বকুলতলা ২২,২৩

0
264

বকুলতলা ২২,২৩
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
২২.
প্রিয় দোস্ত আমার,
কেমন আছিস? জানি, ভালো নেই। আমি তো তোর ভালো থাকাটাই নিজের সাথে করে নিয়ে এসেছি। তোকে প্রিয় বলার, দোস্ত বলে সম্বোধন করার অধিকার আমার নেই। আমি জানি। কিন্তু এসব না ডাকলে যে শান্তি, তৃপ্তি কিছুই পাই না।
তোর মনে আছে? স্কুলের পাশের টং দোকানটা? রিধুকে আমি সেখানেই প্রথম দেখেছিলাম৷ তুই তো খুব ভালো মেয়ে। বাবা মায়ের বাধ্যগত সন্তান। টংয়ের ছেলেদের দিকে ভুলেও তাকাস না। আমিও তোর দেখাদেখি তাকাতাম না। তুই তাকানোর সময়ই দিতি না আমাকে। জোড় করে টেনেটুনে নিয়ে যেতি। সেদিন তুই আসিস নি। আমি ভুলেভালে, শয়’তানের কু প্ররোচনায় টং-এর কাঠের পুরাতন বেঞ্চিতে রিধুকে বসে থাকতে একপলক দেখেছিলাম। ওর সাথে ওর সাঙ্গপাঙ্গরাও ছিল। একমনে সিগারেটে টান দিচ্ছিল ও। চায়ে চুমুক দিচ্ছিল কি ভীষণ সুন্দর করে! আমি ওর চালচলন, স্বভাব— সবকিছুর প্রেমে পড়ে গেলাম। তোর অগোচরে ওর দিকে সময় পেলেই তাকাতাম। দেখতাম। ওকে প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলেছিলাম। স্কুল জীবনটায় ও কিন্তু আমাকে পাত্তা দেয়নি। এতে যেন আমি আরও এগ্রেসিভ হয়ে গেলাম ওর প্রতি। ওকে সাহস করে লাভ লেটার লিখলাম। ও তখনো পাত্তা দেয়নি। অনেক, অনেক প্রেমপত্র পাঠিয়েছি আমি। আঙুল ব্যথা হয়ে যেত, রাত জাগায় চোখের নিচে কালি পরে গিয়েছিল। আমি খুব কাঁদতাম। ও কেন আমাকে দেখে না? ভালোবাসে না? পাত্তা দেয় না? আমি তো অসুন্দর নই।
তোর মনে আছে? তুই কিন্তু আমাকে প্রতিদিনই জিজ্ঞেস করতি, ‘তোর কি হয়েছে? চেহারা, শরীরের এ হাল কেন?’ আমি হাসতাম শুধু। আমার হাসি দেখে তুই হতাশ হতি। বারবার কারণ জিজ্ঞেস করতি। কিছু না জেনেই সান্তনা দিতি। এমন বন্ধু কয়জনে পায়? আমি এদিক দিয়ে একটু বেশিই ভাগ্যবান ছিলাম কিনা!
বাবা-মা কিভাবে যেন রিধুর কথা জেনে গেল। মারলো খুব। ওয়ার্নিং দিলো, আরেকবার ওই ছেলের সাথে মেলামেশা করলে পড়ালেখা বন্ধ করে দিবে। আমার সব অসহ্য লাগছিল। সহ্য করতে পারছিলাম না। তুই হয়তো টের পাসনি, আমি অনেকবার আ’ত্মহ’ত্যা করার চেষ্টা করেছি। হাত কেটেছি, বিষ খেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু একবারও মরিনি! বলে না? শয়’তান সহজে মরে না? আমি ছিলাম শয়’তান। সুযোগ বুঝে রিধুর কাছে গিয়ে এমন ভাবে কাঁদছিলাম যে, ও একটু হলেও গললো। আমার সাথে কথা বলতে আগ্রহী হলো। আমি আবার স্বাভাবিক হতে শুরু করলাম। পৃথিবী এত সুন্দর লাগতে লাগলো আমার! তবে সুখের দিনগুলো বেশিদিন টিকলো না। একদিন হঠাৎ করে রাতে রিধু কল করে জানালো, সে আমাকে চায়। স্বামী-স্ত্রীর মতো করে চায়। বিয়ে ছাড়াই। নয়তো নাকি তার জন্য আমার ভালোবাসা প্রমাণ হবে না!
আমি তৎক্ষণাৎ রাজী হয়ে গেলাম। ওর সাথে রুমডেট করেছি অনেকবার। সংখ্যা মনে নেই। তোরাও কখনো বুঝতে পারিস নি কিছু। এদিকে বাবা মাও আবার কিভাবে যেন রিধুর সাথে আমার সম্পর্ক জেনে ফেলল। আমাকে আরও একবার মারাত্বক ভাবে মারলো। রিধুকে গুন্ডা, বখাটে, মাস্তান, যাতা বলে গালি দিলো! আমি সহ্য করতে পারিনি। আ’ত্মহ’ত্যা করার চেষ্টা করি। কিন্তু ভাগ্য! আবারও বেঁচে গেল আমি নামক শত’তানটা! মূলত বাবা মায়ের কারণেই বেঁচে গিয়েছিলাম। মা দেখে ফেলেছিল আত্ন’হ’ত্যা করার সময়।
তুই বলতি না? কলেজে উঠে আমি এত ফাঁকিবাজ হয়ে গেলাম কিভাবে? কেন রেগুলার ক্লাস এটেন্ড করিনা? এজন্যই করতাম না দোস্ত। তখন তোকে উত্তর দিতে পারিনি। এখন দিচ্ছি।

