বোবা_প্রেম
পর্ব-৪
লেখক : Riyad Ahmod Bhuiya
নানু যখন বললেন,
“তোমার মামা এবার তোমার শশুর হতে চলেছেন!”
নানুর মুখে একথা শুনে কি যে আনন্দ লাগছিল আমার তা বলে বুঝাতে পারবনা। মন চাইছিলো রাস্তার মাঝেই নাচতে শুরু করি! আমার মামা বিয়ে করেছিলেন আমি যখন ক্লাস ওয়ানে পড়ি তখন। এরপর যখনই নানার বাড়ি যেতাম তখনই আমাকে দেখে মামী বলতেন, ‘আমাদের জামাই চলে এসেছে’, আমার মাও বলতেন, ‘যদি মামার কোন মেয়ে হয় তাহলে নাকি আমার সাথে বিয়ে দিবেন!’, কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, দেখতে দেখতে তাঁদের বিয়ের এক যুগ কেটে গেলেও কোন সন্তানের মুখ দেখার সৌভাগ্য তাঁদের হয়নি। অবশেষে আল্লাহর অশেষ কৃপায় এখন তাঁদের কোলে সন্তান আসতে চলেছে!
নিজেকে সামলে নিয়ে এবার নানুকে জিজ্ঞেস করলাম,
-তা, আমাকে এতদিন বলোনি কেন?
নানু বললেন,
-সংশয়ে ছিলাম আমরা। আজকেই আল্ট্রাসনোগ্রাফি করে এসেছে। ডাক্তার সবকিছু বুঝিয়ে বলে দিয়েছে। বলেছে, সবকিছু ঠিক আছে। আল্লাহর দয়ায় আর কোন সমস্যা না হলে চিন্তার কোন কারণ নেই।
আমি বললাম,
-আলহামদুলিল্লাহ্!
আমি এবার ভাবলাম, এই খুশির মাঝেই যদি তানহার বিষয়টা বলে দিই তাহলে কেমন হয়! নানুকে এবার বললাম,
-নানু, একটা জরুরী কথা ছিল। বলব কি?
নানু বললেন,
-বলো কি কথা!
আমি বললাম,
-এখানে আমি একটি মেয়েকে পছন্দ করেছি। মেয়েটি এবার এসএসসি দিবে। ওর মায়ের সাথেও কথা হয়েছে। এখন উনি আমার গার্জিয়ানের সাথে কথা বলতে চেয়েছেন। তুমি একটু বিষয়টা মামাকে বুঝিয়ে বলোনা!
নানু বললেন,
-তা, মেয়ের বাবা আছেন কি?
আমি বললাম,
-নাহ, বাবা নেই।
নানু বললেন,
-মেয়েটা কেমন?
আমি বললাম,
-ভালো।
নানু বললেন,
-মেয়েটার সাথে আমাকে কথা বলিয়ে দিতে পারবা?
আমি আর কোন উত্তর দিতে পারছিলামনা। আমার কোন উত্তর বা পেয়ে নানু জিজ্ঞেস করলেন,
-রিয়াদ, কি হয়েছে তোমার? কথা বলছোনা যে!
আমি বললাম,
-নানু, একটা কথা তোমাকে বলা হয়নি।
নানু বললেন,
-কি কথা?
আমি বললাম,
-নানু, মেয়েটি আসলে….
এই বলে থেমে গেলাম আমি। নানু এবার ক্ষেপে গেলেন। ধমক দিয়ে আমাকে বললেন,
-মেয়েটি আসলে কি?
আমি বললাম,
-মেয়েটি আসলে কথা বলতে পারেনা।
নানু বললেন,
-কথা বলতে পারেনা মানে কি?
আমি বললাম,
-কথা বলতে পারেনা মানে কোন কথাই বলতে পারেনা ও। বোবা।
আমার কথা শুনে নানু বললেন,
-মেয়েটি না হয় বোবা, তুমিও কি বোবা?
আমি একটু নিচু স্বরে বললাম,
-নাহ।
এবার নানু বললেন,
-মেয়েটি বোবা হোক আর যাইহোক, বিয়ে করবে তুমি, তোমার যদি তাকে পছন্দ হয়, তাকে নিয়ে সংসার করতে যদি তোমার কোন আপত্তি না থাকে তাহলে এত আমতা আমতা করছো কেন?
