বকুলতলা-০৭,০৮,০৯

0
304

বকুলতলা-০৭,০৮,০৯
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
৭.
প্রণয় চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে তরীকে। তরীর অস্বস্তি হচ্ছে। কিন্তু তা আমলে নেওয়ার সময় নেই। যত দ্রুত সম্ভব টেবিলে খাবার গুছাতে হবে। প্রণয় ইদানিং বেশ দেড়ি করে ফেরে। সবাই ততক্ষণে খাবার-দাবার শেষ করে ঘুমের দেশে পারি দিয়েছে। অগত্যা সালেহা আর তরীকেই প্রণয়ের খাবারের ব্যাপারটা সামলাতে হয়।
প্রণয় ভেঁজা চুলগুলো একহাতে ঝেঁড়ে হঠাৎ বললো, “বরফ পাওয়া যাবে একটু?”

সেসময় সালেহা গ্লাসে পানি ভরছিল। প্রণয়ের কথা শুনে দ্রুত রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। টেবিলে লবণ নেই। কৌটা-টাও উধাও। সালেহা কি সাথে করে নিয়ে গেছে? তরী আড়চোখে একবার প্রণয়ের দিকে তাকালো। মাত্র গোসল করে এসেছে সে। পরনে পাতলা সুতীর ফতুয়া। গাঢ় সবুজ রঙের। মাথার চুলগুলো ভালো করে মুছেছে। বৈদ্যুতিক পাখার কৃত্রিম বাতাসে দুলছে সেগুলো। তরী নজর ফেরালো। লবণ আনতে এক কদম এগোতে না এগোতেই প্রণয়ের দৃপ্ত প্রশ্ন, “অর্ণবকে মনে আছে তরী?”

মনে হলো, ধুকধুক হৃদযন্ত্রের চলা থেমে গেছে। যেন হঠাৎ করেই বিদ্যুতের ঝলকানি ধ্বংস করে দিয়েছে সব। চোখের পাতা একত্রে মিলছে না। ক্ষীণ কাঁপছে৷ ঠোঁটযুগল নড়েচড়ে কি যেন বলতে চাইছে। কিন্তু নড়া ছাড়া যে আর কিছুই করার সামর্থ্য নেই। প্রণয় সবই খেয়াল করলো। পরখ করে নিলো ভীষণ সূক্ষ্ণতার সঙ্গে। আবার শুধালো,
—“মনে আছে, অর্ণবকে?”
শক্ত হয়ে জমে থাকা তরী এবার কথা বললো। কঠিন, গম্ভীর, থমথমে গলায়,
—“কি চাচ্ছেন আপনি?”
—“আমি কি চাইবো?”
—“জ্বালাচ্ছেন কেন তাহলে?”
—“আপনাকে তিন বছর আগের ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছিলাম। আর কিছু না।”
তিন বছর আগের ঘটনা! তিন বছর আগের তরী! ওই অর্ণব নামের লোকটা! সবটা যেন কয়েক সেকেন্ডের জন্য মাথায় রেকর্ডারের মতো রিপিট হলো। তরীর নিশ্বাস ভারি, ঘনঘন। চোখে কি পানি জমেছে? জমেছে হয়তো।
তরীর হালকা ভেঁজা স্বরের তেজি ভাব ভীষণ মিষ্টি শোনালো প্রণয়ের কাছে, “আমি জানি আমার অতীত। আপনাকে বলতে হবে না। দয়া করে, এত দয়া করবেন না আমার ওপর। আমার স্মৃতিশক্তি যথেষ্ট ভালো আছে।”
ডালে ভাত মাখালো প্রণয়। একলোকমা খেল। কি তৃপ্তি এই সাধারণ বাঙালি খাবারে! রোজ রোজ মাংস, বিরিয়ানি খেতে প্রণয়ের সত্যিই আর ভালো লাগে না। খেতে খেতে প্রণয় বললো,
—“আমার তো মনে হচ্ছে না আপনার আগের কথা মনে আছে। মনে থাকলে তো আর অন্য ছেলেদের সাথে ঘুরতেন না।”

