ফুল_ফুটেনি_এই_বসন্তে,০২,০৩

0
369

#ফুল_ফুটেনি_এই_বসন্তে,০২,০৩
#ফারজানা_আক্তার
০২

অনুভূতিহীন হৃদয় নিয়ে খোলা চুলে দাঁড়িয়ে দেখছি আমার স্বামী কে তার নতুন স্ত্রীর পাশে কেমন মানিয়েছে। মেয়েটার মুখটা দেখা গেলোনা। কিন্তু গায়ের গঠন দেখতে একদম বাচ্চা বাচ্চা লাগছে মেয়েটাকে। তবে স্পষ্ট ভাবে দেখা গেলো আয়ানের মুখটা। ওর মুখের ঝলক দেখে মনে হলো বিশ্বযুদ্ধ জয় করে ফিরেছে। মনে হলো যেনো অনেকদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটেছে। মেঘলা আকাশে তাঁরার ছিটেফোঁটাও নেই। বর্ষা যেয়ে শরৎ আসলেও বৃষ্টি এখনো হয় টুপটাপ মাঝে মধ্যে। বৃষ্টির আগমণ হওয়ার আগেই চট জলদি নতুন বউকে ঘরে বরণ করে নেওয়া হয়। আমাকে পুরো ঘরে না দেখে সবাই মনে করবে হয়তো আমি চলে গিয়েছি বাপের বাড়ি। কিন্তু আদৌও কি সকল মায়া কাটিয়ে চলে যেতে পারবো আমি? প্রশ্নটা থেকেই গেলো। অন্তরীক্ষে তাকিয়ে ভাবছি পৃথিবীতে কিছু মানুষের জন্ম হওয়াটাও হয়তো অভিশাপ। হৃদস্পন্দন কাঁপুনি দিয়ে উঠছে বারংবার। কারো উপর কোনো অভিযোগ না রেখে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে এই মৃদু বাতাসের সাথে। আমার ননদ খোঁজাখুঁজি করতে করতে আমায় ছাঁদে চলে এসেছে। এসেই আমাকে কর্কশ কন্ঠে বললো “জানতাম যাবেনা এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও, থেকেই যাবে বেহাইয়ার মতো তবুও। ভাইয়া যে কেনো তোমায় ডিভোর্স দিচ্ছেনা কে জানে।”
আমি কিছু বললাম নাহ শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ওর থেকে নজর ফিরিয়ে নিয়েছিলাম। কতটা নিষ্ঠুর হৃদয়ের হলে একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়েকে এমন ধা’রা’লো বাক্য দিয়ে খু’ন করতে পারে? বুঝতে পারছি এই ঘরে আশ্রিতা এখন আমি আর সবার মাথার উপর বোঝা। আমার ভাবনায় ছেদ পড়লো আমার ননদ মাহির কথায়। গজগজ করে সে বলল “এতো রাতে এখানে দাঁড়িয়ে থেকে নিজের ম’রা চেহারা পাড়া প্রতিবেশী কে দেখাতে হবেনা আর। নিচে চলো নতুন বউকে বাসরে বসিয়ে আসবে তুমি।” কলিজা কেঁপে উঠে আমার হুট করে মাহির মুখে কথাটি শুনে। শেষ পর্যন্ত আমাকে দিয়ে এটাও করানো হবে ভাবতে পারিনি। আমি যে আয়ানের চোখের দিকে তাকাতে পারবোনা আর, আমি যে বড্ড বেশি দূর্বল ওই মানুষটার প্রতি। মানুষগুলো কেনো এমন করছে আমার সাথে? আমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেই তারা শান্তুি হবে বুঝতে পারছি কিন্তু আমি যে বেইমানি করতে পারবোনা সে মানুষটার সাথে যে মানুষটাকে জীবনের নয়টা বছর প্রাণ উজাড় করে ভালোবেসেছি। আমি