আমি_তোমাতে_বিলীন #পর্ব_১২,১৩

0
810

#আমি_তোমাতে_বিলীন
#পর্ব_১২,১৩
#সুমাইয়া মনি
১২

সকালে ব্রেকফাস্ট করার পরপরই জায়ান বেরিয়ে যায়। মনির সঙ্গে কোনো প্রকার কথা বলেনি। কাল রাতের ঘটনার জন্য এখনো জায়ান রেগে আছে মনির ওপর। মনি আকলিমা বেগমের সঙ্গে টুকটাক কাজ করছিল। বাকিটা কাজের লোকরা রা করলেও, রান্না কার তিনিই করেন। তখনই ড্রইংরুম থেকে শ্বশুর মশাইয়ের ডাক শুনে ছুঁটে আসে মনি।
তিনি ফোন বুক্ষে চেপে ধরে বললেন,
‘তুমি নাকি তোমার আব্বু-আম্মুর ফোন ধরছো না?’
মনি কথাটি শুনে দৃষ্টি নত করে ফেলে। মিনমিন স্বরে বলল,
‘ফোন সাইলেন্ট করা ছিল আব্বু।’
‘মিথ্যে! নেও ফোন। কথা বলো তাদের সঙ্গে।’ বলে ফোন এগিয়ে দিলেন। মনি ফোন হাতে নিয়ে একটু আড়ালে এলো। কণ্ঠেস্বর কাঠিন্য বানিয়ে বলল,
‘বলো কি হয়েছে?’
‘এভাবে কথা বলছিস কেন? এখনো রেগে আছিস মা?’ মোফাজ্জল হোসেন বললেন নরম স্বরে।
‘কি বলবে সেটা বলো। আহ্লাদ দেখাবে না মোটেও।’
মেয়ের এরূপ কথা শুনে তার মুখ মলিন হয়ে এলো। বুঝতে না দিয়ে বললেন,
‘সব বাবা-মা চায় তার সন্তানের ভালো। আমাদের কাছেও ব্যতিক্রম কিছু নয়।’
‘এসব বাদে অন্যকিছু বললে বলো আব্বু।’
‘আচ্ছা তোর মায়ের সাথে কথা বল।’
‘আমি ব্যস্ত আছি। পরে কথা বলব।’ বলে ফোন রেখে দেয় মনি৷ মোফাজ্জল হোসেন দু বার হ্যালো, হ্যালো বলে কান থেকে ফোন সরিয়ে নিলেন। অপর দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন জাহানুর বেগম। স্বামীর মুখ মলিন থেকে তার বুঝতে অসুবিধা হলো না। তিনি কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। নিরাশাজনক আদলে চলে গেলেন তার কক্ষে।
.
মনিকে এত দ্রুত কথা বলে ফিরে আসতে দেখে মাজিদ এহসান প্রশ্ন করলেন,
‘নিশ্চয় তুমি বাবার সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলোনি তাই না।’
মনি নিরুত্তর থেকে ফোন এগিয়ে দেয় তার দিকে। দৃষ্টি সরিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়। তিনি আবার বললেন,
‘তোমার যখন জন্ম হয় তখন তোমার বাবার সুখের সীমা ছিল না। বুকে জড়িয়ে নিয়ে সুখের আবেশে কেঁদেছিল মোফাজ্জল। সবাইকে দেখিয়ে বলে বেড়িয়েছে ছোট মা এসেছে তার ঘরে। ছোট থেকে তোমার সব আবদারই পূরণ করেছে। এখন তার এই ছোট্ট আবদার টুকু মেনে নিতে পারছ না? এই ছিল ওর ভালোবাসার ফল।’
মনির চোখে পানি চলে আসে। টলমল করা চোখ মাজিদ এহসানের চোখে এড়ায়নি। তিনি ফের বললেন,
‘জানি তোমার বিয়েতে মত ছিল না। কিন্তু আমি নিজে বলছি, তোমাকে তোমার বাবা যোগ্য ছেলের হাতেই তুলে দিয়েছে। নিজের ছেলে বলে বলছি না। আমি মোফাজ্জলের স্থানে থাকলে এটাই করতাম হয়তো। আর যাই করো, বাবা-মা’কে হার্ট করে কথা বোলো না। আল্লাহ অসন্তুষ্ট হবেন।’ বাকি কথা বলে তিনি পেপার পড়তে আরম্ভ করলেন। মনি মাথা নত রেখে নিজের কক্ষে ফিরে এলেন। বিছানায় বসে বালিশে মাথা রেখে ছোটবেলার অতীত মনে করতে লাগলেন। চোখের পানি এবার টুপটাপ করে পড়ছে। একটু আগে দুর্ব্যবহারের কথা তাকে প্রচণ্ড যন্ত্রণা দিচ্ছে। ফোন হাতে নিয়ে বাবা-মায়ের ফোনে টেক্সট করে ‘স্যরি’ লিখে। যেটা দেখে অপরপ্রান্তে থাকা পিতা-মাতা ভীষণ খুশি হয়।
_
‘নাজমুল, মেয়েদের দুর্বল পয়েন্ট কোথায় বলতে পারো?’
