চোখের_তারায়_তুই?,০২,০৩

0
1363

?#চোখের_তারায়_তুই?,০২,০৩
#ইভা_রহমান
#পর্ব_০২

চাচার কাপড়ের দোকানের ম্যানেজারের দায়িত্ব আছে শিশির। ভার্সিটিতে ক্লাস না থাকায় সকাল সকাল এসেই সে দোকানে এসে বসলো। কর্মচারিরা অবশ্য তার আগে এসেই নিজেদের কাজ গুছিয়ে নিয়েছে। উজানো আজ সকাল সকাল একটা কাজে একটু বাহিরে গিয়েছিলো, ফেরার পথে ভাবলো যাচ্ছে যখন এ রাস্তা দিয়ে তখন শিশিরের সাথে দেখা করে নিক একটু। সেই সুবাদে দুই বন্ধু বসে গল্প দিচ্ছিলো দোকানে। গল্পের মাঝে শিশির হতাশ কন্ঠে বলে উঠলো,

– চাচ্চু সেদিন বললো যে সামনের মাস থেকে থাইয়ের দোকান টা সামলাতে। কিন্তু আমার মন চাইছে না এ-ই কাজ টা রেখে ওখানে গিয়ে আবার..

– কাজ তো একই করতে হবে তোকে,কাজের পরিমাণ তো আর কমছে না। তাহলে সমস্যা কোথায়?

– সমস্যা না। ছোট থেকে এ-ই দোকান সামলে অভ্যস্ত এখন হঠাৎ। আর থাইয়ের জিনিস একটু এদিক ওদিক হয়ে গেলে সব গুড়া গুড়া। তখন না আবার নিজের পকেট থেকে টাকা ভরা লাগে। অনেক প্যাঁচ রে ভাই।

উজান একটা শ্বাস টেনে শিশিরকে কিছু বলতে যাবে তখনি ফোনটা বেজে উঠলো উজানের। আননোন নাম্বার। ফোনটা রিসিভ করতেই ওপর পাশের মেয়েলি কন্ঠ শুনে একটু থমকে গেলো উজান। এ-ই সকালে কোন মেয়ে হঠাৎ তাকে ফোন করতে পারে! রোদ? কিন্তু রোদের নাম্বার তো তার সেইভ করা তাহলে? সালাম নিবেদন করে উজান সুন্দর করে বলে উঠলো,

-জ্বী কে বলছেন?

-জান তুমি আমার কন্ঠ শুনেও চিন্তে পারছো না আমি কে?

ভূ কুঁচকে আসলো উজানের,বিস্ময় ভঙ্গিতে বললো,

– সরি! কে আপনি?

– কিসের সরি জান,আমি না তোমার ময়নাপাখি আমাকে কিসের জন্য সরি বলছো তুমি হু।

-হোয়াট!

– জানপাখি জানোওওও তোমাকে না স্কাই ব্লু রঙের শার্টটায় জোস লাগছে আজকে। একদম সাকিব খান।

ভীষম খেলো উজান। নিজের দিকে তাকিয়ে সিউর হতে চাইলো সত্যি কি তার পড়নে শার্টের রঙ টা স্কাই ব্লু কি না!

– জান ও জান,তুমি বাহিরে কিছু খাইছো জান, ঔ যে সকালে একটা পাউরুটির টুকরো খেয়ে বেড়িয়ে গেলে তারপর কিছু দিয়েছো আর পেটে তুমি জাআআনন?

অন্তরাত্মা শক্ত হয়ে আসলো উজানের। এ-ই মেয়ে কি করে জানলো সে সকালে শুধু একটা পাউরুটি খেয়ে বেড়িয়েছে,আজব। এটা রোদ নয় তো। কিন্তু রোদেলা তো তার সাথে এরকম মজা করার মতো মেয়ে নয়। তাহলে কে? শুনে তো মনে হচ্ছে পরিচিত কেউ যে তার সম্পর্কে সব জানে। উজান ঘাবড়ে গিয়ে ফোন কেটে দিলো। এসবে মন দেবার সময় কোনো কালই ছিলো না তার। শিশির ইশারায় বললো কি সমস্যা। উজান বিরক্ত ভঙ্গিতে বললো দেখ না কোন জানি একটা মেয়ে ফোন দিয়ে মজা নিচ্ছে। শিশির কিছু বললো না৷ দুই বন্ধু মিলে শুরু করলো আবার তাদের গল্প,কিছু মুহুর্ত পর আবার ফোন বেজে উঠলো। উজান ভূ কুঁচকে তাকাতে শিশির বললো ফোনটা স্পীকারে দিতে। কোন মেয়ে এরকম মস্কারা করছে তার বন্ধুর সাথে তারো খুব শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে। এবার রেগে উঠলো উজান,রেগে গিয়েই ঝারি দিয়ে বসলো,এতে অপরদিকের মানুষটা ভয় পাবার বদলে আরো যেনো মজা পেয়ে গেলো।

-তুমি এ-তো রেগে কেনো যাচ্ছো জান। এ-ই তুমি তোমার ময়নাপাখিটাকে ভালোবাসো। আমি রোজ ব্যালকুনিতে তোমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকি। তুমি এদিক দিয়ে যাবে তোমার বন্ধুর দোকানে আর আমি তোমায় দেখবো। আর দেখো এখন উল্টে তুমি আমায় রাগ করছো।

উজান আর পারলো না মেয়েটার সাথে। কয়েক তরফা কথা বলার পর দম ছাড়লো।

-সরি ম্যাম আপনাকে চিনতে পারলাম না। আর আমার এ জীবনে ময়না পাখি তো দূরে থাক কোনো টিয়াপাখিকেও আমি পোষ মানায় নি। তাই দয়া করে এ-ই নাম্বারে আর ফোন দিয়ে বিরক্ত করবেন না। নয়তো বাংলা গালি কতো প্রকার কি কি সব বুঝায় দেবো আপনাকে,ডিজগাস্টিং!

