চোখের_তারায়_তুই? #পর্ব_১২

0
887

?#চোখের_তারায়_তুই?
#পর্ব_১২
#ইভা_রহমান

রোদকে বাড়িতে ড্রপ করে দিয়ে উজান বললো তুই উপরে উঠতে থাক আমি বাইক টা পার্ক করে আসছি। রোদ ভেংচি দিয়ে বললো বাইক পাড় করেই চলে আসবি সিগারেট গিলতে আবার বাহিরে যাবি না কিন্তু। উজান রোদের মাথায় বারি দিয়ে বললো ভাগ এখান থেকে হেবলি। রোদ আআ বলে খেঁকিয়ে উঠে একটা ভেংচি কেটে লিফট বেয়ে উপরের আসলো। তাদের ফ্ল্যাটের দরজা খোলাই ছিলো বিধায় তাকে আর কলিংবেল পুস করতে হলো না। পায়ের হিল গুলো খুলে রোদ যেই নিজের রুমে ঢুকতে যাবে ওমনি রান্নাঘর থেকে উজানের মা’র সাথে তার মায়ের কিছু কথোপকথন কানে পৌঁছাতে থমকে গেলো সে। রাগে ঘেন্নায় সারাদিনের এতো আনন্দ মুহুর্তে মুছে দিয়ে ক্ষোভের মেঘ জড়ো করতে থাকলো তার আকাশ টা জুড়ে…

উজানের মা,বাসবি,কুচি কুচি করে কাটা পিঁয়াজ গুলোকে লাল করতে সেগুলোকে কড়াইয়ে দিয়ে রোদের মা’কে উদ্দেশ্য করে বললেন,

– বুঝলা মেহরিন তোমার মেজ ফুফুর সাথে কথা বললাম সেদিন,

– কি বিষয়ে ভাবি,,প্রিয়ন্তী আর উজানের বিষয় টার কথা বলছো?

– হুম,সোহেল নাকি সামনের বছরই দুবাই তে সেটেল করবে রিতা আর ওর ফ্যামিলি নিয়ে, তাই বললো যদি এ বছরের শেষে কিছু একটা ব্যবস্থা করা যায় তাহলে বোনের বিয়ে টা ভালো ভাবে দেখেশুনে ঠান্ডা মাথায় দিয়ে ওখানে সব গোছাতে পারবে..

– সে তো মেজ ফুফু সেবারো বলেছিলো তা তুমি আর কোথায় কথা বললে তোমার ছেলের সাথে,

– বলেছিলাম উজানকে একবার যে ওর পছন্দ আছে কি না তা ও তো কিছু বললো না,আর ওর বন্ধু বান্ধব সবার থেকে খোঁজ নিয়ে যা শুনলাম যে ওর নাকি সেরকম কোনো বান্ধবীও নেই তাই ভাবছি যে ওর বাবা যখন প্রজেক্ট টা শেষ করে বাড়ি ফিরবে তখন এ বিষয়ে কথা তুলবো,উনি অবশ্য জানেন তবুও উজানের তো একটা মতামত আছে বলো,

– সে ভাইয়ার কবে প্রজেক্ট শেষ হবে আর উনি আবার দেশে ফিরবে,এ্যান্গেজমেন্ট টা করিয়ে রাখলে ভালো হয় না!

– না,আসুক উনি আগে,আমার নিজে থেকে কিছু না বলাই শ্রেয়,আর উজান কিভাবে কথা টা নিবে ও যদি বলে যে ইন্টার্নি শেষ করার পর বিয়ে নিয়ে ভাববে তখন,

– সামনের বছর তো ফোর্থ ইয়ারে উঠছে তোমার ছেলে,তারপরের বছর ইন্টার্নি,সে আর বেশি তফাৎ কোথায়? শোনো ভাবি মেয়ে ভালো হাতে আছে দেখতে শুনতে সুন্দর,ব্রাক থেকে বিবিএ করছে,এমনকি তোমার ছেলে কে না ঔ সারাদিন পেশেন্ট নিয়েও পড়ে থাকতে হবে না তোমার ছেলেকে সারাজীবন বসে খাওয়াতে পারবে প্রিয়ন্তির বাবা,

