?#চোখের_তারায়_তুই?
#পর্ব_৩৭
#ইভা_রহমান
সকাল ৭টার বাসে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে শিশির। আবহাওয়া খুব একটা ভালো ছিলো না আজ,কাল রাত থেকেই কিরকম ঝুরোঝুরো বৃষ্টি হচ্ছে,কখনো মেঘে মেঘে ঘর্ষনের বিকট শব্দও কানে এসে জড়ালো ভাবে আওয়াজ করছে। ছাতা হাতে ওভাবেই শিশিরকে বাস স্ট্যান্ড অবধি পৌঁছে দিয়ে আসছে উজান। ডিউটি ছিলো তার সারাদিনের,কিন্তু দুপুর অবধি করেই ছুটি নিয়ে নিয়েছে সে।হিয়া বাড়িতে একা। তারউপর শিশিরের অনুপস্থিতিতে শিশির হিয়ার পুরো দায়িত্ব উজানের হাতে দিয়েছে এখন কি আর হিয়াকে একলা রাখলে চলে।
ভয়ে ভয়ে গ্রীলের কাছে এসে চাবি দিয়ে তালা খুলছে উজান। কালকে তো মহারানী ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিলো তার আজকে যে এই অধমকে দেখামাত্র কি তুলকালাম বাঁধিয়ে দেয় সে কে জানে! গ্রীলের দরজা তো খুলে ফেললো উজান কিন্তু ফ্ল্যাটের দরজা। চাবি তো আছে কিন্তু এই মেয়ে তো দেখছি ভেতর থেকেও একদম লক করে রেখে দিয়েছে। কেমনটা লাগে! এই গ্রীলে ঘেরা বারান্দার সাথে লাগনো হিয়ার জানালার গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে গেলো উজান। থাই টা বাহির থেকে টেনে দিয়ে দেখতো চাইলো সেটা আদৌও বাহির থেকে খোলা যায় কি না। যাগ থাইটা লক করা নেই। থাই সরিয়ে ভেতরে উঁকি দিতেই দেখলো তার হিয়া পিচ্চি কিরকম বিছানার উপর শুইয়ে গল্পের বই হাতে মনোযোগ দিয়ে গল্প পড়তে ব্যস্ত দেখো। খুকখুক শব্দ করে কেশে দিতেই চকিতে মারাত্মক রকমের ভয় পেয়ে উঠে বসলো হিয়া। কে ওখানে,কে কে! লাইট গুলো ঠাস ঠাস করে জ্বালিয়ে দিয়ে গায়ের ওড়নাটা ঠিক করে নিয়ে জানালার কাছে এসে বসতেই দেখলো তার দিকে ফ্যাল ফ্যাল তাকিয়ে কিরকম ভ্যাল ভ্যাল করে হাসছে তার উজান স্যার। কপালে ভাঁজ পড়লো হিয়ার। বুকে পাঁচ ছয় বার থু থু ছিটা দিয়ে জানালার আরো কোল ঘেঁষে থাই টা টেনে ধরলো হিয়া। রাগান্বিত সুর টেনে বললো,
– আপনি এখানে কি করছেন কি! বলেছি না এ বাড়িতে আপনি আসবেন না আর।
– শিশির আমাকে আপনার দায়িত্ব দিয়ে গেছে তাই তার ফেরা অবধি তো আমি এ বাড়িতে আসবোই হিয়াআআ পিচ্চি।
উজানকে কাঁচকলা দেখিয়ে হিয়া বললো,
– আপনাকে আমি কঁচু ঢুকতে দিলে তো। আর শুনুন মোটেই আমি এখন আর ছোট নেই হ্যা যে সারাক্ষণ পিচ্চি পিচ্চি বলে ডাক দিবেন আমাকে৷ আমি এখন বড় হইছি।
– হ্যা ঔ বয়স টাই বাড়ছে বুদ্ধি তো যেনো।
– বিড়বিড় করে কি বলছেন হ্যা। আমি কিন্তু সব বুঝতে পারছি বুঝলেন।
– বেশি না বুঝে ফ্ল্যাটের দরজা খুলো আমি ভেতরে ঢুকবো।
– মোটেই না। আপনি ফিরে যান। গিয়ে ঔ প্রিয়ন্তি ফিয়ন্তীকে সাহায্য করে আসুন। আমার এখানে কি। আমি তো ডাক্তার হতে পারিনি না।
রেগে গিয়ে গলাটা গম্ভীর করে উজান বললো,
– আবার এক কথা। আমি কিন্তু এবার রাগ হচ্ছি হিয়া।
– আপনি রাগ হলে আমার কি। যতো খুশি রাগ হোন আমার তো সেটা দেখতে বয়ে গেছে না।
বলেই হিয়া থাইটা টেনে লক করতে যাবে ওমনি উজান হাত দিয়ে থাই টা শক্ত করে আঁটকে ধরে বলে,
– দেখো বাহিরে বাতাস হচ্ছে। বৃষ্টিও হচ্ছে ঝিরিঝিরি,আমি কোথায় যাবো এখন এই ওয়েদারে,আশ্চর্য। একটু বুঝো তুমি।
– কেনো আপনার বাড়ি নেই। শুনুন এখান থেকে সোজা হেঁটে বা দিকে মোড় নিয়ে পাঁচ মিনিট হাঁটুন দেখবেন মোড়ের মাথার ডান দিকে একটা পাঁচ তলা ভবন দাঁড়িয়ে আছে নাম শাহরিয়ার কুঞ্জ। গিয়ে দরজা নক করুন দেখবেন দারোয়ান মামা ঠিক আপনাকে ভেতরে ঢুকতে দিবে। যান।
