#বসন্তের_রঙ_লাল 04,05
#ফাতেমা_তুজ
#part_4
(৭)
কাপ্তাই লেক এর পাশ দিয়ে যাচ্ছে তবে সে স্থানে সময় অতিবাহিত করতে পারছে না ঝিল। এর থেকে দুঃখের বিষয় আর কিই বা হতে পারে। অভিনবর সাথে কোন মতলবে দেখা করালেন সৃষ্টিকর্তা কে জানে। পাশা পাশি বসে থাকলে ও ঝিলের দিকে তাকাচ্ছে না অভিনব। বিষয় টা বেশ বাজে ভাবে ঝিল কে প্রভাবিত করছে। চোখ মুখ কেমন লাল হয়ে যাচ্ছে। বোধহয় রাগ হচ্ছে খুব। জানালায় চোখ থাকলে ও আড়চোখে ঝিলের অবস্থান নির্ণয় করে নিলো অভিনব। আপাততো মেয়ে টা কে রাগানো ঠিক হবে না। তাই বলল
” কোনো ভাবে ডিস্টার্ব হচ্ছেন মিস ঝিল?”
” উহু। ”
” জানালার পাশে বসবেন? ”
” না। ”
” কাপ্তাই হ্রদ দেখবেন? ”
কাপ্তাই লেক এর কথা শুনে পূর্ণ দৃষ্টি ফেলে তাকালো ঝিল। অভিনব শ্বাস টেনে বলল
” অন্য এক সময় যাবেন। আজকে আমরা ঢাকা তে তথা শাহবাগে ব্যাক করছি। ”
” এমন তো কথা ছিলো না অভিনব। আপনি বলেছিলেন আমাকে নিয়ে লালবাগ কেল্লা ঘুরিয়ে নিয়ে আসবেন। ”
” কাল তো বসন্ত উৎসব। আমরা ঢাকা তে বসন্ত উৎসব শেষ করে তারপর না হয় লালবাগ যাবো। ”
” রিয়্যালি আমাকে নিয়ে যাবেন বসন্ত উৎসবে? ”
” হ্যাঁ যাবো তো। ”
উত্তেজনায় আপ্লুত হয়ে গেছে ঝিল। এক হাত আরেক হাতে মুঠো বন্দী করছে তো আবার ছেড়ে দিচ্ছে। অভিনব সে দিকে তাকালো না বেশিক্ষণ। সে ফোন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করেছে।
সকাল আট টা বাজতেই একটা খুপরির সামনে বাস দাঁড় করানো হলো। বাসের হেল্পার বাসের গাঁয়ে চাপর মেরে মেরে বলছেন যাঁর যা যা কাজ আছে তা যেন এই ব্রেক টাইমে সম্পূর্ন করে আসে। কারন লাঞ্চ এর আগে আর বাস থামানো হবে না। ব্যাগ রেখে নামছিলো ঝিল।অভিনব বাঁধা দিয়ে বলল
” ব্যাগ সাথে করে নিয়ে আসুন। রাস্তা ঘাট কিংবা পরিবেশ কোনো টাই ভালো নয়। ”
ভদ্র মেয়ের মতো মাথা ঝাঁকিয়ে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে নেমে আসলো ঝিল। কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ওর থেকে এক হাত আগে হাঁটছে ঝিল। অভিনবর খেয়াল হলো নিউইয়র্কের স্কুল পড়ুয়া মেয়ে গুলো ঝিলের মতোই ব্যাগ নিয়ে হাঁটে। পার্থক্য ঝিল লং কুর্তি পরে আছে আর বিদেশিনী রা পরে শার্ট আর শর্ট স্কার্ট। এই যা সাদৃশ্য।
একটা টেবেলি এসে বসলো ঝিল। একটা ছেলে এসে টেবিল পরিষ্কার করে দিলো। মেনু কার্ড টা হাতে বাঁধাই করা।একটু নারিয়ে চারিয়ে দেখলো কয়েক রকমের খাবারের লিস্ট। আতিথেয়তা সম্পর্কে বেশ ভালোই জানে অভিনব। তাই কার্ড টা ঝিলের দিকে এগিয়ে দিলো। আমতা আমতা করে ঝিল বলল
” আপনি অর্ডার করুন না। ”
” উহু আপনি করুন। ইটস মাই রেসপনসিবিলিটি। ”
” ওয়েল। তাহলে ট্রিট দিচ্ছেন আমাকে? ”
” হুম ধরে নিন। ”
” ওকে ওকে। আমি আবার ট্রিট মিস করি না। ”
