?#চোখের_তারায়_তুই?
#পর্ব_৩০
#ইভা_রহমান
ভয়ে হিয়ার আত্না শুকিয়ে একাকার। এতো রক্ত এতো আঘাত। শিশির ঠিক আছে তো। অজ্ঞানরত শিশিরের পার্লস চেক করে হিয়া বুঝতে চাইলো শিশিরের শরীরের অবস্থা। কোনো বিপদ হয়নি তো তার ভাইয়ের। যদি শিশিরের কিছু একটা… না। এ-র বেশি ভাবতে পারলো না হিয়া। শিশিরের চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে দিয়ে বারবার তাকে ঝাঁকিয়ে বলতে শুরু করলো” ভাই উঠ না ভাই,একটু চোখ খুল না। দেখ না তাকিয়ে কে আসছে তোকে দেখতে”কিন্তু শিশির উঠলো না। ঘাবড়ে গিয়ে বাহিরে বেড়িয়ে আসলো হিয়া। কার কাছে সাহায্য চাইবে এখন সে। পাশে সালেহা খালার বাড়ি গিয়ে “সালেহা খালা সালেহা খালা” বলে গলা ছেড়ে চিৎকার করতেই দৌড়ে ছুটে আসলো সালেহা খালা। কান্নারত হিয়ার অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে উঠলেন উনি। কি হয়েছে হিয়ার এরকম করে ডাকছে কেনো মেয়েটা। হিয়া হাঁপাতে হাঁপাতে বললো” সালেহা খালা চলো না একটু বাড়িতে,ভাইয়া না ওখানে” আর বলতে পারলো না হিয়া। সালেহা আপা সহ বাড়িতে আসতেই,শিশিরের দিকে চোখ পড়তেই কেঁপে উঠলেন সালেহা আপা। একি অবস্থা শিশিরের! সালেহা আপা জলদি ওনার বড় ছেলেকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন দূত শিশিরকে নিয়ে হসপিটালে শীফট করতে। সাথে উনিও যাবেন না হয়।
শিশিরকে নিয়ে ক্লিনিকে ভর্তি হতেই ডাক্তার শিশিরের অবস্থা বিবেচনা করে বললেন দূত ওটি করতে হবে। পেশেন্টের মাথা ফেটে গিয়েছে সেলাই দিতে হবে ইমিডিয়েট আর সেই সাথে চাকু দিয়ে বুকে আঘাত করার ফলে ছিঁড়ে গিয়েছে কিছু শিরা উপশিরা যেগুলো এখনই ওপারেট না করলে শিশিরকে বাঁচানো সম্ভব হবে না আর হয়তো। অপারেশন খরচ হিসাবে তাড়া ধরিয়ে দিলো হিয়ার হাতে একটা ষাট হাজার টাকার রিসিপট যার পুরোটা এখন না দিতে হলেও অর্ধেক না দেওয়া অবধি অপারেশন শুরু করা সম্ভব হবে না বলে জানিয়ে দিলো স্পর্ষ্ট। বিপাকে পড়ে গেলো হিয়া এখন কোথায় পাবে সে এই টাকা!
সাত পাঁচ না ভেবে চাচ্চুকে ফোন করলো হিয়া। কিন্তু তখনকার মতো এখনো চাচ্চু ফোন তুললো না, পরমুহূর্তে হিয়া ফোন করলো উজানকে। কিন্তু উজানের নাম্বার তো এখনো বন্ধ যাচ্ছে। এখন! হঠাৎই ছোট পলাশ দৌড়ে আসলো হিয়ার কাছে। ভাইজানের এ-ই অবস্থা শুনে আর ঠিক থাকতে পারেনি বাচ্চা টা। দোকান বন্ধ করে ছুটে আসছে সোজা ক্লিনিক।
– আমি তো বিকাল বেলায় ভাইজানরে ভালো দেখলাম হিয়াবুবু। এরমধ্যে ভাইয়ের কি হইলো। আর তুমি কই ছিলা এতোদিন। জানো না ভাইয়ার উপর দিয়ে কি কি ঝড় বইছে। কেনো আহো নাই তুমি তখন।
– কিসের ঝড় পলাশ। কিসের কি, কিসব বলছিস তুই।
– কেন ভাইএরে যখন জেলে ঢুকাইছিলো কই ছিলা তুমি তখন। ঔ পুলিশ লোকগুলা যখন আমাদের দোকান ভাঙ্গি দিলো তখন কই আছিলা তুমি?
