মধুবালা,২০,২১

0
607

#মধুবালা,২০,২১
অরিত্রিকা আহানা
#পর্বঃ২০

মুখোমুখি বসে আছে সোহাগ, আশরাফি এবং নাইম। আশরাফির চোখে উৎকন্ঠা! বন্ধুরা তাঁর কথাগুলো বিশ্বাস করেছে কিনা সেটা নিয়ে টেনশনে আছে। বাকি দুজনের মুখ গম্ভীর। বোঝাই যাচ্ছে ইতোপূর্বে আশরাফির বলা কথাগুলো ঠিক হজম করে উঠতে পারে নি তারা। দুজনেই গভীর চিন্তায় নিমগ্ন! আশরাফির বুকের ভেতরটা ঘড়ির কাটার মত টিকটিক করছে! বন্ধুরা কিছু বলছে না কেন?
নিরবতা সোহাগই প্রথম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,’নীলাকে কি জবাব দিবি?’

কিঞ্চিৎ ভরসা পেলো আশরাফি। তবে অস্বস্তি পুরো গেলো না। আসল ভয় নাঈমকে নিয়ে। একটা না একটা খুঁত সে বের করবেই। তারওপর মেহেরকে তো সহ্যই করতে পারে না। তাঁর সূচালো দৃষ্টির বিপরীত একটুখানি হাসলো আশরাফি। সোহাগের কথার জবাবে আত্মবিশ্বাসী গলায় বললো,’ওকে আমি ম্যানেজ করে নিতে পারবো। তোরা দুজন শুধু আমার পাশে থাকলেই হবে।’

জবাব দিলো না সোহাগ। যদিও ভেতরে ভেতরে তাঁর কোন আপত্তি নেই তথাপি নাঈমের বক্তব্য শোনার অপেক্ষা রইলো। নাঈম ভেবেচিন্তে সঠিক জবাব দিতে পারবে।

নাঈম পূর্বের মতই গম্ভীর মুখে বসে আছে। মধুর বিয়ে হয় নি কথাটা সে বিশ্বাস করতে পারছে না। তাঁর ধারণা আবারো নতুন করে কোন খেলা খেলছে মধু। এমনিতেও সে আগে একবার আশরাফিকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো সে। এত সহজে তাঁর ওপর বিশ্বাস করা যায় না। হতে পারে টাকার জন্যই আরমানকে ছেড়ে এখন আবার আশরাফিকে ধরার পায়তারা করছে! বিচিত্র কিছু নয়!

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো নাঈম। আশরাফির মা, বাবা কেউ নেই। মেহের চলে যাওয়ার পর অনেক কষ্ট পেয়েছে সে। নাঈম চায় না তাঁর বন্ধুটিকে নতুন করে আবার কোন কষ্ট পাক। সে চায় তাঁর বন্ধুটি যেন সবসময় ভালো থাকে। এমন একজনকে নিজের জীবন সঙ্গিনী হিসেবে বেছে নেয়, যে তাঁর সমস্ত সুখ, দুঃখে একান্ত আপন জনের মত পাশে দাঁড়াতে পারবে। কিন্তু মেহেরের ওপর সেই বিশ্বাসটা নেই নাঈমের। একমাত্র নীলাই পারতো আশরাফির পুরোনো দুঃখগুলো দূর করে তাঁর সঙ্গে সুস্থ একটা সম্পর্ক গড়ে তুলতে। পাগলের মত ভালোবাসে আশরাফিকে মেয়েটা। অথচ আশরাফি? সবচেয়ে বড় অবিচারটা কিনা তার সঙ্গেই করছে। চুপ করে রইলো সে। আশরাফি বন্ধুর চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললো,’কিছু বলছিস না যে?’

-‘আমি আর কি বলবো? তোর লাইফ, তোর ডিসিশন।’, হতাশ শোনালো নাঈমের কন্ঠস্বর।

আশরাফি বুঝলো এসব অভিমানের কথা। পুনরায় নরম গলায় বললো,’প্লিজ দোস্ত। মেহেরের কথাটা একবার ভাব?’

-‘ওর কথা ভাবার জন্য আমি বসে নেই রাফি। একান্তই যদি কাউকে নিয়ে ভাবতে হয় তাহলে আমি তোর কথা ভাববো। কারণ তুই আমার বন্ধু। ওর কথা কেন আমি ভাবতে যাবো?’, রুক্ষস্বরে জবাব দিলো নাঈম।

আশরাফি তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে বললো,’ঠিক আছে আমার জন্যই নাহয় ওর একটু কথা ভাবলি?’

-‘সেটা তো ভাবছিই। আর সেইজন্যই বলছি, ঐ মেয়ে কোন দিন থেকেই তোর উপযুক্ত নয়।’

-‘আমি তো তোকে বলেছি আরমানের সঙ্গে ওর বিয়ে হয় নি। ওকে জোর করে আটকে রেখেছে শয়তানটা।’

-‘ওকে দেখে কিন্তু আমার একবারও মনে হয় নি আরমান ওকে জোর করে আটকে রেখেছে। জোর করেই যদি আটকে রাখে তবে কেন আরমানকে ও নিজের স্বামী বলে পরিচয় দিলো?’

আশরাফি অসহায় চোখে সোহাগের দিকে চাইলো। সোহাগও বিভ্রান্ত! নাঈমের যুক্তিটা ফেলে দেওয়ার মতন নয়।

নাঈম গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,’তুই ওর ভালোবাসায় অন্ধ। তাই ওর সব কাজ তোর কাছে জাস্টিফাইড। কিন্তু সবার কাছে এমনটা নাও হতে পারে। তুই তো গিয়েছিলি ওর বাপের কাছে কই তিনি তো মেয়ের অবস্থার কথা জানার পরেও একবারও মেয়েকে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলেন নি? কেন বলেন নি জানিস?’