মেনু কার্ড টা ভালো করে পরলো ঝিল। তেমন আহামরি কিছু নাস্তা নেই। পরোটা আর তরকারি দিতে বললো সে। অভিনব নিজের জন্য রুটি, ভাজি আর ডিম সিদ্ধ নিলো। খাবার মোটামুটি ভালোই ছিলো। অভিনব রিসার্চ করে জেনেছিলো রাঙামাটি জেলার কমলা খুব ভালো হয়। তাই দুই গ্লাস কমলার রস নিয়ে নিলো। ঝিলের পেট ভরা দেখে অভিনব বোতলে নিয়ে নিলো সেটা। এতো টা রাস্তা, খারাপ লাগলে না হয় ফলের রস খাওয়া যাবে।
বাসে চেপে বসেছে অনেক টা সময়। বাসের ড্রাইভার কি যেন ভেজাল বাঁধিয়ে দিয়েছেন। অভিনব যেতে নিলেই ঝিল বলল
” যাবেন না প্লিজ। ”
মেয়েটার চোখে মুখে ভয়, আর আতঙ্ক ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ছেলেটা ঠোঁটের কোন প্রশস্ত করে আশ্বস্ত করে দিলো সে যাবে না। ঝিল তবুও ক্ষান্ত হলো না। অভিনবর পিছু পিছু বাস থেকে নামলো। মহা ভেজালে পরলো ছেলেটা। তাই সরাসরিই বলল
” আমি আসলে একটা পার্সোনাল কল করবো। যদি একটু সরে দাঁড়াতেন। ”
লজ্জা পেয়ে দূরে এসে দাঁড়ালো মেয়েটি। তবে মনের ভেতর কেমন খচখচ করছে। আচ্ছা অভিনব কি প্রেমের সম্পর্কে আবদ্ধ?
ভাবতে ভাবতে একটা গাছের সাথে মাথা ঠুকে গেল। মেজাজ টা চরম খারাপ হতে শুরু করেছে। অভিনব যদি ও বা প্রেমে জড়িয়ে থাকে তাতেই বা ওর কি?
ছেলেটা স্বপ্ন পুরুষ হলে ও সে তো স্বপ্নেই থেকে যাবে তাই না। এটাই তো নীতি। হতাশার শ্বাস ফেললো কয়েক বার। আকাশ টা কুয়াশায় ডুবে আছে। আজ বাদে কাল বসন্ত অথচ দেখো কুয়াশার চাদর প্রকৃতির গাঁয়ে এখনো লেপ্টে আছে।
বাসের হেল্পারের ডাকে অভিনব কথা শেষ করলো দ্রুত। আশে পাশে তাকিয়ে দেখলো বেশ অনেক টা দূরে দাঁড়িয়ে ঝিল। দ্রুত পায়ে সেখানে উপস্থিত হলো সে। মেয়েটির ভাবনা দেখে গোল গোল করে তাকালো। কেমন ঠোঁট কামড়ে ডুবে যায় ঘোরে। অদ্ভুত লাগে খুব। ভীষণ অদ্ভুত তো মেয়েটি।
” আজ কে রাঙামাটি তেই থেকে যাওয়ার প্ল্যান করেছেন ঝিল? ”
ফিস ফিস কন্ঠ হঠাৎ কর্নপাত হওয়ায় আঁতকে উঠলো মেয়েটি।অতিরিক্ত চমকায়িত হয়েছে সে। তাই বুকে থু থু দিয়ে প্রচলিত পদ্ধতিতে এক থেকে দশ অব্দি গুনে হালকা হাতে চাপরে নিলো। বিষয় টা পুরোই মাথার উপর দিয়ে নেমে গেল ছেলেটার। মেকি হাসি ঝুলিয়ে ঝিল বলল
” হ্যাঁ হ্যাঁ চলুন। ”
বাসে এসে বসলো ঝিল। অভিনব আরেক পলক তাকালো চারপাশে। প্রকৃতির প্রতি টা সৌন্দর্য বিমোহিত করে ওকে। প্ল্যান অনুযায়ী সাজেক ভ্যালি ঘোরার কথা ছিলো। অথচ পথিমধ্যে মেয়ে টি এসে পরলো। আর এখন কতো কিই না করতে হচ্ছে ওর। ভাবতে ভাবতে হেল্পার আবারো হাক ছেড়ে ডাক জুড়লেন। নেহাত ই বিদেশী দের মতো দেখতে অভিনব। না হলে আচ্ছা করে বকে দিতো হেল্পার ছোকরা টা।
(৮)
পা খুরিয়ে খুরিয়ে হাঁটছে ফারাবি। ভালোই আঘাত লেগেছে পায়ের আঙুলে। তবু ও হেঁটে চলেছে অনড়গল। মনে মনে শ খানেক গালি প্রদান করছে সেই ভয়ঙ্কর মানব কে। না আর সহ্য করা যায় না। এমন ভাব দেখায় যেন বিয়ে করা বউ। স্থির করলো ফারাবি। যে কোনো কিছুর মূল্যে সে যাবেই যাবেই। বাড়ির পাশেই বসন্ত মেলা অথচ যাবে না সে?
