বোবা_প্রেম পর্ব-২

0
870

বোবা_প্রেম
পর্ব-২
লেখক : Riyad Ahmod Bhuiya

তানহার মা এবার তানহাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-তানু মা, যাও তোমার স্যারের জন্য চা বানিয়ে নিয়ে এসো।

আমি অবাক হয়ে গেলাম তানহা ওর মায়ের কথা শুনতে পাচ্ছে বলে। কারণ, জন্মগতভাবে যারা বোবা হয় তারা বধিরও হয়ে থাকে। তবে বিষয়টি এমন নয় যে, বোবা হওয়ার কারণে তারা কানে শুনতে পায়না। বরং বিষয়টি হলো, বধির হওয়ার কারণেই মূলত মানুষ বোবা হয়। কিভাবে? কোন শিশু যখন বধির হয়ে জন্ম নেয় তখন সে চারপাশের কারোর কোন কথা শুনতে পায়না ফলে, কথা না শুনে সে কথা শিখতেও পারেনা। তবে চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির ফলে এর একটি সমাধান রয়েছে যা হয়ত তানহার ক্ষেত্রেও করা হয়েছে। কিন্ত প্রশ্ন হলো, সেটি করে থাকলে ও কথা বলতে পারছেনা কেন?

আমি ভাবতে লাগলাম, এখন যদি আমি উনাকে তানহার ‘বায়োনিক কান’ ইউজ করার বিষয়ে জিজ্ঞেস করি পরে যদি উনি আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করে বসেন যে, ‘তুমি ওর শিক্ষক অথচ এটা জানোনা?’ তাহলে তো ঝামেলায় পড়ে যাব। কিন্ত নাহ, বিষয়টি আমাকে জানতেই হবে। আর তাই আমি আর চুপ করে না থেকে তানহার মাকে বললাম,

-আচ্ছা আন্টি, একথা কথা ছিল।

উনি বললেন,

-হ্যা বাবা, বলো!

আমি বললাম,
-তানহা কি বায়নিক কান ইউজ করে? মানে, ওর কি চিকিৎসা করেছিলেন? যে কারণে বোবা হয়েও ও কথা শুনতে পায়!

উনি বললেন,

-হ্যা বাবা, ও বায়োনিক কান ইউজ করে এবং সেটা ওর বয়স যখন দশ বছর তখন থেকে।

আমি বললাম,

-তাহলে ও কথা বলতে পারেনা কেন?

উনি বললেন,

-আসলে বাবা, আমরা যখন ওর চিকিৎসাটি করি তখন সেটা বড্ড দেরি হয়ে যায়। কারণ, ‘আট বছরের বেশি বয়সী শিশুদের বেলায় কথা বলার জন্য এটি তেমনটা কার্যকর নয়। কেননা আট বছরের মধ্যে কথা বা যে কোন শব্দ উচ্চারণ করতে না পারলে শিশুদের ক্যারিংস বা স্বরযন্ত্র ধীরে ধীরে দৃঢ় হয়ে যায়।’ ফলে, তখন এই বায়োনিক কান দিয়ে শুনতে পাওয়া গেলেও কথা বলতে পারা যায়না। আমরা ওর চিকিৎসাটি করতে দেরিই করে ফেলেছিলাম।

উনার মুখে কথাগুলো শোনার পর আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম,

-সত্যিই, বিষয়টা কত অদ্ভুত!