কথাগুলো বেশ জোড়েই বললো নানু। এমন সময় শুনতে পেলাম ওপাশে মামা জিজ্ঞেস করছেন, ‘কে বোবা? আর কি হয়েছে?’ আমাকে লাইনে রেখেই নানু মামাকে বলে ফেললেন, ‘এই যে তোর ভাগিনা, একটি মেয়েকে পছন্দ করেছে। মেয়ের মায়ের সাথেও কথা বলেছে। উনি রাজি। এখন মেয়েটি বোবা বলে ও সাহস পাচ্ছেনা তোকে কিছু বলতে! এরকম বোকা কি হয় কেউ বলতো? বিয়ে করবে সে, বউকে নিয়ে থাকবেও সে, আমাদের কাজ তো যতদিন বেঁচে আছি ওদেরকে ছায়া দিয়ে রাখা। এটা নিয়ে ভয় পাবার কি আছে বল?
নানু তো মামার কাছে পারমিশন চাইলোনা বরং মনে হলো, আমেরিকা কর্তৃক জাপানের হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমা ফেলার মতো করে সবগুলো কথা মামার মগজে ঢুকিয়ে দিলো! ওপাশ থেকে মামার আর কোন কথা শোনা গেলনা।
এবার আমি নানুকে বললাম,
-নানু…উউউউউ…., ও নানু….উউউউ…, কি হবে এখন?
নানু বললো,
-কি আবার হবে! শুনোনি, তোমার মামাকে সবকিছু কি করে বলে দিলাম। আমি ওকে কালই পাঠাচ্ছি। তুমি নিশ্চিন্ত থেকো!
নানুর মুখে এমন কথা শুনে বললাম,
-নানু, একটা কথা বলব!
নানু বললো,
-হুম, বলো!
আমি বললাম,
-তুমি আসলেই আমার নানু….উউউউ…..।
এবার নানু আমার কথা শুনে হেসে উঠলেন। বললেন,
-কি করে কি হবে না হবে সবকিছু কাল শেষ করে ফেলো। আর পরের বাকিসব আল্লাহ্ যদি আমাকে আর কিছুদিন হায়াত দেন তাহলে সেটা ঠিক করে দিবনে।
আমি বললাম,
-আচ্ছা ঠিক আছে নানু, রাখছি তাহলে!
নানু বললেন,
-আচ্ছা।
ফোনটা রেখে দিলাম। এবার চলে এলাম বাসায়। আজ কেমন যেন অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে। সবকিছুই ভালো লাগছে আজ। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আগে কোনদিন নিজেকে দেখিনি। দেখিনি, মাথার চুলগুলো কিভাবে থাকলে আমাকে ভালো দেখায়। দেখিনি, হাসির সময় ঠোঁট নড়চড় করলে ভালো লাগে নাকি নড়চড় না করলে! হাঁটলে আমাকে কেমন দেখায় তা নিয়েও এর আগে কোনদিন গবেষণা করিনি। আজ এসব করতে মন চাইছে। উঠে গিয়ে এবার আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। নাহ, চুলগুলো আরেকটু ছোট করে রাখলে ভদ্র দেখাবে। হাসিটা তো দেখছি ঠিকই আছে। আরে বাহ! আমার হাসি যে এত সুন্দর আগে তো কোনদিন খেয়ালই করিনি! নাহ, তানহা ছাড়া আর কারোর সামনে এমন হাসি ভুলেও দেয়া যাবেনা।
আজব তো! আয়নার সামনে থেকে নিজেকে সরাতেই পারছিনা। একবার চুল দেখি। একবার মুচকি হাসি দিই। একবার দাঁতের কিছু অংশ বের করে হাসি। একবার হেঁটে দেখি কেমন দেখাচ্ছে। এসব আজব আজব কাজ করেই চলেছি আমি। এমন সময় কল আসলো একটা। ফোনটা বিছানায় রাখা। হাতে নিয়ে দেখি মামা কল দিয়েছেন। রিসিভ করলাম আমি,
-আসসালামুআলাইকুম।
মামা বললেন,
-ওয়ালাইকুমুসসালাম। কি করছিস এখন?
আমি বললাম,
-এইতো মামা শুয়ে আছি।
মামা বললেন,
-আয়নার সামনে কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলি?