-‘সমাজের ভয়ে।’

নাঈম ব্যঙ্গাত্মক হাসলো। বললো,’ওসব বাহানা। সবাই তোর মত বোকা নয়। উনি ঠিকই বুঝেছেন উনার মেয়ে কেমন!’

আশরাফি হতাশমুখে চেয়ে রইলো। সেদিন মধুর ওখান ফিরে ইরতিয়াজ সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলো সে। ভেবেছিলো নিজের মেয়ে ঐ নোংরা জায়গায় আছে শুনলে তাঁকে ফিরিয়ে আনার জন্য বাবা হিসেবে নিশ্চয়ই সহযোগিতা করবেন তিনি। কিন্তু হলো তাঁর উল্টো। সামাজিকভাবে ছোট হওয়ার ভয়ে তিনি তাঁর জীবিত কন্যাকে উল্টো মৃত বলে ঘোষণা দিলেন। বিস্ময়ে, রাগে, হতবম্ভ হয়ে গিয়েছিলো আশরাফি!
আপন জন্মদাতা পিতা কি করে এতটা স্বার্থপর হতে পারে? এতদিন মা বাবা না থাকায় নিজেকে হতভাগা ভাবতো সে কিন্তু মেহের তো তাঁর চাইতেও বেশি হতভাগা। ওর তো বাবা থেকেও নেই!
ইরিতিয়াজ চৌধুরীর প্রতি একরাশ ঘৃণা আর ক্রুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বেরিয়ে এসেছিলো আশরাফি। মনে মনে হাজার বার থুতু নিক্ষেপ করেছিলো লোকটার নির্লজ্জ, নিষ্ঠুর স্বার্থপরতার প্রতি! কিন্তু আফসোস এর চেয়ে বেশি কিছুই করতে পারলো না সে। কারণ শত হলেও লোকটা মেহেরের বাবা!

বন্ধুর বিষণ্ণ মুখপানে চেয়ে নাঈম মোলায়েম কন্ঠে বললো,’মেহেরের সাথে আমার ব্যক্তিগত কোন সম্পর্ক নেই। কোন শত্রুতাও নেই। যেটুকু চিনি সেটা কেবল তোর খাতিরে।
তাই আমার কাছে যেটা যুক্তিসঙ্গত, যেটা ঠিক আমি সেটাই বলেছি। বিশ্বাস কর, তুই আবার একই ভুল করছিস রাফি। ওই মেয়ে আবারো বড়সড় একটা ব্লাফ দেবে তোকে।’

-‘কেন তোর এসব মনে হচ্ছে?’, অধৈর্য, মৌন শোনালো আশরাফি কণ্ঠস্বর।

-‘কারণ ঐ মেয়ে ঘর করার মতন মেয়ে নয়। তুই নিজেই ভেবে দেখ, তোর সঙ্গে ভালোবাসার নাটক করে শেষে বিয়ে করলো গিয়ে বাবার পছন্দের পাত্রকে। সেই ছেলে মারা যাবার পর নতুন করে আরমান। তারপর আবার ঘুরে ফিরে তোর কাছেই আসতে চাইছে। আমি নিশ্চিত ঐ মেয়েই তোকে কথাগুলো বলার জন্য সুলেখাকে শিখিয়ে দিয়েছে! খোঁজ নিলে দেখা যাবে সত্যিই আরমানের বিয়ে হয়ে গিয়েছে ওর!’

-‘ও তো এখনো বলছে আরমানের সঙ্গে ওর বিয়ে হয়েছে। ওকে যেন ওর মত থাকতে দেই। আমার কাছে ফিরে আসার কথা তো একবারও বলে নি।’

-‘এসব করে তোর কাছে মহৎ হতে চাইছে। জানে নিজমুখে বললে তুই সন্দেহ করবি তাই।’

-‘তুই আমাকে কি করতে বলছিস?’

-‘নাথিং। আমার যা বলার ছিলো বলে দিয়েছি। তুই কি করবি সেটা তোর ব্যপার। আফটার অল, আমরা কেবল তোর বন্ধু, গার্জিয়ান নই। তোর ব্যপারে মতামত দেওয়ার অধিকার হয়ত আমাদের আছে কিন্তু সিদ্ধান্ত দেওয়ার অধিকার আমাদের নেই।’

মধুকে নিয়ে প্রতিনিয়ত নাঈমের এমন গা ছাড়া কথাবার্তাগুলো আর সহ্য করতে পারছিলো না আশরাফি। চুলের মুঠো শক্ত করে চেপে ধরে অধৈর্য কন্ঠে বললো,’একটা মেয়ে ভাগ্যের দোষে নোংরা একটা জায়গায় গিয়ে পড়েছে। তাই বলে ওর কষ্টের কোন দাম নেই? তোরা কি চাস ও মরে যাক?’

-‘ভাগ্যের দোষে? ভাগ্যের দোষে তোকে ছেড়ে গিয়েছে? আশ্চর্য! তুই এটা বললি? আই কা’ন্ট বিলিভ দিজ!, হতবিহ্বল শোনালো নাইমের কণ্ঠস্বর। বিস্মিত কন্ঠে বললো,’অথচ তোকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো বলে আজ পর্যন্ত ঐ মেয়েকে ক্ষমা করতে পারি নি আমি। কারণ তোর কষ্টগুলো নিজের চোখে দেখেছি। কিন্তু এখন তো দেখছি যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর। তুই তো সব ভুলে গিয়েছিস! ঐ মেয়ে তোর সঙ্গে কি কি করেছে সব ভুলে গেছিস তুই। বাহ! ভালো। মহৎ প্রেমিক! খুব ভালো।’, শেষটায় অনেকটা ঠাট্টার মত শোনালো নাঈমের কণ্ঠস্বর।