পাঠকদের সংশয় দূর করতে বিষয়টির খোলাসা করা দরকার বলে আমি মনে করি।

আসুন, বিষয়টি আরো খোলাসা করে বলি, “বোবারা কানে শোনে না বলেই কথা বলতে পারে না। আর তাদের কানে শোনার ব্যাপারটি সারছে ইলেকট্রনিক্স কান। যার বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে বায়োনিক কান। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের ভাষায় বলে ‘ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট’। এটি এমন এক ধরনের প্রযুক্তি, যার মাধ্যমে সরাসরি অন্তঃকর্ণের ককলিয়ার নার্ভে শব্দ সংকেত পাঠিয়ে অতি গুরুতর শ্রবণ প্রতিবন্ধীরাও বিশেষত হিয়ারিং এইড যাদের কোন কাজেই আসে না তাদের সফলভাবে শব্দ যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। জন্মগত ত্রুটি, রোগ অথবা দূর্ঘটনাজনিত কারণে স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্থ, বহিঃকর্ণ এবং মধ্যকর্ণ সম্পন্ন শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা কানের বাইরে দিয়েই এ যন্ত্রের মাধ্যমে শ্রবণক্ষম হতে পারে। এ যন্ত্রের সাহায্যে ইয়ার ক্যানাল ছাড়াই শব্দ সংকেত মস্তিষ্কে পৌঁছে এবং শ্রবণ অনুভূতির সৃষ্টি করে। ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্টে প্রধানত দু’টো অংশ রয়েছে। একটি অংশ শরীরের ভিতর থাকে, আরেকটি থাকে বাইরে। বাইরের অংশে আবার তিনটি যন্ত্রাংশ কাজ করে। মাইক্রোফোন স্পিচ প্রসেসর এবং ট্রান্সমিটার। মাইক্রোফোন এবং ট্রান্সমিটারকে একত্রে হেডমেট বলা হয়। স্পিস প্রসেসরকে একটি ফিতা বা স্ট্র্যাপের সাহায্যে পিঠে ঝুলিয়ে রাখা হয়। আর শরীরের ভিতর থাকে দু’টি যন্ত্রাংশ। যাকে বলে ডিকোডার এবং ইলেকট্রোড।”

বসে আছি এমন সময় তানহা চা নিয়ে এলো। চা নিলাম আমি। ও গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো খাটের ওপাশে ওর মায়ের মাথার দিকটায়। এমন সময় আন্টি জানতে চাইলেন,

-তা, তোমরা কয় ভাইবোন?

আমি বললাম,

-আমি একাই।

উনি তাঁর ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,

-আর কোন ভাইবোন নেই?

আমি বললাম,

-না।

উনি বললেন,

-তা মা-বাবা আছেন নিশ্চয়?

আমি বললাম,

-না, বাবা মাও নেই। একটা এক্সিডেন্টে মারা গেছেন উনারা।

আমার কথাটি শুনে উনার চেহারার রং পাল্টে গেল। উনি বললেন,

-সরি বাবা। আচ্ছা, তা বিয়েশাদি করেছ?

আমি চুপ করে রইলাম। উনি বললেন,

-লজ্জা কিসের! বিয়েশাদি করে থাকলে বলো! আর না করে থাকলে তো আমাদেরই তোমার বউ খুঁজে বের করতে হবে তাইনা!

উনার কথার কোন অর্থ বোধগম্য হলোনা আমার। এত তাড়াতাড়ি তিনি আমাকে কি করে এতটা আপন করে নিতে পারেন! তবুও আমি বলে ফেললাম,

-নাহ আন্টি, এখনি বিয়ে করার কোন চিন্তা নেই। সবেমাত্র পড়াশোনা করছি। চাকরী হোক তারপর এসব নিয়ে ভাববো।

এবার উনি বললেন,
-তুমি না শিক্ষকতা করো? এটা কি চাকরী নয়?

আমি বললাম,
-এটি আমি পার্টটাইম হিসেবে করি। পার্মানেন্ট জব নয় এটি।

উনি আমার কথা শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন,

-আমার বোনের একটা মেয়ে আছে। আগামীতে এইচএসসি দিবে। দেখতে শুনতে মাশাআল্লাহ্ ভালো। ওরা ভাবছিল ভালো ছেলে পাওয়া গেলে বিয়ে দিয়ে দিবে। আর তোমাকেও আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। তাই বলেছিলাম আরকি। কিছু মনে করোনা বাবা। নিজের মনে করে বলেছি।

আমি একগাল হেসে দিয়ে বললাম,

-নাহ আন্টি, কি যে বলেন। মনে করার কি আছে!

উনার সাথে কথা বলে মনে হলো উনি এডুকেডেড। বেশ সুন্দর আর গুছিয়ে কথা বলতে পারেন। এবার আমি বললাম,

-আন্টি, এখন আমাকে যেতে হবে। হাতে কাজ আছে কিছু।

উনি বললেন,

-কিছুক্ষণ বসো, লাঞ্চের টাইম তো হয়েই যাচ্ছে, লাঞ্চটা করে যাও!

