(পর্ব দুই )
(তোমায় ভালোবেসে যাবো )
(লেখা অধরা জেরিন )
,
কেনো জানি খুব কান্না পাচ্ছে! শূন্যতা, পূর্ণতা, নির্ভরতা নাকি নিঃসঙ্গতার জন্য, জানি না। শুধু বুঝতে পারছি বুকের ভিতরে কোথায় জেনো লুকানো জায়গা থেকে একদল অভিমান প্রচণ্ড কান্না হয়ে দু’চোখ ফেটে বেরুতে চাইছে। শূন্যতা তার ইচ্ছে মত দেখাচ্ছে নিষ্ঠুর খেলা। আমিতো তোমার বুকে মাথা রেখে সারাজীবন বাঁচতে চাই। কেন এমন হলো।
,,
এই সব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। যখন ঘুম ভাঙে দেখি সকাল হয়ে গেছে । আমার পাশে তখন ও রাতুল গভীর ঘুমে মগ্ন । মনে হচ্ছে কোনও অবুঝ শিশু কোনও কিছুর ভয়ে গুটিসুটি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে । আচ্ছা আমি কি পারবো সারা জীবন ওর হাত টা শক্ত করে ধরে বেঁচে থাকতে ??
,,
আমি ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে নিজেকে চেঞ্জ করে সামনে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। এই প্রথম আমি ভাল করে সব কিছু দেখছি। আমার শশুড়ের বিরাট দুইতলা বাড়ি । সামনে ফাঁকা মাঠ। একপাশে ফুলের বাগান । অন্য পাশে হয়তো বিকেলে বসার জন্য একটা ছোট্ট পার্ক মতো করেছেন । দেখলে খুব ভাললাগে। বাগানে নাম না জানা কতো ফুল ফুটে রয়েছে । একজন মালি দেখা শুনা করছে । হঠাৎ করে আমাকে দেখতে পেয়ে মালি কেমন যেন করে উঠলো। কেমন একটা তার ভিতরে অপরাধ বোধ ভাব। হয়তো এই বাড়ির বউ বলে সম্মান দেখাচ্ছে । আমার খুব হাসি পেল। বলতে ইচ্ছে করছিল আমি ও তোমার মতো একজন । ভাগ্য আমাকে এই খানে আসতে বাধ্য করেছে।
,,
এমন সময় পনেরো ষোলো বছরের একটা মেয়ে এসে আমাকে বললো ভাবি আপনাকে আম্মা ডাকছে। আমি হঠাৎ করে ভাবি ডাক শুনে চমকে উঠলাম । আমি জিজ্ঞাসা দৃষ্টি তে তাকিয়ে আছি। মেয়ে টা কে ? ও হেসে দিয়ে বললো আমি অনন্যা । এই বাড়ির মেয়ে । আমি হেসে দিলাম । তাঁর মানে রাতুলের একটা বোন আছে । কিন্তু ওকে তো কাল দেখিনি ? এমন সময় অনন্যা বললো ভাবি আমি কাল একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম তাই আপনার সাথে দেখা হয়নি।
,,
আমি অনন্যার সাথে ভিতরে গেলাম । যতো দেখছি অবাক হয়ে যাচ্ছি । নাস্তার টেবিলে আমার শশুড় শাশুড়ি বসে আছে । কয়েক জন কাজের মানুষ । আর কতো রকমের যে খাবার আমি নাম ও জানি না। আমাকে দেখে আমার শাশুড়ি বললেন এসো আমাদের সাথে খেয়ে নাও। রাতুলের ঘুম ভাঙার কোনও ঠিক নেই। আমার কেমন যেন একটা অস্থির লাগছে । একরাশ লজ্জা ঘিরে ধরছে । আমার এমন অবস্থা দেখে আমার শশুড় অভয় দিয়ে বললো আমরা তোমার বাবা মায়ের মতো । আমাদের সামনে তুমি কখনও লজ্জা পাবে না। তুমি শুধু এই বাড়ির বউ না। আর একটা মেয়ে।