জায়ানের এরূপ অকপটে প্রশ্ন শুনে নাজমুল কিছুটা থমথম খেয়ে যায়। হতচকিত কণ্ঠে বলল,
‘নিঃসন্দেহে আমি একজন অবিবাহিত পুরুষ! মেয়েদের দুর্বল পয়েন্ট কীভাবে বলব স্যার?’
‘ধ্যাত!’ বিরক্ত প্রকাশ করে জায়ান। পুনোরায় বলে,
‘আমি সেটা বলিনি। আমি বলতে চেয়েছি তুমি কি এসব বিষয়ে কিছু জানো?’
‘না স্যার!’
‘তাহলে কে বলতে পারবে?’
‘গুগল?’
‘আর ইউ শিওর?’
‘হ্যাঁ! সার্চ করে দেখতে পারেন।’
‘হুম।’ কিছুক্ষণ ভেবে জায়ান সার্চ দেয় গুগলে। তেমন কিছু টেকনিক খুঁজে পেল না দেখে কিছুটা নিরাশ হয়। তবে হাল ছাড়ে না। খুঁজে বের করবেই মেয়েদের দুর্বল পয়েন্ট।
.
আজ শীতের রেশ অনেকটা কম। রৌদ্রের তাপমাত্রা বেশ প্রখর। ছাদে এসে ঘেমে গেছে মনি। বেশ কিছুক্ষণ দোলনায় বসে বাবা-মায়ের পর বান্ধবীদের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলার পর এখন নীল আকাশ দেখছে মনোযোগ দিয়ে। নিলমকে কয়েকবার কল দিয়েছিল। কিন্তু ফোন পীক করেনি। তা দেখে কয়েকটা টেক্সট পাঠায়। তবুও রেসপন্স মিলে না। এই দুপুরে একটু টকজাল আচার হলে মন্দ হয় না। দৌঁড়ে নিচে এসে শ্বাশুড়ি নিকট উপস্থিত হয়। ফিরে আসার সময় জায়ানকে আচার আনার কথা বলতে বলে। তিনি উল্টো তাকেই বলতে বলেন। মনি ভালো করেই জানে জায়ান মোটেও আনবে না। তবুও শ্বাশুড়ির কথা অনুযায়ী জায়ানকে বলতে চায়। দু’তিন বার ভেবে কল দিয়েই ফেলে। জায়ান তখন কিছু লোকদের সঙ্গে কথপোকথন ব্যস্ত ছিল। তাই ফোন রিসিভ করে নাজমুল। সুন্দর কর সালাম দেয়। মনি জবাব দিয়ে বলে,
‘কে মুলা ভাইয়া?’