আমি বললাম,
-নাহ আন্টি, আরেকদিন এসে পেট ভরে খেয়ে যাব। আজ আসি।

উনি আর জোড় করলেননা। হাসিমুখে আমাকে বিদায় দিলেন।

বেরিয়ে আসবো এমন সময় কেন যেন মনে হলো পেঁছন থেকে তানহা ডাকছে আমায়। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। হ্যা, ফিরে দেখি তানহা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোঁখমুখই বলে দিচ্ছিলো যে, ও আমাকে কিছু বলতে চাইছে! আমি ফিরে গেলাম ওর কাছে। বাইরে থেকে গ্রীলে হাত রেখে বললাম,

-আমার মনের মধ্যে তোমাকে নিয়ে অনেকগুলো প্রশ্ন তাড়া করে বেড়াচ্ছে। যেগুলোর উত্তর জানা আমার খুবই জরুরী। আমার মন বলছে সেটা এতক্ষণে তুমিও বুঝতে পেরে গেছ। কবে আমার মনের সকল সংশয় দূর করে দিবে তুমি?

ওর চোঁখদুটো টলমল করছে। কিন্ত কিসের জন্যে? মেয়েরা তো এত সহজে কাঁদেনা! আমি ওর কি হই যে আমার জন্যে ওর চোঁখের তীরে জলেরা এসে এভাবে আছড়ে পড়ছে! আমার ধারণাই কি ভুল? ও কি আসলেই আমাকে কোনভাবে ভালোবেসে ফেলেছে? নাকি এরও পেছনে আরো কোন রহস্য বিদ্যমান?

আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ও। এমন চোঁখ এর আগে কখনো দেখিনি আমি। কি আছে এই চোঁখ দুটোতে? মনে হলো, নিজেকে নিজে হারিয়ে ফেললাম কোথাও। এমন সময় তানহা চলে গেল আমার সামনে থেকে। ইশারায় বলে গেল, ‘একটু দাঁড়ান, আমি আসছি।’

প্রায় দশ মিনিট পর ও আসলো। হাতে একটি কাগজ। আমার দিকে কাগজটি বাড়িয়ে দিলো ও। কাগজটি নিলাম আমি। উপরের ভাজে লিখা, ‘এখন চলে যান। আমি এতে কিছু লিখে দিয়েছি।’

আমি চলে আসার জন্য হাটা শুরু করলাম। মনে হচ্ছিল কোন অদৃশ্য শক্তি আমাকে পেছন থেকে টেনে ধরছে। আমি হাটতে পারছিলামনা। কিছুদূর এসে ফিরে তাকালাম ওর দিকে। ওড়না দিয়ে ও চোঁখ মুছছে। আর দাঁড়ালামনা। চলে এলাম আমি।

দুপুর হয়ে গেছে। ঐ হোটেলটায় ঢুকলাম আবার। আমাকে ঢুকতে দেখে রাকিব এগিয়ে এসে একগাল হাসি দিয়ে বললো,

-স্যার পাইছিলেন ঐ ঠিকানাটা?

আমি অনেকটা জোড় করেই একটু হাসি দিলাম। বললাম,
-হুম, পেয়েছিলাম। চল, ভাত খাবো।

এবার ও আমাকে একটা কেবিন রুমে নিয়ে গেল। যেখানে সাধারণত কাপলরা বসে। আমি বললাম,

-কিরে, আমাকে এখানে নিয়ে আসলি কেন?

ও বললো,
-এই রুমে এসি আছে স্যার। আপনি এইখানেই বসেন। আর কি কি খাইবেন সেটা বলেন!

মনে মনে ভাবলাম, দশ টাকার নোটটি এখনো কাজ করছে তাহলে! আরেকজন কাস্টমারের ডাকে ও চলে যাচ্ছিল এমন সময় ওকে ডাক দিলাম আমি। ও কাছে আসলো। আরো একটি দশ টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বললাম,

-তুই মিনিট দশেক পরে আসিস। আমি একটু কাজ করব।

ও বললো,
-ঠিক আছে স্যার, আপনি কাজ করেন। আমারে বইলেন যহন যা লাগে।

এই বলে ও দশ টাকার নোটটি পকেটে ভরে হাসতে হাসতে চলে গেল। আমি এবার তানহার দেয়া কাগজটির ভাজগুলো খুলতে লাগলাম। ভাজটিও করেছে অত্যন্ত যত্নসহকারে। লিখাগুলো দারুণ সুন্দর। গুট গুট অক্ষরে লিখা। পড়তে শুরু করলাম আমি।

