#মধুবালা,পর্বঃ৬
অরিত্রিকা আহানা
ঘরের বাতি নিভিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে আশরাফি। কিচ্ছু ভালো লাগছে না তাঁর। অস্থির, অসহ্য লাগছে সবকিছু। পুরো বাসা ফাঁকা! সে ছাড়া আর কেউ নেই বাসায়। সোহাগ, নাঈম দুজনের বাইরে গেছে। সোহাগ গেছে তাঁর গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে ডেইটে আর নাঈম? সে গেছে বাড়িতে বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। আশরাফির তো বাবা মা কেউই নেই তাই ছুটির দিনগুলোতে একা বাসাতেই কাটাতে হয় তাঁকে। নাঈম অবশ্য বেশ জোরাজুরি করেছিলো তাঁর সঙ্গে যাওয়ার জন্য কিন্তু আশরাফি না করে দিয়েছে। এর আগেও বেশ কয়েকবার নাঈমদের বাড়িতে গিয়েছে সে, সোহাগদের বাড়িতেও গিয়েছিলো কিন্তু দুচারদিনের বেশি মন টেকে না। তাই বারণ করে দিয়েছিলো সে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে না গিয়ে ভুলই করেছে। একা বাসায় ভীষন বোরিং লাগছে। আর সবচেয়ে অসহ্যকর যে বিষয়টা, সেটা হলো একা থাকার কারণে তার সমস্ত চিন্তাভাবনা গুলো কেবল মেহেরকে কেন্দ্র করেই ঘুরছে। যেটা প্রতিটা মুহূর্তে অনেক বেশি যন্ত্রনা দিচ্ছে তাঁকে।চাইলেও মাথা থেকে মেহেরের চিন্তাভাবনা ঝেড়ে ফেলে দিতে পারছে না চায় সে। চোখ বন্ধ করলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে মোহর এবং তাঁর লজ্জাজনক পরিনতি! মেহের যতই বলুক ভালো আছে সে কিন্তু আশরাফি কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না তাঁর মেহের এমন একটা জায়গায় যেখানে টাকার বিনিময়ে খুব সস্তা এবং নোংরাভাবে নারীদের দেহ বেচাকেনা হয়। নারীদেরকে বানানো নয় লালসার বস্তু! যতবার এই কথাগুলো মনে পড়ে আশরাফি ততবার চিৎকার করে কাঁদতে মন চায় তাঁর কিন্তু পারে না। সময়ের সাথে সাথে কান্নাও হারিয়ে গেছে। কিন্তু দুঃখগুলো ঠিক আগেরমতই রয়ে গেছে। নিঃশব্দে, নির্জনে বুকের ভেতর রক্তপাত ঘটায় কেবল!
কাল থেকে ইউনিভার্সিটি খুলবে আশরাফির।
সেই অপেক্ষাতেই আছে সে। ক্যাম্পাস খুললে কাজের চাপ হয়ত একটু বাড়বে। কিন্তু তবুও শান্তি! কাজের মাঝে থাকলে নিজের দুঃখগুলোকে ভুলে থাকতে পারবে সে। ব্যস্ত রাখা যাবে নিজেকে। এমনিতে, একা যতক্ষণ থাকে দমবন্ধ হয়ে আসে তাঁর। মেহেরের সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে সেটা আরো বেড়েছে। সবকিছুই অসহ্য লাগছে তাঁর। মাথার ভেতর উল্টোপাল্টা চিন্তাভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে। মাঝে মাঝে তো মনে হচ্ছে একটা লোডেড পিস্তল নিয়ে ঠিক মাথার খুলি বরাবর গুলি করে উড়িয়ে দিতে মেহেরকে। কিন্তু পরোক্ষনেই আবার তাঁকে কাছে পাওয়া তীব্র আকুতি! আশরাফি নিজেও বুঝতে পারে না এ কেমন চাওয়া তাঁর? নিজের ওপর লজ্জা হয় কিন্তু তবুও অস্বীকার করতে পারে না মেহেরকে এখনো চায় সে। এখনো পাগলের মত ভালোবাসে তাঁকে!
