদিনে তার সাথে আমার সম্পর্কটা দারুণ হয়ে উঠেছে। রেদোয়ান সারাদিনই তো অফিসে থাকে। সারাদিন আমার সময় কাটে না। আম্মা থাকলে দুই শাশুড়ি বউয়ের দিন কেটে যাবে। বেশ ভালো লাগছে।
রেদোয়ান পরের দিন গিয়ে আমার শাশুড়িকে নিয়ে আসলো। শাশুড়ি খুব খুশি। আমিও খুশি। শাশুড়ি কথাবার্তা, চালচলন সব কিছুই এখন স্বাভাবিক। ভালোই চলছে দিন। শাশুড়ি আর আমার মধ্যে আগের মতোই একটা ভালো সম্পর্ক আবারও তৈরি হলো। এখন আমার শাশুড়ির আমার প্রতি যত্ন দেখলে মানুষ বলে আমরা দুজন মা মেয়ে। বেশ ভালো লাগে শুনতে।
হাসি আনন্দেই কেটে গেলো পাঁচটা মাস। সবকিছু সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। ভালোই কাটছে সব। সবার আচরণই স্বাভাবিক। রুশা আপা, জুলি, শান্তি কয়েকদিন পর পরই আমাদের বাড়িতে আসে। কিছুদিন আগে সায়রা, পায়রা ওরাও এসেছে। সবাই ই বেশ স্বাভাবিক। পায়রার জামাই আমাদের গ্রামেই এখন ছোট খাটো একটা মুদি দোকান দিয়েছে। ব্যবসায় লস খাওয়ার পর দ্বিতীয় বার দাঁড়িয়েছে এই মুদি দোকানটা নিয়ে। ভালোই চলছে সবার। সবাই ভালো আছে এটা দেখতেও ভালো লাগছে। রুনা আপার সাথে আমার যোগাযোগ নেই। মাঝে মাঝে রেদোয়ানকে ফোন করে আমার খোঁজ খবর নেয়। কিন্তু তিনি আমার সাথে কথা বলেন না। আমিও ততটা আগ্রহী নই। এ যাবৎ দিনগুলোর মধ্যে আমার জন্য সবচেয়ে খুশির সংবাদ ছিলো যখন আমি প্রথম শুনলাম আমি অন্তঃসত্ত্বা। বর্তমানে আমি তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এই জন্যই সবাই ঘুরে ফিরে আমার খোঁজ খবর নেয়। আমার সময় ভালোই কাটছে। আগামীকাল আমার শ্বশুরের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে মাদ্রাসার এতিম ছাত্রদের জন্য ভুরিভোজের আয়োজন করেছে রেদোয়ান। জুলি, শান্তি, রুশা আপাকে আসতে বলা হয়েছে। রুনা আপাকেও বলা হয়েছে কিন্তু এতো দূরের পথ দেখে উনি আসবেন না বলেছেন। এ নিয়ে আর কেউ কোন কথা বললাম না।
সবাই ই স্বাভাবিক। আয়োজন ভালোই করা হয়েছিল। আজ সারাদিনই রেদোয়ান এগুলোর পিছনে ছিলো। রাতে রেদোয়ান বাসায় ফেরার পর আমার এক অদ্ভুত খায়েশ জাগলো। আজ সারাদিন বসে বসেই এই অদ্ভুত চিন্তা ভাবনা করেছি। আমি নিজেও জানি না কেন আমার এরকম অদ্ভুত ইচ্ছে হচ্ছে। তবুও নিজের মনকে প্রাধান্য দিয়ে অদ্ভুত ইচ্ছেটা পূরণের জন্য রেদোয়ানকে দিয়ে অফিস থেকে তিন দিনের ছুটি নেওয়ালাম। আজকেও রেদোয়ান ছুটি নিয়েছিলো। আমার জোরাজুরিতে দ্বিতীয় বার ফোন করে মিথ্যে বাহানায় ছুটি নিতে হলো তাকে। বস ছুটি দিতে না চাওয়ার কারণেই মিথ্যে বাহানার আশ্রয় নিতে হলো। মাসের শেষ শেষ এ মুহূর্তেই আমার অদ্ভুত ইচ্ছেটা পূরণ করা সম্ভব। রেদোয়ান বিরক্ত হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, অকারণে ছুটি নেওয়ালে কেন? আমি বাসায় থেকে কি করবো?
