সেদিনও_ছিলে_তুমি❤,০৪,০৫

0
973

#সেদিনও_ছিলে_তুমি❤,০৪,০৫
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৪

১০.
—“তুমি কাল রাতে কি কান্ডটাই না করলে, আমাকে তো ছাড়তেই চাইছিলে না।”

আমি চোখ বড় বড় করে ওনার দিকে তাকালাম। ওনি ঠোঁটে হাসি এঁকে বললেন, ‘শুনতে চাচ্ছো নাকি ঘটনাটা? অবশ্য তুমি শুনতে চাইলে আমি মানা করবোনা!’

আমি বললাম, ‘না না। আপনাকে আর বলতে হবেনা।’

—“ওকে! না শুনতে চাইলে থাক, এসব কাউকে না বলাই ভালো।”

আমি ভাবছি কি এমন হয়েছে যে ওনি এমন করছেন? ওনার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে এরচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা দুনিয়াতে আর দ্বিতীয়টি নেই। যাইহোক, খারাপ কিছু না হলেই হলো। আমি বললাম, ‘আমার শাস্তি কি শেষ হয়েছে? নাকি আরও কিছু বাকি আছে?’

ওনি আমার দিকে তাকালেন। বললেন, ‘বাহ! শাস্তি পাওয়ার জন্য এতো উতলা? এমন হতে দেখিনি কাউকে।’

—“এখানে উতলা হওয়ার কি দেখলেন?আমি তো শুধু জিজ্ঞেস করেছি!”

ওনি অবাক হওয়ার ভান করে সন্দেহ নিয়ে আমার দিকে তাকালেন। বললেন, ‘তুমি কি আমার প্রেমেটেমে পড়ে গেছো নাকি মেয়ে? এমনভাবে কথা বলছো আমার তো তা-ই মনে হচ্ছে।’

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘মোটেও না। আপনার মতো কিডন্যাপারের প্রেমে হাবুডুবু খাওয়ার ইচ্ছা আমার নেই!’

ওনি রেগে বললেন, ‘আমি কিডন্যাপার?’

আমি ভয় পেলেও উত্তর দিলাম না। উল্টো দিকে ঘুরে আল্লাহ আল্লাহ করছি। ওনি আর কিছু বললেন না। কাকে যেন ফোন দিলেন, কিসব বলে রেখে দিলেন। একটু পরে একটা মহিলা নাস্তা নিয়ে আসলেন। ওনি মহিলাকে আমার দিকে ইশারা করলেন। আমি অবাক হয়ে তাকাতেই মহিলাটি ট্রে’টা আমার সামনে রেখে বললেন, ‘খেয়ে নিন মা!’

বলেই দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। আমি ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি হচ্ছে এগুলো?’

ওনি ভাবলেশহীনভাবে বললেন, ‘খেয়ে নাও। কাল থেকে তো কিছুই খাওনি!’

—“খাবোনা!”

—“খাবোনা মানে?”

—“খাবোনা মানে আমি খাবোনা।”

—“কেন খাবেনা?”

—“ক্ষিধে নেই, তাছাড়া অচেনা-অজানা মানুষের দেওয়া খাবার আমি খাইনা!”

—“কাল থেকে না খেয়ে আছো, বলছো ক্ষিধে পায়নি? এই তুমি কি পাগল? না খেয়ে এতোক্ষণ থাকছো কিভাবে?”

—“হোস্টেলে থাকি, কোনোবার তিন-চারদিনও না খেয়ে থাকতে হয়েছে। এখন এসব অভ্যাস হয়ে গিয়েছে!”

ওনি অবাক হয়ে বললেন, ‘ক্যান্টিন থাকতে না খেয়ে থাকো, মানে বুঝলাম না।’

আমি শুকনো গলায় বললাম, ‘আপনি এসব বাদ দিন। আমাকে এখান থেকে যেতে দিন প্লিজ! আমার অনেক কাজ আছে।’

ওনি গম্ভীর গলায় বললেন, ‘আগে খেয়ে নাও, তারপর যাওয়ার কথাটা ভেবে দেখবো।’

আমি খুশিতে বললাম, ‘তারমানে আমার শাস্তি শেষ?’