গতকালকেও সারারাত বিছানায় এপাশওপাশ করেছে সে। অনেক ভেবেছে। কিন্তু কোনকিছুতেই কোন কূল পায় নি। একটা মেয়ে কি করে এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে? সারাজীবন ধরে শুনে এসেছে মেয়েদের মন হয় কোমল, স্নেহময়ী, দরদমাখা। কিন্তু মেহেরকে যত দেখছে ততই অবাক হচ্ছে সে। লাজলজ্জা, আবেগ অনুভূতি, মায়ামমতা শূন্য হয়ে গেছে সে। কিন্তু মেহের কি এমন ছিলো? মোটেও না! নরম,কোমল, শান্ত দিঘি মত একটা মন ছিলো তাঁর! আশরাফি একটু ছোঁয়াতে নুইয়ে পড়তো লজ্জাবতী লাজুকলতাটা! সেজন্যই আরো বেশি কষ্ট হয় আশরাফির। এমন মেহেরকে নিজের দুঃস্বপ্নের ভাবে নি যে।
এমন কেন হলো সবকিছু ? টাকার জন্য? মেহের তো নিজমুখেই স্বীকার করেছে। কিন্তু তবুও কেন বিশ্বাস করতে পারছে না আশরাফি? কেন বারবার মনে হয় মিথ্যে বলেছে মেহের। কিছু একটা রহস্য আছে তাঁর জীবনে!
এসব ভাবতে ভাবতেই আবার গভীন ধ্যানে মগ্ন হয়ে গিয়েছিলো আশরাফ। মোবাইলের রিংটোনের শব্দে ধ্যান ভাংলো। শোয়া থেকে উঠে বসে ফোন রিসিভ করলো সে। ওপাশ থেকে নীলা মিষ্টি করে সালাম দিয়ে বললো,’আপনি কি ফ্রি আছেন স্যার?’
সালামের জবাব দিলো আশরাফি। গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,’হ্যাঁ। বলো কি বলবে।’
নীলা তাঁদের ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভ। মানে সি আর! তাই ক্লাস রুটিন, এসাইনমেন্ট, থিসিস জমা দেওয়া সহ, যাবতীয় পড়াশোনামূলক বিষয়ে পুরো ক্লাসের হয়ে তাঁকেই আলাপ করতে হয় স্যারদের সাথে। সেই সুবাদে আশরাফিকেও প্রায়ই ফোন করার সুযোগ হয়েছে তাঁর। কিন্তু আজকে ফোন করার একটা বিশেষ কারণ আছে। কারণটা হচ্ছে আজকে নীলার জন্মদিন। বাসায় পার্টি হবে। সব বন্ধুবান্ধবদের, পরিচিত কয়েকজন স্যার ম্যাডামদের দাওয়াত করেছে সে। কিন্তু আশরাফিকে কি করে দাওয়াত দেবে সেটাই বুঝতে পারছিলো না। দাওয়াত দেওয়ার পরে সে কি রিয়েক্ট করে সেটা ভেবেও ভয় হচ্ছিলো।
শেষমেশ একটা উপায় বের করে ফেললো। নিজের রিসার্চে অ্যাসিস্ট করার জন্য আশরাফি তাঁকে কিছু আগ্রহী ছাত্রছাত্রীদের লিস্ট তৈরী করতে বলেছিলো। লিস্ট রেডি! তাই ফোন করে খবরটা আশরাফিকে জানানো যেতেই পারে। সেই সুযোগে জন্মদিনের কথাটাও বলে ফেলবে।
আশরাফির কাছ থেকে অনুমতি পেয়ে বিনীত কন্ঠে বললো,’রিসার্চে অ্যাসিস্ট করার জন্য আপনি আগ্রহী ছাত্রছাত্রীদের যেই লিস্টটা আমাকে তৈরী করতে বলেছিলেন সেটা রেডি হয়ে গেছে স্যার।’
-‘ঠিক আছে। তুমি তাহলে লিস্টটা মেইল করে পাঠিয়ে দাও আমাকে।’
-‘এখনই?’
