এক_খণ্ড_কালো_মেঘ #পর্ব_৪৭

0
351

#এক_খণ্ড_কালো_মেঘ
#পর্ব_৪৭
#নিশাত_জাহান_নিশি

“কী মিস ইতি? চুপ করে আছেন কেন হ্যাঁ? আপনার মাকে বলুন আজ আপনি ঠিক কী কী করেছেন আমার সাথে। কেন অয়ন্তী ক্ষুব্ধ হয়ে এসে আপনার গাঁয়ে হাত তুলতে বাধ্য হয়েছে। কেন সে আপনার নামে কুমন্তব্য করছে বলুন সব। সত্যিটা বলুন ওকে? আদারওয়াইজ আমি বাধ্য হব আপনার মায়ের হাতটা ভে’ঙে গুড়িয়ে দিতে!”

হকচকিয়ে উঠল ইতি। ব্যথা এবং কান্না ভুলে সে গাল থেকে হাত সরিয়ে ভয়ার্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল জিদ্দি রাফায়াতের দিকে। খেলা জমার আগেই হঠাৎ মাঝপথে এসে খেলা এভাবে ঘুরে যাবে তা ঘুনাক্ষরেও ভাবতে পারেনি সে! পেছন থেকে আকস্মিক অয়ন্তীর বাবা তেড়ে এলেন রাফায়াতের দিকে। রাফায়াতের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি দাঁতে দাঁত চেপে হু’ম’কি’স্বরূপ গলায় বললেন,,

“উনার হাতটা ছাড়ো বলছি রাফায়াত। আমার মানসম্মান নিয়ে আর ছেলে খেলা করো না প্লিজ। এলাকার লোকজন সবাই জড় হয়ে যাচ্ছে। দুর্নাম হওয়ার আগেই উনার হাতটা ছাড়ো কুইকলি। অন্তত আমার মেয়ের দিকটা একবার চিন্তা করো। সবাই তার মুখে থুঃথুঃ দিবে! একটা মা’স্তা’ন ছেলে কী-না তার হাসবেন্ড হবে? তাছাড়া এই মহিলার হাসবেন্ড উকিল। ডি’রে’ক্ট মামলা ঠুকে দিবে!”

মেজাজ হারিয়ে ফেলল রাফায়াত। না চাইতেও অয়ন্তীর বাবার দিকে সে গরম দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। নিয়ন্ত্রাণাধীন হয়ে নম্রতা, ভদ্রতা জলাঞ্জলি দিয়ে গরল গলায় বলল,,

“ধ্যাত! রাখুন আপনার উকিল, আদালত আর মা’ম’লা। এসব আমি পকেটে নিয়ে ঘুরি! আজ উনার মেয়ে আমার যে সর্বনাশটা করেছে না? সেই সর্বনাশটার জন্য আজ আমাকে আবারও পুরোনো পথে হাঁটতে হয়েছে! আপনার মেয়েকে কাঁদাতে হয়েছে! কষ্ট দিয়েছি আজ আমি তাকে। অথচ আমি তাকে কথা দিয়েছিলাম আর কখনও তার চোখের জলের কারণ আমি হবনা আমি! রাখতে পারিনি আমি আমার সেই কথা। গিলটি ফিল হচ্ছে আমার। ঐ অ’সভ্য নি’র্ল’জ্জ মেয়েটি আজ যে অপকর্ম করেছে তার জন্য তো তার মা-বাবাকে রিপেন্ড করতেই হবে। আর কিছু না হোক, আমি চাই আজ তার একটা বিহিত হোক। সত্যিটা সামনে আসুক। এভাবে প্রতিদিন অশান্তি হওয়ার চেয়ে একদিনেই অশান্তি মিটে যাওয়া ভালো। ইভেন এই মেয়েটির জন্য আপনিও আমাকে ছোটো বড়ো কথা কম শোনান নি!”

চেপে গেলেন অয়ন্তীর বাবা। মুখে কোনো প্রতিবাদ না করলে ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসতে লাগলেন! অয়ন্তীর দিকে তিনি তেজী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। বুঝাতে চাইলেন মেয়ের জন্য উনাকে আজ এত অপমান সহ্য করতে হচ্ছে। এলাকায় দুর্নাম হচ্ছে। অয়ন্তী তার বাবার থেকে অপারগ দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। ইতির দিকে বিক্ষোভ ভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। চোয়াল উঁচিয়ে ধমকের স্বরে বলল,,

“বলো ইতি আপু৷ রাদিফ যা জিজ্ঞেস করছে তার ঠিকঠাক উত্তর দাও। তুমি রাদিফকে না চিনলেও আমি কিন্তু বেশ ভালোভাবেই চিনি রাদিফকে। কতটা ডে’ঞ্জা’রা’স সে! একবার রেগে গেলে কিন্তু সে তার বা’পের বাপকেও ছাড়েনা! সো সময় থাকতে সত্যিটা স্বীকার করো। নয়ত তোমার মায়ের হাতটা সত্যিই যাবে!”

