বসন্তের_রঙ_লাল 06,07

0
406

#বসন্তের_রঙ_লাল 06,07
#ফাতেমা_তুজ
#part_6

(১১)
” বয়সে কিংবা ভারসিটির ক্লাস অনুযায়ী তুমি আমার এক বছরের ছোট হও মাহিন। সেই কারনে তুমি বলে সম্বোধন করলাম। কোনো সমস্যা নেই তো? ”

মাহিন হালকা হাসলো। অভিনবর আচার আচারণ চাহনি কিংবা লাইফস্টাইল সব কিছুই এতো টাই সুমিষ্ট যে তা ভাষায় প্রকাশ করা দুষ্কর। দুজনেই গাড়ি তে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সন্ধ্যা পেরিয়ে এখন মধ্য রাতের কাছাকাছি হতে চললো। গগনে শতেক তারার মেলা। চারপাশে ঘুটঘুটে আঁধার ও রয়েছে। প্রায় পাঁচ ঘন্টা হয়ে গেছে। অথচ ঝিলের জ্ঞান ফিরে নি। মাহিন বড্ড কৃতঙ্গ অভিনবর প্রতি।
” কি যে বলবো অভিনব ভাই। আপনি আমাকে বাঁচালেন। ছোট মানুষ ওরা, বুঝতেই পারছেন। ”

” হ্যাঁ সেই কারনেই ঝিল কে দেখে ইনফর্ম করেছিলাম তোমায়। তাছাড়া তোমার সোশ্যাল মিডিয়ায় হতাশা পোস্ট দেখে ও সন্দেহ হয়েছিলো খুব। তাই টেক্সট করেছিলাম আর জানতে পারলাম এই ঘটনা। যদি ও আমাকে সত্য বলেছেন ঝিল। ”

” থ্যাংকস ভাই। ”

” আরে এতো হাইপার হওয়ার কিছু নেই। তুমি আমার জুনিয়র ব্যাচের ছেলে। যদি ও পরিচয় নেই তেমন। বাট ঐ যে সিনিয়র এর দায়িত্ব পালন করলাম। ”

মাহিনের চোখে মুখে স্বচ্ছতা। টুক টাক আরো কথা হলো ওদের। বাড়ির বড় ছেলে মাহিন। হাজার হোক ছোট আর এক মাত্র বোনের প্রতি বেশ সদয় সে। তবে এই বয়সে এভাবে একা পালিয়ে ভ্রমণ করা অত্যন্ত বিপজ্জনক। তাছাড়া রাজনৈতিক অঙ্গনে কথা টা রটে গেছে। যদি ও প্রমাণ না থাকায় ঝিলের দিকে কেউ আঙুল তোলার সাহস করে নি। তবে প্রমাণ পেলে কেউ ছেড়ে কথা বলবে না। যা ঘটেছে তাঁর থেকে উল্টো মন্তব্য করবে। আমাদের সমাজে একজন ছেলে পালিয়ে ট্রাভেল করলে তাঁকে বাহবা দেওয়া হয় তবে মেয়েদের দেওয়ার হয় কলঙ্ক। অনেক টা সময় হলো তবে ঝিল নিস্তেজ। মাহিন কে চিন্তিত দেখে অভিনব বলল
” চিন্তা করো না। আসলে খুব ক্লান্ত থাকায় মেডিসিন টা বেশিক্ষণ ধরে কাজ করছে। বাট চিন্তার কোনো কারণ নেই। ”

” আচ্ছা ঠিক আছে। অনেক টা সময় তো চলে গেল, ওকে নিয়ে যাই কেমন? ”

” হ্যাঁ অবশ্যই। ”

ঝিল কে কোলে তুলে নিলো মাহিন। মুখ টা শুকনো লাগছে। অভিনব এক পলক তাকিয়ে চোখ নামিয়ে দীর্ঘশ্বাস লুকালো। একটু গিয়ে আবার পেছন ঘুরলো মাহিন।
” ভাই তুমি প্লিজ এক বার বাসায় চলো। জাস্ট ডিনার করে চলে এসো। ”

” সময় নেই মাহিন। ”

” প্লিজ ভাই। ”

অনেক টা জোড়াজোড়ি করলো মাহিন। শেষে অভিনব ওদের সাথে বাসায় প্রবেশ করলো। আহনাফ আর রোহন মুখ কালো করে তাকিয়ে আছে। এই বড় ভাই নামক মানুষটি খুব দ্রুত ওদের চাপকে সোজা করবে।
ইকবাল এগিয়ে এসে বললেন
” মাহিন, ঠিক আছে আমার ঝিল মামুনি? ”