মামার কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম আমি। আমতা আমতা করে বললাম,
-না মানে… মামা….।
এবার মামা বললেন,
-হয় রে হয়, এমন হয়। তোর মামীকে দেখে আসার পর তো আমি দরজা লাগিয়ে আয়নার সামনে দু’ঘন্টা যাবৎ নিজের স্টাইল ঠিক করেছিলাম। তুই তো আমারি ভাগিনা। তা করবিনা সেটা কি হয় নাকি! শোন, তুই তো আবার টিউশনি করিস। সময় করে আমাকে ফোন দিস চলে আসবনে। এখন রাখছি। কাজ আছে।
আমি বললাম,
-আচ্ছা মামা।
মামা ফোন রেখে দিয়েছেন। মামা আমাকে এভাবে এসব বলবেন তা স্বপ্নেও কখনো ভাবিনি। এক লাফে গিয়ে বিছানার উপর উঠে গেলাম। শুরু করলাম নাচ। নাহ, এটাকে নাচ বলেনা, ভিমরুলে কামড়ালে যেমন মানুষে নাচে তেমন নাচ। আর এমন নাচই নাচলাম যে, রাতে আমাকে মেঝেতে বিছানা করে ঘুমোতে হয়েছিল।
সকাল থেকেই আজ আমি বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছি। থাকবো নাইবা কেন? আজকেই যে তানহার সাথে আমার বিয়ের আলাপ পাকাপাকি হতে চলেছে! দুপুরে আসলাম রুবিদের বাসায়। আমাকে দেখে রুবি বললো,
-স্যার একটা কথা বলবো?
আমি বললাম,
-হ্যা বলো!
ও বললো,
-আপনাকে দেখে না আজ জামাই জামাই লাগছে!
আমি ওর কথা শুনে কিছুটা লজ্জা পেলেও মুখের হাসি দিয়ে সেটা কাটিয়ে উঠলাম। বললাম,
-হয়েছে হয়েছে, স্যারের প্রশংসা করে আর পড়ায় ফাঁকি দেয়ার ধান্ধা করতে হবেনা।
পড়ানো শুরু করলাম ওদের। পড়াচ্ছি এমন সময় রুবির মা আসলেন। আমাকে দেখে বললেন,
-কি ব্যাপার রিয়াদ, তুমি কি কোথাও যাবে নাকি?
আমি বললাম,
-জ্বী। যাব।
উনি বললেন,
-কোথায়?
আমি বললাম,
-আজকে এক জায়গায় মেয়ে দেখতে যাবো।
উনি বললেন,
-তাই নাকি! এটা তো খুশির সংবাদ। তা মেয়ের বাসা কোথায়?
আমাদের কথাগুলো হা করে শুনছিলো রুবিরা। এটা দেখে রুবির মা বললেন,
-তোমরা এখন নিজেদের রুমে যাও। আজকে স্যারকে ছেড়ে দাও।
ওরা তো মহা খুশি। ওরা চলে গেলা বইখাতা নিয়ে। এবার উনি বললেন,
-হুম, মেয়ের বাসা কোথায়?
আমি বললাম,
-মেয়েটিকে আপনি চেনেন।
উনি আমার কথা শুনে অবাক হয়ে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
-আমি চিনি! কার কথা বলছো?
আমি বললাম,
-আপনাদের এখানে যে ছিল দুমাসের মতো। তানহা। তানহাকেই দেখতে যাব।
উনি এবার আরো অবাক হয়ে গেলেন। বললেন,
-তানহা তো বোবা। সব জেনেও কি করে তুমি এমন ডিসিশন নিলে?
আমি বললাম,
-দেখুন, আসলে মানুষকে মহান আল্লাহ্ তাঁর আঠারো হাজার মাখলুকাতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ট মাখলুক হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। এরমধ্যে কেউ কালো, কেউ সাদা, কেউ লম্বা কেউ বেঁটে। অনেকেই আবার লুলা-ল্যাংড়াও হয়। কেউ হয় অন্ধ আবার কেউ হয় বোবা। এগুলো কি তারা ইচ্ছে করেই হয় বলুন!
উনি বললেন,
-নাহ।
আমি বললাম,
-আমি পড়াশোনা করেছি এবং এখনো করছি। একজন মানুষের বাহ্যিক সৌন্দর্য হয়ত আমাদেরকে সাময়িক সুখ দেয়। মনে তৃপ্তি দেয়। কিন্ত একজন মানুষের ভেতরের সৌন্দর্য আমাদেরকে সারাজীবন সুখে থাকতে সাহায্য করে। যাদের মন ভালো তাদের আত্মার বন্ধনগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী হয়। কঠিন ও মজবুত হয়। আমি আবার এটা বলছিনা যে, যারা সুস্থ এবং সুন্দর তাদের বন্ধন শক্ত হয়না বা তাদের মন ভালো হয়না। তবে বিশ্বাস করুন, ওকে বিয়ে করতে পারলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করব।
এবার উনি বললেন,
-একটা কথা বলি!