-‘হ্যাঁ এখনই। কেন কোন সমস্যা?’
-‘জ্বী না স্যার। আমি এখনই মেইল পাঠাচ্ছি আপনাকে।’
‘ঠিক আছে’, ফোন রেখে দিচ্ছিলো আশরাফি তখনই নীলা তড়িঘড়ি করে বললো,’হ্যালো স্যার?’
ফের ফোন কানে দিলো আশরাফি। শীতল কন্ঠে বললো,’আর কিছু বলবে?’
-‘জি স্যার।’
-‘কি?’
নীলার ভয় লাগছে। আশরাফি সঙ্গে পড়াশোনার বাইরে অন্যকোন কোন আলোচনা কখনোই হয় নি তাঁর। তাই অন্য স্যার ম্যাডামদের চাইতে বেশি ভয় হয় তাঁর সঙ্গে কথা বলতে। তারওপর আজকে তো সরাসরি বাসায় আসার দাওয়াত। বুঝতে পারছিলো না কি হবে! ভীত, ইতস্তত কন্ঠে বললো,’না মানে। আজকে আমার জন্মদিন স্যার। তাই বাবা ছোটখাটো করে একটা পার্টির…’ তার কথার মাঝখানেই আশরাফি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো,’তাই নাকি?’
-‘জি স্যার!’
-‘তাহলে তো উইস করা উচিৎ তোমাকে?’
জবাবে নীলা কিছু বললো না। হাত পা কাঁপছিলো তাঁর। আশরাফি মুচকি হেসে বললো,’ শুভ জন্মদিন। অনেক বড় তুমি। আর খুব খুশি থাকো।’
বিশেষ মানুষদের কাছে থেকে শুভেচ্ছা পেতে সবারই ভালো লাগে। হোক না সেটা খুবই সামান্য। তবুও অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করে। প্রশান্তিতে ভরে যায় মন! কানায় কানায় ভয়ে জায় আনন্দের মাত্রা! নীলার মনটাও আনন্দে ভরে গেলো। আজকের দিনটা স্বার্থক তাঁর। লাজুক কন্ঠে বললো,’থ্যাংক ইউ স্যার।’
আশরাফি ফের হাসলো। হাসিমুখেই জিজ্ঞেস করলো সে,’তারপর? তুমি যেন কি বলছিলে? বাসায় পার্টি হবে তাইতো?’
-‘জি স্যার। তবে খুব বড় করে নয়। বাবা, মা, আমি আর আমার সব বন্ধুরা থাকবে। লায়লা ম্যাম, আরিফ স্যারকেও বলেছি। উনারা আসবেন। আপনি কি আসবেন স্যার? আপনি এলে খুব খুশি হবো আমি।’
-‘আমি?’
-‘হ্যাঁ স্যার। আসবেন ?’ খানিকটা আবদারের সুরেই জিজ্ঞেস করলো নীলা। বারণ করতে পারলো না আশরাফি। এমনিতেও বাসায় ভালো লাগছিলো না তাঁর। তাছড়া ওখানে কলিগরাও আসবে, আড্ডা দেওয়া যাবে সবার সঙ্গে।’ আগ্রহের সাথেই জিজ্ঞেস করলো,’অনুষ্ঠান কয়টায়?’
-‘সাতটায়।’
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো আশরাফি!তারপর নীলাকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে বললো,’ঠিক আছে আমি আসবো!’
খুশিতে চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো নীলার। সে স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি এত সহজে রাজি হয়ে যাবে আশরাফি। রীতিমতো কল্পনার বাইরে তাঁর! উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বললো,’থ্যাংক ইউ স্যার। আপনি আসবেন, অনেক খুশি হয়েছি আমি।’
-‘ঠিক আছে। আমি তাহলে এখন রাখি।’
-‘জি স্যার। খোদা হাফেজ!’