ফাহমিদা শাড়ি ভাঁজ করছেন। খুরিয়ে খুরিয়ে সেখানে উপস্থিত হলো ফারাবি। ফাহমিদা দেখে ও না দেখার ভান করে রইলেন। কষ্ট পেল ফারাবি। ঐ ভয়ঙ্কর মানব মা নামক মানুষ টি কে ও হাত করে নিয়েছে।
দরজার কাছে এসে আবার ফিরে এলো সে। ফাহমিদার কাপড় গুলো তে শুয়ে পরলো অকপটে। ফাহমিদার কোনো হেল দোল নেই। ফারাবি এবার রুষ্ট গলায় বলল
” তুমি কি আমাকে বুঝো না আম্মু? ”
” বোঝার তো কিছু নেই। ফারহান নিশ্চয়ই ভালো বুঝেই যেতে বারণ করেছে? ”
” হুম ভালো বুঝেন ওনি? সবর্দা এমন করে আমার সাথে। আমি কাউ কে বোঝাতে ও পারছি না। ”
” দেখ আমি এসবের মাঝে নেই। তোর আব্বু কে যা বলার বল। ”
” হুম বলবো, আব্বু কেই বলবো। ঐ ভয়ঙ্কর মানব তোমাকে ও হাত করে নিয়েছেন। জানি না কবে আব্বু কে ও হাতে নিয়ে নেন। ফোনে বললে তো কিছুই বুঝবে না আব্বু। ধ্যাত বলবোই না আমি। ”
মেয়ের দিকে তাকিয়ে আবার কাজে মনোযোগ হলেন ফাহমিদা। এই মেয়ে টা কে বোঝা বড্ড মুশকিল।একেক সময় একেক মতামত জুড়ে দেয়। নিজের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ ই নেই।
ছাঁদ থেকে বসন্ত উৎসবের জন্য সাজানো স্কুলের মাঠ টা দেখা যায়। ফারাবি সেই দিকেই তাকিয়ে আছে। কি হবে বাড়ির পাশের মেলায় একটু আনন্দ উল্লাস করলে। ওর ভাবনার মাঝেই চিলেকোঠা দিয়ে ছাঁদে প্রবেশ করে রিফাত। কানে ফোন গুঁজে দিয়ে কথা বলছে। কখনো হাসছে তো কখনো বাংলার পাঁচের মতো করে নিচ্ছে মুখ। ফারাবি যেন আশার আলো খুঁজে পেল। রিফাতের সাথে গেলে নিশ্চয়ই বাঁধা নেই?