আমার চোখে পানি চলে এলো। আনন্দ কষ্ট দুইটাই পাচ্ছি । এতো সুখ কি আমার কপালে সইবে । খাওয়া দাওয়ার পর আমাকে আমার শশুড় তাঁর রুমে নিয়ে গেলেন । এর পর শুরু করলেন সেই অজানা কথা ।
,,
রিয়া হচ্ছে আমার বন্ধুর মেয়ে । আমার বন্ধু আমেরিকা থাকে । প্রতি বছর একবার আসে সপরিবার নিয়ে বাংলাদেশে। আমার বাসায় ওঠে । দু মাস কখনও তিন মাস কাটিয়ে যায় । আমার আজকের এই অবস্থান শুধু ওর জন্য । রিয়া আর রাতুল ছোট বেলা থেকেই খেলার সাথি । এদেশে আসলে দুজন মানিকজোড় হয়ে থাকে । রাতুল মাসটার্স কমপ্লিট করেছে । রিয়ার এক বছর বাকি ছিল । আমাদের দুই বন্ধুর ইচ্ছে ছিল আমরা আমাদের সম্পর্ক আরো গাড়ো করবো। ওদের বিয়ে দেব। এতে করে রাতুল আর রিয়ার কোনও অমত ছিল না। সে বছর আমার বন্ধু জানালো সে তাঁর সমস্ত বিজনেস গুটিয়ে নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসছে । এবার ই রিয়া আর রাতুলের বিয়ে দেবে। আর আমেরিকা ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। রিয়া তাদের একমাত্র মেয়ে । বাকি টা জীবন এই বাংলাদেশে থেকে যেতে চায়।
,,
বিয়ে ঠিক হলো । সবাই খুব খুশি । রিয়া আর রাতুল দুজন দুজন কে আগের থেকে পছন্দ করে । তাদের খুশি যেন বহুগুণ বেড়ে গেল । বিয়ের আগের দিন । রাতুল আর রিয়া গেল মার্কেট করতে । আজ কথা ছিল বিয়ের গহনা নিয়ে আসবে । রিয়া বায়না ধরলো সে ও রাতুলের সাথে যাবে । সে দিন বাইরে প্রচুর বৃষ্টি । দুজনে গাড়ি নিয়ে বের হলো। ওরা যখন গহনা নিয়ে বের হয় তখন কিছু সন্ত্রাস এর হাতে পড়ে। বাইরে বৃষ্টি লোক নেই বললে চলে । গাড়ির ড্রাইভার কে আগেই মাথায় বাড়ি দিয়ে অজ্ঞান করে ফেলে । রাতুলের সাথে অনেক ধস্তাধস্তি হয়। এক সময় ওকে ও আঘাত করে মাথায় । নিয়ে যায় সমস্ত গহনা । কিন্তু রিয়া ?? ওকে আজও খুঁজে পাইনি। ও বেঁচে আছে না মরে গেছে জানিনা। আশেপাশের মানুষ ওদের হাসপাতালে ভর্তি করে। আমরা খবর পেয়ে যখন যাই তখন ও রাতুলের জ্ঞান ফিরেনি। আমার বন্ধু এই খবর পেয়ে সাথে সাথে হার্টফেল করে মারা যায় ।
,,
আহ কি কষ্টের পরিস্থিতি । যখন রাতুলের জ্ঞান ফিরে তখন জানতে পারে রিয়াকে পাওয়া যাইনি। তখন থেকেই ও কেমন হয়ে যায় । কারো সাথে কথা বলতো না । কারো সাথে মিশতো না। এক সময় ও পাগলামি শুরু করলো। রিয়া কে ও সব সময় দেখতে পায়। ও সব সময় ছুটে চলে যায় মনে যেদিকে চায় সে দিকে । রাতে ও ঘুমের ভিতরে কথা বলে । এক সময় ও মানসিক রুগি তে পরিণত হয়। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি। কাজ হয়নি। শেষ চেষ্টা হিসাবে এক ডাক্তার বললেন ওকে বিয়ে দিলে হয়তো ঠিক হয়ে যেতে পারে । ওর এখন এমন একজন দরকার যে রিয়ার অভাব পূরন করবে।
,,