রাগতে গিয়েও নিজেকে শান্ত করে নিলো আশরাফি। তিরস্কারটা গায়ে মাখলো না। বন্ধুর রাগটা ঠিক কোনজায়গায় এবার বোধহয় বুঝতে পেরেছে সে। চোখ বন্ধ করে সৃষ্টিকর্তার কাছে মনে মনে একটাই প্রার্থনা করলো সে তাঁর বন্ধুটি যেন সারাজীবন এমনই থাকে। তাঁকে যেন কোনদিন আশরাফির মত কষ্ট সহ্য করতে না হয়। নতুবা সেও বুঝতো ,কেন মেহেরকে ব্রোথেলে দেখে আশরাফির রাতের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছে! কেন তাঁকে না পাওয়ার যন্ত্রণায় প্রতিনিয়ত ছটফট করছে আশরাফি? কেন এতকিছুর পরেও পাগলের মতন মেহেরকেই চায় সে! কিন্তু তবুও আশরাফি কক্ষনো চাইবে না তাঁর বন্ধুর জীবনে কখনো এমনটা ঘটুক। কারণ, এই যন্ত্রণা বড় মারাত্মক! মৌমাছির হুলের মত প্রতিনিয়ত দংশন করে। এখনো নাঈম পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখি মানুষ! কারণ ভালোবাসার যন্ত্রণা তাঁকে উপলব্ধি করতে হয় নি। সারাজীবন যেন এমনটাই থাকে!’

নাঈমের কথার জবাবে শান্ত সুরে বললো,’যাকে নিয়ে তোদের এত অভিযোগ সে কিন্তু মুখ বুঝে সব মেনে নিয়েছে। একবারও আমার কাছে ফিরে আসার কথা বলেনি। আমি ওর গায়ে পর্যন্ত হাত তুলেছি তবুও সত্যিটা স্বীকার করে নি। অথচ তোরাও জানিস ও যদি মুখফুটে একবার ফিরে আসার কথা বলতো পৃথিবীর অন্য কারো কথা শোনার প্রয়োজন আমার পড়তো না। এর পরেও কেন তোর মনে হয় ওর মহৎ সাজতে চাইছে?’

নাঈম হাল ছেড়ে দিয়ে বললো,’আমি আর এই বিষয়ে কিছুই বলবো না। তুই হয়ত আমার ওপরে বিরক্ত হচ্ছিস কিন্তু বিশ্বাস কর, তুই যদি ওকে নিয়ে সত্যি সুখে থাকতে পারিস আমার কোন দ
আপত্তি নেই। কিন্তু আমার ভয় হয়! আবারো যদি আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে?

এই প্রশ্নের জবাবে আশরাফির তড়িৎগতিতে উত্তর দিয়ে বললো,’ঘটবে না। কারণ আমি জানি, মেহের এখনো আমাকেই ভালোবাসে!’


-‘আমার বিরুদ্ধে নারী ও শিশু অপহরণের মামলা করেছে সে।’ হুঙ্কারর দিয়ে উঠলো আরমান। ভয়ে কেঁপে উঠলো মধু। ‘সে’বলতে আশরাফিকেই বুঝিয়েছে আরমান। এত করে তাঁকে বারণ করে দেওয়ার পরেও ঘুরেফিরে সাপের লেজে পা দিয়েছে আশরাফি। আরমানের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেছে।
আরমানের চোখজোড়া ভয়ানক লাল হয়ে আছে। নির্দেশের সুরে বললো,’জিনিসপত্র গোছাও। আজই বাড়ি ছাড়বো আমরা!’

-‘কিন্তু যাবো কোথায়?’,অবাক হলো মধু।

-‘নতুন একটা বাড়ি জোগাড় হয়েছে।’ গম্ভীর গলায় জবাব দিলো আরমান। তাঁর ভেতরে রক্ত টগবগ করছে। সামনে পেলে এইমুহূর্তেই আশরাফিকে খুন করতো সে। ইতোমধ্যে লোকও লাগিয়ে দিয়েছে তাঁকে মারার জন্য। মধু এসব জানে কিচ্ছু না। কিন্তু আরমানের কথাবার্তায় সন্দেহ হচ্ছে তাঁর। আরমান মানুষ ভালো নয়! মধুর সঙ্গে কিছু না করলেও এই ঘটনার পরে আশরাফিকে সে ছেড়ে দেবে না। তাই আগে থেকেই সাবধান করে দিতে হবে আশরাগি। এদিকে আরমানও আছে অন্য চিন্তায়। এখন আর মধুকেও বিশ্বাস করতে পারছে না সে। কি জানি আশরাফির সাথে হয়ত সেও জড়িয়ে আছ! অতএব বুঝে শুনে কাজ করতে হবে। নতুন বাড়ির ঠিকানাটা এইমুহূর্তে বলা যাবে না মধুকে। মধুও জিজ্ঞেস করলো না।
সুলেখাকে নিয়ে চুপচাপ ঘরে চলে এলো। আরমানকে নিয়ে অনেক বেশি ভয় হচ্ছে তাঁর। লোকটা যদি সত্যি সত্যি আশরাফির কোন ক্ষতি করে দেয়?
অসহ্য লাগছে মধুর! যাওয়ার সময় আশরাফির হাতে পায়ে ধরার বাকি রেখেছিলো সে। কত করে বুঝিয়েছে এবার গেলে আর যেন কখনো এখানে না আসে। মধুর কথা যেন মাথা থেকে ফেলে দেয়! কিন্তু যেই কপাল যে মাথা! ঘুরেফিরে নিজের মর্জিমতনই কাজ করেছে আশরাফি। সুলেখা কাঁদোকাঁদো গলায় বললো,’এবার কি হবে মধুমা?’