রিফাত যে দিকে যাচ্ছে ফারাবি ও পেছন পেছন সে দিকে যাচ্ছে। একই ভঙ্গিমা করে হাঁটছে ওহ। কথার মাঝে কেউ এমন অনুসরণ করলে বিরক্ত হওয়ার ই কথা। রিফাত কল কেঁটে দিয়ে বলল
” কি হয়েছে? এমন পাগলের মতো ঘুরছিস কেন? ”
” বসন্ত উৎসবে যাবো ভাইয়া। ”
” হুম তো যা। বারণ করেছে কে? ”
” যেতে দিচ্ছে না তো। ”
” কে যেতে দিচ্ছে না? ”
” তোমার জল্লাদ বন্ধু। ”
” ফারহান বারণ করেছে? ”
ফারাবি মাথা কাঁত করে বলল
” হুম।সে বলেছে আমি যেন এক পা ও বাহিরে না যাই। আর কাউ কে না ও বলি সে বারণ করেছে। যদি ও বা বলা না বলাতে যায় আসে না তাঁর । প্লিজ ভাইয়া আমি যাবো। ”
” একদম ই নয়। ফারহান যেহেতু বলেছে তো ভেবেই বলেছে। কোনো প্রয়োজন নেই আমি না হয় তোকে মেলা থেকে পাপর ভাজা এনে দিবো। ”
মানুষের মন ও বুঝি ফুটো বেলুনের মতো চুপসে যায়? এই যে ফারাবির ছোট্ট মন টা চুপসে গেল কেমন করে। সকলে ফারহান ভাই কেই কেন এতো মান্য করে। কি আসে ঐ মানবের মাঝে। ফারাবি তো ভয়ঙ্কর রাগ মিশ্রিত চাহনি আর জোড় খাটানো ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না ওনার মাঝে। এখন এক মাত্র ভরসা বড় আব্বু।
ফারাবি কে দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারছে ফারহান মেয়ে টি উচ্ছন্নে চলে যাচ্ছে। আরো শাসন করতে হবে। হাজার খানেক ব্যস্ততা এসে চেপে না ধরলে চরম শাস্তি দিতো মেয়ে টি কে। আপাততো সময় নেই একদম। ফারাবির বাসার ছাঁদ থেকে চোখ নামিয়ে গাড়ি নিয়ে বের হলো ফারহান। মানসলোকে কিছু তেই শান্তি পাচ্ছে না সে। তাই ফোন করলো রায়হান কে।
” শোন আমার কাছে এতো সময় নেই এক্সপ্লেইন করার মতো। শুধু ফারাবির উপর নজর রাখবি। বাসা থেকে বের হয়ে কোন কোন জায়গায় যাচ্ছে সব টা আমার ইনফর্মেশন চাই। ”
” আচ্ছা ভাই। ”
ফোন রেখে ও শিথিল হতে পারলো না ফারহান। যতো এগুচ্ছে ঠিক ততোই মন টা বিক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছে। একদম ই মন টানছে না।
রউফ অফিস থেকে ফিরেছেন মাত্র। ওনার জন্য ই অপেক্ষা করছিলো ফারাবি। দ্রুত গতিতে কিচেন থেকে পানি নিয়ে এসে সামনে দাঁড়ালো। রউফ পানি পান করে বললেন
” কিছু বলবে মামুনি? ”
” জী বড় আব্বু। ”
” তো বলো। এতো টা চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন? ”
” আসলে বড় আব্বু আমি বসন্ত উৎসবে যেতে চাই। ”
” হ্যাঁ তো যাবে। না যাওয়ার কি আছে? ”
ফারাবির মুখ হা হয়ে আছে। রউফ একটু পর বললেন
” ফারহান কি বারণ করেছে যেতে? ”
গরম ভাতে পানি ঢেলে দিলে যেমন টা অনুভব হবে ঠিক তেমন টাই অনুভব হলো ফারাবির। মলিন আর শুকনো হয়ে গেল মুখ। ঠোঁট দুটো হালকা হালকা নড়ছে। মনে মনে ফারহান কে তেলে ভেজে ফেলেছে যেন। ফারাবির মাথায় হাত রেখে রউফ বললেন
” বান্ধবীদের সাথেই যেও। একা একা যেও না কেমন? ”
” জী বড় আব্বু। ”
ক্লান্ত ভঙ্গি তে কাউচ থেকে উঠে চলে গেলেন রউফ। ফারাবির মনে শত প্রজাপতি ডানা ঝাপটা দিচ্ছে। খুশি তে ম’রেই যেতে ইচ্ছে করছে।
রিমি এসে ধাক্কা দিলো ফারাবি কে। ফারাবি ভ্রু নাচিয়ে বলল
” কি ভেবেছে তোর ভাই? আমার সাথে অত্যাচার চলবে না। বলে দিস ঐ শয়তান মানব কে। ফারাবি ভয় পায় না ওনাকে। ”
” তোর মাথা ঠিক আছে? ”
” ক্যান আমি আবার কি করলাম তোরে? ”
” ভাইয়া জানলে তুই শেষ। ”
” তুই আর তোর ভাই দুজন ই জঘন্য। এখন সর তো। ”
রিমি কে ঠেলে বাইরে চলে এলো ফারাবি। গালে হাত দিয়ে বসে রইলো রিমি। কে জানে কি আছে এই মেয়ের কপালে।
চলবে
#বসন্তের_রঙ_লাল
#ফাতেমা_তুজ
#part_5
(৯)
লাঞ্চ করার ফুসরত অব্দি নেই। মাত্র পনেরো মিনিট সময় দিয়েছে লাঞ্চ করার জন্য। বাসের ড্রাইভার একজন রগচটা ব্যক্তি তা সবাই বুঝে গেছে। নেহাত ই এই বাস দিয়ে ঢাকায় ফিরবে অভিনব। না হলে বাসের ড্রাইভারের সাথে হিসেব চুকিয়ে দিতো একদম। খাবারের প্যাকেট নিয়ে ছুটে এলো বাসে। ফর্সা মুখে লাল লাল ছোপ এসে গেছে। হয়তো আবহাওয়া টা ঠিক ঠাক মানাতে পারছে না শরীর। ঝিলের বেশ মায়া হয়। কখনো কল্পনা তে ও আসে নি অভিনবর সাথে দেখা হবে। মানুষ টা পাশে বসে আছে ভাবতেই গাঁয়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। শরীরের প্রতি টা লোমকূপ জেগে উঠে বলে এটা নিশ্চয়ই তোর ভ্রম। অভিনব খেয়ে চলেছে। বেশ ক্ষিদে পেয়েছে ওর। ঝিলের ইচ্ছে হলো না খেতে। সমস্ত ধ্যান দিয়ে দিলো অভিনবর পানে। ছেলেটার প্রতি টা শিরা গুনে ফেলবে যেন। আহা মানুষ এতো সুন্দর হয় বুঝি?