‘মুলা?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে নাজমুল।
‘হ্যাঁ! মুলা।’
‘স্যরি রং নাম্বার। এখানে মুলা নামের কেউ থাকে না।’
‘আরে না, থাকে তো। আপনি মুলা, আই মিন নাজমুল ভাইয়া তাই না।’
ঠাস ঠাস শব্দ শুনতে পায় মনি। আসলে নাজমুল নিজের কপালে চাপড়াচ্ছে নিজের নামের অপমান শুনে। মনি মৃদু হেসে বলল,
‘মশা মারছেন নাকি মুলা ভাইয়া?’
‘নাহ! নিজের কপালকে মারছি।’
‘তা কেন?’ মুচকি হেসে।
‘আপনার বলা নাম শুনে। আমার নাম নাজমুল, মুলা নয়।’
‘এত বড়ো নাম ধরে ডাকা সম্ভব নয়। তাই প্রথমের নাজের আকারকে লাস্টে যোগ করে মুলা বানালাম। সুন্দর না?’
‘খাইছে রে! আর কিছু বলবেন কি?’ আহত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।
‘আপনার স্যার কোথায়?’
‘স্যার মিটিং এ আছে।’
‘আচ্ছা! মিটিং শেষ হলে বলবেন যে আসার সময় আচার কিনে আনতে।’
‘আচার?’
‘হ্যাঁ! আম বা তেঁতুলের আচার।’
‘ঠিক আছে বলব। আর কি?’
‘আপনি কি মুলা খেতে পছন্দ করেন? আপনার স্যার তো মোটেও পছন্দ করে না।’ মিটমিটিয়ে হেসে বলে।
‘ভাবি, আমার নামটিকে এমন ভাবে অপমান করবেন না প্লিজ!’ আহত কণ্ঠে বলল নাজমুল।
মনি মুখ টিপে হেসে বলে,
‘করব! রাখি।’ বলেই ঠুস করে ফোন কেঁটে দেয়।
নাজমুল কান থেকে ফোন সরিয়ে করুণ চোখে তাকায়। তার প্রাণপ্রিয় নামটাকে অর্ধ ধর্ষণ করে দিয়েছে ভেবে দুঃখি সে।
___
দুপুরের দিকে জায়ান ফিরে। সঙ্গে কিছু আচারও নিয়ে আসে। তবে সেগুলো মনিকে ডেকে না দিয়ে মায়ের হাতে তুলে দেয়। এতে মনি কিছুটা অপমান বোধ করলেও পাত্তা দেয় না। বোয়াম হাতে খেতে আরম্ভ করে। জায়ান ওপরে দাঁড়িয়ে এটা দেখে কিছুটা বিরক্ত হয়। দুপুরের খাওয়ার পর্ব শেষ করে মনি জায়ানের রুমের দিকে অগ্রসর হয়। আসলে মনি কলেজে যেতে চায়। এ বিষয়ে মাজিদ এহসান জায়ানের সঙ্গে কথা বলতে বলে। এজন্যই এখন জায়ানের কাছে আসা।
রুমে প্রবেশ করে দেখে জায়ান ফোনে কারো সঙ্গে কথা বলছে। জায়ানের নিকট এসে দাঁড়াতেই ফোন রেখে দেয়। সোফায় বসে টেবিলে রাখা পেপারগুলো ঘাটতে আরম্ভ করে।
মনি আরেকটু এগিয়ে যায়। মাথা নত রেখে কিছু বলতে যাবে তখনই জায়ান কাঠ কাঠ কণ্ঠে বলে,
‘কাজ করছি, নাউ গেট আউট!’
মনি বুঝতে পারে জায়ান ওর সঙ্গে কেন এমন করছে। বিরক্তির সঙ্গে রাগ মাখা আদল নিয়ে রুম ত্যাগ করে।
করিডোরে পায়চারি করতে করতে দুষ্টু বুদ্ধি ভাবতে থাকে।
আর সেটা পেয়েও যায়। রান্না ঘরে ছুঁটে এসে ফ্রিজ খুলে অনেক রকমের শাক-সবজি দেখতে পায়। সেখানে জায়ানের অপছন্দের মুলাও ছিল। একটি মুলা বের করে কিচেনের পাশে বসে ফোন ঘাটতে আরম্ভ করে। ইউটিউব ঘেঁটে বের করে কীভাবে নুডলস রান্না করে। সম্পূর্ণ দেখার পর মনি বিড়বিড় করে বলে,
‘সবাই দেয় আলু, আমি দিবো মুলা, হাহ!’