মধু জবাব না দিয়ে বললো,’কি আর হবে। মরণ ছাড়া দেখছি আমার আর উপায় নেই।’

অতঃপর সুলেখাকে দরজার বাইরে পাহারায় বসিয়ে আশরাফিকে ফোন করলো সে। দুবার রিং হওয়ার পর রিসিভ করলো আশরাফির। ‘ব্যস্ত আছি’ বলে সঙ্গে সঙ্গে ফোনটাও কেটে দিলো। মধুর টেনশনে হাত পা কাঁপছে। বুক ধড়ফড় করছে! আশরাফি নিজেও জানে না কতটা ভয়ঙ্কর খেলায় নিজেকে জড়িয়েছে সে। পুনরায় ফোন করলো।

আশরাফি রিসিভ করে নরম গলায় বললো,’ব্যস্ত আছি তো। ফ্রি হয়েই ফোন দিচ্ছি তোমাকে!’

সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিবাদ করে উঠলো,’খবরদার ফোন রাখবে না বলছি। কথা আছে তোমার সঙ্গে!’

আশরাফি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ক্লান্ত স্বরে বললো,’আচ্ছা রাখবো না। বলো কি বলবে?’

-‘আরমানের নামে মামলা করেছো কেন তুমি?’

-‘তুমি আমাকে বাধ্য করেছো।’

-‘আমি?’ অবাক হলো মধু। তারপর না থেমেই বললো,’আমি তোমাকে বলেছি তুমি ওর নামে মামলা করো?’

-‘না বলো নি। কিন্তু তুমি যদি ভালোয় ভালোয় আমার সঙ্গে ফিরে আসতে রাজি হতে তাহলে আর এই ঝামেলাটা হতো না। দরকার হলে আমি আরমানকে টাকা দিয়ে দিতাম! ওর মুখবন্ধ থাকতো।’

-‘তুমি ওর নামে মামলা করলে যে আমি তোমার কাছে ফিরে আসবো এই কথা তোমাকে কে বলেছে?’

-‘কেউ বলা লাগে না। ও একবার জেলে গেলেই তোমার সব নাটক শেষ হয়ে যাবে।’

-‘ও যে তোমাকে মারার জন্য লোক লাগিয়েছে সেটা জানো?’, আন্দাজেই ঢিলটা ছুঁড়লো মধু।

-‘তাই নাকি?’ হাসলো আশরাফি।
মধু অসহ্য রাগে, অভিমানে ফুঁপিয়ে উঠে বললো,’তুমি কি চাও? আমি মরে যাই?’

আশরাফি ফের হাসলো। বললো,’এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমার সঙ্গে সোহাগ আছে, নাঈমও আছে। মারা এত সোজা নাকি? এনিওয়ে কান্না শেষ হলে ফোনটা রাখো। আমার হাতে এখন সময় নেই।’

-‘কোন মহৎ কাজটা করছো শুনি?’

-‘সেটা একটু পরই বুঝতে পারবে।’ ফোন রেখে দিলো আশরাফি। মধু হতবম্ভ হয়ে বসে রইলো। আবার নতুন করে কি ঝামেলা বাঁধানো চেষ্টা করছে আশরাফি? উফ! ভয়ে দমবন্ধ হয়ে আসছে মধুর! চোখবন্ধ করে প্রার্থনা করলো সে,’ইয়া আল্লাহ! তুমি ওকে রক্ষা করো। ওর যেন কোন ক্ষতি না হয়।’
.
.
.
চলবে

#মধুবালা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২১

নিচতলায় পুলিশ এসেছে। মেয়েরা সব আতংকিত চেহারা নিয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যদিও ইতোপূর্বে আরো একবার এই ব্রোথেলে পুলিশ এসেছিলো। কিন্তু নতুনদের কাছে এবারই প্রথম। তাই একটু বেশিই ভয় পাচ্ছে তাঁরা। পুলিশ এসেছিলো, প্রায় তিনচার বছর আগের ঘটনা। একটা নারীবাদী সংগঠন থেকে মামলা করা হয়েছিলো আরমানের বিরুদ্ধে। এরেস্ট ওয়ারেন্টও জারি হয়েছিলো কিন্তু শেষপর্যন্ত কোন লাভই হয় নি। পুলিশ আসার আগেই পালিয়েছিলো আরমান। এসব অপরাধীদের ইনফরমেশন দেওয়ার লোকের অভাব নেই। জায়গায় জায়গায় লোক ফিট করা থাকে তাদের। সময় মতন ফোন করে পুলিশ আসার খবরটা জানিয়ে দিয়েছিলো। এবারেও তাঁর ব্যতিক্রম হয় নি। পুলিশ আসার আগেই গোপন সূত্রে খবরটা পৌছে যায় আরমানের কানে। এবং আবারো পালায় সে। হাতে সময় খুব কম থাকায় মেয়েদের কাউকে সঙ্গে নিতে পারে নি। অবশ্য নেওয়ার বিশেষ প্রয়োজনও মনে করে নি। কি দরকার? শুধুশুধু সময় নষ্ট!

আপাতত কয়দিন গা ঢাকা দেওয়াটাই উত্তম। তারপর মোটা অংকের একটা অ্যামাউন্ট খরচ করতে পারলেই এসব পুলিশি ঝামেলা মেটানো তাঁর বাঁ হাতের খেল। এর আগেরবারও তাই করেছিলো। অবশ্য এবার যদিও শুরুতে মেয়েদেকে সাথে নিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করেছিলো কিন্তু সময় স্বল্পতার জন্য সেটা আর হয়ে উঠে নি।