আমি আ’ত্মহ’ত্যা আগেও করার চেষ্টা করেছি, এটা জানার পর আমার বাবা মা কেমন চুপ হয়ে গেল। আমাকে কিছুতেই বাঁধা দিতো না। আমি ছিলাম স্বাধীন পাখি। পরে জানতে পারলাম, তারা আমার অগোচরে বিশাল কুবুদ্ধি আঁটছেন। আমার জন্য গোপনে পাত্র দেখছেন। আমার মেজাজ বিগড়ে গেল। রাগে, কষ্টে হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। মাঝরাতে রিধুকে ফোন করে পাগলের মতো বলছিলাম, ও যেন আমাকে নিয়ে কোথাও পালিয়ে যায়। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে এখানে। আমি ওর সাথে সুখে থাকতে চাই।
রিধু প্রথমে উত্তর দেয়নি। পরে রাজী হয়ে যায়। জুড়ে দেয় কঠিন শর্ত! ওর নাকি তোকে অনেক ভালো লাগে। আমাদের স্কুলে নাকি সে সবসময় তোর জন্যই আসতো। তোর সাথে একরাত কাটাতে চায় ও। আমি প্রথমে রাজী হয়নি। রেগে গিয়ে জীবনে প্রথম কাউকে বিশ্রী বিশ্রী গালি দিয়েছিলাম। বিনিময়ে রিধুও আমাকে গালি দিয়েছিল আমার থেকেও দ্বিগুণ খারাপ ভাবে। বলেছিল, আমার সাথে সে আর সম্পর্ক রাখবে না। আমার বাবা মায়ের যন্ত্রণাতে নাকি আমি পঁচে মরবো। ওকে পাবো না। ওকে ছাড়া অন্য কারো সাথে ভালো থাকবো না।
অন্ধ আমি দিশেহারা হয়ে গেলাম। ওকে পাওয়ার জন্য শেষ সীমা পর্যন্ত নিচে নামলাম। আমার কেন যেন আমার রুমটা ভালো লাগতো না। নিজেকে একা একা লাগতো ভীষণ। আমাকে নিয়েই বাবা মায়ের ঝগড়া হতো বেশিরভাগ। রুম থেকে স্পষ্ট তাদের চিৎকার শুনতে পেতাম। ওইদিনও পাচ্ছিলাম। আমার মাথা কাজ করছিল না। আমি রিধুকেই নিজের সর্বসুখ মনে করছিলাম। ওর সাথে প্লেন করে তোর ক্ষতি করালাম। তোকে নষ্ট করলাম। তোর বিশ্বাস নষ্ট করলাম। বন্ধুত্বের মধুর সম্পর্ক নষ্ট করলাম। কিন্তু বিশ্বাস কর, তোর সাথে করা অন্যায়ে আমার একটুও খারাপ লাগছিল না। রিধুর সাথে সেই রাত্রেই উত্তরার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলাম। মনে একটা কথাই বাজছিল, এবার থেকে আমি বুঝি সত্যিই স্বাধীন পাখি!

