?#চোখের_তারায়_তুই?
#পর্ব_২৫
#ইভা_রহমান
সদর দরজার বাহিরে বাইকে মাথা হেলিয়ে হিয়ার জন্য অপেক্ষারত উজান৷ বললো তো বের হচ্ছি তাহলে এতোক্ষণ লাগছে কিসের জন্য হিয়ার। একটা কি ফোন করবো। কিন্তু হিয়া যে বারণ করে দিলো। দুমিনিট বাদে আর অপেক্ষার প্রহর গুনতে না পেরে বাইক থেকে নেমে সদরদারজার সামনে এসে দাঁড়ালো উজান। দরজা টা আলতো ফাঁক করে ভেতরে উঁকি দিতেই হিয়ার দেখা মিললো। মাথার আকাশি রঙের ধূসর ওড়নাটা ঠিক করে খুব সতর্কতার সাথে মুখ লুকিয়ে বেড়িয়ে আসলো হিয়া। হিয়াকে নিয়ে দূত বাইকের সামনে এসে হেলমেটটা হাতে নিয়ে উজান বললো,
– শিশির কোথায়?
– ভাইয়া ওয়াশরুমে। কিন্তু আমরা এখন কোথায় যাবো?
– কাজি অফিস,বিয়ে করবো,আজকেই এক্ষুনি!
চোখ বড় করে অবাক কন্ঠে হিয়া বললো,
– আপনার মাথা ঠিক আছে তো, উজান। ভাইয়া খু*ন করে ফেলবে আপনাকে সাথে আমাকেও।
– আই ডোন্ট কেয়ার। অনেক বুঝিয়েছি তোমার ভাইকে,তোমার চাচিকে। ইভেন কাল রাতে গিয়েও বুঝিয়েছি শিশিরকে দোকানে। তোমাকে ভিক্ষা চেয়ে এসেছি। তারপরো সে রাজি হলো না তো। এরপর যা হবে তার জন্য সে নিজে দায়ী থাকবে।
– কিন্তু তারপর? আর আপনার পরিবার?
– তোমার আমাকে লাগবে না আমার পরিবারকে হিয়া?
– এটা কিরকম প্রশ্ন। এরকম ভাবে বিয়ে করলে, ওরা তো এমনিতেই রাজি না।
হিয়ার এতো প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে গেলো উজান।মাথায় হেলমেটটা পড়ে নিয়ে বাইকে বসে গিয়ে বললো,
– যা-ও তাহলে ভেতরে তুমি। কাজি আছে না সাথে। ছেলেও তৈরি বিয়ে করে নেও তাকে।
– না।
– তাহলে এতো প্রশ্ন কেনো করছো তুমি। আমার উপর তোমার ভরসা নেই?
– তা নয়। আছে ভরসা। কিন্তু ভাইয়া?
– কি ভাইয়া?
– ভাইয়া আমাকে কখনো ক্ষমা করবে না উজান স্যার।
– আর আজকে তুমি ফিরে গেলে আমি তোমাকে কখনো ক্ষমা করবো না হিয়া। এখন বলো তুমি কি চাও?
বিপাকে পড়ে গেলো হিয়া। একবার সদর দরজার দিকে দেখছে তো একবার উজানের দিকে। হাত কাঁপছে হিয়ার৷ এ কেমন টানাপোড়েনে পড়ে গেলো হিয়া। বাড়ি ফিরে গেলেই তাকে বাঁধা পড়তে হবে অন্য কারো সাথে, ভাইয়ের উপর তো কিছু বলতেও পারবে না এ-ই মুহুর্তে। ফলস্বরূপ হারাতে হবে উজানকে। আর এদিকে উজানের সাথে বেড়িয়ে গেলেই অসম্মান করা হবে শিশিরকে,বোনের জন্য শিশিরের যেই ত্যাগ সেটাকে তুচ্ছ করা হবে। কোনদিকে যাবে এখন হিয়া!