ইতির মা রাগে কেবল ফোঁস ফোঁস করছেন। অগ্নিঝরা দৃষ্টিতে তিনি কিছুক্ষণ রাফায়াতের দিকে তাকাচ্ছেন তো কিছুক্ষণ অয়ন্তীর বাবা এবং অয়ন্তীর দিকে তাকাচ্ছেন। শেষ অবধি তিনি নিজের অহংকার এবং ক্ষোভের সাথে পাল্লা দিতে না পেরে তটস্থ গলায় ইতিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,

“দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী দেখছিস ইতি? যা তোর বাবাকে ফোন দে। এক্ষণি আসতে বল তাকে।”

এলাকার লোকজন জড়ো হয়ে তামাশা দেখছে! মাঝে মাঝে ফুসুর ফুসুর করে কীসব যেন বলছে। কিছুদল ইতিদের বিরুদ্ধে বলছে তো কিছুদল অয়ন্তীর পক্ষে বিপক্ষে বলছে। তাদের আলোচনা এবং সমালোচনার যেন অন্ত নেই। দু’পক্ষের ঝ’গ’ড়াঝা’টিতে বেশ মজাই নিচ্ছে তারা! পরের দিন হয়ত পাড়ায় পাড়ায় ব্রেকিং নিউজ হিসেবে রটবে আজকের এই ঝগড়া! পরিস্থিতি ক্রমশ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে তবুও কেউ ঘটনাচক্রে এসে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করছেনা! ইতি তার মায়ের অভয় পেয়ে দৌঁড়ে যেইনা বাড়ির ড্রয়িং রুমে ঢুকতে যাবে অমনি অয়ন্তী পেছন থেকে এসে ইতির হাত দুটো চেপে ধরল! দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,,

“সত্যিটা স্বীকার করো ইতি আপু। সত্যিটা বললে কেউ তোমাকে জে’ল, ফাঁ’সি দিবেনা। বরং মিথ্যে বলে তুমি পরিস্থিতি বিগড়ে দিচ্ছ।”

“কী সত্যি বলব আমি হ্যাঁ? তোর উডবি সব মনগড়া কথা বলছে!”

তীব্র প্রতিবাদ জানালো রাফায়াত। প্রত্যত্তুরে আগ্রাসী গলায় বলল,,

“স্বীকার করবেন না তাইতো? ওকে। কোনো সমস্যা নেই। আপনার ফ্রেন্ডকে আমি কল করছি! যে ঐসময় ঘটনাচক্রে উপস্থিত ছিল!”

অমনি ঘাবড়ে গেল ইতি! এমনিতেই তার ফ্রেন্ড বিগড়ে আছে তার প্রতি। এখন যদি আবার রাফায়াতের ইন্ধন পায় তো সব সত্যি সে গড়গড় করে বলে দিবে। ব্যাপারটা নিয়ে আরও বেশী জল ঘোলা হবে। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কেউটে বের হয়ে আসবে! হীতে বিপরীত হয়ে যাবে৷ এলাকার সবার সামনে ই’জ্জ’ত’হা’নি হবে তার! এরচেয়ে বরং বিষয়টা নিজেদের মধ্যে সলভ করা যাক। রাফায়াত এবং অয়ন্তীকে ঘরে ডেকে এনে আপোষে বিষয়টা মিটিয়ে নেওয়া যাক! সুবুদ্ধির উদয় হতেই ইতি জোরপূর্বক হাসল। অয়ন্তীর কানে ফিসফিসিয়ে বলল,,

“অয়ন্তী প্লিজ ঘরে চল। রাফায়াতকে বল বিষয়টা আমরা নিজেদের মধ্যে মিটমাট করে ফেলি। লোকজন হাসিয়ে লাভ নেই। বরং এতে যেমন তোদের দুর্নাম হবে। তেমনি আমাদেরও!”