এদিকে তাঁর খোঁজ না পেয়ে মেয়েদেরকে জেরা শুরু করে দিয়েছে পুলিশ। ঠিক জেরা অবশ্য নয়, ওদের নিজেদের সম্পর্কে টুকটাক কিছু প্রশ্ন। এই যেমনঃ কি করে ওরা এখানে এসেছে, কতবছর ধরে এখানে আছে, কতজন আছে এইসব টুকটাক প্রশ্ন।
মধুর ইনকয়্যারি শেষ হতেই বিরক্তমুখে উপরে উঠে গেলো সে। মনে মনে আশরাফির ওপর খুব রাগ হলো। এত অল্প সময়ে আরমানকে ধরার জন্য পুলিশ পাঠাবে আশরাফি একথা স্বপ্নেও ভাবে নি মধু! তারওপর নিজেও আসে নি। একটা ফোনও করে নি! রাগে, দুশ্চিন্তায় মুখ কালো হয়ে গেলো মধুর। যাওয়ার সময় আরমান বারবার করে শাসিয়ে গেছে আশরাফিকে সে ছাড়বে না। এর শেষে দেখে নেবে।
কিন্তু মধু তো জানে আশরাফি হাল ছাড়ার পাত্র নয়। একবার যখন স্থির করে নিয়েছে আরমানকে জেলে পাঠাবে তখন পাঠিয়েই ছাড়বে। কিন্তু এই চক্করে যে তাঁর নিজের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে সে কথাটা একবারও ভাবছে না। উপরন্তু মধুর নিষেদগুলোকেও হালকাভাবে নিচ্ছে।

তাই এতকিছুর পর টেনশনে আর নিজেক স্থির রাখতে পারলো না মধু! তাঁর জন্য আশরাফির কোন ক্ষতি হলে নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করবে সে। এই কথাটা আশরাফি কেন বুঝতে চায় না? কেন নিজের বিপদের কথাটা একবারও ভাবছে না সে? পাশের পানির জগ থেকে ঢকঢক করে পানি খেলো মধু। তাড়াহুড়া করে আশরাফির নাম্বারে ডায়াল করলো।


মধুর ফোনে অপেক্ষাতেই ছিলো আশরাফি। রিং হতেই মুখ হাসি ফুটে উঠলো তাঁর। রিসিভ করে হাসিমুখে টেনে টেনে বললো,’হানিইই? সারপ্রাইজটা কেমন দিলাম?’
রাগে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলো না মধু। সব ব্যপারে আশরাফির গোয়ার্তমি তাঁর একদমই পছন্দ নয়। মিনিট খানেক চুপ থেকেই তিক্ত কণ্ঠে বললো,’তুমি পুলিশ পাঠিয়েছো কেন?’

-‘সেটা তো তুমি ভালো করেই জানো!’

-‘এর ফলাফল কি হতে পারে একবারও ভেবে দেখেছো? আরমান তোমাকে ছেড়ে দেবে?’

-‘ওর কথা কে ভাবে? আমার বয়েই গেছে ওর কথা ভাবতে। আমি তো শুধু তোমার কথা ভাবছি। কবে তোমাকে ঐ নরক থেকে বের করে আনতে পারবো সেই কথা।’

-‘আমি তোমাকে কতবার বলেছি আমি ফিরবো না?’

-‘পাগলের কথা আমি কানে নেই না।’

-‘আমি পাগল?’ তেঁতে উঠলো মধু। আশরাফি ফোনের ওপাশ থেকে মিটিমিটি হাসলো। মধু না থেমেই বললো,’আমি মোটেও পাগল নই। আমি যা বলেছি একদম ঠিক বলেছি। পাগল তুমি! তুমি আমার কথাগুলো বুঝতে পারো নি।’

-‘বুঝতে যখন পারি নি, তখন ছেড়ে দাও না। কেন বারবার কানের কাছে একই কথা ঘ্যানঘ্যান করছো? নিজের ওপর বিশ্বাস নেই? না থাকলে এত বড়বড় কথা কিসের? কেন বাধা দিচ্ছো আমাকে? আমার যা মন চায় আমি তাই করবো।’

-‘ঠিক আছে। করো, তোমার যা মন চায় তাই করো। কিন্তু আমি যখন বলেছি আমি ফিরবো না তারমানে আমি ফিরবো না।’

-‘দেখাই যাক। কার দম কতদূর!’, খোঁচাটা হাসিমুখেই দিলো আশরাফির। মধু রাগে, অভিমানে দাঁতেদাঁত খিঁচে বললো,’তুমি প্রচন্ড নির্লজ্জ, বেহায়া, আত্মসম্মানহীন একজন মানুষ! তোমার মানসম্মান বলতে কিচ্ছু নেই। নতুবা এতবার করে বলার পরে আঠার মতন পেছনে লেগে থাকতে না! কি চাও টা কি তুমি? আমি নিরুদ্দেশ হয়ে যাই?’

-‘যাওয়ার সময় আমাকে সঙ্গে নিলেই হবে।’, ওপাশ থেকে চাপা হাসির শব্দ শোনা গেলো আশরাফির!

-‘তোমার কি মনে হয় আমি তোমার সঙ্গে ঠাট্টা করার জন্য ফোন করেছি?’

চুপ করে গেলো আশরাফি। ভদ্র ছেলের মত ফোনের ওপাশ থেকে মাথা দোলালো সে। মধু কিন্তু থেমে রইলো না। ফোনের ওপাশ থেকে রীতিমত ঝড় বইয়ে দিয়েছে সে। আশরাফি ফের হাসলো। এত অধিকার নিয়ে ঝাড়ি দেওয়ার ক্ষমতা তো কেবল মধুরই আছে! তাকে নিরুত্তর দেখে মেজাজ আরো চটে গেলো মধুর। ধমক দিয়ে বললো,’কথা বলছো না কেন?’

-‘কি বলবো?’,

‘আমার মাথা তোমার মুন্ডু!’ হাল ছেড়ে দিলো মেহের। আশরাফি কৃত্রিম অবাক হওয়ার ভান করে বললো,’তোমার মাথা আমার মুন্ডু হতে যাবে কেন? তোমার মাথা তোমার, আমার মাথা আমার! তোমার সিদ্ধান্ত তোমার, আমার ভালোবাসা আমার।’ মেহের হতাশ কন্ঠে বললো,’এমন নির্লজ্জ মানুষ আমি জীবনে দেখিনি!’