হিয়ার অস্থিরতা উপলব্ধি করলো উজান৷ জানে এটা ঠিক কতোটা কঠিন হিয়ার জন্য। মনে তো আছে উজানের জন্য আকাশ সমান ভালোবাসা কিন্তু শিশিরকেই বা কি করে এতোবড় একটা পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড় করাবে হিয়া। হিয়ার মাথায় হাত রাখলো উজান। হিয়াকে অভয় দিয়ে বললো” আমি আছি শিশিরকে সামলে নেওয়ার জন্য,তুমি আমাকে একটু ভরসা করো” চোখ বন্ধ করলো হিয়া৷ তপ্ত শ্বাস ফেলে মাথা হালকা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। এদিকে রাস্তার ওদিক থেকে কিছু মানুষের আনাগোনা চোখে পড়তেই নিজের হেলমেট টা খুলে হিয়াকে টপাটপ পড়িয়ে দিলো উজান। যাতে পাছে কেউ হিয়াকে হিয়া না বলে চিনতে পারে।
গন্তব্য এখন কাজি অফিস। নীরব স্যারকে বলে ইতিমধ্যে বিয়ের যাবতীয় ব্যবস্থা করা শেষ। সময় পেড়িয়ে তখন বিকেলের মাঝামাঝি। হিয়াকে নিয়ে কাজি অফিসে উপস্থিত উজান। নীরবকে সাক্ষী করে যতদূত পারা যায় বিয়ে সম্পূর্ণ করলো উজান। উজানের মাথায় একটাই চিন্তা ছিলো এতোক্ষণ ধরে কোনোমতে বিয়ে করে হিয়াকে নিজের নামের পাশে জায়গা দেওয়া। তারপর বাদ বাকি দুনিয়া কোথায় যায় যাগ। ধ্বংস হোক পুরো পৃথিবী। ঝলসে যাগ সবার কঠিন হৃদয়। শুধু হিয়া উজানের হয়ে থাক। শুধু তার উজানের!
এখনো ঘোরের মধ্যে কাটছে হিয়া। সকাল থেকে কি হচ্ছে এসব তার সাথে। এক লহমায় কতো কি হয়ে গেলো তার এই ছোট্ট জীবনে। সকালে ঘুম থেকে উঠে,কলেজ থেকে ফেরার আগেও কি হিয়া ভেবেছিলো আজ এভাবে এই অসময় উজানকে বিয়ে করবে সে। কখনো কি ভেবেছিলো বাড়ি থেকে এভাবে পালিয়ে আসবে সে। কখনো কি ভেবেছিলো শিশির আর উজানের মাঝে যেকোনো একজনকে বেছে নিতে হবে তাকে..!!
শরীর পুরো ছেড়ে দিয়েছে। মাথা কাজ করা বন্ধ হয়েছে। পুরো শরীরে রক্তশূন্যতার আর্বিভাব দেখা মিলছে। কথা বলতে পারছে না হিয়া। সে তো কোনোদিন চাইনি এভাবে বিয়ে হোক তার। সেও তো চেয়েছিলো লাল টুকটুকে বউ সেজে উজানের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনতে। কিন্তু বিধাতা এটা কি করলো,ঠিক না ভূল! সে নিজেও কি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে এ-ই কাজটা করে ভালো করলো! বাড়িতে নিশ্চয়ই রিয়াজদের পরিবার তুলকালাম বাঁধিয়ে দিয়েছে। শিশির কি এতো অপমান ডিজার্ভ করতো! আর ভাবতে পারে না হিয়া। ভাইয়ের জন্য মনটা দুমড়েমুচড়ে ওখানেই পিষতে শুরু করলো। ভাই ক্ষমা করবে তো আমাকে!
!
!
সন্ধ্যার আযান পড়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ হলো। আলো হারিয়ে ফেলেছে তার জৌলুশ। রাত নেমে গিয়েছে। হিয়াকে নিয়ে স্বপ্ন মেসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে উজান। কথা অনুযায়ী নীরবের প্রেমিকা পৃথার সাথে আজ রাত টা এই ছাএীনিবাসে থাকবে হিয়া। কাল ভোরে রওনা হবে চিটাগাংএর উদ্দেশ্যে। উজান হিয়াকে সব বুঝিয়ে যাচ্ছে কখন কোথায় যাবে। কবে বাড়ি ফিরবে। কীভাবে থাকবে। কিন্তু হিয়ার অশান্ত মন কিছুতেই আজ সারাদিনের এই ঝড় গুলো থেকে বেড়িয়ে আসতে পারছিলো না। উজানের সব কথাতে হুম হ্যা করে যাচ্ছে হিয়া কিছু মগজে নিচ্ছে তো কিছু না বুঝেই প্রকৃতির উপর ছেড়ে দিচ্ছে।
– আমার একা হতে ভীষণ ভয় করছে উজান। আপনি থাকুন না আমার সাথে আর কিছুক্ষণ।
– আমি এখানেই দাঁড়িয়ে আছি। এ-ই দেখো। পৃথার রুম এই থার্ড ফ্লোরের জানালার কাছে। যখনি কিছু প্রয়োজন হবে, আমাকে দেখতে ইচ্ছে হবে তুমি জানালায় এসে দাড়িয়ে যেও কেমন।
– ঠিক আছে, কাল কখন বের হবো আমরা?