পাশেই বাসের ঝাঁকুনি খেয়ে এক লোক ভেতর থেকে সব উগরে ফেললেন। খুব সম্ভবত পনেরো মিনিটে গ্রোগাসে খাবার গিলেছেন তিনি। কেউ কেউ নাক কুঁচকে রইলো। এটা অস্বাভাবিক কিংবা দৃষ্টিকটু নয়।সবাই তো সব টা সহ্য করতে পারে না। সকলের মধ্য থেকে অভিনব উঠে গিয়ে লোক টার হাতে পানির বোতল এগিয়ে দিলো। যাঁর ফলে ঝিল চরম অবাক হলো। এমন একজন অসাধারন মানুষ এতো টা মিশুক হয় বুঝি? ঝিলের প্রশ্নবিদ্ধ মুখ দেখে অভিনব ক্ষীণ হাসছে। ঝিল ওপাশ ফিরে রইলো। কারো বমি দেখলে ওর ওহ বমি আসে। বেশ কিছু টা সময় অতিবাহিত হওয়াতে অভিনব বলল
” ঔষধ টা নিন। এটা খেয়ে নিলে আই থিংক আর প্রবলেম হবে না। ”
ঝিল বমি করে দিবে এমন অবস্থা। মেয়েটার পিঠে হালকা করে হাত বুলিয়ে দিলো অভিনব। প্রথমে সে স্পর্শ অনুভব না করলে ও পরে অনুভব করলো মেয়েটা। ভেতর টা কেমন অস্থির হয়ে গেছে। অন্যদিকে অভিনব খুব ই স্বাভাবিক। সে পানি আর ঔষধ দিয়ে ফোনে মগ্ন হলো আবার। ঔষধ খেয়ে সিটে হেলান দিয়ে দিলো ঝিল। উহু ভালো লাগছে না তাঁর। মনে হচ্ছে প্রাণ টা ঝলসে যাচ্ছে। এতো টা বাজে অনুভব হচ্ছে যে বসে ও থাকতে পারছে না। থেকে থেকে তাকাচ্ছিল অভিনব। মেয়েটার অবস্থা আশঙ্কাজনক দেখে জানালার সিটে বসিয়ে দিলো। হালকা হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
” চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করুন। আমি আপনার পাশেই থাকছি। ”
ঝিল ঘুমানোর চেষ্টা করলো। তবে খুব কষ্ট হচ্ছে ওর। ভেতর টা কেমন তেঁতো তেঁতো লাগছে। বিকেলের দিকে বাস এসে থামলো সায়েদাবাদ বাস স্টপ এ। একে একে নেমে যাচ্ছে সবাই। ঝিল আর অভিনব বসেছে বাসের মাঝের সিটে। ওদের পেছনে থাকা যাত্রী ও নেমে গেছে। এবার স্থির কন্ঠে ঝিল কে ডাকলো অভিনব। চোখ হালকা খুলে অভিনবর মুখ টা দেখতে পেয়ে কিছু টা চমকায়িত হলো। দ্রুত উঠে গিয়ে ব্যাগ কাঁধে নিলো সে। ওর আচারন ঠিক ঠাক অনুধাবন হলো না। অভিনব ও ব্যাগ কাঁধে নিলো। বাস থেকে নেমে যাওয়ার পূর্বে বলল
” সব কিছু দেখে নিয়ে আসুন। ”
সায়েদাবাদ বাস স্টপ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরত্ব মোটামুটি পাঁচ কিলোমিটার। অভিনব ফোনে লোকেশন সার্চ করে দেখে নিলো সব টা। বস্তুত দিক খোঁজাখুঁজি তে সমস্যা হচ্ছে কিছু টা। পূর্বে এই স্থানে আসা হলে হয়তো আরো দ্রুত ও সহজতর রাস্তা দিয়ে আগাতে পারতো। তবে এখন এই স্মার্ট ফোন ই ভরসা।