” জী বাবা। ঠিক আছে ওহ, শুধু জ্ঞান হারিয়েছে। ”

” কিন্তু কি করে? ”

” পরে বলবো। এখন ঘরে নিয়ে যাই ওকে। ”

মাহিনের সাথে অভিনব ও গেল। ঝিল কে শুয়ে দিয়ে মাহিন গেল পরিবারের সবাই কে সব টা বোঝাতে। অভিনব ঝিলের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো। পুরোই পাগল মেয়েটা। নিস্তেজ শরীরে বিছানায় গাঁ এলিয়ে আছে কেমন। ওর খুব মায়া হলো। তাই মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো নরম হাতে। চলে যাবার জন্য উঠে দাঁড়াতেই হাতে টান অনুভব হলো। চোখ দুটো না চাইতে ও বন্ধ হয়ে গেল। ক্রন্দনরত ঝিল উঠে বসলো। প্রায় ঘন্টা খানেক আগে জ্ঞান ফিরেছে তাঁর। তবে অভিনবর সাথে মাহিন কে দেখে সব টা খোলা খোলা লাগছিলো। গাড়ি তে বসে থেকে সব টা শুনে নেয় ওহ। অভিনব, যে কি না ওর স্বপ্নপুরুষ সেই মানুষ টা ওকে ঠকালো। বিষয় টা ভাবতেই কান্না পাচ্ছে খুব। ধারালো মস্তিষ্কের অধিকারী অভিনব। চট জলদি সব টা বুঝে গেল সে। এক্সপ্লেইন করার সুযোগ অব্দি পেল না। তাঁর আগেই ঝিল হিচকি তুলে বলল
” এভাবে ঠকালেন আমায়? এভাবে কষ্ট দিলেন। কখনো ভাবতে পারি নি আমার লাইফের প্রথম সম্পূর্ন একা করা ট্রাভেল টা আমার আইডল নিজে এসে ভেঙে দিবেন। আই হেইট ইউ অভিনব আই হেইট ইউ। ”

বাক্য দ্বয় বুকের ভেতর সূক্ষ্ম ব্যথার সূচনা করলো। মাথার সামনে থাকা ঘড়ির কাঁটা গিয়ে ঠেকলো ঠিক বারো টায়। ঝনঝনে শব্দ তুলে জানান দিলো বসন্তের আগমন। চারপাশ থেকে বাজি ফাঁটার শব্দ শোনা যাচ্ছে। কেউ কেউ খুব চেঁচাচ্ছে। কপাল বেয়ে নেমে গেল ঘ্রামের তরল স্রোত। র’ক্ত হীন যেন শরীর। এই বসন্তেই ঝিল কে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ঘুরানোর কথা ছিলো তাঁর। অথচ সে উল্টো পথে হেঁটে সব টা শেষ করে দিয়েছে। করেছে ঝিলের স্বপ্ন ভঙ্গ। অভিনব আর এক সেকেন্ড দেরি না করে বেরিয়ে পরলো সেই স্থান থেকে। মুখে হাত গুঁজে দিয়ে কাঁদছে মেয়েটা। সমস্ত অনুভূতি, আর মনের ভেতরের সুপ্ত প্রেমময় বসন্ত সব কিছু মুহূর্তেই ধুলিসাৎ হয়ে গেল কেমন। লাল বসন্ত হয়ে গেল ধূসর।

( ১২ )

ফারহান এই মুহূর্তে যে স্থানে অবস্থান করছে সেখানে নেটওয়ার্ক নেই। ফোন টা কাজ করছে না অনেকক্ষণ যাবত। ব্যক্তি গত কারনে এখানে এসেছিলো সে। সম্প্রতি বাবার থেকে বেশ অনেক গুলো টাকা ধার হিসেবে নিয়ে বিজনেস শুরু করেছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত এর একটি ইন্ডাস্ট্রির সাথে শেয়ার বিজনেস। কাজ শুরু করার পূর্বেই বাজে ভাবে সার্ভার ডাউন হয়ে গেছে। কিছু টা চিন্তিত হলো সে। কারো সাথে যোগযোগ করা ও যাচ্ছে না। ঐ দিকে ফারাবির খবর নেওয়া ও হচ্ছে না। মেয়েটা বড্ড চঞ্চল প্রকৃতির। মন টা কেমন কু গাইছে। ভেতর টা স্বস্তি পাচ্ছে না একদম ই। অন্তকর্ন জানান দিতে চায় বারং বার। ফারাবি নিশ্চয়ই যে কোনো উপায়ে মেলা তে উপস্থিত হবে।
” হেই মিস্টার ফারহান। আপনি কি কোনো ভাবে চিন্তিত? ”