আমি বললাম,
-জ্বী, বলুন!
উনি বললেন,
-তানহা সত্যি খুব ভালো মেয়ে। আমারো মনে হয়, ওকে বিয়ে করলে তুমি সত্যিই খুব সুখী হবে। তুমি একটু বসো, আমি আসছি।
কথাগুলো বলে উনি নিজের রুমের দিকে চলে গেলেন। আমি চুপচাপ বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পরই উনি আসলেন। আমার দিকে কাগজে মোড়ানো কিছু একটা বাড়িয়ে দিলেন। জিজ্ঞেস করলাম,
-কি এগুলো?
উনি বললেন,
-এখানে কিছু টাকা আছে রেখে দাও।
আমি বললাম,
-আমার তো মাস শেষ হয়নি এখনো।
উনি বললেন,
-তোমার মা যদি টাকাগুলো দিতো তাহলে কি নিতেনা?
আমি আর কিছু বলতে পারলামনা। হাতে নিলাম টাকাগুলো। উনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসছি এমন সময় উনি পেছন থেকে ডাক দিলেন। থেমে গেলাম আমি। পেছনে তাকাতেই উনি বললেন,
-যদি সমস্যা হয় তাহলে কালকেও এসোনা। দুদিন ছুটি কাটাও। আর কি হয় না হয় আমাকে জানায়ো।
আমি মুচকি হেসে উনাকে বললাম,
-আচ্ছা, জানাবনে।
ফুটপাত ধরে হাঁটছি। সামনে পেছনে কাউকে দেখা যাচ্ছেনা। রাস্তা একদম ফাঁকা। টাকাগুলো গুণে নিলাম একবার। একি! পুরো দশ হাজার টাকা! টাকাগুলো পকেটে রাখতে রাখতে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম,
‘আল্লাহ্, তুমি সত্যিই মহান! তোমার লীলা বুঝার সাধ্য কারোর নেই। সত্যিই তুমি মহান।’
মামাকে ফোন দিয়ে বললাম চলে আসতে। আমাদের বাড়ি আবার বেশি দূরে নয়। সিএনজি দিয়ে আসলে দেড়-দুঘন্টার মধ্যে আসা যায়। এবার চলে আসলাম ঐ রেস্টুরেন্টে। সময়টা তো কাটাতে হবে।
আমাকে দেখেই রাকিব ছুটে এলো৷ বললো,
-আরে স্যার, আইছেন আপনি! আসেন আসেন!
আমি চুপি চুপি ওকে বললাম,
-তুমি কি শুধুমাত্র টিপস পাবার জন্য এসব করো?
ও বললো,
-কি যে কন স্যার! এইখানে কাজ করি আইজ দুই বছর। এর মইধ্যে আপনার মতো কেউ এত ভালা কইরা কথাও কয়নাই আমার লগে। কোনকিছু উনিশ-বিশ অইলেই বাপ-মা তুইল্যা গালি দেয়। ট্যাকার জন্যেই মানুষ সবকিছু করেনা স্যার। আপনি ভালা মানুষ। ভালা ব্যবহার করেন তাই আপনারে ভালোবাইসাই এইসব করি।
আমি ওর কথার কোন উত্তর দিতে পারলামনা। খেয়াল করলাম ওর জামাটা একটু ছেঁড়া। বললাম,
-জামাটা সেলাই করোনা কেন?
ও বললো,
-আরেকবার ছুটিতে বাড়ি গেলে মায়ের হাতে সেলাই করাইয়া আনুম।
আমি বললাম,
-তোমার কি রংয়ের শার্ট পছন্দ?
ও বললো,
-লাল রংয়ের। ক্যান স্যার?
আমি বললাম,
-কিছুনা। যাও, এক কাপ চা নিয়ে এসো!
ও চলে গেলো চা আনতে। আমি ভাবতে লাগলাম, ‘
‘দুনিয়াটা আসলে কতইনা অদ্ভুত! আজ যদি আমি ওর জায়গায় থাকতাম তাহলে?’ শুধু আমি কেন, আপনিও তো ওর জায়গায় থাকতে পারতেন!
——চলবে——
৩য় পর্বের লিংক –