উজান রেগে গিয়ে কিছু বলতেই একটা বিরাট হাঁচি দিয়ে উঠে,আর হাঁচির সব ছিটেফোঁটা গিয়ে হিয়ার মুখে জড়ো হলে চোখ মুখ খিঁচে ওঠে হিয়ার। মুখ মুছতে মুছতে বলে” হাঁচি দেওয়ার সময় মুখে হাত দিতে হয় জানেন না সেটা আপনি” উজান আরেকটা হাঁচি দিয়ে নাক টানতে টানতে বললো” দেখো হিয়া আমি এমনিতেই আসতে গিয়ে অর্ধেক ভিজে আছি এখন আর বিরক্ত করো না তো তুমি। হিয়া মেজাজ দেখিয়ে গল্পের বই টা আবার হাতে নিয়ে বিছানায় শুতে শুতে বলে” আপনি অর্ধেক ভিজুন আর পুরো,আমার কি”
– আরে কি আশ্চর্য। আমি কিন্তু এবার দরজা ভেঙে ফেলবো হিয়া। খোলো বলছি। আর এ এ এটা কি তোমার হাতে,গল্পের বই কিসের জন্য হাতে। মেইন বই কোথায় তোমার,এরকম করে পড়ে কখনো চান্স হবে দ্বিতীয়বার তোমার।
রাগে বইটা ঠাস করে বন্ধ করে দিলো হিয়া। গজগজ করতে করতে তেড়ে এসে উজানকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললো,
– দেখুন আমার চান্স নিয়ে না আপনাকে বেশি ভাবতে হবে না। গিয়ে নিজের ডক্টরির সুতোতে চড়কা কাটুন বুঝলেন। এখন তো শুধু লক করে দিয়েছি এরপর গ্রীলের দরজায়ও এমন তালা ঝুলিয়ে রাখবো যে আপনি তো দূর ভাইয়ার কাছেও একস্ট্রা কোনো চাবি দেবো না আর।
উজান হাত বাড়িয়ে জানালার গ্রীল ভেদ করে হিয়ার গাল দুটো জোড়ে করে চিপে ধরলো। শরীরের যতপ্রকার রাগ আছে সব এসে পিষে দিলো যেনো হিয়ার গাল জোড়াকে। উজানের হাতে তিন চারটে বারি দিতে থাকলো হিয়া। কিন্তু উজান ছাড়লো না। রেগে উঠে হিয়ার গাল না এবার হিয়ার পুরো মুখে এলোপাথাড়ি চিপে দিতে দিতে বললো” সত্যি সত্যি যেদিন প্রিয়ন্তীর কাছে চলে যাবো না ঔদিন ম্যাডামের হুঁশ ফিরবে,বেয়াদব একটা” হিয়া উজানের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে কিছু বলতে যাবে ওমনি এক বিরাট বাজ পড়ার শব্দে কেঁপে উঠলো পৃথিবীর মাটি। কেঁপে উঠলো বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা উজান নিজেও। সাথে সাথে কারেন্ট নিভে গেলো। বাতাস বইতে শুরু করলো আরো একটু জোড়ালো গতিতে। কি একটা মনে হতে চটপট বিছানা ছেড়ে নেমে আসলো হিয়া। রান্নাঘরের কাবাড খুঁজে একটা বড় সাদা পলিথিন বের করে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে বের হতে নিতেই উজান হিয়ার দিকে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলো”কোথায় যাচ্ছো আবার এ-ই বৃষ্টিতে হিয়া? হিয়া উজানের হাতে চাবি ধরিয়ে বললো” আপনি দরজাটা লক করে দিয়ে দিন তো,ওদিকে আমার বাচ্চাটা ভিজে যাচ্ছে আমি তো ওকে আজ পলিথিন দিয়ে ঢেকে দেবার কথা ভূলেই গিয়েছিলাম,সব আপনার জন্য ” উজানের হাতে চাবি ধরিয়ে দিয়ে এক দৌড়ে পেছনে এসে সেই কামিনী ফুলের গাছটার নিচে বসে গেলো হিয়া। পায়ে যে জুতা পড়বে সেই হুঁশ টাও নেই যেনো আর তার মাথায়। খালি পায়ে বসো পড়লো সেই বৃষ্টির পানি মাখা কাঁদা মাটির নিচে,বৃষ্টির ছাট এসে পুরোপুরি হিয়াকে ভিজিয়ে না দিলেও অনেকটা কাক ভেজা হয়ে উঠলো হিয়া। পলিথিনের কভারটা সেই মাটির নিচে সুন্দর মতো বিছিয়ে ছোট ছোট ইট দিয়ে চাপা দিতে দিতে হিয়া বললো” এই তো আমার সোনা বাবু টা,ইশশ কি ভিজে গেছে দেখো,মাম্মাম টা পঁচা না,মাম্মাম টা তো আগে আসেনি না আজকে,এখন মাম্মাম এসে পরীটাকে ঢেকে দিয়েছে আর পরীটার কষ্ট হবে না আমার। আমার সোনা বুড়িটা”