উত্তরায় একমাস! আমার আর রিধুর জীবন ভালোই কাটছিল। আমরা তখনো বিয়ে করিনি। বিয়ে বিয়ে করে ওর মাথা খেয়ে ফেলতাম। ও বিরক্ত হয়ে শুনতো। কিছু বলতো না। একদিন, দু’দিন, তিনদিন! চারদিনের মাথায় প্রথম গায়ে হাত তুললো। এরপর যেন গায়ে হাত তোলা রুটিন হয়ে গিয়েছিল। মদ গিলে রাতে বাসায় ফিরতো। মানসিক, শারীরিক বিভিন্ন টর্চার করতো। মুখের ভাষার কথা আর বললাম না। আমি তাও মেনে নিয়েছিলাম। ও যে এমন, আমি জানতাম। ওর বন্ধুরাই বলেছিল। রিধুও বলতো। আমি তবুও বোকার মতো ওর পিছু পরে থাকতাম।
গায়ে হাত তোলা, মদ গেলা, গালি দেওয়া, এসবে রিধু সীমাবদ্ধ থাকলো না। উত্তরায় আসার প্রথম থেকেই ও নিয়মিত ওর এক গার্লফ্রেন্ডের সাথে অনৈতিক মেলামেশা করতো। যদিও আমিও পবিত্র নারী ছিলাম না। কিন্তু মানতে পারিনি। ওর ফোনে মেয়েটার সাথে অশ্লীল, আদরমাখা চ্যার্টগুলো আমাকে কষ্ট দিতো। বুকে মনে হয় কেউ আঘাত দিতো! ও রাতে এসে আমাকে নিজেই দেখাতো ওগুলো। ওর আর ওই মেয়ের বাজে ছবিও দেখাতো। ও কিন্তু এক মেয়েতে আসক্ত ছিল না। ছিল হাজার হাজার মেয়েতে।
আমি ততদিনে বুঝে ফেলেছিলাম, আমি ভুল মানুষের হাত ধরেছি। ভালোবেসেছি। যে আমাকে একটু সম্মান করে না। ভালোবাসা তো অনেক দূরে। আমার সাথে রিধুর একেকটা অন্যায় যেন আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল তোর কথা। উপলব্ধি করাচ্ছিল তোর কষ্ট।
আমি সরিরে দোস্ত। বুঝতে পারিনি। আমি আমার ভুলটা যে কেন এত দেড়িতে বুঝলাম! এটাই বোধহয় তোকে লিখা আমার শেষ চিঠি। আমার আর এই জীবন ভালো লাগছে না। রাতের রান্নার সাথে বি’ষ মিশিয়েছি। ওকে আগে বি’ষ খাইয়ে মারবো। তারপর ছুঁড়ি দিয়ে কো’পাবো! ওর শক্তির সাথে তো আমি পারবো না। ও মরে গেলে ধীরে সুস্থে ছুঁড়ি দিয়ে কাটতে পারবো। পরে নাহয় আমিও অমৃতের মতো বি’ষ মেশানো ভাত খেয়ে চিরবিদায় নেব! বেঁচে থেকে লাভ কি? লাভ নেই তো। কোনো লাভ নেই।
ভালো থাকিস। পারলে ক্ষমা করিস।