– তোমার মনে হয় উজান সেই মেন্টালিটির ছেলে। আর আমাদেরো কিন্তু কিছু কম নেই,যে উজানকে শ্বশুর বাড়ি দিয়ে চলতে হবে।

– আমি কথাটা সেভাবে বলি নি ভাবি। ওরা সব দিক দিয়ে আমাদের ফ্যামিলির সাথে যায় তাই বোঝাতে চেয়েছি তোমাকে….আর তোমার ছেলেকে তো দেখি কি রকম লাইফ লিড করে সারাক্ষণ ঔ শিশির বলে ছেলে টার সাথে কি ওর,সময় সুযোগ পেলে তার দোকানে গিয়ে বসে আড্ডা দেয়,আর কি অবসর কাটানোর ওয়ে নেই কোনো ওর,

– এভাবে বলিস না মেহরিন,ওরা ছোট থেকে একই সাথে পড়াশোনা করেছে একই সাথে খেলেছে তাই থাকে একসাথে..আর শিশির ছেলে টা তো খারাপ না।

– শোনো খারাপ ভালো বিচারে আসতে চাই না,একটা ক্লাস থাকে যা তাদের নেই,আমার সিয়াম টাকে দেখো সেদিন ওর যে বন্ধু টা বাড়িতে আসলো সে কার ছেলে তুমি জানো,

আর সহ্য করতে পারলো না রোদ। নিজের মায়ের এই ধনী গরিবের ভেদাভেদ দেখে বুকটা চুপসে গিয়ে ছিঁড়ে আসছিলো তার,রাগে গটগট করতে রান্নাঘরে এসে ফ্রীজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতল বের করতে করতে রোদ বললো,

– না জানার কি আছে মা,রাফাতের সাথেই তো তোমার ছেলে প্রতি সপ্তাহে বারে গিয়ে মদ নেশা গিলে আসে তাই না,

হঠাৎই রোদের এরকম একটা কথা শুনে থমকে গেলো রোদের মা,রাগান্বিত চাহনিতে রোদের দিকে তাকিয়ে বললো,

– এসব কি ধরনের কথা রোদেলা..!

– কেমন কথা মা,শিশির গরীব বলে তুমি ওর ক্লাস নিয়ে কথা বললে আর নিজের ছেলে যে তার বন্ধুদের সাথে কিসব করে বের হয় সে কথা ভূলে গেলে জিনিসটা আজব না..

– একটা বাহিরের ছেলের জন্য তুমি তোমার মা’র সাথে তর্ক করছো রোদ,এই শিক্ষা পেয়েছো তুমি তোমার পরিবার থেকে..

– প্লিজ মা,আমি বুঝি না তোমার সমস্যা টা কোথায়,এর আগেও শিশির বাড়িতে আসলে আমি দেখেছি তুমি ওর দিকে কিরকম একটা দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে থাকো,কেনো করো ওরকম,ছেলে টা কতো পরিশ্রম করে তুমি জানো..বাবা নেই মা নেই তবুও নিজের ছোট বোনটাকে ক্যান্ট থেকে পড়াশোনা করাচ্ছে নিজের যোগ্যতাতে,আমি,উজান,ভাইয়া আমরা সবাই তো ক্যান্ট থেকে পড়াশোনা করেছি তুমি দেখোনি কিরকম খরচ লাগতো আমার আর ভাইয়াদের সেসময়,আর আমার থেকে শিশির কম কিসে দু’জনে পাবলিকে পড়ছি একই সাবজেক্টে,দোকান সামলিয়েও এবার শিশির ক্লাসে সবার চাইতে ভালো করেছে শুধু ওর বাবা মা নেই ভালো বাড়ি নেই এটাই কি ওর সমস্যা..

– তুমি এসব কথা আমাকে কেনো শোনাচ্ছো রোদেলা,সেই ছেলে কি করে তার বোনকে পড়ায় না নিজে পড়ে তা জেনে আমি কি করবো…আর তুমি আজকে সারাদিন কোথায় ছিলে,আর এসব শাড়ি পড়ে সেজেগুজে কোথায় ঘুরতে গিয়েছিলে তুমি?

– কেনো যাবার সময় বলে যা-ই নি আমি যে ভার্সিটিতে ফাংশন আছে আজ।

– তো এ-ই রাত দশটা অবধি ফাংশন হলো তোমার ভার্সিটিতে,আমাকে শেখাচ্ছো?