পুনরায় সালাম দিয়ে ফোন কাটলো নীলা। আনন্দের নাচতে ইচ্ছে করছে তাঁর। পরীক্ষায় ফার্স্ট হলেও এতখুশি লাগে নি আজকে যতটা খুশি লাগছে। তড়িঘড়ি করে সাজতে বসে গেলো সে। এদিকে ফোন রেখে ঘড়ির দিকে চাইলো আশরাফি। সবে সাড়ে সাড়ে চারটা বাজে। হাতে এখনো সময় আছে। ঘড়িয়ে পৌনে ছয়টার এলার্ম সেট করে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লো সে। যদিও এখন ঘুম আসবে না। তবুও বৃথা চেষ্টা। বাসায় বসে এমনিতেও তেমন কোন কাজ নেই। তারচেয়ে চোখবন্ধ করে শুয়ে থাকলেও রেস্ট হবে।
★
ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে পারফিউম স্প্রে করছিলো আশরাফি। ফোনটা বেজে উঠতেই ভাবলো নীলা ফোন করেছে। না দেখেই রিসিভ করলো সে। কিন্তু সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবে ওপাশ থেকে কেউ একজন ‘হ্যালো’ বলে উঠলো ওমনিই হৃদপিন্ডটা ধড়াস করে লাফিয়ে উঠলো তাঁর। মেহের ফোন করেছে! কণ্ঠ চিনতে একটুও ভুল হয় নি আশরাফির। কি করে হবে? সম্পর্কটা হয়ত মিথ্যে হয়ে গেছে কিন্তু যতগুলো রাত সে মেহেরের মিষ্টিমধুর, আদুরে কণ্ঠস্বর শুনে পার করেছে সে রাত গুলোতো আর মিথ্যে হয়ে যায় নি। আশরাফি এখনো মনে পড়ে, সারারাত ফিসফিস করে কথা বলে ভোরবেলায় ঘুমাতো দুজনে, এরজন্য কত ক্লাস মিস হয়েছে তাঁর। স্যার ম্যাডামদের কত বকা শুনতে হয়েছে তাঁকে ! অথচ সেই প্রেম, সেই অনুভূতি সবই এখন ফিকে! অর্থহীন! মূলহীন পীড়াদায়ক এক অতীত কেবল! যেটা ধুয়ে মুছে শেষ করে ফেলেছে মেহের! কিন্তু আশরাফি? সে এখনো মেহেরের স্মৃতি নিয়েই পড়ে আছে। তাঁর ঘৃণা, ভালোবাসা, রাগ, অভিমান সব এখনো মেহেরকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। চাইলেও সত্যিটা অস্বীকার করতে পারে না। কারণ মানুষ নিজের কাছে কখনোই মিথ্যে বলতে পারে না! নিজের অজান্তেতই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিরে। ওপাশ থেকে আবারো মেহেরের অধৈর্য কন্ঠস্বর শোনা গেলো,’হ্যালো, হ্যালো? কি হলো শুনতে পাচ্ছো না? আমি মধু!’
মুহূর্তেই মেজাজটা আবার খারাপ হয়ে গেলো আশরাফির। মধু নামটা শুনেই মাথায় রক্ত উঠে যায় তাঁর। তারপরেও কতবড় সাহস মেহেরের তাকে ফোন করে মধু নামে পরিচয় দিচ্ছে। দাঁতমুখ খিঁচে বললো,’কিন্তু আমি মৌমাছি নই।’ কথা শেষ সটাং ফোন কেটে দিলো সে।
এদিকে মধু হতভম্ভ! এটা কি হলো? আশরাফি এটা কি বললো? মৌমাছি নই মানে? সে কি মধু বলে পরিচয় দেওয়াতে খেপে গেছে? নাকি অন্যকিছু? পুনরায় আশরাফির নাম্বারে ডায়াল করলো সে।
সময়ে অসময়ে যোগাযোগের জন্য ছোট এই বাটন ফোনটা আরমান কিনে দিয়েছিলো তাঁকে। সেটা থেকেই আশরাফিকে ফোন করেছে সে। নাম্বার জোগাড় করতেও বেশ কাঠখড় পোহাতে হয়েছে। চুরি করে আরমানের ফোন থেকে আশরাফির জোগাড় করেছে। শুধুমাত্র একবার আশরাফি কন্ঠটা শোনার জন্য!