পলাশের কথায় থমকে গেলো হিয়া। একদিকে শিশিরের এরকম মর্মান্তিক অবস্থা তারউপর পলাশের এইসব কথা। পুরো শরীর অসার হতে শুরু করলো হিয়ার। একটা বড় শ্বাস টেনে নিয়ে হিয়া বললো,
– আচ্ছা আমি ওসব কথা পড়ে শুনবো। এখন তুই আমাকে বল যে দোকানে কোনো টাকা আছে কি না? ভাইয়ের সাথে যে রমজান মামা থাকে সবসময়,ওনার কাছেও তো মাঝেমধ্যে লাভের কিছু টাকা থাকে, আছে উনি এখন দোকানে?
– হ আছে তো। দোকানেও টাকা আছে। তোমার টাকা লাগবো। কতো লাগবো কও আমারে, আমি মা’কে বইল্লা আইন্না দিচ্ছি।
হিয়া পলাশকে বললো লাগবে কিন্তু এদিকে দেখি আগে। দোকান আর রমজান মামার থেকে বিশ হাজারের মতো টাকা তুলে হিয়া ডাক্তারদের বললো যত তাড়াতাড়ি হয় ওটির ব্যবস্থা করুন আমি এক্ষুনি আর দশ এনে দিচ্ছি আপনাদেরকে। সালেহা আপার অনুরোধে ডাক্তাররা রাজি হলেন ঠিকই কিন্তু বললেন রাতের মধ্যেই বাকি দশ জমা করে দিতে কাউন্টারে। সালেহা আপা নিজের থেকে পাঁচ দিয়ে হিয়াকে বললেন এটা দিয়ে বাকি ঔষধপএ কিনতে,পরে শিশির সুস্থ হলে না হয় ফিরিয়ে নেওয়া যাবে___ওটি শুরু হলো। আর টানা দেড় ঘন্টার ব্যবধানে সম্পূর্ণ হলো ওটি। কিন্তু জ্ঞান না ফেরা অবধি কিছুই সঠিকভাবে বলা সম্ভব হচ্ছে না এখন। ভাগ্যিস মাথার চোট টা বেশি গভীর ছিলো না, নয়তো ডাক্তারদের পক্ষেও শিশিরকে বাঁচিয়ে আনা হয়তো কোনো ক্রমেই সম্ভব ছিলো না।
সালেহা আপা হিয়ার থেকে বিদায় নিয়ে বাড়িতে আসলেন। বললেন বাড়িতে ওনার মেয়ে অসুস্থ, সাথে ছোট নাতি উনি না থাকলে হবে না। হিয়া সালেহা আপাকে কৃতজ্ঞতা দিয়ে বললেন আপনি এতোক্ষন অবধি যা করেছেন আমার জন্য এটাই অনেক খালা। আপনি বাড়ি যান এখন। হিয়াকে ভালো কিছুর আশ্বাস দিয়ে বাড়িতে আসলেন সালেহা আপা। ক্লিনিকে এখন শুধু হিয়া আর পলাশ।
*
*
*
*
তখন থেকে উপর নীচ উঠানামা করতে করতে হিয়া ক্লান্ত। শরীরে যেনো চলার আর বিন্দুমাত্র শক্তি নেই তার। শিশিরকে ওটি থেকে কেবিনে শীফট করা হচ্ছে। কিছুসময় বাদে হিয়া তার সাথে দেখা করতে পারবে। নিজের ক্লান্ত বিধস্ত শরীরটা চেয়ারে বসে ছেড়ে দিলো হিয়া। একটু চারপাশের পরিবেশটা শান্ত হতেই হিয়া চাচ্চুকে ট্রাই করলো আবার কিন্তু এবারো চাচ্চু ফোন তুললেন না ওদিকে যে চাচির অবস্থাও ভালো না,চাচি ঠিক আছে তো। এবার আবারো উজানকে ট্রাই করলো হিয়া। কিন্তু আশ্চর্য হলেও উজানের নাম্বার এখনো বন্ধ । একটা দীর্ঘ শ্বাস টেনে চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখটা বন্ধ করলো হিয়া! তপ্ত এক শ্বাস টেনে নিজমনে বললো,
– কোথায় তুমি উজান। এখনো কি রংপুরে আসোনি তুমি। রাত এগারোটা পাড় হচ্ছে এখনো কি আসতে পারোনি তুমি। তোমার না সন্ধ্যার ফ্লাইটে আসার কথা ছিলো!