-‘দেখবে কি করে? আমাকে ছাড়া অন্যকারো দিকে নজর পড়ে নাকি তোমার? বুঝি, বুঝি আমি সবই বুঝি।’

-‘লজ্জা শরম সত্যিই নেই তোমার তাই না?’

-‘এভাবে কেন বলছো মেহের? একেবারেই যে লজ্জা নেই তা কিন্তু নয়। একটু হলেও বোধহয় আছে! ‘..

-‘চুপ! একদম চুপ।’ সজোরে ধমক দিলো মধু।

আশরাফি হাসলো। বললো,’সুযোগ পেয়ে খুব ধমকানো হচ্ছো আমাকে! যাকে ভালোবাসো না তাঁকে ধমকানোর অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে হ্যাঁ?’

থমকে গেলো মধু। এই কথাটা কি করে বলতে পারলো আশরাফি? মধু তাঁকে ভালো বাসে না? অতঃপর হতাশভাবে কিছুক্ষণ হাসলো। বললো,’যে তোমাকে ভালোবাসে না তাঁকে নিয়েই বা কিসের এত মাথাব্যথা তোমার?’

কথাটা অভিমানের। আশরাফি বুঝলো। মনে মনে হাসলো সে। ফিসফিস করে বলতে ইচ্ছে হলো,ভালো তুমি আমাকে বাসো মেহের! কিন্তু মুখে বলতে পারো না।’ বললো না। মুচকি হেসে বললো,’এতকিছু আমি জানি না। আমি
শুধু সুযোগের অপেক্ষায় আছি। কবে আমি সুযোগটা পাবো আর ভালো মতন তোমাকে একটা শিক্ষা দিতে পারবো যাতে তুমি দিনরাত চব্বিশঘন্টা, উঠতে বসতে কেবল আমার নাম জপ করবে!’

-‘সেই সুযোগ তোমার জীবনেও আসবে না। আরমানের ভাড়া করা গুন্ডারা যখন ধড় থেকে মুন্ডুটা আলাদা করে দেবে তখন বুঝবে কত ধানে কত চাল!’

-‘কি বললে তুমি?’, ঠাট্টার সুরেই প্রশ্নটা করলো।

-‘কি বললাম?’, বলতে বলতেই কেঁদে ফেললো মধু। আশরাফিকে কোনভাবেই সিরিয়াস করতে না পেরে মুখ ফস্কে কথাটা বেরিয়ে গিয়েছিলো তাঁর। শ্রুতিগোচর হতেই বুকটা ধক করে উঠলো। অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠলো। ঝোঁকের বশে ভয়ঙ্কর একটা অলক্ষুণে কথা বলে ফেলেছে সে! হতাশা, গ্লানিতে নিজের মাথার চুল টেনে ধরলো। চোখবন্ধ করে মিনতি ভরা কন্ঠে আর্তনাদ করে উঠলো সে,’ইয়া আল্লাহ! কেন তুমি আমার মুখ দিয়ে এমন কথা বের করলে?’ অতঃপর চাপা কান্নায় ডুঁকরে উঠলো সে।
আশরাফি হো হো করে হেসে উঠে বললো,’মধুবালার হলোটা কি? সে কেন একটা আত্মসম্মানহীন, নির্লজ্জ, বেহায়া পুরুষ মানুষের জন্য কাঁদছে? হায়! অধমের বুঝি এত ক্ষমতা?’ মনে মনে বললো,’ঠিক হয়েছে। অনেক কষ্ট দিয়েছো আমাকে। এবার আমার জন্য একটু কাঁদো।’

মধুর ফোন ফেলে বালিশে মাথা ঠেকিয়ে হাউমাউ করে কান্নাজুড়ে দিলো। তাঁর মুখ থেকে কি করে এই অলক্ষুণে কথাটা বেরোলো? মনে মনে হাজার বার সৃষ্টিকর্তা কাছে মাফ চাইলো সে। অভিসম্পাত করলো নিজেকে। কিন্তু কান্না কিছুতেই থামলো না। আশরাফি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ফোন কেটে দিলো। তারপর আবার কল ব্যাক করলো। ধরলো না মধু। যেমনি বসে ছিলো তেমনিভাবে চোখের জলে বিছানায় বালিশ ভিজিয়ে ফেললো। আবার ফোন দিলো আশরাফি। বেশ কিছুক্ষণ পর রিসিভ করলো মধু।

-‘কি ব্যপার? কথা বলছো না কেন?’

এতক্ষনেও কান্না থামে নি মধুর। উপরন্তু চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো বুক চিরে। ফুঁপিয়ে উঠলো সে। আশরাফি ইচ্ছাকৃত ভাবে তাঁকে ভয় দেখিয়ে বললো,’হায়! হায়! এবার কি হবে মেহের? তোমার কথাটা যদি সত্যি হয়ে যায়? সত্যি সত্যি যদি আমি মরে যাই?’

মধু জবাব না দিয়ে অসহায়ের মত ডুঁকরে উঠলো। আজ আর আশরাফির ঠাট্টা সইলো না! যত কঠিনই হোক, নারীহৃদয় বলে কথা। আকস্মিক ভয়টা কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারলো না সে। আশরাফির কথা শুনে কান্নার বেগ আরো বেড়ে গেলো। কাঁদতেই বললো,’কক্ষনো না।’

আশরাফি কন্ঠস্বরে কৃত্রিম দুঃখভাব নিয়ে বললো,’হতেও তো পারে মেহের। মানুষের মৃত্যুর তো কোন বিশ্বাস নেই। এইজন্যে বলি চলো দুজনে সংসার করি। তারপর আর মরে গেলেও আফসোস থাকবে না!’

