?#চোখের_তারায়_তুই?
#পর্ব_২৮
#ইভা_রহমান
আজো রোজকার মতোই শিশির দোকানে এসে তার হিসাবের খাতায় সব হিসাব মিলিয়ে দেখতে ব্যস্ত। আজকে মনটা তার সবকিছু থেকে অনেকটা হালকা লাগছে। একটা শান্তি,একটা ভালোলাগা,একটা অদ্ভুত অনুভূতি আজ তার মাঝে বিরাজ করছে। তার তো ভয় ছিলো হিয়াকে নিয়ে,কার হাতে তুলে দিবে সে তার এই সন্তানতুল্য বোনকে। যার হাতে তুলে দিবে সে পারবে তো হিয়াকে তার মতো করেই গড়ে তুলে সারাজীবন আগলে রাখতে। আজ শিশিরের সব দুশ্চিন্তা মিশিয়ে গিয়েছে। এরপর আর তার যাই হোক উজান তো আছে হিয়ার ঢাল হ’য়ে। আর তার বিশ্বাস উজান সারাজীবন শুধু হিয়ার ঢাল না,সে তো সারাজীবন হিয়াকে ঝিনুকের মতো আবরণে আগলে রাখা খোলস হয়ে হিয়ার সারাজীবন জুড়ে থাকবে…আজকে নিজেকে আরেকটু বেশি হালকা লাগার কারণ তার আর তার রোদরানির একটা সাজানো,পরিপাটি, যতোটা পারা যায় গোছানো আর ভরপুর সংসার সাজাতে যা যা করতে হবে অনেকটাই তার হাতের নাগালে এখন। ইন্জিনিয়ার এসে সব গুছিয়ে দিয়েছে। ছাঁদ ঢালাইের কাজ কম্পিলিট। এখন শুধু প্রাচীর তুলে সেটাকে সাজিয়ে নেওয়া বাকি। সেটা সাজাতে যা যা দরকার ইট সিমেন্ট বালু সব এসে প্রস্তুত। কাল থেকে তার রোদরানির স্বপ্নে আঁকা বাড়িটার কাজের দ্বিতীয় শুভারম্ভ হবে। সাথে গ্রাম থেকে পাওয়া কাঠ গুলো দিয়ে যা যা ঘরের জিনিস বানানো যায় সব অর্ডার দিয়েই দোকানে এসে বসলো শিশির। সেই অর্ডারের ম্যামো হাতে রোদকে নিয়ে তার এক সাজানো সংসারের প্রতিচ্ছবি ভাবতে গিয়েই মুচকি হাসলো সে। এরপর না হয় ভবিষৎ এ যা হবে দেখা যাবে। দরকার পড়লে রোদকে তার পরিবার থেকে ছিনিয়ে আনবে সে। দেখবো কে কি ক্ষতি করতে পারে তাদের!
কিন্তু শিশির জানতো না এ-ই রামধনু ওঠা আকাশটা মুহুর্তে এক কালো ছায়ায় ঢেকে গিয়ে এক বিশাল ঝড় বয়ে নিয়ে আসবে তার জীবনে। তার সাথে রোদ,হিয়া আর উজানের জীবনটাকেও লন্ডভন্ড করে দিয়ে পুরো বিধস্ত করে ছাড়বে!!