হঠাৎই চিন্তার গভীরে হারিয়ে যেতে পলাশের কথা গুলো মনে পড়লো হিয়ার। আচ্ছা পলাশ তখন কি বললো ঔসব। থানা,জেল,পুলিশ। কি হয়েছিলো এরমধ্যে যে। পলাশকে ডেকে নিয়ে হিয়া বললো তখন তার বলা কথা গুলোর কি মানে। কি বলতে চাইছিলো পলাশ তখন। হিয়ার অনুমতিতে পলাশ বললো কিছুদিন আগের সেই নির্মম দিনটার কথা। বললো কেমন করে শিশিরকে ঔ নরপশু গুলো আহত করেছিলো। কেমন করে তারা বিনা অপরাধে তাদের পেটের খাবার কেড়ে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলো___ মাথার উপর আকাশটা যেনো হাজার হাজার টুকরো হ’য়ে ভেঙে পড়লো হিয়ার মাথায়। শিশির এতোকিছু কতো অবলীল ভাবে সহ্য করে গেছে অথচ একটা বার বুঝতে দেয়নি তার ভাইয়ের সাথে হওয়া এই পাষবিক নির্যাতনের আভাস। রাগে ঘেন্নায় ক্ষোভে ফুঁসতে শুরু করলো হিয়া। মানুষ এরকম অমানবিক-স্বার্থপর আর বেইমান কি করে হতে পারে!
হিয়া নিজেকে সংযত করে আরো কিছু বলতে যাবে ওমনি একজন সিস্টার এসে বললো এ-ই ঔষধ গুলো নিয়ে আসতে আর বাকি টাকা টা দূত জমা করে দিতে। হিয়া সম্মতি দিয়ে বললো ঠিক আছে এক্ষুনি আনছি ঔষধ গুলো,আপনি একটু থামুন। সালেহা আপার দেওয়া টাকা গুলো দিয়ে ঔষধ গুলো কিনে হিয়া পলাশকে সেগুলো দিয়ে বললো এগুলো সিস্টারটাকে গিয়ে দিয়ে আয় আমি একটু বাড়ি থেকে আসছি। পলাশ সেগুলো নিয়ে উপরে আসতে হিয়া বাড়িতে আসলো। কিন্তু ভয়ে আর রক্তমাখা শিশিরের রুমে ঢোকার সাহস কুলাতে পারলো না। নিজের রুমে গিয়ে কাবাড থেকে একটা বক্স বের করলো। সেখান থেকে একটা পাঁচ আনার সোনার চেইন বের করে নিয়ে হিয়া আসলো আবার ক্লিনিক। এ-ই চেইন টা হিয়ার বাবা মায়ের রেখে যাওয়া শেষ চিহ্ন ছিলো। যেটা হিয়া ছোট থাকাকালীন তার মা হিয়ার গলায় পড়িয়ে দিয়েছিলো। এতোগুলো বছর সেই চেইনটাকে নিজের বাবা মায়ের শেষ চিহ্ন বলে খুব যত্নভরে রেখে দিয়েছিলো হিয়া। কিন্তু আজ ভাগ্য আর সময়ের পরিস্থিতিতে সেটাতেও হাত দিতে হলো তাকে। হিয়া ক্লিনিকে এসে পলাশের হাতে চেইনটা দিয়ে বললো ” যদি কোনো স্বর্নকারের দোকান খোলা থাকে তাহলে একবার গিয়ে নিজের মায়ের সাথে এটা বিক্রি করে দিয়ে আয় তো পলাশ” পলাশ কান্নাভেজা চোখে চেইনটা নিয়ে বললো এটা তো একটা ছোট বাচ্চার চেইন মনে হচ্ছে হিয়া বুবু, কোথ থাইক্কা আনলা এইখান?” হিয়া বললো এটা তার ছোটবেলার। এখন দরকার তাই বিক্রি করতে হচ্ছে। পলাশ আরো কিছু বলতে চাইলো কিন্তু হিয়া বললো আর কথা বাড়াস না যা বলছি গিয়ে কথা শোন আমার। হিয়ার কথা মতে চেইনটা নিয়ে পলাশ তার মা সহ সেটা বিক্রি করতে বেড়িয়ে পড়লো। এদিকে পলাশকে বিদায় দিয়ে হিয়া যে-ই রাস্তা পেড়িয়ে উপরে উঠতে যাবে ওমনি আচমকা এক ঝড়ের মতো
উজানের মা এসে হিয়াকে থামিয়ে দিলো। হঠাৎ এ-ই এতো রাতে উজানের মা’কে দেখে একটু অবাক হলো হিয়া। তারমানে উজানরা কি এসে পৌঁছেছে রংপুরে!