মানুষটাকে কথা দিয়েছিলাম সে ভুলে গেলেও ভুলে যাবোনা আমি, তাকে ছেড়ে কখনো যাবোনা কোথাও। কিন্তু মাহির কথা ভাবতে গেলেই মাথায় আসে ও তো যুক্তির কথায় বলেছে। আয়ান দ্বিতীয় বিয়ে করার জন্য এক্সাইটেড হলেও আমাকে ডিভোর্স দেওয়ার কথা মুখে একবারও উচ্চারণ করেনি। তাহলে কি আয়ান এখনো ভালোবাসে আমায়? না তা কখনোই সম্ভব না, ভালোবাসলে কখনোই আমাদের মাঝে তৃতীয় কাউকে আনতে পারতো না। ভালোবাসলে আমার চোখের নিচের কালি শুষ্ক ঠোঁট এলোমেলো চুল দেখেও সে এতোটা শান্ত থাকতে পারতো না। বিয়ের পর প্রথম বার যখন আমার পিড়িয়ড হয় তখন আয়ানের পাগলামী দেখে আমি মনে করেছিলাম হয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী ব্যক্তি আমি। আমি যখন আয়ানকে বলেছিলাম এই ব্যাথা টা অস্বাভাবিক কিছুনা, দুইদিন থেকে চলে যাবে। তখন কিছুটা শান্ত হলেও আয়ান আমার জন্য ঔষুধ আনতে ভুলেনি, এমনকি নিজে পানি গরম করে ব্যাগে ভরে নিজ হাতে আমার পেটে গরম পানির ব্যাগটা হালকা চেপে ধরে বসেছিলো যতক্ষণ আমার ব্যথা স্বাভাবিক হয়নি। আর এখন আমি যে এতোটা যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি তা দেখেও না দেখার মতো হয়ে বেশ স্বাভাবিক ভাবে সে চলাফেরা করছে। পৃথিবী টা বড্ড বেশি স্বার্থপর। আঁচমকায় কাছের মানুষগুলো দূরে চলে যায়।
আমাকে নিচে যেতে বলেই মাহি চলে গেলো। কিন্তু বিন্দু পরিমাণ ইচ্ছে করছে না আমার এই মুহুর্তে নিচে যেতে। তবুও পা বাড়ালাম, ড্রয়িং রুমে আসতেই পা থমকে গেলো আমার। চোখের সামনে নিজের স্বামীকে অন্যকারো সাথে কোনো মেয়েই স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে পারেনা হোক না অন্য মেয়েটাও সেই মানুষটার দ্বিতীয় স্ত্রী। সবাই নতুন বউকে নিয়ে মেতে আছে সারা বাড়ি জুড়ে। মাহি আয়ান আর ওর নতুন স্ত্রী নয়নাকে কাপল পিক তোলার বিভিন্ন পোজ শিখিয়ে দিচ্ছিলো আর আয়ান তা হাঁসিমুখে পালন করছে। বিন্দু পরিমাণ চিন্তার রেখা আয়ানের মাঝে দেখছিনা আমি। সবাই দেখার আগে চোখের কোণের জমা অশ্রুটা মুছে নিয়ে জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নিলাম তারপর শ্বাশুড়ির কাছে গিয়ে বললাম “মা ডেকেছেন আমায়?”
সাথে সাথেই আমার শ্বাশুড়ি হুং’কা’র দিয়ে বলে উঠলেন “ডাকছি আরো তিন ঘন্টা আগে আর মহারানীর আসার সময় হলো এখন।”
মায়ের কথায় সবাই আমার আর উনার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন সাথে আয়ান আর তার নতুন বউ নয়নাও। আমি শান্ত স্বরে মাকে বললাম “কি বলছেন এসব আম্মু? মাত্রই তো মাহি বলে আসলো আপনি ডাকছেন।”