তরীর সর্বাঙ্গ দারুণ চমকে হতবাক হলো। বিমূঢ়তা চোখে-মুখে স্পষ্ট। জিজ্ঞেস করলো, “আপনি আমার বিষয়ে এত কিছু জানেন কিভাবে?”
প্রণয়ের নির্লিপ্ত উত্তর, “আপনাকে একটা ছেলের সঙ্গে দেখেছিলাম কয়েকদিন আগে।”
—“আর তিন বছর আগের ঘটনা? ওগুলো কিভাবে জেনেছেন? মামা-মামী বলেছে?”

প্রণয়ের উত্তর আর শোনা হলো না৷ সালেহা চলে এসেছে। বাম হাতের বাটিতে অনেকগুলো বরফের কিউব আর ডান হাতে লবণের কৌটা। তরী আস্তে আস্তে সরে এলো সেখান থেকে। রান্নাঘরে যায়নি। একেবারে নিজের ঘরের দরজা আটকে বিছানায় শুয়ে পরেছে।

সময় গড়িয়ে গেছে। রাতের কালো আচ্ছন্নতা শেষে সূর্যের আলোকিত স্নিগ্ধতা মন ভুলিয়ে দিতে চলে এসেছে। তরী কাল সারারাত ঘুমাতে পারেনি। ফলসরূপ সকাল থেকে ভীষণ মাথাব্যথা। কাজ করতে গিয়েও যে কি আলসেমী লাগছে! ভার্সিটির জন্য তৈরি হতে গিয়ে খুব সময় লাগালো তরী। সাহেলার জোরাজোরিতে অল্প একটু পরোটা আর চা খেল।
মাহাদ তরীর জন্যই অপেক্ষা করছিল। তবে এবার ম্যানরোডের কাছে নয়, তরীর মামার বাড়ির সামছে দাঁড়িয়েছে। গেটের অনেকখানি দূরত্বে। দু’আঙুলের ভাঁজে সিগারেট রেখে একেকটা সুখটান দিচ্ছে। তরী তখন বেড়িয়েছে মাত্র। মাহাদকে প্রথমে খেয়াল করেনি। কিন্তু পরপরই যখন লোকটা ওকে ডাকলো, তরী থমকালো। মাহাদ সিগারেট ফেলে দিয়েছে। একেকটা দৃঢ় কদমে এগিয়ে আসছে ওরই পানে। কাছাকাছি হতেই পূর্ণ দৃষ্টে চাইলো। শান্ত, শীতল, ঠান্ডা দৃষ্টি।

—“তোমাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ঠিকঠাক খাওনি?” সন্তপর্ণে লুকিয়ে থাকা তীব্র যত্ন প্রশ্নটায়।
তরী মৃদু গলায় উত্তর দিলো,
—“খেয়েছি।”
তারপর একটু থেমে আবার বললো, “আপনি হঠাৎ এ এলাকায় এসেছেন কেন? বাড়ির সামনে এভাবে আর দাঁড়াবেন না।”
তরীর কথায় কি কখনো গ্রাহ্য করেছে মাহাদ? মনে পরছে না। সে বরাবরই নির্বিকার। দৃঢ়, একরোখা, জেদী। কারো কথায় যার কিছুই যায় আসে না।
আশপাশে বিরক্তিকর চাহনি নিক্ষেপ করে মাহাদ গাঢ় গলায় শুধালো,
—“বড়োলোকি রাস্তায় হাঁটতে এসেছিলাম। হেঁটে মজা পাইনি। হাঁটতে হাঁটতে যদি একটু ইট-পাথরে উসঠাই না খাই, তাহলে কি আর ভালো লাগে?”

