মধুচন্দ্রিমা
পর্ব ১
তানিয়া রহমান
ইরিন প্রায় আধঘন্টা যাবৎ ধানমন্ডি ২৭ নাম্বারের সানবিমস্ স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, জ্যামের কারণে রাপাপ্লাজার সামনে গাড়ী থেকে নেমে রুপুকে কোলে করে হেটে হেটে এসে স্কুল গেটে ঢুকিয়ে দিয়েছে তাও অনেকটা সময় আগে।ঘর্মাক্ত মুখে বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে।একবার ভাবছে সামনে এগিয়ে গিয়ে গাড়ীতে উঠবে আবার ভাবছে এখানে অপেক্ষা করি।এমন দোটানায় ইরিনের কানে এল সেই চেনা কন্ঠে চেনা শব্দ যা প্রায় দু বছর আগে হারিয়ে গিয়েছে
– কেমন আছ ইরি
ইরিন দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে দেখলো মনির দাঁড়িয়ে আছে, এ দু’বছরে চেহারা ভেঙ্গে গেছে অনেকটা, স্বাভাবিকের চাইতে বয়স মনে হচ্ছে বছর পাঁচেক বেড়ে গেছে। ভ্রু কুঁচকে ইরিন জিজ্ঞেস করল – আমাকে বলছেন
মনির হেসে বলল – আমাকে আপনি বলার কারণ
ইরিন কঠিন কন্ঠে বলল – অচেনা কাউকে আমি তুমি বলে অভ্যস্থ নই
মনির অবাক বিস্ময়ে বলল- আমি অচেনা!
ইরিন উত্তর দেয়ার আগেই একটা ব্লাক কালারের হোন্ডা ভেজেল এসে দাঁড়ালো।গাড়ীর ভিতর থেকে ড্রাইভার বাবলু বলল- ম্যাম তারাতাড়ি উঠে আসেন পিছনে লম্বা লাইন
ইরিন গাড়ীর দরজা খুলে উঠে বসলো।আর মনির দেখলো তারই ২৯ বছরের চেনা মানুষটা কেমন অচেনা হয়ে গিয়েছে।
গাড়ী এগিয়ে যাচ্ছে মিরপুরের দিকে, আজ ইরিনের বান্ধবী মোনার বাসায় গেট টুগেদার পার্টি। সেখানেই লাঞ্চ করার কথা সব বন্ধুদের।ইরিন ছুটে যাচ্ছে মোনার উদ্দেশ্যে।কিন্তু মনিরকে দেখার পর ইরিনের চোখ না চাইতেও জলে ভিজে যাচ্ছে বারংবার। সানগ্লাস খুলে চোখ মুছে স্মৃতি হাতরে দু’বছর পিছনের এক সকালে ডুব দিল।
সেদিন ছিল জুলাই মাসের এক তারিখ। আর মাত্র নয় দিন পর ঈদুল আজহা, গতকাল চম্পাকে বলে দিয়েছিল কাবাব আর স্টেকের জন্য স্পেশাল মশলা তৈরী করে রাখতে, মনির কাবাব আর স্টেক খেতে পছন্দ করে তাই ২৯ বছর ধরে ইরিন ঈদুল আজহার আগে এই মসলা তৈরী করে।
কিন্তু সেদিনের সকাল ছিল ভিন্ন
চম্পা দশমিনিট ধরে ইরিনকে ডেকেই যাচ্ছে কিন্তু ইরিনের কোন হেলদোল নেই।
চম্পা শেষ পর্যন্ত ইরিনের গায়ে ধাক্কা দিয়ে বলল – আম্মা মশলার সরঞ্জাম কোতায়
ইরিন ঘুম ভেঙ্গে চোখ পিটপিট করে বলল – কি ব্যাপার চম্পা তুমি এখানে কি করছো
– আম্মা মেলা বাজে, মশলার সরঞ্জাম কোতায়
ইরিন উঠে দাঁড়াল বিছানা ছেড়ে, চম্পাকে বলল- তুমি টেবিলে ব্রেকফাস্ট দাও আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি
ফ্রেশ হয়ে এসে ইরিন মনিরের স্টাডি রুমে এল মনিরকে ডাকতে,মনির নেই, বারান্দায় গেল সেখানেও নেই, পুরো বাড়ির কোথাও নেই মনির। ইরিন আবার স্টাডি রুমে এল, টেবিলের উপর তাকিয়ে দেখলো ল্যাপটপ নেই, দেয়ালে মনিরের কোন ছবি নেই, দ্রুত আলমারি খুলে দেখলো সেখানে না আছে মনিরের কোন ইম্পর্ট্যান্ট কাগজ না আছে কোন জামাকাপড়। বেডরুমে ফিরে এসে সোফায় বসে পরলো ইরিন।সেল ফোন হাতে নিয়ে ফোন দিল মনিরের নাম্বারে।
– দিস নাম্বার ইজ আনরিচেবল
পরপর তিনবার ফোন দিয়ে ইরিন বুঝতে পারলো মনির ইচ্ছে করে ফোন সুইচ অফ করে রেখেছে।
চম্পাকে ডেকে বলল- তুমি ঘরে ঢুকলে কিভাবে? মেইন ডোর কি খোলা ছিল
– খালুজানের লগে নিচে দেহা অইছিল কইল আপনে গুমান বেল জ্যান না দেই,দরজা খোলা আছে, ক্যান খালাম্মা কিছু অইসে?