– ভোরের আলো টা ফুটুক।
হিয়া মাথা নাড়িয়ে যেতে ধরেও থেমে গিয়ে বললো,
– আমি ভাইয়ার সাথে কোনো অন্যায় করলাম না তো উজান স্যার!
উজান হিয়ার হাত টা মুঠো করে ধরে বললো,
– করেছি। তবে তোমাকে কথা দিচ্ছি সব ঠিক করে দেবো আমি!
মৃদু হেঁসে পৃথার সাথে উপরে আসলো হিয়া। ভরসা হলো উজানের উপর ঠিকই কিন্তু অনুতাপের গ্লানিতে ভেতরে ভেতরে পিষে মরছিলো মেয়েটা। এদিকে হিয়াকে পৃথার কাছে সেফলি পৌঁছে দিয়ে নীরবসহ পলাশের কাছে আসলো উজান। শিশির যেমন পলাশের চোখের তারা,কলিজার কলিজা তেমনি শিশিরের সূএে উজানো পলাশের অনেক ফেবারিট। মুচকি হাসি দিয়ে পলাশ দৌড়ে আসলো উজানের কাছে। পলাশের মুখের হাসি বলছে দোকানের ওদিকে আপাতত সবকিছু খেয়িরাত আছে।
-উজান ভাই একলা আইতে কইলেন কেন আমারে? ভাইয়ের লগে আজকেও কিলাকিলি করছেন নাকি?
মুচকি হাসলো উজান। হেসে দিয়ে বললো করিনি তবে করবো।
– আচ্ছা করেন কিলাকিলি। আমার আবার ফাইটিং দৃশ্য দেখতে সেই লাগে। অবশ্য আপানাগো যা ফাইটিং হু।
– কেন আমাগো ফাইটিংএ আবার কি আছে!
– না মারামারি ঘুতাঘুতি করি আবার দু’জনে বইসা একসাথে চা পানি খান। একই সিগারেট ভাগাভাগি করে টানেন৷ আপনাগো আর কি! কয় মাস থাকি তো এই কইরা যাচ্ছেন।
হেসে দিলো নীরব৷ সাথে হাসলো উজান নিজেও। তবে নিজেকে সংযত করে পলাশের হাতে কিছু কাগজ ধরিয়ে দিয়ে উজান বললো এগুলো সোজা গিয়ে শিশিরের হাতে দিতে। আর যেনো কারো হাতে না যায়! পলাশ মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিয়ে এক ছুটে আবার দৌড় দিলো দোকানের পথে। একটা দীর্ঘ শ্বাস টানলো উজান!
!
!
পলাশের হাত থেকে কাগজের খাম টা হাতে নিয়ে আঙ্গুলের ইশারায় পলাশকে কাজে মন দিতে বললো শিশির। ভাইয়ের হুকুম যথাযথ পালন করতে চটপট নিজের কাজে লেগে পড়লো পলাশ। এদিকে শিশির আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো যে যার কাজে মগ্ন আছে কিনা৷ সবাইকে নিজেরদের কাজে ব্যস্ত দেখে খাম থেকে কাগজ টা বের করলো শিশির। চোখবুলালো ফটোকপি করা কাগজটার এপিঠ থেকে ওপিঠ অবধি। কাগজটার আদৌপান্ত সব বুলে নিয়ে চোখ বন্ধ করলো শিশির। বন্ধ চোখেই চেয়ারে মাথা ঠেকালো সে। কাগজ গুলো লেপ্টে ধরলো নিজের প্রশ্বস্থ বুকে। একরাশ অভিমান থাকলেও কোথাও একটা শান্তি আর স্বস্তির আভাস মিললো যেনো শিশিরের চোখে মুখে..!! হয়তো সে নিজেও বাজিয়ে দেখতে চেয়েছিলো উজান তার বোনের জন্য ঠিক কতোদূর যেতে পারে..!!
!
!