ওনি রেগে বললেন, ‘আমি কখন বললাম শাস্তি শেষ? শাস্তি তো দিইনি তোমাকে, জাস্ট ট্রেইলার দেখালাম। তোমার শাস্তিটা আমি ঠিক করবো, বুঝলে? সো বেশি কথা না বলে জলদি খাবার শেষ করো!’

আমার মনটা আবারও ‘কু’ ডাকা শুরু করলো।নিঃশব্দে খেতে লাগলাম। খাবারটা কেমন বিস্বাদ লাগছে, এটাকে নাকি সুপ বলে। আমি কখনো সুপ খাইনি, যার ফলে স্মেলটাও সহ্য হচ্ছেনা। তাও গিলতে লাগলাম।

১১.
আমার খাওয়া শেষ হতেই ওনি বললেন, ‘সো রেডি?’

—“কি রেডি?”

—“তুমি না হোস্টেলে ফির‍্তে চাও?”

—“ওহহ চলুন!”

ওনি হাসতে হাসতে বললেন, ‘আচ্ছা, শুনো! তুমি না আর জোকার সেজে ভার্সিটিতে এসোনা৷’

আমি মুচকি দিয়ে বললাম, ‘আপনাকে বলতে হবেনা।’

তারপর আমি ওইরুম থেকে ওনার পেছন পেছন বের হলাম। তারপর আমার চক্ষুচড়ক গাছ। কি সুন্দর সাজানো গোছানো একটা বাড়ি। চারদিক যেন আলোতে ঝলমল করছে। আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম। কারণ এতো সুন্দর বাসা এর আগে আমি আর কখনো দেখিনি। ওনি পেছনে ঘুরে আমাকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ধমকে বলে উঠলেন, ‘এই মেয়ে! হা করে তাকিয়ে আছো কেন?’

আমি থতমত খেয়ে বললাম, ‘না না কিছুনা।’

—“এখন কি আমার সাথে যাবেন মিস আরশি বেগম? নাকি এভাবে হা করে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অক্কা লাভ করিবেন?”

আমি তাড়াহুড়ো করে বললাম, ‘না না চলুন। আমি আসছি তো!”

ওনি রাগী গলায় বললেন, ‘জ্বি চলুন। আর আমাকে উদ্ধার করেন।’

—“এটা কি আপনার বাসা?”

—“আমার নয়তো কি অন্যকারো বাসা নাকি আজব!”

—“ওহহ!”

আমার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিলো ওনার বাসার সবাই কোথায়? কাউকেই তো দেখলাম না আশেপাশে। কেউ কি এই বাসায় থাকেনা? তাহলে ওনার বাবা মানে ভিসি স্যার বা উনার স্ত্রী-ই বা কোথায়?

এসব ভাবতে ভাবতে বাসার বাইরে চলে আসলাম।
ওনি বললেন, ‘উই উইল হ্যাভ টু হারি। লেট’স গো!’

আমি বললাম, ‘আপনার যেতে হবেনা স্যার। আমি একাই যেতে পারবো।’

উনি সন্দেহী চোখে তাকালেন। বললেন, ‘তাই নাকি?’

—“জ্বি!”

ওনি ঠোঁট উল্টে বললেন, ‘কিন্তু তা তো হচ্ছেনা! তোমাকে আমি নিয়ে এসেছি, আমিই ছেড়ে আসবো!’

আমি অস্বস্তি নিয়ে বললাম, ‘আপনার যাওয়ার দরকার নেই, আমিই পারবো স্যার!’

ওনি রেগে বললেন, ‘আমার মুখের ওপর কথা বলা আমি পছন্দ করিনা। চুপচাপ গাড়িতে ওঠে বসো।মাইন্ড ইট।’

—“কিন্তু….”

