ফুল_ফুটেনি_এই_বসন্তে [১২]বোনাস_পর্ব,১৩

0
419

#ফুল_ফুটেনি_এই_বসন্তে [১২]বোনাস_পর্ব,১৩
#ফারজানা_আক্তার
১২ বোনাস পর্ব

আপু তুমি আমার ডায়েরি কেনো ধরেছো? এভাবে কারো জিনিসে অনুমতি ছাড়া হাত দিতে নেই জানোনা?”

নয়না এক প্রকার ছুটে এসে আমার হাত থেকে ডায়েরি টা নিয়ে কথাগুলো বলে। আজ প্রথম এভাবে কথা বলেছে নয়না আমার সাথে। ওর কণ্ঠ শীতল থাকলেও বাক্যগুলো খুব রেগে উচ্চারণ করেছে ও। আমিও উল্টা জবাব ওকে দিলাম “উকিলবাবু কে হয় তোমার? উকিলবাবুর ছবি কেনো তোমার ডায়েরির ভাঁজে? ভালোবাসো উকিলবাবুকে তুমি?”
এবার নয়নার চোখেমুখে লেপ্টে গেছে ভয়। ভয়ে মেয়েটা ঘেমে-নেয়ে একাকার। আমতা আমতা করছে নয়না কিন্তু কিছু বলতে পারছেনা। আমি আবারও জিজ্ঞেস করলাম শক্ত কন্ঠে তখন নয়না বলল “হু খুব ভালোবাসি কিন্তু সব ভালোবাসা কি আর পূর্ণতা পায় বলো? আমার ভালোবাসাটাও অপূর্ণ থেকে গেছে আর আমিও নতুন পথে মানিয়ে নিয়েছি নিজেকে।”
নয়নাকে কিছু বলতে চেয়েও আর বললাম না কারণ আমার হাতে এখন বেশি সময় নেই। নয়নাকে শুধু এইটুকুই বললাম “এসে কথা বলবো তোমার সাথে। একটা কাজে যাচ্ছি মা আসলে মাকে ম্যানেজ করে নিও পারলে নয়তো আমি এসে দেখে নিবো।”
এটা বলেই বাসা থেকে বেরিয়ে আসলাম। নয়না কিছু বলতে চাইলেও ওকে বলার সুযোগ দিলাম না আর।

ডাক্তারসাহেব কে রিপোর্টের ফাইলগুলো দিলাম। উনি চিন্তিত হয়ে বসে আছেন রিপোর্টগুলো হাতে নিয়ে। উনার কপালে স্পষ্ট ভেসে উঠেছে চিন্তার ভাব। ভ্রুজোড়া কুঁচকে রেখেছে। আমি উনার সামনে অশান্ত হয়ে বসে রয়েছি। রিপোর্টে কি আছে জানতে হবে আমাকে।
বেশ কিছুক্ষণ ডাক্তার সাহেবের সাথে কথা বলে বাড়ি ফিরে আসলাম। বাড়ি ফিরেই আরেক ঝামেলা শুরু। আমার শ্বাশুড়ি আজ সরাসরি আমার মুখের উপর বলে দিলেন আমি নাকি পরোকিয়ায় লিপ্ত তাই এখন সময়ে অসময়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় কাউকে কিছু না বলে। উনাকে কি বলবো বুঝতে পারছিনা। এই মুহুর্তে আমি কিছু বললেও উনি বিশ্বাস করবেনা কারণ উনার বিশ্বাস উঠে গেছে আমার থেকে এই কয়দিন এভাবে বাড়ি থেকে কিছু না বলে বাহিরে যাওয়ার ফলে। অন্যদিকে কষ্টে বুকটা ছিঁ’ড়ে যাচ্ছে ডাক্তার সাহেব এমন একটা সত্যি বললো যা আমি আমার কানকে বিশ্বাস করাতে পারছিনা। চারিদিকে এতো এতো ঝামেলা অশান্তিতে আমি একদম ক্লান্ত। তবুও স্বাভাবিকভাবে বলেছি “আপনি যা ভাবছেন তেমন কিছুনা মা। আপনার ছেলেকেই ভালোবাসি শুধু আমি। একটু সময় দিন আমায় সব সবার সামনে দৃশ্যমান হবে। একটু বিশ্বাস করুন মা।”
কিন্তু আমার শ্বাশুড়ি বিশ্বাস করলেননা। কতগুলো বিচ্ছিরী গালি দিয়ে আমায় আরো ভে’ঙে দিয়েছেন উনি। আজ উনি যা করেছেন এতে একদমই আমার মন থেকে উঠে গেছেন উনি। মা বলে এতোদিন সব সহ্য করেছি কিন্তু আজ যা করেছেন উনি তা কখনো ভুলবোনা আমি।
আমি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে চলে গেলাম গোসল করতে। আজানের সময় হয়ে এসেছে। হাসপাতাল থেকে আসতে আসতেই দুপুর হয়ে গিয়েছে তারপর আবার শ্বাশুড়ির সাথে ত’র্ক বি’ত’র্ক। অ’স’হ্য’ক’র অনুভূতি
********
নির্জন সময়টা আমার কষ্টগুলো যেনো আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাস। আকাশটা ভীষণ মেঘলা আজ। হয়তো বৃষ্টি নামবে। বিকেলের এই সময়টাতে ঘুম খুব করে টানে আমায় নিজের দিকে কিন্তু আজ আমার ঘুম আসছেনা পর পর এতো এতো ধা’ক্কা খেয়ে। নয়নাকে ডেকে এসে চিলেকোঠার দেওয়ালের সাথে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। নয়না এখনো আসছেনা কেনো কি জানি, হয়তো ভয়ে আছে মেয়েটা।