” নো, নো মিস্টার রায়। আমি একদম ই ঠিক আছি। সার্ভার ঠিক হয়েছে কি? ”

” উম না। প্রাকৃতিক কারনে সার্ভার ডাউন হয়ে গেছে খুভ সম্ভবত। খুব দ্রুত ঠিক হবে বলে আশা করা যায়। ”

” ওহ ওকে। ”

কিছুক্ষণ যেতেই একজন লোক এসে জানালেন কিছু দিন ধরে এই এলাকায় কোনো প্রকার নেটওয়ার্ক নেই। আর সেটা ওদের থেকে লুকানো হয়েছে। রাগে গজগজ করতে লাগলেন মিস্টার রায়। ফারহান খুব স্বাভাবিক আর নম্র কন্ঠে বলল
” আমরা অন্য কোথাও কাজ টা করতে পারি না? ”

” বাট কিছু টা সময় লাগবে যে মিস্টার ফারহান। ”

” সমস্যা নেই। আপনি অন্য স্থান নির্বাচন করুন। ”

মূলত দ্রুত কাজ শেষ করে ফিরতে চাচ্ছে ফারহান। ওর ভেতর টা অস্থির হয়ে আছে। কিছু তেই শান্তি মিলছে না। এ স্থান ত্যাগ না করা অব্দি কোনো খবর ও পাওয়া যাবে না। মনে মনে নানান পরিকল্পনা সাজালো সে। এই নেটওয়ার্ক বিহীন এলাকা থেকে বের হতে পারলেই সমস্ত টার প্রয়োগ চালাবে।

ভ্যালেন্টাইন ডে স্পেশাল ডেকোরেশনে সেজে উঠেছে চারপাশ। কপোত কপোতি রা দলে দলে বেঁধেছে লাল রঙা জুটি। আবার কেউ কেউ বসন্ত উৎসব পালনে মেতে উঠেছে। জানালা দিয়ে সেসব ই দেখছে ফারাবি। ইস কি সুন্দর মনোরম দৃশ্য। প্রান যেন জুড়িয়ে যায়।
” এক গ্লাস পানি দে বোন আমার। ”

বিছানায় শুয়ে কথা টা বললো রিমি। এই মেয়েটা হচ্ছে আরেক ধাপ্পাবাজ। ভাই বোন কেউ ই শান্তি দিচ্ছে না ওকে। মুখের সামনে গ্লাস ধরতেই পানি নিয়ে নিলো রিমি। ঢগ ঢগ করে পান করছে সে। যেন এই পানি টা না পেলে ম’রে যেতো।
” বুঝলি রিমি তোর ভাই না থাকলে পরিবেশ খুব সুন্দর আর মনোরম হয়। ”

” হুম যখন বুঝবি তখন খুঁজবি। ”

” দেখ এসব সো কলড ইমোশনালি কথা বার্তা আমাকে বলে লাভ নেই। আমি তো আমার ক্রাশ দের নিয়েই খুব হ্যাপি।”

আয়না তে নিজে কে দেখছে আর কথা গুলো বলছে ফারাবি।রিমি কিছু বললো না। মন টা ভালো নেই তাঁর। রিলশনের প্রথম বসন্ত, প্রথম ভ্যালেন্টাইন ডে অথচ প্রেমিক পুরুষ টি অন্যত্র পরে আছে। কি হবে এমন পড়াশোনা দিয়ে যদি প্রেমিকার সাথে একটি দিন উদযাপনের সময় সুযোগ না ঘটে!

বাসন্তী রঙা শাড়ি খোঁপায় কাঁচা ফুলের মালা। হাতে মুঠোপূর্ণ চুড়ি। আর কানে ঝুমকো গলা টা খালি। ফারাবির এমন ফর্মাল লুক দেখে চক্ষু চড়কগাছ হলো রিমির। এই সুন্দরী মেয়ে টা কে চিনতে কিছু টা অসুবিধাই হলো। ওর হা হাওয়া মুখের পানে তাকিয়ে বিরক্তি মাখা স্বরে বলল ফারাবি
” এমন হা হয়ে আছিস কেন? আর রেডি হ মেলায় যাবো তো আমরা। ”

” এটা তুই দোস্ত? ”

” আমার ভূত। দেখবি এখন তোর ঘাড় মট’কাবো? ”

” এই না না না আমি তো শুধুই মজা করছিলাম। ”

” হুম এবার রেডি হ। ”

রিমির চোখে কাতরতা। ফারাবি বুঝতে পারে ওর কষ্ট টা। তবু ও সান্ত্বনা দিয়ে বলল
” সেজে গুঁজে রেডি হ ভালো লাগবে। ”