আশে পাশে চোখ বুলালে ও ঝিলের পূর্ণ মনোযোগ রয়েছে অভিনবর দিকে। ওর দুই চোখ বার বার স্মার্ট ফোনের স্ক্রিনে তাকানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে এই লম্বা দেহের বিদেশী মানবের হাত টা ওর মাথার ও কিছু টা উপরে। এক টা বদ অভ্যাস রয়েছে ওর। অধিক চিন্তায় চিন্তিত হলে নিজের অজান্তেই আঙুল চলে যায় মুখে। আর নখ কামড়াতে থাকে। অভিনব ফোনের কার্যক্রম শেষ করে তাকাতেই সেটা লক্ষ্য করলো। নখ কামড়ানো টা খুব ই বাজে লাগে অভিনবর। সেই কারনে কপালের মাঝে ভাজের সৃষ্টি হয়ে গেছে। ইচ্ছে করছে বেশ কড়া কথা শুনিয়ে দিতে। তবে এই স্থানে দাঁড়িয়ে সেটা সম্ভব নয়। পরিকল্পনা মাফিক কাজ করতে হবে তাকে। না হলে ঝিল তাঁর কথার অগ্রাহ্য করবে নিশ্চিত। কারন মেয়ে মানুষের মন অত্যন্ত আবেগি হয়। এরা সব সময় নিজেকে কঠোর দেখাতে চায় ঠিক ই তবে একটু শাসন বারণ কিংবা হালকা আদরেই নেতিয়ে যায়।
বেশ ক্ষিদে পেয়েছে ঝিলের। মন টা ও খাবারের জন্য আনচান করছে। লাঞ্চ এ ঠিক ঠাক খাওয়া হয় নি। তবে এখন সমস্যা হচ্ছে অভিনব কে বলতে কেমন লজ্জা লাগছে। এক পা এগোচ্ছে তো আরেক পা পিছিয়ে যাচ্ছে। ঠোঁট টা নড়ে ও নড়ছে না। স্বরনালি যেন বন্ধ হয়ে আছে। কি একটা জ্বালাতন। অভিনব আবার ফোনে মজেছে। গভীর মনোযোগে কথা বলছে। রাগ আর ক্ষোভে ক্ষুব্ধ হচ্ছে ঝিল। কোনো কিছু না ভেবেই রাস্তা পারাপার হতে যায়। তৎক্ষনাৎ একটা ট্রাক এসে পরে। অভিনবর চোখ দুটো ফোন থেকে সরে যায় রাস্তায়। কেবলি চিৎকার করে উঠে
” ঝিল সরে যান। ”
চিৎকারের শব্দে পেছনে তাকায় ঝিল। তবে বুঝতে পারে না কি হতে চলেছে। কয়েক সেকেন্ড এর ব্যবধানে ট্রাক এসে থামে ঝিলের বরাবর। বেশ জোরালো ব্রেক কষেছেন ড্রাইভার। তবে ঝিলের শরীর কাঁপছে। অভিনব ছুটে এসে রোড থেকে নামিয়ে নিলো তাঁকে। রাস্তায় জনসমাগম কম ছিলো। তবু ও কিছু কিছু মানুষ এসে জট বাধাচ্ছে। অভিনব হাতে ইশারা দিয়ে বলল
” সী ইজ ফাইন। আপনারা যেতে পারেন।”
ধীরে ধীরে সবাই চলে গেল। মেয়েটার চোখ মুখে অন্ধকার এসে নেমেছে। অভিনবর বাহু ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো। ঠিক যেন পাঁচ বছরের বাচ্চা। এমন ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে সে। তেরো বছর পূর্বে এমন নির্মম এক দৃশ্য দেখেছে। ঘাড়ে সুচের মতো কি যেন লাগলো। অসম্ভব কাঁপুনি দিয়ে নিস্তেজ হয়ে গেল ঝিলের শরীর। অভিনব শিরা পরীক্ষা করে বুঝলো জ্ঞান হারিয়েছে। আপাততো রেস্ট এর প্রয়োজন। ঝিলের মাথা টা বুকে চেপে ধরে কাউ কে ফোন করলো। পাঁচ মিনিটের মাথায় একটা গাড়ি এসে থামলো। ইশারায় দরজা খুলতে বললো সে। লোক টা দরজা খুলে দিলেই ঝিল কে নিয়ে উঠে বসলো সে। পানির বোতল থেকে পানি পান করে বলল