তরী সরল চোখে তাকালো। তপ্ত নিশ্বাস ফেললো আস্তে আস্তে। উগ্র মাহাদকে হঠাৎই গভীর ভাবে অনুভব করলো। সেই অনুভব গভীরে গিয়েও যেন মন ছুঁলো না। মাঝপথে আটকালো, ক্ষতবিক্ষত হলো, ভাঙ্গলো, এরপর ফিরে এলো। ভেতরকার অতি গোপন কষ্ট যেন একটু একটু করে বাড়ছে। ডান চোখ থেকে একটুখানি পানি গড়িয়ে পরছে। একদম সামান্য। সেই সামান্য পানি আলতো হাতে মুছে দিলো মাহাদ। প্রথমবার! প্রথমবার তরীকে আদরমাখা হাতে স্পর্শ করলো। কপালের এলোমেলো চুল পেছনে ঠেলে ঠিকঠাক ঘোমটা আরও ঠিকঠাক করে দিলো। ঢিমে যাওয়া গলার স্বর উৎকণ্ঠা হয়ে উঠলো, “তরী? কি হয়েছে? বেশি খারাপ লাগছে? কিছু কিনে দেই? খাবে? এই মেয়ে! কথা বলছো না কেন?”
তরী সিক্ত নেত্রজোড়া নুইয়ে নিলো। থেকে থেকে বললো, “আমার– আমার কষ্ট লাগে।”
—“কেন লাগে এত কষ্ট? কেউ কিছু বলেছে? আমি কিছু করেছি?”

তরী ছোট্ট শিশুর মতো মাথা এদিক-ওদিক নাড়ালো। কেউ কিছু বলেনি। মাহাদও কিছু করেনি। মাহাদ এবার কোমলস্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “তাহলে?”
—“এখানে থাকতে ভালো লাগেনা।”
—“তবে চলো বিয়ে করে ফেলি। অন্য জায়গায় গিয়ে থাকবো। অনেক দূরে। সবার থেকে দূরে।”

তরী কান্না ভুলে বড় বড় চোখে তাকালো। ওর তাকানো দেখে মাহাদ হেসে ফেললো। বিস্তর অথচ নিঃশব্দে। বললো, “মজা করছিলাম। কোথায় থাকবে না? তোমার মামা বাড়িতে? হোস্টেলের ব্যবস্থা করবো?”
—“হোস্টেলে সীট খালি নেই তো। আমি খুঁজেছিলাম।”

গালের লবণ পানিগুলো আবারও মুছে দিলো মাহাদ, “এভাবে কাঁদবে না তরী। চোখ ফুলে তোমাকে ভয়ংকর দেখায়। আমি ভয় না পেলেও রাস্তার মানুষ কিন্তু তোমার নামে মামলা ঠুকে দিবে।”

_______________

চলবে
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

বকুলতলা

৮.
মাহাদের সাথে রিকশা চালকের একপ্রকার ঝগড়াই লেগে যাচ্ছিল। সেটা বেশি দাম চাওয়ায় নাকি অন্য কিছু, তরী বুঝতে পারছে না। সামলাতেও পারছে না মাহাদকে। লোকটা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে গেছে। বারবার তেড়ে যাচ্ছে রিকশা চালকের দিকে। চোখ-মুখ কাঠিন্যে ভরপুর। দম ফেলছে না প্রায়। নিশ্বাস আটকে মুখশ্রী লাল করে ফেলেছে।
দিক বেদিক শূণ্য হয়ে তরী মাহাদের বাহু খামছে ধরলো, “মাহাদ! চলুন এখান থেকে! রাস্তার সবাই দেখছে। কি শুরু করেছেন?”