বালিশ বুকে জড়িয়ে বসে রইলো রিমি। চোখের কোনে জমেছে এক আকাশ সমান অশ্রু কনা। ফারাবির মন বিষিয়ে গেল ক্ষণকালেই। হতাশা নিয়ে বেরিয়ে পরলো মেলার উদ্দেশ্য। ঐ ফারহান নামক বদ লোক টা তে দেখিয়ে দিবে ও।

তিন ঘন্টা পর

ফারাবি কে বেঁধে রেখেছে রিক। মেয়েটার প্রতি নজর ছিলো আগে থেকেই। তবে ঠিক সুযোগ হচ্ছিলো না। বহু দিন পর মেয়েটা কে সম্পূর্ন একা পেয়েছিলো। এই সুযোগ টা হাত ছাড়া করা এতো সহজ?

মেয়েটার শরীর থেকে চন্দনের সুবাস ভেসে আসছে। বোধহয় চন্দন মেখেছিলো আজ। ফারাবির কিছু টা কাছে গেল সে। ভেতর থেকে অদ্ভুত মোহ কাজ করছে। সবে দশম শ্রেনি তে পা রাখা মেয়েটি এতো সুন্দর হয় কি করে?

রিক আর ফারাবির মাঝে দুরুত্ব কয়েক ইঞ্চি মাত্র। তৎক্ষনাৎ ওর গাঁয়ে হকি স্টিক এর আঘাত পরলো। আর্তনাদ করে উঠলো রিক। ফারহানের শরীর কাঁপছে, রি রি করছে রাগে। প্রতি টা লোমকূপ জাগ্রত। ক্রমশ ঘাম নেমে যাচ্ছে। কতো টা কষ্ট করে ফারাবি কে খুঁজে বের করেছে জানা নেই ওর। দুই ঘন্টা ধরে পাগলের মতো খুঁজে গিয়েছে মেয়েটা কে। ফ্লাইট থেকে নেমেই ছুটোছুটি করে দিয়েছে। এক গ্লাস পানি অব্দি মুখে তুলে নি।

আশে পাশে তাকালো রিক। একটা লোক কে ও দেখতে পেল না। ফারহান কে দেখে ভয় হচ্ছে ওর। ফারাবির পিছু নেওয়া তে ওয়ার্নিং দিয়েছিলো ওকে। বলেছিলো মিনিস্টারের ছেলে দেখে প্রথম বার মাফ করেছে। কিন্তু দ্বিতীয় বার সুযোগ দিবে না। কপালের ঘাম দেখে নিজেই ভরকে গেল রিক। পেছনে যেতে গিয়ে সরঞ্জাম পরে গেল। সেগুলো পাশ কাঁটিয়ে আবার যেতে লাগলো। ফারহানের চোখ থেকে নেমে যাচ্ছে আগুনের স্ফুলিঙ্গ। রিকের কন্ঠে ভয় আর আর্তনাদ
” দেখ আমার সাথে উল্টো পাল্টা কিছু করলে তোর অবস্থা ও খারাপ হবে। আমার ড্যাড ছাড়বে না তোকে। ”

” কি বললি তুই? ”

” আগাবি না ফারহান। ”

” আগাবো না? ”

রিক কে কষিয়ে থাপ্প’ড় মা’রলো ফারহান। পরে গিয়ে মাথা ঠুকে গেল দেয়ালে। হকি স্টিক দিয়ে দুটো আঘা’ত করতেই ফারাবির মিনমিনে কন্ঠ
” মার’বেন না, মার’বেন না আপনি। ”

ফারাবির দিকে তাকিয়ে হাত থেকে হকি স্টিক পরে গেল ফারহানের। সে সুযোগে পালিয়ে গেল রিক। অবশ্য ফারহানের নজর নেই সে দিকে। ফারাবি পিট পিট করে তাকাচ্ছে। ঠোঁট দুটো নড়ছে হালকা। ফারহানের বুকের ভেতর জমে থাকা রাগ সব এক সেকেন্ডেই গলে গেল পানি হয়ে। মেয়েটা হালকা আর্তনাদ ও করছে। ফারহান গেল না বাঁধন খুলে দিতে। এই মেয়ের শাস্তির প্রয়োজন।

বি : দ্র : ভুল ত্রুটি মাফ করবেন। রেসপন্স দেখে হতাশ আমি।

চলবে

#বসন্তের_রঙ_লাল
#ফাতেমা_তুজ
#part_7

(১৩)
” বাঁধন টা খুলে দিন না ফারহান ভাই। ”

” দিবো না। ”