রান্নার কাজ আরম্ভ করে দেয়। একজন কাজের লোক এসে সাহায্য করতে চাইলে মনি তাড়িয়ে দেয়। সন্ধ্যার নাস্তা আপাতত মনিই বানাবে।

মাগরিবের আজান পড়েছে। মাজিদ এহসান নামাজ পড়ে ফিরে এসেছে। জায়ান তখন নিচে এসে ড্রইংরুমে বসে। বাবার সঙ্গে কথপোকথনে ব্যস্ত থাকার সময় একজন সার্ভেন্ট নুডলস নিয়ে উপস্থিত হয়। এমতাবস্থায় সেখানে আকলিমা বেগম ও মনি আগত হয়। তাদেরও দেওয়া হয় নুডলস। দু’জনের কথোপকথনের মাঝে জায়ান এক চামিচ নুডলস মুখে তুলে নিলো। সঙ্গে সঙ্গে থু দিয়ে বাটিতেই ফেলে দেয়। ধাপ করে টেবিলের উপর বাটিটি ফেলে ক্ষেপে গিয়ে বলে,
‘মুলা দিয়েছে নুডলসে কে?’
থমথম খেয়ে আহাম্মক চোখে তাকায় তারা জায়ানের দিকে। মনি কিছুটা ভয় পেয়ে যায় জায়ানের ঝাড়ি শুনে। তবে দমে না। মনে মনে বলে,
‘মুলা, এবার ঠেলা সামলা।’
সার্ভেন্টটি দ্রুত ছুঁটে আসে রান্না ঘর থেকে। জায়ান তার দিকে কুর্নিশ করে তাকিয়ে তেজী কণ্ঠে শুধালো,
‘নুডলস রান্না করেছে কে?’
সার্ভেন্টটি অতি নরম স্বরে বলল,
‘ছোট ম্যাম!’
সকলের নজরে মনি। জায়ান রাগে আরো ফেটে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে কিছু বলার পূর্বেই মাজিদ এহসান বলে,
‘ভালোই তো হয়েছে। তুমি না খেলে খেও না। বৌমাকে কিচ্ছু বলবে না। ও আমাদের জন্যই রান্না করেছে।’
‘শিওর তুমিই মনিকে বলেছো আমি মুলা পছন্দ করি না আম্মু?’ জায়ান তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রশ্নটি ছুঁড়ে ওর আম্মুর দিকে।
আকলিমা বেগম কিছুটা থমকালের। তিনি নিজেও জানতেন না তার গুনধর বৌমা জায়ানের পছন্দ, অপছন্দের ফায়দা ওঠাবে। নিশ্চয় এটা কোনো কারণে মনি ইচ্ছে করে করেছে।
হতে পারে জায়ানকে জব্দ করতে! ভেবে কপালে হাত রাখলেন। যেমন ছেলে, ঠিক তেমনই বৌমা পেয়েছেন!
.
.
.
#চলবে?