আনমনে একটা ভেংচি কেটে নিজ মনে আর কেউ না আমাদের হিয়া পিচ্চি বলে উঠলো” আপনার বাংলা গালি আপনি আপনার কাছে রাখুন স্যার,আমিও একটা দুইটা জানি,আফটার ওল আপনারই স্টুডেন্ট! নিজেকে শান্ত করে হিয়া এবার কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললো “না জান প্লিজ এরকম বলো না,আমি তো তোমার জন্যেই…” আর কিছু বলতে পারলো না হিয়া। তার আগেই ফোনটা উজানের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে শিশির গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো “” তুই কি কোনোদিন শুধরাবি না হিয়া,কি শান্তি লাগে তোর উজানকে এতো জ্বালাতন করে। বাড়ি যাই আজ দেখাচ্ছি তোকে “”

চোখ থেকে মনি দুটো বেড়িয়ে আসবে এরকম বড় বড় চাহনিতে হিয়া তাকিয়ে উঠলো। হার্টবিট বন্ধ হয়ে গেলো কিছু মুহুর্তের জন্য। টুক করে ফোনটা হাত থেকে পড়ে যেতে ধরেও সে সামলে নিলো। পর মুহুর্তে ফোন কেটে দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস ছাড়তে শুরু করলো হিয়া। ইসস এভাবে ধরা খেতে হবে জন্মেও ভাবেনি সে । লতা এসে হিয়াকে নাড়িয়ে চাড়িয়ে জানতে চাইলো হিয়া ঠিক আছে তো?

– হেই মেয়ে এরকম সাইলেন্ট মুডে কেনো চলে গেলি,হিয়া,হিয়া কথা বল। উজান স্যার কি কিছু আন্দাজ করতে পেরেছে যে এটা তুই। এ-ই মেয়ে বোবা হয়ে গেলি কেনো,হিয়া?

হিয়া লতাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে দিলো,

– লতা পাতাআআআ স্যারের পাশে ভাইয়া ছিলো ফোনে,সব সব বুঝে গেছে। আর আমাকে হুমকি দিচ্ছে বাড়িতে ফিরে এসে ভাইয়া আমাকে এ্যা হ্যা এখন কি হবে। এ্যাআআ..

রেগে গেলো লতা। কান্নারত হিয়াকে ঠাস করে বুক থেকে সরিয়ে বিছানায় ছুঁড়ে দিলো,

– এজন্য বললাম ফ্রী মিনিটস আছে বলেই এরকম মজা করিস না। বুঝ এবার। যতোসব পাকনামো সবসময়। উজান ভাইয়ার সাথে মজা। এখন বুঝবি কতো ধানে কতো চাল।

হিয়া রেগে দিয়ে জানালার পর্দা টেনে ধরলো,

– আমি কি জানতাম সাদা বিলাই টার সাথে ভাইয়াও আছে। এ-ই তোদের ক্রাশ ফ্রাস উজান ভাইয়া আমার জীবনটাই ত্যানা ত্যানা বানিয়ে দিলো। কোনোদিন কপালে ভালো বউ জুটবে না এ-ই লোকের। কোনোদিন না।

হিয়ার কথা শুনে লতা হতবাক। নিজে স্যারের সাথে মজা করে এখন নিজে বলছে কি না স্যারের কপালে ভালো বউ জুটবে না। লতা মুখে ভেংচি এটে বললো অভিশাপ দেওয়ারো একটা লিমিট থাকে হিয়া,শেষমেশ কপালে ভালো বউ জুটবে না,লাইক সিরিয়াসলি!

!
!

উজান হতবাক হ’য়ে আছে। আর শিশির মিচকে মিচকে হাসছে। হিয়া পিচ্চি যে এরকমো মজা করতে পারে তার সাথে এটা ছিলো উজানের কাছে অকল্পনীয়। শিশির হেঁসে দিয়ে বললো দোস্ত আর বেশি শকড খেয়ে হুঁশ হারিয়ে ফেলিস না, আমি সিউর আমার এ-ই বোনের জন্য তোকে একদিন হেব্বি ভাবে ফাঁসতে হবে। উজান দম ফেললো মানে বোঝালো হয়তো তোর কথাই ঠিক।… না আজকে বাড়িতে গিয়ে হিয়ার ডানা দুটো কাটতে না পারলেও সুতো দিয়ে সেলাই করে বেঁধে দিতে হবে, যা বুঝছে শিশির………উজান শিশিরের থেকে বিদায় নিয়ে বাড়িতে আসলো। দুপুরে কোচিং-এ প্রক্সি ক্লাস নিতে যেতে হবে তাকে, পরে সময় পায় কি না পায় তাই বাড়িতে এসে বই খাতা খুলে নিজের ডক্টরি জ্ঞান টুকু মস্তিস্কে ঢুকাতে থাকলো।

!
!
দুপুর তখন একটার কিছু পর;

দোকানের হিসাব গুলো আরেকবার মিলিয়ে নেবার কাজে যখন অত্যান্ত মনোযোগের সাথে শিশির মোটা খাতা হাতে টাকা গুনছিলো ঠিক সেই মুহুর্তে কাঁচের বড় থাই টা খুলে দোকানের ভেতর পা রাখলো রোদেলা। শাড়ি হাতে বসে থাকা ছোট্ট পলাশ হেঁসে দিয়েই বলে উঠলো আরে রোদ আপা আইলো যে! রোদ নামটা শুনেই খাতা হতে মুখ তুলে সামনে তাকালো শিশির৷ চোখ আঁটকে গেলো এক পা দু পা করে ভেতরে আসা বেগুনি পোশাকের মেয়েটার দিকে। দুধে আলতা গায়ের রঙ,চুল গুলোও কোমড় অবধি লম্বা,কোনো সাজগোছ কিচ্ছু নেই শুধু একহাতে ঝুলছে একডজন রেশমি চুড়ি, সৃষ্টিকর্তা রোদকে শুধু টাকার প্রাচুর্য দিয়েই জম্ম দেননি সাথে সৌন্দর্যের পুরোটাই ঢেলে দিয়েছেন তার পুরো শরীর জুড়ে। তাই তো ফর্সা গায়ে বেগুনি রঙ টা যেনো একটু বেশি মানিয়েছে তাকে। শিশিরকে এক পলক দেখে নিয়ে রোদ তার সাথে আসা তাসফিয়াকে নিয়ে সামনের টুল টায় বসে গেলো। পলাশকে বললো নতুন কি আছে সেটা দেখাতে। ছোট্ট পলাশও তার প্রিয় রোদ আপার কথা মতো যা যা নতুন আছে সব বের করতে শুরু করলো। বেশ অনেক কয়েকটা জামা দেখার পর রোদের একটা লালের মাঝে হলুদ চুরনি বাটিক ড্রেস পছন্দ হলো,যার প্রাইস লেখা ২৫৫০। রোদ ছোটকে বললো এটা প্যাক করে দিতে। ছোটও সুন্দর মতো প্যাক করে দিলো। রোদ প্যাকেট টা নিয়ে উঠে যেতে ধরবে ওমনি ছোট বলে উঠলো,

– রোদ আপা টাকা দিবেন না?