স্পষ্ট জবাব ফারহানের। ফারাবি আবার আকুতি মিনতি করা শুরু করলো। কিন্তু ফারহান নিজ কথা তেই অটল। মেয়েটার কপালে দুই পাশ দিয়ে বয়ে চলছে ঘামের নোনা জল। অথচ বাতাবরণ শীতল। বস্তুত এতোক্ষণ যাবত বাঁধা থাকাতে আর অধিক টেনশন করাতেই এমন টা হয়েছে। না পেরে ফারাবি এবার কেঁদে দিলো। ওর কান্না সহ্য হয় না ফারহানের। মানসপটে সেটা গোপন রেখে চোখ বন্ধ করলো সে। তবে কিছু তেই নিজেকে স্থির রাখতে পারলো না। কয়েক সেকেন্ড ভেবে দুষ্টু বুদ্ধি এঁটে নিলো।
” দেখ ফারাবি তুই চাইলেই খুলে দিবো আমি। তবে আমার একটা শর্ত আছে। ”

” আপনাকে বিয়ে করা ব্যতীত সব শর্তে রাজি আমি ফারহান ভাইয়া। দয়া করে খুলে দিন। আমার কষ্ট হচ্ছে খুব। ”

” তোকে বিয়ে করবেই বা কে? ফারহান কি পৃথিবী তে আর মেয়ে দেখতে পায় না। তোর থেকে বহু গুন সুন্দরী আমার পেছনে ঘুরে বুঝেছিস। ”

” খুলে দিন না প্লিজ আমার কষ্ট হচ্ছে। ”

বাঁধন খুলতে লাগলো ফারহান। হাত টা খুব বেশিই লাল হয়ে আছে। খারাপ লাগছে ওর। সময় টা এখন মধ্য বিকেল বলা চলে। ফারাবির নরম হাতে হালকা করে স্পর্শ করে দিলো ফারহান। কোনো রকম অনুভূতি নেই ফারাবির মাঝে। কিন্তু ফারহান যেন হাজার ভোল্ট এর শক খেলো। ফারাবি উঠে দাঁড়াতেই প্রচন্ড ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো। দাঁতে দাঁত চেপে সব টা সহ্য করলো ফারহান। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার। চোখ দিয়ে পানি নেমে যাচ্ছে অবিরত।
” কোনো শর্ত নেই আমার। চলে আয় আমার সাথে। ”

ফারহানের পেছন পেছন হাঁটতে লাগলো ফারাবি। কি একটা বিদঘুটে পরিবেশ। থেকে থেকেই সিগারেট আর ম’দের গন্ধ। মাথা ধরে গেছে ওর। ফারহান নিজের গাড়ি নিয়ে আসে নি। তাই দুজন অপেক্ষা করতে লাগলো। মিনিট পার হলো গাড়ি নেই। মনে হচ্ছে এ রাস্তা টা গাড়ি বিহীন। তিক্ততার সাথে ফারহান বলল
” তোর জন্য এখন অপেক্ষা করতে হবে এই গাড়ির জন্য। ”

” আমি তো বলি নি আমাকে বাঁচান আপনি। ”

” বেশি কথা বলছিস আজকাল। ”

” তো কি করবো আর কতো কাল চুপ থাকবো আমি। শান্তি পাচ্ছি না একটু ও। দম বন্ধ হয়ে যায় আমার। আপনি যখন তখন অধিকার দেখান। কিন্তু যাঁর কোনো ভ্যালু নেই। অথচ জোড় খাটানো স্বভাব আপনার। সত্যি বলতে ঐ বদ লোক টা আর আপানর মাঝে বিন্দু মাত্র ফারাক চোখে পরে না আমার। ”

এতো গুলো কথা অনড়গল বললো ফারাবি। একটা কথা ও বললো না ফারহান। কিছুক্ষণ পর বাস এলো। সেই বাসে উঠে বসলো দুজনেই। ফারাবি যেন বেশ অবাক। ফারহান নামক ভয়ঙ্কর মানব কে এতো কিছু শোনালো আজ। অথচ কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। মনে মনে খুশি হলো সে। তবে কল্পনা ও নেই ঠিক কতো টা আঘাত করে দিয়েছে ফারহান কে।

