স্ত্রী
পর্বঃ১০
লেখিকা ঃতাওহীদা
ওই দিনের পর থেকে জিনাত আর রায়ানের সাথে বাজে ব্যবহার করে নি।নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছে সে।রায়ানের মায়ের দেখাশোনা আর পড়াশোনাতেই নিজেকে আবদ্ধ করে নিয়েছে জিনাত।রায়ান কি করলো না করলো ওদিকে আর কোনো খেয়াল দেবার প্রয়োজন মনে করে না সে।
রায়ানো জিনাতের থেকে নিজেকে যতটা সম্ভব দূরে রাখে।খুব প্রয়োজন ছাড়া ওর সাথে কথা বলে না।রাতে যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি ফিরে আসে।জিনাতকে কথা শোনানোর সুযোগ দিতে চায় না সে।কারন শত হলেও প্রিয়জনের মুখ থেকে তাচ্ছিল্যের কথা খুবই তেতো লাগে শুনতে।
এভাবেই জিনাত আর রায়ানের বিয়ের দুইমাস পার হয়ে গেলো।
দিন দিন রায়ানের মায়ের শরীরের অবনতি ঘটছে।শরীরে সাংঘাতিক চর্মরোগ দেখা দিচ্ছে।বার বমি হচ্ছে।তার সাথে ব্লিডিং।শরীর মাত্রাতিরিক্ত দুর্বল হয়ে গিয়েছে।গতদুইদিন স্যালাইন পুশ করে রাখতে হয়েছে।ডাক্তার তাকে ক্লিনিকে এডমিট করতে বলেছিলো।কিন্তু সে কিছুতেই ক্লিনিকে যেতে রাজি না,,,তার একটাই কথা যে কটা দিন বাচবে এই বাড়িতে থেকেই শেষ নিঃশ্বাস ফেলবে সে।
ওদিকে মায়ের এমন অবস্থা দেখে রায়ানের প্রায় পাগলপ্রায় দশা।দিন নেই,রাত নেই সারাক্ষন মায়ের পাশে বসে থাকে সে।রাতে মা যখন ঘুমিয়ে থাকে,,মায়ের পাশে জায়নামাজে বসে দু হাত তুলে আল্লাহর কাছে কাদে রায়ান।মায়ের চিকিৎসার কোনো ত্রুটি রাখেনি সে,,ভারতের দুই তিন জায়গায় মাকে নিয়ে নামকরা ডাক্তারদের দেখিয়েছে,,,বন্ধুর কথায় অস্ট্রেলিয়ার বড়ো ডাক্তারের কাছে মায়ের রিপোর্টগুলো পাঠিয়েছে। কিন্তু কোথাও কোনো আশার বানী শুনতে পায় নি সে।তাই এখন শুধু আল্লাহর কাছেই কাদে,,আল্লাহ যেনো ওর মায়ের যন্ত্রণা একটু কমিয়ে দেন।
জিনাতও ওর শাশুড়ির সেবাযত্নে কোনো ত্রুটি রাখছে না।শুধু শাশুড়ী হিসেবে না,,এই কয়দিনে রায়ানের মা বড্ড আপন হয়ে গিয়েছে তার।এতো ভালো একজন মানুষের এইরকম কষ্ট দেখে ওর বুকটা হু হু করে ওঠে। জিনাতও আল্লাহর কাছে আন্তরিক ভাবে দোয়া করে,,, আল্লাহ যেন তাকে সুস্থ করে দেন।তবে একটা জিনিস জিনাতকে আজকাল বড্ড ভাবায়,,,রায়ান এতো মা ভক্ত একটা ছেলে।সে তো মায়ের প্রতিটি কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে।আর তার মাকে জিনাত যতটুকু দেখেছে,,তাতে ওর মনে হয় না, সে তার ছেলেকে কোনো অনৈতিক কাজ করার কথা বলতে পারে।তাহলে সে এমন গুন্ডামী করে কেনো?নাকি এইরকম গুন্ডামী করে,,, অসহায়ের রবিন হুড হতে চায় সে!!