-ও এখন তাহলে আমি মিথ্যা বলছি?
আমি লক্ষ করলাম নয়না মেয়েটা চোখ বড় বড় করে হা হয়ে দেখছে সব। এটাই তো স্বাভাবিক পিচ্চি একটা মেয়ে কি এতো দ্রুত এসবের সাথে খাপ খাওয়াতে পারবে সহজে? অদ্ভুত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে স্থির হয়ে আছে নয়না। শুনেছিলাম মেয়ের বয়স মাত্র ১৯। মানে আয়ানের থেকে ১১/১২ বছরের ছোট মেয়েটা আর আমার থেকে নয় বছরের ছোট। ঠিক একই বয়সে আয়ান আমাকেও তার জীবনসঙ্গীনি করে এনেছিলো। মায়ের কথা শুনে আমি নিচের দিকে তাকিয়ে আছি মাথা নিচু করে। উনার কথার উপরে কথা বলতে আর ইচ্ছে করলোনা, বাড়ি ভর্তি মেহমান। উনি সবাইকে বললেন সবাই যেনো নিজ নিজ স্থানে গিয়ে ঘুমিয়ে যায় রাত হয়েছে অনেক। আমাদের বিল্ডিংয়ের সাথে একটা বিল্ডিং খালি ছিলো সেই বাসায় মেহমানদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সবাই চলে গেলে মা মাহিকে বললেন আমাকে যে কাজের জন্য ডাকা হয়েছে তা বলার জন্য, এটা বলেই মা চলে গেলেন ঘুমাতে। যাওয়ার আগে বলে গেলেন আমায় এখানের সব কাজ শেষ করে যেনো সকালে সবার জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করে ঘুমাতে। আমি নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। চোখে জল টলমল করলেও কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে নিলাম অন্যদিকে ঘুরে।