অর্ডারের ম্যামো টা মানিব্যাগে ভরে রেখে যেই হিসাবের কলম টা ধরতে যাবে ওমনি বিভৎস এক চিৎকারে কেঁপে উঠলো শিশির। কি হচ্ছে এসব। শিশির চেয়ার থেকে ওঠার আগেই দুজন পুলিশ এসে শিশিরের উপর এমনি চড়াও হয়ে উঠলো যে তারা তো শিশিরের গায়ে হাত তুললো তুললো সাথে শিশিরকে বাঁচাতে এসে ছোট্ট পলাশো তাদের সেই পাথর সমান আঘাতের হাত থেকে রেহাই পেলো না। তারা হায়নার মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো শিশিরের উপর। হিংস্রতাক ভাবে জখম করতে থাকলো শিশিরকে। সাথে লন্ডভন্ড করে দিলো দোকানের যাবতীয় সবকিছু। বাকি কর্মচারিরা সবাই পুলিশের ভয়ে বাহিরে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো, কেউ বা প্রতিবাদ করতে চাইলো কিন্তু সাহস জুটাতে পারলো না৷ তারা ব্যবসার সব মালামাল ধ্বংস করে একটা রণক্ষেত্র তৈরি করলো জায়গাটাকে। কাঁচের ঝনঝন শব্দতে মুখরিত হয়ে উঠলো চারপাশের পরিবেশ। রাস্তায় লোক জড়ো হলো। খবর পাবার সাথে সাথে চাচ্চু কাপড়ের দোকান হতে ছুটতে শুরু করলো তার এই দোকানে। কিন্তু লাভ হলো না কিছুই। তার আগে হাতে হ্যান্ডক্যাফ পড়িয়ে শিশিরকে তারা নিয়ে গেলো থানায়। শুরু করলো শিশিরের উপর তাদের অমানবিক পাষবিক নির্যাতন….!!
!
!
– এ-ই কাজ টা আগে করতে পারলে আর এ-ই দিন দেখতে হতো না আমাদের। বারবার বলেছিলাম ভাইয়া তোমার ছেলে স্টুডেন্ট ভালো তাকে বাহিরে পড়াশোনা করাও। কিন্তু তুমি তো শুনো নি না কারো কথা।এখন কি হলো দেখলে।
রোদের মা’কে চুপ করিয়ে দিয়ে রোদের বাবা বলে উঠলেন,
– আমার তো এটা ভেবে অবাক লাগছে যে বড় ভাবি আপনি সবটা জানার পরো কি করে এটা লুকিয়ে গেলেন,অনন্ত আমাদের পরিবারের সম্মানের কথা না ভাবুন,আপনার নিজের স্বামীর ইজ্জত,তার কথা তো ভাবতে পারতেন।
উজানের মা নির্বাক। নিজের ছেলের জন্য যে আজ পুরো শাহরিয়ার পরিবার ওনাকে বিচারকের কাঠ গড়ার দাঁড় করাবে এটা তার কাছে নতুন কিছু না। উনি জানতেন সবকিছু এসে একদিন ওনার ঘাড়েই পড়বে। তাই আজ দোষ না করেও দোষের ভাগীদার হয়ে তাকে মাথা বুজে সব শুনতে হচ্ছে..!
– বাসবি__তুমি আমার সাথে এই পরিবারের সাথে কথাটা লুকিয়ে যতো বড় অন্যায় করেছো তা ক্ষমার অযোগ্য। তোমার ছেলের এতো বড় একটা ভূল কে তুমি ফ্রেন্ডদের সাথে ট্রিপ বলে চালিয়ে যাচ্ছিলে আমার সাথে এতোদিন! ছিঃ
হঠাৎই সিয়াম এবার উঠে এসে বলতে শুরু করে,
– ভরেছে না জেলে। এবার রিমান্ডে নিলে ভাইয়া কোথায় আছে কি করছে সব বের করে দিবে ঔ মেয়ের ভাই। আগে জানলে ঔ ছেলেকে কতোদিনে খু*ন করে রেখে দিতাম। নেহাৎ আজ তোমরা আটকালে বলে। আর মা তোমাকেও একটা কথা বলছি আমি কিন্তু রোদেলার ব্যাপার স্যাপার ইদানীং খুব ভালো দেখছি না। অনেক কিছু কিন্তু কানে আসে আমার। এখন তো বড় আব্বুও চলে আসছে। ভালোই ভালো মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেও এর মধ্যে। নয়তো ভাইয়ার মতো বাড়ির সম্মান ডোবাতে তোমার মেয়েও কিন্তু এক সেকেন্ড ভাববে না।
দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে এতোক্ষণ সবকিছু হজম করছিলো রোদেলা। পুরো শরীর কাঁপছে তার। কি ক্ষতি করেছে এরা তার শিশিরের সাথে! পুলিশ,রিমান্ড, হত্যা এগুলো কি বলছে তার বাড়ির সবাই। শিশিরকে কি পুলিশ! কিছু মুহুর্ত ওখানেই শকড হ’য়ে দাঁড়িয়ে ছিলো রোদেলা। মাথা কাজ করা ছেড়ে দিলো কিছু মুহুর্তের জন্য। এসব যদি সত্যি হয় তাহলে শিশিরের কি হবে,শিশিরের ভবিষ্যৎ!