– দশটা অবধি ফাংশন কেনো হতে যাবে,আমরা মেলাতে গিয়েছিলাম,উজানো ছিলো সাথে, আসছে ও,

– ঔ ছেলে টাও ছিলো নিশ্চয়ই!

– হ্যা ছিলো কোনো সমস্যা।

সপাটে রোদের গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো তার মা। রোদের এ-ই নিজের রাগ টাকে কন্ট্রোল করতে না-পারার কারণ তার পরিবারের সবার একই রকম রাগের সমস্যা আছে। বিশেষত তার বাবা-র। রক্ত গুনেই রোদ এ-ই রাগ আর জিদ টা তার মাঝে পেয়েছে। তার উপর শিশিরকে নিয়ে তার মায়ের এরকম নিম্ন ধারণা রাগ টা যেনো আজকে একটু বেশি পাচ্ছিলো তার। তাই নিজের অজান্তেই তার মা’র সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়ে সে।

– বড্ড বাড় বেড়েছো তুমি রোদ,এমন কিছু ভূল করো না যাতে তোমার জন্য কোনো ছেলের জীবন টা নষ্ট করতে হয় তোমার বাবাকে,আর তুমি তো তোমার বাবার ক্ষমতা কতো তা ভালো করেই জানো,

মুহুর্তে চোখ দিয়ে দু ফোঁটা পানি বেড়িয়ে আসলো রোদের। বাসবি গ্যাসের সুইস টা বন্ধ করে দৌড়ে এসে রোদকে আগলে ধরলো তার বুকে।

– আহ মেহরিন কেনো শুধু শুধু এই কথা গুলো অহেতুক তুই ওকে বলছিস,ও কি কিছু করেছে বা বলেছে তোকে,আশ্চর্য!

– শোনো ভাবি তোমার ছেলে কার সাথে মিশে না মিশে এটা তুমি সামলাবে কিন্তু তার জন্য আমার মেয়ের জীবন নষ্ট করতে আমি কিন্তু দেবো না..আর তোমাকে বলছি পরশু বাবা বাড়িতে আসুক তোমার বিয়ের বিষয়ে কথা বলছি আমি,ইদানীং বেশি অবাধ্য হচ্ছো তুমি,ভুলে যেও না আমরা তোমার বাবা মা,তোমার যেটায় ভালো হবে তাই করবো কথা টা মনে রেখো…

বলেই রোদের মা নিজের রুমে চলে গেলেন। বাসবি রোদের কপালে স্নেহের পরশ বুলে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন কাঁদে না মা। মা কিচ্ছু বলে নি তো।

রোদ কান্না ভেজা মুখ তুলে বাসবিকে প্রশ্ন করলো,

– মা সবসময় এরকম ধনী গরিবের ভেদাভেদ কেনো তুলে আনে বড় আম্মু,এটা কি ঠিক তুমি বলো?

– মন খারাপ করে না মা,জানিসই তো তোর মা’র মাথা একটু গরম থাকে..আর তোকেও বলছি মা এমন কিছু ভূল করিস না যে তোর জন্য অন্য কাউকে সাফার করতে হয়,তুই তো তোর বাবাকে চিনিস তোর বড়আব্বুর চাইতেও রাগ কতো,ওরা তো তোকে কিছু বলবে না কিন্তু ছেলে ওনাদের মন মতো না হলে ওরা তার জীবন নষ্ট করে দিয়ে হলেও তোকে নিজেদের মতো করে রাখতে চাইবে..

– আর আমার খুশি টা,আমি যদি ভালো না থাকি ওদের সিদ্ধান্তে..আচ্ছা ওসব বাদ দেও আজ যদি উজান এরকম কিছু একটা ভূল করে ধরে আমাদের চাইতে কম আছে এরকম কারো সাথে জড়িয়ে পড়ে তখন তুমি কি করবে?

– কিসব বলছিস বল তো?

– না মানে আমি কথার কথা ধরতে বলছি,আচ্ছা হিয়ার কথাই ধরো যদি উজান এসে তোমাকে বলে যে মা আমি হিয়াকে বিয়ে করতে চাই তুমি আর বড় আব্বু কি করবে তখন?