ওনি আবারও রেগে গেলেন। গাড়ির জানালার পাশে একটা ঘুসি দিয়ে বললেন, ‘ইউ ব্লাডি গার্ল, আই জাস্ট স্টপ ইট!’

আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘কোথায় বসবো স্যার?’

ওনি গম্ভীর গলায় বললেন, ‘ড্রাইভিং সিটের পাশে!’

ওনি দরজা খুলে দিলেন। আমি তাড়াহুড়ো করে বসলাম। বাবারে! কার পাল্লায় পড়লাম। সোজাসাপটা কথাটাকে ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে ক্যাঁচাল করে প্যাঁচাল মেরে দিলেন।

ওনি ড্রাইভিং সিটের বসলেন। আমি একেবারে জানালার পাশে সিঁটিয়ে বসলাম। ওনি ধমক দিয়ে বললেন, ‘এদিকে সরে বসো। সিটবেল্ট পড়ে নাও।’

আমি একটু সরে এদিকে বসলাম। কিন্তু সিটবেল্ট নামক জিনিসটাকে কিছুতেই আটকাতে পারলাম না। অসহায় চোখে ওনার দিকে তাকাতেই বললেন, ‘আমি দেখিয়ে দিচ্ছি!’

আমি বললাম, ‘না না। লাগবে না।’

ওনি চোয়াল শক্ত করে আমার দিকে তাকালেন। চোখে রোদচশমা পরে সোজা হয়ে পিঠ ঠেকিয়ে বসলেন। আমার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আমি মেয়েদের গায়ে হাত দিইনা, একবার আস্ক করেছি। আমি আমার নিজের বেল্ট লাগাচ্ছি, তুমি সেভাবে ট্রাই করো মেয়ে!’

আমি মাথা নাড়লাম। ওনার এই কথাটা আমার হঠাৎ পছন্দ হয়ে গেলো। যাইহোক, ওনাকে দেখে দেখে সিটবেল্ট পড়াটা শিখে নিলাম। তারপর ওনি
ড্রাইভ করতে শুরু করলেন। দুজনেই চুপচাপ।
প্রায় আধঘন্টা পর গাড়ি আমার হোস্টেলের সামনে এসে থামলো। আর আমি প্রায় সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির দরজা খুলে একদৌড়ে পগার পার। পেছনে ফিরেও তাকালাম না। আপদ থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই ভালো। একটা বিষাদময় ঘটনার আপাতত এখানেই ইতি ঘটলো।

১১.
হোস্টেলে পৌঁছে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম। একটা দারুণ শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে এলাম। চুল মুছতে মুছতে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। হঠাৎ দেখলাম, আমার গলার কাছে একটা দাগ, লাল টকটকে হয়ে আছে। ভালো করে খেয়াল করতেই দেখি এটা কামড়ের দাগ। সদ্য দেওয়া কামড়ের দাগ! আমি চমকে উঠলাম। গালের মধ্যেও একটা কামড়ের দাগ। আমি এবার হতভম্ব। কে করলো আমার সাথে এই কাজ? আদ্র? কাল তো উনিই ছিলেন সারাক্ষণ আমার সাথে, তাহলে কি উনিই? আমাকে কি এই ঘটনাই ওনি বলতে চেয়েছিলেন? নাহ, আমার এবার ভয় হচ্ছে। ওনি আমার সরলতার সুযোগ নিয়ে কি খারাপ কিছু করেছেন আমার সঙ্গে! তবে যে বড় মুখ করে ওনি বলেছেন, ‘ওনি মেয়েদের গায়ে হাত দেননা।’

ওনি কি আমাকে তবে মিথ্যে কথা বলেছিলেন? ওনি একটা মিথ্যাবাদী! আমি ভাবতে পারছিনা। আমার পায়ের তলার মাটি সরে গেলো। থাপ্পড়ের প্রতিশোধ এভাবে নিলেন! আমি ওনাকে যতই অপছন্দ করিনা কেন, এটুকু বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু সব ছেলের মতো ওনিও সুযোগের সদ্ব্যবহার করে আমার সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়ালেন। আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। কিন্তু আমার কান্না চারদেয়ালে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনি হয়ে আমার কাছেই ফিরে এলো। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের আসলেই হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করাটা অনেক রিস্কের, কে যেন আমাকে বলেছিলো! মনে পড়ছেনা।

?”নামায ফেরেশতাদের ভালোবাসা লাভের উপায়!”