কিছুক্ষণ পর নয়না এসে দাঁড়িয়েছে আমার পাশে। চুপচাপ হয়ে আছে খুব। মুখটা মলিন। চোখগুলো লাল টুকটুকে হয়ে আছে। মনে হচ্ছে যেনো কান্না করেছে বেশ খানিক্ষণ। আমি একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে ওকে বললাম “তুমি যে কখনো মা হতে পারবেনা সেটা কাউকে বলোনি কেনো? কেনো লুকিয়েছো সব? তুমি কি দেখছোনা এই একটা বিষয় নিয়ে কতকিছু হচ্ছে ঘরের মধ্যে? আমার সাথে কি হচ্ছে দেখছোনা তুমি?”

“আপু আমি সত্যি বলছি বিয়ের আগে এসব বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না। আমার ভাই ভাবিও কিছু জানতোনা বিশ্বাস করো। ওরা যদি জানতো তবে কখনোই বিয়ে দিতোনা আমায় এই ঘরে। ওরা তো ভেবেছে ছেলের আগের বউ আছে হয়তো ছেলে মেয়েও থাকবে আর আমার এই সমস্যার জন্যেও কোনো সমস্যা হবেনা কিন্তু এখানে দেখি সব উল্টো। জানো আপু খুব ছোটবেলা একটা এ’ক্সি’ডে’ন্ট হয় আমার আর তখন নাকি আমার…

আর কিছু বলতে দিলাম না ওকে। বুঝে নিয়েছি নিজে থেকে সবটা। মেয়েটা বড্ড অভাগী ঠিক আমার মতোই। তারপর ওকে জিজ্ঞেস করলাম ” উকিলবাবুকে ভালোবাসলে এখন কিভাবে সংসার করছো তুমি? উনার জন্য কি একটুও মন খারাপ হয়না? সত্যি ভালোবেসেছিলে তো উনাকে?”

“আমার মা বাবা মারা যাওয়ার পর ভাই আর ভাইয়ের বউ আমাকে আর পড়ালেখা করতে দেয়নি। এসএসসি পরীক্ষার পর ঘরবন্দী হয়েছিলাম। একদিন একটা বিয়ে বাড়িতে উকিলবাবুর সাথে পরিচয় আর তারপর থেকে ধীরে ধীরে সম্পর্ক তৈরি হয়। উকিলবাবুকে আমার ভাই ভাবি বিশ্বাস করতে পারেনি তাই এই জায়গায় বিয়ে দিয়েছে আমার এই সমস্যার জন্য। আমার ভাবি আমাকে একটুও সহ্য করতে পারেনা। দেখছোনা বিয়ের এতোদিনেও একটু দেখতে আসা তো দূরে থাক কখনো একটা কল পর্যন্ত দেয়না।”

কি বলবো এই মেয়েকে বুঝতে পারছিনা। এই মেয়ের কথাগুলো শুনে আমি নিজেই ওর কষ্ট অনুভব করছি। মা বাবা না থাকলে মানুষ কতটা অসহায় তা আমি খুব ভালো করেই জানি। তবুও নিজেকে শক্ত করে বললাম “তুমি ধারণা করতে পারছো তো সবাই সবটা জানার পর কি হবে? কয়েকদিন পর যখন মা তোমাকে নাতি নাতনির কথা বলে অতিষ্ঠ করে তুলবে তখন কি জবাব দিবে তুমি?”