– কঠিন প্রশ্ন করে ফেললি কি উওর দেই বল তো?

– কেনো বড় আম্মু আমি তো ভাবলাম যে তুমি সাথে সাথে উওর দিবে যে উজানের খুশিতে তোমার খুশি উজান যা চাইবে তাই হবে,তাহলে

– হ্যা কিন্তু

– কি কিন্তু বড় আম্মু তুমি কি হিয়াকে পছন্দ করো না,ভালোবাসো না হিয়াকে?

– মা রে মা,দেখ..হিয়াকে আমি ভালোবাসি,স্নেহ করি আদরো করি,হিয়ার মা আর আমার বাড়ি তো একই এলাকায় ছিলো আলাদা সম্পর্ক ছিলো আমাদের,কিন্তু একটা

– কি একটা বড় আম্মু বুঝাও সেটা আমাকে?

– আচ্ছা তুই আমাকে কখনো হিয়ার সাথে খারাপ ব্যবহার করতে দেখেছিস,হিয়া যখন বাড়িতে আসে আমি কি নিজ হাতে তোর সাথে ওকেও খাইয়ে দেই না বল,আদর করি না হিয়াকে,

-তুমি আমার কথা ঘুরাচ্ছো বড় আম্মু,আমি তো জানি তুমি হিয়াকে নিজের মেয়ের মতো করেই দেখে আসছো এতো গুলো বছর তাহলে সমস্যা টা কোথায় সেটা বলো আমাকে,

– হিয়া ভালো,নম্র,মিষ্টি কিন্তু সে এ বাড়ির বউ হবার জন্য যোগ্য না রোদ!

– বড় আম্মু( অস্ফুটে)

– তোর বড় আব্বুর যা আছে তার নূন্যতম হিয়াদের নেই,আর তুই তো জানিস এ-ই শাহরিয়ার ফ্যামিলিতে এ-ই জিনিস গুলোই সবার আগে খুতিয়ে দেখা হয়,তাদের মতে টাকার পাল্লায়,খ্যাতির পাল্লায় যার অংশ ভারী সেই বেশি মানানসই এই পরিবারের সাথে।

– তাই বলে..

– আমি নিজে মধ্যবিও বাড়ি থেকে এ পরিবারে এসেছি রোদ,এখন না হয় এ বাড়িতে আমরা আর তোর বাবারা থাকি কিন্তু তখন পুরো বাড়ি ভর্তি মানুষ ছিলো। তখন হয়তো তোর দাদু বাড়ির কেউ কখনো আমাকে গায়ে হাত তুলে কোনো আঘাত করে নি কিন্তু আকার ইঙ্গিতে তারা আমাকে যে কথা শুনিয়েছে সেগুলো কোনো আঘাতের চাইতে কম ছিলো না,তাদের ব্যবহার,তাদের চাহনি,তাদের তাচ্ছিল্য সব সহ্য করে আমি আমার পরিবারের কথা ভেবে এ বাড়ির খুঁটি আঁকড়ে ছিলাম। তাই ঔদিন গুলোর কথা ভাবলেই আমি চাই না হিয়া কেনো কোনো উচ্চ মধ্যবিও পরিবার থেকে আসা মেয়ে এ বাড়ির বউ হয়ে আসুক। বিশেষ করে ফ্যামিলির সব চাইতে বড় ছেলে উজান তার বউ হবে এরকম বাপ রে আমাকে তো জ্বালিয়ে খাবে খাবে সাথে সেই মেয়েকে যে এরা মিলে কি করবে না,এদের সাথে ঔ মদ নেশা গেলা হাই প্রোফাইলের মানুষ’ই যায় মা,অন্য কেউ না!

– তাই বলে তুমি পারবে উজানের সাথে এরকম মদ নেশা অহংকারী কাউকে জড়িয়ে দিতে?