মাহাদ জবাব দিলো না। পরোয়া করলো না একদমই। বাধ্য হয়ে তরীকেই জোড় করে টেনে আনতে হয়েছে। রিকশা চালকটার ভাষা বড্ড বিশ্রী! আজেবাজে কথা বলছিল শুধু। ওগুলো শোনাও পাপ। মাহাদ যেতে যেতে পেছন ফিরে আরেকবার দেখে নিলো রিকশা চালকটাকে। ভীষণ রাগী গলায় বললো, “ওই ব্যাটার চোখদু’টোয় পেন্সিল ঢুকিয়ে দিবো আমি! শুধুমাত্র তোমার জন্য লোকটাকে কিছু করতে পারিনি। আরও কয়েকটা গালি দেওয়ার দরকার ছিল।”
তরী হতাশ নয়নে তাকালো। মাহাদ মুখ গম্ভীর করে রেখেছে। নিশ্বাসের আনাগোনায় ক্ষিপ্ততার স্বতঃস্ফূর্ত আভাস। সরল কণ্ঠে জানতে চাইলো, “মাথা গরম কেন? কি করেছে লোকটা?”
মাহাদের সব রাগ, তেঁতো মেজাজ যেন তরীর ওপর পরলো এবার। উচ্চস্বরে ধমকে উঠলো, “তুমি না মেয়ে? বেয়াদবটা যে প্রথম থেকে তোমার দিকে বাজে নজরে তাকাচ্ছিল, খেয়াল করোনি? এভাবে চলাফেরা করো রাস্তায়? বাহ্!”
—“এটুকুই কারণ?”

কুঁচকে থাকা কপালের ভাঁজগুলো একটু একটু করে বেড়ে গেল। চোখ তুলে পাশের মেয়েটাকে দেখলো সে। বেগুনি রঙের জামা পরনে। পাতলা ওড়নাটাও কি সুন্দর করে শরীর ঢেকে রেখেছে। মাহাদ প্রথমে তরীর স্থির মুখটির পানে বেশক্ষণ তাকিয়ে রইলো। ভেতরে ভেতরে তেক্ত হয়ে উঠলো, এই শান্ত, স্নিগ্ধ মেয়েটার ওপর কিভাবে এতটা বাজে নজর দিতে পেরেছে আধবুড়ো লোকটা? যেন চোখ দিয়েই গিলে খাচ্ছিল বুকের কাপড়ের আবৃত অংশ।
মাহাদের মেজাজ আবারও বিগড়ালো। তীব্র হলো অসহ্য অনুভূতি। অশান্ত হলো সবকিছু।

—“তোমার কাছে এটুকু কারণ মনে হয় এটা?”
—“আগে মনে হতো না। এখন হয়। আপনি তো মাত্র আজকেই দেখলেন। আমরা তো প্রতিদিন সহ্য করি। আর বললেন না? আমি মেয়ে হয়ে কিভাবে খেয়াল করিনা এসব? আমি খেয়াল করি মাহাদ। সব বুঝতে পারি। বাম দিকে তাকান, কালো প্যান্ট-শার্ট পরা একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। সে কিন্তু আমার দিকে ওই নজরেই তাকাচ্ছে।”

মাহাদ তৎক্ষণাৎ বাম দিকে তাকালো। দুই লাইনের সাধারণ রাস্তা। মাঝখানে অল্পসল্প গাছগাছালি লাগানো। সেই গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে লোকটাকে স্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে। এতক্ষণ তার নজর তরীর দিকেই ছিলো। মাহাদকে তাকাতে দেখে এমন ভাব করলো, যেন সে নিস্পাপ, ভাঁজা মাছটাও উলটে খেতে পারে না।
মাহাদ এমনিতেই মাথা গরম মানুষ। তরী কথাগুলো বলতে চায়নি। পাছে যদি লোকটাকে কিছু করে ফেলে সে? শুধুমাত্র বাস্তবতা বুঝাতে চেয়েছিল। এখন ভয় লাগছে। মাহাদের দৃষ্টি স্বাভাবিক না। লোকটাকে মনে মনে কতবার যে মেরে ফেলেছে, তার ইয়ত্তা নেই! কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে মাহাদ কিছুই করলো না। বরং নির্বিকার ভঙ্গিতে তরীর আঙুলগুলো হাতের ভাঁজে নিয়ে নিলো সে। কোমল ভাবে আগলে ধরলো। ভাবখানা এমন, তরীকে সব খারাপ দৃষ্টি থেকে আড়াল করে ফেলছে সে। কি ভীষণ নম্র-ভদ্র! তরী অল্প হাসলো। আলতো স্বরে বললো, “এখন তো কেউ দেখছে না। হাত ছাড়ুন।”
মাহাদের একরোখা উত্তর, “না দেখুক।”
তারপর আবার বললো, “তুমি একা একা আর কোথাও বের হবে না। আমাকে কল করবে। আমি আসবো। রিকশা ঠিক করে দিবো।”
তরী বিস্ময় নিয়ে বললো,
—“শুধু রিকশা ঠিক করে দিতে আসবেন? সেটা তো আমিও পারি।”
—“এখন থেকে কিভাবে রিকশা ঠিক করতে হয় ভুলে যাও। এ বিষয়ে তুমি মূর্খ।”
—“আমি মূর্খ?”
—“আগে ছিলে না। এখন থেকে মূর্খ।”
অধরের ক্ষীণ হাসিটা মিইয়ে গেল। উদাস নেত্রে মাহাদকে পরখ করলো সে। দেখলো। এরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “আমার জন্য এতটা করার প্রয়োজন নেই মাহাদ। অভ্যাস হারালে কষ্ট পাবেন।”
মাহাদ এবার একটুখানি চুপ থাকলো। তারপর মুচকি হেসে বললো, “আমি আমার অভ্যাস হারাতে দিবোই না। তাছাড়া তোমার দিকে কেউ খারাপ চোখে তাকালে আমার ভেতরটা জ্বলে যায়।”