~হযরত আলী (রাঃ)

চলবে….

#সেদিনও_ছিলে_তুমি❤
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৫

১২.
কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম। ভার্সিটিতে যাওয়ার কথা ছিলো, কিন্তু এসব দেখে আর কোথাও যাওয়ার জন্য সাহস বা শক্তিটা পেলাম না। হোস্টেলের সেই অগোছালো, গুমোট ঘরটাতে মরার মতো ঘুমিয়ে রইলাম। বিকেলের দিকে ঘুমটা ছুটে গেলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম কামড়ের দাগগুলো দগদগে ঘা’য়ের মতো লাল হয়ে গিয়েছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্টোভে ভাতের হাড়ি চড়ালাম। একটা ডিমের অমলেট তৈরি করে খেয়ে ক্ষিধে মেটালাম।

হোস্টেল বলতে এটা একটা বাসা। খুব ছোট্ট পুরানো দিনের দোতলা একটা বাসাতে আমি আর শেফা একটা রুমে থাকি। শেফার বাসা ভার্সিটি থেকে একটু দূরে হওয়ায় আমার সঙ্গে থাকে। আর দোতলায় বাসার মালিক মানে একটা বুড়ো মহিলা থাকে। আমরা ওনাকে দাদী ডাকি, ওনার ছেলেমেয়েরা সবাই বড় বড় চাকরি করে। সবাই এই বাসাতেই একসাথে থাকে, খুব ভালো একটা পরিবার। যাইহোক, একা একা রুমের ভেতর দমবন্ধ লাগছিলো। তাই মোবাইল নিয়ে একটু বসলাম। কখন যে রাত হয়ে গেলো বুঝতেই পারলাম না। এমন সময় শেফার ফোন এলো। আমি রিসিভ করতেই বলে উঠলো, ‘এই গাধী, কই তুই?’

—“বাসায়, কেন?”

—“আজ আসলি না কেন?”

—“কোথায়?”

—“ভার্সিটিতে। আমি তো বাসা থেকে এসেছিলাম, ভাবলাম তুইও আসবি। কিন্তু তুই তো এলিই না।”

—“ওহহ। আমার শরীরটা ভালো লাগছিলো না, তাই আসিনি। কেন? কোনোকিছু হয়েছে?”

—“হুম।”

—“কি?”

—“কাল বাসন্তী উৎসবের প্রোগ্রাম আছে ভার্সিটিতে। আর আমাদের ওই পলিটিশিয়ান বড় ভাই ওনি তোর খোঁজ করছিলো।”

আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, এই পলিটিশিয়ান লোকটা আবার কে, আমার ঠিক মনে পড়লো না। আমি শেফাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোন বড় ভাই?’

শেফা ক্ষুব্ধ স্বরে বললো, ‘তুই চিনস না গাধি!’

—“আরে তুই বলবি তো। কত ভাই-ই তো আছে, আমার যিনি খোঁজ করছিলো ওনি কে?”

—“আদ্র ভাই। আই মিন তোকে ওইদিন বিচার করতে যে ভাইয়ের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো।”

আমি চমকে উঠলাম। ‘এই লোক আমার খোঁজ কেন করবে? আমাকে আবার কোন নতুন শাস্তি দেওয়ায় পায়তারা করছে ওনি?’

শেফা বললো, ‘কিরে শুনছিস?’

—“বল।”

—“তুই আজ এতো চুপচাপ কেন? কথা বলতে কি ভাল্লাগছে না?”