– কি করছো মা,দেখে রাস্তা পাড় হও। মন কোথায় তোমার আর একটু হলে তো।
– আন্টি আপনি,এখানে!
– হ্যা মা,তোমার বাড়িতে গিয়েছিলাম কিন্তু ছিলেনা পরে এক ভদ্রমহিলা বললেন তুমি নাকি শিশিরকে নিয়ে ক্লিনিকে..কি হয়েছে শিশিরের হিয়া?
বাসবির কথা শুনে হিয়ার কেনো জানি মনে হলো শিশিরের অবস্থা শুনতে চাওয়াতে বাসবি রসিকতা করছে তার সাথে একপ্রকার। যাদের জন্য আজ তার ভাইয়ের এই করুন অবস্থা তাদের এই আদিক্ষ্যেতা ঠিক হজম হলো না হিয়ার।
– কিছু না আন্টি এমনি একটু অসুস্থ। তা আপনি হঠাৎ এ-ই রাতে আমার খোঁজে। উজান কোথায়? ও ফেরেনি আপনাদের সাথে?
– ফিরেছে,বাড়িতে আছে। আমি বাড়ি থেকে তোমার কাছে আসলাম।
– উজান পাঠিয়েছে আপনাকে?
– না। আমি কিছু কথা বলতে এসেছি তোমার সাথে।
একটু অবাক হয়ে হিয়া বললো,
– এ-ই রাতে। আচ্ছা বলুন।
বাসবি হিয়াকে নিয়ে রিসিপশনের নিচে বসে পড়লো। বাসবিকে দেখে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচাইতে অসহায় আর ভয়ে কাতর এক মা তিনি। বাসবির চোখ ভর্তি পানিতে। কি দিয়ে কি কথা বলবে জানা নেই তার। হিয়া হয়তো কিছু আন্দাজ করতে পারলো বাসবির মনের সুপ্ত কথা গুলো। বুঝতে পারলো বাসবি আসলে ঠিক কি বলতে চায় তাকে। কিন্তু হিয়া চুপ রইলো। সে নিজ কানে শুনতে চাইলো বাসবির কথা গুলো আসলে ঠিক কি।
– মা আমি তোমার কাছে উজানের ভবিষ্যৎ টা ভিক্ষে চাইছি। ওর এতো পরিশ্রম,এতোদূর অবধি পড়াশোনা এগুলো তুমি বিফলে যেতে দিও না মা। ফাইনাল প্রফে সে বসতে না পারলে কি হবে তুমি বুঝতে পারছো তো হিয়া। একটু বুঝো।
– এতে আপনি আমাকে কি করতে বলছেন আন্টি?
– মা উজানের বাবা উজানের পড়াশোনার জন্য সব টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আর আমাকেও বলেছে আমি যাতে উজানের হাতে একটা পয়সা অবধি না দেই। এমনকি উজানের বাবা আমার জমানো সব টাকা তো কেঁড়ে নিয়েছে সাথে আমার এ্যাকাউন্ট,কার্ড সব লক করে রেখেছে___মা আমি শুধু তোমার কাছে একটা জিনিস চাইছি উজানকে ইন্টার্নিটা শেষ করতে দেও তারপর আমি নিজে তোমাদের এক করবো। কিন্তু এ-ই মুহুর্তে আর তোমরা কোনো জীদ করো না মা।
– এটা তো কথা ছিলো না আন্টি। আপনি তো অন্য কিছুর আশা দেখিয়ে আমাদের এখানে ফিরিয়ে আনলেন। কি দরকার ছিলো তাহলে সেই মিথ্যে নাটকটার!
– আমি বাধ্য হয়েছি মা। ওরা আমাকে ভয় দেখিয়ে মিথ্যা বলতে বাধ্য করেছিলো।
– তাহলে এখন আপনি কি চাইছেন? আমি উজানকে তালাক দেই?
– বাড়ির সবাই তো তাই চাইছে হিয়া কিন্তু বিশ্বাস করো আমি তা চাইছি না। আমি তো জানি,এতোটুকু তো এতোদিনে বুঝে গিয়েছি আমার ছেলের ভালো থাকা শুধুমাএ তোমাকে ঘিরে। আমি শুধু চাইছি তোমার এ্যাডমিশন আর উজানের এমবিবিএস টা শেষ হওয়া অবধি তোমরা আলাদা থাকো। এমনভাবে থাকো যেনো কিছু হয়নি। তোমরা তোমাদের ক্যারিয়ার টা গুছাও তারপর নাহয় অন্য কিছু ভাবো।
– আমি উজানের থেকে আলাদা থাকলে উজানের বাবা উজানের পড়াশোনার সব খরচ দিতে রাজি হবে আন্টি! তখনো তো আমি আর উজান একটা সম্পর্কে আবদ্ধ থাকবো তাই না। তাহলে?