ইতি,
রুপালী রুপা

তরী পড়া শেষ করলো। আস্তে ধীরে কাপড়ের ভাঁজে আবার রেখে দিলো চিঠিটা। দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সুদীর্ঘ, বেদনাদায়ক নিশ্বাস! আলমারির দরজা লাগালো। ফোনটা কালকে রাতেই চার্জের অভাবে বন্ধ হয়ে পরে ছিল। সকালে চার্জে দিয়েছে। এতক্ষণে বোধহয় ফুলচার্জ হওয়া শেষ। তরী বিছানায় বসলো। ফোন চার্জ থেকে খুলে অন করলো। অন করার এক মিনিট পরই নোটিফিকেশনের জ্বালায় টেকা গেল না আর! ফোনের এই টুংটাং শব্দ যে কি বিরক্তিকর! বাধ্য হয়ে তরী বাটন টিপে সাউন্ড শূণ্য করে দিলো। লক স্ক্রীনে তাকাতেই দেখলো, মাহাদের নম্বর থেকে একের পর এক কল, মেসেজ আসছে। কাল বিকাল থেকে আজ ভোর সকাল পর্যন্ত মোট ছাপ্পান্নটা নোটিফিকেশন।
স্ক্রীনের কালো কালো লেখাগুলোর দিকে তরী কিছুক্ষণ নিষ্পলক চেয়ে রইলো। অনুভূতি শূণ্যে ফেলে। আঙুলের চাপে মেসেজে ঢুকে শেষ দুটো মেসেজই পড়লো,
—“যদি সম্ভব হতো তোমার কান টেনে কাছে নিয়ে আসতাম। তুমি শাস্তি পাবে তরী। আমাকে জ্বালানোর অনেক বড় শাস্তি পাবে। আমি এমনি এমনি ছেড়ে দেব না।”
—“মেয়ে, তুমি আমাকে জ্বালিয়ে কি সুখ পাও?”

তরী তড়িঘড়ি করে মেসেজ থেকে বের হয়ে গেল। আবার আঙুলের চাপে বন্ধ করে দিলো ফোন। বিছানার একপাশে রাখলো। বসার ঘর থেকে বাবার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। তিনি নাকি রান্না শেষ করে ফেলেছেন প্রায়। ওকে তাড়াতাড়ি গোসল সেড়ে আসতে বলছেন। তরী সবভুলে জামাকাপড় নিয়ে পুকুরের দিকে ছুটলো।
তরীর মা মারা যাওয়ার পর তরীর বাবাই এখন রান্নাবান্না করেন। যদিও তরীর খাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি কখনো। আগে তো কাজের খালাই রাঁধতেন। তরী ঢাকা যাওয়ার পর তাকে তাড়িয়ে দিয়েছেন তরীর বাবা।