একটা মুহুর্ত আর বিলম্ব না করে রোদের জমানো যতো যা টাকা ছিলো সেই টাকা আর মোবাইল নিয়ে সোজা বাড়ির বাহিরে বেড়িয়ে আসলো রোদ। আর সোজা এসে থামলো শিশিরের দোকানের সামনে। রিক্সা থেকে নেমেই পা আঁটকে গেলো রোদেলার। এতো মানুষ কেনো এ-ই জায়গাতে। কীসের এতো ভীড়। এক পা দু পা করে ভীড় ঠেলে দোকানের মুখে আসতেই কেঁপে উঠলো রোদেলা। একি অবস্থা সবকিছুর। এগুলো এরকম ছিন্ন বিছিন্ন হয়ে পড়ে আছে কেনো সব। এ-ই এই থাই গুলো এরকম গুঁড়া গুড়া হয়ে সব জায়গায় কাঁচের ছড়াছড়ি কেনো?রমজান মামা,আর রিফাত চাচার কপাল দিয়ে রক্ত কেনো পড়ছে?আর চাচ্চু মাটিতে বসে এভাবে কেনো কাঁদছে। শিশির শিশির কোথায়?
রোদেলা কাঁপা পায়ে চাচ্চুর সামনে এসে বসতেই রোদকে দেখামাএই রেগে গিয়ে আরো কান্না করে ভাসিয়ে দিলো চাচ্চু,কান্নারত চোখে অভিযোগ ছিলো স্পষ্ট!
– ধ্বংস করে দিলে তো রোদ মা। সব কেড়ে নিয়ে গেলে তোমরা। পথে নামিয়ে দিলে। কি খাবো এখন আমরা,কি দিয়ে বাঁচবো বলতে পারো মা।
– এসব কি চাচ্চু। শি শিশির কোথায়?
– কি করবে ঔ ছেলেটাকে দিয়ে। পুরোপুরি মেরে ফেলবে। তোমার ভাই তো আমার সব মান সম্মান নিয়ে চলে গেলো আর তুমি,তুমি আমার পেটের খাবার টা নিয়ে চলে গেলে রোদ মা!
চাচ্চুর সাথে এবার কান্নায় ভেঙে পড়লো রোদেলা। এসব কি বলছে চাচ্চু। রোদ কেনো তাদের পেটের খাবার কেড়ে নিতে যাবে। চাচ্চু আর কথা বাড়ালো না। পুড়ে যাওয়া ক্ষতের ছাই থেকেই খুঁজতে থাকলো কিছু ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায় কি না। সবার কথা বলাবলিতে রোদ জানতে পারলো শিশিরকে থানায় নিয়ে গিয়ে রাখা হ’য়েছে। হয়তো ওদের মনমতো কিছু তথ্য না পেলে এরপর তাকে জেলে নেওয়া হবে। একটা মুহুর্ত আর দাঁড়িয়ে থাকলো না রোদ। সোজা এসে দাঁড়ালো থানার সামনে। জীবনে প্রথমে সে এ-ই থানার গন্ডিতে পা রাখছে কোথায় কি করতে হয়,কাকে কি বলতে হয় জানা নেই তার। তবুও সাহস করে ভেতরে ঢুকলো সে। থানার মানুষ গুলো কিরকম বাঁকা চোখে তাকিয়ে আছে রোদের দিকে। ব্যাপারটা বেশ সংকোচের হলেও রোদ এদিক সেদিক ভিড়তে থাকলো শিশিরের খোঁজে। মূল ভবনের দিকে আসতেই একটু দূরে তার চোখ পড়লো দেওয়ালের এক কিনারে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট পলাশের উপর। পলাশের কপাল ফেটে গিয়ে রক্ত জমা হ’য়েছে। দুচোখ দিয়ে অবিরত বয়ে যাচ্ছে লোনাজল। মনে হচ্ছে মনিবের