রোদ মুচকি হেঁসে উওর দিলো যেনো এটা তার অধিকার..!!

– তোমাদের ম্যানেজারের থেকে টাকা টা নিয়ে নিও পলাশ!

রোদ আর কিছু না বলে বেড়িয়ে গেলো তাসফিয়াকে নিয়ে,শিশির খাতার দিকেই মুখ রেখে নীরব হেঁসে দিলো। রোদের দিকে তাকালো না আর। রোদ বিনা পয়সায় কিছু নেবার মেয়ে না। আজ নিয়েছে তার মানে নিশ্চয়ই তার মাথায় কিছু না কিছু ঘোরপাক খাচ্ছে। এদিকে শিশিরের নীরব হাসি দেখে পলাশ এবার ফোড়ন কেটে বলতে থাকলো,

– ভাই রোদ আপা তো প্রত্যেকবার জিনিস কিনলে টাকা দিইয়া যায়,আজ আপনার থাইকা টাকা কেন নিতে কইলো? কি চলেএএ ভাইজান!

শিশির রেগে গিয়ে পলাশকে ঝারি দিলো,

– ধুর ব্যাটা বেশি বুঝওছ তুই। আমার লগে তোদের রোদ আপা যায় রে। ওরা কতো বড়লোক তুই জানিস। এরকম হাজারটা দোকান কেনার ক্ষমতা রাখে ওর আর উজানের বাপে। আর তুই আইছোস জেগে জেগে স্বপ্ন দেখার জন্য। কাজ কর নিজের।

পলাশ হাসলো,হেঁসে দিয়েই বললো,

– তবে যাই কন ভাই,আপায় কিন্তু আপনারে বহুত ভালোবাসে আপনি মানেন আর না মানেন।

শিশির কিছু বললো না আর। মনটাতে ভালো লাগা খারাপ লাগা দুই কাজ করতে থাকলো,রোদ যতোই তাকে ভালোবাসুক এ-ই সম্পর্ক কখনো পরিণতি পাবে না সে এটা খুব ভালো করেই নিজের মনকে বুঝিয়ে দিয়েছে,খুব ভালো করে।

!
!

ক্লাস দুটোয় শুরু হবার কথা থাকলেও এখন বাজে ২টা ১০। স্যারের আতাপাতা কিচ্ছু নেই। উপস্থিত সবাই সীটে বসে যে যার মতো গল্প দিচ্ছে। কেউ বা টিপছে ফোন। হঠাৎই সবার গল্পের মাঝে ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্ট ছেলে নীরব সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো এ-ই তোরা দেখবি আমি সায়রা ম্যামের নকল করবো এখন। সবাই চুপ হ’য়ে গেলো। নীরব কিছু করা মানেই যে হাসির মেলা সবাই তা জানে। তাই সবাই মনোযোগ দিয়ে দেখতে থাকলো নীরব কি করে। নীরব একদম তাদের বাংলা টিচার সায়রা ম্যামের অবিকল নকল করতে থাকলো। কেমন পড়ার সময় উনি নাক টানেন৷ হাত পেঁচিয়ে মুখে ভঙ্গি এটে পড়াতে থাকেন,সব। এদিকে সবাই হাসতে থাকলো। নীরব এবার রিকুয়েষ্ট করলো আর কে আছিস যে মিমিকিরি করতে পারবি। যদি সেইম টু সেইম হয় তাহলে আজ নিচে যে ঝালমুড়ি মামা বসে আমি তার থেকে তাকে বিশ টাকার ঝালমুড়ি খাওয়াবো যা। দু’জন দুটো টিচারের মিমিকিরি করলো কিন্তু কারো টা মন মতো হলো না। এবার তুড়ুৎ করে হিয়াপাখি উঠে দাঁড়িয়ে বললো সাড় তো কিছুই তো পারিস না তোরা। মিমিকিরি কি করে করতে হয় আমি দেখাচ্ছি। ওয়েট।

বলেই হিয়া সবাইকে চুপ করে বসিয়ে দিয়ে স্যারের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালো। লতার কাছে তার চশমা টা চেয়ে পড়তে গিয়ে দেখলো ইসস কি পাওয়ার। না না এটা পড়া যাবে না। ভালো চোখ গুলো অযথা খারাপ বানানোর কোনো মানে নেই তার। তাই না পড়েই কাজ চালাতে হবে। বায়োলজি বই হাতে হিয়া চোখ মুখ শক্ত করে গেটে এসে দাঁড়ালো। নীরব ওয়ান টু থ্রী বলতেই শুরু হলো হিয়ার মিমিকিরি। গম্ভীর ভাবে নিচে তাকিয়ে স্যারের বেঞ্চে এসে বইটা রাখলো হিয়া। রিডিং চশমা টা পকেট থেকে বের করে চোখে পড়ার ভঙ্গি এটে দিয়ে শুরু করলো নাম পেজেন্স।

-রোল নাম্বার এক,দুই,তিন,চার,পাঁচ__পাঁচ কে?

পাঁচ কে বলার সাথে সাথে লতা এমনি এমনি দাঁড়িয়ে গেলো,হিয়া মুখে রাগের দৃষ্টি ছুড়ে বলতে থাকলো,

– আগেরদিন এ্যাবসেন্ট ছিলে কিসের জন্য। কোচিং টা কি ছেলে খেলা মনে হয় তোমাদের। বাড়িতে তো পড়াশোনা করো না। এ্যাটলিস্ট এখানে তো ঠিক করে সেটা করবে। নেক্সট টাইম থেকে যেনো এরকম এ্যাবসেন্স না দেখি।

লতা মুখ টিপে হেঁসে বসে গেলো,হিয়ার এ-ই অবিকল নকল করা দেখে কারোই বুঝতে বাকি থাকলো না এটা আর কেউ না তাদের গম্ভীর উজান স্যার। সবাই হেসে দিয়ে উঠলো,

– হোয়াই ওল আর ইউ লাফিং? এখানে কি সার্কাস হচ্ছে। ডিজগাস্টিং__না এদেরকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না_____উহুউহু(কেশে দিয়ে)_কিপ কোয়াইট এ্যান্ড এ্যাটেনশন টু দিস বোর্ড!