তরী চুপচাপ হাঁটতে লাগলো মাহাদের সঙ্গে। আর কিছু বললো না। সে জানে, মাহাদের তাকে রিকশা ঠিক করে দেওয়াটাই মূখ্য উদ্দেশ্য না। বাইকে করে তরীর পিছু পিছি এসে দেখা, রিকশা চালকটা আসলেই তরীকে নিরাপদ ভাবে পৌঁছে দিয়েছে কিনা! তরীর উদাসীনতা বেড়ে যায়। লোকটা কেন আরও আগে এলো না তার জীবনে? তাহলে হয়তো তাকে ভালোবাসার বিশাল বাঁধাটাও থাকতো না।

ফোনের স্ক্রীনে একটা গ্রামীণ নম্বর তুলে রাখা। তরীর বাবার নম্বর। প্রায় দু’সপ্তাহ আগে রাশেদ আকবরের সঙ্গে কথা হয়েছিল তার। এরপর না ওপাশ থেকে কল এসেছে, না এপাশ থেকে কল দেওয়া হয়েছে। তরী একটু দুরুদুরু মনেই কল লাগালো নম্বরটায়। রিং হলো। কল রিসিভ হলো। নিরবতা চললো কিছুক্ষণ। রাশেদ আকবরের কাঁপা কণ্ঠ শোনা গেল,
—“মা? কেমন আছিস?”

উপচে আসা কান্নাটা গিলে ফেললো তরী। মলিন গলায় জবাব দিলো, “আলহামদুলিল্লাহ বাবা। তুমি কেমন আছো?”
—“আমি আছি কোনোরকম। ঢাকায় কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো? তোর মামী কি তোকে এখনো অপমান করে?”
—“ঢাকা শহর অনেক সুন্দর বাবা। সবাই অনেক ভালো। মামীও আর বকেন না।”
তরী কি মিথ্যেটা ভালোভাবে বলতে পারলো? পারলো না বোধহয়। রাশেদ আকবরের কণ্ঠেই বোঝা গেল সেটা। তিনি ঠুকরে উঠলেন, “ওখানে কি বেশি অসুবিধা হচ্ছে মা? টাকা হাতে এখনো পাই নাই। তুই অন্য বাসা খুঁজ। যা লাগে আমি পরে দিয়ে দিবো।”
—“বার্তি টাকা দিতে হবে না বাবা। আমি অনেককে বলে রেখেছি। কয়েকদিনের মাঝে কোনো একটা চাকরি পেয়ে যাবো। তখন বান্ধবীদের নিয়ে একটা নতুন বাসা খুঁজবোনে। তুমি চিন্তা কইরো না।”