রাত তখন দশটার কিছু পর। শিশিরের হাতে কাগজ দিয়ে সেই সন্ধ্যারাত থেকে এখন অবধি ছাএীনিবাসের সামনে এক চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে আছে উজান। আর হিয়া দাঁড়িয়ে আছে ঠিক তার অপজিটে দাঁড়িয়ে থাকা নীল রঙের নিবাসের থার্ডফ্লোরের জানালায়। চোখে চোখ রেখে মিনিটে হাজারবার এই নিচ থেকে দাঁড়িয়ে হিয়াকে অভয় দিয়ে যাচ্ছে উজান। তবু হিয়ার মন মানছে না। খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে তার শিশির ভাই কি করছে!
সেই দুপুর থেকে কিচ্ছু পেটে পড়ে নি না হিয়ার না উজানের। দুজনই না খাওয়া। উজান যদিও পৃথাকে হিয়ার জন্য খাবার দিয়ে দিছিলো কিন্তু হিয়া মুখে তুলেনি। আজকের এই সময়টা বড্ড ধীরে প্রবাহিত হচ্ছে মনে হচ্ছে। কখন আলো ফুটবে কখন একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলবে হিয়া।
– এখনো তুমি কাঁদছো হিয়া?
– না কাঁদছি কোথায়!
– আমাকে মিথ্যে বলছো। এখন তো আমার নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি জোড় করে তোমাকে দিয়ে বিয়ে টা করালাম এতে তোমার নিজের কোনো সহমত ছিলো না।
জানালার সিক ধরে আরো সামনে এসে হিয়া ফোন টা ভালো করে ধরে বললো,
– প্লিজ আপনি নিজেকে অপরাধী ভাববেন না। দেখুন আপনি তো বুঝেন বলুন আমার পরিস্থিতি টা। আমার ভাইয়ের জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে। চাচি না ইদানীং কেমন জানি একটা হ’য়ে গেছে আপনি জানেন না। আমি,আমি যে চাচির কাছে থেকে মানুষ কখনো না চাচি আমাকে বুঝতে দেয়নি কিছুর অভাব..
– তুমি কোনোদিন ওনার মেয়ে নীলির মতো দামি কিছু চেয়েছিলে কি তোমার চাচির কাছে যে উনি না করতে পারতেন।
– বিষয়টা তা না। বিষয়টা অনুভূতির আবেগের। আগে চাচিকে নিজের মানুষ বলে মনে হতো কিন্তু কিছু মাস থেকে চাচির ব্যবহার টা কিরকম ভিন্ন ধরনের লাগছে। উনি আমাকে হিয়া মা বলে ডাকছেন ঠিকই কিন্তু ঔ কন্ঠে সেই আগের রেশ নেই। উনি চাইছেন আমি যতো তাড়াতাড়ি বিদায় হতে পারি তোতোই ভালো। অবশ্য আমি ভুল ও হতে পারি।
– তা-ই জন্য তোমার মনে হচ্ছে তোমার চাচি শিশিরকে কথা শোনাবে,বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিবে।
– সেটা উনি পারবেন না। কারণ দাদু আমাদের ঔ জায়গা টুকু বাবা আর চাচ্চুকে দু’জনের নামে সমান সমান করে লিখে দিয়েছেন। আমার শুধু ভয় ওরা না মনোমালিন্য করে ভাইয়াকে কিছু কথা শুনিয়ে দেয়।
– কেউ কিচ্ছু শোনাবে না৷ আমি গিয়েছিলাম দোকানের ওদিকে। পলাশ বললো তোমার ভাই নিত্যদিনের মতো স্বাভাবিক আছে। দোকানো করছে..অবশ্য আমি একটু অবাক হয়েছি এতে শিশির তোমাকে খুঁজতে না বেড়িয়ে দোকান সামলাচ্ছে,স্ট্রেন্জ না?
– ভাইয়া সত্যি আমাদের খোঁজ করছে না!
– পলাশের কথা শুনে তো তাই মনে হলো।
– তাই!
– হুম তোমার ঔ নিষ্ঠুর ভাই বুঝেছে আমার সাথে সে পারবে না। কিরকম তার নাকে ডগা দিয়ে তার বোনকে ভাগিয়ে নিয়ে আসলাম!