ছাতা হাতে হিয়ার পেছনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো উজান। কান পেতে শুনলো হিয়ার বলা প্রত্যেকটা বাক্য। বুকটা ছিঁড়ে আসলো তার। মনে হচ্ছে উপরে আকাশের উপর মেঘে মেঘে ঘর্ষন হয়ে বজ্র ডাকছে না মনে তো হচ্ছে তার ভেতরের সবকিছু নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে এরকম টা করছে। আকাশ কাঁপিয়ে বৃষ্টি শুরু হলো। ঝিরিঝিরি থেকে মুহুর্তেই তার গতি বেড়ে উঠলো। ভিজিয়ে দিলো প্রকৃতির রুক্ষতাকে,প্রাণহীন পরিবেশটা যেনো মুহুর্তেই প্রানবন্ত হয়ে চারিদিকে সতেজতা ছড়াতে শুরু করলো। ছাতাটা হিয়ার দিকে মেলে ধরে নিচে বসতেই উজানের দিকে তাকিয়ে এক করুন চাহনি দিলো হিয়া। বোঝাতে চাইলো তার এই প্রখর অপারগতা ঠিক কতোটা যন্ত্রণার। চোখ ভিজে আসলো হিয়ার। সাথে চোখ টলটল করতে শুরু করলো উজানেরো। রিমা সেদিন শুধু উজানকে এতোটুকুই বলেছিলো যে তাদের একটা বাচ্চা এ পৃথিবীতে এসেছিলো আর সেটা দূর্ভাগ্যবশত মিচক্যারেজ হ’য়ে যায়, এরপর হিয়া তাদের বাচ্চার ঔ রক্তপিণ্ড টার ঠিক কি করেছিলো সেটা জানা নেই তার। এতোশতো চাপের মধ্যে থাকায় উজানের মনেও সেই চিন্তা কখনো আসেনি। তার মনে প্রশ্ন আসেনি হিয়া সেদিন তাদের বাচ্চাটাকে নিয়ে ঠিক কি করেছিলো। কিন্তু আজ উজান জানতে পারলো। সে উপলব্ধি করতে পারলো হিয়ার এই ঘনঘন পেছনে আসার কারণ। উজান উপলব্ধি করলো কেনো তার পিচ্চি হিয়া এ-ই কামিনী ফুলের গাছটার নিচে এভাবে ঘন্টারপর ঘন্টা সময় ব্যয় করতে পারে।
– জানো উজান, সেদিন যখন বাবুটা আমার পেট থেকে ঝরে পড়ে যায় সেদিন আমি খুব করে চেয়েছিলাম তুমি আসো। তুমি এসে দেখো কীভাবে আমাদের বাচ্চাটা আমাদের সাথে রাগ করে না ফেরার দেশে হারিয়ে যাচ্ছে। সে এভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়ে চলে যাচ্ছে আমাদের ছেড়ে, যেতে যেতে আমাকে বলছে তুমি একটা খারাপ মা,তুমি তো বুঝতেই পারোনি যে আমি আসছি এই পৃথিবীতে,আমি যে তোমার মাঝে তোমার পেটে বড় হচ্ছি তুমি বুঝোনি বাবাও বুঝে নি। শুধু তোমরা ঝগড়া করছো,রাগারাগি করছো,আমাকে দেখছিলা একবারো,দেখো নি,ঔজন্য তো আমি চলে যাচ্ছি আর আসবো না আমি, কখনো আসবো না। তুমি একটা বাজে মা। একটা একটা খুব খারাপ মা তুমি!
বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে উঠলো হিয়া। হিয়ার সাথে তাল মিলিয়ে উজানো তার দুচোখ দিয়ে অশ্রুর বন্যা ঝরাতে শুরু করলো। হাত থেকে ছাতা টা আলগা হয়ে একপাশে পড়ে গেলো তার। মাটিতে বসে গিয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে কান্নারত হিয়াকে বুকে টেনে নিয়ে উজান কাঁদতে কাঁদতে বললো” সরি হিয়া,আই এ্যাম সরি পাখি,সত্যি আমি একটা খারাপ বাবা,খুব খুব বাজে আমি” হিয়া উজানের বুক আগলে ধরে বললো” সেদিন যখন ওকে দাফন করি তখন আমি খুব করে চেয়েছিলাম উজান আসো,আসো উজান,আমি পারবো না একা হাতে ওকে দাফন দিতে তুমি আসো উজান,তুমি আসো নি,আমি খুব কান্না করছি,কান্না করে করে বাচ্চাটাকে দাফন দিছি আর কি বলছি জানো,বলছি বাচ্চাটাকে দাফন করার সাথে সাথে আমি আমাদের দু’জনের এ-ই ভালোবাসাটা কেও দাফন দিয়ে দিলাম,বিশ্বাস করো আমি তাই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম সেদিন! কিন্তু এতোকিছুর পরো না আমি তোমার জন্য আমার ভালোবাসা টাকে দাফন করতে পারিনি উজান,পারিনি তোমাকে ভূলতে। কেনো পারিনি বলো না? কেনো এতো ভালোবাসি আমি তোমাকে কেনো এতো কিছুর পরো আমি পারিনা তোমাকে ঘৃণা করতে!
কেঁদে ভাসালো হিয়া। হিয়ার সাথে আজ কান্নার বাধ ভাঙ্গলো উজানের। ভাগ্যিস বৃষ্টি টা ঠিক সময় এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে এ-ই প্রেমিকযুগলকে নয়তো তাদের গাল বেয়ে ঝরে পড়া অবিরত চোখের পানি গুলো যে লুকানো যেতো না কারো থেকে। কিছুতেই লুকানো যেতো না।