—“এই তুই কাজের কথা বল। ওই লোক আমাকে খোঁজেছিলো কেন? কিছু বলছে তোকে?”

—“হুম। আসলে বাসন্তী উৎসবের সব দায়িত্ব তো ওনার উপরেই পড়েছে। তাই ওনি সব স্টুডেন্টদের কাজটাজ ভাগাভাগি করে দিয়েছেন। আর তোর কাজ হলো সবকিছুর হিসাব রাখা, ঠিকঠাক মতো ওনাকে পরে বুঝিয়ে দেওয়া। আমার কাছে সবার নামের লিস্ট দিয়ে দিয়েছেন। তুই কাল ওদের থেকে সব রসিদ জমা নিয়ে আদ্র ভাইকে হিসাব বুঝিয়ে দিবি। আমি ফোনে পাঠাচ্ছি ছবিগুলো।”

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘মানে? আমি এসব করবো কেন?’

—“আমি কি জানি? আদ্র ভাই বলে দিয়েছে।”

আমি বিরক্ত হয়ে ফোন রেখে দিতে যাবো আর তখনই শেফা বললো, ‘শোন!’

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘বল!’

—“কাল সবাই বাসন্তী শাড়ি পড়ে আসবে। তুইও পরে আসিস।”

—“কিন্তু আমার তো এই রঙের শাড়ি নেই!”

শেফা বললো, ‘কি বলিস!’

—“হুম।”

—“তাহলে কি পরবি?”

—“জানিনা। লাল, নীল যা আছে ইচ্ছে হলে পরবো নইলে যা ইচ্ছা তা-ই পরবো। রাখি।”

বলেই ফোন রেখে দিলাম। এই ন্যাকামুর মানে হয়? যার বাসন্তী শাড়ি নেই সে কি পরে যাবে তার চিন্তা করলো না কেউ। যত্তসব!

১৩.
আজ রাতেও ঘুমানোর পর আমি কারো হাতের ছোঁয়া পেলাম গালে। কপালে কারো ঠোঁটের ছোঁয়া। আমি বুঝতে পেরেও উঠলাম না। এক ভয়ংকর ভীতি আমাকে গ্রাস করলো। চোখ খোলার সাহসটাও করলাম না। তবে কিছুক্ষণ পর কারো অস্তিত্ব টের না পেয়ে আমি চোখ খুলে তাকালাম, কখনো ঘরের লাইট অফ করিনা। সেই আলোতে চোখ খুলে দেখলাম, ‘একটা প্যাকেট রাখা! রুমে কেউ নেই। আমি ঝট করে উঠে দাঁড়ালাম। প্যাকেট খুলে হাতে নিয়ে দেখি একটা হলদে শাড়ি।’

কেউ কি করে জানলো আমার ঠিক এই শাড়িটাই দরকার? যাইহোক, কালকের শাড়ির ব্যবস্থা হয়ে গেলো। হাসলাম আমি। পরদিন যথাসময়ে রেডি হয়ে রওনা দিলাম ভার্সিটিতে।

১৪.
ভার্সিটিতে ঢুকলাম শেফার সাথে। পরণে সেই হলুদ শাড়িটা। কিছুক্ষণ ঘুরাফেরা করে পানি খাবার উদ্দেশ্যে ক্যান্টিনের দিকে যেতেই হঠাৎ আদ্রে’র সাথে দেখা। ওনি আমার পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করতেই শাড়িতে পা বেঁধে উল্টে আমি আদ্রে’র উপর পড়ে গেলাম।

এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম, আদ্র’কে দেখে মনে হচ্ছে ওনি আমার চেয়ে দ্বিগুণ হতভম্ব! আমি অবাক এবং বাকরুদ্ধ! পুরো ভার্সিটির সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে রইলাম। আমার পিঠের যেখান থেকে শাড়িটা সরে গিয়েছিলো ঠিক সেখানেই অসভ্য আদ্র’ ওনার হাত দিয়ে আমাকে ধরে রেখেছেন। ইচ্ছে করছে ওনার চুলগুলো টেনে ছিঁড়ে দিই। নিজেকে সামলে নিয়ে আমি উঠে দাঁড়ালাম, সেদিনের অসভ্য ইতর ছেলেটা আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। আদ্র ছেলেটার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকাতেই ছেলেটি সে সরে গেলো। সবাই হাসাহাসি করছে, আদ্র’ ও উঠে দাঁড়ালো। ওনার হলদে-সোনালি পাঞ্জাবি ধুলোয় মাখামাখি। আমি আর সেখানে এক মুহূর্তও দাঁড়ালাম না। চোখ গোলগোল করে তাকিয়ে থাকা শেফাকে নিয়ে সেখান থেকে চলে আসতে চাইলে আদ্র’ আমাদের দাঁড়াতে বললেন। তারপর আশেপাশে থাকা সবাইকে ধমকে সেখান থেকে চলে যেতে বললেন, শেফাও ভয়ে ভয়ে চলে গেলো।
সবাই চলে গেলে ওনি আমার উদ্দেশ্যে বললেন,

-“আচ্ছা, তুমি কি মেয়ে? এতো উড়নচণ্ডী দশা কেন তোমার? সবসময় লাফালাফি, ঝাঁপাঝাঁপি না করলে তোমার শান্তি লাগেনা?”

আমি কাঠ কাঠ গলায় বললাম, ‘আমার মোটেও উড়নচণ্ডী দশা হয়নি। আর লাফালাফি, ঝাঁপাঝাঁপি করলে আপনার কি সমস্যা? আপনি আমার উপর পড়লেন কেন?’

-“বাহ! বেশ তো বেশ পটর পটর করছো, শাস্তির কথাটা এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে! ওয়াও।”

-“দেখুন,আপনি আমায় অপমান করার চেষ্টা করছেন! আর শাস্তির কথা আপনার মুখে মানায় না, যে লোক মেয়েদের অসম্মান করতে ভুলে না তার সাথে আমার কথা বলতে ঘেন্না হচ্ছে।”

আদ্র গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে অবাক হয়ে বললো, ‘মানে? তুমি এসব কি বলছো, সুযোগের সদ্ব্যবহার মানে?’

আমি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললাম, ‘এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন সবকিছু? বাহ! আসলে বড়লোকের ছেলে বলে কথা। এদের কি আর সব মনে থাকে!’

-“মানে?”

আমি বিরক্ত চাহনি মেলে ওনার মুখপানে তাকালাম। বললাম, ‘এতো মানে মানে করছেন কেন আপনি! আপনি সাথে কথা বলার কোনো মুড নেই আমার। আমার সাথে করা ঘটনাগুলো মনে করুন, বুঝে যাবেন!”

ওনি বললেন, ‘কি করেছি আমি? তুমি আমায় অপমান করেছো আমি তোমাকে একদিন আটকে রেখেছি, আটকে রেখেছি বললে ভুল হবে। তুমি সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলে তাই আমি তোমাকে আমার বাসায় নিয়ে গিয়েছি। দ্যাটস এনাফ।’

—“ওহহ তাই! তাহলে ভার্সিটিটা তো আপনার , আপনিই তাহলে থাকুন।”

ওনি ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘মানে?’

—“মানে আমি এখানে আর পড়বো না।”

—“পড়বেনা মানে?”

—“মানে আমি এখান থেকে চলে যাবো, এই ভার্সিটিতে আমি আর পড়বোনা। আপনি শান্তিতে থাকুন! আমার চেহারাও আপনার দেখতে হবে না!”

