কালো জাদু ( ১ম পর্ব)

0
1170

#কালো জাদু ( ১ম পর্ব)

তিথি স্বামীকে চুমু খেয়ে বললো,
‘আজ অনেক ধকল গেছে তাই না? তোমাকে কেমন ক্লান্ত লাগছে।’

হাসিবুর কোনো কথা বলতে পারছে না৷ তার বমিবমি ভাব হচ্ছে। ঝাপসা চোখে সন্ধ্যার মতোন সবকিছু আবছা লাগছে। খুব চেষ্টা চালাচ্ছে বমি আটকানোর। এই যুদ্ধ কতক্ষণ চালাতে পারবে বুঝা যাচ্ছে না। কিন্তু বাসর ঘরে বমি করে ফেললে ভীষণ লজ্জার ব্যাপার হবে। বাইরে গিয়ে বমি করে আসতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু সে যেন নড়তেও পারছে না।

তিথি খানিক অবাক হয়ে বলল, ‘হাসু তুমি কোনো কথা বলছো না কেন! তোমাকে কেমন জানি দেখাচ্ছে, কোনো সমস্যা? দেখে তো মনে হচ্ছে শ্বাস বন্ধ করে আছো। মুখ-টুখ ঘেমে অবস্থা খারাপ।’
হাসিবুর দূর্বল গলায় বলল, ‘আমাকে একটু টয়লেটে নিয়ে চলো।’

তিথি চোখ পাকিয়ে বলল, ‘কেন? তুমি একা যেতে পারো না?’

হাসিবুর কোনো উত্তর দিলো না। কেবল শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তিথির দিকে। মুখ খুলে কথা বললেই বাসর ঘরে বমি করার মতো বিশ্রী একটা কর্ম ঘটে যেতে পারে।
তিথির কাছেও এখন হাসিবুরকে কেমন অস্বাভাবিক লাগছে। হাত ধরে তাকে শোয়া থেকে বসিয়ে বলল, ‘টয়লেটে চলো।’
হাসিবুর নিজে দাঁড়াতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিল। ধরে ফেলল তিথি।
লক্ষ্য করলো হাসিবুর পা ফেলতে পারছে না৷ তিথি খুব সাবধানে তাকে টয়লেটে নিয়ে গেল। মুহূর্তেই সে গড়গড় করে বমি করা শুরু করেছে। তিথি অবাক হয়ে দেখে রক্তবমি। নাকমুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে।
.
হাসিবুরের জন্মের সময় তার মা মারা গেলেন। ছোট্ট একটা শিশু। শুধু বাবাকে দিয়ে তার পোষাবার কথা নয়। দরকার মায়ের মমতা। আজমল সাহেবকে তখন সবাই বিয়ের জন্য জোরাজোরি করে। কিন্তু উনার কথা একটাই, বিয়ে করবেন না। হাসিবুরের মা’র স্মৃতি বুকে নিয়েই পুরো জীবন কাটিয়ে দিতে চান। এতে অবশ্য হাসিবুরের খুব একটা সমস্যা হলো না। দু’জন চাচি তাকে দেখাশুনা করেছেন। একজন চাচি তিথির আম্মু। তিথি হচ্ছে হাসিবুরের চাচাতো বোন। শৈশব তাদের একসাথে কেটেছে। বিকেলে যখন হাসিবুর ঘুড়ি নিয়ে দৌড়ে মাঠের দিকে যেত। পেছন থেকে একটা ডাক ভেসে আসতো, ‘ও হাসু ভাই। আমিও যাবো।’

হাসিবুর দাঁড়িয়ে বলতো,
‘তাড়াতাড়ি আয় তিথি। আজ দেখিস সবার উপরে আমার ঘুড়ি থাকবে।’

পশ্চিম আকাশে সূর্য লাল হয়ে দূরের কোনো অচেনা গ্রামে হারিয়ে গেলেই কেবল দু’জন বাড়ি ফিরতো।