ফাহিমের কাঁধে মাথা এলিয়ে লেকের পানির উথাল পাথাল দেখছে রিমি। মুখে নেই কোনো প্রকার সাজ সজ্জা। গাঁয়ে সাধারন একটা কামিজ। কে বলবে এই মেয়েটি বিখ্যাত বিজনেসম্যান ফরহাদ চৌধুরীর তিন সন্তানের মাঝে একটি মাত্র কন্যা। সময় টা কে উপভোগ করছে ফাহিম। রিমির চুলের ভেতর হাত গলিয়ে দিয়ে বিলি কেঁটে দিচ্ছে। সেই চট্টগ্রাম থেকে ছুটে এসেছে সে। আজ রাতের ট্রেন ধরেই ফিরে যাবে। কাল থেকে ক্লাস। শুধু মাত্র প্রিয়তমার মুখের স্বচ্ছল উচ্ছলিত হাসি টা দেখার জন্য এতো বেদনা। তবু ও প্রাণে রয়েছে সুমধুর কিছু বানী। বুক পকেট থেকে এক জোড়া গোলাপ ফুল বের করলো সে। রিমি তখনো ব্যস্ত প্রিয় মানুষের শ্বাস প্রশ্বাস গুনে নিতে।
” রিমি সোনা। একটু তাকাবে প্লিজ। ”

” এমন করে বলো না ফাহিম। আমার হৃদপিন্ড থেমে যায়। ”

” এমন বললে চলে জান? তোমার হৃদপিন্ড থেমে গেলে আমি যে পাগল ই হয়ে যাবো। ”

বুক ভরে শ্বাস নিলো রিমি। কাঁচা ফুলের সুবাস এসে ছুঁইয়ে গেল মন প্রাণ অধর সমস্ত দেহ। ছলাৎ করেই কেড়ে নিলো গোলাপ ফুল দুটি। খুশি তে আপ্লুত হয়ে চেষ্টা করলো মাথায় পরার। তবে পারছে না পরতে। ফাহিম নিজ হাতে সেটা পরিয়ে দিলো।
” এমন বাচ্চা দের মতো করলে চলবে জান? আমি তো এমনি তেই পরিয়ে দিতাম। দুষ্টুমি টা না করলে ও তো হতো। ”

” হুম বাচ্চা মেয়ের সাথে প্রেম করার আগে ভাবা উচিত ছিলো। ”

” ইস নিজেকে বাচ্চা বলে। বিয়ে করলে দুদিন বাদেই বাচ্চার মা হয়ে যাবে। আর ওনি কি না এখনো বাচ্চা। ”

লজ্জা পেয়ে অন্য দিক ফিরে নিলো রিমি। ফাহিমের মনে ইচ্ছা ছিলো আরো কিছু সময় কাটানোর। তবে ঘড়ির কাঁটা বলছে এখনি যেতে হবে। তবে মন সেটা চাইছে না। প্রিয়তমার শরীরের মা’দকতা আর মিষ্টি ফুলের সুভাসে মেতে উঠা বসন্ত সব মিলিয়ে মন চাইছে না যেতে। তবে সন্ধ্যা ও অনেক টা গভীর হতো চললো। সবাই কে ফাঁকি দিয়ে সেই দুপুর থেকে অপেক্ষা করছে রিমি। এতো ক্ষণ অব্দি বাসায় না ফেরাতে নিশ্চয়ই বকা ও খেতে হবে। যদি ও বা পাশেই বসন্ত উৎসবের গান পরিবেশিত হচ্ছে। এই অজুহাত দেওয়া যেতেই পারে। তারপর ও ফাহিমের মন রিমির জন্য ব্যাকুল হয়ে গেল। নিজের আবেগ লুকিয়ে মেয়েটার কপালে শুষ্ক চুম্বন করে বলল
” অনেক টা সময় পার হয়ে গেছে। এখন বাসায় ফিরে যাও। ”

(১৪)

ইববান শিকদার সামান্য বিচলিত। ক্ষণ কাল পূর্বেই তিনি জানতে পেরছেন মির্জা বাড়ি তে গিয়েছিলো অভিনব। পায়চারি করছেন ঘরময়। মন টা অশান্ত হয়ে গেছে। মির্জা দের সাথে পূর্ব শত্রুতা রয়েছে এই পরিবারের। যা সম্পর্কে অবগত নয় অভিনব। তবে এখন সময় এসেছে অবগত করার।

ওয়াসরুম থেকে ফ্রেস হয়ে বের হতেই ইববান এর মুখ টা ভেসে উঠলো। তিনি বিচলিত পায়ে এগিয়ে গেলেন। বিদেশে বসবাস রত এই এক মাত্র ভাগ্নে কে প্রচুর ভালোবাসেন তিনি। যদি ও প্রিয় বোন ইহরিমা তাঁর প্রতি অভিমান করে আছে। তবে ভাগ্নের সাথে যোগাযোগ ছিলো সর্বদা। অভিনব কে ফোন করে আসতে বলেছেন তিনিই।
” মামা কিছু বলবে? ”

” হ্যাঁ খুব ই গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে ইহান। ”