#আমি_তোমাতে_বিলীন
#পর্ব_১৩
#সুমাইয়া মনি

‘কি সমস্যা তোর নিলম? কল ধরছিস না, টেক্সটের রিপ্লাই দিচ্ছিস না। হোয়াই?’ মনি রেগে কথা গুলো বলল নিলমের উদ্দেশ্যে।
নিলম গম্ভীর চোখেমুখে তাকায় মনির পানে। পরপরই নজর সরিয়ে নেয়। তারা সকলে ক্যাম্পাসের মাঠে বসে আছে। মনিকে কলেজে আসতে দিয়েছে জায়ান। পড়াশোনা কন্টিনিউ করতে বলেছে। ক্যাম্পাসে এসেই আগে নিলমকে খুঁজতে শুরু করে। বাকি বান্ধবী’রা এলেও নিলম নাকি ক’দিন ধরে ভার্সিটিতে আসছে না। তারাও যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ফলস্বরূপ শূণ্য! মনির কথায় পাত্তা দিচ্ছে না দেখে তারানা এবার ক্ষেপে বলল,
‘তোর হয়েছেটা কি? যেমন বিহেভিয়ার করছিস, দেখে মনে হচ্ছে ছ্যাঁকা খেয়েছিস।’
‘হুম, হারিয়ে ফেলেছি তাকে।’ নিলম দৃষ্টি নত রেখে কোমল স্বরে বলল।
‘মানে তোর ব্রেকআপ হয়েছে সত্যি?’ তমা জিজ্ঞেস করে।
‘উঁহু! হারিয়ে ফেলেছি।’
‘কাকে?’ মিনা রেগে বলল।
‘প্রেয়সীকে।’
‘আরে চিল কর দোস্ত! এমন মেয়ে তোর জীবনে আরো অনেক আসবে। ভুলে যা তাকে।’ মনি নিলমের কাঁধে হাত রেখে বলল।
নিলম মনির হাতের দিকে তাকিয়ে কাঠিন্য কণ্ঠে বলল,
‘আমার তাকেই চাই।’ বলেই উঠে চলে যায়।
তারা নিলমের যাওয়ার পানে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকায়। নিলম তাদের দৃষ্টির অগোচরে যেতেই তমা বলল,
‘হঠাৎ নিলমের ব্যবহারে এতটা পরিবর্তন কি করে এলো বুঝতেছি না।’
‘ব্রেকআপ হলে মানুষ স্যাড মুডে থাকে। কিন্তু নিলমের চেহারায় রাগ দেখা যাচ্ছে।’ তারানা বলে।
‘হতে পারে গার্লফ্রেন্ডের ওপর রেগে আছে।’ মিনা থুতনিতে হাত রেখে বলল।
‘আচ্ছা বাদ দে। মনি তোর খবর বল। নতুন সংসারে কেমন ফিল হচ্ছে?’ তমা মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করল।
‘একদম মুলা তরকারির মতো।’
‘মানে?’ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে মিনা।
‘বলছি!’
__
‘কাল মনি যা করেছে, তাতে জায়ান এখনো রেগে আছে বোধহয়।’ আকলিমা বেগম কিছুটা চিন্তিত স্বরে বলল।
‘ওদের বিষয়ে তুমি যেও না তো।’
‘যাচ্ছি না। তোমার ছেলে তো আমার ওপর রেগেমেগে উঠল তখন। বুঝিয়ে বলেছিলাম বলেই না রাগ দমেছে। নয়তো খরব ছিল।’
‘শিখাও নি ছেলেকে মুলা খাওয়ানো। এখন ভুগো!’
‘এখন তো আমার দোষই দিবে।’
‘এক কাজ করো। কাল ওদের মনিদের বাড়িতে যেতে বলো।’
‘সেটা ভালো হয়। কিন্তু ইঁদুর, বিড়ালের যুদ্ধ যেই পরিমাণ বেড়েছে। মনে হয়না জায়ান যেতে রাজি হবে। দেখি জায়ানকে বলে।’
‘তুমি তো চুপই থাকো। মনির সঙ্গে তুমিও দোষী।’
‘আজাইরা কথা বলবে না বলে দিলাম।’ কিছুটা রেগে বললেন।
‘বললাম না। জায়ানকে আমিই বলব। আপাতত তুমি চুপ থাকো।’
তিনি চুপ হয়ে রইলেন। আর কথা বললেন না। তবে জায়ান কাল যে পরিমাণ ক্ষেপে ছিল। মনে হয় না মনিদের বাড়িতে যাবে। ভেবে তিনি কিছুটা বিচলিত।
_
কলেজ থেকে মনি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে। জায়ান এখনো ফিরেনি। তাই জায়ানের রুমেই শাওয়ার সেরে নেয়। বের হবার পর দেখে জায়ান ক্রোধান্বিত চোখেমুখে বসে আছে বিছানায়। মনি সেখানেই থেমে যায়। আগে পা বাড়ানোর সাহস হচ্ছে না।
অতি কষ্টে বুকে সাহস সঞ্চয় করে মিনমিন কণ্ঠে বলল,
‘আসলে আম্মু গিয়েছিল গোসল করতে তাই..’