অয়ন্তীর মনে হলো ইতি আসলেই মন্দ কিছু বলেনি! তার বাবার দিকটা চিন্তা করে হলেও ব্যাপারটা আপোষে মিটিয়ে নেওয়া যাক। নয়ত তিনি রাফায়াত এবং তার উপর প্রচণ্ড ক্ষিপ্র হয়ে উঠবেন। অনেক পরে হলেও ইতির সুবুদ্ধি হয়েছে এই বা কম কীসে? রাফায়াতকে থামিয়ে অয়ন্তী তার বাবা এবং ইতির মা’কে নিয়ে ইতিদের বাড়িতে প্রবেশ করল। ইতি নির্দ্বিধায় তার দোষ স্বীকার করল সবার কাছে! লজ্জায় ইতির মায়ের মাথা নত হয়ে গেল। মেয়ের কুকীর্তির জন্য অনুশোচনা হতে লাগল। খারাপ ব্যবহারের জন্য তিনি অয়ন্তী এবং রাফায়াতের কাছে ক্ষমা চাইলেন! সেই সাথে তাদের আশ্বস্তও করলেন ইতি আর কখনও রাফায়াতকে বিরক্ত করবেনা। এমনকি অয়ন্তী এবং রাফায়াতের মাঝখানেও আসবেনা। উনার কথায় আশাবাদী হয়ে রাফায়াত এবং অয়ন্তী তাদের বাসা থেকে বের হয়ে এলো। অয়ন্তীর বাবা যদিও ভেতরে ভেতরে অনুতাপে ভুগছেন তবুও তিনি মুখ ফুটে একটি বারের জন্যেও রাফায়াতের সাথে আন্তরিকভাবে কথাও বললেন না!

অয়ন্তীর বাবা বড়ো বড়ো পা ফেলে উনার বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়লেন। রাগ যেন কোনোভাবেই কমছেনা উনার! শেষের দিকে সব মিটমাট হলেও শুরুর দিকে তো এলাকার লোকজনদের সামনে উনার মানসম্মান হানি হয়েছে! না জানি আগামীকাল পাড়ায় কী কী রটে! সুযোগ বুঝে রাফায়াত হঠাৎ পেছন থেকে অয়ন্তীর হাতটা টেনে ধরল! চমকে ওঠে অয়ন্তী পিছু ফিরে তাকাতেই রাফায়াত স্মিত হাসল। অয়ন্তীর দিকে প্রফুল্লিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। মুহূর্তেই শক্ত করে অয়ন্তীকে জড়িয়ে ধরে সে অয়ন্তীর কপালে আদুরে চু’মু খেয়ে বলল,,

“থ্যাংকস পরাণ। আমাকে এতটা বিশ্বাস করার জন্য!”

অভিমানে মুখ লুকিয়ে নিলো অয়ন্তী। চোখ বুজে ভরাট গলায় বলল,,

“এত আহ্লাদ দেখানোর প্রয়োজন নেই! আপনি আবারও রুড হয়ে উঠছেন রাদিফ। সাংঘাতিক বাজে ব্যবহার করেছেন আজ। ভীষণ কষ্ট পেয়েছি আমি।”

“বাধ্য হয়েছিলাম। তাছাড়া মেজাজ খারাপ ছিল আমার। ইউ নো দেট মেজাজ খারাপ থাকলে আমার হিতাহিতজ্ঞান থাকেনা। কার সাথে কী ব্যবহার করে ফেলি মাথায় থাকেনা।”

“তাই বলে আমাকে বাসা থেকে বের হয়ে যেতে বলবেন?”

“গাঁয়ে হাত তুলতে চাইনি তাই!”

“ওহ্ আচ্ছা। তার মানে বিয়ের পর ঝগড়া হলেই গাঁয়ে হাত তুলবেন?”

“এখন থেকেই বলতে পারছিনা। তবে মাথার সেন্টিমিটার গরম হয়ে গেলে তুলতেও পারি!”

“বি’য়া’দ্দ’প!”

বলেই বিদঘুটেভাবে নাক-মুখ কুঁচকে অয়ন্তী রাফায়াতের কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য জোরাজুরি করতে লাগল। এমন মনে হচ্ছিল যেন শক্তিশালী রাফায়াতের সাথে সে খুব সহজেই পেরে উঠতে পারবে! অয়ন্তীর দুঃসাহসিকতা দেখে রাফায়াত দাঁত কেলিয়ে হাসল। অয়ন্তীকে ঘুরিয়ে পাঁজাকোলে তুলে নিলো! মোহমায়ায় আবিষ্ট হয়ে আবেদনময় দু’চোখে অয়ন্তীর রাগী মুখশ্রীতে তাকালো। অয়ন্তীর নাকে নাক ঘঁষে বলল,,

“মজা করেছি। অতিরিক্ত রে’গে গেলে প্রয়োজনে নিজের ক্ষতি করব। তবুও আমার পরাণের গাঁয়ে হাত তুলবনা!”