এ-ই দূর্বিষ পরিস্থিতি বাচ্চাটাকেও পিষিয়ে মারছে। দৌড়ে পলাশের দিকে ছুটে আসতেই নিজের রোদ আপাকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লো পলাশ। রোদ নিচে বসে পলাশের দু বাহু ধরে তাকে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে প্রশ্ন করতে থাকলো শিশির কোথায়! কোথায় নিয়ে গিয়ে রাখছে তারা তার শিশিরকে।
– ভাইয়েরে ঔ পুলিশ লোকটা খুব মারছে রোদ আপা। ভাইয়ের অবস্থা ভালা না। মুখ দিয়া মেলা রক্ত পড়ছে। ভাইয়ের শরীর জখম বানায় দিছে লোক গুলা। তুমি কিছু করো রোদ আপা। এমন মা-ইর খাইতে থাকলে তো ভাই আমার…
পলাশ আর কিছু বলার আগে পলাশের মুখ চিপে ধরলো রোদেলা। সে থাকতে তার শিশিরের কিচ্ছু হতে দিবে না সে। কিচ্ছু না। সে ঢাল হয়ে দাঁড়াবে তার শিশিরের হ’য়ে…উঠে গিয়ে থানার ভেতরে আসলো রোদ। যে-ই পুলিশ দুটো শিশিরকে নিয়ে এসেছিলো তাদের সাথে কথা বলে বললো সে শিশিরের সাথে দেখা করতে চায়,আর্জেন্ট। পুলিশ দুটো রাজি তো হলেই না বরং নানা মন্তব্য করে বিদায় করতে চাইলো রোদকে। শেষে রোদ বাধ্য হয়ে বললো সে কর্ণেল ওসমানের মেয়ে আর তাকে তার বাবা-ই শিশিরের সাথে কথা বলার জন্য পাঠিয়েছে। বিশ্বাস না হলেও রোদকে অগ্রাহ্য করার সাহস হলো না তাদের। তারা রোদকে পারমিশন দিলো ঠিকই সাথে ফোন করে সবটা জানালো রোদের ভাইকে..!!
!
!
একটা রুমের উপর বিধস্ত হ’য়ে পড়ে আছে শিশির। মুখ দিয়ে এখনো চুইয়ে চুইয়ে হালকা রক্ত পড়ছে তার। গায়ের শার্ট টা আর গায়ে পড়া নেই,সাদা গেঞ্জিতে রক্তের ছাপ স্পষ্ট। ফর্সা ফর্সা বাহুতে মোটা লাঠির মারের দাগ স্পষ্ট। সাথে পায়ের কাছেও ফুলে টনটন করছে তার। এ-ই শরীরের দিকে তাকাতে শিউরে উঠলো রোদেলা। কি নির্মম অবস্থা বানিয়েছে এরা তার শিশিরের। গ্রীলে দুহাত ঠেকিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতেই মাথা তুলে সামনে তাকালো শিশির। একি তার রোদরানি এখানে! অনেক কষ্টে দেওয়াল ধরে দাঁড়িয়ে রোদের কাছে আসলো শিশির। এক হাত রাখলো রোদের এক হাতের উপর,আরেক হাত বাড়িয়ে হাত রাখলো রোদের মাথার উপর। করুন চাহনি ভরে শিশিরের চোখের দিকে তাকিয়ে অনুতাপ, অপারগতা সব জাহির করলো রোদেলা। শিশির বুঝলো তার প্রেয়সীর সক্ষমতা কতুটুকু। সে যে এই নরপিশাচ দের ভয় ভূলে তার কাছে এসেছে এটাই তো যথেষ্ট তার জন্য,তাই নয় কি!
– তুমি এখানে কেনো আসছো রোদ। তোমার বাড়িতে জানে?