-এই যে মহারানী শুনুন এবার, আমার নতুন ভাবিকে বাসর ঘরে বসিয়ে দিয়ে আসুন তারপর পুরো ঘর পরিষ্কার করবেন। অতঃপর সময় ফেলে ঘুম।

আমি অসহায়ের দৃষ্টিতে তাকালাম আয়ানের দিকে।৷ আর যে সহ্য হচ্ছে না আমার। আয়ানের মুখটাও হঠাৎ কেমন ভার হয়ে উঠে মাহির কথায়। আয়ান বিরক্তিকর কন্ঠে বলে “কি বলছিস মাহি তুই এসব? যা ঘুমাতে যা”
আয়ানকে বেশ ভয় পায় মাহি তাই আর কোনো প্রশ্ন না করে যেতে নিতে লাগলো তখনই আমার কণ্ঠ পেয়ে পা থামিয়ে নেয় মাহি। আমি নতুন বউয়ের পাশে গিয়ে পেঁছন দিকে হাত ঘুরিয়ে ওর বাহু ধরে বললাম “চলো বোন তোমাকে তোমার আসল ঠিকানায় পৌঁছে দিয়ে আসি।” এটা বলেই হাঁটা ধরলাম আমার রুমের দিকে যদিও রুমটা এখন আমার নেই তবুও অভ্যাস হয়ে গেছে রুমটাকে আমার রুম বলতে বলতে। হয়তো ধীরে ধীরে অভ্যাসটাও পরিবর্তন হয়ে যাবে আয়ানের মতো। নতুন বউকে বাসর ঘরে বসিয়ে দিয়ে বললাম “দোয়া করি বোন তুমি যেনো এই পরিবারকে তাদের সুখের দিন দিতে পারো, যেনো আজকের মতো ভবিষ্যতেও তারা তোমাকে এইভাবেই আগলে রাখে।”
নয়নাকে কথাটি বলে আর এক মুহুর্তও না দাঁড়িয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে আসতে নিলাম। নয়তো যে আর একটু সময় ব্যয় করলেই চোখের অবাধ্য জলগুলো বেড়িয়ে আসতো সকল বাঁধা পেরিয়ে। নয়না মনে মনে হয়তো আন্দাজ করতে পেরেছে আমি কে। তাইতো মেয়েটা কিছুটা ভয় আর লজ্জার সংমিশ্রণে আমার দিকে তাকাচ্ছিলো বারংবার।
আমি নয়নাকে বসিয়ে দিয়ে রুম থেকে বাহিরে পা রাখতেই চোখাচোখি হলো আয়ানের সাথে। দরজার পাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে আয়ান। মুখশ্রী ভার, চোখগুলো বিষন্ন, ঠোঁট দুটো শুকনো। হঠাৎ ওর এমন অবস্থা দেখে বুকটা ধুকপুক করে উঠলো। তবুও ওকে নিজের অনুভূতি বুঝতে না দিয়ে স্টোর রুমের দিকে পা বাড়ালাম তখনই আমার হাত ধরে ফেলে আর বলে “খুব বেশিই কি কষ্ট দিয়ে ফেলেছি?”
আয়ানের কথা শুনে মনে হলো ও আরো বেশি দূর্বল করতে চাই আমাকে তাই আমিও নিজের মনকে শক্ত করে ভ্রু কুঁচকে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললাম “উহু মোটেও আমি কষ্ট পাচ্ছিনা। একটা বেয়মানের জন্য কষ্ট পাওয়ার চেয়ে নিজের গলায় নিজে খ’ঞ্জ’র বসানো অনেক টা ভালো মনে করি আমি।”