স্থির হয়ে এলো অয়ন্তী। রাগ যেন ক্রমেই দমে এলো তার। টুপ করে রাফায়াতের কপালে চু’মু খেয়ে সে আহ্লাদি গলায় বলল,,

“কাঁধে উঠব আপনার! আজ পুরো এলাকা আজ আপনি আমাকে কাঁধে তুলে ঘুরাবেন! যা যা খেতে চাইব সব খাওয়াবেন।”

“এলাকা তোমার। যদি কোনো কমপ্লেন আসে তো?”

“পরোয়া করিনা।”

অয়ন্তীকে সত্যি সত্যি পিঠে তুলে নিলো রাফায়াত! খুশিতে আত্মহারা হয়ে অয়ন্তী রাফায়াতের দু’কাঁধে হাত ঝুলিয়ে দিলো। দ্বিধাময় গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কষ্ট হচ্ছে?”

অয়ন্তীকে রাগানোর জন্য রাফায়াত মিথ্যা নাটকের আশ্রয় নিলো! মুখ চেপে হেসে বলল,,

“মটু হয়ে যাচ্ছ দিন দিন!”

“কী বললেন?”

“এত ভারী কেন হ্যাঁ?”

“নামছিনা কিছুতেই!”

“ম’রে যাবো তো!”

“কবরে শুইয়ে দিয়ে আসব!”

“তবুও কাঁধ থেকে নামবেনা?”

“না!”

“যদি সত্যি সত্যিই ম’রে যাই তো?”

“এই ভারে কেউ ম’রে’না!

“তবুও। যদি ম’রে যাই তো?”

“ডোন্ট ওরি। কবরেও আমাকে পাশে পাবেন!”

“মুক্তি নেই আমার তাই তো?”

“এত সহজে না।”

“ইশশশশ!”

“বিরক্ত?”

“না। আশ্চর্যিত!”

“এবার চলুন। ফার্স্টে আইসক্রীম খাব।”

“তারপর?”

“সামনে যা পাই তাই।”

রাস্তায় নেমে এলো রাফায়াত। এই মুহূর্তে নিজেকে তার ফিল্মের হিরোদের চেয়ে কোনো অংশে কম মনে হচ্ছেনা! মন মেজাজ যেন ধীরে ধীরে চাঙা হয়ে উঠছে তার। ভেতরে বড্ড সুখ সুখ অনুভূত হচ্ছে। রাস্তার ফুটপাত ধরে সোজা হাঁটা ধরল রাফায়াত। কাঁধের উপর ওঠে ছোটো বাচ্চাদের মত কেবল এদিক ওদিক হেলছে দুলছে অয়ন্তী! বেশ আনন্দ পাচ্ছে সে। খুশিতে আত্মহারা প্রায়। রাফায়াত এভাবে তার ইচ্ছে পূরণ করে দিবে স্বপ্নেও যেন ভাবেনি সে! এদিকে রাস্তায় থাকা মানুষজন হা করে তাকিয়ে আছে অয়ন্তী এবং রাফায়াতের দিকে! রাতে সূর্য দেখার মত যেন চমকে উঠেছে তারা! ডানে বায়ে কোনো দিকে তাকানোর সময় নেই অয়ন্তী এবং রাফায়াতের। তারা তাদের নিজস্ব জগৎ নিয়ে ব্যস্ত। দুজনই খুশি খুশি মনে তাদের গন্তব্য পথে হেঁটে চলছে।

এই রাতে অয়ন্তী যা যা খেতে চাইল, যা যা করতে চাইল তার সব ইচ্ছে পূরণ করে দিলো রাফায়াত! ব্রীজের উপর ওঠে চাঁদ দেখা থেকে শুরু করে আইসক্রীম খাওয়া, ভাগ্যক্রমে মাহফিলের এরিয়া থেকে ফুচকা খাওয়া, ভেলপুরি খাওয়া, চাপ, গ্রিল, চিপস, চকলেট, বার্গার এমনকি অয়ন্তীর যত ধরনের পছন্দের খাবার আছে সব খাওয়ালো! আজকের রাতটা হয়ে উঠল অয়ন্তীর ইচ্ছা পূরণের রাত!

#চলবে….?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here