মধু কাঁদতে কাঁদতেই অনুনয় করে বললো,’দোহাই তোমার! আমার ভুল হয়ে গেছে। এমন কথা আমি আর কোনদিন বলবো না। এবার আমাকে একটু শান্তি দাও প্লিজ! আমি আর পারছি না!’

-‘শান্তি? শান্তি আশা তুমি ছেড়ে দাও । আমাকে কষ্ট দিয়ে তুমি শান্তিতে থাকবে এটা আমি কি করে মেনে নেবো? যত যাই করো না কেন আমার হাত থেকে তোমার নিস্তার নেই। এত সহজে তোমাকে আমি ছাড়ছি না।’ তারপর মধুর কিছু বলার অপেক্ষা না করেই ফোন রেখে দিলো সে। মধু ফোন রেখে আবারো বিছানায় লুটিয়ে পড়লো। অবরুদ্ধ ক্রন্দনে বুক ভেসে গেলো তাঁর। অদূরে দাঁড়িয়ে সবই দেখছিলো সুলেখা। সেও নিরবে অশ্রু বিসর্জন করে আড়ালে সরে গেলো।


দুদিন বাদের ঘটনা, দরজায় টোকার আওয়াজ শুনে ভেতর থেকে সাড়া দিলো মধু,’কে? ‘সদ্য গোসল সেরে নিজের ঘরে শাড়ি পরছিলো সে। মাথায় তোয়ালে প্যাঁচানো।

-‘আমি!’ হাসিমুখে জবাব দিলো আশরাফি।

ভেতরে ঢুকার জন্য অগ্রসর হচ্ছিলো সে, মধু তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললো,’খবরদার এখন ভেতরে ঢুকবে না! আমি ব্যস্ত আছি।’

আশরাফি ভাবলো তার ওপর রাগ করে ‘না’ বলেছে মধু। তাই নিষেধ উপেক্ষা করে ভেতরে ঢুকে গেলো সে। কিন্তু ভেতরে ঢুকতেই হতবুদ্ধি! আকস্মিক লজ্জায় শরীরটা শিরশির করে উঠলো। উল্টোদিকে ঘুরে শাড়ি পরছে মধু। তাঁর শাড়ির আঁচল নিচে অবিন্যস্ত। তারওপর সবকিছু ছাপিয়ে আশরাফির নজর গিয়ে সোজা মধুর উন্মুক্ত ফর্সা কটিতে। মনোহারি এবং প্রচন্ড নেশাদায়ক! দ্রুত গলা খাঁকারি দিলো সে। ভূতগ্রস্তের ন্যায় চমকে উঠে পেছনে চাইলো মধু। অবাক হয়ে চেয়ে থেকে শাড়ির আঁচল টেনে নিয়ে এলোমেলো ভাবে গায়ে জড়ালো। মুখ ঘুরিয়ে নিলো আশরাফি। খাটের ওপর বসে গম্ভীরমুখে বললো,’এই অবেলায় গোসল করলে যে?’

বারণ করার পরেও ভেতরে ঢুকায় রাগ হলো মধুর। আশরাফির প্রশ্নটার জবাব বাঁকাভাবে দিয়ে বললো,’আমাদের আবার বেলা অবেলা কি?’

-‘আমাদের? আমাদের মানে? তুমি ঠিক কি মিন করতে চাইছো?’

-‘আমাদের মানে বোঝোনি? এখানে আমরা যেকজন মেয়ে আছি আমরা সবাই।’

আশরাফি ক্ষুব্ধ চোখে চাইলো। তাঁকে আঘাত করার জন্য প্রতিবারই ইচ্ছে করে এই কথাগুলো বলে মধু। জানে এসব কথায় কষ্ট পায় আশরাফি তবুও তাকে এসবই বলতে হবে। এবং প্রতিবারই এইধরণের কথাবার্তা শোনার পর নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে আশরাফি।
আজকে অতিরিক্ত রাগে কোন কথা বলতে পারলো না। চুপচাপ বসে রইলো। মধু আঁচলটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে চোখে কাজল দিলো। ঠোঁটে হালকা করে একটু লিপস্টিক দিতেই প্রতিবাদ করে বললো,’এত সাজগোজ কিসের জন্য?’

-‘তোমার জন্য!’ মুখ টিপে হাসলো মধু। তার কন্ঠে ঠাট্টার সুর। এবার আশরাফির রাগত মুখে গাঢ় অভিমানের ছায়া নামলো! সত্যিই যদি তাঁর আর মেহেরর বিয়েটা হতো তাহলে নিশ্চয়ই তাঁরজন্যেই এমন করে সাজতো মধু। বিষণ্ণ কন্ঠে বললো,’আমার জন্য যে নয় সে আমি জানি। কিন্তু আগে তো এত সাজগোজ করতে দেখি মি। আজকে হঠাৎ দেখছি তাই জিজ্ঞেস করলাম।’

-‘বললাম তো তোমার জন্য।’, আবার মুখটিপে হাসলো মধু। তার ঠাট্টা গায়ে মাখলো না আশরাফি। বরাবরই তাঁকে আঘাত করে সুখ পায় মধু। আজকে আর এই নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে মন চাইলো না। তারওপর চোখে কাজল দেওয়াতে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে মধুকে। তার কাজল চোখের মনি যেন আশরাফিকে উদ্দেশ্য করে আছে। মন্ত্রমুগ্ধের মত সেদিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে আশরাফি অনুরোধের সুরে বললো,’আমি তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরি মেহের?’

-‘আমাদের জড়িয়ে ধরার জন্য পারমিশন লাগে না।

মেজাজটা আবার বিগড়ে গেলো আশরাফির। যতই ভাবে মধুর সঙ্গে আর খারাপ ব্যবহার করবে না ততই তাঁকে রাগানোর জন্য উঠেপড়ে লাগে মধু। আশরাফির মনের অবস্থাটা একবারও বোঝার চেষ্টাই করে না। রাগত কন্ঠে বললো,’বেছে বেছে তোমার খারাপ কথাগুলো কেবল আমাকেই শোনাতে হবে?’