রেগে গিয়ে হিয়া বললো,
– মোটেই আমার ভাই নিষ্ঠুর না। নিষ্ঠুর তো আপনার পরিবার।
– তোমার ভাই কি যেএএ চিজ ভাই রে ভাই উপর মাবূদ ই ভালো জানেন সেটা। ড্রাকুলা একটা।
রাগে ঠোঁটে ঠোঁট চিপে ফোন কেটে দিলো হিয়া। উজানকে একটা ভেংচি কেটে জানালার পর্দা টেনে দিয়ে বিছানায় এসে শুইয়ে পড়েই চোখ বন্ধ করে নিলো। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললো আমার ভাই ড্রাকুলা হলে আপনি কি জিরাফের বাচ্চা একটা!
!
!
সব কাস্টমারদের বিদায় দিয়ে দোকানের সিক নামিয়ে তালা দিচ্ছিলো শিশির। আজকে মনে হয় একটু বেশি লেট হয়ে গেছে দোকান বন্ধ করতে। আশেপাশের কমবেশি সব দোকানী বন্ধ। মানুষজনের আনাগোনাও অনেকটা কম। তালা দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়নের শার্টটা ঝারতে ঝারতে সামনে তাকাতেই থমকে গেলো শিশির। রোদলা!…এ-ই এতো রাতে রোদ এখানে! ধীর পায়ে রোদের দিকে এগিয়ে আসলো শিশির। রোদের মায়াভরা মুখটার দিকে তাকাতেই বুকটা ভারী হয়ে আসলো তার। কিরকম বিবর্ণ হয়ে আছে দেখো। কিছু কি খাইনি নাকি সারাদিন!
– তুমি এখানে?
ভেজা ভেজা চোখে কাঁপা কন্ঠে রোদ বললো,
– ভয় হচ্ছিলো ভীষণ। উজান উজান খুব রেগে ছিলো। বললো তোমাকে খু*ন করে দেবে। আমি ওর পা ধরে ওকে আটকাতে চেয়েছি ও শোনেনি। বাবা ছিলো বাড়িতে আমাকে বের হতে দেয় নি। তোমাকে ফোন দিয়ে পাচ্ছিলাম না। আরো ভ*য় হচ্ছিলো। তুমি তুমি ঠিক আছো?
মৃদু হেঁসে রোদের মাথায় হাত বুলে দিলো শিশির। ধীর কন্ঠে বললো “পাগলি”। মুহুর্তে এক ফালি হাসি দিলো রোদ।
– এখন এ-ই রাতে কি বলে বের হলে?
– সাব্বির নিয়ে আসলো। মা’কে বললো একটা ফ্রেন্ড আছে ওর জন্মদিন আমাকেও নিয়ে যেতে চায়। মা রাজি হলো। সাব্বির আমাদের কথা সব জানে। ও বাড়িতে এসেছিলো একটা কাজে। ওকে সব খুলে বলতেই ও নিয়ে আসলো। ঔ যে দেখো ওদিকে মোটরসাইকেলে দাঁড়িয়ে আছে।
পেছন ঘুরে সাব্বিরের দিকে তাকালো শিশির। সাব্বির আর শিশির পূর্ব পরিচিত। রোদের সূএেই পরিচয়। বেশ কয়েকদিন দেখাও করেছিলো তারা। রোদকে নিয়ে পায়ে হেঁটে সাব্বিরের কাছে আসলো শিশির। দু’জনে হ্যান্ডসেক করে জড়িয়ে ধরলো হালকা। সাব্বির হেঁসে দিয়ে বললো” এ-ই যে রোদ ম্যাডাম,খুশি তো এখন আপনি। যা কান্নাকাটি করছিলো আমি তো ভাবলাম কি না কি” সাব্বিরকে থ্যাংকস জানালো শিশির। সাব্বির বললো আমি একটু আমার এদিকের কাজ টা সেরে আসি তোরা না হয় বরং একটু কথা বলে নে। রোদ তো একপায়ে রাজি হয়ে গেলো। শিশির বললো ঠিক আছে, ফোন দিও তোমার কাজটা শেষ হলে। সাব্বির চলে যেতেই একটা রিকশা ভাড়া করলো শিশির। যদিও রাত অনেক গভীর হওয়াতে তাকে গুনতে হলো এক্সট্রা টাকা!