– আমাকে ক্ষমা করে দেও তুমি। সব আমার জন্য। সব কিছুর জন্য আমি আমি দায়ী।
রোদের চোখের পানিটা মুছে দিয়ে শিশির আহত কন্ঠে বললো,
– একদম নিজেকে দায়ী ভাববে না রোদ। তুমি এখন আমার কথা শুনো। তুমি বাড়ি যা-ও। সব ঠিক হ’য়ে যাবে। আমি সব ঠিক করে দেবো প্রমিস করছি তোমাকে।
– আমি তোমাকে এভাবে রেখে কোথাও যাবো না শিশির। মানুষ এতো খারাপ আর জঘন্য কি করে হতে পারে…ওহ শিশির, শিশির তুমি ওদেরকে বলে দেও না গো ভাইয়ারা কোথায় আছে। তাহলে তো ওরা তোমাকে ছেড়ে দিবে বলো?
– না রোদ,উজান আর হিয়া একসাথে অনেক ভালো আছে ওদের ভালো থাকতে দেও। আমি তো বলছি সময় আসলে আমি সব বলবো।
– কিন্তু এভাবে পালিয়ে বাঁচিয়ে কতোদিন। তুমি না বলতে পারলে আমাকে বলো আমি বলি ওদেরকে।
– না রোদ একদম না। যখন সময় আসবে আমি সবাইকে সবটা বলবো। তুমি আগ বাড়িয়ে কিচ্ছু করতে যাবে না। তুমি এখন আমার কথা শুনো তুমি বাড়ি যাবে এখন। গিয়ে চুপচাপ থাকবে। এদিকে কে কি করলো না করলো তোমাকে ভাবতে হবে না।
– এখনো ভাববো না বলছো। এতোকিছু হ’য়ে যাবার পরো বলছো চুপ করে থাকতে। তুমি কি চাইছো উজান আর হিয়া ওখানে ভালো থাক। আর তুমি এখানে…আর আমি কোথায় যাবো সেটাও বলে দেও তাহলে। তুমি তোমার বোনের কথা ভাবছো আর আমার ভবিষ্যৎ আমার ভালো থাকা। তুমি না থাকলে কি করবো আমি। বলে দেও। কি হলো বলো।
অস্থির রোদেলার দু গালে হাতরেখে তাঁকে গ্রীলের একদম গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে দিলো শিশির। মুখ বাড়িয়ে রোদের কপালে একটা চুমু দিয়ে বললো,
– তুমি তো অন্তত আমাকে ভূল বুঝো না রোদ। হিয়া যেমন আমার কাছে ইম্পর্ট্যান্ট তেমনি তুমিও আমার জন্য অনেক স্পেশাল। আমার জীবনে তুমি আর হিয়া ছাড়া কে আছে বলো।
– তাহলে বলে দেও সবটা।
– কেনো জীদ করো তুমি রোদ। ওরা তো আমাকে নিয়েই আসছে। যা নির্যাতন করার করেছে না। বিনা অপরাধে তারা তো আমাকে এখানে আঁটকে রাখতে পারবেনা বেশিদিন তাই না বলো।
রোদ অস্থির হয়ে মুখ খুলে কিছু বলতে যাবে তার আগেই সেখানে এসে উপস্থিত সিয়াম সহ রোদের বাবা। মেয়েকে আর শিশিরকে এভাবে এতো ক্লোজলি দেখে যেনো উনি পুরো হতভম্ব হয়ে পড়লো। তারমানে আসতে আসতে রোদ আর শিশিরের সম্পর্কে সিয়াম যা বললো সবটা সত্যি! রোদের গালে এক থাপ্পড় বসিয়ে উনি চিৎকার শুরু করলেন। সাথে সাথে পুলিশ এসে জড়ো হ’য়ে শিশিরকে আবার পাকড়াও করলো। বাবা মেয়ের একটা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো ইতিমধ্যে। শিশির হাত জোড় করে বিনীতির সুরে বলতে লাগলো” রোদের কোনো দোষ নেই আঙ্কেল,ওকে ছেড়ে দিন” কিন্তু রোদের আব্বু শুনলো না। টেনেহিঁচড়ে রোদকে নিয়ে আসলো বাড়িতে। শুরু করলো মেয়ের উপর মানসিক নির্যাতন। শাহরিয়ার বাড়িতে বইতে শুরু করলো এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঝড়ের তান্ডব। রোদো কম জীদের মেয়ে না। বাড়িস সব কিছু তছনছ করে,ভেঙে ফেললো সবকিছু। অনেক দিন অনেক সহ্য করেছে সে কিন্তু আর না। শুরু করলো নিজেকে আঘাত। অশান্ত রোদকে থামাতে বেগ পেতে হলো বাড়ির সবার। শিশিরকে এভাবে নির্যাতন করার জন্য যে তাদের মেয়ে এতো টা ভায়োলেন্ট হয়ে যাবে এটা তারা কল্পনাও করতে পারেনি।
!