” লোকেশন কালেক্ট করে দ্রুত সেখানে যান। ”
” ইয়েস স্যার। ”
কপালের বেবি হেয়ার গুলো নাকে মুখে এসে বিরক্ত করছে খুব। ঝিল অচেতন থাকায় সেটা অনুভব করছে না তবে অভিনব করছে বেশ। খুব সূক্ষ্ম ভাবে চুল গুলো গুছিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। ভাগ্যিস ঠিক ঠিক ব্রেক কষেছিলেন ড্রাইভার। তবে ভয় পেয়ে জ্ঞান হারালো নাকি ইনজেকশন পুস করাতে তা ঠিক ঠাওর হচ্ছে না।
সে যাই হোক তৎক্ষনাৎ তো জ্ঞান হারিয়েছে। আর এখন কাজ টা বেশ সহজ ও হয়ে গেছে। ভয় পেয়ে জ্ঞান হারালে ও ইনজেকশন এর প্রভাবে দুই ঘন্টা জ্ঞান আসবে না। আর এর মাঝেই কাজ হয়ে যাবে।বুক ভরে স্বস্তির শ্বাস নিয়ে জানালা দিয়ে চোখ গলিয়ে দিলো অভিনব। এই প্রকৃতি এক বার নয় বার বার বিমোহিত করে ওকে।
(১০)
হাতে মেহেদি দিচ্ছে ফারাবি। মোট কথা বসন্ত উৎসবের সাজ সজ্জা আজ থেকেই শুরু করেছে সে। বাতাসে ফুলের গন্ধ ম ম করছে। নানান আয়োজনের হট্টগোল আওয়াজের ধ্বনি শোনা যায়। প্রিয় প্রকৃতি সেজে উঠেছে নতুন রূপে নতুন সাজ সজ্জায়। নতুন রূপে নতুনত্ব ছড়িয়ে দিবে এই ধরায়। ফারহান না থাকাতে বেশ আরাম করে বসেছে ফারাবি। ভয়ঙ্কর মানব থাকলে এ বাসা তে ওর টিকি টা ও দেখা যায় না। তাই মনে মনে রিমি তাঁর ভাই কে গালি প্রদান করলো। চপ আর মুড়ি রেখে বসলো পাশে। মেয়েটা বেশ ভালো অঙ্কন শিল্প রপ্ত করেছে।
” আমাকে খাইয়ে দে না বাবু। ”
” ওল্লে আসছে আমার প্রেয়সী। ”
” হু আমি তো তোর প্রেয়সীই তাই না? ”
” হয়, আমার ভাইয়ের প্রেয়সী যেহেতু সেহেতু আমার ও প্রেয়সী। ”
” মজা করিস না তো। তোর ভাই কে আমার জঘন্য লাগে। ”
” কেন রে আমার ভাই কি সুন্দর না? ”
” না। একদম ই সুন্দর নন তিনি। প্রচন্ড ভয়ঙ্কর আর খবিশ লোক। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে মাথা ফাটিয়ে দিতে। ”
হতাশ হলো রিমি। এই যে তাঁর ভবিষ্যত ভাই পত্নীর মুখে ভাইয়ের নামে বদনাম। অথচ পৃথিবী উল্টিয়ে গেলে ও ফারাবি কেই বিয়ে করবে ফারহান।
রিমির মাথায় চাপর দিলো ফারাবি। কিছু টা ভয় পেয়ে গেছে রিমি। চোখ দুটো আবার চিন্তিত হলো।
” তুই কি ভাবছিস বল তো? ”
” তোর কথা। ”
” আমার কথা। ”
” হু।”
” তো কি ভাবা হচ্ছে? ”
” এই যে আমার ভাই পৃথিবী উল্টে গেলে ও তোকে বিয়ে করবে। ”
ফারাবির মুখে কালো মেঘ এসে ভর করলো। এ বিষয় টা মাঝে মাঝে আসে ওর ভাবনা তে। তখনি বুক চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস আর হতাশা। এভাবে এক টা মানুষ কি করে বাঁচতে পারে?