-বলতে পারলে এভাবে তুমি রিহানা?
-কেনো বলতে পারবোনা? আপনি পারবেন আপনার পরিবার পারবে শুধু আমি বললেই দোষ?
-তুমি কি আমার পরিবার নও? মানুষকি দুটো বউ নিয়ে সংসার করছেনা আর?
-করছে হয়তো কিন্তু এক বউকে রাণী সাজিয়ে আর অন্য বউকে কাজের মেয়ে সাজিয়ে স্টোর রুমে হয়তো কেউই রাখছেনা।

আমার কথা টি শুনেই আয়ান মাথা নিচু করে ফেললো। হয়তো ওর কাছে রিপ্লাই করার মতো কোনো বাক্য আর অবশিষ্ট নাই। তাই আমিই বললাম আবার “যান নিজের রুমে গিয়ে বাসর করুন আর এই পরিবারকে বাচ্চা দিন দ্রুত। আর হ্যাঁ আমি মোটেও কষ্ট পাচ্ছিনা কষ্ট পেলে অবশ্যই বাসর ঘর টা সেই নয় বছর আগে সাজানো ঘরটার মতো সেইম ভাবে সাজাতাম না।”
এটা বলেই এক ছুটে স্টোর রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দপাশ করে নিচে বসে পড়লাম। আর এক মুহুর্তও যদি সেখানে দাঁড়াতাম তবে হয়তো নিজেকে আবারো দূর্বল করে ফেলতাম আয়ানের প্রতি যা আমি কিছুতেই আর হতে দিবোনা কখনোই। ভালোবাসা সুন্দর হলেও মানুষগুলো বড্ড বেশি জঘন্যরকম হয় যা আয়ান আর তার পরিবারকে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না। অদ্ভুত বিষয় অনেক কান্না পাওয়া সত্বেও একটুও চোখে জল আসছেনা আমার। পাথরের ন্যায় হয়ে গেলো চোখ অম্বর টা। আজকের পর হয়তো আমি কখনো আয়ান নামক মানুষটার জন্য চোখ ভরে জল নামাবেনা কখনো।

*
ভোর পাঁচটাই দরজায় কেউ টুকা দিতেই জেগে যায় আমি। ঘুম ঘুম কন্ঠে বললাম “কে?”
কিন্তু কেউ শব্দ করলোনা তাই আমিও চোখ খুললাম না আর। কিন্তু আবারো দরজায় টুকা পরতেই শোয়া থেকে উঠে বসলাম। ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম সকাল পাঁচ টা বাজলো। দরজায় তখনও টুকা দিয়েই যাচ্ছে অপর পাশের মানুষটা। আমি একটু বিরক্তিকর কন্ঠে বললাম “আসতেছি। আর টুকা দিতে হবেনা।”
তারপর বসা থেকে উঠে দরজায় কাছে যেয়ে দাঁড়ালাম। জীবনে প্রথম খাট ছাড়া ঘুমালাম নিচে বিছানা পেতে তাই শরীরটা হালকা ব্যাথা ব্যাথা লাগছে। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে দরজা খুলে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে তাকাতেই চমকে উঠলাম আমি। এটা কি আদৌও সত্যি নাকি স্বপ্ন দেখছি? এই মুহুর্তে তো এই মানুষটার অন্যকোথাও থাকার কথা তবে এখানে কোনো?