” হুম বলো না কি বলবে। ”

” এখানে নয় বাগানে চল। ”

” ওয়েট তাহলে আমি ফুল ঝুঁটি কে চকলেট গুলো দিয়ে আছি। ”

রূপা আর ফুল পড়াশোনা করছিলো। দুই বোন একে অপরের জান আবার একটু পরেই হয়ে যায় চরম শত্রু। চুপিসাড়ে রুমে প্রবেশ করলো অভিনব। ফুল গভীর মনোযোগে পড়ছে। মেয়ে টা কে পেছন থেকে জাপটে ধরে উঁচু করলো অভিনব। ফুল খিল খিল করে হাসছে। অভিনবর চোখে বাচ্চা টি খুব ই সুন্দর। শ্যাম বর্ণের হলে ও চেহারায় রয়েছে অদ্ভুত স্নিগ্ধতা।
” ফুল সোনা মজা পেয়েছো? ”

” হু পেয়েছি তো। খুব মজা ছিলো এটা। আচ্ছা ইহান ভাইয়া তুমি কখন এসেছো? ”

” এই তো কিছুক্ষণ আগেই। তোমাকে সারপ্রাইজ দিবো বলে দেখা করি নি। ”

” খুব ভালো করেছো। ”

ফুলের হাসি হাসি মুখ। রূপা কে এক হাতে জড়িয়ে ধরে অভিনব বলল
” কি মিস রূপসী। আপনি বুঝি অভিমান করেছেন। ”

” একদম ই নয়। তবে এই যে চকলেট এনেছো সেগুলো কিন্তু আমার ও চাই।”

” একদম, কেন দিবো না। আমি তো জানি আমাদের রূপসী কন্যা এখনো সেই বাচ্চা রয়ে গেছে। ”

” ঠিক বলেছো তুমি। জানো ইহান ভাইয়া আজ ছোট দের মতো করে আপু ফোনে কাকে যেন বলছিলো বাবু আমার কিন্তু গোলাপ আর চকলেট চাই ই চাই। ”

মেয়েটির মুখ চেপে ধরলো রুপা। অভিনব যা বোঝার বুঝে গেছে। রূপা অস্বস্তি তে নুইয়ে যাচ্ছে যেন। অভিনব তীক্ষ্ম দৃষ্টি ফেলে বলল
” প্রেম করছো রূপসী কন্যা? ”

” না মানে ভাইয়া তেমন কিছু নয়। ”

” কাল দেখা করিয়ে দিবে। আমি তাকে পরখ করে নিতে চাই। ”

” জী ভাইয়া। ”

ফুলের নাক টিপে দিয়ে চলে গেল অভিনব। রূপা আর ফুলের মাঝে চকলেট নিয়ে হাতাহাতি চলছে। পেছন ফিরে সেটা স্পষ্ট দেখলো ছেলেটা।

” মামা আমি চাই না এই শত্রু তা বহাল থাক। ”

” এটা আমাদের পূর্ব নীতি ইহান। ”

” কি দরকার এমন নিয়মের। দুই এলাকার মানুষ গুলো আতঙ্কিত হয়ে আছে। সব থেকে বড় কথা মম খুব ই আপসেট। সে তাঁর বেস্ট ফ্রেন্ড এর থেকে ছিন্ন হয়েছে এই শত্রুতার জন্য।”

ভারী শ্বাস প্রশ্বাস গুলো শোনা গেল মাত্র। দুই এলাকা ই চায় ক্ষমতা নিজেদের মাঝে স্থির থাকতে। যার কারনে এতো শত ঝামেলার উপত্তি। কেউ এক চুল ও ছাড় দিতে রাজি নয়।

মন খারাপের মাঝে ও এক চিলতে হাসি বান্ধবী মৌন। ঝিল কে নানান ভাবে হাসানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে। মেয়ে টার এমন এমন কান্ডে না হেসে ও পারে না ঝিল। তবে ভেতরে থাকা কষ্ট টা সেটা তো লাঘব হয় না কিছু তেই। মৌনতা এবার সিরিয়াস হলো। ঝিলের গালে হাত দিয়ে বলল
” কি হচ্ছে কি দোস্ত! তুই এমন ভাবে মন মরা করে আছিস যেন তোর প্রাণ টাই বুকের ভেতর থেকে খোয়া গেছে। ”