এবার চুপ করে রইলো নয়না। মেয়েটার চোখে অ’শ্রু রা খেলা করছে। খুব মায়া হলো আমার তাই বললাম আচ্ছা যাও ঘুমাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।
তারপর উকিলবাবুকে কল দিলাম। উকিলবাবু বললেন আমার কাজটা হতে আরো ২থেকে ৩মাস লাগবে।
*******
এই তিনমাস আমি আয়ানের থেকে খুব বেশিই দূরে দূরে ছিলাম। রা’গে ক্ষো’ভে জেদ চলে এসেছিলো মনে। কিভাবে এতোটা স্বা’র্থ’প’র ভাবতে পারলো আয়ান আমাকে? আমার ভালোবাসায় তো কোনো ভুল নেই তবে কেনো করলো ও এমনটা? আমার উপর কি ওর একটুও বিশ্বাস নেই? নাহ আজ কথা বলতেই হবে ওর সাথে। সব সত্যি জানার পরেও তিনমাস চুপ ছিলাম আমি কিন্তু আর না। অনেক রা’গ অনেক জেদ করা হয়ে গেছে এবার যেহেতু আমার গোপন কাজটাও হয়ে গিয়েছে তবে আয়ানের সাথেও খোলামেলা সব কথা বলে নিতে হবে। আজ উকিলবাবু মেসেজ করে জানিয়েছেন আমার সব কাজ হয়ে গিয়েছে।
এই তিনমাসে প্রতিটি মুহুর্তে আমি আয়ানের সাথে কথা বলতে চেয়েছি কিন্তু যখনই কথা বলতে যেতাম তখনই রা’গ উঠে যেতো আমার। আমার মনে হতো প্রতিটি মুহুর্তে আয়ান আমায় কখনোই ভালোবাসতে পারেনি। ভালোবাসলে কিভাবে অন্য মেয়ের সাথে সংসার করছে এতোদিন যাবত? আজ রাতেই আয়ানের সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলাম।
********
রাতের খাবার খাওয়া শেষ হতেই আমি আয়ানের হাত ধরে ওর রুমে নিয়ে গেলাম তারপর ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। হয়তো আমার এমন কান্ডে নয়না অবাক হয়েছে বেশ। কারণ এই ৪/৫ মাসে এমনটা কখনোই হয়নি নয়নার সামনে। আমার শ্বশুড় শ্বাশুড়ি খেয়েদেয়ে রুমে চলে যাওয়ার পরই এমনটা করি আমি। আয়ান বেশ বিরক্তি নিয়ে বললো “কি করছো তুমি এসব রিহানা?”
আয়ানের এমন বিরক্তি দেখে রা’গ আরো বেশিই বেড়ে গেলো। রা’গে মুখ দিয়ে যেনো কথা বেরোইচ্ছেইনা। আয়ানও রে’গে যাচ্ছে খেয়াল করলাম। রাগলে রাগুক তাতে আমার কি হুঁহ্। আমি ওর রাগকে পাত্তা না দিয়ে বললাম “এতো বিরক্ত হচ্ছো কেনো তুমি? আজ কি প্রথম আমার সাথে এক রুমে বন্ধ তুমি? এর আগে কি নয় বছর এক ঘরে ছিলেনা আমার সাথে? ”
কথাগুলো খুব ইমোশনাল হলেও খুব রেগে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললাম। অতিরিক্ত রেগে গেলেই কণ্ঠ কেঁপে উঠে আমার। কান্নাও পাই বেশ।

আয়ান আমার কথার উত্তর না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করে আমায় “এই তিনমাস তো চোখ তুলেও তাকাওনি আমার দিকে, কথা বলা তো দূরে থাক তাহলে আজ কি হয়েছে তোমার? কি করতে চাইছো তুমি? ”