#চলবে_ইনশাআল্লাহ

ভুলত্রুটি মার্জনীয়।

#ফুল_ফুটেনি_এই_বসন্তে [০৩]
#ফারজানা_আক্তার

পুরো রুম জুড়ে নিরবতা। দুজনের মুখে কোনো কথা নেই। কিন্তু আমি বড্ড বেশি অবাক হয়েছি এই মানুষটাকে চোখের সামনে দেখে। কারণ আমি এটা মোটেও আশা করিনি যে আয়ান এই মুহুর্তে এই জায়গায় দাঁড়ানো থাকবে আমারই দৃষ্টির সীমানায়। বুকটা কেঁপে উঠলো হঠাৎ। আয়ানের চোখ মুখ গুলো অদ্ভুত ভাবে জানান দিচ্ছে আমায় আমার আয়ান ভালো নেই। কিন্তু ওর তো ভালো থাকার কথা। ওর ভালো থাকার জন্যই তো এতো সব আয়োজন। গতকাল তো বেশ ভালোই লাগছিলো এই মানুষটাকে, মুখশ্রী জোড়ে ছিলো বিশ্ব জয়ের হাসি তবে আজ কি হলো। জানতে বড্ড ইচ্ছে করছে। কিন্তু মনে মনে নিজেকে শক্ত করলাম আর আয়ানের মুখের উপরই বলে দিলাম “এখানে কেনো তুমি? নতুন বউ একা তার কাছে যাও, তাছাড়া মা দেখলে তুলকালাম হয়ে যাবে।”
আমার কথা বলা শেষ হতে না হতেই আয়ান আমার কোনো কথাকে পাত্তা না দিয়ে আমাকে দরজা থেকে সরিয়ে সোজা গিয়ে আমার নিচে পাতানো বিছানায় শুয়ে পরে। আমি শুধু অবাক চোখে দেখেই যাচ্ছি। আমাকে আরো অবাক করে দিয়ে আয়ান আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে “ভোর হয়ে যাচ্ছে, দ্রুত নামাজ পড়ে নাও।”
কথাটা মন্দ বলেনি আয়ান। আগে নামাজ পড়ে নেওয়া উচিত। সময় খুব কম। যেহেতু এটা স্টোর রুম তাই এই রুমে কোনো ওয়াশরুম নেই। আমি রান্নাঘরের পাশের ওয়াশরুমে ফ্রেশ হয়ে ওজু করে নিলাম তারপর স্টোর রুমে আসতেই মনে পরলো এই রুম পরিষ্কার করা হয়নি। আর এই অপরিষ্কার জায়গায় তো নামাজ পড়া যাবেনা তাই দ্রুত চলে গেলাম ছাঁদের চিলেকোঠায়। চিলেকোঠায় নামায শেষ করে আবারো পা বাড়ালাম আমার রুমের দিকে। রুমটা আগে পরিষ্কার করা উচিত। তারপর আবার সকলের জন্য নাস্তা। উফ্ বিরক্ত লাগছে এবার আমার। চিন্তিত চেহারা নিয়ে আনমনা হয়ে রুমে প্রবেশ করতেই আরেক দফা অবাক হলাম। আয়ান এখনো শুয়ে আছে নিচে আর শুয়ে শুয়ে আমার ফোন ঘাটছে। আমি ধীর পায়ে হেটে ওর পাশে গিয়ে দাড়ালাম কিন্তু বসলাম না। আয়ান ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েই আমায় উদ্দেশ্য করে বললো “বসো।” আমি একটুও না ভেবে ফটাফট প্রতিত্তোরে বললাম “বসার সময় নেই। কাজের মেয়ে কিনা! উঠুন বিছানা গুছিয়ে রুম টা পরিষ্কার করে আবার সকলের জন্য সকালের নাস্তা তৈরি করতে হবে। ”
কথাটা বলতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আমার বুকের বামপাশ থেকে। আয়ান হুট করেই দাঁড়িয়ে গেলো আর আমার দিকে দৃষ্টি রেখে বললো “খুব পরিবর্তন এসেছে তোমার আচরণে।”