– আমার কথা এ বাড়িতে কখনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি মা,এমনকি তোর মা’রও না এ বাড়িতে তোর বড় আব্বু তোর বাবা এরা যা সিদ্ধান্ত নিবে তাই হবে। আর সব বড়লোক ঘরের মেয়েই কি খারাপ হয় বল দেখি তুই তো কতো বড়লোক কিন্তু তোর মনের মতো সুন্দর মন আছে কারো..আমিও আমার রাজার জন্য তোর মতোই কাউকে ঠিক খুঁজে আনবো দেখিস। আর প্রিয়ন্তি কিন্তু তোর মতোই দেখেছি ওকে আমি। খুব ভালো লেগেছে ওর সাথে কথা বলে আমার। খুব মিশুক।

বাসবির থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে রাগ অভিমান সব এক করে রোদ নিজের রুমে যেতে যেতে বললো,

– প্রিয়ন্তীকে আমার একটুও ভালো লাগে না বড় আম্মু একটু ও না। ও কোনো মিশুক না ও একটা অহংকারী মেয়ে খুব চালাক।

!
!

পরের দিন কোচিং এসে ক্লাস রুমে ঢুকতেই লতা,মোহিনী,অর্পা সহ বাকি সবাই হিয়াকে দেখতে পেয়েই হিয়ার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে শুরু করলো,হিয়াকে গায়ের জোড়ে চেপে ধরে লতা ঝাঝাঁলো কন্ঠে বললো”শালি কালকে তোর জন্য আমরা মেহুর জন্মদিনটাও ভালো করে সেলিব্রেট করতে পারলাম না আর তুই গিয়ে উজান স্যারের সাথে মেলা ঘুরে আসলি,শয়তান মাইয়া” অনেক কষ্টে ফ্রেন্ডগুষ্টির হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে হিয়া একটা শ্বাস টেনে বললো আমি কি করতাম স্যারই তো নিয়ে গেলো জোড় করে,আর সাথে ভাইয়াও ছিলো বিশ্বাস কর। লতা হিয়ার মাথায় বারি দিয়ে বললো,করলাম বিশ্বাস আর এটাও বুঝলাম কি চলছে তোমার আর স্যারের মাঝে হু। ভূ কুঁচকে আসলো হিয়ার কি চলছে মানে! লতা ফোড়ন কেটে বললো ” কি চলছে তুমি বুঝো না না কচি খুঁকি আমাদের,উজান স্যার যে তার সব কিছু তোমার মাঝে ডুবাতে বসেছে সে কি আর আমাদের না জানতে” লতার কথায় বিষম খেলো হিয়া। লতাকে ধাক্কা দিয়ে গা থেকে ছাড়িয়ে বললো,

-মাথার স্ক্রু কি পুরোটাই ঢিলে হয়ে গেছে তোর লতা,কিসব পাগলের বিলাপ পাড়ছিস সে বিষয়ে কোনো ধারণা আছে তোর?

লতা ভেংচি এঁটে বললো,

– না থাকার কি আছে। উজান স্যার যে তোকে চোখে হারায় এই কথা টা অস্বীকার করতে পারবি তুই?

– মানে…যা তো ইদানীং বড্ড বাজে বকছিস তুই। তোর মনে হয়,যে উজান স্যার আমাকে সবসময় বকে ধমকায়,একটুতে রাগ করে সেই মানুষ টা আমাকে ভালোবাসবে?

-হ্যা রে হ্যা সেই মানুষ টা-ই তোকে ভালোবাসে। আর শুধু সেই মানুষ টা না তুই নিজেও তাকে তোর মন প্রাণ কলিজা কিডনি হার্ট লিভার পাকস্থলি সব দিয়ে ভালোবাসিস বুঝলি,

লতার কথায় সবাই হো হো করে হেঁসে দিলো,হিয়া বিরক্ত চাহনি তে বললো,

– যা তো ফাজলামো করিস না। আমি কোনোদিন স্যারকে ঔ নজরে দেখি নি। স্যার কেনো কোনো ছেলের উপর’ই সেরকম কোনো ফিলিংস কোনোদিন জন্মেনি আমার,

– তাহলে উজান স্যারকে জড়িয়ে ধরে তুই ওরকম কান্না করলি কেন। সে তো স্যার হয় তুই যে রাগে ওনাকে মারলি এটাকে কি বলবি তুই।

– আরে আশ্চর্য তো,ওটা হ’য়ে গেছে। কতোবার বলবো আমি নিজের মধ্যে ছিলাম না তখন।

মোহিনী হিয়ার গলা জড়িয়ে বললো,

– তুই নিজের মধ্যে থাকলেও সেই একই কাজ করতি হিয়ারানী। আচ্ছা একটা কথা বল তো তুই যখনই কোনো বিপদে পড়িস তোর সবার আগে কার কথা মাথায় আসে শিশির ভাইয়াকে বাদ দিয়ে বল দেখি,

– ভাইয়াকে বাদ দিয়েএএএ উজান স্যার।

– তুই মোনাজাতে তোর আম্মুআব্বু ভাইয়া ছাড়া আর কার জন্য আগে দোয়া করিস বল?