পলিথির আবরনটা সরিয়ে দিয়ে হিয়ার সাথে সেই দাফন হওয়া জায়গাটায় হাত বুলালো উজান। সাথে সাথে এক দমকা বাতাস এসে ছুঁইয়ে দিলো দু’জনের শরীরকে। হিয়ার হাতের সাথে হাত গুজিয়ে বাচ্চাটকে আলতো করে বুলিয়ে দিলো উজান। কান্না ভেঁজা কন্ঠে বললো” জানো হিয়া নবীজি তার হাদিসে কি বলেছেন? হিয়া উজানের দিকে মুখ তুলে বিষ্ময়ে সুর টেনে দিয়ে বললো “কি? উজান হিয়ার মুখ জোড়া তার দু’হাতের তালুতে ধরে নিয়ে বললো” ছোট বয়সে মৃত্যুবরনকারী সন্তানেরা জান্নাতের প্রজাপতির মতো। তাদের কেউ যখন কিয়ামতের ময়দানে পিতামাতার সঙ্গে মিলিত হবেন তখন সে তার পিতা-মাতার হাত কিংবা কাপড় ধরে থাকবেন। আর এই হাত কিংবা কাপড় ততোক্ষণ অবধি ছাড়বে না যতক্ষণ না আল্লাহ তালা তাকে তার বাবা মা সহ জান্নাতে প্রবেশ করাবেন(মুসলিমঃ৬৩৭০)। মৃদু হেঁসে হিয়া বললো তাই! উজান হিয়ার মুখের পানি গুলো মুছতে মুছতে বললো উনি আরো কি বলেছেন জানো” শিশু বয়সে যেই মুসলীম বাচ্চা গুলো মারা যায় তারা জান্নাতের খাদেম হবে। তুমি ভাবছো কতো মর্যাদা তাহলে আমাদের বাচ্চাটার এখন ওখানে! হিয়া চোখ মুখ মুছে মুখটা রঙীন করে বলে উঠলো আর কি কি জানো তুমি,আর কি বলেছেন নবীজি আমাদের বলো না শুনি। উজান হিয়ার কপালে স্নেহের পরশ দিয়ে বললো” বলেছে, শপথ ঔ সওার,যার হাতে আমার প্রাণ! সন্তান গর্ভে মারা যাবার পর মা যদি ধর্য্য ধরে,ঔ গর্ভস্থ সন্তান কিয়ামতের দিন তার মা’র নাড়ি জড়িয়ে তাকে টানতে টানতে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাবেন(ইবনে মাজাহ ১৬০৯,মুসনাদে আহমেদ ২২০৯০)
হিয়া উজানের হাত দুটো আঁকড়ে ধরে বললো” তাহলে কি এখন আমাকে ধর্য্য ধরতে হবে,ধর্য্য ধরলে আমাদের বাবুটা ওখানে ভালো থাকবে? উজান হিয়াকে বুকের মধ্যে লেপ্টে নিয়ে বললো” হ্যা হিয়া এখন তোমাকে খুব ধর্য্য ধরতে হবে। এ-ই যে তুমি একটুতে রাগারাগি করো,খাও না নিজের যত্ন নিতে চাও না,এগুলো এখন থেকে একদম বন্ধ ঠিক আছে, আমি যেভাবে যা বলবো তুমি তাই করবে কেমন! হিয়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। উজান একটা তপ্ত শ্বাস ছুঁড়ে হিয়াকে নিয়ে উঠতে যেতেই দুটো হলুদ ডোরাকাটা প্রজাপতি ভিজতে ভিজতে কামিনী ফুলের গাছটার নিচের ডালে এসে জোড়ো হলো। ইশশ এতো বৃষ্টি, এই গাছের ছায়াতলের নিচেই যেনো একটু আরাম। প্রজাপতি দুটোর দিকে তাকিয়ে পরমুহূর্তে নিজেদের দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে ফেললো হিয়া। চোখ জোড়া পিটপিট করে বললো” উজান দেখো তুমি প্রজাপতির কথা বললে আর প্রজাপতি এসে এখানে কেমন লাফাচ্ছে দেখো” উজান কি যেনো একটা ভেবে নিয়ে বললো” আমি তো একটা বাচ্চার কথা বলেছিলাম হিয়া,এখানে তো দুটো প্রজাপতি,তারমানে কি!__টুইন বেবি! চোখ বড় করে উজানের দিকে আবার তাকিয়ে উঠলো হিয়া। সত্যি কি টুইন বেবি ছিলো! ধুর না কিসব আজগুবি কথা ভাবছি আমরা এগুলো ধুর….হিয়াকে নিয়ে রুমে আসলো উজান। একটা লম্বা গোসল সেরে জামাকাপড় চেঞ্জ করলো,সাথে সাথে ভাত বেড়ে নিয়ে আসলো হিয়া। উজানের ভাত খাওয়া হয়ে যেতেই হিয়াও নতুন করে তার আধো ভেজা জামাটা পাল্টে নিলো। উজানকে খাওয়া শেষে হাত ধুতে দেখে কাঁথা মুড়িয়ে বিছানায় এসে শুইয়ে পড়লো হিয়া। গল্পের বই টা নিয়ে এক পাতা পড়তেই সেটাকে এসে একটানে কেঁড়ে নিলো উজান। বইটাকে ড্রয়ারের ভেতর লক করে দিয়ে রুমের সব দরজা জানালা বন্ধ করে পুরো বাড়িটাকে একবার দেখে নিয়ে রুমে আসলো সে। লাইট গুলো নিভিয়ে দিয়ে কাঁথার তোলে শুতে শুতে বললো” সামনের এই এক বছর একটা গল্পের বইে যেনো হাত দেওয়া না দেখি আমি,তাহলে সেদিনই শিশির কে বলে সেকেন্ড টাইম কোচিং বন্ধ করে দেবো,মনে থাকে যেনো কথাটা” রাগে উজানের মাথার চুল টেনে ধরলো হিয়া। মুখ ফুলিয়ে অন্য দিকে শুইয়ে নিতেই হেঁসে দিলো উজান। আলতো করে পেছন থেকে হিয়াকে জড়িয়ে হিয়ার কানের ভাঁজে চুলের ফাঁকে মুখ ডোবালো। লম্বা পা টা হিয়ার উপর মেলে দিতেই রেগে গিয়ে পা টাকে এক ঠেলে নামিয়ে দিলো হিয়া। ইশশ কি ভারী। এবার আরো ভালো করে পা টা হিয়ার শরীরের উপর তুলে দিয়ে গায়ের সর্বশক্তিদিয়ে হিয়াকে জড়িয়ে ধরলো উজান। খিঁচে ওঠে হিয়া বললে,