-আমার জায়গায়টাও তো পরিবর্তন হয়েছে। আমার তো এই স্টোর রুমে থাকার কথা ছিলোনা।

আমার এমন কথায় একদম চুপ হয়ে যায় আয়ান। মুখটা ফ্যাকাসে করে ফেলেছে। আমার ফোনটা আমার হাতে দিয়েই হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। আমি জানি আয়ান কেনো এসেছে এতো সকাল সকাল এই রুমে। মানুষটা যে সকালের খিদে সহ্য করতে পারেনা। সকালে নামাযের পর তার কফি খাওয়ায় লাগে। নয়না নতুন বউ বলে ওকে বলতে হয়তো লজ্জা লাগছিলো তাই আমাকে স্মরণ হলো তার। যাক তবুও তো স্মরণ করলো।
আমি আর দাঁড়িয়ে না থেকে রুম পরিষ্কারের কাজে লেগে গেলাম। রুমটা পরিষ্কার করে ভেজা কাপড় দিয়ে ভালো করে মুছে নিলাম। রুমটা সবসময়ই বন্ধ থাকতো এতোদিন তাই কেমন জানি এক অদ্ভুত রকমের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে পুরো রুমে। আমি আর কিছু না ভেবে দ্রুত পা বাড়ালাম রান্না ঘরের দিকে। ওমা একি! রান্নাঘরে এসেই খেলাম আরেক টাস্কি। নতুন বউ নয়না কফি বানাচ্ছে। আমর আর বুঝতে বাকি রইলোনা যে এই কফি সে কার জন্য বানাচ্ছে। তাই চুপচাপ নিজের কাজে লেগে গেলাম। মানুষটা খুব আশা নিয়ে আমার কাছে গিয়েছিলো অথচ আমি বুঝেও তাড়িয়ে দিয়েছি। কিভাবে হলাম এতোটা নিষ্ঠুর আমি? বিয়ের নয় বছরে এই প্রথম সকালে আমি ওকে কফি করে দেয়নি বরং কথা শুনিয়ে দিয়েছি এক গাদা। মানুষটা কি কষ্ট পেয়েছে আমার এমন আচরণে? হয়তো পেয়েছে! কারণ এই নয় বছরে আজ প্রথম তাকে আমি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছি। তার খিদের জ্বালা বুঝেও চুপ থেকেছি। খিদে লাগলে একদম বাচ্চা বাচ্চা হয়ে যায় ৩০+ বয়সের সুঠাম পুরুষটার মুখটা।
আমি সবার জন্য কি নস্তা তৈরি করবো ভাবতে ভাবতে রুটি ভাজি আর চা বানানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। যেই ভাবা সেই কাজ। রুটির জন্য খামি তৈরি করে ভাজির জন্য আলু পেঁপে ডাল পেয়াজ মরিচ সব জোগার করে নিলাম। ভাজি চুলাই বসিয়ে দিয়ে রুটি বেলতে লেগে গেলাম। ঘামে পিঠ টা ভিজে গিয়েছে। মুখটাও ঘামে একাকার। তখনই নয়না মেয়েটা প্রবেশ করে রান্না ঘরে। আমিও মেয়েটাকে দেখেও না দেখার মতো হয়ে কাজের ব্যস্ততা দেখাচ্ছি তখনই মেয়েটা আমার সাথে এই ওই কাজ করবে বলে বাহানা শুরু করে দেয়। আমি হাজার বারণ করলেও আমার সাথে হাতাহাতি করেই চলেছে মেয়েটা যা আমার মোটেও পছন্দ হলোনা তাই এক প্রকার বাধ্য হয়েই ওকে বললাম চা বানাতে। কড়া করে চা বানানের আদেশ দিলাম। মেয়েটা খুশি হয়ে ঝকঝকে মুখ নিয়ে চা বানাতে পাত্র নিলো হাতে। আমার থেকে জিজ্ঞেস করলো পানি কতটুকু দিবে। আমিও সব শিখিয়ে দিলাম। আমার শ্বশুড় আবার কড়া চা পছন্দ করে বেশ। নয়নার একটু আগে বলা কথাটা ভাবাচ্ছে আমায়, আমি যখন কাজ করতে না করি তাকে তখন সে আমায় বলে “আপনি বাড়ির বউ হয়ে কাজ করতে পারলে আমি কেনো পারবোনা?”
আমি অবাক হলাম মেয়েটার কথায় আর কিঞ্চিৎ হেঁসে জিজ্ঞেস করলাম কিভাবে জেনোছো আমি যে এই বাড়ির বউ? তখন মেয়েটা কিছুটা লজ্জা আর কিছুটা ভয় মেশানো কণ্ঠে বলে “উনি আমায় সব বলেছেন।”
খানিকক্ষণের মধ্যেই হুড়মুড় করে রান্না ঘরে আমার শ্বাশুড়ি ননদ দু’জনেই প্রবেশ করে। আমার শ্বাশুড়ি আমার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হুংকার দিয়ে বলে “এই মেয়ে আমার ছেলের নতুন বউকে দিয়ে কোন সাহসে কাজ করাচ্ছো তুমি? নিজের মতো বানাতে চাইছো নাকি?”
আমি চুপ হয়ে শুধু উনার দিকে ঘৃণিত দৃষ্টিতে তাকালাম। কষ্টে বুকটা হাঁহাকার। আমাকে চুপ দেখে উনি আবারও বললেন “শেষবার বলছি মেয়ে আমার ছেলের বউকে দিয়ে কোনো কাজ করাবে না যা করার তুমি একাই করবে।”
আমি তবুও চুপ হয়ে আছি কারণ আমি যদি বলি নয়না নিজ থেকে কাজ করছে তা কেউ বিশ্বাস করবেনা উল্টা আরো বেশি করে কথা শোনাবে, কি দরকার শুধু শুধু কথা বাড়িয়ে নিজের অপমানের খাতা ভরাট করার?
মুহুর্তেই আমাকে অবাক করে নয়না ধীর কণ্ঠে বলে উঠলো “মা আপু আমাকে কাজ করতে দেয়নি বরং আমিই আপুর হাত থেকে জোরপূর্বক কাজ ছিনিয়ে নিয়েছি। প্লিজ আম্মু আপুর সাথে কোনো অশান্তি করবেননা।”
কথাগুলো বলেই নয়না হাতের কাজ টা শেষ করে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। মেয়েটা হয়তো মানিয়ে নিতে পারছেনা নতুন পরিবেশে। সবাই কি আর সব সহ্য করতে পারে? মেয়েটাকে খুব সহজ সরল মনে হচ্ছে।