মনিকা এসে থেকে মুখে মেকআপ লাগাতে ব্যস্ত। মেয়েটা বড্ড চঞ্চল আর মিশুক ধাঁচের। এই যে এখনো বিয়ে হয় নি তবু ও হবু শশুর বাড়ি তে এসে পরেছে বিনা টিকিটে। রিফাত দাঁত কিড়মিড় করছে। কেন যে এই মাথা নষ্ট মেয়ে টা কে ভালোবাসতে গেল।
” রিফাত এ দিকো আসো প্লিজ। ”
” কি হয়েছে? ”
” লুক। আমাকে কেমন লাগছে? ”
” পুরাই পেত্নি। ”
” কি বললে? ”
” মজা করছিলাম। তোমাকে তো অলোয়েজ সুন্দর লাগে। ”
গর্ববোধ হলো মনিকার। নিজেকে ঠিক ঠাক করতে আবার ব্যস্ত হলো। ওদের মাঝে এসে যোগ দিলো ফারাবি। মনিকা কে সাইট করে হাত ধুতে লাগলো। মনিকার কপালে বিরক্তির ছায়া। সামান্য ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল
” এই তোর কোনো কান্ড জ্ঞান নেই? দেখছিস না আমি চুল ঠিক করছি। ”
” স্যরি স্যরি গো। আসলে আমার মেহেদি ঘেটে ঘ হয়ে গেছে। ”
” কি করে? ”
” এমনি। ”
হাত ধুয়ে চলে গেল ফারাবি। মূলত কিছু লুকাচ্ছিলো সে। যা আন্দাজ হলো মনিকার। রিফাতের দিকে ভ্রু কুটি করে তাকিয়ে বলল
” তোমার বোনের মত্তলব কি বলো তো? ”
” আর যাই হোক তোমার থেকে ভালো। ”
কথা শেষ করেই হনহনিয়ে চলে গেল রিফাত। রাগে ফেটে যাচ্ছে মনিকা। এই প্রেমিক নামক পুরুষ সর্বদা এমন করে তাঁর সাথে।
ঘরে এসে বালিশে মুখ গুঁজে দিলো ফারাবি। বুকের ভেতর এখনো ধিম ধিম আওয়াজ করছে। ঐ ভয়ঙ্কর মানব নিশ্চিত মে’রেই ফেলবে ওকে। কি দরকার ছিলো এভাবে ফোন করার।
রিমিদের বাসা থেকে চলে আসতেই ওর ফোনে আননোন নাম্বার থেকে কল আসে। ফারহানের নাম্বার চুপিসাড়ে ব্লক লিস্টে ফেলে রেখেছে সে। তাই সেই ভয়ঙ্কর মানবের ভয় নেই। ফোন রিসিভ হতেই ফারহানের রুষ্ট কন্ঠ
” এই রোদ্দুরে আর এক মুহূর্ত ছাঁদে দাঁড়িয়ে থাকলে সোজা ফেলে দিবো ছাঁদ থেকে। ”
ফারাবি নিজ কান কে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। তাই তৎক্ষনাৎ বলল
” কে রে আপনি। ঐ ফারহান শয়তানের গলা নকল করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। ”
” থাপ’রিয়ে দাঁত ফেলে দিবো। ”
এবার সত্যিই ভরকে যায় ফারাবি। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল
” কে, কে আপনি। ”
” একটু আগে যাকে শয়তান বললি আমি সে। ”
কথা টা শুনেই হাত থেকে ফোন টা পরে যায়। আর ধরার চেষ্টা করতেই দেয়ালে হাত লেগে মেখে যায় মেহেদি।
ফারাবি হাতের দিকে তাকালো। এক পাশে নিজের প্রিয় ট্রাভেলার্স এর নাম লিখেছিলো সে। এখন সেটা পুরাই ঘ হয়ে গেছে। ভীষন কান্না পাচ্ছে ওর। অভিনব নামের অ লেপ্টে গেছে। সব ঐ ভয়ঙ্কর মানবের দোষ। কিছুতেই ঐ অসভ্য লোক টা কে বিয়ে করবে না ফারাবি।
** রহস্যময় অভিনব। আর ফারাবি ও বিদেশীর উপর ক্রাশ। লাগলো রে ভেজাল। **
চলবে