নির্মল প্রকৃতি। শুনসান চারিপাশ। দোকান পার্টের বেশিরভাগই বন্ধ। রিক্সা চলছে ভার্সিটির রাস্তার দিকে। ভার্সিটির ঔ নিয়ন আলোতে ঘেরা রাস্তা টা তো এমনিতেই মনোমুগ্ধকর তারউপর এ-ই রাতে,হিমেল বাতাসে একটু বেশি মনে ধরছে আজ।
শিশিরের ঘামে ভেজা শার্টের ভাঁজে মুখ লুকিয়ে,শিশিরের বাহুতে হেলান দিলো রোদ। এ-ই তো শান্তি। এটাই শান্তি। এটাই যেনো সর্বসুখ।
– সারাদিন অনেক ধকল যায়না তোমার উপর দিয়ে?
– কোথায়,এটুকু পরিশ্রম না করলে হবে।
– কতোটুকু পরিশ্রম করো তা তো তোমার শরীর দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
– আরে না। গরম না খুব……..রোদ?
– হুম বলো?
– বাড়ি থেকে কি বিয়ের জন্য খুব চাপ দিচ্ছে।
– না। আগে মা একটু পেশারাইজ করতো কিন্তু বাবাকে বলে সামলে নিয়েছি। বলেছি অনার্সটুকু শেষ করতে চাই।
– আমাদের ফাইনাল হবার আর কতোদিন আছে? স্যাররা বলেছিলো কিছু এ বিষয়ে?
– কতো আর সবাই তো বলছে চার পাঁচ মাস পরেই নাকি ফাইনাল।
– চার-পাঁচ মাস…হয়ে যাবে।
শিশিরের বাহু থেকে মুখ তুলে রোদ কপালে হালকা ভাজ এঁকে বললো”কি হয়ে যাবে?” শিশির রোদের ডান হাত টা নিজের পায়ের উরুর উপর তুলে রোদের আঙ্গুল নাড়তে নাড়তে বললো।
– সামনের উঠোনের বাদিকের জায়গাটা তো জানো আমাদের।
– হুম বলেছিলে একবার। ওখানে নাকি ভীওিও দেওয়া আছে শুধু ছাঁদ করা নেই।
– হুম….ওখানে আমাদের একটা ছোট্ট বাড়ি বানাবো। আমি থাকবো তুমি থাকবে আর এ-ই(রোদের নাকটা টেনে ধরে বললো) এই রোদের মতো অনেকগুলো সিনড্রেলা থাকবে!
শিশিরের এই কথা গুলো রোদের মন ভালো করার জন্য মারাত্মক পর্যায়ের যথেষ্ট ছিলো। রোদের তো বেশি কিছু চাহিদা ছিলো না। ক্লান্তির সব রেশ মুহুর্তে ধুলোয় মিশে গেলো। চোখে মুখে শান্তির রেখা ফুটে উঠলো রোদের। তার তো চাই একটা নিজের সাজানো সংসার। ছোট্ট হলেও ক্ষতি নেই কিন্তু সেটা পরিপাটি হওয়া যেনো চাই চাই।
– সত্যি!!….কিন্তু তুমি এতো টাকা পাবে কোথায়?
– কেনো শিশির কে কি তোমার এতোই অকাজের মনে হয়!
– আরে কি মুশকিল তা বলছি কোথায়? ছাঁদ দিয়ে রুম করতে,সেটা রঙ করতে, সাজাতে তো অনেক খরচ এতোগুলো একসাথে,কি করে?
– হুম,মায়ের গ্রামে যেই অংশটুকু ছিলো মামারা সেদিন ভাগে বসেছিলো। আমি তো গিয়ে ওখানে থাকবো না। তাই মামা বললো তোর মায়ের জমি যেহেতু আমার সাথে লাগানো আমি তোকে টাকা দিচ্ছি তুই ওটা আমাকে লিখে দে। তাহলে মামারো বড় করে বাড়ি করতে সুবিধে হতো।
– তুমি কি বললে?