হিয়া ওর হাতের কাছ টা এমনি এমনি ফ্লোড করে বই নিয়ে দাঁড়িয়ে ব্লাকবোর্ডে কিসব হাবিজাবি লিখে সামনে এসে আরো কিসব বুঝিয়ে বলতে থাকলো, এদিকে কখন যে উজান এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গেছে সামনের বেঞ্চে বসে থাকা দু একজন বাদে কারোই নজরে পড়লো না তেমনটা! তারা একটু কন্ঠ উঁচু করে হিয়াকে থামাতে যাবে ওমনি উজান হাতের ইশারায় তাদের চুপ থাকতে বললো,

– নীরব বই কোথায় তোমার? আজকেও বই নিয়ে আসো নি। আমি কি একবারো বলেছিলাম বই লাগবে না আমার ক্লাসে। জাস্ট আউট। জাস্ট আউট ওফ মাই ক্লাস। কি হলো কি কথা কানে যায় নি। দিস ইস টু মাচ। ডিজগাস্টিং রিয়েলি ডিজগাআ- আ- আ–আ–স্টি–ং

পেছন ঘুরে তাকাতেই আঁতকে উঠলো হিয়া! কে বাঁচাবে এবার আজ তাকে। সকালে ফোনের ঔ রং নাম্বার কান্ড আর এখন!!

চলবে….

আমি শুধু #উজান_হিয়া’র ছবি দিলাম রোদ আর শিশিরকে তোমরা কল্পনা করে নিও?❤️

?#চোখের_তারায়_তুই?
#পর্ব_০৩
#ইভা_রহমান

মারাত্মক রকমের ভয়ে এ-ই মুহুর্তে চুপসে আছে হিয়া। উজান ভূকুঁচকে কিছুক্ষন হিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে ভাঁজ করা হাত দুটো নিচে নামালো,শান্ত হয়েই হিয়ার এক হাত দূরে থাকা নিজের উচু টেবিল টার সামনে এসে দাড়াতেই চুপসে থাকা হিয়ার দম টা যেনো আরো দমে গিয়ে সরু হতে থাকলো। উজান হাতে থাকা তার রিডিং চশমা টা চোখে দিয়ে আস্তে করে হিয়ার উদ্দেশ্যে বললো “সীট”। একটা বড় শ্বাস ফেললো হিয়া। মাথা নিচু করে গুটিগুটি পায়ে লতার পাশে গিয়ে বসতেই লতা মজার ছলে তার পানির বোতল টা বাড়িয়ে দিলো হিয়ার দিকে। এক ঢোকে অর্ধেক পানি গলগল করে গিলে নিলো হিয়া। উজান হালকা কেশে দিয়ে শুরু করলো তার ক্লাস। উজান সচারাচর হিয়াদের ক্লাস নেয় না। একান্তই দরকার না থাকলে। আজো তাই নিচ্ছে বায়োলজি ভাইয়া ছুটিতে আছে বিধায়।

পাক্কা চল্লিশ মিনিট ২০৬টা হাড়ের আদৌপান্ত বুঝিয়ে উজান দম ফেললো। কিন্তু এ-ই ২০৬টা হাড়ের একটাও যে হিয়ার মাথায় ঢুকে নি তা হিয়ার চোখ মুখের কুঁচকে যাওয়া ভাঁজ দেখেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। এমন না যে হিয়া স্টুডেন্ট খারাপ। ভালো খারাপের মিশেলে তার এ-ই ছটফটে মস্তিষ্কের তুলতুলে ব্রেন। কিন্তু এ-ই মুহুর্তে ভয় নামক বস্তুটা এতোই প্রখর হয়ে হিয়ার মাঝে জমা হচ্ছে যে আপাতত হিয়ার এ-ই মস্তিষ্ক বাকি কাজ গুলো করা বন্ধ করে দিয়েছে এ-ই ভয়ে যে ক্লাস শেষে উজান না তার অবস্থা টাই টাই ফিস করে ফেলে!

ক্লাস শেষ করলো উজান। হিয়ার দিকে একবার চোখ বুলে নিয়ে অফিস রুমের দিকে পা বাড়ালো। হিয়া একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। যাগ বাঁচা গেলো। কিন্তু হিয়ার এ-ই স্বস্তি বেশিক্ষণ বহাল থাকলো না। এরপর আরো দুটো ক্লাস শেষে আজকের মতো কোচিং এর পার্টের ইতি ঘটতেই হিয়ার ডাক আসলো। কোচিং এর এক সহকারী এসে হিয়াকে বলে গেলো তোমাকে উজান স্যার অফিস রুমের বাহিরে ডাকছে নিচে আসো তাড়াতাড়ি। হার্টবিট কাজ করা বন্ধ করে দিলো মুহুর্তে। ভয়ে লতার জামা খিঁচে ধরে হিয়া কেঁদে উঠলো,

-এখননন কি হবে লতাআআআ,এ্যা হ্যা এ্যা,আজকে তো উজান স্যার আমাকে জ্যান্ত পুঁতে দিয়ে আসবে। আমি নিচে যাবো নাআআ। এ্যাআআ..