রাশেদ আকবর শান্ত হলেন না। বাবার অসহায় কণ্ঠ, ঠুকরে ওঠা তরীকে যেন আরও দূর্বল করে দিলো। কোনোমতে কথা কাটিয়ে কল কেটে দিলো সে। প্রশান্তির নিশ্বাস ফেলতে ফেলতেই আবার দরজায় কারাঘাত। সালেহার কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। অস্পষ্ট কিসব বকছে মেয়েটা!
তরী গায়ের ওড়না ঠিক করলো। দরজা খুলে দিতেই সালেহা বকবক করে উঠলো, “প্রণয় ভাইজান আইছে আপা। আজকে মনে অয় মেজাজ ভালা নাই ভাইজানের। চোখ-মুখ কেমন করি রাখছে! এত যে কিল্লাই রাগে!”

তরী শুনলো। তবে কোনোরুপ আগ্রহ দেখা দিলো না। ক্লান্ত স্বরে বললো, “আজকে আমার ভালো লাগছে না সালেহা। তুমি প্রণয় ভাইয়াকে খাবার-দাবার একটু বেড়ে দিও?”

সালেহা যেন আঁতকে উঠলো, “কি কও আপা? বেশি খারাপ লাগতাছে?”
—“আমি ঠিক আছি সালেহা। শুধু একটু ক্লান্ত লাগছে। ঘুমালে ঠিক হয়ে যাবে।”

সালেহা তিন, চারবার পলক ঝাপটে বললো, “আইচ্ছা তাইলে তুমি ঘুমাও। আমি ভাইজানরে খাওন দিয়ে দিমুনে।”

____________

চলবে
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

বকুলতলা

৯.
প্রণয়কে বেশ শান্ত লাগছে এখন। কিছুক্ষণ আগের রাগ আর দেখা যাচ্ছে না। তরীকে আশেপাশে দেখতে না পেয়েও তার প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক। চুপচাপ প্লেটের বিরিয়ানিটুকু খাচ্ছে। আজকের রান্নাটা মজা হয়নি তেমন। প্রত্যেকটা লোকমায় মুখের স্বাদ বিগড়ে যাচ্ছে। নাকি তার মনটাই বিস্বাদে ভরে গেছে?
আয়েশা খাতুন হঠাৎ-ই সেখানে উদয় হয়ে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, “এত কম খাবার নিয়েছিস কেন বাবা? টেবিলে দেখছি বিরিয়ানির বাটিটাও নেই! এই তরী মেয়েটা কি আদৌ কোনো কাজ ঠিক করে করতে পারে না? মেয়েটা কোথায়?”