” ঠিক ই বলেছিস মৌন। আসলেই আমার প্রাণ টা খোয়া গেছে। মানুষ সব থেকে বেশি ব্যথিত হয় প্রিয় মানুষের আঘাতে। হ্যাঁ সে আমার স্বপ্ন পুরুষ মাত্র। কোনো রকমের সম্পর্ক নেই আমাদের মাঝে। তবে আমার ফিলিং নিয়ে এভাবে কেনো খেললেন তিনি? আমি তো কখনো বেশি কিছু চাই নি কারো কাছে। ওনার কাছে ও তেমন কিছু চাই নি। ট্রাভেলিং কে নিজের মধ্যে লালন করেছি এতো গুলো দিন। আমার স্বপ্ন পুরুষ ই আমার স্বপ্ন মুছে দিলো। ”

” দোস্ত কান্না করছিস তুই? ”

কান্না লুকানোর চেষ্টা করলো ঝিল। আকাশের পানে তাকিয়ে দাঁত কামড়ে চোখের পানি কে বাঁধা প্রদান করলো। তবে সেটা থামছে না। বেহায়ার মতো গলে গলে পরছে।

হতাশা নিয়ে চলে গেল মৌনতা। রোহন ছাঁদে দাঁড়িয়ে কবুতর নিয়ে খেলা করছে। শখের বসে বিভিন্ন প্রজাতির কবুতর পালন করে সে। এক মুঠো গম নিয়ে অল্প করে ছিটিয়ে দিলো মৌনতা। রোহনের নজর সে দিকে নেই। রোহন ব্যস্ত কবুতর পালনে। ঝিলের মনের অবস্থা একটু হলে ও অনুভব করতে পারে। তবে মাহিন তাঁদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এই সমাজে মেয়েদের সম্ভ্রম কতো টা হুমকি তে। আবেগে ঝিলের সেফটি মাথায় ছিলো না। তবে এখন থেকে আর ভুল করবে না।

বসন্ত উৎসব পেরিয়ে গেলে ও দু এক স্থানে একুশে ফেব্রুয়ারির জন্য আয়োজন চলছে। গাজীপুর আর মির্জাপুরের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হতে যাচ্ছে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান। যার ফলে দুই এলাকার মাঝের দ্বন্দ্ব লাঘব হবে বলে আশা করছেন কিছু ব্যক্তি জন। যুব সংগঠন থেকে আহনাফ আর রোহন ও যুক্ত এই আয়োজনে। বহু কষ্ট করে ঝিল কে নিয়ে বের হতে সক্ষম হলো মৌনতা। বিগত তিন চার দিন ধরে এই বাসাতেই থাকছে সে। ঝিল অধৈর্য হয়ে বলল
” আর কতো দূর মৌন? ”

” আর একটু। তুই এমন হাঁপিয়ে যাচ্ছিস কেন? ”

” ভালো লাগছে না আমার। ”

কথা বলতে বলতে আয়োজিত মঞ্চ স্থানে চলে এলো ওরা। মৌনতা ছুটে গেল রোহনের কাছে। ছেলেটা কাল থেকে বাড়ি তে ফিরে নি। তাই প্রচন্ড আবেগী হয়ে পরেছে মৌন। ভালো লাগলো ঝিলের। চারপাশে স্নিগ্ধতা ওকে আলিঙ্গন করে যাচ্ছে। মাথার উপর দাঁড়িয়ে আছে লম্বা লম্বা গাছের সারি। হঠাৎ করেই একটা ব্যানারে চোখ যায়। অভিনবর দারুণ একটা ছবি টানানো। সেখানে গোটা গোটা করে লেখা ” বিখ্যাত ট্রাভেলার্স অভিনব সরকার ইহান এখন বাংলাদেশের মাটি তে। ”

না চাইতে ও চোখ থেকে স্বচ্ছ পানির স্রোত নেমে গেল। মুখ চেপে কান্না করতে লাগলো ঝিল। বড্ড অসহায় লাগছে নিজেকে। চিৎকার করে বলতে চাইলে ও গলা দিয়ে খুব জোরে আওয়াজ এলো না। চোখের জল এলোমেলো হাতে মুছে নিয়ে ঝিল বলল
” আই হেইট ইউ অভিনব আই হেইট ইউ। আপনি আমার জীবনের যে অংশে ছিলেন সেই অংশ টা ধারন করতে কষ্ট হচ্ছে আমার। এতো বড় প্রতারণা! হেইট ইউ, হেইট ইউ, হেইট ইউ অভিনব। ”

পেছন ঘুরতেই গাছের আড়ালে চলে গেল অভিনব। শ্বাস নিতে গেলে বাতাবরণ কেমন ভারী ঠেকলো। মনে হচ্ছে বাতাসে মিশে গেছে গুনগুনে ব্যথার সুর। নাকে আসে করুণার গন্ধ। বড্ড মায়া হলো নিজের প্রতি। তবে সত্যিই কি ভুল হয়ে গেল তাঁর!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here