আবারো রেগে উঠলো লতা। নিজে সারাক্ষণ অকাজ কুকাজ করে এখন ন্যাকা কান্না কাঁদছে। ঢং দেখলে তো গা জ্বলে উঠে।

-এ-ই শোন হিয়া একদম এরকম ঢং করে কাঁদবি না। সবসময় উজান স্যারের সাথে কি এ-তো শ*এুতা তোর হ্যা। ক্লাসের প্রত্যেক বান্দা উজান ভাইয়া বলতে জ্ঞান হারিয়ে বসে আর তুই কিনা মানুষটাকে..দেখি ছাড় আমাকে।

-নাআআআআ তুই আমাকে রেখে যাবি না প্লিজজ। সোনা বোন আমার এরকম করিস না। তুই থাকলে আমি একটু মনে সাহস পাবো প্লিজজ লতা।

লতা নিজেকে হিয়ার থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললো,

– আমার খেয়ে দেয়ে আর কাজ নেই তো আমি বাঘের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলবো,বাঘ মামা নেও অফার চলছে বাই ওয়ান গেট ওয়ান ফ্রী।
হিয়ার সাথে আমিও আছি। নেও ইচ্ছে মতো খেয়ে পেট ভরাও।

শেষ কথা গুলো আর কানে আসলো না হিয়ার। রেগে গিয়ে নিজের চুল নিজে খামছে ধরলো হিয়া।

– পাতার বাচ্চা লতা আমাকে রেখে পালিয়ে গেলি তো। আমারো দিন আসবে একদিন। হু।

দাঁত মুখ শক্ত করে হিয়া নিচে অফিস রুমের সামনে এসে দেখতে পেলো আশেপাশে ভেতরে বাহিরে কেউ নেই। শুধু এক কোণে একটা টুলে বসে সায়রা ম্যাম খাতা না কি একটা খুব মনোযোগ সহকারে দেখছে। হিয়া মনে মনে ভাবলো এটাই সুযোগ। পালিয়ে গেলে উজান স্যার তার টিকিটাও করতে পারবে না হু। যেই ভাবা সেই কাজ,বলা মাএই এক দৌড়ে হিয়া বাহিরে আসতেই দেখলো বাইক নিয়ে গেটের ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে আছে উজান। হাসি-হাসি মুখ টা আবারো ভয়ে ছোট হয়ে আসলো তার। মাথা নিচু করে গুটিগুটি পায়ে উজানের সামনে এসে দাঁড়ালো হিয়া। উজান একটা শ্বাস ফেলে বলে উঠলো,

– তিন তলা থেকে নামতে এতোক্ষণ সময় লাগে তোমার?

-ইয়ে মানে আমি..

হিয়াকে আমতা আমতা করতে দেখে উজান বললো পেছনে গিয়ে বসো। কথাটা শুনেই চোখ তুলে উজানের মুখের দিকে বিস্ময়ে তাকালো হিয়া। পেছনে বসবো মানে! কেনো? হিয়ার প্রশ্নে উজান জবাব দিলো,শিশির বললো তোমাকে নিয়ে মার্কেটের দিকে যেতে শিশির দোকানে আছে, কিছু একটা হয়তো দিবে। উজানের কথা শুনে বাধ্য মেয়ের মতো হিয়া পেছনে বসতে যাবে ওমনি কোচিং থেকে আবার উজানের ডাক আসলো। উজান হিয়াকে বাইকের সামনে রেখেই ভেতরে এসে স্যারদের সাথে কথা বলতে থাকে। এদিকে এ-ই ফাকা রাস্তায় এ-ই মুহুর্তে একা দাঁড়িয়ে থাকতে মোটেই ইচ্ছে হচ্ছে না হিয়ার। তবে যাগ এটা ভেবে শান্তি যে উজান তাকে বকা দেবার বদলে নিজে থেকে তার ভাইয়ের কাছে নিয়ে যেতে চাইছে। উপপ শান্তি, খুব শান্তি। কিন্তু এই অপেক্ষা!

– ধুরো ভালো লাগছে না। এর চাইতে একটা রিক্সা নিয়েই আমি এতোক্ষণ ভাইয়ার দোকানে গিয়ে পৌছাঁতে পারতাম। কোথায় গেলো এ-ই সাদা বিলাই টা। অসহ্য।

নিচে রোজ দাঁড়িয়ে থাকা ঝালমুড়ি মামার দিকে রাগে গজগজ করতে করতে হিয়া আসলো। অপেক্ষা করতে করতে পেটে ক্ষিদের ছুঁচো টা নড়াচড়া করতে শুরু করেছে হালকা। এখন এটাকে কিছু একটা দিয়ে না শান্ত করলেই নয় যেনো। ব্যাগের পকেট হাতড়িয়ে দেখলো পাঁচ টাকার একটা চকচকে কয়েন’ই খুচরো পড়ে আছে। মামাকে বললো ঔ পাঁচ টাকারই ঝালমুড়ি দিয়ে দেও। ঝালমুড়ি নিয়ে বাইকের সামনে এসে হাত দিয়েই খুব স্বাদ করে সেটা মুখে দিচ্ছিলো হিয়া। আহ অমৃত মামার এ-ই ঝালমুড়ি। পাঁচ টাকা তো দূর পাঁচশো টাকার খেলেও পাকস্থলীতে তৃপ্তি মিটবে না এমন। কাসুন্দি গুলোও যা রসালো মন প্রাণ জুড়িয়ে যায় একদম। হিয়া মনে মনে ভাবলো আর পাঁচ টাকা থাকলে পুরো দশটাকারই কেনা যেতো ইসস। কাল ভাইয়ার পকেট থেকে আরো কিছু খুচরা টাকা নিয়ে আসতে হবে হু।

নীল আকাশের গা বেয়ে শুভ্র মেঘর বর্নিল সাজ,মেঘের থেকে অনেক দূরে সূর্যের রাগ্বানিত তেজ।তপ্ত রোদ,গাছের পাতার ফাঁকের মাঝে দিয়ে সেই রোদের সোনালী কিরণ এসে পড়ছে হিয়ার মুখে,ঘামে ভিজে গেছে হিয়ার পিঠের পেছন ভাঁজ,বিন্দু বিন্দু লোনাজল জমেছে হিয়ার নাকের ডগায়। ডান হাতে কখনো ঝালমুড়ি মুখে পুড়তে তো কখনো হাত কপালে রেখে রোদ থেকে বাঁচতে চলছে হিয়ার ব্যর্থ চেষ্টা। সবকিছু মিল করে কতো যে মোহনীয় লাগছে হিয়াকে এই মুহুর্তে!আগোছালো হিয়াকে প্রকৃতির এ-ই সরঞ্জামে সাজাতেই যেনো মেঘ,রোদের এই ব্যস্ততা।