-‘হ্যাঁ। কারণ বেছে বেছে একমাত্র তুমিই পেছনে পড়ে আছো।’

-‘কি বলেছি আমি? সামান্য একটু জড়িয়ে ধরতেই তো চেয়েছি?’

-‘চাওয়াটাই তোমার ভুল হয়েছে। আমাদের কাছে কেউ চায় না। সবাই উশুল করে নেয়।’

রেগে গেলো আশরাফি। বললো,’বেশ পারমিশন যখন লাগে না। তাহলে আজকে আমার পাওনা আমি আদায় করে নেবো। অনেক সহ্য করেছি। এবার তোমার একটা শিক্ষা হওয়া দরকার।’ কথা শেষ করে সবেগে মধুর দিকে এগিয়ে গেলো সে। ক্ষিপ্তহস্তে শাড়ির আঁচল সমেত টান দিলো । ফলাফলস্বরুপ কাধের পিন আলগা হয়ে আঁচল খুলে গেলো। লজ্জা নিবারণের জন্য সঙ্গে সঙ্গেই আঁচল মুঠোয় চেপে ধরলো মধু। ভয়ার্ত বিস্ফোরিত নয়নে অবাক হয়ে বললো,’এসব কি ধরণের অসভ্যতা?’
আশরাফির রাগে দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে হাতের মুঠোয় চেপে রাখা আঁচল পুনরায় টান দিয়ে মধুকে কাছে নিয়ে এলো। তাঁর ক্ষীণ কটিতে সজোরে বলপ্রয়োগ করে বললো,’সভ্যতা শেখাতে আমি এখানে আসি নি। অসভ্যতা করতে এসেছি। বলেছিলাম না আমি ভালোর সঙ্গে ভালো। খারাপের সঙ্গে খারাপ! তবুও কেন আমাকে রাগালে?’

মধুর দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো সে। তাঁকে অবাক করে ফিক করে হেসে দিলো মধু। আশরাফি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। রাগে তাঁর গা দিয়ে আগুন বেরোচ্ছে আর এইমুহূর্তে মধু হাসছে? কাঠ কাঠ গলা প্রশ্ন করলো সে,’হাসছো কেন?’

সহজে থামে না মধুর হাসি। হাসতে হাসতেই বললো,’তোমার ক্ষমতা আমার জানা আছে!’

ছেড়ে দিলো আশরাফি। ঠেলে সরিয়ে দিলো সামনে থেকে। আঘাত করলে যে কষ্ট পায় তাঁকে আঘাত করায় আনন্দ আছে,আত্মতৃপ্তি আছে কিন্তু যে নিজেই আঘাতকে সাদরে আমন্ত্রণ জানায় তাঁকে কি করে আঘাত করা যায়? তথাপি নিজের ভাব বজায় রেখে বিড়বিড় করে বললো,’নির্লজ্জ! বেহায়া মেয়ে! ক্ষমতার কথা বলছে। ক্ষমতা যদি দেখাই তবে তোমার এই হাসি থাকবে?’

-‘সেকি তুমিই তো বললে? তোমার অধিকার, সরি পাওনা আদায় করে নেবে? তাহলে এখন কি হলো? সব রাগ ফুস হয়ে গেলো? ভীতু, হাদারাম!’

-‘ধ্যাৎ!’ রাগে মুখ বিকৃত করে বেরিয়ে যাচ্ছিলো আশরাফি। তাঁর অক্ষমতা নিয়ে মধুর এমন নিষ্ঠুর পরিহাস সহ্য হলো না। সঙ্গে সঙ্গেই মধু দুহাত মেলে পথ আগলে দাঁড়ালো।’
পরিণাম তাঁর দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আশরাফি। সতর্ক করে দিয়ে বললো,’এবার কিন্তু মার খাবে মেহের! সরো সামনে থেকে!’

-‘সরবো না। দেখি কত সাহস তোমার? মারবে? মারো!’

আশরাফি হাতজোড় করে বললো,’ভুল হয়ে গেছে আমার। মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে আর কখনো এমন কথা বলবো না। তোমার কথাই ঠিক। আমি একটু ভীতু, হাদারাম। দয়া করে এবারেও মত রেহাই দাও!’

তাকে বেকায়দায় ফেলতে পেরে মধুর হাসি পূর্বের চাইতে প্রশস্ত হলো। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে দিয়ে বললো,’রাগের বহর দেখে হেসে বাঁচি না। পারলে তো এক্ষুনি আমাকে কাঁচা গিলে খাও সে কি আর আমি বুঝি না। মুখ দেখলেই সব বোঝা যায়!’

-‘তুমি আমার সামনে থেকে সরো। আমি বেরোবো।’

-‘তুমি সরাও। তবে সরবো।’

আশরাফি এগিয়ে গেলো তাঁকে সরানোর জন্য। কিন্তু মধুর মাথাও তো দুষ্টুমি চেপেছে। আশরাফি তাঁকে যেপাশে সরাতে যায় তাঁর উল্টোদিকে সরে সে। এভাবে বেশ কয়েকবার এপাশ ওপাশ শেষে বাধ্য হয়ে তাঁকে কোলে তুলে নিলো আশরাফি। বিছানার ওপর বসাতে গেলে তাঁর গলা চেপে ঝুলে রইলো মধু। নামাতে গেলে নামলো না! আশরাফি হেসে ফেললো। বললো,’হঠাৎ করেই এত মাখামাখি কিসের জন্য বলতো? উদ্দেশ্যটা কি?’ জবাবে মধু রহস্যজনক ভাবে হেসে বললো,’আছে আছে, কারণ আছে। বসো তুমি। বলছি।’
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here