আদ্র’ কিছু না বলে গম্ভীর হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। সত্যিই আমি আর ওনাকে নিতে পারছিনা। বড্ড অসহ্য লাগছে। এখান থেকে আমি চলে যাবো, ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে অন্য কোনো কলেজে ভর্তি হবো। এ শহরেই আর থাকবোনা আমি।

১৫.
আমি আড়চোখে একবার আদ্র’কে দেখে নিলাম। বাই বলে চলে আসলাম। পেছনে ফিরে দেখলাম, ওনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি সেখান থেকে চলে আসলাম। স্টেজে নাচগান হচ্ছে, আমি শেফাকে অনেক খুঁজে একটা চেয়ারে বসারত অবস্থায় দেখতে পেলাম। দৌড়ে গিয়ে ওর পাশে বসে পড়লাম। ও বড়বড় চোখ করে আমার দিকে তাকাতেই আমি বললাম, ‘এদিকে না তাকিয়ে পারফরম্যান্স দেখ। একটা কথাও বলবিনা!’

বেচারি শেফা আমার কথামতোই চুপচাপ স্টেজে মনোযোগ দিলো! আর আমার মাথায় ঘুরছে ওখানে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা আদ্রে’র বিষন্ন চেহারা। ওফফ..এই লোকটার সামনেই কেন বারবার তার সাথে এমন ঘটছে?বারবার আমার সাথেই ওনার দেখা হয়। শেফাকে পর্যন্ত বলিনি আমি এখানে আর পড়বোনা! ইশ,কি বাজে পরিস্থিতি!

অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। ভার্সিটির মাঠ প্রায় খালি, সবাই চলে গিয়েছে। আমি সব হিসাব ঠিকঠাক করে একটা ছেলেকে দিয়ে আদ্রে’র কাছে পাঠিয়ে দিলাম। তারপর শেফাকে নিয়ে চলে আসলাম। শেফা বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। আর আমি ভার্সিটি গেইটের সামনে রিকশার জন্য ওয়েট করছি। হেঁটে যেতে মোটেও ভালো লাগছেনা। হঠাৎ আদ্র’ এসে আমার হাত ধরে টেনে ভার্সিটির ভেতর নিয়ে গেলো। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই ওনি শক্ত গলায় বললেন,

-“কি? পগার পার হওয়ার মতলব করছো নাকি?”

আমি চেঁচিয়ে বললাম, ‘আমাকে যে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে এমন তো নয়, আমি সব কাজ শেষ করে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমার আর এখানে থাকার কোনো মানে হয়না!’

ওনি রেগে বললেন, ‘চুপ। একদম চুপ।’

তারপর কি একটা ভেবে বললো, ‘ চলো তোমাকে রিকশা করে দিই।”

আমি কঠিন গলায় বলে উঠলাম, ‘লাগবে না। আমি একাই বাড়ি ফিরবো।”

-“তুমি কি আমার উপর রাগ করেছো নাকি?”

-“আজব!আমি রাগ করবো না কি করবো না সেটার কৈফিয়ত আপনাকে কেন দেব? প্লিজ আপনি অন্যপথ ধরুন, আমার পিছু ছাড়ুন। গেট এনাদার ওয়ে!”

ওনি রেগে গেলেন। প্রচন্ড জোর গলায় নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে বললেন, ‘তুমি কিন্তু আবারও বাজে বিহেভ করছো মেয়ে!’

-“আপনার আজাইরা প্যাঁচাল বন্ধ হলে যান এখান থেকে।”

ওনি রেগে আমাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলেন।
আমার কপালে চুমু দিয়ে বসলেন। আমি কি রিয়েকশন করবো বুঝলাম না। ওনাকে একটা ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলাম। এ সময় দরজায় এসে দাঁড়ালো ভিসি স্যার, আমি অবাক হয়ে গেলাম!

?”মুমিন বান্দার ওপর যে কষ্ট-ক্লেশ, রোগ-ব্যাধি, দুশ্চিন্তা ও পেরেশানি আসে, এমনকি যে কাঁটা তার দেহে ফোটে, এসবের মাধ্যমে আল্লাহ তার গুনাহ গুলো ক্ষমা করে দেন।”

~ [বুখারি, হাদিস নং- ৫৬৪১]

চলবে…..ইনশাআল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here