হিয়ার খাবার মাঝে উজান বেড়িয়ে বাইকের সামনে হেঁটে আসলো। সামনে তাকাতেই চোখ আটকে রইলো তার প্রিয়তমার এই অগোছালো রুপের মায়াজালে। কিছুক্ষন এক নেশাক্ত চোখে সে চেয়ে রইলো ঘার্মাক্ত হিয়ার মুখের অবলীল সৌন্দর্যে। তবে মনে আসা অনুভূতি টাকে বেশ কৌশলে সামলে নিলো উজান। চোখ টা নামালো হিয়ার মুখের দিক থেকে। হিয়াকে হাত সহ ঝালমুড়ি খেতে দেখেই ভূ কুঁচকে আসলো তার। ইসস কতো না জানি হাইজিন এটাতে! উজানের কপালের গাঢ় রগ গুলো খেয়াল করতেই হিয়া তার ঝালমুড়ির শেষ অংশ টুকু টপাটপ মুখে পুড়ে নিয়ে কাগজ টা দেওয়ালের এক কানিতে ছুঁড়ে দিলো। উজান বাইকে বসতেই হিয়া এসে উজানের পেছনে বসলো। উজান বাইক স্টার্ট দিলো। হিয়া আনমনে ওর ঝালমুড়ি মাখা ডান হাত টা উজানের কাঁধে রাখতেই হাতে লেগে থাকা সব হলুদ কাসুন্দি মেখে গেলো উজানের সাদা শার্টে। হুঁশ ফিরলো হিয়ার! জিহ্বে কামড় দিয়ে মাথায় একটা বারি মারলো নিজের। ধ্যাত কেস টা কি হলো। নিজেকে মনে মনে হাজার টা বকুনি দিতে থাকলো হিয়া। এদিকে উজান এরই মধ্যে বাইক স্টার্ট দিয়ে দিয়েছে। গাড়ি চলছে অলিগলি বেয়ে মার্কেটের পথে। হিয়া তার বা হাত উজানের কাঁধে দিয়ে শান্তি মতো বসতে পাচ্ছে না বিধায় আবার ডান হাত টা রাখলো উজানের বাহুতে। লেগেই তো গেছে সব, এখন বাকি টা লাগলেই বা কি আর না আগলেই বা কি। তার সাদা বিলাই টা না বুঝতে পারলেই তো হলো নাকি!

!
!

এদিকে উজান আর হিয়ার জন্য অপেক্ষারত শিশিরের সামনে এসে একটা ছোট্ট ব্যাগ হাতে ধপ করে বসে পড়লো পলাশ। ব্যাগ টা শিশিরে হাতে দিয়েই মুখে এক ফালি হাসি টেনে পলাশ বললো ” ভাইজান এটা রোদ আপায় পাঠাইছে আপনার জন্য,নিন নিয়ে উদ্ধার করুন আমাকে” ভূ কুঁচকে আসলো শিশিরের। ব্যাগ টা হাতে নিয়ে পলাশকে বললো যা তোর কাজে। পলাশ শিশিরকে একটা পাকা পাকা হাসি উপহার দিয়ে নিজের কাজে মন দিলো। ব্যাগ টা হাতে নিয়েই শিশির দেখলো তাতে দুটো শার্ট, একটা টি শার্ট আর দুটো প্যান্ট রাখা। নিমিষে রাগের মেঘ এসে জমা হতে থাকলো শিশিরের মাথার মধ্যে। কতোবার সে রোদেলাকে বলেছে তাদের মাঝে কখনো কিছু সম্ভব না রোদ তারপরো কেনো!

টেক্সট আসার শব্দে শিশিরের রাগ টা হালকা কাটলো। ফোন হাতে নিয়ে টেক্সট ওপেন করতেই লেখা ভাসলো “এই যে ম্যানেজার সাহেব আপনার থেকে কিছু না নিলে তো আবার আপনাকে কিছু গিফট করা যায় না। তাই কিছু নেবার বদলে কিছু রিটার্ন করলাম। শার্টের ছেড়া বোতাম টাও যে একটু শখ করে লাগিয়ে নিবেন সেটারো তো সময় হয় না আপনার! যা দিয়েছি কাল ক্লাসে পড়ে আসবেন। রিটার্ন দেবার চিন্তা ভূলেও করবেন না নাহলে কিন্তু!….শিশির কিছু না ভেবেই তৎক্ষনাৎ উওর করলো ” আমি এটা নিতে পারবো না রোদপাখি,আমাদের মাঝে কিছু সম্ভব না একটু বুঝো তুমি” সাথে সাথে রিপ্লাই আসলো রোদেলার ” হুম বুঝলাম, কালকে ক্লাসে শার্ট দুটো থেকে একটা পড়ে এসো তারপর বাকি কথা হবে” শিশির কাঠ কাঠ ভঙ্গিতে বললো” এ-ই শার্ট আমি পড়বো না রোদেলা” রোদেলা উত্তর দিলো” বেশ,তোমাকে কি করে এ-ই শার্ট পড়াতে হয় সেটাও আমার জানা আছে শিশির আহমেদ!””

!
!

রাত তখন বারোটার কিছু পর। উজানকে নিয়ে চাচা সহ বাড়িতে আসলো শিশির। বাহিরে চলছে প্রচন্ড ঝড়ের তান্ডব। সকালের সূর্যের তেজ দেখে এটা বোঝার উপায় ছিলো না সূর্য অস্ত যাবার পর এই মধ্য রাতে আকাশ কাপিয়ে মেঘ তার গর্জন শুরু করবে। উজানদের বাড়িতে নিয়মমত দশটার মধ্যে বাড়িতে ঢোকার কড়া হুকুম থাকলেও এ-ই অনাকাঙ্ক্ষিত ঝড়ের কবলে পড়ে উজানের পক্ষে বাড়ি ফেরা আজ সম্ভব হয়নি। হয়তো ঝড় শেষ হলে যেতে পারতো কিন্তু শিশির বললো থেকে যা না একটা দিন। অনেকদিন তো হলো থাকা হয় না একসাথে,এ-ই সুযোগ আন্টিকে বলে কিছু একটা যদি ম্যানেজ করা যায়। উজানেরো খুব ইচ্ছে হলো শিশিরের সাথে অনেকদিন পর একটা রাত কাটানোর তাই তার মা’কে বলে রাজি করানো গেলো ব্যাপারটা। বাড়িতে এসেই ফ্রেশ হয়ে নিয়ে উজান সহ বিছানায় গা মেলে দিলো শিশির। হিয়া আপাতত ঘুমে আছে। যাগ শান্তি। রাত টা অনন্ত ভালো কাটানো যাবে। এদিকে চাচি এসে শিশিরকে বললো উজান কিছু খাবে কিনা বা তার কিছু লাগবে কি না। শিশির বললো কিছু লাগবে না তবে আরেকটা কাঁথা দিয়ে গেলে ভালো হতো। চাচি ঝটপট ট্রাঙ্ক থেকে আরেকটা কাঁথা বের করে শিশিরকে ধরিয়ে দিলো। বৃষ্টির আমেজে রাত টা ভালোই কাটছিলো দু বন্ধুর। জমানো গল্প হাজারো পুরানো স্মৃতি সাথে চুপিসারে একটা সিগারেটের টান। এ-ই তো আর কি লাগে এ-ই মুহুর্তটার জন্য!