গোরস্থানের দেয়ালে এক পাগল বসে পা নাড়াতে নাড়াতে ভুলবাল ইংলিশ বলতো। সবাই ইংলিশ পাগল বলে ডাকে। এই পাগলকে তিথির যা ভয় লাগতো৷ কিন্তু দূর থেকে পাগলের কাণ্ডকারখানা দেখতে বড় ভালো লাগে। মাঝেমাঝে হাসু ভাইরা পাগলকে আড়াল থেকে ঢিল মারে। পাগল তাড়া করলেই সবাই দৌড়। পেছনে পড়ে যেত তিথি। ভয়ে সে কাঁদো কাঁদো গলায় ডাকতো, ‘ও হাসু ভাই আমাকে নিয়ে যাও, হাবু পাগলা আমাকে ধরে ফেলবে।’

হাবু পাগলা কাউকে ধরতে পারে না। সে খানিক দৌড়ে আবার অন্যমনস্ক হয়ে যায়।

হাসিবুর একদিন তিথিকে বলল,

‘পাগলের পাশে বসে আমি তমাল আর হৃদয় গল্প করেছি জানিস? হাবু পাগলা মারে না৷ একা একা শুধু ভুলবাল ইংলিশ বলে।’
তিথির বিশ্বাস হলো না৷ সে মুখ বিকৃত করে বলল, ‘অ্যা কি সাহস, সব মিথ্যা কথা।’
হাসিবুর বলল, ‘তুই যাবি?’
তিথি থুতনি বুকের সাথে লাগিয়ে মাথা নীচু করে বলল ‘আমার ভয় লাগে। তুমি যদি পাগলের কাছে রেখে দৌড়ে পালাও।’
‘আরে রেখে আসলেও কিছু করবে না।’

একদিন তিথি হাসিবুরের সাথে ভয়ে ভয়ে পাগলের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। সে একা একা আকাশের দিকে তাকিয়ে ভুলবাল ইংলিশ বলছে, ‘ইউ চুয়িং বাং টু মে হাউ টু দুয়িং মাউ।’
হাসিবুরের হাত শক্ত করে ধরে আছে তিথি। ভয় অনেকটা কেটে গিয়ে পাগলকে দেখে হাসি পাচ্ছে।

এমন নানান স্মৃতিতে ভরা তিথির শৈশব। ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠার পর ওর বাবা ইংল্যান্ড থেকে চলে আসেন। মেয়ে আর স্ত্রীকে ইংল্যান্ড নিয়ে যাবেন। পাসপোর্ট ভিসা সব রেডি। খবরটা শুনে হাসিবুরের মন খারাপ হয়ে গেল৷ সে বিলের পাড়ে বসে পানিতে অন্যমনস্ক হয়ে ঢিল মারছে।
তিথি চুপচাপ হাসিবুরের পাশে গিয়ে বলল, ‘আমি চলে যাব হাসু ভাই।’
তিথির দিকে না তাকিয়েই বলল, ‘হ্যা জানি।’
‘ও দেশ থেকে চিঠি লেখা যায় হাসু ভাই।’
‘হ্যাঁ।’
‘আমিও লিখবো তোমাকে।’
হাসিবুর কোনো কথা বলে না। এক ঝাক হাঁস বিলে নেমে পড়েছে। বিলের ঢলঢলে জলের ভেতর সূর্য। মাঝখানে এক ঝাঁক লাল শাপলা, শাপলার পাশে একদল পানা, পানার উপরে সাদা ধবধবে বক বসে আছে পুঁটি মাছ ধরার জন্য। হাসিবুর আরেকটা ঢিল মারে। বক নিরাপদ স্থানের খুঁজে উড়াল দেয়। হঠাৎ হাসিবুর দাঁড়িয়ে যায়। তারপর বলে, ‘তুই এখন যা তিথি৷ আমি বকুলদের বাড়ি যাবো।’