আশরাফি সেদিন রাগ করে বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকেই মনটা বড় অশান্ত হয়ে আছে তাঁর।খুব দেখতে ইচ্ছে করছিলো তাঁকে! একবার তাঁর কণ্ঠ শোনার জন্য আকুপাকু করছিলো মনটা। কিন্তু ফোন করার কোন বাহানা খুঁজে পাচ্ছিলো না।
কিন্তু কথায় আছে, ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। অবশেষে মধুও পেয়ে গেলো উপায়! আশরাফি তাঁদের কম্পানীর জন্য যেই মেয়েগুলো খোঁজ করছিলো তাদেরকে মোটামুটি সব শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছে মধু। চাইলেই সেই ব্যপারেই আলাপ করার জন্য আশরাফিকে ফোন করতে পারে সে। আশরাফি যদি কিছু বলে তবে মধুও বলতে পারবে ব্যবসার ব্যপারে আলাপ করতেই ফোন করেছে তাঁকে। তখন আর নিশ্চই কিছু বলতে পারবে না আশরাফি?
এদিকে তখনো রাগে গজগজ করছিলো আশরাফি। এতবড় সাহস তাকে ফোন করে বলে কি না মধু! সামনে পেলে মুখ সেলাই করে দিতো একদম! কিন্তু আশরাফি হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিউর মধু একদিন নির্ঘাত খুন হবে তাঁর হাতে! হবেই হবে!
এসব চিন্তার মাঝখানেই আবারো ফোন বেজে উঠলো আশরাফি। আগের নাম্বার থেকেই এসেছে। রিসিভ করে শুরু হলো ঝাড়ি। মধুকে কোন কথাই বলতে দিলো না সে। ইচ্ছে মত ঝাড়লো। আধঘন্টা বাদে কিছুটা শান্ত হলে মধু মুচকি হেসে বললো,’আমার ফোন ব্যালেন্স কম। তোমার যদি খুব বেশি বকতে ইচ্ছে হয় তবে নিজের ফোন থেকে করো। কিন্তু এবার দয়া করে আমাকে কাজের কথাটা বলতে দাও প্লিজ!’
এমনিতেই আশরাফির মেজাজ সপ্তম আকাশে! তারওপর যখন দেখলো সে এতক্ষণ যাবত চেঁচামেচি করার পরেও মধু বিন্দুমাত্রও বিচলিত হয় নি তখন মেজাজ আরো খিঁচড়ে গেলো। তাই আরো বেশি খেপে গেলো সে। ফোনের ওপাশ থেকে ঝাড়ি মেরে বললো,’এই ফোন রাখো তুমি! তোমার সাথে কোন কথা বলার রুচি আমার নেই। আমি তোমার সাথে কোন কাজের কথা বলবো না।’
-‘বলতে হবে। কারণ তুমি আমার স্বামীকে তোমার একটা কাজ করে দেওয়ার জন্য টাকা দিয়েছো। সেটার ব্যপারে কথা বলতেই তোমাকে ফোন করেছি।’
অত্যাধিক রাগে কিছুক্ষনের জন্য নির্বাক হয়ে গেলো আশরাফি। রিয়েক্ট করার মত আর কোন ভাষা খুঁজে পেলো না সে। মেহের তাঁকে স্বামী দেখাচ্ছে! স্বামী? স্বামীর চৌদ্দগুষ্ঠির কাঁথায় আগুন। চিৎকার করতে, করতে হয়রান হয়ে গেছে সে আর মেহের এসেছে তাঁকে স্বামী দেখাতে? এবার দ্বিগুণ জোরে চেঁচিয়ে উঠলো সে,’স্বামী না? খুব স্বামী স্বামী করছো? তোমার স্বামী আমার…’
ভয়ানক একটা গালি দিলো সে। বিগত চারবছর যাবত শান্তই ছিলো সে। ইউনিভার্সিটি সবচেয়ে কুল এন্ড কাম লেকচারার পরিচিত ছাত্রছাত্রীদের কাছে। অথচ দুদিনেই তাঁর মাথা কি পরিমান গরম করে দিয়েছে মধু। নিজের মানমর্যাদা, অবস্থা, পরিস্থিতে সব ভুলে গিয়ে মুখ দিয়ে কুরুচিপূর্ণ গালি বেরোচ্ছে! সব দোষ মেহেরের। এবার আরো বেশি করে গালি দেবে আশরাফি!