বাসবি নিজের চোখ দুটো মুছে নিয়ে বললেন,
– তাই জন্য তো ওনারা চাইছে ডিভোর্স। আমি কি ঠিক করেছি জানো আমি একটা মিথ্যে ডিভোর্স পেপার সাজিয়ে সেটা তাদেরকে দিয়ে বলবো তোমরা এখন আলাদা। তারপর উজানের এমবিবিএস টা শেষ হতেই তোমরা না হয় আবার।
একটা তাচ্ছিল্যের হাসি টেনে হিয়া বললো,
– আমার কি মনে হয় জানেন আন্টি এ-ই সম্পর্ক টা এখানেই শেষ করে দেওয়াটাই সবার জন্য সবদিক দিয়ে উওম। উজান এমবিবিএস শেষ করে বড় ডক্টর হবে আমিও এ্যাডমিশন দিয়ে একটা কোথাও ভর্তি হলাম কিন্তু আমার ভাইয়া! তার জীবনে তো একটা দাগ বসিয়ে দিলেন আপনারা! তার কি হবে আন্টি? ( বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লো হিয়া,কাঁদতে কাঁদতে অভিযোগের সুরে হিয়া বললো) শেষে গিয়ে তো সবাই ভালো থাকবে আপনার ছেলেও ডাক্তার হবে কিন্তু আমরা। আমার ভাই। তার ভবিষ্যত! তাকে পুলিশ ধরিয়ে দিয়ে থানার রেখে এতো নির্যাতনের কি খুব দরকার ছিলো আন্টি! আপনাদের বিবেকে বাধে নি। দোষ টা কার ছিলো আমার ভাইয়ার না আমার? আপনার ছেলে আমাকে নিয়ে বিয়ে করেছে আমি তাকে বলিনি এতো জলদি বিয়ে করতে। তার জেদ তার রাগ। সে আমাকে বিয়ে করলো। আর এখন আপনি আসছেন তার হ’য়ে কথা বলতে….ওদিকে আমার ভাই হসপিটালের বেডে শুইয়ে বাঁচা মরার জন্য লড়ে যাচ্ছে। আমার ভাই আন্টি সে। আমার বাবা মা নেই সে নিজে আমাকে নিজের সন্তানের মতো মানুষ করে বড় করেছে আর আপনি বলছেন তাকে ভূলে গিয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ সাজাতে। এতো সহজ আন্টি!
– হিয়া মা তুমি…
– আন্টি আপনি বাসা যান। গিয়ে উজানকে বোঝান সে যেনো আমাকে ছেড়ে দেয়। এই সম্পর্ক থাকা মানে আরো জটিল হওয়া। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি আমি আর উজানের রাস্তাতে আসবো না কিন্তু আপনার ছেলেও যেনো আমার পেছনে আর না আসে।
– তুমি অভিমান করছো হিয়া। আমি জানি তোমার রাগ হচ্ছে কিন্তু এভাবে।
– না আন্টি কোনো অভিমান,রাগ,অভিযোগ কিচ্ছু হচ্ছে না আমার। জীবনটাকে অনেক সহজ ভাবতাম কিন্তু জীবনটা আমাদের মতো এতিমদের জন্য জীবনটা এতোটাও সহজ না আজ সেটা তকমা লাগিয়ে বুঝিয়ে দিলেন আপনারা। এরপর আর যাই হোক নিজের ভাইকে রেখে কোনো সংসার সাজানো আমার পক্ষে সম্ভব হবে না আন্টি কখনো না। যাই হোক আন্টি ভাইয়া আমার অপেক্ষায় আছে আমি আসছি।
– শিশিরের অবস্থা কি খুব খারাপ মা,কোনো দরকার হলে বলো টাকা পয়সা যদি কিছু।
– আমার ভাইকে সুস্থ করার মতো ক্ষমতা আমার আছে আন্টি। কারো সাহায্যের প্রয়োজন হবে না আশা করি আমার। এখানে থেকে আমার ক্ষত টা আর ভরিয়ে তুলবেন না আন্টি। আপনি এখান ফিরে যান।
!
!