বাবা-মা’র সাথে কেনাকাটা আর আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে ব্যস্ত দিন কাটে তিথির৷ হাসিবুর কেমন নীরব হয়ে গেছে। তিথি যেন তখনও পুরোপুরি বুঝতে পারছে না ক’দিন পর ওর হাসু ভাইকে রেখে অচেনা-অজানা এক দূরের দেশে চলে যাবে সে। কিন্তু যেদিন বাড়িতে গাড়ি এলো ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে গাড়িতে তোলা হচ্ছে৷ আত্মীয়-স্বজন আয়োজন করে তাদেরকে বিদায় দিচ্ছেন। হাসিবুর খানিক দূরে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ তিথির কেমন জানি লাগে। ভেতর গুলিয়ে কান্না আসে। আচমকা হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে সে। হাসিবুর তিথির দিকে তাকায় না। তারও জলভরা চোখ। শরীরে কান্নার কাঁপন।
.
তিথি বাসর ঘরে হাসিবুরের হাত ধরে প্রথম কথাটা বলল, ‘আমার একটা কথা রাখবে হাঁস ভাই।’

হাসিবুর অবাক হয়ে বলল, ‘হাঁস ভাই!’

তিথি ফিক করে হেঁসে বলল,
– ‘ছোটবেলায় স্কুলে তোমাকে হাসিবুর না ডেকে সবাই হাঁস বলে ক্ষেপাতো মনে নাই?’

– ‘তাই বলে তুমিও ডাকবে?’
– ওমা আমি একবার শখ করে স্বামীকে ডাকতে পারি না?’
হাসিবুর মেঘ জমা থমথমে মুখে বলল,
-এটা কেমন শখ?’
– ‘আচ্ছা ডাকছি না। কিন্তু আমার কথাটা রাখবে প্রমিজ করো।’
– ‘আগে কথাটা তো বলো।’
তিথি ছোটবেলার সেই বাচ্চা মেয়ের মতোই বলল,

– ‘না আগে প্রমিজ।’

হাসিবুর হেঁসে বলল,

– ‘প্রমিজ করলাম কথা রাখবো, এবার তো বলো।’

– ‘আমি না কখনও প্রেম করিনি।
তাই ইচ্ছে ছিলো স্বামীর সাথে প্রেম করবো। কমপক্ষে এক বছর অবিকল সাচ্চা প্রেমিক-প্রেমিকার মতো আমরা চলাফেরা করবো।’

হাসিবুর আসলে তখনও তিথির চালাকি ধরতে পারেনি। সে ভীষণ খুশি হয়ে বলল,

– ‘আরে এটা তো খুবই আনন্দের কথা। স্বামী-স্ত্রীর প্রেমই তো পবিত্র প্রেম।
আমি একশো একবার প্রমিজ করলাম। আমি তোমার স্বপ্নের সেই প্রেমিক হবো। এক বছর কেন জীবনভর আমি তোমার সেই স্বপ্নের প্রেমিক হতে রাজি।’

তিথি খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলল – ‘ধন্যবাদ। জানতাম তুমি কথাটা রাখবে। এখন থেকে বিয়ের আগে ছেলেমেয়েরা যেমন প্রেম করে আমরাও সেরকম প্রেম করবো।’

হাসিবুর তখনও ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি।সে তিথিকে টেনে বুকে জড়িয়ে নিতে নিতে বলল,
– ‘আচ্ছা ঠিকাছে। কিন্তু এবার তো আমার বুকে এসো। পঁচিশ বছর যাবত এই বুক শুন্য। এবার তুমি ভালোবাসা দিয়ে পূর্ণ করে দাও।’

তিথি হঠাৎ চেঁচিয়ে বলল,

– ‘ছি ছি হাসু। তোমার দেখছি চরিত্র ভালো না। প্রেমের প্রথমদিন কী কেউ এভাবে প্রেমিকাকে জড়িয়ে ধরে?’

হাসিবুরের যেন আসমান ভেঙে মাথায় পড়ে। সে বিস্মিত হয়ে বলল,

– ‘ওমা নিজের বউকে বাসর ঘরে জড়িয়ে ধরলে চরিত্র খারাপ হয়ে যায় নাকি?’