‘সালাম নিবেন!
কি করে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছিনা। আমি কতবড় অভাগী দেখুন, আপনি আমাদের বাসায় আসলেন, বসলেন অথচ আমি আপনার সাথে মুখ ফুটে দুটো কথা পর্যন্ত বলতে পারলামনা। সবই আসলে ভাগ্য। আমি জানি আপনি কেন আমার খোঁজ করে আমার বাসা পর্যন্ত চলে এসেছেন। আর এটি আমার বিশ্বাস ছিল আপনি আসবেন। আমি কোনকিছু ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে বলতে পছন্দ করিনা। রুবিদের বাসায় একদিন আপনার একটি কাজ দেখেই আপনার প্রতি আমার দুর্বলতা তৈরি হয়ে যায়। আমি তখন বাসার ছাদে ছিলাম। রুবির ফুফাতো বোন যে কিনা আমেরিকা থেকে বেড়াতে এসেছিল সে তখন গার্ডেনে শর্ট ড্রেস পড়ে হাঁটছিল। আমি দেখেছিলাম, গেট খুলে ভেতরে আসতেই প্রথমে তার দিকেই আপনার নজর পড়ে। এটি স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পরক্ষণেই আপনি নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেন। চাইলেই আপনি ওর অর্ধনগ্ন দেহের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারতেন অথচ করেননি। কেন জানিনা সেদিনের পর থেকে আপনাকে ছাড়া আমি আর কিছু ভাবতে পারিনা। স্বপ্ন বুনতে শুরু করলাম আপনাকে নিয়ে। জানিনা এই স্বপ্ন আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে। জানিনা, এর শেষটা বেদনার হবে নাকি মধুর। তবে আমি আমার এই বেদনাবিধুর জীবনের সাথে আপনার সুন্দর আর সম্ভাবনার জীবনকে কল্পনা করে কখনো কখনো আঁতকে উঠি। সামলাই নিজেকে। আমি সবকিছুর জন্য ক্ষমা চাইছি। আমি আপনার সামনে কখনো আসবোনা আর। ভালো থাকবেন। নিজের খেয়াল রাখবেন। সাবধানে থাকবেন।

তানহা’

লিখাটি পড়ার পর মনের অজান্তেই দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো আমার। চোঁখের পানিও বোধহয় মনে ভাষা বুঝতে পারে। যেখানে ‘তানহা’ নামটি লিখা সেখানেই পানিটা পড়লো!

আমি ডাকলাম রাকিবকে। ও আসলো। বললাম,
-একটা চা নিয়ে আয় তো!

ও চলে গেল চা আনতে। আমি বসে রইলাম। ভাবতে লাগলাম, মানুষের জীবনটা কতইনা অদ্ভুত! তানহাকে নিয়ে যতই ভাবছি ততই অবাক হয়ে যাচ্ছি। কত প্রখর ওর চিন্তাধারা! কোত্থেকে আমাকে ও জাজ করলো! এসব ভাবছি এমন সময় রাকিব চা নিয়ে চলে আসলো।
সবার আগে আমার গল্প পড়তে চাইলে “নীল ক্যাফের ভালোবাসা” পেজে পাবেন।

সামনে চা রেখে ও বললো,
-স্যার, ভাত খাইবেননা?

আমি বললাম,
-ভালো লাগছেনা রে। চা টা খেয়ে নিই। পরে বলছি তোকে।

ও বললো,
-আচ্ছা স্যার, ডাক দিয়েন আমারে।

এই বলে ও চলে গেল। তানহার কথা ভাবতে ভাবতে চায়ে চুমুক দিলাম আমি। জিভে স্পর্শ পাওয়া মাত্রই আঁতকে উঠলাম! এরকম চা তো তানহা বানায়! চায়ের স্বাদটা তো অন্তত সেটাই বলছে। না না, এটা কি করে পসিবল! এখানে তানহা কোত্থেকে আসবে? তবে নিজের মনকে মানাতে পারছিলামনা আমি। আমি শতভাগ নিশ্চিত যে, এই চা তানহার হাতেই বানানো!

——চলবে——

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here