‘সিরিয়াসলি? আম্মু তো কিচেনে। ‘ এক ভ্রু উঁচু করে গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো।
মনি নিরুত্তর হয়ে রয়। জায়ান উঠে দাঁড়ায়। ধীরে পায়ে এগিয়ে আসে মনির নিকট।
মনি ভয়ে বিড়বিড় করে বলে,
‘সিনেমা না হোক, সিনেমা না হোক!’
জায়ান মনির ঠোঁট নড়াচড়া করতে দেখে জিজ্ঞেস করল,
‘বিড়বিড় করে কি বলছো?’
কথাটা শুনে মনি ভ্রু কুঁচকে ফেলে। জায়ান উত্তরের অপেক্ষা না করে এগিয়ে আসে মনির নিকট। মনি ঘাড় অন্যদিকে ফিরিয়ে রাখে। জায়ান মনির পারে তাকিয়ে আগাগোড়া দেখে নিয়ে কানের কাছে ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলে,
‘গেট আউট!’
মনি কিঞ্চিৎ রাগ নিয়ে জায়ানের পানে তাকাল। সে ভেবেছিল জায়ান উল্টাপাল্টা কিছু করবে হয়তো। এক্সপেক্ট করেনি এটা বলবে। মনি পাশ কাঁটিয়ে চলে যাওয়া ধরলে জায়ান পিছন থেকে চিল্লিয়ে বলল,
‘এক সপ্তাহের আগে যেন এ রুমে তোমাকে না দেখি।’
মনি কথাটা শুনতে শুনতে বেরিয়ে যায়। শ্বাশুড়ির রুমে এসে রাগে ফোঁসফোঁস করে।
দুপুরে খাওয়ার সময়কালীন মনিদের বাসায় যাওয়ার কথা জায়ানকে বলতেই অমত করে সে। তাদের দু’জনার জোরাজোরিতে যেতে রাজি হয় জায়ান। মনি মনে মনে ঠিক করে এত ভাব দেখানোর ফল তাকে দেখাবে। কঠিন ভাবে দেখাবে। শুধু একবার যাক বাড়িতে।
_
মাহিদ ঢাকায় এসেছে কিছুক্ষণ আগে। তার ঢাকায় আসার বিষয়ে রজত আলি কিছু জানে না। তাকে না বলেই তিনি এসেছেন। আর তার মূল কারণ জায়ান। বাবা যে কাজ তাকে দিয়েছে। সেটা সে তার আড়ালেই করে দেখাবে। এবং নিজের সাহসীকতার প্রমাণ দিবে। এখানের একটি হোটেলে উঠেছেন। হোটেলটি বনানীর ঠিক কাছাকাছি অবস্থিত। ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে ফোন চেক করতেই বাবার মিসড কল দেখে তাকে দ্রুত কল দেয়। একবার রিং হতেই ফোন রিসিভ করেন তিনি। ক্ষেপে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কোথায় তুমি?’
‘বন্ধুদের সঙ্গে কক্সবাজার এসেছি।’
‘হ্যাঁ! শুধু তো পারো বাবার টাকা উড়াতে। এছাড়া আর কি পারো। গাঁধা কোথাকার।’
মাহিদ রেখে গেলেন গালি শুনে। তবুও চুপ থেকে বলল,
‘কি বলার জন্য কল দিয়েছো?’
‘আসছো কবে?’