!
সন্ধ্যার আযান পেড়িয়ে আকাশে তখন আলো অন্ধকারের আবছায়া দেখা মিলছে। নিজের রুমে বন্দি রোদেলা ছটফট করে মরছে তার নির্যাতিত প্রেমিকের জন্য। কি করে দিবে সে মুক্তি শিশিরকে। কি করে বাঁচাবে সে শিশিরের ভবিষ্যতটাকে। একবার জেলে গেলে তো কোনোদিনই আর শিশির সরকারি চাকরি পেয়ে উঠবে না। কি হবে তখন শিশিরের সব স্বপ্নগুলোর। শিশির বাঁচতে পারবে তো সেই স্বপ্ন গুলো ছাড়া। মন তো চাইছে ছুটে যাই,দৌড়ে যাই,উড়ে চলে গিয়ে বাঁচিয়ে আনুক সে শিশিরকে। কিন্তু কিভাবে। সব ক্ষমতা তো সেই নরপশু গুলোর হাতে। কে শুনবে তার ভেতরের চিৎকার?
রোদের এই অসহয়ত্বের সুযোগ নিতে একটুও ভূল করলো না তার ভাই সিয়াম সাথে তার পরিবার। রোদের সামনে এনে রাখলো এমনি এক প্রস্তাব যেটার একটা গ্রহন করা মানে অন্যটায় জ্বলে গিয়ে পুড়ে মরা।
সিয়াম ভিডিও ওন করে দেখালো এখনো পুলিশ গুলো কীরকম অমানবিক,পাষনিক নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে শিশিরের উপর। কিরকম একটার পর একটা মা’র এসে বিঁধছে শিশিরের শরীরে। সেই মারের আঘাতে কিরকম করে কেঁপে উঠছে তার শিশির।
– এসব কি সিয়াম! তোরা কি মানুষ না জানোয়ার।
রোদের গাল চিপে ধরলো সিয়াম। অগ্নি দৃষ্টি ছুঁড়ে বললো,
– খুব মুখ চলে না তোর ইদানীং, সাহস কতো তোর আমাদের ফাঁকি দিয়ে নিজের আসিককে বাঁচাতে যাস৷ নির্লজ্জ কোথাকার।
– তাও ভালো নির্লজ্জ পশু তো আর না৷
– রোদ শোন,তোকে ভালোই ভালো একটা প্রস্তাব দিচ্ছি। মন দিয়ে শোন। তুই নিজে সব দেখলি আর এর পরিনাম সামনে কতো ভয়ানক হতে পারে সেটারো আন্দাজ তুই নিশ্চয়ই করতে পারিস। শিশিরকে হত্যা করে বা গুম করে রাখতেও কিন্তু বাবা-র বেশি সময় লাগবে না।
– কি বলতে চাইছিস তুই সিয়াম। খোলাখুলি বল।
– শিশিরকে বাঁচাতে চাস তো। আমরা যা করবো তা করবি তুই?
– শিশিরকে বাঁচাতে সব করতে রাজি আমি।
– বেশ। শিশিরকে আজকের মধ্যেই থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হবে,কোনো মামলা বা এফআইআর কিচ্ছু করা হবে না। কিন্তু তার বিনিময়ে তোকে?
– আমাকে কি!
– তোকে আজকেই আমাদের পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করতে হবে,রাজি তুই?
– সিয়াম!!