পুকুরটা বেশ বড়োসড়োই। পাঁচছয়জন যে যার ঘরের সামনের পুকুরের অল্পটুকু জায়গা দখল করে রেখেছে। পুকুরের মালিক মারা গিয়েছে সেই কুয়াত্তুর আমলে। ছেলেমেয়েদেরও এই পুকুর নিয়ে তেমন একটা আগ্রহ নেই। তাই বলা যায়, পুকুরটা ওই পাঁচছয় জনেরই।
তরীদের পুকুরের অংশুটুকু সিমেন্ট দিয়ে ঘেরাও করা। বাহিরের মানুষের সিমেন্টের দেওয়ালের ওপাশে কি হচ্ছে, তা জানার জো নেই। এতে মেয়েদের জন্য অনেকটা সুবিধাই হয়েছে। তরী শুকনো সিঁড়ির একপাশে জামাগুলো যত্ন করে রাখলো। ওড়নাও খুলে রাখলো ওখানে। কিছুক্ষণ নিগূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো পুকুরের থলথলে, ঝলমলে পানির দিকে। একপা একপা করে কোমড় অব্দি পানিতে নামলো৷ তরী যেন ক্রমশই অন্য দুনিয়াতে হারিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে গেছে অতলে। মন্ত্রমুগ্ধ করছে পানিগুলো। চোখের দৃষ্টি গাঢ় হচ্ছে। মস্তিষ্ক ফাঁকা। হঠাৎ-ই পানির নিচের সিঁড়িতে ধপ করে বসে পরলো তরী। চোখ শক্ত করে বুজে রইলো। ঠোঁটের পাতা চিপে থাকলো। তার আশেপাশে শুধু পানি আর পানি! পানিতে চুল উপরের দিকে ভাসছে। তরী বুঝতে পারছে। এ যেন পানির দমকা হাওয়া! মৃ’ত্যুকে কাছ থেকে চিনতে চাইছিলো ও। কিন্তু কয়েক সেকেন্ড গড়াতেই নিশ্বাসের অভাবে ছটপট করতে লাগলো। দমবন্ধ হয়ে আসলো। অসার হতে লাগলো শরীর। মস্তিষ্ক যেন আচমকাই সচল হলো। জানান দিলো, “এটা পাপ তরী। মহাপাপ! আল্লাহ নারাজ হবেন!”

চট করে চোখ খুললো তরী। বেঁচে ফিরলো, পানির অতলে হারিয়ে যাওয়া থেকে।

_______________

চলবে
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

বকুলতলা

২৩.
ঘরটায় কেমন ভ্যাপসা গরম, ফাপা গন্ধ। জানালার ওপারটা গাছগাছালিতে জঙ্গল হয়ে আছে। সূর্যের আলো ঢুকছে কম। তরী ভেঁজা চুলগুলো ভালো ভাবে মুছে নিলো। গামছাটা রাখলো পুরোনো কাঠের চেয়ারটাতে। তিতির গভীর তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। হাত-পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমিয়ে আছে বিছানার মাঝখানটায়। তরী নিঃশব্দে বোনের মাথার কাছে এসে বসলো। চুলে হাত বুলাতে লাগলো আলতো করে। বোনটা তার অনেক আদরের। মা মারা যাওয়ার পর থেকে তরীই যেন ওর সব। অথচ সে শহরে যাওয়ার পর থেকে মেয়েটা কেমন অযত্নে নেতিয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি পরেছে, শরীর-মুখ শুকিয়ে কাঠ, মাথার চুল যত্নের অভাবে উষ্কখুষ্ক হয়ে আছে। এসবে আসলে বরকত সাহেবকে তেমন একটা দোষ দেওয়া যায় না। তিনি আর কত করবেন? সারাদিন দোকানের কাজ, রান্নাবান্না, ঘরদর পরিচ্ছন্ন রাখা- এসব করতে করতে তো নিজেরই খেয়াল রাখা হয়না। তিতিরকে কিভাবে সামলাবেন? মেয়েটা এমনিতেও বড্ড চঞ্চল। বড্ড অভিমানী।
তরী খানিকটা মাথা ঝুঁকালো। তিতিরের কপালে দীর্ঘ চুমু এঁকে সরে এলো তৎক্ষণাৎ। খাবার ঘর থেকে বাবার হাঁক শোনা যাচ্ছে। ভাত খেতে ডাকছেন তিনি। গায়ে ওড়না জড়াতে জড়াতে তরী উঁচু গলায় জবাব দিলো, “আসছি, আব্বা।”