– আহ কি ওজন শরীর টার। পা টা নামান নামান বলছি,কি ওজন হইছে চড়ু গুলোর দেখো,কি বিশ্রী।
হিয়ার কথাকে কানেই তুললো না উজান। চোখ বন্ধ করে ভোস-ভোস শব্দ করে ঘুমের রাজ্য হারিয়ে ফেললো নিজেকে। হিয়াকে জড়িয়েই যে তার শান্তি,তার শত ক্লান্তির অবসান। এদিকে রেগে থাকলেও কিছু মুহুর্তে বাদে এপাশে ফিরে উজানের দিকে মুখ ঘুরে তাকালো হিয়া। নিজেই উজানের পা টাকে নিজের কোমড়ের উপর ঠিক মতো তুলে নিয়ে একটা চুমু আকলো উজানের উন্মুক্ত বুকে। আজ অনেকটাই নিজেকে হালকা লাগছে হিয়ার। সত্যি যদি আজ উজান হিয়াকে না বোঝাতো,যদি না বলতো তার ধর্য্যের পুরষ্কার স্বরুপ সৃষ্টিকর্তা কি উপহার রাখছে তার জন্য, তাহলে তো এখনো বাচ্চা হারাবার শোকে পাথর হয়ে জমে থাকতো হিয়া। কঠিন থেকে কঠিন হয়ে উঠতো দিনকে দিন।
– আমি ভাগ্যগুনে আপনার মতো একটা স্বামী পেয়েছি উজান স্যার। আপনার প্রতি কখনো স্ত্রীর কোনো হক আদায় করিনি আমি,কখনো স্ত্রী হিসাবে এক গ্লাস পানিও হয়তো এগিয়ে দেই নি আমি আপনাকে,অনেক অবহেলা করছি,অনেক অবজ্ঞা করেছি,তবুও আপনি ভূলে যাননি আমায়। ভূলে যাননি আমাকে দেওয়া সেই সব অঙ্গীকারনামার কথা। আমি হয়তো এরপরো নিজের মানসিক অবস্থার বিচ্যূতি ঘটিয়ে আপনাকে তাড়িয়ে দেবো,খারাপ আচরণ করবো আপনার সাথে। কিন্তু আমি জানি আমার শতো অপরাধেও আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিয়ে এভাবেই আগলে রাখবেন। কেনো এতো ভালোবাসেন আমায়। এতো তো ভালো না বাসলেও চলতো!❤️
!
!
?
যাগ হাজার হাজার শুকরিয়া যে শিশিরের জীবনের প্রথম এতবড় একটা ক্লাইন্ড মিটিং সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলো। নিজের চাচ্চুর সাথে চাচ্চুর বন্ধুরো মান রাখতে সক্ষম হলো শিশির। শিশিরের সাথে আসা আরো দু’জন কলিগ শিশিরকে অভিনন্দন জানাতে জানাতে বললো,
– স্যার তো দেখছি,সিনিয়রদের নাক ডুবিয়ে দিয়েই ছাড়বে। যেই ডিল গত ছয়মাস ধরে পোস্ট পন্ড হয়ে আছে সেটা কিনা শিশির স্যার আসতে আসতেই সলট আউট হয়ে গেলো।
– সবটাই আপনাদের সহযোগিতায় সম্ভব হয়েছে মির্জাসাহেব। এখন তো শুধু নতুন করে এই পাঁচ টা শহরে ব্রাঞ্চ খুলছি এরপর তো ইচ্ছে আছে দেশের বাহিরের কান্ট্রিতেও যদি সম্ভব হয় তখন না হয়।
অপর এক সিনিয়র হেঁসে দিয়ে বললো,
– আস্তে মেরি ভাই। জয়েন করার তো এক বছরো হচ্ছে না এতেই এতো কাজের বোঝা নিতে চাইছেন। বস তো এবার বোধহয়,আপনার জন্য কর্মীছাটাই শুরু করে দেবে দেখছি।
শার্টের হাতা ফ্লোড করতে করতে শিশির বললো,
– এতে কর্মীছাটাই না স্যার বরং যতো নতুন ব্রাঞ্চ হবে ততোই নতুনদের জন্য কর্মক্ষেএ তৈরি হবে ভেবে দেখবেন।
– পয়েন্ট আছে কথায়। তা দ্বিতীয় মিটিং টা তো আধা ঘণ্টা লেট আছে চলুন না হয় রেস্টুরেন্ট থেকে বেড়িয়ে একটু চা সিগারেট খেয়ে আসি।
মৃদু হেঁসে দিয়ে ল্যাপটপ টা ওন করতে করতে শিশির বললো,
– না স্যার। আমি বরং কাগজপত্রের ফাইল গুলো আরেকবার চেক করে নেই। আপনারা ঘুরে আসুন।
– যথাআজ্ঞা জুনিয়র সাহেব। মির্জাহোসেন লেটস গো এ ওয়াক এ্যারাউন্ড দা রেস্টুরেন্ট। কি বলেন?
– অবশ্যই স্যার। তা শিশির ভাই একা থাকতে কোনো সমস্যা হবে না তো আপনার। পারবেন তো একা এভাবে?