‘বলতে পারছি না।’
‘দরকার কি আসার! বিয়েশাদি করে সেখানেই থেকে যাও না।’ বলেই খট করে ফোন কেঁটে দিলেন তিনি। মাহিদ ফোন বিছানায় রেখে দিলেন। আপাতত তার রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বিছানায় বসে তার এক বন্ধুকে কল দিলেন।
বিকালের দিকে মাহিদ তার বন্ধুকে নিয়ে বেরিয়েছে। মুখে মাস্ক ছিল। এ গলি, ও গলি ঘুরতে ঘুরতে জায়ানের বাড়ির সামনে দিকে গেলেন তারা। সেখানে মনিকে এক নজর দেখতেও পেল সে। মনি তখন বারান্দায় বসে গালগল্প দিচ্ছিল বান্ধবীদের সঙ্গে। তখনই মাহিদের বন্ধুর ফোনে কল আসে। তিনি একটু আড়ালে গেলে মাহিদ বারান্দার দিকে তাকিয়ে থাকে। ভালো করে বাড়িটি পর্যবেক্ষণ করছেন তিনি। গ্রিল বা পাইপ বেয়ে উঠা সম্ভব নয়। দেয়ালের ওপরের অংশে লোহা গাঁথা। দেয়াল টপকানোর কোনো ওয়ে নেই। গেটের সামনে পাহারা দেওয়ার জন্য দু’জন সিকিউরিটি গার্ড রয়েছে। মূল কথা বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করার সব পথ বন্ধ। ভেতরে যদি যেতেই হয় তবে পরিকল্পনা করে যেতে হবে। আরো কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে আসেন হোটেলে।
__
‘শোনো বৌমা তোমরা কিন্তু পরশুই চলে আসবে। আমাদের আবার রাজশাহীতে ফিরতে হবে।’ আকলিমা বেগম বললেন মনির উদ্দেশ্যে।
‘আম্মু আপনারা এখানেই থেকে যান আমাদের সঙ্গে।’
‘তা হয় নাকি বলো। তোমরাও তো আমাদের সঙ্গে যেতে। কিন্তু এখন সমস্যা হলো তোমার পড়াশোনা নিয়ে। আপাতত এই বছর এখানে পড়ো। তারপরের বছর রাজশাহীতে ভর্তি করাবো তোমাকে।’
‘এটা কি আপনার ছেলে বলেছে?’
‘হ্যাঁ! কাল বাপ-ছেলে আলাপ করে আমাকে বলল।’
মনির খুশিমুখ কে দেখে। সে এমনিতেও রাজশাহীতে যেতে চায় নি। ঢাকাতেই থেকে যেতে চেয়েছিল। আর এটাই হয়েছে। তার অনাকাঙ্ক্ষিত ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। তার এই খুশিমুখ শ্বাশুড়ির সামনে প্রকাশ করতে পারছে না। তবে সে মনে মনে খুশিতে আত্মহারা!
‘কাপড়চোপড় গুছিয়ে নেও। আমি বরং এশারের নামাজ পড়ে আসি। আজান দিয়েছে।’
‘জি আম্মু।’
তিনি চলে যেতেই মনি তার বান্ধবীদের টেক্সট করে খবরটি জানিয়ে দেয়।
.
.
ব্যালকনির গ্রিল জুড়ে দাঁড়িয়ে নিলম সিগারেটের ধোঁয়া উড়াচ্ছিল। আগে সে তেমন সিগারেট খেতো না। কিন্তু এখন তার নিত্যদিনের সঙ্গী হয়েছে বলা যায়। মনোযোগ দিয়ে গগনের দূর চাঁদের দিকে তাকিয়ে ছিল। সেই সময় ফোনের মেসেজ টোন বেজে উঠায় অন্য হাত দিয়ে ফোন আনলক করে মনির মেসেজ সিন করে নেয়। তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া নেই তার মধ্যে। ফোন সেভাবে রেখে মগ্ন সিগারেটের ধোঁয়া উড়াতে। কিছু স্মৃতি তাকে প্রচণ্ডভাবে আঘাত করছে হৃদয়ে। ক্ষণে ক্ষণে দমে গেলেও নিজেকে নতুন ভাবে উপস্থাপন করতে চাইছে। বন্ধু থেকে ভালোবাসার মানুষে পরিণত হয়েছে মনি। জানা নেই তার আদৌও মনির প্রতি জমানো আসক্ততা কাঁটাতে পারবে কি-না!