অকারণ বলছো কেন? আমি কি অকারণে তোমাকে ছুটি নিতে বলেছি?
তাহলে কেন ছুটি নেওয়ালে? কোথাও যাবে? নাকি ডাক্তার দেখাবে?
আরে না। এছাড়া অন্য কারণ থাকতে পারে না? কারণ একটা আছে দেখেই নেওয়ালাম। দেখবে কাল। এখন ঘুমাও তো। আমার শরীর ভীষণ ক্লান্ত। আমি ঘুমাবো।
একটু থেমে আবার বললাম, শোনো এই তিন দিন আমি বাড়িতে যা যা করবো তুমি শুধু দেখবে কিছুটি বলতে পারবে না।
রেদোয়ান মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো আর কিছু বললো না। ঘুমিয়ে পড়লাম। রুশা আপা রাতে বাড়িতে চলে গেলেন। জুলি, শান্তি এখানেই রয়ে গেলো। রুশা আপাকেও থাকতে বলেছি। কিন্তু উনি চলে গেলেন।
আজ সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হলো আমার। আমি উঠার আগেই নাস্তা রেডি। এ অবশ্য নতুন নয়। ইদানিং জুলি আর শান্তি আসলে আমার রান্নাঘরে যাওয়া লাগে না। ওরাই সব করে। আমি, রেদোয়ান, শাশুড়ি এবং ওরা সবাই একসাথে বসেই নাস্তা করে নিলাম। রেদোয়ান ছুটি নিয়েছে অফিসে তো আর যায় নি। ও ও বাসায় নাস্তা করে নিলো। সেদিন সারাদিনই রেদোয়ান বাসায় থাকলো। এরপরের দিনও ও সে বাসায় থাকলো। রেদোয়ানকে বাসায় দেখে সবারই মনে যে খটকা লাগছে তা বেশ ভালো বুঝতে পেরেছি। কিন্তু কেউ মুখ খুলছে না।
তৃতীয় দিন যখন রেদোয়ান অফিস মিস করলো তখন আমার শাশুড়ি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, রেদোয়ান দেহি কয়দিন ধইরা অফিসে যায় না। কি হইছে? শরীর টরীর খারাপ নি?
দুদিন যাবৎ এ প্রশ্নের অপেক্ষাতেই আমি ছিলাম। আমি বিষন্ন ভাবে বললাম, না মা ওকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
আমার শাশুড়ি মনে হয় খুব বড় ঝাটকা খেলেন। জুলি আর শান্তিও সেখানে বসে ছিলো। আমার শাশুড়ি বললেন, বরখাস্ত করছে মানে? ওর চাকরি কি গেছে গা?
হ্যাঁ আম্মা।
শাশুড়ি বিচলিত হয়ে বললেন, কেমনে গেলো?
এটা ঠিক বলতে পারছি না আম্মা। ও বলে নি আম্মা।
আমার শাশুড়ি নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। জুলি এবার সুর বদলে বললো, আমি আগেই জানতাম এমন কিছু একটা হবে। বেশি বাড়াবাড়ি ভালো না। কতবার বলেছি আমাদের সাথে রাখো রাখলে না তো। এবার চলবে কিভাবে?
শান্তি বললো, কি বলছো মেজ ভাবি? শুকরিয়া করো আল্লাহর। আমরা না থেকে ভালোই করেছি। এই যে এখন চাকরি চলে গেছে সাথে থাকলে সেই আগের মতো আমাদেরই টানতে হতো। আমাদের উপর বসে বসে তখন খেতো। সাথে থাকি নি ভালো করেছি।
মেজ জা বললো, এই দিক থেকে তো ঠিকই করেছি। আগে তো দুজন ছিলো এখন আরো তিন জন হয়েছে। সবগুলোকেই টানতে হতো। যাক আল্লাহ বাঁচিয়েছে।
আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেলো। কি বলছে ওরা!! তাহলে এতো দিনে ওদের আচরণ গুলো কি ছিলো? ওরা নানান কথা বলতে শুরু করলো। আমি শুনে যাচ্ছি। ওদের কথা শুনে আমার মাথা ঘুরে যাওয়ার উপক্রম। আমার শাশুড়ি চুপ আছেন। ভাবলাম তিনি হয়তো এগুলো নিয়ে কোন কথা বলবেন না। তিনি তো এখন আমাকে ছাড়া কিছু বোঝেন না। কিন্তু
কিছুক্ষণ পর আমি আমার শাশুড়ির কাছ থেকে কিছু কল্পনাতীত কথা শুনলাম। আমি অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছালাম। আমার শাশুড়ি আগের রূপে ফিরে গিয়ে বললেন, এমন বউ ঘরে থাকলে তো চাকরি যাইবোই। আমার কথা কি জীবনে শোনে পোলায়? শোনে বউয়ের কথা। বউ যা কয় তাই করে। এই লেইগাই তো চাকরিটা খাইলো। এহন থাকবো কই আর কি করবো কই?