রা’গে যেনো মাথা ফে’টে যাবে এমন অবস্থা হচ্ছে আমার। আমারও বিরক্ত লাগছে এখন ওর সাথে একই রুমে বন্ধ থাকতে। মানুষটা পাল্টে গেছে, ভীষণভাবে পাল্টে গেছে।
দু’জনেই চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। দু’জনের চোখেই স্পষ্ট রাগ ফুটে উঠেছে। আমি ঘন ঘন শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছি। আয়ান এক হাত কোমরে রেখে আরেক হাতের আঙ্গুল চোখের উপরে রেখে ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে। সব নিরবতা ভে’ঙে আমি স্বাভাবিক কন্ঠে বললাম “কেনো বলোনি আমায় তুমি যে বাবা হতে অক্ষম আয়ান কেনো? নয় বছরেও কি আমাকে নিজের মানুষ ভাবতে পারোনি? আমি কি একটুও ভালোবাসা দেয়নি তোমায় এই নয় বছরে? এতোটাই কি পর আমি?”

আয়ান প্রশ্নগুলো শুনে চোখের উপর থেকে আঙুল সরিয়ে আশ্চর্য জনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। চোখগুলো কেমন জানি লাল হয়ে যাচ্ছে ওর। মুখটা শুকনো হয়ে এসেছে একেবারে। অবাক করা কণ্ঠে আয়ান বলে “রিহানা তুমি…

আয়ান পুরো কথাটা আর বলতে পারলোনা কারণ হঠাৎ বাহির থেকে আমার শ্বাশুড়ির কান্না আর চিৎকারের শব্দ ভেসে আসলো। আমি আর আয়ান দ্রুত গতিতে দরজা খুলে বাহিরে এসে শুনি শব্দ আমার শ্বাশুড়ির রুম থেকে আসতেছে। আমরা দু’জনই দৌড়ে আমার শ্বাশুড়ির রুমে গিয়ে দেখলাম আমার শ্বাশুড়ি আহাজারি করে যাচ্ছে আর নয়না উনাকে সামলানোর চেষ্টা করছে। আমরা যেতেই নয়না কান্নাজড়িতো কণ্ঠে বললো ” আপু আব্বু আর নেই।”
কথাটা আমার কানে আসতেই যেনো পায়ের নিচে থেকে মাটি সরে গেলো। অশ্রুসিক্ত নয়নে আব্বুর দিকে তাকাতেই দেখি খুব সুন্দর ভাবে খাটে ঘুমিয়ে আছেন আব্বু। নিজেকে সামলাতে না পেরে আয়ানকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলাম।