– yea,of course! এতে না পারার কি আছে মির্জাভাই,হাসাবেন না তো। যান গিয়ে কি জানি একটা খাবেন খেয়ে আসুন।
মির্জাসাহেব হেঁসে দিয়ে সিনিয়র কলিগটার সাথে বেড়িয়ে আসলো। শিশির আপাতত হওয়া বিল গুলো পেমেন্ট করে দিয়ে ল্যাপটপে মন দিতেই কয়েকজন ছেলেমেয়ে খিলখিল করে শব্দ করে হাসতে হাসতে রেস্টুরেন্টে ঢুকে ঠিক শিশিরের ডান দিকের টেবিল টায় বসে পড়লো। হালকা বিরক্ত হলে-ও ওদিকে পাওা দিলো না শিশির। হালকা এক ঝলক দিয়েই বোঝা যাচ্ছে এ-ই ছেলেমেয়ে গুলো সবকটাই বখে যাওয়া কোনো কোটিপতিদের সন্তান। তাদের ভাষাও যেমন ছিলো নোংরা তেমনি ড্রেসআপো ছিলো অশালীন।
– দোস্ত,আজকে আমি কিচ্ছু জানি না তোর ক্ল্যাবের উপরের রুম ফাঁকা আছে,আমার আজকে রাতে রোদেলা কে যে করে হোক চাই।
রোদেলা নামটা কানে পৌঁছাতে চমকে উঠে এদিকে চোখ ফেরালো শিশির। পর মুহুর্তে কি মনে হতে নিজ মনে হেসে দিয়ে বললো” ধুর কি ভাবছি আমি এসব,রোদ কেনো এখানে আসতে যাবে। রোদ তো চিটাগং এ ওর হাসবেন্ডের সাথে। আর এ-ই ছেলে মেয়ে গুলোকে দেখে মনো হয় তার রোদ এসব লাফাঙ্গা উচ্ছৃঙ্খল ছেলেমেয়েদের সাথে মেশার মানুষ। তার রোদ তো কলেজ কেনো ভার্সিটি থাকাকালীনো সে ছাড়া অন্য ছেলের সাথে সহজে কথা বলতো না আর তার রোদ কি বা এদের সাথে ” মাথা নাড়িয়ে আবার নিজের কাজে মন দিলো শিশির। এদিকে ছেলেমেয়ে গুলো হাসতে হাসতে বললো,
– তোর কি মাথায় গন্ডগোল আছে আবীর। কতো করে বলবো রোদের গায়ে হাত দেওয়া পুরোপুরি নিষিদ্ধ আছে তারপরো কেনো জীদ করিস বল তো। অন্য মেয়ে বল আমি ম্যানেজ করে দিচ্ছি। কিন্তু রোদ না।
– অন্য মেয়ে হলে তোকে রিকুয়েষ্ট করতে হতো না আমাকে রকি। আমার শুধু রোদেলাকে চাই একটা রাতের জন্য হলেও চাই। এতে তুই যা বলবি তাই করবো আমি। দরকার পড়লে তোর ক্লাবের এক্সট্রা করে প্রমোশন করে দেবো আমি কোনো খরচাপাতি ছাড়া। এবার তো হ্যা বল।
– তাসফি প্লিজ তোর এ-ই কাজিনকে একটু বোঝা। রোদেলার চাইতেও কোটিগুন সুন্দর মেয়ে আমি এনে দেবো ভাই এখন একটু ওফ যা।
– রোদেলার চাইতেও সুন্দর! হাসালি রকি। আমার তো মনে হয় তার মতো সুন্দর মেয়ে এই ঢাকা শহর কেনো পুরো দেশ জুড়ে খুজলেও একটা মিলবে না।
– হ্যা এখন সেজন্য ওফ যা,বেশি সুন্দর তোর সহ্য হবে না ব্রো।
ক্ষেপে উঠলো আবীর। রাগান্বিত সুর টেনে বললো,
-সমস্যা টা কি ভাই তোর। হাসবেন্ডের সাথে তো ডিভোর্সো হয়েছে তার তাহলে হ্যা বলতে কি সমস্যা হচ্ছে তোর।
– দেখ ভাই আরমান স্যারের কড়াকড়ি নিষেধাজ্ঞা আছে আর যাই করি রোদেলা’র শরীরে হাত যেনো না পড়ে কারো। নাহলে ঔদিনে আমার ক্লাবসহ আমাকেও আস্ত গিলে ফেলবেন উনি।
তাসফি মুখ থেকে আয়না সরিয়ে চোখ পাকিয়ে বললো,
– এক সেকেন্ড এক সেকেন্ড এ-ই আরমানের কেস টা কি। হু ইস দা ম্যান ব্রো? আন্নুমালিকের ছেলের কথা বলছিস না তো আরমান মালিক। ওহ মাই গড। রোদেলা তাকেও ফাঁসিয়ে দিয়েছে।
– ডাফার। কোনো আন্নুফান্নু না ইনি হলেন নামকরা ইন্ডাসট্রিয়াল আরমান রানা। বাহিরে তো চলে ওনার হিরার ব্যবসা কিন্তু ভেতরে খোঁজ নিয়ে দেখ যতোসব ইয়াবা,মদ,গাঞ্জা,আইস সব ওনার হাত দিয়েই দেশে আমদানি হয়।
– ওহ,,এক সেকেন্ড তারমানে তোর ক্ল্যাবে যে-সব মদ,গাঞ্জা ঢুকে সব ওনার বদৌলতে আসে?
– তোকে ওতো জানতে হবে না। তুই নেশা গিলতে পারিস নেশা গিল,এতো খবরদারী কিসের তোর।
কিছুসময় বাদে শিশিরের ফোনে মির্জাসাহেবের ফোন আসতেই রেস্টুরেন্টের সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায় শিশির। মির্জাসাহেবের থেকে সিগারেট নিয়ে একটা টান দিয়ে বলে ওঠে” হলো আপনাদের ঘোরাঘুরি, তাহলে একটু কাজ গুলো গুছিয়ে নেই আমরা” মির্জা সাহেব রেগে গিয়ে বললো” সিগারেট টানতে দিলাম সিগারেট টানেন, সারাক্ষণ কানের কাছে কাজ কাজ করলে ভালো লাগে বলেন তো সুলতান ভাই?” হেঁসে দিলো শিশির। পরমুহূর্তে গেটের দিকে চোখ পড়তেই দেখলো ঔ ছেলেমেয়ে গুলো কিরকম করে ঢলাঢলি করতে করতে বেড়িয়ে আসছে দেখো। চোখ নামিয়ে নিলো শিশির। হঠাৎই একটু দূরে একটা কালো গাড়ি এসে থামলো রেস্টুরেন্টের বাহিরে। আর গাড়ির দরজা খুলে যাকে বের হতে দেখলো শিশির তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না যেনো সে। রোদেলা!