তরীর বড় ফুপি এসেছেন। আমেনা খাইরুন। মহিলা বেশ ঠোঁটকাটা স্বভাবের। মুখে যা আসে সরাসরি বলে দেন। কে কি মনে করলো, খারাপ লাগলো কিনা, এতে তার কিচ্ছু যায় আসে না। তরীদের দশঘর পরেই উনার টিনের ছোটখাটো বাড়ি। এলাকার সবাই আমেনাকে এক নামেই ডাকে, ‘পাশের বাসার আন্টি।’
তরী একটু জোড়সড়ো হয়ে চেয়ারে বসলো। প্লেটে দু’চামচ ভাত আর পটল ভাঁজা নিলো। আড়চোখে সামনের মানুষটাকেও দেখে নিলো একবার। আমেনা জহুরি চোখে চেয়ে আছেন সেই প্রথম থেকে। মুখশ্রী ভীষণ ভাবে কুঁচকানো। বিশেষ করে কপালের দিকটা। কয়েক মিনিটের পর্যবেক্ষণ শেষে খসখসে কণ্ঠে বললেন, “তোর খানাদানার এই ছিরি ক্যান? কিছু কি খাস না?”
তরীর মৃদু স্বরের উত্তর, “খাই।”
—“দেইখা তো তেমনডা মনে অয় না। চোখের নিচে কালি বইয়া গেছে। রাত জাইগা থাকোস নাকি? নতুন নাগর জুটাইছোস?”

তরী মাত্র ভাতের এক লোকমা মুখে দিয়েছিল। চাবাতে পারলো না আর। থমকালো। চোখের দৃষ্টি স্থির হলো ভাতের দানার ওপর। বরকত সাহেব কৃত্রিম হেসে বললেন, “ওসব কিছু না বুবু। তরী সারারাত জেগে পড়াশোনা করে তো!”
আমেনা বিশ্রী ভাবে মুখ বাঁকালেন। স্বাচ্ছন্দে ভাত চিবুতে চিবুতে তাচ্ছিল্য করলেন, “কি পড়ালেহা করে, আমার জানা আছে। আমারে শিখাইতে আসিস না। এক পড়ালেহা, পড়ালেহা কইরা অসতী হইলো। আবার বিয়াটাও টিকলো না। এত পড়ালেহা করাইয়া কি করবি বরকত? আবার বিয়া দেওনের চেষ্টা কর। আমার কাছে একখান ভালা সম্বন্ধ আছে।”

ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে বুঝি? তরী বুঝতে পারলো না। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। মুখের ভাতটুকু গলা দিয়ে নামতেই চাইছে না। দৃঢ় কিছু কথা শুনিয়ে দিতে গিয়েও পারলো না। বরকত সাহেব বারবার চোখের ইশারায় অনুরোধ করছেন কিছু না বলার জন্য। তরী সশব্দে উঠে দাঁড়ালো। একপলক বাবার দিকে অভিমান ভরা দৃষ্টে তাকিয়ে, চলে গেল ডানপাশের ঘরটায়।
আমেনা কিন্তু তখনো ক্ষান্ত হননি। খসখসে কণ্ঠটা ক্যাসেটের মতো চালাতেই রইলেন, “অর্ণব ছেলেডার সাথে কালকা দেখা হইছিল। কি ভদ্র,সভ্য হইছে! আগের কুনু বদকাম করে না। তোর মাইয়ার মইধ্যেই দোষ আছিলো। ভালা পোলাটারে ধইরা রাইখতে পারলো না!” কণ্ঠস্বর চুইয়ে চুইয়ে একরাশ আফসোস।
এবার আর না রেগে পারলেন না বরকত সাহেব। বিরক্তিতে মুখ তিতা করে রাখলেন।

—“তোমাকে আমার মেয়ের ব্যাপারে চিন্তা করতে হবে না বুবু। খাইতে আসছো, খেয়ে চলে যাবা। এত বার্তি ঝামেলা পছন্দ না আমার।”
কথাটা কি গায়ে লাগলো আমেনার? লাগেনি বোধহয়। আগের মতোই তৃপ্তির সাথে খাবার খাচ্ছেন তিনি। মাঝখান দিয়ে আবার কি যেন বিড়বিড় করে বলছিলেনও! বরকত সাহেব শুনতে পাননি।