আয়েশা খাতুন মাত্রই ঘুম থেকে উঠে এসেছেন বোধহয়। কণ্ঠে ঘুমুঘুমু ভাব স্পষ্ট। প্রণয় তাকালো না। চুপচাপ বিরিয়ানির একেকটা কণা গিলতে লাগলো। পাশ থেকে সালেহা ভয়ে ভয়ে জবাব দিলো, “আপার শরীলডা আইজকা ভালা না ম্যাডাম। কইলো ঘুমাইবো।”
মুহুর্তেই প্রণয় থেকে নজর ঘুরিয়ে সালেহার দিকে তাকালেন তিনি। তীক্ষ্ণ, তাচ্ছিল্য দৃষ্টি। ঠাট্টার সুরে বললেন,
—“এত ক্লান্ত কেন? তোর আপা কি এভারেস্ট জয় করে আসছে নাকি?”
তার এই ঠাট্টাটা কারোই পছন্দ হলো না। সালেহা সামনাসামনি কিছু বলতে না পারলেও মনে মনে ভীষণ রাগে ফুঁসে উঠলো।
আয়েশা খাতুন আবার বললেন, “যাহ্, তোর আপাকে ডেকে নিয়ে আয়। এত ঘুমাতে হবে না। পরে ঘুমাক।”
—“আমার খাওয়া শেষ আম্মু। কাউকে ডাকতে হবে না।” এতক্ষণ বাদে গম্ভীরমুখে বলে উঠলো প্রণয়। বাস্তবিকই তার খাওয়া শেষ প্রায়। আর অল্প একটু আছে।
আয়েশা খাতুন ভয়ংকর ভাবে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেললেন। চাহনি হলো কাঁটা কাঁটা। সন্দিহান কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লেন, “ডাকলে কি সমস্যা? তুই কি আবারো–”
কথা শেষ হলো না। আধখাওয়া প্লেট রেখে তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালো প্রণয়। রাগে গা শিরশির করছে। কিছু একটা মনে পরে গেছে আবারও! মায়ের দিকে কেমন কঠিন নয়নে তাকালো সে। কাঠকাঠ গলায় বললো,
—“তুমি কি আমাকে শান্তি দিবে না?”
—“আমি কখন তোকে শান্তি দিলাম না? বরং তুই নিজেই অশান্তির পথে হাঁটছিস। দেখ প্রণয়, তরী ভালো মেয়ে না।”
নিশ্বাসের ঘনত্ব বাড়িয়ে প্রণয় কিছুক্ষণ কথা বললো না। মেজাজ তিরতির করে তেতে যাচ্ছে। রুক্ষ হতে চাচ্ছে আচরণ। তবুও যথেষ্ট শান্ত গলায় সে বললো, “তরী আমার জন্য কেউ না আম্মু। থাকতে এসেছে, থাকুক। ওকে দয়া করে কষ্ট দিও না।”
কিন্তু প্রণয়কে তো আয়েশা খাতুন চিনেন। কথাটা ঠিক বিশ্বাস করতে পারলেন না। বললেন, “প্রণয়, তুই ভুল পথে পা বাড়াচ্ছিস। মায়ের কথা শুন। তোকে তো তিন বছর আগের ঘটনা বলেছিই আমি, তাই না? নির্লজ্জ মেয়েটা অলক্ষী না হলে কি ওমন হতো?”

প্রণয় সেসব কথায় কান দিলো না। খাবার ঘর ছেড়ে চলে যেতে লাগলো। ক্রমশই বুক ভারি হয়ে আসছে তার। অসহ্য মাথা ব্যথায় কাতর হচ্ছে শরীর।
সালেহা নীরব দর্শকের মতো সব দেখছিল। বলা যায়, হা করে গিলছিল সব। আয়েশা খাতুন আড়চোখে ওর দিকে একবার তাকালেন। পরপরই জোড়ালো কণ্ঠে ধমক দিয়ে উঠলেন, “যা শুনেছিস, শুনেছিস। কথাগুলো যেন তরীর কানে না যায়।”

অবাক সালেহা আড়ষ্ট ভঙ্গিতে উপর-নিচ মাথা নাড়ালো। একবার, দুবার, লাগাতার।

নীল রঙের আকাশ। তার মাঝে একটু একটু করে উড়তে থাকা সাদা মেঘ। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। মন মাতানো বাতাস এসে এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে। মাথার ঘোমটা সামলাতে খানিকটা বেগ পেতে হচ্ছে তরীর। হাত উঁচিয়ে ওড়না কপাল অব্দি টেনে নিলো সে। দু’কানে ইয়ারফোন গুঁজে রাখা। এই অবেলায় গানটি বাজছে। তার ভীষণ পছন্দের গান।
মাহাদ কোত্থেকে যেন বাদাম কিনে নিয়ে এসেছে। কুড়ি টাকা দিয়ে। এখন আবার বাদামগুলো থেকে সযত্নে খোসা ছাড়িয়ে তরীর হাতে গুঁজে দিচ্ছে। তরী প্রথমে মানা করেছিল, সে খাবে না। কিন্তু ত্যাড়া লোকটা কি আদৌ তার কথা শুনবে কিংবা কখনো শুনেছে?