– কার জন্য আবার রোদ আপু সাথে উজান স্যার সবার জন্য করি,

– তাহলে বুঝ।

– কি বুঝবো,আজব!

– এটাই যে তুই উজান স্যারকে ভালোবাসিস আর আমার তো মনে হয় তোদের মাঝে ইটিসপিটিস কিছু চলছে ভেতরে ভেতরে যা আমরা জানি না..

– তোরা কি চুপ করবি প্লিজ, না আমি এখন তোদের সবার গলা চিপে ধরবো কোনটা…আচ্ছা একটা কথা বল তো উজান স্যারের সাথে আমার যায়। ওনারা কোথায় আর আমরা কোথায়। জানিস আগে যখন বাস্তব টা বুঝতাম না তখন আমি খুব করে চাইতাম রোদ আপু আমার ভাবি হয়ে আসুক তখন ভাইয়া আমাকে সবসময় কি বলতো জানিস ধুর পাগলি তোর রোদ আপু যায় আমার সাথে। আমি তখন বুঝতাম না ভাইয়ার কথাটা’র মানে। বড় হবার সাথে সাথে উপলব্ধি করলাম ভাইয়া কেনো কথা টা বলতো। তাই এখন আর সেরকম কোনো ইচ্ছে জাগে না মনে। আর তোরা বলছিস কি না উজান স্যার আর আমি হাসালি মোহিনী,

– তুই যাই বলিস হিয়া,ভালোবাসতে গেলে এসব মাথায় থাকে না। লতা আর ফয়সালের কথা-ই ধর যদি ধনী গরিবের ভেদাভেদ করিস তাহলে ফয়সালের বাবা কোনোদিন ই লতাকে নিজের ছেলে হিসাবে মেনে নিতে চাইবেন না তবুও কি ওদের ভালোবাসা কখনো থেমে ছিলো না এখনো আছে। ভবিষ্যৎ না ভেবেই কিন্তু ওরা চার বছর ধরে এক সাথে আছে।

– লতার বিষয় টা আলাদা মেহু। সেখানে আমি আর উজান স্যার!

– কোনো আলাদা না। আচ্ছা তুই এ-ই কয়দিন একটু ঠান্ডা মাথায় ভাব দেখবি তুই ঠিক তোর মনের ভালোবাসা টাকে খুঁজে পাবি,দেখবি তোর মন কি চায়। তোর মনে যদি ভালোবাসার ঘন্টা না বাজে তাহলে আমার নামো মোহিনী না।

হিয়া মোহিনীর মাথায় গাট্টা দিয়ে বললো,

– এটা দেবের পাগলু ২ পাস নি যে ভালোলাগলে মনের মধ্যে ঢং ঢং ঘন্টা বাজবে ডাফার। বাস্তবে ফিরে আয়,

– বুঝবি বুঝবি যেদিন সত্যি ঘন্টা বাজবে ঔদিন ঠিক বুঝবি।

– হুম বুঝবো,চল তো এখন আজাইরা প্যাঁচাল।

!
!