#চলবে_ইনশাআল্লাহ

ভুলত্রুটি মার্জনীয়।

#ফুল_ফুটেনি_এই_বসন্তে [১৩]
#ফারজানা_আক্তার

আজ ৭দিন হলো আমার শ্বশুড় নেই আমাদের মাঝে। পুরো বাড়িতে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। একদম চুপচাপ শান্ত পরিবেশ। আমার শ্বাশুড়ি নিজের রুম থেকে মোটেও বের হয়না। আমি নিজেই উনার সেবা করতেছি। আমার শ্বশুড় মা’রা যাওয়ার পর থেকে কিছুটা অসুস্থ আমার শ্বাশুড়ি। আর আগের মতো করে বাজে ভাষায় আমার সাথে কথা বলেননা এখন। অনেক চুপচাপ হয়ে গেছেন। কারোই সাথে তেমন একটা কথা বলেনা কিন্তু আমার সাথে বলে দুই একটা মাঝে মাঝে তাও খুব সুন্দর করে যেমনটা বিয়ের শুরুর দিকে বলতো। আমি বুঝে উঠতে পারছিনা হঠাৎ এতো বদলে গেলেন কি করে উনি? স্বামীর মৃত্যু শোকে নাকি এর পেঁছনেও আছে অন্য রহস্য। এই শ্বাশুড়ি নামক মানুষটার উপর খুব রা’গ আমার তবুও দীর্ঘ আট বছর খুব ভালোবাসা দিয়েছেন আমায় তাই এই এক বছরের অ’ত্যা’চা’র মনে রাখতে চাইনা তবুও মনের ভেতর খুঁত থেকেই যায়। আমি পারছিনা মন থেকে উনাকে ক্ষমা করতে বিশেষ করে সেইদিনের মিথ্যে অপবাদ দেওয়ায়। শ্বশুড় নেই আর শ্বশুড়ের কথা রাখতেই এই ভদ্র মহিলার সেবা করতেছি তাছাড়া আমার আল্লাহ তো দেখছেন সব। তাই নিয়তির উপরেই ছেড়ে দিলাম সব। সবাই-ই তো নিজেদের স্বার্থের জন্যই আমার সাথে খারাপ আচরণ করেছে তা ছাড়া কিছুইনা আর।
আমার শ্বশুড় মা’রা যাওয়ার পর থেকেই মাহি এখানে থাকে। আমার শ্বশুড় মা’রা যাওয়ার ৪দিন পর চলে যেতে চাইলেও আমি যেতে দেয়নি মাহিকে। মাহিও এখন স্বাভাবিক আচরণ করে আমার সাথে কিন্তু তবুও নিয়ানকে আমার ধারে কাছে ঘেঁষতে দেয়না যা আমার খুব বেশিই খারাপ লাগে। মাঝে মাঝে শুনি তারা মা মেয়ে কোনো একটা বিষয় নিয়ে বিড়বিড় করছে কিন্তু আমাকে দেখলেই কথা বন্ধ করে চুপ হয়ে যায়। নয়নাও অনেকবার লক্ষ করেছে এই বিষয়টা। একইভাবে ওকে দেখলেও কথা বন্ধ করে, চুপচাপ হয়ে যায়। নয়না নিজেই বলেছে এটা আমায়। আমি অবাক হচ্ছি এদের মা মেয়ের কান্ড দেখে। খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি যত যা হয়ে যাক তবুও এদেরকে আর আপনজন ভেবে ভুল করবোনা কখনো কিন্তু ছেড়েও যাবোনা কারণ এটা আমার সংসার। আমার আর আমার আয়ানের ছোট্ট সংসার যেখানে আছে রা’গ অভিমান ভালো লাগা ভালোবাসা দুষ্টুমি খুনসুটি আর একরাশ অপূর্ণতা।

এই ৭দিনে আয়ানের সাথে রিপোর্ট গুলোর বিষয়ে আর কোনো কথায় বলিনি। বাবার মৃত্যুটা মেনে নিতে পারছেনা এখনো আয়ান। আমি কাছে গেলেই ছোট বাচ্চাদের মতো আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। নয়না কয়েকবার দেখেও এড়িয়ে গিয়েছে কেনো জানিনা। আয়ানের এই অবস্থায় নিজেদের পার্সোনাল কথাগুলো বলার আর সাহস পেলাম না।
দেখতে দেখতে দিন কেটে যাচ্ছে। আয়ানও একটু স্বাভাবিক হচ্ছে। আমি শুধু সুযোগ খুঁজি একটু আয়ানের সাথে কবে একা কথা বলতে পারবো। কিন্তু বাড়িতে সময়সময়ই সমাগম থাকে ইদানীং। আমার শ্বাশুড়ি কে দেখতে আসে সবাই। আবার কেউ কেউ তো মুখের উপরই হা হুতাস করে বলে দেয় আহারে এই বয়সে স্বামী হারানো খুব বেদনার, ছেলে যদি না চাই তবে রাস্তায় থাকতে হবে। মানুষের এমনসব অযুক্তিক কথা শুনে আমার শ্বাশুড়ির মুখ একদম ফ্যাকাসে হয়ে যেতো আর সবাই চলে যাওয়ার পরই কান্নায় ভে’ঙে পরতো। আমার খুব রাগ হতো। এই সমাজটাই এমন। আ’গু’নে’র মধ্যে কেরোসিন ঢালার অভ্যাস এই সমাজের কিছু মহিলাদের। কারো কষ্ট তো কমাতে পারেনা বরং বাড়িয়ে দিয়ে যায়।