রাত তখন আড়াইটেরর কাটা ছুঁই ছুঁই। শিশিরের কেবিনে শিশিরের বেডের পাশে শুইয়ে সেই রাত থেকে কেঁদে যাচ্ছে হিয়া। কেনো জ্ঞান ফিরছে না শিশিরের এখনো। কেনো শিশির এখনো তাকিয়ে দেখছে না তার এ-ই ছোট্ট পরীর মতো বোনটাকে। শিশিরে ব্যান্ডেজ করা চোখ মুখের দিকে তাকাতেই কেঁপে উঠছে হিয়া। আজ যদি সে বাড়ি না ফিরতো তাহলে কি শিশির ওভাবেই। আবারো কান্নার বাঁধ ভাঙ্গলো হিয়ার। শিশিরের হাতটা জাপ্টে ধরে হিয়া বললো,
– আমাকে ক্ষমা করে দে না ভাই। আজ আমার একটা ভূলের জন্য তোকে। ছোট থেকে বড় হয়েছি কোনোদিন একটা আঘাত আসতে দিসনি তুই আমার উপর আর আমি তোকে একটা জাহান্নামে রেখে গিয়ে ওদিকে নিজের সুখের এক সংসার সাজাতে..ঘেন্না হচ্ছে আজ নিজের উপর আমার। আমি কবে এতোটা স্বার্থপর হ’য়ে গেলাম। ভাই ও ভাই উঠ না একটু।দেখ না আমাকে। আমি আমি তোকে কথা দিচ্ছি আমি আর যাবো না উজান স্যারের কাছে বলবো না আর উজান স্যারের কথা। আমরা আগে যেমন বাড়িতে থাকতাম ওভাবেই থাকবো এখন থেকে বিশ্বাস কর। ভাইয়াআ উঠ না ভাইয়া। আমার খুব ভয় হচ্ছে ভাইয়া। এ-ই হসপিটালে একা থাকতে আমার ভয় হচ্ছে খুব। তুই তো কোনোদিন আমাকে রাতে একা বের হতে দিস নি কিন্তু আজ দেখ আমি একা একা এই মাঝরাতে বাড়ি থেকে আসলাম। যদি রাস্তায় কিছু হ’য়ে যেতো আমার কে নিরাপত্তা দিতো আমাকে। ভাইয়া ঔ শিশির উঠ না। শিশির উঠঠ..ভাই আমি দুপুর থেকে কিছু খাইনি আমার ক্ষুধা লাগছে ভাই তুই খাইয়ে দিবি না আমাকে। আমার যে পেট ডাকছে। শুনবি তুই। তাহলে চোখ খোল আগে….ওরা তোকে খুব মেরেছে তাই না ভাই খুব আঘাত করেছে না। এখন এখন তো আমি আমি এসে গেছি আমি এখন কিছুতেই তোর কোনো ক্ষতি করতে দেবো না তোর। তোর ঢাল হ’য়ে থাকবো আমি। এরপরো তুই উঠবি না ভাই। উঠ না শিশির!
হিয়ার কান্নার শব্দে পলাশ দৌড়ে ছুটে এসে হিয়াকে জড়িয়ে ধরলো। হিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো ” আর কান্দিস না বুবু,ভাই উঠবে তো দেখিস,তুই আর কান্দিস না ভাইকে ঘুমোতে দে,সকাল হইলেই ভাই উঠে যাবে বুবু, তুই আর কান্দিস না”
!
!
নিজের রুমে এদিক থেকে সেদিক পায়চারি করছে উজান। কেনো জানি বাসবির কথা গুলো কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না তার । মনে হচ্ছে কিছু একটা লুকিয়ে যাচ্ছে তার মা সাথে তার বাড়ির লোকজন কিন্তু কি! নিজের অশান্ত মনকে সামলাতে পারলো না উজান। আবার এই রাতে ডেকে নিয়ে আসলো তার মা’কে সে। আবারো শুনতে চাইলো হিয়ার সাথে গিয়ে উনি আসলে ঠিক কি কথা বলে আসলেন!
– কি আবার কথা বলবো উজান। তোদের কবে কি করবো সেই বিষয়ে কথা বলতেই তো আমি।
– মা আমার সাথে মিথ্যা না। তোমার এসব কথা বলারই থাকলে রাত বারোটার সময় তুমি নিশ্চয়ই হিয়ার কাছে যেতে না।
– রাত কি আর দিন। বলতে হতো তাই বলে আসলাম।
– তাই! রোদ কোথায়। আসছি থেকে ওকে দেখছি না কেনো? ওকে গিয়ে এক্ষুনি বলো উজান ডাকছে ওকে।
– রোদকে দিয়ে কি করবি এখন। ওহ ঘুমোচ্ছে। শুধু শুধু এই রাতে ওকে বিরক্ত করার কি আছে !
– রোদ বাড়িতে আছে তো মা?