_
দরজায় নক করে ভেতরে প্রবেশ করে মনি। শ্বশুড় মশাইকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘আব্বু আপনার ছেলে কোথায়?’
‘ছাদে।’
‘আচ্ছা।’ বলে রুম ত্যাগ করল মনি। এগিয়ে গেল সিঁড়ির দিকে। বিড়বিড় করে বলছে,
‘আজ আমি আমার ফেসবুক আইডি নেবই। নিলমের কাছ থেকে পাসওয়ার্ড নিয়ে আইডি লগইন করার পরপরই আবার হ্যাক করে পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করে দিয়েছে। এই জ্বালা আর সহ্য করার মতো নয়। আজ কিছু করতেই হবে হু!’ কথা গুলো আওড়াতে আওড়াতে ছাদে এসে পৌঁছালো। দোলনার অপর দিক মুখ করে জায়ান দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিল।
সাদা লাইটের আলোয় জায়ানের ব্লু রঙের টি-শার্টটি কিছুটা চিকচিক করছে। মনি তৎক্ষনাৎ থুতনিতে হাত রেখে মৃদুস্বরে আওড়ায়,
‘এত কি গোপন কথা বলছে। গার্লফ্রেন্ড -টার্লফ্রেন্ড নয়তো? হলে হোক। তাতে আমার ওড়না ছেঁড়া গেল।’ বলেই চুপিচুপি এগিয়ে গেল। দু’হাত পিছনে রেখে কান সামনের দিকে এগিয়ে দিলো। যদি কিছু শুনতে পায় তো! এই আশায়। কিন্তু তেমন কিছু কানে এলো না। হঠাৎ জায়ান ঘুরে তাকায়। মনি হকচকিয়ে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। এমন ভান ধরে যেন সে আকাশের তারা গুনতে এসেছে, জায়ানকে সে দেখেই নি। জায়ান কপাল কুঁচকে ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল,
‘হোয়াট?’
‘আমার আইডির পাসওয়ার্ড বলেন।’ সোজাসাপ্টা বলে দিলো মনি।
জায়ান কিছুক্ষণ মনির দিকে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকায়।।ফের বলে,
‘এই জন্য এসেছো?’
‘হ্যাঁ!’
জায়ান স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায়। মনির দিকে এক কদম এগিয়ে এসে বলল,
‘আমি কি প্রফিট পাবো? মানে কিছু নিতে হলে কিছু দিতে হয়। এই নিয়মটা তুমি জানো?’
‘আপনি চালু করেছেন নাকি? তবে বলুন কত টাকা চাই?’
জায়ান শাহাদাত আঙুল নিজের দিকে তাক করে বলল,
‘আমাকে দেখে কি তোমার ফকির বলে মনে হচ্ছে?’
‘আপাতত তাই মনে হচ্ছে!’ মাথা চুলকিয়ে বলল মনি।
‘সাটআপ!’ ধমক দিলো জায়ান।
মনি কেঁপে উঠে এক পা পিছিয়ে যায়। আমতা আমতা করে বলে,
‘এটা না, এটা না। কি চান সেটা বলেন।’
‘সত্যি কথা জানতে চাই।’
‘কি সত্যি কথা?’
‘এই দু’দিন যা করেছো এবং বলেছো, নিজের ইচ্ছেতে নাকি কোইন্সিডেন্স ছিল?’
মনি মাথা চুলকিয়ে মিনমিন কণ্ঠে বলল,
‘ইচ্ছেতে!’
‘রিয়েলি?’
‘হুম।’
জায়ান মিনিট কয়েক চুপ থেকে পরক্ষণেই বলল,
‘জানমনি, পাসওয়ার্ড!’
মনি তৎক্ষনাৎ ফোন হাতে ফেসবুকে লগইন করে পাসওয়ার্ড দেয়। ওপেন হয় আইডি। দেখে খুশি হয় সে। জায়ান মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় এর শাস্তি মনিকে দিবে। কঠিন ভাবে দিবে!
.
.
#চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here