তিতির অনেকদিন ধরেই অসুস্থ। এই জ্বর, এই ঠান্ডা-কাশি। এবার খানিকটা মাত্রা ছাড়ানো জ্বরই হয়েছে ওর। প্রতিবার ঘুমের ঘোরে নাকি তরীকেই একটু জড়িয়ে ধরার আবদার করছিল। একটুখানি কথা বলার অফুরান আবদার জাহির করছিল। বাবার কাছে সবকিছু শুনে তরী আর দেড়ি করতে চায়নি। সকালেই চলে এসেছে। তারও আর শহরের যান্ত্রিকতা ভালো লাগে না। দমবন্ধ হয়ে আসে। এই প্রকৃতি, ঠান্ডা বাতাস, বিশ হাত দূরে মায়ের কবর, ওইতো ওই বকুল গাছটা! তরী নামক নৌকা নিজের তির ছাড়া বাঁচবে কিভাবে?

ঘড়িতে তখন পৌনে দুইটা। তিতির শক্ত বাঁধনে তরীকে জড়িয়ে ধরে আছে। তরীর চোখে ঘুম নেই। শুয়ে শুয়ে গ্যালারি দেখছিল ও। একদম শেষের সারিতে কয়েকটা ছবি দেখতে পেল বন্ধুদের নিয়ে। রুপালীও আছে। তরী আর রুপালী একই শাড়ি পরেছিল সেদিন। মুখে কি আনন্দের বিস্তর হাসি! একে অন্যের দিকে তাকিয়ে হাসছিল ওরা। মুহুর্তেই তরীর মনে একটা প্রশ্ন এলো, রুপালীকে কবর কোথায় দেওয়া হয়েছে? ওর বাবা মা তো রাগ করে মেয়ের লা’শটাও দেখতে যায়নি।
তরীর ফোনে কল এসেছে। অচেনা নম্বর। তরী স্বাভাবিকভাবে অচেনা নম্বর ধরে না। কিন্তু এ ফোনটা নতুন। শহরে যাওয়ার আগে বাবা কিনে দিয়েছিলেন। অনেকের নম্বরই ফোনে সেভ নেই। খানিক্ষণ ভেবে চিন্তে তরী ফোনটা ধরলো, “হ্যালো, কে বলছেন?”

ওপাশ নিশ্চুপ। কথা নেই। তরী আবার বললো, “কথা বলছেন না কেন? হ্যালো?”
সেকেন্ড লাগিয়ে ওপাশের ব্যক্তি উত্তর দিলো, “আমি বলছি।”
গলাটা প্রণয়ের। গম্ভীর গলা। তরী ভড়কালো খুব। কথা বলতে পারলো না। প্রণয়ই শুধালো,
—“আপনি কি ঘুমাচ্ছিলেন?”
—“না।”
যথা সম্ভব শান্ত গলায় জবাব দিলো তরী। প্রণয় শুনলো। কিন্তু কথা বললো না। ওপাশ থেকে নিশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। তিতির নড়েচড়ে শুয়েছে। আরও শক্ত করে ধরেছে তরীকে। সেও পালটা ভাবে তিতিরের কপালে চুমু খেল। তারপর অনেকটা বিরক্ত হয়েই জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কি আমি কি করছি সেটা জানার জন্যই কল করেছেন? কিছু বলার থাকলে দ্রুত বলুন। আমি ঘুমাবো।”
প্রণয় বেশক্ষণ চুপ থেকে ধীর গলায় শুধালো, “কবে আসবেন?”
—“কেন?”
—“আমার আপনাকে মনে পরছে তরী। তাড়াতাড়ি চলে আসুন।”

______________

চলবে
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here