– না থাকবে কেনো। না থেকে কোথায় যাবে আর?
– মা কি লুকাচ্ছ তোমরা? রোদ আসলে কোথায়?
কথাটা উচ্চস্বরে বলতেই চাচি রুমে এসে বললেন,
– রোদেলা ওর শ্বশুর বাড়িতে। কি দরকার তোমার এখন রোদকে শুনি?
– শ্বশুর বাড়িতে মানে!
– আমরা রোদের বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। একটা যোগ্য ওয়েল এ্যডুকেটেট ছেলের সাথে কোনো অনাথ বা ভিখিরির সাথে না।
– এসব চাচি কি বলছে মা? রোদকে তোমরা কি করে?___আমি আগেই বুঝেছিলাম তোমাদের এ-ই সব চালাকি। কিন্তু আপসোস হিয়াকে সেটা বোঝাতে পারলাম না। মেয়েটা এতো সরল যে সে তোমাদের সব কথা চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে নিলো। আর তোমরা। ছিঃ মা।
– উজান আমি ইচ্ছে করে তোকে মিথ্যে বলিনি। আমি বাধ্য হয়ে।
– হিয়া কি বলে জানো, মা রা নাকি মিথ্যা বলতে পারে না। কিন্তু তুমি। কি ভাবো এরকম করে আমাকে আর হিয়াকে আলাদা করতে পারবা তোমরা। আমার খারাপ রুপ টা বের করতে বাধ্য করলা তোমরা মা। এরপর শুধু দেখবা আমি উজান ঠিক কি করি।
উজান নিজের ওয়ালেট টা বিছানা থেকে তুলে নিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে আসতে ধরবে ওমনি উজানের বাবা এসে উজানের সামনে দাঁড়িয়ে যায়।
– একটা বস্তির মেয়ের জন্য নিজের বাবা মা’কে তুমি তুচ্ছ করছো উজান। একটা কথা মনে রাখবা আজ যদি তুমি বাড়ি থেকে বের হও আমি কিন্তু তোমার সব হাতখরচ ইভেন তোমার সব পড়াশোনার খরচ বন্ধ করে দেবো!
উজান নিজের বাবা-র দিকে আঙ্গুল তুলে নিয়ে বললো,
– খুব টাকার অহংকার না আপনার। আপনার টাকা আপনি নিজের পকেটেই রাখুন। দরকার পড়লে শিশিরের মতো দোকান দিয়ে বসবো কিন্তু আপনার টাকার দিকে চোখ তুলেও তাকাবো না।
– আমার দিকে আঙ্গুল তুলে কথা বলছো তুমি। শিশিরের তো অভ্যাস আছে ছোট থেকে সে ওভাবেই মানুষ। কিন্তু তুমি। পারবে নিজের বিলাসিতা কাটিয়ে ফুটপাতের বাচ্চাদের মতো লাইফ লীড করতে। জীবনটা এতো সহজ না যতোটা তুমি ভাবছো।
– হবে হয়তো….আর একটা কথা হিয়া কোনো বস্তির মেয়ে না।সে এই বাড়ির বড় ছেলের বউ। তাই তাকে সেই সম্মান টুকু দিয়েই কথা বলবেন। নাহলে আপনাদেরকেও সম্মান করতে ভূলে যাবে এই উজান শাহরিয়ার।
বাড়ির সবাইকে অগ্রাহ্য করে উজান বেড়িয়ে আসলো বাড়ি থেকে। বাইক নিয়ে যে হিয়ার কাছে আসবে রাগে ক্ষোভে সেই বাইকের চাবিটাও উজানের থেকে ছিনিয়ে নিলো তার বাবা। কথা বাড়ালো না উজান। বাধ্য হয়ে বেড়িয়ে আসলো শূন্য রাস্তায়। রাতের গভীরতা নেমে গিয়েছে। চারপাশে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। না আছে কোনো রিক্সা না খোলা কোনো দোকানপাট। হাঁটতে ভয় করলেও যত দূত পারা যায় পায়ে হেঁটে হিয়ার বাড়িতে এসে পৌঁছালো উজান। কিন্তু একি দরজায় তালা কেনো! কপালে ভাঁজ পড়লো উজানের। ভয়ে শরীর জুড়ে দরদর করে ঘাম ঝরতে শুরু করলো তার। না তো হিয়া ফোন তুলছে না শিশিরকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে। চাচ্চু তো বললো যে হিয়াকে রংপুরে পৌঁছে দিয়ে উনি গাইবান্ধার জন্য বেড়িয়েছেন তাহলে কি হিয়া ফেরেনি বাড়িতে। ভয়ে শরীরের সব লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেলো উজানের। হাত পা কাঁপতে শুরু করলো। কোথায় তার হিয়া!