এদিকে লজ্জায় জিভ কাটলো মধু। সঙ্গে সঙ্গে কানের কাছ থেকে ফোন সরিয়ে নিলো সে। একটুবাদে আবার কানে দিয়ে অবাক হয়ে বললো,’ছিঃছিঃ মুখের ভাষা এত খারাপ কি করে হলো তোমার? আগে তো এমন ছিলে না তুমি?’
-‘সেই কৈফিয়ত তোমাকে দেবো নাকি? ইচ্ছে হয়েছে গালি দিয়েছি দরকার হলে আবার দেবো। তুমি ফোন রাখো! কেন ফোন করেছো ফোন আমাকে? যার মুখের ভাষা ভালো তাকে নিয়েই থাকো না। শুধুশুধু আমাকে কেন জ্বালাচ্ছো?’
-‘বললাম তো কাজের জন্য ফোন করেছি।’
-‘তোমার সঙ্গে আমার কোন কাজের কথা নেই, থাকতে পারে না আর ভবিষ্যতেও থাকবে না।’
-‘একবার আসতে পারবে?’
হঠাৎ এইপ্রস্তাবে থতমত খেয়ে গেলো আশরাফি। সে ভাবতেই পারে নি মধু তাঁকে এমন প্রস্তাব দেবে! রাগী আশরাফি আড়ালে যেই কঠিন প্রেমিক আশরাফি বাস করছে মুহূর্তেই সে যাওয়ার জন্য সায় দিয়ে দিলো। কিন্তু রাগী, অভিমানী আশরাফি নিজের রাগ, অভিমান ডাঁট বজায় রেখে বললো,’তোমার সাহস তো কম না? তুমি আমাকে ঐ নোংরা জায়গায় যেতে বলছো? তুমি কি তোমার মত ভাবো সবাইকে? আমি তোমার ঐ….. জায়গায় যাবো? হাউ ক্যান ইউ এক্সপেক্ট দিজ ফ্রম মি?’
এবারেও যথারীতি শুন্যস্থানে একটা বড়সড় গালি বসবে! এবারে অবশ্য ইচ্ছে করে দিতে চায় নি আশরাফি! কিন্তু মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেছে। জবাবে মেহের একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো কেবল। তারপর ম্লান কন্ঠে বললো,’তারমানে আসবে না তুমি? ঠিক আছে। আমি তাহলে রাখি।’ কথা শেষ করে ফোন কেটে দিলো সে। ফোন হাতে নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো আশরাফি। আবারো একরাশ শূন্যতা এসে ঘিরে ধরলো তাঁকে। বুকের ভেতরে পিনপিন শুরু হলো। মেহের তাঁকে এ-কি অসহ্য যন্ত্রণা ফেলেছে। না পারছে সইতে না পারছে কিছু বলতে। পৃথিবীতে এর চাইতে ভয়ংকর এর চাইতে যন্ত্রনার আর কিছু হতেই পারে না। কারণ এই যন্ত্রনার কোন প্রতিকার নেই! নিরবে নিভৃতে সহ্য করে নিতে হয় কেবল!
.
.
.
চলবে