– তুমি যাও
ড্রাইভার বাবুলের ডাকে বর্তমানে ফিরে এল ইরিন।
– ম্যাম ডাইনে না বামে যামু
– গাড়ী ঘোরাও, বাসায় যাব
বাবুল গাড়ী ঘুরিয়ে ধানমন্ডির দিকে চলল।ইরিন আবার অতীতে ডুব দিল।
দুদিন পর বন্ধু অন্জনের সাহায্যে ট্রেস করতে পেরেছিল মনিরকে।ছুটে গিয়েছিল উত্তরার তিন নাম্বার সেক্টরে,শুধু একটি প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য।না,মনির সেদিন দেখা করেনি ইরিনের সঙ্গে। প্রশ্ন আর উত্তরের মজার খেলায় সাতদিন পর ইরিন হাতে পেয়েছিল রেজিস্ট্রিকৃত এক পাতা কাগজ।
তারপর কেটে গিয়েছে বহু বিষন্ন বিকেল,চোখের জলে হারিয়েছে কতশত নির্ঘুম রাত।
বাসায় ফিরে এসে ইরিন হ্যান্ড ব্যাগটা বেডের উপর ছুড়ে ফেলল, দু’হাতে কপাল চেপে সোফায় বসে পরলো, অস্ফুট ভাবে বলল ” সবকিছু মানিয়ে নিজেকে যখন পাথর তৈরী করেছি তখন আবার কেন এলোমেলো করতে এসেছো মনির ”
সাতদিন পর
রুপু ইরিনের গলা জরিয়ে ধরে বলল- ফুপি শুননা
ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাতে উল্টাতে ইরিন বলল- বল শুনছি
– কাল স্কুলে লাল শাড়ী পরে যেতে হবে
– কেন
– নতুন বছর,তুমি জান না!
– নাতো! আমাকে কেউ বলেইনি
– তোমাকেও লাল শাড়ী পরে যেতে হবে
– আমি কেন তোমার মাকে বল
– আমি তোমার সঙ্গে যাব
– জেদ করেনা সোনা
– আমি জেদ করবো, একবার করবো বারবার করবো
ইরিন হেসে দিল, দুবছর আগে ইরিনের সবকিছু যখন গুড়িয়ে গিয়েছিল তখন এই রুপুর কাছে পেয়েছিল বেঁচে থাকার প্রাণ।
রুপু আবার বলল – তুমি যাবা বল
– আচ্ছা যাব
ধানমন্ডি ২৭নাম্বারে আজ লাল পরিদের ভীড়। কি সুন্দর করে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা লাল সাদায় সেজেছে। ইরিনও সিঁদূর লাল জামদানীতে নিজেকে মুড়িয়ে নিয়েছে।মাথায় গুঁজে দিয়েছে বেলি,লাল রঙের কাঁচের রিনিঝিনি শব্দে মুখরীত চারদিক।
রুপুকে ক্লাস টিচারের কাছে পৌঁছে দিয়ে ইরিন এসে বসলো হলরুমের মাঝের সারির কর্ণারের চেয়ারে। হন্তদন্ত হয়ে এসে মনিরও বসলো ইরিনের পাশে।
ইরিন মুখ ঘুরিয়ে মনিরকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে গেল। সাদা পাঞ্জাবিতে মনিরকে আজ ভাল লাগছে, ষাটের কাছকাছি মনিরের বয়স সেদিন যেমন হুট করে বেশি মনে হয়েছিল আজ যেন হুট করে কমে গিয়েছে। তীক্ষ্ণ চোখে মনিরের দিকে তাকালো ইরিন।মনির বলল- এমন করে তাকিয়োনা প্রিয় খুন হয়ে যাচ্ছি
চাপা স্বরে ইরিন বলল- ফাজলামো বাদ দাও, এখানে কেন এসেছো?
-তার আগে বল এ কদিন আসনি কেন
– বলতে বাধ্য নই
– রুপু কি প্রিতমের মেয়ে
– হুম
– বড় হয়ে গিয়েছে, কত বয়স হলো ওর
– সাত, সরে বোস আমি বের হবো
মনির ইরিনের কথা শুনে পা দুটো সামনের দিকে বারিয়ে দিল আর এক হাত দিয়ে সামনের চেয়ার বেরিকেটের মত করে আঁকড়ে ধরল।
ইরিন বলল- এসব কি হচ্ছে
– কথা আছে
– আমার কোন কথা নেই
– তোমার কথা নাই থাকতে পারে কিন্তু আমার আছে
ইরিন তাচ্ছিল্যের সুরে বলল- বল কি বলবে
মনির অপরাধী কন্ঠে বলল – আমার ভুল হয়ে গিয়েছে ইরি,তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছি না, চল আবার আমরা এক হয়ে যাই
– তুমি বোধহয় ভুলে গেছ তুমি আমাকে ডিভোর্স করেছো
– তো কি হয়েছে, আমরা আবার বিয়ে করবো
– যেদিন তুমি থার্ড নোটিশ পাঠিয়েছিলে সেদিন থেকে আমি তোমার জন্য নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছি
মনির করুণ চোখে তাকিয়ে রইল ইরিনের দিকে। কি সুন্দর লাগছে আজ ইরিনকে।লাল ঠোঁট জোড়া ভোরের সূর্যের মতো আভা ছড়াচ্ছে। কতশত সুন্দর মুহূর্ত তাদের জীবনে আছে। শুধুমাত্র ঐ কাগজের নোটিশের জন্য তারা আর কোনদিন এক হতে পারবে না।
চলবে