– দেখ রোদ তুই যদি এ-ই প্রস্তাবে রাজি হোস তো একদিকে যেমন শিশির ছাড়া পাবে ওমনি শিশিরের ভবিষ্যৎ টাও সিকিউর থাকবে। নয়তো শিশিরের নামে কোনো মামলা থাকলে তার সরকারি চাকরি তো দূর বাবা ওর এমন অবস্থা করে ছাড়বে যে ঔ দোকান থেকে দুটো পয়সা আয় করতেও বেচারাকে মাথা ঠুকু মরতে হবে। আর একটা কথা উজান হিয়া কোথায় আছে সেটা কিন্তু আমি জানি। চাইলে বলতে পারতাম কিন্তু….
– তোকে নিজের ভাই বলতে ঘেন্না লাগছে আমার। থু তোর মুখে। বাংলায় একটা কথা আছে না জাতে মাতাল তালে ঠিক৷ তোর অবস্থাও ঠিক সেরকম। সারাদিন মাতলামি করিস কিন্তু কোথায় সুযোগ বুঝে স্বার্থ হাসিল করতে হয় খুব ভালো করে জানিস সেটা।
রোদকে ফ্লোরে ফেলে দিয়ে সিয়াম উঠে দাঁড়ালো। রোদের ঝাঁঝালো কথা গুলো যেনো হজম হলো না তার। দাঁড়িয়ে গিয়ে নিজেকে ঠিক করে নিয়ে সে বললো,
– এক ঘন্টা সময় দিলাম তোকে হয় এ-ই বিয়ের জোড়াটা পড়ে তৈরি হয়ে নিবি নয়তো ওদিকে শিশিরকে পাঠানো হবে জেলে। এখন তুই ভাব তুই কি করবি?
!
!
একটা মেয়ের জীবনে এরকম দূর্বিষ মুহূর্ত জেনো আর কখনো না আসে। একদিকে নিজের ভালোবাসা একদিকে শিশিরের ভবিষ্যত। কোনটাকে বাঁচাবে রোদেলা। মনে হচ্ছে মরে যাগ সে। পুড়ে যাগ তাও ভালো কিন্তু এ-ই মনের কষ্ট এ-ই আহাজারি কি ভাবে বেড়িয়ে আসবে সে এখান থেকে। চাচ্চুর কথা গুলো বারবার বারবার কানে ভাসছে তার”তুই আমার পেটের খাবার কেড়ে নিয়ে গেলি রোদ মা” যেনো রোদকে আরো জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খার বানিয়ে দিচ্ছে। সত্যি কি তার একটা হ্যা তে বদলে যাবে তার আর শিশিরের সমস্ত পথ,দুদিকে মোড় নিয়ে বেকে যাবে এ-ই সম্পর্কের গতিপথ।
নিজেকে কঠোরকরে বেড়িয়ে আসলো রোদেলা। কঠিন দৃষ্টি ছুঁড়ে বললো,
– আমি রাজি। কিন্তু এতে আমারো একটা শর্ত আছে।
– কি শর্ত,বল?
– আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে শিশিরকে ছাড়ানো দেখবো আর
– আর?
– শিশিরের দোকান ভেঙে যে ক্ষতিটা তোরা করেছিস,সেসব কিছুর ক্ষতিপূরণ কালকে সকালের মধ্যে বাবাকে করে দিতে হবে। ইস এ্যান্ড এ্যাভরি লস্টের হিসাব বাবাকে পুষিয়ে দিতে হবে।
– এটুকুই তো,হ’য়ে যাবে। দরকার পড়লে আরেকটা দোকান বসিয়ে দেবো শুধু তুই বিয়েটা করে নে। তবে কোনো সিনক্রিয়েট করা চলবে না। ওরা জাতে না বুঝে আমরা তোকে ফোর্স করে বিয়ে টা দিচ্ছি।
একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো রোদ।,হেসে দিয়ে বললো
– আর একটা কথা আমি বিয়েতে বসার পর যদি তোমরা আবার কিছু করার চিন্তা করো তো এ-ই রোদেলা ঠিক কতোদূর যাবে তোমরা আন্দাজেও মেলাতে পারবে না মা।
– তোর বিয়ে দিয়ে দিলেই আমাদের কোনো ঝামেলা নেই। শুধু সবকিছু করে দেবার পর তোকে যেনো মত পাল্টাতে না দেখি। নাহলে তোর এ-ই ভাই কোথায় গিয়ে কি করতে পারে সেটারো আন্দাজ তোর নেই।
– আমি তোদের মতো পরিস্থিতির সুযোগ নিতে জানি না ভাই। শিশিরের সাথে এতোদিন থেকে এতটুকু তো শিখেছি কি করে কথা দিয়ে কথা রাখতে হয়। নয়তো এই শাহরিয়ার বাড়ির যা শিক্ষা দেখলাম!