কিন্তু এদিকে উজানের এ-ই শিশির’দের বাড়িতে থাকার বিষয় টা খুব একটা ভালো চোখে নিলেন না উজানের বাবা। একটু রাগান্বিত কন্ঠেই উনি উজানের মা’কে বললেন,

– যখন দেখলো ঝড় হতে পারে তখনি তো তোমার ছেলে বাড়িতে আসতে পারতো। আর শিশিরের সাথে কি এতো সারাক্ষন ওর। তোমার ছেলের কি আর বন্ধু বান্ধব নেই। শিশিরদের সাথে জায় আমাদের বলো তো তুমি!

উজানের মা’র মনে একটা চাপা অভিমান এসে বিরাজ করলো। উনি সেটাকে হজম করে নিয়েই বললেন,

– বন্ধু বান্ধব কেনো থাকবে না। উজান সবার সাথেই মেশে তুমি দেখতে পারো না৷ আর শিশিরের সাথে একটু বেশি সময় থাকে কারণ ওরা ছোট থেকে একই সাথে বড় তাই জন্য..

উজানের বাবা একটু শান্ত হয়ে শীতল কন্ঠে বললেন,

-ঠিক আছে, আজকে রাত টা থাক। কাল সকাল সকাল উজানকে ফিরতে বলো বাড়িতে!

!
!

ঝড়ের তান্ডব কাটিয়ে সকালের মিষ্টি রোদ এসে উঁকি দিচ্ছে হিয়ার রুমের ভ্যান্টিলেটর ভেদ করে ঘরের দেওয়ালের এক কানিতে। সকালের এই নরম নরম রোদের ঝলক দেখে কি আর বোঝার উপায় আছে কাল কি ঝড় টাই না হয়েছিল সারারাত জুড়ে। চাচির ডাকে আড়মোড়া ভেঙে ঘুম ঘুম চোখে একটা বিরাট হাই টেনে উঠে বসলো হিয়া। ঘড়িতে চোখ পড়তে দেখলো ৭ টা ১৫। আটটায় ক্লাস। যাগ সময় আছে ধীরেসুস্থে তৈরি হওয়া যাবে। ব্রাশ করে এসে স্কুল ড্রেস পড়ে নাস্তায় লাল চায়ের সাথে একটা টোস্ট চুবিয়ে খেলো হিয়া। ব্যাগ গোছাতে খেয়াল করলো রুটিনে জ্বলজ্বল করে লেখা আছে ফোর্থ পরিয়ডে শিল্পী ম্যাডামের পিটি ক্লাস! রাগ উঠলো হিয়ার। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো নক গুলো ছোট আর পরিষ্কার আছে কি না। যাগ যা আছে মানানসই আছে। কিন্তু এই দুই বেনী কে করে দিবে এখন! কি জ্বালা। এমন না যে হিয়া বেনী করতে পারে না। পারে। কিন্তু যা করে তাতে কখনো একটা মোটা হয় তো আরেকটা চিকন৷ খুবই ঝামেলার একটা জিনিস।

চাচিকে না পেয়ে সব গুছিয়ে হাতে চিরুনি আর দুটো সাদা রাবার ব্যান নিয়ে শিশিরের রুমের দিকে পা বাড়ালো হিয়া। সোজা গিয়ে ধপ করে বসে পড়লো কাঁথা দিয়ে নিজেকে মুড়িয়ে রাখা উজানের পায়ের কাছে। আর দু’বার শিশির ভেবে উজানের পা টেনে ধরে ডাকতে থাকলো উজানকে!

– ভাইয়া ও ভাইয়া উঠ না। আজকে পিটি ক্লাস আছে দে না দুটো বেনি করে। চাচি যে কোথায় গেলো। উঠ না ভাইয়াআআ__দেড়ি হচ্ছে তো আমার। উঠবি। না পানি এনে ঢালবো তোর গায়ে। ভাইয়াআআ..

হিয়ার ডাকে লেগে আসা ঘুম টা ভেঙে গেলো উজানের। উজান এক হাতে চোখ টা হালকা কচলে নিয়ে এপাশ ফিরতে যাবে ওমনি হিয়ার নজরে পড়লো সামনে একটা মোটা বইয়ের ভাঁজে। উজানের দিকে আর না তাকিয়ে বইটা হাতে তুলে নিলো হিয়া। আরে এটা তো সাদা বিলাই এর বই। এখানে কেনো,হোয়াই?