লতা আর মোহিনীর প্রেমবিদ্যা মাথায় ঢোকার পর থেকেই হিয়ার মন উথালপাথাল ঢেউয়ের শেষ পর্যায়ে গিয়ে বারি খেয়ে আবার স্রোতের টানে কূলে এসে আছড়ে পড়তে থাকলো। তাদের কথার নেশা যে এমন ভাবে হিয়াকে গ্রাস করবে এটা সেই মুহুর্তে হিয়া আন্দাজো করতে পারে নি। আজ এক সপ্তাহ ধরে না হিয়া ঠিক মতো খেতে পারছে না পড়তে পারছে না ঘুমোতে পারছে। গল্পের বই নিয়ে শুধু পাতা উল্টিয়ে যাচ্ছে,মনে শুধু একটাই প্রশ্ন ঘূর্ণিপাকের মতো ঘুরপাক খাচ্ছে তার,উজান স্যার কি সত্যি তাকে ভালোবাসে! আচ্ছা ভালোবাসা মানে কি, ভালোবাসা মানে কি ঔ দুটো ছেলে আর মেয়ের মাঝে যা হয় তাই। যাকে লোকে প্রেম বলে আখ্যায়িত করে। ভালোবাসা মানে কি সেই প্রেম যেই প্রেমের জন্য সালেহা আপার ছোট মেয়ে তার ছোট বেলার খেলার সাথী হৈমন্তী আপু গলায় দড়ি দিয়েছিলো। ভালোবাসা মানে কি সেই প্রেম যার জন্য রাহাত ভাইয়া লিসা আপুকে বিয়ের আগের দিন রাতে বাড়ি থেকে নিয়ে পালিয়েছিলো। ভালোবাসা মানে কি সেই প্রেম যার জন্য তন্নি আপুকে তার পরিবার তাজ্য ঘোষণা করেছিলো..!!

আর ভাবতে পারে না হিয়া। উজানের সাথে কাটানো আজ অবধি প্রত্যেকটা মুহুর্ত তার চোখের সামনে জ্বলন্ত শিখার মতো জলজল করতে থাকে। না চাইতেও হিয়া উজানের দিকে এক অদ্ভুত মায়াবী দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো এ কয়েকদিন। তাকিয়ে থেকে বুঝতে চেষ্টা করছিলো উজানের মুখের ভঙ্গি, পড়তে চেষ্টা করছিলো উজানের চোখের ভাষা। ধুর এসব কিসের পোকা ঢুকিয়ে দিলো লতা আর মোহিনী তার মাথায়। এই পোকা যে বড্ড যন্ত্রণা দিচ্ছে হিয়াকে। এ-ই পোকা যে তার পুরো বিষ হিয়ার প্রত্যেকটা নিউরনে আঘাত দিয়ে বারবার বলছে এটাই ভালোবাসা হিয়া। এটাকেই ভালোবাসা বলে!

গল্পের বই টা বন্ধ করে রুমের লাইট বন্ধ করে দিয়ে হিয়া বিছানার দেওয়াল ঘেঁষে বসলো। মাথার কাছে জানালা টা খুলে দিয়ে বালিশের ভেতর থেকে সেই দামি ছবিটা হাতড়ে দু’হাতের তালুতে শক্ত করে ধরে জানালার ধার ঘেষে গ্রীলে মাথা দিয়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো হিয়া। মুখে রোদ পড়ায় পর্দা টা মেলে দিলো হালকা,

– এটা কিসের পোকা আমার মাথায় ঢুকিয়ে দিলো লতা আর মোহিনী মিলে মা। আমি যে কিছুতেই আর সেই চিন্তা থেকে বেরুতে পারছি না। ওরা পাগল তাই না বাবা। এটা কি আদ্যৌও সম্ভব আমার আর উজান স্যারের মাঝে! ওরা আমার সাথে মজা করছে তাই না বলো। কিন্তু আমার মন কেনো বারবার ওদের মজা টাকেই সত্যি বলে মনে হচ্ছে মা৷ উজান স্যারের জন্য আমার যা অনুভূতি সেটাকে কি সত্যি ভালোবাসা বলে..কিন্তু আমি তো কোনোদিক দিয়েই ওনার সাথে যাই না। আআআআ মনে হচ্ছে লতা আর মোহিনীর চুলে পেট্রোল ঢেলে ওদের মাথায় আগুন জ্বালিয়ে দেই,বেয়াদব গুলো। আমি এখন কি করবো আমার যে কিছুতেই কিছু করে শান্তি আসছে না!

হতাশার এক দীর্ঘ শ্বাস ফেললো হিয়া। জানালা দিয়ে বাহিরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজের বা হাত টার দিকে তাকিয়ে উঠলো সে। এ-ই হাত টাই তো সেদিন উজান চড়কিতে ওঠার সময় শক্ত করে চিপে ধরে রেখেছিলো তার..!

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here