★
কিছুদিন থেকেই শরীরটা ভালো যাচ্ছে না।রায়ানের মা হঠাৎ বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ায়,,ওর নাওয়া, খাওয়া,ঘুম যেনো উবে গিয়েছিল। তাছাড়া শরীরে কিছু মেয়েলি সমস্যাও লক্ষ্য করছে সে।খাওয়া দাওয়াও করতে ইচ্ছে করে না তার।
আজ দুপুরে খাওয়ার সময় জিনাত দৌড়ে বেসিনে গিয়ে গলগল করে বমি করে দিলো।রায়ান আর ওর মা বেশ ঘাবড়ে গেলো ওকে হঠাৎ এভাবে বমি করতে দেখে।রায়ান আর শিমু মিলে জান্নাতকে ধরে এনে সোফায় বসালো।রায়ানের মা আস্তে আস্তে উঠে এসে জান্নাতের মাথায় হাত বুলাতে লাগলো।হঠাৎই কিছু একটা ভেবে রায়ানের মায়ের মন পুলকিত হয়ে উঠলো।সে রায়ানকে বললো,,,,রায়ান বাবা,,আজমল ভাইকে একটা কল করতো।বলিস,,বিকেলে চেম্বারে যাওয়ার আগে জিনাতকে যেনো একটু চেক আপ করে যায়।(রায়ানদের পরিবারের খুব ক্লোজ একজন, ডাক্তারঃ আজমল হোসেন।ওদের বাড়ির কাছেই থাকে।)
বিকালে,,ডাক্তার এসে চেকাপ করলো।তবে তেমন কিছু বললো না,,,জিনাতের অসুবিধা গুলো শুনলো।তারপর তার ব্যাগ থেকে সিরিঞ্জ বের করে জিনাতের ব্লাড স্যাম্পল নিয়ে,, বললো,,টেস্ট করে জানাবে।আর ওকে রেস্টে থাকতে বলে গেলো।
রায়ানের মা মনে মনে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে লাগলো,,যেনো তার ধারনাই সত্যি হয়।মৃত্যুর আগে যেনো এই সুখবর টা শুনতে পায় সে।
ওদিকে অজানা ভয় চেপে ধরলো জিনাতকে।একটা দমকা হাওয়ায় জীবনের সবকিছু ওলট পালট হয়ে গিয়েছিলো জিনাতের।কোনমতে এই দুইমাসে নিজেকে সামলে নিয়েছিলো সে।কিন্তু এখন যে ও ঝড়ের আভাস পাচ্ছে।মনেপ্রাণে আল্লাহকে ডাকছে, যেনো তার ধারণা সত্যি না হয়।
রাত ৯ টায় বাড়ির ল্যান্ড লাইনে ফোন এলো।রায়ানের মা টেলিফোনের পাশেই সোফায় বসে টিভি দেখছিলো।আর জিনাত আর শিমু রান্নাঘর এ কাজ করছিলো। তাই ফোনটা সেই রিসিভ করলো।রিসিভ করেই,,তারপর চোখমুখ আনন্দে ঝলমল করে উঠলো। বেশ জোরেই সে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলো।
হ্যা ডাঃআজমল সাহেবই ফোন দিয়েছিলো।জিনাতের টেস্টের রেজাল্ট পজেটিভ। জিনাত প্রায় দুইমাসের অন্তসত্ত্বা!
রায়ান তখন বাসায়ই ছিলো।রায়ানের মা চিৎকার করে রায়ান আর জিনাতকে ডাকলো সে।তার ডাক শুনে ওরা দৌড়ে এলো।রায়ান আসতেই,,ওর মা ওকে জড়িয়ে ধরলো।।
-আজ আমি খুব খুশি বাবা খুব খুশি!! আমি মনেপ্রাণে আল্লাহকে বলতাম আল্লাহ যেনো তোকে একটা নেক স্ত্রী দান করেন,,যে তোর জীবন সংসার ভরিয়ে রাখবে।আমার অসুখের কথা জেনে আমার মনে হয়েছিলো,,আমি হয়তো তোর সংসার দেখে যেতে পারবো না।এরপর আল্লাহই জিনাতকে মিলিয়ে দিলেন।
জিনাত সংসারের হাল ধরে সংসারটাকে কি সুন্দর আপন করে নিয়েছে।এই দেখে মনে প্রবল ইচ্ছে হচ্ছিলো,,,এই সংসারে যেনো দুটো ছোটো ছোটো পায়ের আনাগোনা হয়।দেখ কি ভাগ্য আমার আল্লাহ আমার সেই ইচ্ছেও পুরন করেছেন।নাতি-নাতনীর মুখ না দেখতে পারি,,ওদের আসার সুখবর শুনে তো মরতে পারবো এখন।
ওনার কথা শুনে রায়ান হা করে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে।এই দেখে সে একগাল হেসে বললো,,,
-ওরে গাধা হা করে আছিস কেনো,,তুই বাবা হতে চলেছিস,,মিষ্টি নিয়ে আয়!!!
এটা শুনেও রায়ান হা করেই তাকিয়ে আছে,,খুশি হবে নাকি কষ্ট পাবে বুঝতে পারছে না।বরং ওর তো এখন ভয় হচ্ছে,,জিনাতের মুখোমুখি কিভাবে হবে ও!
জিনাততো স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে।যেই ঝড়ের আভাস পাচ্ছিলো,,সেই ঝড় টাই শক্তিশালী হয়ে আছড়ে পরলো ওর জীবনে,,,ও তো আশায় ছিলো এই মিথ্যে সংসারের অভিনয় থেকে একদিন ও মুক্তি পাবে।কিন্তু এখন,,, এখন কি করবে ও?(চলবে)