– ভাইয়া এটা সাদা বিলাই টার বই না। তোর কাছে যে। ফেলে রেখে গিয়েছিলো নাকি দোকানে। ইসস কি কঠিন কঠিন ইংলিশ কেমনে পড়ে এসব!__অবশ্য ওনার মতো হিটলারের জন্য এরকম বস্তা বস্তা বইয়ের যুদ্ধে নিজেকে বিজয়ী করা খুব একটা কঠিন কাজ না।___তবে কি জানিস ভাইয়া আমাদের ব্যাচের যে একটা মেয়ে আছে না মোহিনী। ভাই রে ভাই সেই মেয়ে তো উজান ভাইয়া বলতেই ফিট খায়। শুধু কি মোহিনী ব্যাচের প্রত্যেকটা মেয়ের নাকি ক্রাশ এ-ই সাদা বিলাই টা। কিন্তু আমার না এ-ই লোকটাকে দেখলেই কেনো জানি পায়ের রক্ত মাথায় উঠে জানিস। একটু কি মিষ্টি করে কথা বলতে পারে না। মানলাম ব্যাটা অনেক বড়লোক। তার আব্বার অঢেল আছে তাই বলে একটু হাসি মুখে কথা বলবে না। ইসস এ্যাটিটিউড দেখলে তো গা পিওি আমার তিরতির করে জ্বলে যায়। জল্লাদ একটা দেখলেই আত্না শূন্য হয়ে আসে আমার। এদিকে আমার রোদ আপুটাকে দেখ তো কতো মিষ্টি,কি শান্ত। মনে হয় ওরা একসাথে এক বাড়িতে থাকে। আমার তো খুব ইচ্ছে রোদ আপুর মতো একটা সুন্দরী ভাবী হবে আমার। রোদ আপু একটা গোলাপি গোলাপ ফুল বুঝলি দেখলেই চোখ টায় শান্তি লাগে। ইসস হাসিটা আপুর! আমি যদি বড় হয়ে রোদ আপুর মতো হতে পারতাম। আর ঔ সাদা বিলাই টা তো আপুর পুরো উল্টো। মানছি সে সুন্দর স্মার্ট তাই বলে এতো মুড! হু__শোন না ভাইয়া আমি একটা কবিতা ঠিক করেছি সাদা বিলাই টার জন্য,সুকুমার রায়ের একটা কবিতা,একবারে খাপেখাপ মিলে যায় ওনার সাথে, শুনবি,শোন” রাম গরুর ছানা-হাসতে তাদের মানা- হাসতে গেলে বলে-হাসবো না না না” একদম পারফেক্ট না বল..

কবিতা টা বলতেই খিল খিল করে হেঁসে দিলো হিয়া। হিয়ার এই লাগামহীন কথা আর হাসির মাঝে বাথরুম থেকে মুখ তোয়ালে দিয়ে মুছতে মুছতে রুমে ঢুকলো শিশির। শিশিরকে দেখেও হিয়ার কথা থামলো না। আরো কিসব বলতে গিয়েই হিয়ার হুঁশ ফিরলো। একটু অবাক হ’য়েই চুপ হয়ে গেলো হিয়া। নিজমনে কি একটা চিন্তা করেই আঁতকে উঠে হিয়া টপ করে দাঁড়িয়ে গেলো। শিশির বললো” কি সমস্যা তোর সাইলেন্ট মুডে চলে গেলি কেনো হঠাৎ” হিয়া কপাল ভাঁজ করে,দাঁত মুখ খিঁচে চোখের ইশারায় বললো ফ্লোরো ওটা কে ঘুমোচ্ছে? শিশির আয়নায় মুখ দেখতে দেখতে স্বাভাবিক উওর করলো, উজান,কেনো? উজান নামের তিনটে বর্ণ কানে পৌঁছাতে চুপসে গেলো হিয়া। হিয়ার কলিজা টাকে আরো একটু শূন্য করতে উজান তার মুখ থেকে কাঁথা সরাতেই হিয়া খেলো শকড! উজানের চোখে চোখ পড়তেই একটা হাসি দিলো হিয়া। ইয়ে মানে হু হ্যা করতে করতেই এক দৌড়ে নিজের রুম থেকে ব্যাগ নিয়েই সোজা বেড়িয়ে গেলো সদর দরজা পেড়িয়ে লতাদের বাড়ির দিকে। হাতে তার এখনো রাবার ব্যান আর চিরুনি ঝুলছে!

!
!

শিশিরের থেকে বিদায় নিয়ে বাড়িতে ফিরলো উজান। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে যাবে ওমনি উপর থেকে নেমে আসা রোদকে দেখে থেমে গেলো দু’জনে। উজান ভূ কুঁচকে তাকালো রোদের দিকে। আজ রোদকে কেনো জানি একটু বেশি খুশিখুশি লাগছে।

– কি ব্যাপার এতো হাসতে হাসতে কোথায় যাওয়া হচ্ছে এ-ই সকালে?

রোদ আরো লজ্জা পেয়ে হেঁসে দিয়ে উওর দিলো,

– কোথাও না ভাই,ক্লাস আছে__তা হিয়ার সাদা বিলাই রাতে বুঝি খুব খাওয়া দাওয়া করেছিলো ও বাড়িতে?

-সরি!

– না মানে,নিজে না খেয়ে জামাকাপড়কে খাইয়েছিলে বোধহয়,দেখো কি রকম হলুদ হয়ে আছে পিঠের এদিক টা!

রোদের কথা অনুসরণ করে উজান ঘাড় বাকিয়ে দেখতে চেষ্টা করলো রোদ কিসের হলুদ লেগে থাকার কথা বলছে। দেখতে না পেয়ে শার্ট টা টেনে ধরলো সে। দাগ গুলো হালকা দৃষ্টিগোচর হলো তার। বোঝাই যাচ্ছে এটা কোন তেল জাতীয় কিছুর দাগ। সাথে কাসুন্দির কালো কালো ছাপ। ভূ কুঁচকে আসলো উজানের। রোদ হেঁসে দিয়ে নামতে নামতে বললো “বাড়িতে ঢুকে যা তাড়াতাড়ি বড় আব্বু এমনিতেও ক্ষেপে আছে তোর উপর খুব। আমি চললাম, টাটা” রোদ নেমে পড়তেই উজান উপরে আসলো। নিজের রুমে এসে প্রথমেই খুললো তার শার্ট। তাকে যে এখনি এ-ই হলুদ লেগে থাকার রহস্য ভেদ করতে হবে এ্যাট এনি কস্ট। শার্ট টা হাতে নিয়ে ভাবলো কালকের পুরো দিনের কথা। তাহলে কি শিশিরের বাড়িতে কাল। না কিন্তু। অনেক্ক্ষণ বাদে মনে আসলো হিয়াকে নিয়ে ফেরার সময় তো হিয়ার হাতে…সব হিসাব বুঝে আসতেই উজান রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালো তার হাতে রাখা শার্টের দিকে। না এ-ই মেয়েকে আজ একটা পানিশমেন্ট দিতেই হবে। সাদা বিলাই,হিটলার,জল্লাদ,রামগরুর ছানা তবে রে আজ দেখাচ্ছি মজা!

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here