আজ একমাস পূর্ণ হলো আমার শ্বশুড় নেই আমাদের মাঝে। পুরো ঘরটা কেমন জানি ফাঁকা ফাঁকা লাগে। অদ্ভুত শূন্যতা অনুভব করি। নয় বছর ধরে শ্বশুড় নামক মানুষটাকে বাবার স্থানে বসিয়েছিলাম। সেই বাবা যদি এভাবে হুট করে চলে যায় পৃথিবী ছেড়ে তবে কষ্ট পাওয়াটা স্বাভাবিক। আমি সব জেনেও কিছু করতে পারিনি কারণ সময় শেষ হয়ে এসেছিলো।
আমার শ্বাশুড়ির জন্য মুরগীর সুপ বানিয়েছি। সুপ নিয়ে দরোজার কাছে যেতেই শুনতে পেলাম আমার শ্বাশুড়ি আর মাহি নয়নাকে খুব কথা শুনাচ্ছে। বিয়ের এতোমাস হয়ে গেলেও বাচ্চা কেনো হচ্ছে না। এই বিষয় নিয়েই অনেক রাগারাগি চেঁচামেচি করতেছে। নয়না বেচারি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু চোখের জল ফেলছে। হঠাৎ নয়নার জন্য খুব মায়া হচ্ছে। নাহ আর সময় নষ্ট করা যাবেনা, মাত্র বিকাল হলো ৪টা আর আয়ানের অফিস ছুটি ৫টাই। কল দিলাম আয়ানকে। আজ কতদিন পর যে আয়ানের ফোনের স্ক্রিনে আমার নামটা ভেসে উঠবে, আয়ান কি খুশি হবে আমার নাম দেখে নাকি বিরক্ত হবে? অদ্ভুত রকমের অনুভূতি হচ্ছে। তিনবার রিং পরার পর আয়ান কল রিসিভ করে। আয়ান কল রিসিভ করতেই ওকে কিছু বলতে না দিয়ে বললাম দ্রুত বাসায় আসার জন্য। এটা বলেই কল কেটে দিলাম দ্রুত। এবার আয়ান আগ পিছ কিছু না ভেবেই চলে আসবে। একটু চিন্তা করবে, করুক চিন্তা তাতে আমার কি? ঘরে আসলেই সব চিন্তা দূর হবে।

*
আয়ান আর আমি একই খাটে চুপ হয়ে বসে আছি। দরজা বন্ধ। সেই পুরোনো রুম পুরনো মানুষটা তবুও কেমন জানি সব নতুনত্ব লাগছে আমার কাছে। আয়ানের দিকে খুব কোতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। আয়ান একটু নড়েচড়ে বসে বলা শুরু করলো “হ্যাঁ আমারই সমস্যা আমিই অক্ষম। তাই আমি তোমাকে আমার এই অভিশপ্ত জীবনের সাথে জড়িয়ে রাখতে চাইনি আর। আমি চেয়েছিলাম আমি যতই কষ্টে থাকিনা কেনো তবুও তুমি সুখি হও, একটু সুখে থেকো। আমার কাছে থাকলে মাতৃত্বের স্বাদ কখনোই পাবেনা তুমি কিন্তু অন্যকেউ তোমাকে পারবে সেই সুখ দিতে। হ্যাঁ আমি স্বার্থপর হয়েছি শুধু তোমার জন্য, আমার ভালোবাসার জন্য। আমি অনেক চেয়েছি তোমাকে ডিভোর্সের কথা বলতে কিন্তু পারিনি। ডিভোর্সের কথাটা চিন্তা করলেও আমার দম বন্ধ হয়ে আসতো। কিন্তু আমি খুব করে চেয়েছিলাম তুমি নিজ থেকে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যাও আমার অভিশপ্ত জীবন থেকে। তাই কখনো আম্মু আর মাহিকে বাঁধা দেয়নি তোমার সাথে খারাপ আচরণ করার সময়। আমি ভেবেছিলাম তুমি এসব সহ্য করতে না পেরে ডিভোর্স দিয়ে দিবে কিন্তু না আমার ভাবনা ভুল প্রমানিত হলো তুমি তো নাছোরবান্দা, আমি বিয়ে পর্যন্ত করে নিলাম তবুও তুমি চুপচাপ সহ্য করে যাচ্ছো। আচ্ছা তোমার মাঝে এতো ধৈর্য আসলো কোথায় থাকে?”