তিথি আরও চড়াও হয়ে বলল,

– ‘তো চরিত্র খারাপ না? বিয়ের আগে আমি ওসব জড়াজড়ি চুমাচুমিতে নেই।’

হাসিবুর এতোক্ষণে পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। তার মেজাজ সাথে সাথে খারাপ হয়ে গেল।

চরম বিরক্তি নিয়ে বলল,

‘তোমার এসব ছেলেমানুষী প্রেম-ভালোবাসার আলাপ বাদ দাও তো তিথি৷’।

ধমক খেয়ে তিথি পাক্কা অভিনেত্রীর মতো কাঁদতে শুরু করেছে।

– ‘আরে কান্নাকাটি করছো কেন? কেউ শুনলে কী ভাববে?’

তিথি আরও উচ্চস্বরে বলল,

– ‘যার যা ইচ্ছে ভাবুক। তুমি কীভাবে আমার প্রেম-ভালোবাসাকে ছেলেমানুষী বললা? এই কী সাচ্চা প্রেমিকের ধরন! আমার স্বপ্নের প্রেমিক তো এমন ছিলো না।’

হাসিবুর হাতজোড় করে বলল,

‘প্লিজ কান্না থামাও আর একটু আস্তে কথা বল।’

তিথি কান্না থামিয়ে বলল,

‘তাহলে আলাদা বিছানা করে নাও। বিয়ের আগে কী প্রেমিক-প্রেমিকা একসাথ থাকে বল?’

হাসিবুর কোনো কথা না বলে করুণ মুখে তিথির দিকে তাকিয়ে রইল।
তিথি খিলখিল করে হাসতে শুরু করে। তারপর চোখে খানিক জল। হাসিবুরকে জড়িয়ে ধরতে যেতেই তিথিরের ঘুম ভেঙে গেল। এতোক্ষণ স্বপ্ন দেখেছিল। বাসর ঘরে হাসিবুর নেই। তাকে ডাক্তারে নেয়া হয়েছে। রক্তবমি দেখে সবাই ঘাবড়ে গেছেন। রাত খুব বেশি হয়নি৷ সবেমাত্র বারোটা হয়েছে। হঠাৎ তিথি লক্ষ্য করলো দরজায় কে জানি অনবরত নক করে যাচ্ছে। বোধহয় নক শুনে তার ঘুম ভেঙেছিল। তিথি দরজা খুলে দেখে হাসিবুর হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে।

-‘আরে এলে কখন? আর তোমার শরীর কেমন?’

– ‘আমি পুরোপুরি ঠিক আছি তিথির পাখি।’ বলেই হাসিবুর দরজা বন্ধ করে নেয়। বাসর রাতের এক মুহূর্ত সময় যেন সে নষ্ট করতে চায় না৷ জড়িয়ে ধরে তিথিকে। বৃষ্টির মতো চুমু পড়তে থাকে তিথিরের কপালে গালে ঠোঁটে গলায়..
তিথির ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠে। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে আজমল চাচা। আজমল চাচা হচ্ছেন হাসিবুরের বাবা।
তিথি ফোন রিসিভ করে সালাম দিল।

– ‘হ্যাঁ মা তুমি ফোন দিয়েছিলে রিসিভ করতে পারিনি।’

– ওর কী অবস্থা জানার জন্য কল দিয়েছিলাম চাচা।’

– ‘মা হাসিবুরের কোনো রোগই তো ধরা পড়ছে না৷ রক্তবমি হওয়া যেসব রোগের লক্ষণ ওর সেসব রোগই নেই। হাসিবুরকে নিয়ে চলে আসতেছি মা।’

তিথি বিস্মিত হয়ে গেল। সে তাকিয়ে দেখলো হাসিবুর বিছানায়। অবাক হয়ে বলল,

– ‘বাবা হাসিবুরকে নিয়ে আসছো মানে? সে কোথায়?’

– ‘মা এইতো আমাদের সাথে আছে। ফোনে কথা বলবে নাকি? আচ্ছা হাসিবুরকে বলছি কল দিতে।’

ফোন রেখে দিলো তিথি। ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম৷ খানিক বাদেই হাসিবুরের নাম্বার থেকে কল এলো। অথচ বিছানায় দেখা যাচ্ছে হাসিমুখে হাসিবুর তার দিকে তাকিয়ে আছে।

…চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here