তুমি হয়তো মনে করছো আমি তোমাকে কেন এই বাড়ির বউ করলাম ?? কারণ তোমার মতো একটা মেয়ে আমি খুঁজেছি। আমি জানি তোমার সম্পর্কে সব কিছু । তুমি অনেক বুদ্ধিমতী মেয়ে । যথেষ্ট ধৈর্যশীল । একমাত্র তুমি পারবে আমার ছেলে কে ভাল করতে । একজন পিতা হিসাবে তোমার কাছে আমার আবদার আমার ছেলে কে তুমি ছেড়ে কোনও দিন যেও না।
,,
আমি কথা গুলি শুনে অবাক চোখে তাকিয়ে আছি। আমার শশুড় শাশুড়ির চোখে পানি। আজ তারা এতো কোটিপতি হয়ে ও তাদের ছেলের জন্য আমার মতো একটা সামান্য মেয়ের কাছে আবদার করছে। এটা আমার চরম পাওয়া । আমি আমার শশুড়ের পায়ে হাত দিয়ে বললাম আমার জন্য দুআ করবেন বাবা । আমি আপনার ছেলে কে আবার যেন আগের জীবনে ফিরিয়ে নিতে পারি।
,,
এমন সময় রাতুলের চিৎকার কানে এলো। ওর ঘুম ভেঙেছে। ও চিৎকার করে বলছে মা মা রিয়া কোথায় ? ওকে দেখছি না কেন ? আবার মনে হয় আমার সাথে লুকোচুরি খেলছে। এবার যদি ধরতে পারি না একটা পিটান দেব। ও বোঝে না ওকে না দেখলে আমার কষ্ট হয় । তুমি বলো না ওকে আমার সামনে আসতে । আমি আমার শাশুড়ির পিছনে দাঁড়িয়ে আছি। অনেক টা ভয়ে । কখনও এমন পরিস্থিতিতে পরিনি। এমন সময় রাতুলের চোখ পড়লো আমার দিকে । আমার দিকে তাকিয়ে থেকে হেসে দিয়ে বললো এই রিয়া তুমি মায়ের পিছনে লুকিয়ে আছো। আমি তোমাকে কতো খুজেছি। কোথায় ছিলে এতো দিন । এসো আমার সামনে ।
,,
দুরে আমার শশুড় দাড়িয়ে আছে । তাঁর চোখে পানি কিন্তু মুখে একটা মিষ্টি হাসি লুকিয়ে আছে । যে হাসির অর্থ তুমি পারবে আমার ছেলে কে ঠিক করতে । রাতুল আবার আমাকে বললো কি হলো তুমি আসবে না আমার কাছে বুঝেছি তুমি রাগ করেছো। ঠিক আছে আমি আর তোমার সাথে দুষ্টামি করবো না। যা যা বলবে সব শুনবো।
,,
এবার আমি বললাম ঠিক তো আমি এখন থেকে যা বলবো শুনবে তো ?? রাতুল মাথা নেড়ে সায় দিল। আমি বললাম এখন থেকে ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করবা। ঔষধ খাবা। কখনও চেচামিচি করবা না। তাহলে আমি আর কখনও হারিয়ে যাব না। আমার সব কথা রাতুল মেনে নিল। আমি আমার শাশুড়ি কে বললাম মা আপনি রাতুলের খাবার দেন। আমি আজ ওকে নিজে খাইয়ে দেব। তিনি চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলেন ।
,,
আমি রাতুল কে মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছি । আর ও চুপটি করে বসে খাচ্ছে । আমার খুব ভাল লাগছে । দুজন লোকের মুখে হাসি ফুটাতে পেরেছি।
কিন্তু রিয়া !!!!!!
ও যদি কখনও ফিরে আসে ??এসে যদি ওর ভালবাসা দাবি করে ?? আর রাতুল ও রিয়া কে পেয়ে আমাকে না চেনে ?? ও যদি বলে তোমার সাথে থাকা আমার সম্ভব না। তুমি চলে যাও । তাহলে আমি কি পারবো সবার মায়া ছিন্ন করে ফিরে যেতে ????
,,
,,