—“তরী? আরও খাবে?”
হঠাৎ বলে উঠলো মাহাদ। তরীর কানে ইয়ারফোন থাকায় সে শুনতে পায়নি। অন্য খেয়ালে বিভোর হয়ে আছে। মাহাদ কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করলো। এরপর আচমকাই তরীর কান থেকে একটা ইয়ারফোন খুলে নিজের কানে ঢুকিয়ে নিলো। ওপাশ থেকে গানের লাইন ভেসে আসছে,
‘এই অবেলায়, তোমারি আকাশে, নিরব আপোষে ভেসে যায়
সেই ভীষন শীতল ভেজা চোখ
কখনো দেখাইনি তোমায়।’

শুনে হাসলো মাহাদ। ক্ষীণ হাসি। ইয়ারফোনটা আবার সাবধানে তরীর কানে গুঁজে দিতে দিতে অবাক তরীকে শুধালো, “আমার গাওয়া গান-না তোমার বাজে লাগে? তুমি এত এত মিথ্যে বলো তরী?”

মাহাদ খুব সুন্দর গান গাইতে পারে। দারুণ মারাত্বক কণ্ঠ তার! ক্ষীণ ভরাট, ক্ষীণ ভারি। প্রায়ই তরীর পছন্দের সব গান গেয়ে, রেকর্ড করে তরীকে পাঠায় সে। গিটারও খুব ভালো বাজাতে পারে। তরীর প্লে-লিস্ট এখন মাহাদের গাওয়া গান পর্যন্তই সীমিত। অন্যদের গাওয়া গান এখন আর ভালো লাগে না। অথচ তরী দিব্যি মিথ্যে বলে গেছে, তার মাহাদের গান পছন্দ না। মনে মনে সে কিন্তু ঠিকই অবসর সময়ে, একটুখানি মন খারাপে, একটুখানি আনন্দে কানে ইয়ারফোন গুঁজে বসে থাকে।
তরী মিনমিনে কণ্ঠে বললো, “আমি– আমি অন্য গান শুনছিলাম। হঠাৎ করে এ গান চলে এসেছে। আমি পছন্দ করি না আপনার গান।”

মাহাদ হাসলো আবারও। নিঃশব্দে। লহু স্বরে বললো,
—“মিথ্যে বলাটা হয়নি তরী। মিথ্যে বলার সময় ঠোঁট কাঁপা বারণ। এদিক-ওদিক তাকানো যাবে না। দৃষ্টি স্থির রাখতে হবে। জোড়ে জোড়ে নিশ্বাসও নিতে পারবে না। স্বাভাবিক থাকবে। ঠিকাছে? এবার আবার মিথ্যেটা বলো।”
তরী পলক ঝাপটালো। সরল কণ্ঠে বললো,
—“আপনি কিভাবে বুঝে ফেলেন?”

মাহাদ উত্তর দিলো না। হাসতে হাসতেই প্রশ্ন করলো, “আরও বাদাম খাবে? নিয়ে আসি?”
—“খাবো না।”
বলতে বলতে একটা তীব্র বাতাস এসে উলটপালট করে দিলো চারিদিক। পাখির কিচিরমিচির শব্দ হলো। পাতাগুলো গাছ থেকে আলাদা হয়ে ছুটোছুটি স্বাধীন ভাবে করলো। তরী তাকিয়ে রইলো। ম্লান কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “আপনাকে আমি কেন মেনে নেইনা, সেটা জানতে ইচ্ছে করে না মাহাদ?”
—“করে।”
—“তাহলে কখনো জিজ্ঞেস করেননি কেন?”
—“জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়নি। আমার কষ্ট পেতে ভয় লাগে তরী।”

তরী একদম চুপ হয়ে গেল। দৃষ্টি নুইয়ে গেল আস্তে আস্তে। মাহাদ বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো, “বাস আসতে বোধহয় দেড়ি হবে। ওদিকটায় অনেক জ্যাম বেঁধেছে। আমার আসতেই তো দেড়ি হলো। তৃষ্ণা পেয়েছে না? আমি পানির বোতল নিয়ে আসছি।”

_________________

চলবে
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here