– বললাম আমি রাজি। তারপর ওখান থেকে আড়াই লাখের মতো পেলাম একটু বেশি দুই লাখ আশি। আর বাবার ব্যাংকে কিছু টাকা ছিলো।
– হ্যা আঙ্কেল তো ব্যাংকে জব করতো শুনেছি আমি।
– হুম ওখানেই জমা ছিলো,ওটা ফিক্সড ডিপোজিট করা ছিলো। আমি নমিনি ছিলাম। হিয়া তো তখন হয়নি। ওখান থেকে না ওরা লাভ সহ ৬এর কাছাকাছি দেবে। অনেকদিন হলো যে। আর আমার নিজের কিছু জমানো ছিলো যেটা আমি হিয়ার বিয়ের জন্য রেখেছিলাম বা ভবিষ্যৎ এ যদি কিছু করতে হয়। সব মিলিয়ে ১১লাখের একটু উপরে এ্যারেন্জ করেছি….সেদিন এক ইঞ্জিনিয়ার এর সাথে কথাও বললাম। বললো যে ঔরকম তিনটে রুম ড্রয়িং ডাইনিং আর দুটো ওয়াশরুম করতে দশের কাছাকাছি লাগবে। হয়তো একটু বেশি। লাগলে ওটা পরে ম্যানেজ হয়ে যাবে……সামনের মাস টা পড়লেই কাজে হাত দেবো এরপর,ফাইনাল।
– সবই তো বুঝলাম কিন্তু চাচিরা কিভাবে নিবে বিষয়টা যদি ওরা মন খারাপ করে!
– করবে না রোদ। ওরা চাইছেই আমি আলাদা থাকি। মুখে বলে না বোঝা যায়। চাচ্চু অবশ্য মাটির মানুষ কিন্তু তারপরো। আর তাছাড়া।
-তাছাড়া?
– আমি তোমাকে চাচির সাথে রাখবো না রোদ। আমরা আলাদা থাকবো আমাদের আলাদা বাড়ি হবে। হিয়া উজানো যদি থাকতে চায় আমাদের সাথে then they are also always invited!
– বালাইষাট উজান আর হিয়া আমাদের সাথে থাকতে যাবে কোন দুঃখে। আমার ভাইয়ের কি বাড়ি নেই নাকি হু….তবে আমরা চারজন একসাথে থাকলে কিন্তু খুববব মজা হবে বলো। আমি আর হিয়া সারাক্ষণ তখন?
– হুম,হয়েছে আর তাহলে!
– আচ্ছা শোনো না আমারো না কিছু জমানো টাকা আছে প্রায় এক লাখের উপরে দেড়ের মতো তুমি নিবে। যদি কম পড়ে।
– ধুর পাগলি,তোর টাকা আমি নেবো কেনো,আমি তো এ্যারেন্জ করেই নিয়েছি সব।
– আহা তা বলছি না। আচ্ছা বাদ দেও। ওটা আমি জমিয়ে রাখবো তারপর আমি আমাদের রুমের জন্য ঔ পুঁথির সুন্দর সুন্দর মালা গুলো আছে না দরজায় লাগানোর ওগুলো একটা কিনবো?
– একটা শুধু!আর কি কিনবি?
– আর একটা ওয়াইন চার্ম কিনবো। তারপর হুম একটা আমাদের বিয়ের একটা ইয়াআআআ বড় ছবি বাধাই করে আমাদের বেডের উপর টাঙ্গিয়ে রাখবো ঠিক আছে।
শিশির রোদের নাকটা আবার টেনে দিয়ে বললো ওকে মাই বিউটিফুল সিনড্রেলা। সব হবে। শুধু আমাকে আর একটু সময় দিন আপনি!
এদিকে শিশিরদের রিক্সা ঠিক এসময় ক্রস করছিলো স্বপ্ন ছাএীনিবাসের রাস্তা দিয়েই। এখনো হিয়া জানালায় মাথা ঠুকে নিচের দিকে দাঁড়িয়ে থাকা উজানকে দেখে যাচ্ছে। উজানো বন্ধ দোকানের সাথে রাখা উঁচু ব্রেঞ্চটায় হেলান দিয়ে মগ্ন তার পিচ্চি হিয়াকে পাহাড়া দিতে। শিশিরদের রিক্সা ঠিক ক্রস করলো উজানের সামন দিয়ে। ঘন অন্ধকার আর নিজেদের মধ্যে গল্পে লিপ্ত থাকায় উজানকে ঠিক লক্ষ্য করলো না শিশির আর রোদ। এদিকে এদেরকে একসাথে দেখে চমকে উঠলো উজান। ঠিক দেখলো তো উজান। না ভুল হতেই পারে না। এটা তো শিশির আর রোদ’ই। কিছুমুহুর্ত হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থেকে রাগে ফেটে পড়লো উজান। এখানে এরা টেনশনে ফেটে যাচ্ছে আর এদেরকে দেখো কিরকম বিন্দাসে রাএিবিলাসে বেড়িয়েছে!
চলবে..