স্ট্র্যাইট চুল গুলো একদম উঁচুতে একটা পোনিটেল বাঁধা। সেই পোনিটেলের লেজ এসে ঠেকেছে ঠিক কোমড়ের মাঝ বরাবর। কানে রাউন্ড শেপের বড় বড় ইয়াররিং ঝুলছে। এক হাতে একটা সাদা রঙের স্মার্ট ওয়াচ তো অন্য হাতে ঝুলছে একটা দামি ব্র্যাচলেট। জুতোর হিল টাও বেশ উঁচু। মেরুন রঙের জুতোর সাথে একটা কালো ডোরাকাটা প্যান্ট,একটা নাভির নীচ অবধি নামা শর্ট টপস,তার উপর একটা পাতলা সবুজ রঙের জ্যাকেট। বলাই বাহুল্য রোদ যে-রকম সুন্দর তার শরীরে এরকম ওয়েস্টার্ন পোশাক বড্ড মানিয়েছে যেনো….বন্ধুদের সাথে হাই হ্যালো বলতে বলতেই রোদের গাড়িতে উঠে পড়লো সবাই। এদিকে রোদের দিকে তাকিয়ে থেকে এখনো একটা ঘোরের মধ্যে কাটছিলো যেনো শিশিরের। এ কাকে দেখলো সে। রোদকে? তাও আবার এরকম পোশাকে! কপাল দিয়ে বিন্দু বিন্দু ঘামের চিহ্ন দেখা গেলো তার। গলার টাই টা ঢিলে করতে করতে রাস্তায় এসে দাঁড়াতেই তার সামন দিক দিয়ে গাড়িতে করে চলে গেলো রোদেলা। রোদেলা রোদেলা বলে গলা ছেড়ে মাঝরাস্তাতেই চিৎকার শুরু করলো শিশির। কিন্তু রোদ শুনলো না। একটা ট্যাক্সি ঠিক করতে করতে মির্জা সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললো” স্যার,আমি আপনার ইমেইলে মিটিং এর যাবতীয় সব কিছু ফরওয়ার্ড করে দিয়েছি,প্লিজ এই মিটিং টা একটু আপনি হ্যান্ডেল করে নিন” মির্জা সাহেব শিশিরকে অভয় দিতে দিতে বললো” সে না হয় সামলে নিচ্ছি কিন্তু আপনি হঠাৎ এভাবে কোথায় যাচ্ছেন?” শিশির কিছু বলতে পারলো না শুধু বললো এসে কথা বলছি। ব’লেই ট্যাক্সিচালকে উদ্দেশ্য করে বললো সামনে যে-ই গাড়িটা গেলো একটু আগে তার পেছনে যেতে হবে আমাদের ফাস্ট। ট্যাক্সিচালক তো আর বুঝলো না কোন গাড়ি,কি গাড়ি। শিশির বললো আপনি চলেন আমি বলছি”
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত তখন আটটার কাছাকাছি। অনেক খুঁজে সেই ক্ল্যাবের ঠিকানায় পৌঁছাতে সক্ষম হলো শিশির। আর ভেতরে ঢুকেই শরীর উতলাতে শুরু করলো তার। এ-তো গান বাজনা। এতো আলোকসজ্জা। তার উপর অন্ধকারে কারো মুখো তো ঠিকভাবে চেনা যাচ্ছে না সেভাবে। কোথায় খুঁজবে এখন সে তার রোদরানিকে। ঔ ছেলে গুলো যদি সত্যি সত্যি রোদেলার কোনো ক্ষতি করে বসে। এর বেশি ভাবতে পারলো না শিশির। সোজা ঢুকে পড়লো ক্ল্যাবের একদম ভেতরে। টানা বিশ মিনিট সবার চোখ মুখ দেখে খুঁজতে চেষ্টা করলো তার রোদকে। কিন্তু কিছুতেই রোদের সন্ধান মিললো না। এদিকে কিছু জনকে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে দেখে অস্থির হ’য়ে উঠলো শিশির। এক ওয়েটারকে কি কিছু বকশিস ধরিয়ে দিয়ে বললো সে-ও উপরে যেতে চায়। কিছু টাকার লোভে ওয়েটার রাজি হয়ে শিশিরকে উপরে যেতে দিলো ঠিকই। কিন্তু উপরে উঠেও দিশেহারা হ’য়ে পড়লো যেনো ছেলেটা। একদিকে পুলসাইড আরেক দিকে নিচের মতো নাচগানে মশগুলো কিছু ছেলে মেয়ে। তো অন্য দিকে পেছন সাইডে কত্তো গুলো ছোট্ট বড় রুম। কোথায় আর খুঁজবে শিশির তার রোদকে!
!
!
– আমাদের মাঝে কিন্তু ডিল হয়েছিল আরমান আমি তোমার সব অবৈধ কাজে তোমাকে সাহায্য করবো এর বিনিময়ে তুমি বা অন্য কেউ কখনো আমাকে একটা টাচ অবধি করবে না। তাহলে আজকে আবীর কিসের জন্য আমাকে জোড় করে.
– ওহ কামন রোদেলা একটা রাতেরই তো ব্যাপার। চিল না বেবি। এমন তো না যে শিশির কোনোদিন তোমার গায়ে টাচ করেনি।
– জাস্ট শাট আপ আরমান। শিশিরের সাথে নিজেদের কম্প্রায়ার করা বন্ধ করো। নেহাৎ শিশিরের জানের ভয় দেখিয়েছো বিধায় আমি তোমার সাথে ডিল করতে বাধ্য হয়েছি তাই বলে ভেবো না শর্তের বাহিরে গিয়ে এই রোদকে দিয়ে যা খুশি করাতে পারবে তুমি।
– ওকে রিলাক্স। আমি দেখছি,রকিকে বলে আবীরকে তাড়ানোর ব্যবস্থা করছি তুমি থাকো।
ফোন রেখে পেছন ফিরতে যাবে ওমনি আবীর এসে রোদের ফোন কেঁড়ে নিয়ে বিছানার ছুঁড়ে দিলো। রোদের এক বাহু চিপে ধরে নেশাক্ত সুর টেনে বললো,
– এতো সাধুত্বের কি আছে রোদ বেবি। এমন তো না যে তুমি মদ গাঞ্জা টানো না! কোন ভালো মেয়ে এসব খায় বলো তো শুনি। শুনেছি একদিন টানতে না পারলে খুব নাকি শরীরে ব্যাথা হয় তোমার!