*
সবাইকে নাস্তা খাইয়ে একটু বসলাম ডাইনিংয়ে। খুব খিদে পেয়েছে। সবার খাওয়া শেষ হওয়ার পর দেখলাম রুটি আছে অবশিষ্ট একটা। ভাজি একটুও নেই। তাই চাইয়ে রুটিটা চুবালাম কিন্তু মুখে দিতে পারলাম না তার আগেই আমার শ্বাশুড়ি উঁচু গলায় বলে উঠলেন “অনেক গেলেছো এবার কাজে লেগে যাও। আজ দুপুরে সবার জন্য বিরিয়ানি রান্না করবে।”
এটা বলেই উনি চলে গেলেন। আমার আর খাওয়া হলোনা। আমি হাতের রুটিটা রেখে উঠে যেতে নিলেই নয়না বলে উঠে “নাহ আপু এভাবে খাবারের সাথে অন্যায় করিয়েননা। রুটিটা খেয়ে নিন।”
খুব আদুরে সুরে বলল মেয়েটা কথাটি। কিন্তু তবুও আমার গলা দিয়ে খাবার টা নামলো না। লক্ষ করলাম মেয়েটার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে একদমই।

*
আমার শ্বশুড়ের জন্য এক কাপ কড়া চা নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে বললাম “আব্বু আসবো?”
আমার শ্বশুড় হাসি মুখে খুব আহ্লাদি সুরে বলল “আসো মা, এই চায়ের অপেক্ষায় ছিলাম এতক্ষণ।”
কিন্তু আমার শ্বাশুড়ির পছন্দ হলোনা কথাটা তাই তিনি নাক-মুখ কুঁচকে বলে উঠলেন “ঢংয়ের আর শেষ নাই। এতো আদিখ্যেতা আমার সামনে একদম দেখাবেনা বুঝেছে।”
মুহুর্তেই আমার শ্বশুড়ের হাসিমাখা মুখে আঁধার নেমে আসলো। আমিও চুপচাপ উনার হাতে চায়ের কাপটা গুঁজে দিয়ে চলে আসার জন্য পা বাড়ালাম। রুমের বাহিরে পা রাখতেই চোখাচোখি হলো নয়না মেয়েটার সাথে। আমার শ্বশুড় বরাবরই খুব বাধ্য স্বামী আমার শ্বাশুড়ির। কখনো কোনো কিছুর প্রতিবাদ করেননা উনি। প্রতিবাদ করেননা বললে ভুল হবে প্রতিবাদ করতে পারেননা। মানুষটা বড্ড বেশি সহজ সরল। এই বিয়েতেও আমার শ্বশুড় আমার মতো নিরব দর্শক ছিলেন কিছুই বলতে পারেননি।
আমি একটু এগিয়ে গিয়ে নয়নাকে প্রশ্ন করলাম “তোমার কি কিছু লাগবে বোন?”
আমাকে অবাক করে দিয়ে নয়না উল্টা প্রশ্ন ছুঁড়লো আমার দিকে “আপনার সাথে উনারা এতো খারাপ আচরণ করেন কেনো? আর আপনিও কোনো প্রতিবাদ করেননা কেনো?”
মেয়েটার প্রশ্নের উত্তর নেই আমার কাছে তাই ওকে এড়িয়ে যাওয়ার বাহানায় ছাঁদের দিকে পা বাড়ালাম। মেয়েটা অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে আমার চলে যাওয়ার দিকে।
ছাঁদে পা রাখতেই থমকে গেলো পা। এ আমি কাকে দেখছি। নিজের চক্ষুদ্বয়কে বিশ্বাস করাতে পারছিনা। যে মানুষটাকে দেখেছি অন্যকাউকে কোনোদিন নিজের সামনে সিগারেট টানতে দেয়নি সেই মানুষটা আজ একমনে সিগারেট টেনে যাচ্ছে অন্তরিক্ষের দিকে তাকিয়ে। চারপাশে ধোঁয়া রা যেনো খেলা করছে। আমি আয়ানকে দেখে আবারও পিঁছন দিকে পা বাড়িয়ে চলে যেতে নিলে আয়ান বলে উঠে “এদিকে এসো? এভাবে লুকোচুরি খেলার আবেগি বয়স নেই এখন আর আমাদের।”
আময়ানের কথার কোনো অর্থ বুঝতে পারলাম না। এগিয়ে গেলাম ওর দিকে, ও রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। আমার মুখে কোনো কথা নেই। আমাকে চুপচাপ দেখে নিরবতা ভে’ঙে আয়ান বললো “জানো একসময় এই নিকোটিনের ধোঁয়াকে বড্ড বেশি ঘৃণ করতাম কিন্তু আজ বুঝতে পারছি কেনো মানুষ এই নিকোটিনের ধোঁয়াকে নিজের নিত্যদিনের সঙ্গী বানায়। বাস্তবতা যেভাবে বাহিরটা জ্বা’লা’য় নিকোটিন সেভাবে ভেতরটা ছারখার করে দেয়।”
কথাটা বলেই হাতে থাকা অর্ধ সিগারেট টা ফেলে পায়ে পিষে ধপাধপ্ পা পেলে সিঁড়ি বেয়ে নিচে চলে গেলো। আমি অবাক হবো নাকি বিস্মিত হবো বুঝে উঠতে পারছিনা। কি চলছে আয়ানের মনে? কি হচ্ছে এসব? কি রহস্য লুকিয়ে আছে আয়ানের মাঝে? কেনো এমন অদ্ভুত আচরণ? বিরক্ত লাগছে সবকিছু আমার। কি এমন যন্ত্রণা আয়ানকে খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে? বাবা হওয়ার চান্স তো পেয়েছে। এখন শুধু অপেক্ষা তবুও এতো আক্ষেপ মানুষটার মাঝে কিসের?

#চলবে_ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here