আমি ভীষণ অবাক হলাম। একদৃষ্টে মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে আছি। আমার শাশুড়ি আমাকে আরো কিছু কথা শুনিয়ে দিয়ে বললেন, এহন আমার কি হইবো?আমার ঔষধও তো শেষ হইছে। এহন আনমু কি দিয়া?
আমি পাথর হয়ে গেছি। কিছু না বলে আস্তে করে নিজের ঘরে চলে আসলাম। রেদোয়ান এখনো ঘুমাচ্ছে। আমি বারান্দায় চলে গেলাম। এই মানুষগুলোকে নিয়ে একটু ভাবতে লাগলাম।
কথায় আছে কয়লা ধুলেও ময়লা ছাড়ে না। কথাটা আজ আবার প্রমাণিত হলো। আমার অদ্ভুত ইচ্ছেটা আমায় আবার সবাইকে চিনিয়ে দিলো। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।
জগৎ বড়ই অদ্ভুত। সবই চলে টাকার খেলায়। স্বার্থপর এই জগতে কেউ কারো নয়। যার অর্থসম্পদ বেশি তার কদর এ জগতে বেশি। অর্থ নেই তো এ জগৎ তোমার নয়! সবই বদলে যায় দিন বদলের হাওয়ায়। এই তো আমার আশেপাশের মানুষগুলোর কথাই বলা যায়। কত সুন্দর করে বদলে যেতে পারে তারা। ভীষণ স্বার্থপর এই মানুষগুলো। স্বার্থপর এই মানুষগুলোর বিচার আমি হয়তো কখনোই করতে পারবো না। এদের বিচার ইহলোকে হয়তো কখনো হবে না। স্বার্থের খেলায় এ দুনিয়ায় মেতে থাকবে তারা। তবে বিধাতা তাদের বিচার পরলোকে তো করবে। সে মহান তার হাতেই সবকিছু। এদের কর্মফল এরা নিশ্চয়ই ভোগ করবে। দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
অতঃপর শাশুড়ির কাছে গিয়ে ওনার ঔষধের টাকাটা ওনার হাতে দিলাম। আমাকে টাকা দিতে দেখে শাশুড়ি বিস্মিত হলেন। জিজ্ঞেস করলেন, টাকা পাইলা কই?
মুচকি হেসে বললাম, আপনার ছেলের চাকরিটা যায় নি আম্মা। মানুষ চিনলাম আবার। নিন আপনার ঔষধের টাকাটা।
তিনি আমার কথায় হকচকিয়ে গেলেন। আমার দিকে হা করে তাকিয়ে রইলেন তিনি। তার হাতে টাকাটা দিয়ে শান্ত পায়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলাম আমি।
জীবন সুন্দর। মানুষ সুন্দর। মানুষ মানুষের জন্য। কিন্তু বদলে যায় দিন বদলের হাওয়ায়। এ পরিবর্তনশীলতা চলতে থাকে আপন গতিতে। একেক সময় একেক রূপ নিয়ে আসবে সামনে। যাকে মেনে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে ভুবনে। কিন্তু বিধাতার কাছে প্রার্থনা আমার মতো এমন দিন বদলের পাল্লায় যেন কেউ না পড়ে কারণ আপন মানুষগুলো থেকে পাওয়া যন্ত্রনা গুলো খুবই তিক্ত যা বিগত দিন গুলোতে অনুভব করেছি আমি। আজ আবারও করলাম। এ জগৎ সুন্দর মানুষ সুন্দর চলুক আপন গন্তব্যে সফল হোক সকলে।
আবার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। নিয়তি স্মরণে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। দক্ষিণা বাতাস বইছে আমার চারদিকে…
সমাপ্ত।