সেই অন্ধকার রাতে ওভাবেই পায়ে হেঁটে দোকানের দিকে আসলো উজান কিন্তু দোকানো তো বন্ধ। চাচ্চুকে ফোন করলো কিন্তু ফোন করেও ঠিক কিছু জানতে পারলো না সে। কি করবে উজান এখন। তার মা যে বললো উনি হিয়ার সাথে কথা বলতে গিয়েছিলো,সত্যি বলেছিলো নাকি মিথ্যা। আর যদি বলেও থাকে তাহলে তখন কোথায় ছিলো হিয়া। একটা কি নিজের মা’কে ফোন দিবে উজান। আর উপায়ন্ত না পেয়ে বাসবিকে ফোন করলো উজান।আর জানতে পারলো শিশির অসুস্থ তাকে নিয়ে নাকি হিয়া এখন ক্লিনিকে এডমিট। ওখানেই ওনার সাথে কথা হয়েছিল হিয়ার।
নিজেকে আর সংযত রাখতে পারলো না উজান। তাহলে কি শিশির সত্যি খুব অসুস্থ। চাচ্চু তাহলে ঠিকই বলেছিলো তখন। কিন্তু কি এমন অসুস্থ যে হিয়াকে শেষমেশ শিশিরকে ক্লিনিকে এ্যাডমিট করাতে হলো। মাথা কাজ করা ছেড়ে দিলো উজানের। কি হচ্ছে সকাল থেকে এসব ভাবতেই রাগ উঠলো তার। কেনো হিয়া শুনলো না তার কথা। কেনো বুঝতে চাইলো না সবার এই চাটুকারিতা।
সেই এক ঘন্টা পায়ে হেঁটে সে পৌঁছালো ধাপ রোডে। ঘড়িতে তখন চারটা পার হচ্ছে। ফজরের আযানের মধুর ধ্বনি কানে ভাসছে। পুরো রাস্তা শুনশান। সোডিয়াম লাইটের আলোয় রাস্তাটা বেশ আলোকিতই মনে হচ্ছে। এতোদূর অবধি হেঁটে এসে উজানের অবস্থা পুরো বেহাল। পুরো শরীর দিয়ে ঘাম ঝরছে মনে হচ্ছে কোনো পুকুর থেকে ডুব দিয়ে আসলো সে। তেষ্টা তো পেয়েছে খুব। তেষ্টায় গলা মুখ বুক শুকিয়ে পুরো কাঠ হ’য়ে আছে। তার উপর সে নিজেও কোনো খাবার পেটে দেয়নি। ক্ষিদায় পেটে ব্যাথা দিচ্ছে তার। সাথে ব্যাথা করছে পায়ের গোড়ালিগুলি মনে হচ্ছে জুতাগুলো খুলে ফেলে দিক সে। কিন্তু না এখন এসব দেখলে হবে না। তাকে আগে যে করেই হোক হিয়ার কাছে পৌঁছাতে হবে তার। রাস্তায় একটা কল দেখে থেমে দাঁড়ালো উজান। যাগ একটুতো পানি পাওয়া যাবে। কল চিপে হাত মুঠো করে পানি খেলো তা থেকে ছেলেটা। সাথে চোখমুখেও পানি ছিটিয়ে দিলো অনেকটা। পেটের ক্ষুধা না মিটলেও তেষ্টাতো অনেকটা কমে আসলো৷ যাগ এখন একটু জোড় দিয়ে হাঁটা যাবে আবার।
!
রিসিপশনে এসে জোরে জোরে শ্বাস ফেলে উজান জিজ্ঞেস করলো শিশিরের কেবিনের কথা। এক সিস্টার এসে উজানকে দেখিয়ে দিলো শিশিরের কেবিন। কাঁপা পায়ে সেই কেবিনে প্রবেশ করতেই বুকটা ছিঁড়ে আসলো উজানের। শিশিরের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না,তারউপর হিয়া তার ভাইয়ের কোল আগলে কিরকম বাচ্চাদের মতো চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে আছে দেখো। মন মস্তিষ্ক সব কাজ করা ছেড়ে দিলো উজানের। সবকিছুর জন্য নিজেকে অপরাধী মনে হতে থাকলো তার। মনে হচ্ছে হিয়ার এই করুন পরিণতির জন্য আর কেউ না সে নিজে দায়ী। শুধু সে নিজে!
চলবে..