!
!
চাচ্চুর সাথে থানার গেট দিয়ে বের হচ্ছে শিশির। সাথে আছে ছোট্ট পলাশ আর তাদের পরিচিত এক কনস্টেবল। শিশিরের অবস্থা এরকম যে তার শরীরে হাটবার মতো বিন্দুমাএ শক্তি নেই। শরীর পুরো নেতিয়ে গেছে। কিন্তু তাতে এখন মন নেই আর শিশিরের তার ভাবনা তো এতো জলদি কি করে ছাড়লো এরা তাকে। তা-ও কিছু তথ্য না নিয়েই। চাচ্চু শিশিরকে বললো তুই আর পলাশ বাড়ি যা আগে আমি কনস্টেবল টাকে কিছু টাকা দিয়ে আসছি। চাচ্চুর হ্যা তে হ্যা করলো শিশির। এ-ই মানুষ টার আজ সব হারিয়ে গেছে,এরপর এই ধ্বংসস্তুপ থেকে তিনি যে কি করে সবটা সাজিয়ে নিবেন একমাত্র উনি জানেন। আজকে চাচ্চুর উপর আরেকবার সম্মান বেড়ে গেলো শিশিরের। সব হারিয়েও লোকটা ছুটে এসেছে তাকে বাঁচাতে! দিন দিন ঋন টা যেনো বাড়িয়ে দিচ্ছে এ-ই সংসারের পেছনে অর্ধেক জীবন পাড় করে দেওয়া মানুষটা।
রিক্সায় পলাশের হাত ধরে বাড়ি ফিরছে শিশির। ছোট্ট হাতেই পলাশ আঁকড়ে ধরে আছে তার শিশির ভাইয়ের হাত। সাথে মুখে এক চিরশান্তির হাসি ফুটে বলছে,
– আমি জানতাম রোদআপায় ঠিক আমার ভাইজানরে ছাড়ায় নিবে। আর তাই হইলো।
– রোদ আসছিলো পড়ে আর এখানে!
– ও মা,একি কও তুমি ভাইজান। তোমাক না যখন লকাপ থাকি বাইর কইরা ছাড়ায় দিলো তখন তো রোদ আপাও ওনার আব্বার সাথে ভেতরে আছিলো। তুমি দেখো নাই।
– রো-দ ভেতরে ছিলো! ওর বাবার সাথে? কোথায় আমি তো খেয়াল করলাম না।
– তুমি যে ভেতরের রুমে যাওনি। আমি চাচার লগে ঢুকছিলাম। রোদ আপায় তো ঔ লোকটার সাথে আইসা তোমাকে ছাড়াইলো। আর জানো তো ভাইজান আমাদের দোকানেও নাকি কয়েকজন লোক আইসা বইল্লা গেছে কালকে সকালের মধ্যে সব আগের মতো ঠিক কইরা দিবে। একদম সব নুতুন ঝকঝকা।
– কিসব বলছিস পলাশ। এগুলো সত্যি!
– হ ভাই হ। বিশ্বাস না হইলে চাচারে জিগাও তুমি। চাচায় তো লোকসানের হিসাব টা ধরায় দিলো তেনাগো হাতে।
পলাশের কথায় তপ্ত এক শ্বাস ছাড়লো শিশির। তারমানে এ-ই চটজলদি তাকে ছাড়ানোর সব সিদ্ধান্ত তার রোদরানির। মুচকি হাসলো শিশির। এ-ই পাগলি টা আর কতো কি করবে তার জন্য। নিজ মনে বলে উঠলো”এবার দেখা হলে ইচ্ছে মতো আদর করে দিবো তোকে রোদ,খুব শখ না তোর আমার হাতের আদর নেবার। আর একটু ধর্য্য ধরো সব গুছিয়ে নিচ্ছি আমি”
চলবে….