একটু হাসলাম তারপর বললাম “মনে আছে তোমার? একদিন বলেছিলে তুমি ভুলে গেলেও যেনো আমি ভুলে না যায় তোমায়। শুধু এই কথাটা মনে রেখেই সব সহ্য করেছি মুখ বুঁজে। খুব যে ভালোবাসি তোমায়। কিভাবে এতোটা স্বার্থপর ভেবে নিলে আমায় আয়ান? কি করে ভাবলে আমি শুধু একটা বাচ্চার উছিলা দিয়ে চলে যাবো তোমায় ছেড়ে? তুমি কি আমার চোখে তোমার জন্য এক বিন্দু ভালোবাসাও দেখোনি কখনো?”

“একটু বেশিই ভালোবাসি তোমায়। তবুও চাই চলে যাও তুমি। অন্যের সাথে সুখী হও। একটু স্বার্থপর হও নিজের সুখের জন্য।”

“আর একবার এমন কথা বললে তোমার এই কোঁকড়া চুলে আ’গু’ন লাগিয়ে দিবো। তারপর বুঝবে রিহানা কি জিনিস।”

আয়ান মুচকি হাঁসলো সাথে আমিও হাঁসলাম। তারপর গম্ভীর হয়ে ভাবলাম না এখন সব ক্লিয়ার করতে হবে, এক সেকেন্ডও সময় নষ্ট করা চলবেনা।

“একটু সিরিয়াস হও আয়ান। আমাকে এতো ভালোবাসো তাই আমাকে নিজের থেকে আলাদা করতে চাইছো কিন্তু অন্য একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করার জন্য তাকে বিয়ে কিভাবে করলে? একটুও কি ভাবলেনা সেই মেয়েটার কথা।”

“কি বলছো কি এসব? আমি কেনো ওই মেয়ের জীবন নষ্ট করবো? তুমি তো জানোই নয়নার আগেও আমার জন্য অনেক মেয়ে দেখা হয়েছে কিন্তু আমার কাউকে পছন্দ হয়নি। সবাইকে পছন্দ হয়নি বললেও আমি ইচ্ছে করেই সেই মেয়েগুলোকে রিজেক্ট করেছিলাম। পরে নয়নাকে দেখতে গেলে ওর সাথেও আলাদা কথা বলতে দেওয়া হয় আমাকে। তারপর নয়না সুযোগ পেয়ে আমার সাথে তার জীবনের একটা সত্য শেয়ার করে…

নয়না মা হতে পারবেনা কখনো, এটাইতো?
আয়ানকে থামিয়ে ওর কথার মাঝেই বললাম কথাটা।
আয়ান ভীষণ অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করে ” তুমি জানো? কিন্তু কিভাবে?”

আমি বললাম সে অনেক কথা। মেয়েটার জীবন কেনো নষ্ট করলে তুমি?
আয়ান তখন আমতা আমতা করে বললো “মানে? জীবন নষ্ট হলো কেমনে?”

“মেয়েটা একটা ছেলেকে খুব ভালোবাসে কিন্তু তোমার জন্য তার ভালোবাসা অপূর্ণ রয়ে গেছে? কিভাবে পারলে একটা মেয়েকে এতোটা কষ্ট দিতে?”

“আজব আমি কেমনে জানবো? নয়না এই বিষয়ে কিছু বলেনি আমায়?”

“তুমি কি জানো আজ মা আর মাহি নয়নার সাথে কতটা খারাপ আচরণ করেছে এখনো বাচ্চা হচ্ছেনা বলে। কি জবাব দিবে মেয়েটা মা আর মাহিকে? তুমি প্লিজ তোমার সমস্যার কথা সবাইকে বলো। আমি নিজের কষ্ট সহ্য করে নিয়েছি কিন্তু ওই অসহায় এতিম মেয়ের কষ্ট আমি সহ্য করতে পারবোনা।”

আমার কথা শোনে খুব চিন্তায় পরে গেলো আয়ান। আয়ান মুখটা মলিন করে চোখগুলো সরু সরু করে আমার হাতদুটো নিজের দুই হাতের মুঠোই নিয়ে বলে “রিহানা বিশ্বাস করো তো আমায়?”

“হুম নিজের থেকেও বেশি।”

“কিছু সত্য কথা বলবো আজ তোমায়? বিশ্বাস করবে তো”

হঠাৎ বুকটা ধুকপুক করে উঠলো। কি এমন কথা বলবে আয়ান যার জন্য ও এভাবে মলিন কণ্ঠে আমার হাত ধরে বাচ্চাদের মতো করে বললো।
আয়ান একটু কেঁশে বলে উঠে_____

#চলবে_ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here