রেগে উঠে রোদ বললো,
– আমাকে এ্যাডিক্টেট আরমান সহ তোমরা বানিয়েছো। আমাকে নেশার প্রতি আসক্ত হতে বাধ্য করেছো তোমরা। দিনের পর দিন আমাকে ইনজেক্ট করে আমার নেশা তুলেছো এখন কিসের জন্য তোলো এসব কথা। লজ্জা করে না।
– সে যেভাবেই হোক। তুমি তো এখন পুরোপুরি ড্রাগ এ্যাডিক্টেট বেবি। তাই আমাকেও না হয় একটু এ্যাডিক্টেট করে তুলো তোমার উপর।
– আমার হাত ছাড়ো আবীর। আমি একটা চিৎকার করলে কি হবে তুমি জানো। ছাড়ো বলছি ছাড়ো আমাকে।
– ছাড়বো তো তখনি যখন তোকে নিজের করে পাবো। ভালোই ভালো নিজের করতে চেয়েছিলাম শুনিস নি তো এবার দেখ কি করি।
বলেই রোদকে জড়িয়ে নিতেই চিৎকার শুরু করলো রোদেলা। রোদের মুখ চিপে ধরলো আবীর। একটা সিরিঞ্জ তুলে রোদের শরীরে পুশ করতে যাবে ওমনি আবীরের সেই সিরিঞ্জ ধরে রাখা হাতটা চেপে ধরে মচকে ফেললো শিশির। মাটি থেকে মুখ তুলে এপাশ ফিরে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই সামনের মানুষ টার দিকে তাকাতেই চমকে উঠলো রোদেলা। শিশির! এখানে!
আবীরকে মাটিতে ফেলে টানতে টানতে সোজা পুল সাইডে নিয়ে এসে দাঁড় হলো শিশির। গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে মেরে শেষ করলো এই নরপশুটাকে। মুহুর্তে লোক জড়ো হলো। গান বন্ধ হলো। থমথমে পরিবেশে আবীরের আর্তনাদ আরো জোড়ালো হ’য়ে শোনা যেতে থাকলো৷ শিশির আবীরকে মারছে যেভাবে পারছে মারছে। ইচ্ছে মতো মারছে। মারতে মারতে হাঁপিয়ে উঠছে কিন্তু সে থামছে না। খবর পেয়ে ছুটে আসলো রকি। আবীরকে এভাবে কেউ একজন মারছে দেখেই এগিয়ে আসতেই নিজের এক আঙ্গুল উঁচু করে রকিকে থামিয়ে দিলো রোদ। জানে আবীরকে বাঁচাতে গেলে রকিকেও না নিজের প্রাণ নিয়ে টানাটানি করতে হয় পড়ে। দৃষ্টি তার অপলক শিশিরের দিকে নিবদ্ধ, এ-ই ছেলেটা কি করে বুঝলো রোদ এতো বড় একটা বিপদে আছে আজ! এটাকেই কি বলে আত্নার সম্পর্ক!
আবীরকে পুরো অচেতন করে দিয়েই তারপর গিয়ে ক্ষান্ত হলো শিশির। উঠে দাঁড়িয়ে আরেকটা লাথি মারলো আবীরের পেটে। হাতের রক্ত গুলো খয়েরী রঙের শার্টটাতে মুছতে মুছতে রোদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়লো সে। চোখে চোখ নিবদ্ধ রেখে অনেক কথাই বলতে চাইলো ক্ষতের সাগরে ভেসে বেড়ানো হৃদয় দুটো কিন্তু কি যেনো একটা বাঁধ সাধলো। কারো মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হতে চাইলো না। সপাটে রোদের গালে এক চড় বসিয়ে দিলো শিশির। থমথমে পরিবেশ টা যেনো আরো থমথমে হয়ে গেলো মুহুর্তে। রোদেলার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো কয়েকফোটা নোনাজল। কান্নারত রোদকে বুকে আগলে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলো শিশির। চুমু আকলো রোদের পুরো মুখে! সাথে রাগ করতে করতে বললো,
– কু্ত্তার বাচ্চা কি অবস্থা বানাইছিস নিজের এটা তুই। এগুলা কি ধরনের জামা পড়ছিস। কি খাচ্ছিস এগুলা। মদ খাইস তুই রোদ। বল কি খাস এগুলা?
শিশিরের দিকে অপলক তাকিয়ে মুচকি হাসছে রোদ। আজো সেই তেজ,আজো সেই অধিকার, আজো সেই একইরকম শাসন, আর ভালোবাসাটা?
– এগুলা করতে তোর বাপ তোক বিয়া দিছে। এরকম করে সুখে আছিস তুই। এতো সাহস তোর নিজেকে নষ্ট করিস তুই!
রোদেলা শুধু মুগ্ধ হয়ে শিশিরের কথা শুনছে। ইশশ চোখ গুলো দেখো ছেলেটার,আজো আমার জন্য আকাশ সমান ভালোবাসা ভর্তি। মনে হয়ে ডুবে যা-ই এ-ই চোখে! রোদকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে আরো রাগ উঠলো শিশিরের। রোদের গাল শক্ত করে চিপে ধরে বললো,
– কথা বলিস না কেন। কথা বল। তোর হাসবেন্ড কোথায়,কোথায় আরমান রানা। বল কোথায়? বলবি কি রোদ না তোকেও খু*ন করে বসবো আমি। রোদ চুপপপ করে থাকবি না। উওর দে।
উওরের বিনিময়ে অকপটে শিশিরকে জড়িয়ে ধরলো রোদেলা। এ-ই তো সেই চিরচেনা লোমে ঢাকা প্রশ্বস্থ বুক,সেই চিরচেনা হৃদ স্পন্দনের ধকধক শব্দ,ঘামে ভেজা শরীরের একটা উষ্ণ গন্ধ!❤️
চলবে….